১০ প্রতিষ্ঠানের মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণ বাজেটের এক-চতুর্থাংশ

­সরকারের কাছে ঋণ নিয়ে সেই ঋণের কিস্তি পরিশোধ না করে বছরের পর বছর জিইয়ে রাখছে অধিকাংশ রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান। এতে আর্থিক ব্যবস্থাপনায় সমস্যা হচ্ছে। ১০টি প্রতিষ্ঠানের মেয়াদোত্তীর্ণ এই ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৪৮ হাজার ৪৫৬ কোটি টাকা। এই দেনা চলতি অর্থবছরের বাজেটের এক চতুর্থাংশ।

সঠিক সময়ে ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে তাগিদ দিয়ে এসব প্রতিষ্ঠানকে নিয়মিত চিঠি দেয় অর্থ মন্ত্রণালয়। তবে তাতে তেমন সাড়া পাওয়া যায় না। বছরের ব্যবধানে সুদসহ এই ঋণের পরিমাণ শুধু বাড়ে।

এরপরও এগুলো অবশ্যিক প্রতিষ্ঠান হওয়ায় হাজার কোটি টাকার ঋণ অনাদায়ী থাকলেও নতুন প্রকল্পের জন্য আবারও দেয়া হচ্ছে ঋণ। আর তারা ফের খেলাপি হচ্ছে। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

রাষ্ট্রের কাছে ঋণ নিয়ে পরিশোধ না করা ১০টি প্রতিষ্ঠান হলো, বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি), বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজসম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা), ঢাকা ওয়াসা, বাংলাদেশ সাবমেরিন কেবল কোম্পানি (বিএসসিসিএল), বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি), বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন (বিসিআইসি), বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশন (বিজেএমসি), ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি), পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি) ও বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি)।

এদের মধ্যে পিজিসিবির দাবি, তারা ‘সময়মতো ঋণের কিস্তি পরিশোধ করে, তারা খেলাপি নয়।’ তারা ‘লাভও করে।’ তবে অর্থ মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান বলছে পিজিসিবির কাছে রাষ্ট্রের পাওনা ৪ হাজার ৩৬২ কোটি টাকা।

সরকারের কাছে সবচেয়ে বেশি দেনা রয়েছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড বা বিপিডিবির। ২০২০ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটির দেনা প্রায় ৬৫ হাজার ৭৮৩ কোটি টাকা। এর পরেই রয়েছে পেট্রোবাংলা। সরকারের কাছে প্রতিষ্ঠানটির দেনা ১৮ হাজার ২২৯ কোটি টাকা। ঢাকা ওয়াসার দেনা ১২ হাজার ৫৮৯ কোটি টাকা। বিএসসিসিএলের ঋণ ১৪ হাজার ৮৪৬ কোটি টাকা।

একইভাবে বিপিসির কাছে সরকার পাবে ১২ হাজার ৪২ কোটি টাকা, বিসিআইসির কাছে ১১ হাজার ৫১১ কোটি টাকা, বিজেএমসির কাছে ৩ হাজার ৭৭৬ কোটি, ডিপিডিসির কাছে ২ হাজার ৩১০ কোটি, আরইবির কাছে ৩ হাজার ৮ কোটি টাকা।

প্রতিষ্ঠানগুলো ঋণের কিস্তি সময়মতো পরিশোধ করছে না। প্রতিবছরই বাড়ছে ঋণের বোঝা। আগের বছর অর্থাৎ ২০১৯ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর দেনা যা ছিল, পরের বছর না কমে বরং বেড়েছে। অর্থনীতিবিদদের আশঙ্কা, এই দেনা প্রতিবছরই বাড়বে এবং প্রতিষ্ঠানগুলো তা পরিশোধ করবে না। এক বছরের ব্যবধানে বিপিডিবির দেনা বেড়েছে ৭ হাজার ৪০৯ কোটি টাকা, পেট্রোবাংলার বেড়েছে ৬ হাজার ৬৯৮ কোটি টাকা, ঢাকা ওয়াসার ৯ হাজার ৭৩৩ কোটি টাকা, বিএসসিসিএলের ৩ হাজার ৯৫২ কোটি টাকা, বিপিসির ২ হাজার ১২৭ কোটি টাকা, বিসিআইসির ২ হাজার ৫৯৭ কোটি টাকা, বিজেএমসির ৭৯৯ কোটি টাকা, পিজিসিবির ২ হাজার ৭১৩ কোটি টাকা ও আরইবির ৪১৩ কোটি টাকা।

