মমতা ও পশ্চিমবঙ্গের সাম্প্রতিক রাজনীতি

গৌতম রায়

পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল কংগ্রেসের সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক অবস্থানটি প্রকৃতপক্ষে কি? তিনি কি যথার্থই সাম্প্রদায়িক বিজেপিবিরোধী? বিজেপির হাতে রাহুগ্রস্ত ভারতকে মুক্ত করতে চান? যদি তাইই চান, তাহলে তো তার একক শক্তিতে কোন অবস্থাতেই তিনি নরেন্দ্র মোদিকে আগামী লোকসভার ভোটে (২০২৪) হারাতে পারবেন না। সেক্ষেত্রে তার কি রাজনৈতিক পদক্ষেপ হবে? অবিজেপি জোট তৈরির ক্ষেত্রে শেষ পর্যন্ত তিনি কতখানি আন্তরিক এবং যথার্থ ভূমিকা নেবেন ... এই প্রশ্নগুলোই এখন পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে বিশেষভাবে আবর্তিত হচ্ছে। বিশেষ করে ২৭ সেপ্টেম্বর বিজেপি সরকারের কৃষি নীতির বিরুদ্ধে প্রায় সব অবিজেপি দল গুলিই সম্মিলিতভাবে যে ভারত বনধ ডেকেছে, সেই বনধকে মমতা সমর্থন করছেন না। অথচ তিনি নিজেকে বিজেপির সংশোধিত কৃষি আইনের বিরোধী বলে দাবি করছেন। মমতার এই বহুমুখী রাজনৈতিক অবস্থান কেবল পশ্চিমবঙ্গেই নয়, গোটা ভারতে সাম্প্রদায়িক বিজেপির বিরুদ্ধে সংঙ্গবদ্ধ প্রতিবাদের প্রশ্নে একটা বড় রকমের সংশয়ের বাতাবরণ তৈরি করেছে।

বিজেপি বিরোধিতার প্রশ্নে গত বিধানসভার (’২১) ভোটোত্তর পরিস্থিতিতে মমতার প্রকৃত অবস্থান ঘিরে নানাভাবে সংশয়ের বাতাবরণ তৈরি হচ্ছে। প্রথম সন্দেহের বাতাবরণটি হলো, ধর্মনিরপেক্ষতার প্রশ্নে সত্যিই মমতার অবস্থান কি? তিনি কি এখনও বিজেপির উগ্র ধর্মান্ধ হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার পাল্টা হিসেবে কখনও নরম, কখনো বা প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান নিয়েই চলতে চান? মমতার বিদেশ সফরে কেন্দ্রীয় সরকার অনুমতি না দেয়ায় মমতা প্রকাশ্যে বলেছেন; তিনি আন্তর্জাতিক স্তরে অনেক ভালো হিন্দুত্বের প্রচার করতে সক্ষম।

সনাতন ধর্মাবলম্বীদের আধ্যাত্মিক অবস্থান আর হিন্দুত্ববাদ- দুটি সম্পূর্ণ পৃথক বস্তু। সনাতন ধর্মে যারা বিশ্বাস করেন, তারা কখনও অপর ধর্মকে ঘৃণা করেন না। অপর ধর্মকে ছোট করে ও দেখেন না। আধুনিক সময়ে সনাতন ধর্মের যে যুগোপযোগী ধারা নির্মাণ করেছেন শ্রীরামকৃষ্ণ তার, ‘যতমত ততপথ’ - এই মানবিক চেতনার ওপরে ভিত্তি করে, সেই চেতনার সঙ্গে সনাতন ধর্মকে যারা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে চান, সেই হিন্দুত্ববাদীদের মত-পথের এতটুকু সাদৃশ্য নেই।

তাহলে প্রশ্ন হলো; এই হিন্দুত্ববাদের প্রচারে নিজের সক্ষমতার কথা বলে মমতা ঠিক কি বোঝাতে চাইছেন? মমতা কি রাজনৈতিক ভাবে সনাতন ধর্মকে তুলে ধরবার লক্ষ্যে মোদি- অমিত শাহের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় যেতে চান? সেই লক্ষ্যেই কি মমতা নিজেকে মোদির থেকে অনেক দক্ষ হিন্দুত্বের প্রচারক হিসেবে মেলে ধরতে উদগ্রীব হয়ে উঠেছেন? বিজেপির সমালোচক হিসেবে গত এক দশক ধরে মমতা নিজেকে তুলে ধরার চেষ্টা করেন। যদিও নয়ের দশকে এই বিজেপির সঙ্গে ভোট মিতালীর দৌলতেই মমতা নিজের রাজনৈতিক অস্তিত্ব রক্ষা করতে পেরেছেন।

মমতা এই নিজের পায়ের তলায় জমি শক্ত করেছেন বিজেপির মূল মস্তিষ্ক আর এস এসের বদান্যতায়। বাজপেয়ী- আদভানির আধিপত্য থাকা বিজেপির সঙ্গে যখন কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় মমতা ছিলেন, তখন নানা স্বার্থের নিরিখে তার সঙ্গে বিজেপির কোন না কোন স্তরে সংঘাত লেগেই থাকত। তবে সেই সংঘাতে মতাদর্শের কোনো দ্বন্দ্ব ছিল না। স্বার্থজনিত সেসব। সংকটকালেও দেখা গিয়েছে আরএসএস কখনও মমতা সম্পর্কে একটি নেতিবাচক শব্দ উচ্চারণ করেনি। পাশাপাশি বাজপেয়ী ভালো আর আদভানি মন্দ ... এই তত্ত্বের উদগাতা মমতা নিজে ও কিন্তু ভুলক্রমে ও কখনো আরএসএস সম্পর্কে একটা নেতিবাচক শব্দ উচ্চারণ করেননি।

বামপন্থিদের ক্ষমতাচ্যুত করে মমতাকে পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতাসীন করবার ক্ষেত্রে কংগ্রেস, বিজেপি, আরএসএস, একাংশের সংকীর্ণতাবাদী রাজনীতিক, যারা নিজেদের বামপন্থি বলে দাবি করেন বা এসইউসির মতো নিজেদের বামপন্থি বলে দাবি করা রাজনৈতিক শক্তির সক্রিয় ভূমিকা রয়েছে। আরএসএস যেভাবে মমতাকে পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতাসীন হতে সাহায্য করেছে, ঠিক সেভাবেই ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতেও সবরকমের সহযোগিতা করে চলছে। বস্তুত পশ্চিমবঙ্গে নিজেদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি কে সরাসরি ক্ষমতায় সঙ্ঘ আনতে চায়- এমনটা তাদের কার্যকলাপ দেখে কখন ও মনেও হয় না। কারণ, মমতার বদান্যতায় পশ্চিমবঙ্গে মেরুকরণের রাজনীতির বিস্তারে আরএসএস দারণভাবে সফল। এই সাফল্য তাদের শুধু পশ্চিমবঙ্গ বা ভারতের নিরিখে সীমাবদ্ধ- এমনটাও ভেবে নেয়ার কোন কারণ নেই। আন্তর্জাতিক স্তরে সমস্ত মৌলবাদের ভেতরে যে শ্রেণীগত ঐক্য রয়েছে, তার নিরিখেই হিন্দু-মুসলমান- খ্রিস্টান ... সব মৌলবাদের ভেতরেই অভিন্ন স্বার্থে একটা জবরদস্ত সখ্যতা রয়েছে। আর সেই সখ্যতার কারণেই পশ্চিমবঙ্গে হিন্দু সাম্প্রদায়ের মানুষদের সাম্প্রদায়িক এবং ধর্মনিরপেক্ষ ... সমস্ত স্তরের ভেতরেই নানা কৌশলে মুসলমান বিদ্বেষের বিষ মমতা ক্ষমতাসীন হওয়ার কাল থেকেই আরএসএস বপন করতে শুরু করেছিল। সেই বিষের ফসল, বিষবৃক্ষ এখন অনেক জোরদারভাবেই নিজেদের ডালপালা বিস্তার করে ফেলেছে।

আর সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদ, মেরুকরণ, বিভাজন ... এই যে মনুষ্যতর রাজনীতি, এই রাজনীতি বিস্তারে মমতা সবরকমভাবে সাহায্য করছেন হিন্দুত্ববাদীদের। ফলে পশ্চিমবঙ্গে নিজেদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি সরাসরি ক্ষমতাসীন হলে ভারতের জাতীয় রাজনীতিতে হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তি যতটা লাভবান হতো, দক্ষিণ এশিয়ায় ধর্মান্ধ মৌলবাদের বনিয়াদ আরও দৃঢ় করবার কাজটি যতখানি সাফল্য অর্জন করতে পারত, তার থেকে অনেক বেশি এই দুটি ক্ষেত্রেই হিন্দু- মুসলমান নির্বিশেষে ধর্মান্ধ মৌলবাদের নিজেদের নখদন্তকে সুদৃঢ় করবার সুযোগটা বেড়েছে মমতা ক্ষমতায় টিকে যাওয়ার ফলে।

২০২১-এর বিধানসভার ভোটের সময়কালে ধর্মান্ধতার বিপদ এবং প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতার বিপদ ঘিরে সাধারণ মানুষ সবটা ঠিক মতো বুঝেছিলেন কি না- এটা ঘিরে ভোটের কয়েক মাসের ভেতরেই ঘোরতর সংশয়ের বাতাবরণ তৈরি হয়েছে। একটা বড় অংশের মানুষের ধারণা হয়েছিল; বিজেপিকে ঠেকাবার একমাত্র ক্ষমতা এবং যোগ্যতা আছে মমতার। এই ধারণা তৈরির ক্ষেত্রে গত ১০ বছরের বিভিন্ন সময়ে মমতার নানা জনবাদী পদক্ষেপ গুলি, যা সাধারণ মানুষের একটা বড় অংশকে সাময়িক কিছু রিলিফ দিয়েছিল, সেই সাময়িক স্বস্তির বিষয়টি অনেক বেশি সামনে চলে এসেছিল।