তবে ডিপিডিসির দেনা আগের বছরের চেয়ে কমেছে। অর্থাৎ কোম্পানিটি কিছু ঋণ পরিশোধ করেছে। আগের বছরের চেয়ে কোম্পানিটির ঋণ কমেছে ১ হাজার ১০৯ কোটি টাকা। এসব রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলো অধিকাংশই পানি, বিদ্যুৎ এবং গ্যাসের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। প্রতিষ্ঠানগুলো দাবি করে, জনগণকে যে দামে পণ্য সরবরাহ করে উৎপাদন খরচ পড়ে তার চেয়ে অনেক বেশি। তাই এসব প্রতিষ্ঠান লোকসান করে। কিন্তু এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ অহরহ। তাই অর্থনীতিবিদদের প্রশ্ন, এসব প্রতিষ্ঠান কি জনগণকে ভর্তুকি দেয়ার কারণে লোকসানে রয়েছে, নাকি দুর্নীতির কারণে লোকসান করছে?

এ প্রসঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এবি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম সংবাদকে বলেন, ‘যেসব প্রতিষ্ঠান খুবই আবশ্যিক নয়, সেগুলো বন্ধ করে দেয়া উচিৎ। আর যেগুলো রাখা জরুরি, সেগুলোর ম্যানেজমেন্ট পরিবর্তন করা দরকার। আর যে ম্যানেজমেন্ট আসবে, তাদের কর্মকা- সঠিকভাবে তদারকি করতে হবে।’

একই মন্তব্য গবেষণা সংস্থা সিপিডির (সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ) সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমানের। তিনি বলেন, ‘প্রথমত, সরকারি এসব প্রতিষ্ঠানে লোকবলের র‌্যাসনালাইজেশন (যৌক্তিককরণ) নেই, অনেক বাড়তি খরচ আছে, ইনইফিসিয়েন্সি (অদক্ষতা) আছে। এগুলো বছরের পর বছর সংস্কার হয় না। দ্বিতীয়ত, অস্বীকার করার উপায় নেই, একটা পণ্যের উৎপাদন খরচ যত হয়, তারচেয়ে কম দামে জনগণের কাছে বিক্রি করতে হয়। অর্থাৎ সরকারকে ভর্তুকি দিয়ে প্রতিষ্ঠানগুলো চালাতে হয়। একইসঙ্গে এটাও সত্যি, যে পরিমাণ ভর্তুকি দেয়া প্রয়োজন, তার চেয়ে অনেক বেশি দিতে হয় শুধু এসব প্রতিষ্ঠানের অব্যবস্থাপনা, অদক্ষতা ও দুর্নীতির কারণে। তৃতীয়ত, সরকারি মালিকানায় রেখেও এসব প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনাকে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেয়ার সিস্টেম সারা বিশ্বে চালু আছে। এই সিস্টেমে মালিকানা সরকারের থাকে, কিন্তু সেগুলো কোন সরকারি কর্মচারী পরিচালনা করে না। চতুর্থত, কিছু প্রতিষ্ঠান আছে যেগুলো সরকারের হাতে রাখার প্রয়োজন নেই। সরকার বাজারের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে চাইলে আমদানি করে বা টিসিবির মাধ্যমে মূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। এতে উৎপাদনে যাওয়ার প্রয়োজন নেই সরকারের।’

মোস্তাফিজুর রহমান আরও বলেন, ‘এমনও কিছু প্রতিষ্ঠান আছে, প্রতি বছর প্রকল্প হাতে নেয় এবং লস করে। তারপরের বছর আবার বলে, ৫০০ কোটি টাকা দেয়া হোক, তাহলে ভালো মতো প্রকল্পটি চালাতে পারব। তাকে সেটা দেয়া হয়। এরপরের বছর আবার সেই প্রকল্পে ১০০০ কোটি টাকা চায়। এভাবে জনগণের করের টাকার অপব্যয় হয়।’

২০১৮ সালের শেষ দিকে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) একটি জরিপ প্রকাশ করে। সেই জরিপে বাংলাদেশের সার্বিক দুর্নীতির চিত্র উঠে আসে।

জরিপে বলা হয়, ২০১৭ সালে সেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ৬৬ দশমিক ৫ শতাংশ খানা দুর্নীতির শিকার হয়েছে। ওই বছর ঘুষের পরিমাণ ছিল ৫ হাজার ৯৩০ কোটি টাকা। খাত হিসেবে তেল, গ্যাস ও পানি ইত্যাদি খাতগুলো ঘুষ লেনদেন হওয়া তালিকার উপর দিকেই রয়েছে।

দেশে পেট্রোলিয়াম পণ্য আমদানি, মজুত, বিপণন, বিতরণ ও নিয়ন্ত্রণসংক্রান্ত কাজের একমাত্র রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। রাষ্ট্রায়ত্ত এ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে বহুবার।

বিপিসির বর্তমান চেয়ারম্যান (সচিব) এবিএম আজাদ সংবাদকে বলেন, ‘এগুলো সরকারি প্রতিষ্ঠান। সরকার যদি মনে করে এই প্রতিষ্ঠান চালিয়ে জনগণের লাভ হচ্ছে না, তাহলে তা বন্ধ করে দিবে। অতীতে বহু প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়েছে।’

এভাবে বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের (বিসিআইসির) বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ছোট নয়। বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশন (বিজেএমসি) দীর্ঘদিন ধরে একটি লোকসানি প্রতিষ্ঠান। ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির (ডিপিডিসি) বিরুদ্ধেও অতিতে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে।

এ ছাড়া পিজিসিবির মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণের বিষয়ে পিজিসিবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক গোলাম কিবরিয়া সংবাদকে বলেন, ‘আমরা তো সময়মতো ঋণের কিস্তি পরিশোধ করি। আমরা খেলাপি হইনি।’

পিজিসিবি লোকসানে আছে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘না, পিজিসিবি লোকসানে নাই। আমরা লাভে আছি।’

একইভাবে বিআরইবি, বিএসসিসিএল ও বিপিডিবির বিরুদ্ধেও নানা অভিযোগ রয়েছে। পেট্রোবাংলার দুর্নীতি নিয়ে তো খোদ হাইকোর্টই হতাশা প্রকাশ করেছে। ২০১৯ সালের মার্চ মাসে হাইকোর্ট বলেছে, পেট্রোবাংলা ও তিতাসের দুর্নীতির ৫০ ভাগও যদি কমানো যায়, তাহলে গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রয়োজন পড়বে না। আন্তর্জাতিক বাজারে গ্যাসের যে মূল্য রয়েছে সেটা মেনেই দেশে গ্যাসের দাম বৃদ্ধি বা কমানো উচিত। কারণ, ভারত যেখানে ছয় ডলার দিয়ে গ্যাস কিনছে, সেখানে বাংলাদেশ একই পরিমাণ গ্যাস কেন ১০ ডলার দিয়ে কিনবে? ওই সময় পেট্রোবাংলা ও তিতাসের দুর্নীতিতে দুদকের ভূমিকা নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করেন হাইকোর্ট।