অপরপক্ষে একাংশের বামপন্থিরা অপরাংশের বামপন্থিদের কংগ্রেসের সঙ্গে সখ্যতার বিষয়টি আদৌ ভালোভাবে মেনে নিতে পারেননি। ফলে অতিবাম রাজনীতির সঙ্গে সংযুক্ত অংশের বামেরা অন্তর থেকে কতটা বিশ্বাস করেছেন যে, মমতাই পারবেন বিজেপিকে ঠেকাতে- এ নিয়ে আমার ঘোরতর সন্দেহ থাকলেও, তারা অপরাংশের বামেদের কংগ্রেস প্রীতির ঠ্যালা বোঝাতে কার্যত মমতাকেই বিজেপিবিরোধী আইকন করে তুলেছেন। মমতার বিজেপি বিরোধিতার কথা তুলে, ‘নো ভোট টু বিজেপি’ সেøাগানকে সামনে আনা হলেও মমতার আরএসএস ঘিরে নীরবতা ঘিরে এই অতিবামেরা কখনোই কিন্তু একটি শব্দ ও উচ্চারণ করেননি। আবার কোন কোন বিধানসভা কেন্দ্রে বামফ্রন্টভুক্ত প্রার্থীদের হয়ে এই অতিবামেরা দুই একটা প্রচার সভা করেছেন। কিন্তু নো ভোট টু বিজেপি বলবার আড়ালে ভোট টু তৃণমূল ও যেমন বলেননি, আবার ভোট টু সংযুক্ত মোর্চাও কখনওই বলেননি।

বামপন্থিদের ভেতরে একটি অংশ ক্ষমতায় ফিরে আসার জন্যে এতোটাই হ্যাংলার মতো আচরণ করতে শুরু করেছিলেন ভোটের অনেক আগে থেকেই যে, কংগ্রেসের সঙ্গে জোট ইত্যাদি ঘিরে বামফ্রন্টভুক্ত বামেদের নিজেদের ভেতরে প্রাথমিক আলাপ-আলোচনার অনেক আগেই এরা প্রকাশ্যে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট ঘিরে সরব হয়ে পড়েছিলেন।

আবার বামফ্রন্টভুক্ত বামেদের ভেতরেই একটা বড় অংশ ছিল, যারা গণ-আন্দোলনের তীব্রতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গেই বামফ্রন্টের বাইরের বামশক্তিগুলোর ভেতর সমন্বয় সাধনের পক্ষপাতী ছিলেন। তারা গভীরভাবে বিশ্বাস করতেন; কোনো শর্টকার্ট পদ্ধতিতে ক্ষমতায় ফিরে আসাটাই একমাত্র লক্ষ্য নয়। ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক শক্তি এবং তাদের সহযোগীদের মোকাবিলা করতে বামপরিসরকে আরও প্রসারিত করবার এই প্রয়াসটা দানা না বেঁধে, একটা বড় অংশের ক্ষমতালোভীদের প্ররোচনায় বাম-কংগ্রেসের ভেতরে ভোট কেন্দ্রিক সমঝোতা হওয়ার ফলে ফ্রন্টের বাইরের বামেদের ভেতরেও একটা যে জেদাজেদির মানসিকতা তৈরি হয়ে যায়নি- সে কথা হলফ করে বলতে পারা যায় না।

বিধানসভা ভোটের পরেই মমতা নিজেকে বিজেপিবিরোধী আইকন হিসেবে মেলে ধরতে প্রয়াসী হন। এই কাজে পশ্চিমবঙ্গের একটা অংশের প্রচারমাধ্যম মমতার পক্ষে অত্যন্ত সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। আমলাতন্ত্রের সঙ্গে গত ১০ বছর ধরে মমতা যে সম্পর্ক নির্মাণ করেছেন, তার জেরেই বলা যেতে পারে, প্রধানমন্ত্রী মোদির সঙ্গে ব্যক্তিস্তরে সংঘাতে জড়িয়ে পড়া প্রাক্তন আমলাকে মমতা রাজ্যসভায় পাঠান। বিজেপিবিরোধী এই আচরণের পাশেই আমাদের মনে রাখা দরকার, ভারতের সংসদের দুই কক্ষেই কিন্তু মমতার দল তৃণমূল কংগ্রেস, শাসক বিজেপি বেকায়দায় পড়ে- এমন একটি অবস্থান আজ পর্যন্ত নেয়নি। পক্ষান্তরে নারদা মামলা থেকে শুরু করে বহুবিধ দুর্নীতির অভিযোগে মমতা বা তার ঘনিষ্ঠবৃত্তের ভেতরে থাকা মানুষজন সামান্য বিপদে পড়েন- এমন কোন অবস্থান কিন্তু দিল্লির বিজেপি সরকার একটিবারের জন্যও নেয় নি।

পশ্চিমবঙ্গে গত একবছরের ও বেশি সময় ধরে কোনো নির্বাচিত পৌরসভা নেই। কোভিড পরিস্থিতির দোহাই দিয়ে ভোট এড়িয়ে পশ্চিমবঙ্গের প্রতিটি পৌরসভাকে মমতা নিজের দলের হস্তগত করিয়েছেন। পৌর আইন মোতাবেক নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ছাড়া কোটি কোটি টাকা কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে পৌরসভাগুলোতে আসছে। বিশ্বব্যাংক থেকে শুরু করে বিভিন্ন বিদেশি অনুদানকারী সংস্থা যে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ছাড়া, সম্পূর্ণ রাজ্যের শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেসের লোকজনের দ্বারা পরিচালিত পৌরসংস্থাগুলোতে টাকা দিচ্ছে- এ নিয়ে কিন্তু আজপর্যন্ত কেন্দ্রীয় সরকার টুঁ শব্দটি উচ্চারণ করেনি। বিধানসভার ভোট হলো করোনা পরিস্থিতির ভেতরেই। অথচ মমতার প্রশাসন পৌরসভার ভোট করালেন না। শুধু মুখ্যমন্ত্রীর আসন যাতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্থায়ী হয়, সেই জন্য ভবাণীপুর কেন্দ্র উপনার্বাচন হলো। আদালত রাজ্যের মুখ্যসচিবকে তুলোধুনা করলেন। তবু ও পৌরভোটের নামগন্ধ নেই।

মমতার বিজেপি বিরোধিতার শৌখিন মজদুরি এবং আর এস এসের মমতার প্রতি নিজেদের স্বার্থেই সহানুভূতি যদি না থাকত, তাহলে কি বছরের পর বছর ভোট না করে মমতা গোটা পশ্চিমবঙ্গের সব কটি পৌরসভাকে নিজের দলের কব্জার ভেতরে নিয়ে আসতে পারতেন? কংগ্রেস নেতা তথা সাংসদ অধীররঞ্জন চৌধুরী প্রকাশ্যে বলেছেন; আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবতের অঙ্গুলি হেলনেই দুর্নীতির অভিযোগে মমতার ঘনিষ্ঠবৃত্তের কেশাগ্র স্পর্শ করছে না কেন্দ্রের বিজেপি সরকার। তার পরেও কিন্তু কি মমতা, কি তার দল তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষ থেকে কেউ অধীরের এই কথার বিরোধিতা করে আরএসএসের সম্বন্ধে একটাও কড়া কথা বলেছেন।

আরএসএসের সঙ্গে মমতার একটা গোপন বোঝাপড়া ঘিরে গত বিধানসভা ভোটের আগে সোচ্চার হয়েছিলেন সিপিআই (এম)-এর অন্যতম শীর্ষনেতা ডা. সূর্যকান্ত মিশ্র। ভোটের পর সোচ্চার হলেন কংগ্রেসের অন্যতম শীর্ষনেতা অধীররঞ্জন চৌধুরী। অতিবাম নেতা এখন ও পর্যন্ত মমতার সঙ্গে আরএসএসের সম্পর্ক ঘিরে প্রকাশ্যে কোনো কথা বলেননি। কিন্তু মমতা নিজে যেভাবে আরএসএসের হিন্দুত্ববাদী চিন্তার প্রায় সহাবস্থানজনিত মন্তব্য প্রকাশ্যে করে চলেছেন, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও তিস্তার পানি ঘিরে নিজের অবস্থানের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশের ইসলামীয় মৌলবাদীদেরই উৎসাহিত করে চলেছেন- তার প্রেক্ষিতে দীপঙ্কর ভট্টাচার্যের মতো মানুষেরাও আর কতদিন মমতাকে বিজেপিবিরোধী লড়াইয়ের আইকন হিসেবে সাব্যস্ত করে যাবেন- তা নিয়ে রীতিমতো সংশয় জাগছে।

ভারতের জাতীয় স্তরে বিজেপি বিরোধী ঐক্যের প্রশ্নে মমতা অতি সম্প্রতি যে অবস্থান নিচ্ছে- তা প্রকারান্তে বিজেপিকেই সাহায্য করছে। যে কংগ্রেস থেকে রাজনৈতিক জীবনের সূচনা হয়েছিল মমতার, সেই দলটি সম্পর্কে মমতা ধারাবাহিকভাবে অরাজনৈতিক ব্যক্তি আক্রমণ করে চলেছেন। কংগ্রেস দলের যাই ত্রুটি বিচ্যুতি থাকুক না কেন, বামপন্থিদের সঙ্গে কংগ্রেসের একটা মৌলিক নীতিগত প্রভেদ আছে, কিন্তু মমতার? যে দলটির দৌলতে প্রথম সংসদ সদস্য হয়েই জাতীয় স্তরের রাজনীতিতে কিছুটা পরিচিতি পেয়েছিলেন মমতা, সেই দলটিকে বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের নাম করে ‘পচা ডোবা’ ইত্যাদি মমতার বলার ভেতর দিয়ে বিজেপিবিরোধী কোন লড়াইটা শক্তি অর্জন করবে?