রবিবার, ০৩ অক্টোবর ২০২১ , ১৮ আশ্বিন ১৪২৮ ২৪ সফর ১৪৪৩

১০ প্রতিষ্ঠানের মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণ বাজেটের এক-চতুর্থাংশ

রেজাউল করিম

image

­সরকারের কাছে ঋণ নিয়ে সেই ঋণের কিস্তি পরিশোধ না করে বছরের পর বছর জিইয়ে রাখছে অধিকাংশ রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান। এতে আর্থিক ব্যবস্থাপনায় সমস্যা হচ্ছে। ১০টি প্রতিষ্ঠানের মেয়াদোত্তীর্ণ এই ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৪৮ হাজার ৪৫৬ কোটি টাকা। এই দেনা চলতি অর্থবছরের বাজেটের এক চতুর্থাংশ।

সঠিক সময়ে ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে তাগিদ দিয়ে এসব প্রতিষ্ঠানকে নিয়মিত চিঠি দেয় অর্থ মন্ত্রণালয়। তবে তাতে তেমন সাড়া পাওয়া যায় না। বছরের ব্যবধানে সুদসহ এই ঋণের পরিমাণ শুধু বাড়ে।

এরপরও এগুলো অবশ্যিক প্রতিষ্ঠান হওয়ায় হাজার কোটি টাকার ঋণ অনাদায়ী থাকলেও নতুন প্রকল্পের জন্য আবারও দেয়া হচ্ছে ঋণ। আর তারা ফের খেলাপি হচ্ছে। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

রাষ্ট্রের কাছে ঋণ নিয়ে পরিশোধ না করা ১০টি প্রতিষ্ঠান হলো, বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি), বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজসম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা), ঢাকা ওয়াসা, বাংলাদেশ সাবমেরিন কেবল কোম্পানি (বিএসসিসিএল), বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি), বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন (বিসিআইসি), বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশন (বিজেএমসি), ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি), পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি) ও বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি)।

এদের মধ্যে পিজিসিবির দাবি, তারা ‘সময়মতো ঋণের কিস্তি পরিশোধ করে, তারা খেলাপি নয়।’ তারা ‘লাভও করে।’ তবে অর্থ মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান বলছে পিজিসিবির কাছে রাষ্ট্রের পাওনা ৪ হাজার ৩৬২ কোটি টাকা।

সরকারের কাছে সবচেয়ে বেশি দেনা রয়েছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড বা বিপিডিবির। ২০২০ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটির দেনা প্রায় ৬৫ হাজার ৭৮৩ কোটি টাকা। এর পরেই রয়েছে পেট্রোবাংলা। সরকারের কাছে প্রতিষ্ঠানটির দেনা ১৮ হাজার ২২৯ কোটি টাকা। ঢাকা ওয়াসার দেনা ১২ হাজার ৫৮৯ কোটি টাকা। বিএসসিসিএলের ঋণ ১৪ হাজার ৮৪৬ কোটি টাকা।

একইভাবে বিপিসির কাছে সরকার পাবে ১২ হাজার ৪২ কোটি টাকা, বিসিআইসির কাছে ১১ হাজার ৫১১ কোটি টাকা, বিজেএমসির কাছে ৩ হাজার ৭৭৬ কোটি, ডিপিডিসির কাছে ২ হাজার ৩১০ কোটি, আরইবির কাছে ৩ হাজার ৮ কোটি টাকা।