[লেখক : ভারতীয় ইতিহাসবিদ]

শনিবার, ০২ অক্টোবর ২০২১ , ১৭ আশ্বিন ১৪২৮ ২৩ সফর ১৪৪৩

মমতা ও পশ্চিমবঙ্গের সাম্প্রতিক রাজনীতি

গৌতম রায়

পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল কংগ্রেসের সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক অবস্থানটি প্রকৃতপক্ষে কি? তিনি কি যথার্থই সাম্প্রদায়িক বিজেপিবিরোধী? বিজেপির হাতে রাহুগ্রস্ত ভারতকে মুক্ত করতে চান? যদি তাইই চান, তাহলে তো তার একক শক্তিতে কোন অবস্থাতেই তিনি নরেন্দ্র মোদিকে আগামী লোকসভার ভোটে (২০২৪) হারাতে পারবেন না। সেক্ষেত্রে তার কি রাজনৈতিক পদক্ষেপ হবে? অবিজেপি জোট তৈরির ক্ষেত্রে শেষ পর্যন্ত তিনি কতখানি আন্তরিক এবং যথার্থ ভূমিকা নেবেন ... এই প্রশ্নগুলোই এখন পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে বিশেষভাবে আবর্তিত হচ্ছে। বিশেষ করে ২৭ সেপ্টেম্বর বিজেপি সরকারের কৃষি নীতির বিরুদ্ধে প্রায় সব অবিজেপি দল গুলিই সম্মিলিতভাবে যে ভারত বনধ ডেকেছে, সেই বনধকে মমতা সমর্থন করছেন না। অথচ তিনি নিজেকে বিজেপির সংশোধিত কৃষি আইনের বিরোধী বলে দাবি করছেন। মমতার এই বহুমুখী রাজনৈতিক অবস্থান কেবল পশ্চিমবঙ্গেই নয়, গোটা ভারতে সাম্প্রদায়িক বিজেপির বিরুদ্ধে সংঙ্গবদ্ধ প্রতিবাদের প্রশ্নে একটা বড় রকমের সংশয়ের বাতাবরণ তৈরি করেছে।

বিজেপি বিরোধিতার প্রশ্নে গত বিধানসভার (’২১) ভোটোত্তর পরিস্থিতিতে মমতার প্রকৃত অবস্থান ঘিরে নানাভাবে সংশয়ের বাতাবরণ তৈরি হচ্ছে। প্রথম সন্দেহের বাতাবরণটি হলো, ধর্মনিরপেক্ষতার প্রশ্নে সত্যিই মমতার অবস্থান কি? তিনি কি এখনও বিজেপির উগ্র ধর্মান্ধ হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার পাল্টা হিসেবে কখনও নরম, কখনো বা প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান নিয়েই চলতে চান? মমতার বিদেশ সফরে কেন্দ্রীয় সরকার অনুমতি না দেয়ায় মমতা প্রকাশ্যে বলেছেন; তিনি আন্তর্জাতিক স্তরে অনেক ভালো হিন্দুত্বের প্রচার করতে সক্ষম।

সনাতন ধর্মাবলম্বীদের আধ্যাত্মিক অবস্থান আর হিন্দুত্ববাদ- দুটি সম্পূর্ণ পৃথক বস্তু। সনাতন ধর্মে যারা বিশ্বাস করেন, তারা কখনও অপর ধর্মকে ঘৃণা করেন না। অপর ধর্মকে ছোট করে ও দেখেন না। আধুনিক সময়ে সনাতন ধর্মের যে যুগোপযোগী ধারা নির্মাণ করেছেন শ্রীরামকৃষ্ণ তার, ‘যতমত ততপথ’ - এই মানবিক চেতনার ওপরে ভিত্তি করে, সেই চেতনার সঙ্গে সনাতন ধর্মকে যারা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে চান, সেই হিন্দুত্ববাদীদের মত-পথের এতটুকু সাদৃশ্য নেই।

তাহলে প্রশ্ন হলো; এই হিন্দুত্ববাদের প্রচারে নিজের সক্ষমতার কথা বলে মমতা ঠিক কি বোঝাতে চাইছেন? মমতা কি রাজনৈতিক ভাবে সনাতন ধর্মকে তুলে ধরবার লক্ষ্যে মোদি- অমিত শাহের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় যেতে চান? সেই লক্ষ্যেই কি মমতা নিজেকে মোদির থেকে অনেক দক্ষ হিন্দুত্বের প্রচারক হিসেবে মেলে ধরতে উদগ্রীব হয়ে উঠেছেন? বিজেপির সমালোচক হিসেবে গত এক দশক ধরে মমতা নিজেকে তুলে ধরার চেষ্টা করেন। যদিও নয়ের দশকে এই বিজেপির সঙ্গে ভোট মিতালীর দৌলতেই মমতা নিজের রাজনৈতিক অস্তিত্ব রক্ষা করতে পেরেছেন।

মমতা এই নিজের পায়ের তলায় জমি শক্ত করেছেন বিজেপির মূল মস্তিষ্ক আর এস এসের বদান্যতায়। বাজপেয়ী- আদভানির আধিপত্য থাকা বিজেপির সঙ্গে যখন কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় মমতা ছিলেন, তখন নানা স্বার্থের নিরিখে তার সঙ্গে বিজেপির কোন না কোন স্তরে সংঘাত লেগেই থাকত। তবে সেই সংঘাতে মতাদর্শের কোনো দ্বন্দ্ব ছিল না। স্বার্থজনিত সেসব। সংকটকালেও দেখা গিয়েছে আরএসএস কখনও মমতা সম্পর্কে একটি নেতিবাচক শব্দ উচ্চারণ করেনি। পাশাপাশি বাজপেয়ী ভালো আর আদভানি মন্দ ... এই তত্ত্বের উদগাতা মমতা নিজে ও কিন্তু ভুলক্রমে ও কখনো আরএসএস সম্পর্কে একটা নেতিবাচক শব্দ উচ্চারণ করেননি।

বামপন্থিদের ক্ষমতাচ্যুত করে মমতাকে পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতাসীন করবার ক্ষেত্রে কংগ্রেস, বিজেপি, আরএসএস, একাংশের সংকীর্ণতাবাদী রাজনীতিক, যারা নিজেদের বামপন্থি বলে দাবি করেন বা এসইউসির মতো নিজেদের বামপন্থি বলে দাবি করা রাজনৈতিক শক্তির সক্রিয় ভূমিকা রয়েছে। আরএসএস যেভাবে মমতাকে পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতাসীন হতে সাহায্য করেছে, ঠিক সেভাবেই ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতেও সবরকমের সহযোগিতা করে চলছে। বস্তুত পশ্চিমবঙ্গে নিজেদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি কে সরাসরি ক্ষমতায় সঙ্ঘ আনতে চায়- এমনটা তাদের কার্যকলাপ দেখে কখন ও মনেও হয় না। কারণ, মমতার বদান্যতায় পশ্চিমবঙ্গে মেরুকরণের রাজনীতির বিস্তারে আরএসএস দারণভাবে সফল। এই সাফল্য তাদের শুধু পশ্চিমবঙ্গ বা ভারতের নিরিখে সীমাবদ্ধ- এমনটাও ভেবে নেয়ার কোন কারণ নেই। আন্তর্জাতিক স্তরে সমস্ত মৌলবাদের ভেতরে যে শ্রেণীগত ঐক্য রয়েছে, তার নিরিখেই হিন্দু-মুসলমান- খ্রিস্টান ... সব মৌলবাদের ভেতরেই অভিন্ন স্বার্থে একটা জবরদস্ত সখ্যতা রয়েছে। আর সেই সখ্যতার কারণেই পশ্চিমবঙ্গে হিন্দু সাম্প্রদায়ের মানুষদের সাম্প্রদায়িক এবং ধর্মনিরপেক্ষ ... সমস্ত স্তরের ভেতরেই নানা কৌশলে মুসলমান বিদ্বেষের বিষ মমতা ক্ষমতাসীন হওয়ার কাল থেকেই আরএসএস বপন করতে শুরু করেছিল। সেই বিষের ফসল, বিষবৃক্ষ এখন অনেক জোরদারভাবেই নিজেদের ডালপালা বিস্তার করে ফেলেছে।

আর সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদ, মেরুকরণ, বিভাজন ... এই যে মনুষ্যতর রাজনীতি, এই রাজনীতি বিস্তারে মমতা সবরকমভাবে সাহায্য করছেন হিন্দুত্ববাদীদের। ফলে পশ্চিমবঙ্গে নিজেদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি সরাসরি ক্ষমতাসীন হলে ভারতের জাতীয় রাজনীতিতে হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তি যতটা লাভবান হতো, দক্ষিণ এশিয়ায় ধর্মান্ধ মৌলবাদের বনিয়াদ আরও দৃঢ় করবার কাজটি যতখানি সাফল্য অর্জন করতে পারত, তার থেকে অনেক বেশি এই দুটি ক্ষেত্রেই হিন্দু- মুসলমান নির্বিশেষে ধর্মান্ধ মৌলবাদের নিজেদের নখদন্তকে সুদৃঢ় করবার সুযোগটা বেড়েছে মমতা ক্ষমতায় টিকে যাওয়ার ফলে।

২০২১-এর বিধানসভার ভোটের সময়কালে ধর্মান্ধতার বিপদ এবং প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতার বিপদ ঘিরে সাধারণ মানুষ সবটা ঠিক মতো বুঝেছিলেন কি না- এটা ঘিরে ভোটের কয়েক মাসের ভেতরেই ঘোরতর সংশয়ের বাতাবরণ তৈরি হয়েছে। একটা বড় অংশের মানুষের ধারণা হয়েছিল; বিজেপিকে ঠেকাবার একমাত্র ক্ষমতা এবং যোগ্যতা আছে মমতার। এই ধারণা তৈরির ক্ষেত্রে গত ১০ বছরের বিভিন্ন সময়ে মমতার নানা জনবাদী পদক্ষেপ গুলি, যা সাধারণ মানুষের একটা বড় অংশকে সাময়িক কিছু রিলিফ দিয়েছিল, সেই সাময়িক স্বস্তির বিষয়টি অনেক বেশি সামনে চলে এসেছিল।