প্রতিষ্ঠানগুলো ঋণের কিস্তি সময়মতো পরিশোধ করছে না। প্রতিবছরই বাড়ছে ঋণের বোঝা। আগের বছর অর্থাৎ ২০১৯ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর দেনা যা ছিল, পরের বছর না কমে বরং বেড়েছে। অর্থনীতিবিদদের আশঙ্কা, এই দেনা প্রতিবছরই বাড়বে এবং প্রতিষ্ঠানগুলো তা পরিশোধ করবে না। এক বছরের ব্যবধানে বিপিডিবির দেনা বেড়েছে ৭ হাজার ৪০৯ কোটি টাকা, পেট্রোবাংলার বেড়েছে ৬ হাজার ৬৯৮ কোটি টাকা, ঢাকা ওয়াসার ৯ হাজার ৭৩৩ কোটি টাকা, বিএসসিসিএলের ৩ হাজার ৯৫২ কোটি টাকা, বিপিসির ২ হাজার ১২৭ কোটি টাকা, বিসিআইসির ২ হাজার ৫৯৭ কোটি টাকা, বিজেএমসির ৭৯৯ কোটি টাকা, পিজিসিবির ২ হাজার ৭১৩ কোটি টাকা ও আরইবির ৪১৩ কোটি টাকা।

তবে ডিপিডিসির দেনা আগের বছরের চেয়ে কমেছে। অর্থাৎ কোম্পানিটি কিছু ঋণ পরিশোধ করেছে। আগের বছরের চেয়ে কোম্পানিটির ঋণ কমেছে ১ হাজার ১০৯ কোটি টাকা। এসব রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলো অধিকাংশই পানি, বিদ্যুৎ এবং গ্যাসের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। প্রতিষ্ঠানগুলো দাবি করে, জনগণকে যে দামে পণ্য সরবরাহ করে উৎপাদন খরচ পড়ে তার চেয়ে অনেক বেশি। তাই এসব প্রতিষ্ঠান লোকসান করে। কিন্তু এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ অহরহ। তাই অর্থনীতিবিদদের প্রশ্ন, এসব প্রতিষ্ঠান কি জনগণকে ভর্তুকি দেয়ার কারণে লোকসানে রয়েছে, নাকি দুর্নীতির কারণে লোকসান করছে?

এ প্রসঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এবি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম সংবাদকে বলেন, ‘যেসব প্রতিষ্ঠান খুবই আবশ্যিক নয়, সেগুলো বন্ধ করে দেয়া উচিৎ। আর যেগুলো রাখা জরুরি, সেগুলোর ম্যানেজমেন্ট পরিবর্তন করা দরকার। আর যে ম্যানেজমেন্ট আসবে, তাদের কর্মকা- সঠিকভাবে তদারকি করতে হবে।’

একই মন্তব্য গবেষণা সংস্থা সিপিডির (সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ) সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমানের। তিনি বলেন, ‘প্রথমত, সরকারি এসব প্রতিষ্ঠানে লোকবলের র‌্যাসনালাইজেশন (যৌক্তিককরণ) নেই, অনেক বাড়তি খরচ আছে, ইনইফিসিয়েন্সি (অদক্ষতা) আছে। এগুলো বছরের পর বছর সংস্কার হয় না। দ্বিতীয়ত, অস্বীকার করার উপায় নেই, একটা পণ্যের উৎপাদন খরচ যত হয়, তারচেয়ে কম দামে জনগণের কাছে বিক্রি করতে হয়। অর্থাৎ সরকারকে ভর্তুকি দিয়ে প্রতিষ্ঠানগুলো চালাতে হয়। একইসঙ্গে এটাও সত্যি, যে পরিমাণ ভর্তুকি দেয়া প্রয়োজন, তার চেয়ে অনেক বেশি দিতে হয় শুধু এসব প্রতিষ্ঠানের অব্যবস্থাপনা, অদক্ষতা ও দুর্নীতির কারণে। তৃতীয়ত, সরকারি মালিকানায় রেখেও এসব প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনাকে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেয়ার সিস্টেম সারা বিশ্বে চালু আছে। এই সিস্টেমে মালিকানা সরকারের থাকে, কিন্তু সেগুলো কোন সরকারি কর্মচারী পরিচালনা করে না। চতুর্থত, কিছু প্রতিষ্ঠান আছে যেগুলো সরকারের হাতে রাখার প্রয়োজন নেই। সরকার বাজারের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে চাইলে আমদানি করে বা টিসিবির মাধ্যমে মূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। এতে উৎপাদনে যাওয়ার প্রয়োজন নেই সরকারের।’

মোস্তাফিজুর রহমান আরও বলেন, ‘এমনও কিছু প্রতিষ্ঠান আছে, প্রতি বছর প্রকল্প হাতে নেয় এবং লস করে। তারপরের বছর আবার বলে, ৫০০ কোটি টাকা দেয়া হোক, তাহলে ভালো মতো প্রকল্পটি চালাতে পারব। তাকে সেটা দেয়া হয়। এরপরের বছর আবার সেই প্রকল্পে ১০০০ কোটি টাকা চায়। এভাবে জনগণের করের টাকার অপব্যয় হয়।’

২০১৮ সালের শেষ দিকে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) একটি জরিপ প্রকাশ করে। সেই জরিপে বাংলাদেশের সার্বিক দুর্নীতির চিত্র উঠে আসে।

জরিপে বলা হয়, ২০১৭ সালে সেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ৬৬ দশমিক ৫ শতাংশ খানা দুর্নীতির শিকার হয়েছে। ওই বছর ঘুষের পরিমাণ ছিল ৫ হাজার ৯৩০ কোটি টাকা। খাত হিসেবে তেল, গ্যাস ও পানি ইত্যাদি খাতগুলো ঘুষ লেনদেন হওয়া তালিকার উপর দিকেই রয়েছে।

দেশে পেট্রোলিয়াম পণ্য আমদানি, মজুত, বিপণন, বিতরণ ও নিয়ন্ত্রণসংক্রান্ত কাজের একমাত্র রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। রাষ্ট্রায়ত্ত এ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে বহুবার।

বিপিসির বর্তমান চেয়ারম্যান (সচিব) এবিএম আজাদ সংবাদকে বলেন, ‘এগুলো সরকারি প্রতিষ্ঠান। সরকার যদি মনে করে এই প্রতিষ্ঠান চালিয়ে জনগণের লাভ হচ্ছে না, তাহলে তা বন্ধ করে দিবে। অতীতে বহু প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়েছে।’

এভাবে বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের (বিসিআইসির) বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ছোট নয়। বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশন (বিজেএমসি) দীর্ঘদিন ধরে একটি লোকসানি প্রতিষ্ঠান। ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির (ডিপিডিসি) বিরুদ্ধেও অতিতে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে।

এ ছাড়া পিজিসিবির মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণের বিষয়ে পিজিসিবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক গোলাম কিবরিয়া সংবাদকে বলেন, ‘আমরা তো সময়মতো ঋণের কিস্তি পরিশোধ করি। আমরা খেলাপি হইনি।’

পিজিসিবি লোকসানে আছে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘না, পিজিসিবি লোকসানে নাই। আমরা লাভে আছি।’

একইভাবে বিআরইবি, বিএসসিসিএল ও বিপিডিবির বিরুদ্ধেও নানা অভিযোগ রয়েছে। পেট্রোবাংলার দুর্নীতি নিয়ে তো খোদ হাইকোর্টই হতাশা প্রকাশ করেছে। ২০১৯ সালের মার্চ মাসে হাইকোর্ট বলেছে, পেট্রোবাংলা ও তিতাসের দুর্নীতির ৫০ ভাগও যদি কমানো যায়, তাহলে গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রয়োজন পড়বে না। আন্তর্জাতিক বাজারে গ্যাসের যে মূল্য রয়েছে সেটা মেনেই দেশে গ্যাসের দাম বৃদ্ধি বা কমানো উচিত। কারণ, ভারত যেখানে ছয় ডলার দিয়ে গ্যাস কিনছে, সেখানে বাংলাদেশ একই পরিমাণ গ্যাস কেন ১০ ডলার দিয়ে কিনবে? ওই সময় পেট্রোবাংলা ও তিতাসের দুর্নীতিতে দুদকের ভূমিকা নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করেন হাইকোর্ট।