অপরপক্ষে একাংশের বামপন্থিরা অপরাংশের বামপন্থিদের কংগ্রেসের সঙ্গে সখ্যতার বিষয়টি আদৌ ভালোভাবে মেনে নিতে পারেননি। ফলে অতিবাম রাজনীতির সঙ্গে সংযুক্ত অংশের বামেরা অন্তর থেকে কতটা বিশ্বাস করেছেন যে, মমতাই পারবেন বিজেপিকে ঠেকাতে- এ নিয়ে আমার ঘোরতর সন্দেহ থাকলেও, তারা অপরাংশের বামেদের কংগ্রেস প্রীতির ঠ্যালা বোঝাতে কার্যত মমতাকেই বিজেপিবিরোধী আইকন করে তুলেছেন। মমতার বিজেপি বিরোধিতার কথা তুলে, ‘নো ভোট টু বিজেপি’ সেøাগানকে সামনে আনা হলেও মমতার আরএসএস ঘিরে নীরবতা ঘিরে এই অতিবামেরা কখনোই কিন্তু একটি শব্দ ও উচ্চারণ করেননি। আবার কোন কোন বিধানসভা কেন্দ্রে বামফ্রন্টভুক্ত প্রার্থীদের হয়ে এই অতিবামেরা দুই একটা প্রচার সভা করেছেন। কিন্তু নো ভোট টু বিজেপি বলবার আড়ালে ভোট টু তৃণমূল ও যেমন বলেননি, আবার ভোট টু সংযুক্ত মোর্চাও কখনওই বলেননি।

বামপন্থিদের ভেতরে একটি অংশ ক্ষমতায় ফিরে আসার জন্যে এতোটাই হ্যাংলার মতো আচরণ করতে শুরু করেছিলেন ভোটের অনেক আগে থেকেই যে, কংগ্রেসের সঙ্গে জোট ইত্যাদি ঘিরে বামফ্রন্টভুক্ত বামেদের নিজেদের ভেতরে প্রাথমিক আলাপ-আলোচনার অনেক আগেই এরা প্রকাশ্যে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট ঘিরে সরব হয়ে পড়েছিলেন।

আবার বামফ্রন্টভুক্ত বামেদের ভেতরেই একটা বড় অংশ ছিল, যারা গণ-আন্দোলনের তীব্রতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গেই বামফ্রন্টের বাইরের বামশক্তিগুলোর ভেতর সমন্বয় সাধনের পক্ষপাতী ছিলেন। তারা গভীরভাবে বিশ্বাস করতেন; কোনো শর্টকার্ট পদ্ধতিতে ক্ষমতায় ফিরে আসাটাই একমাত্র লক্ষ্য নয়। ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক শক্তি এবং তাদের সহযোগীদের মোকাবিলা করতে বামপরিসরকে আরও প্রসারিত করবার এই প্রয়াসটা দানা না বেঁধে, একটা বড় অংশের ক্ষমতালোভীদের প্ররোচনায় বাম-কংগ্রেসের ভেতরে ভোট কেন্দ্রিক সমঝোতা হওয়ার ফলে ফ্রন্টের বাইরের বামেদের ভেতরেও একটা যে জেদাজেদির মানসিকতা তৈরি হয়ে যায়নি- সে কথা হলফ করে বলতে পারা যায় না।

বিধানসভা ভোটের পরেই মমতা নিজেকে বিজেপিবিরোধী আইকন হিসেবে মেলে ধরতে প্রয়াসী হন। এই কাজে পশ্চিমবঙ্গের একটা অংশের প্রচারমাধ্যম মমতার পক্ষে অত্যন্ত সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। আমলাতন্ত্রের সঙ্গে গত ১০ বছর ধরে মমতা যে সম্পর্ক নির্মাণ করেছেন, তার জেরেই বলা যেতে পারে, প্রধানমন্ত্রী মোদির সঙ্গে ব্যক্তিস্তরে সংঘাতে জড়িয়ে পড়া প্রাক্তন আমলাকে মমতা রাজ্যসভায় পাঠান। বিজেপিবিরোধী এই আচরণের পাশেই আমাদের মনে রাখা দরকার, ভারতের সংসদের দুই কক্ষেই কিন্তু মমতার দল তৃণমূল কংগ্রেস, শাসক বিজেপি বেকায়দায় পড়ে- এমন একটি অবস্থান আজ পর্যন্ত নেয়নি। পক্ষান্তরে নারদা মামলা থেকে শুরু করে বহুবিধ দুর্নীতির অভিযোগে মমতা বা তার ঘনিষ্ঠবৃত্তের ভেতরে থাকা মানুষজন সামান্য বিপদে পড়েন- এমন কোন অবস্থান কিন্তু দিল্লির বিজেপি সরকার একটিবারের জন্যও নেয় নি।

পশ্চিমবঙ্গে গত একবছরের ও বেশি সময় ধরে কোনো নির্বাচিত পৌরসভা নেই। কোভিড পরিস্থিতির দোহাই দিয়ে ভোট এড়িয়ে পশ্চিমবঙ্গের প্রতিটি পৌরসভাকে মমতা নিজের দলের হস্তগত করিয়েছেন। পৌর আইন মোতাবেক নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ছাড়া কোটি কোটি টাকা কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে পৌরসভাগুলোতে আসছে। বিশ্বব্যাংক থেকে শুরু করে বিভিন্ন বিদেশি অনুদানকারী সংস্থা যে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ছাড়া, সম্পূর্ণ রাজ্যের শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেসের লোকজনের দ্বারা পরিচালিত পৌরসংস্থাগুলোতে টাকা দিচ্ছে- এ নিয়ে কিন্তু আজপর্যন্ত কেন্দ্রীয় সরকার টুঁ শব্দটি উচ্চারণ করেনি। বিধানসভার ভোট হলো করোনা পরিস্থিতির ভেতরেই। অথচ মমতার প্রশাসন পৌরসভার ভোট করালেন না। শুধু মুখ্যমন্ত্রীর আসন যাতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্থায়ী হয়, সেই জন্য ভবাণীপুর কেন্দ্র উপনার্বাচন হলো। আদালত রাজ্যের মুখ্যসচিবকে তুলোধুনা করলেন। তবু ও পৌরভোটের নামগন্ধ নেই।

মমতার বিজেপি বিরোধিতার শৌখিন মজদুরি এবং আর এস এসের মমতার প্রতি নিজেদের স্বার্থেই সহানুভূতি যদি না থাকত, তাহলে কি বছরের পর বছর ভোট না করে মমতা গোটা পশ্চিমবঙ্গের সব কটি পৌরসভাকে নিজের দলের কব্জার ভেতরে নিয়ে আসতে পারতেন? কংগ্রেস নেতা তথা সাংসদ অধীররঞ্জন চৌধুরী প্রকাশ্যে বলেছেন; আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবতের অঙ্গুলি হেলনেই দুর্নীতির অভিযোগে মমতার ঘনিষ্ঠবৃত্তের কেশাগ্র স্পর্শ করছে না কেন্দ্রের বিজেপি সরকার। তার পরেও কিন্তু কি মমতা, কি তার দল তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষ থেকে কেউ অধীরের এই কথার বিরোধিতা করে আরএসএসের সম্বন্ধে একটাও কড়া কথা বলেছেন।

আরএসএসের সঙ্গে মমতার একটা গোপন বোঝাপড়া ঘিরে গত বিধানসভা ভোটের আগে সোচ্চার হয়েছিলেন সিপিআই (এম)-এর অন্যতম শীর্ষনেতা ডা. সূর্যকান্ত মিশ্র। ভোটের পর সোচ্চার হলেন কংগ্রেসের অন্যতম শীর্ষনেতা অধীররঞ্জন চৌধুরী। অতিবাম নেতা এখন ও পর্যন্ত মমতার সঙ্গে আরএসএসের সম্পর্ক ঘিরে প্রকাশ্যে কোনো কথা বলেননি। কিন্তু মমতা নিজে যেভাবে আরএসএসের হিন্দুত্ববাদী চিন্তার প্রায় সহাবস্থানজনিত মন্তব্য প্রকাশ্যে করে চলেছেন, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও তিস্তার পানি ঘিরে নিজের অবস্থানের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশের ইসলামীয় মৌলবাদীদেরই উৎসাহিত করে চলেছেন- তার প্রেক্ষিতে দীপঙ্কর ভট্টাচার্যের মতো মানুষেরাও আর কতদিন মমতাকে বিজেপিবিরোধী লড়াইয়ের আইকন হিসেবে সাব্যস্ত করে যাবেন- তা নিয়ে রীতিমতো সংশয় জাগছে।

ভারতের জাতীয় স্তরে বিজেপি বিরোধী ঐক্যের প্রশ্নে মমতা অতি সম্প্রতি যে অবস্থান নিচ্ছে- তা প্রকারান্তে বিজেপিকেই সাহায্য করছে। যে কংগ্রেস থেকে রাজনৈতিক জীবনের সূচনা হয়েছিল মমতার, সেই দলটি সম্পর্কে মমতা ধারাবাহিকভাবে অরাজনৈতিক ব্যক্তি আক্রমণ করে চলেছেন। কংগ্রেস দলের যাই ত্রুটি বিচ্যুতি থাকুক না কেন, বামপন্থিদের সঙ্গে কংগ্রেসের একটা মৌলিক নীতিগত প্রভেদ আছে, কিন্তু মমতার? যে দলটির দৌলতে প্রথম সংসদ সদস্য হয়েই জাতীয় স্তরের রাজনীতিতে কিছুটা পরিচিতি পেয়েছিলেন মমতা, সেই দলটিকে বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের নাম করে ‘পচা ডোবা’ ইত্যাদি মমতার বলার ভেতর দিয়ে বিজেপিবিরোধী কোন লড়াইটা শক্তি অর্জন করবে?

[লেখক : ভারতীয় ইতিহাসবিদ]