জেলমুক্ত ঝুমন দাশ, নিরাপত্তার অজুহাতে ‘জেলায় বন্দী’, সংসার চালানোই মূল চিন্তা এখন

সুনামগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে জামিনে মুক্তি পেয়ে গত ২৮ সেপ্টেম্বর বাড়ি ফেরার পর থেকে ঝুমন দাশ তার শিশুপুত্রকে কোল থেকে যেন নামাতেই চাচ্ছেন না। এক সময় জেলা ও জেলার বাইরে বিভিন্ন পণ্য বিক্রি করে সংসার চালানো ঝুমন জেলমুক্ত হলেও নিরাপত্তার অজুহাতে ‘জেলায় বন্দি’ অবস্থায় রয়েছেন। এখন সংসার চালানোই মূল চিন্তা তার।

কথায় কথায় বললেন, সংসার চালাতে তিনি এখন কর্মসংস্থান চান। হেফাজতের সাবেক নেতা কারাবন্দি মামুনুল হকের সমালোচনা করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট দেয়ার অভিযোগে গত ১৬ মার্চ রাতে পুলিশ ঝুমন দাশকে আটক করেছিল। মামুনুলের অনুসারীরা ১৭ মার্চ নোয়াগাঁও গ্রামে হামলা ও লুটপাট চালিয়ে গ্রামটি তছনছ করেছিল। ঘটনার পর থেকেই ঝুমন ও তার পরিবার জানিয়ে আসছিল, মামুনুলকে নিয়ে বা সাম্প্রদায়িক উসকানিমূলক কোন পোস্ট তিনি দেননি।

তিনি আবারও বললেন, যে অভিযোগে তিনি জেল খেটেছেন, সেই অপরাধ তিনি করেননি। ঝুমন দাশ জানান, ২০১২ সালে তিনি ফেইসবুক আইডি খোলেন। গত ১৬ মার্চ মামুনুল হক যাতে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক কথাবার্তা বলে পরিস্থিতি উত্তপ্ত না করেন, সে জন্য তিনি গঠনমূলক একটি পোস্ট দেন। পরে তার নামে আইডি খুলে সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী উসকানিমূলক পোস্ট দিয়ে পরিস্থিতি জটিল করে।

ঝুমন জানান, তিনি যখন জেলহাজতে তখনো তার নামে ১৫-১৬টি ফেইসবুক আইডি সচল ছিল। সেসব আইডি দেশ-বিদেশ থেকে চালানো হয় বলে তিনি পরে জেনেছেন। ঝুমন দাশ বলেন, ‘আমি জেল থেকে কীভাবে ফেইসবুক আইডি সচল রাখব? সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করতেই কোন চক্র এসব করেছে। আমার মামলার এজাহারে তিনটি ফেইসবুক পোস্টের কথা বলা হয়েছে। এর মধ্যে আমি মাত্র একটি পোস্ট দিয়েছিলাম। সেটি ছিল মামুনুল হক যাতে দেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট না করেন সেই সংক্রান্ত। বাকি যে পোস্ট ফেইসবুকে ভাইরাল হয়েছে সেগুলো আমার নয়। নতুন আইডি খুলে স্ক্রিনশট দিয়ে আমার নামে সেগুলো চালিয়ে দেয়া হয়েছে।’

ঝুমন দাশ আরও বলেন, ‘এ ঘটনায় শুধু আমি নই, আমার পরিবার, গ্রাম ও এলাকার মানুষও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এখন আমাকে বাড়িতেই থাকতে হবে। আমি আগে মার্কেটে পণ্য বিক্রি করতাম। এ দিয়েই আমার সংসার চলত। জেল থেকে বেরুলেও এখন আমাকে ‘জেলায় বন্দি’ থাকতে হবে। আমি বাইরে বের হব, এমন পরিস্থিতিও নেই। তাই আমাকে বিভিন্নজনের পরামর্শে বাড়িতেই কর্মহীন থাকতে হবে। কিন্তু এই অবস্থায় আমার স্ত্রী, শিশুপুত্র, মা-বোনকে কী দিয়ে লালন-পালন করব? এ নিয়ে এখন আমি দুশ্চিন্তায় আছি। আমার এলাকায় একটি কর্মসংস্থান বা সংসার চালানোর কোন ব্যবস্থা হলে সংসারের হাল ধরে রাখতে পারব।’

ঝুমন দাশের স্ত্রী সুইটি রানী দাশ বলেন, ‘আমার স্বামীর নিঃশর্ত মুক্তি দেয়া হোক। এখন আমাদের খারাপ অবস্থা। মানসিক ট্রমা থেকে বেরোতে সময় লাগবে। আমার স্বামী অপরাধ না করেও জেল খেটেছেন। তাকে অভিযুক্ত করার ঘটনাটি সম্পূর্ণ মিথ্যা। আমার স্বামীর সারা জীবনের নিরাপত্তা চাই। আমরা আগে যেভাবে ছিলাম, সেই অবস্থানে ফিরতে চাই।’

ঝুমনের মা নিভা রানী দাশ বলেন, ‘ঝুমনই আমার পরিবারের প্রধান উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। সে সিলেট, বিয়ানীবাজার, ঢাকা, সুনামগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পণ্য বিক্রি করে আমাদের সংসার চালাত। এখন তার জেলার বাইরে যাওয়া নিষেধ আছে। তাছাড়া গ্রামে হামলার কারণেও আমাদের ভেতরে ডর আছে। গত দুই দিন হলো সে জামিনে বাড়ি এসেছে। আমি তাকে চোখে চোখে রাখছি। এখন এই অবস্থায় কীভাবে খাব, চলব, কীভাবে বাঁচব? আমার ছেলের জীবনের নিরাপত্তার পাশাপাশি আমাদের সংসার চালানোর সুযোগও চাই। না হলে না খেয়ে মরতে হবে আমাদের।’

নোয়াগাঁও গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা অনিল চন্দ্র দাশ বলেন, ‘আমরা শুরু থেকেই বলে আসছি, যে অপরাধে ঝুমনকে জেলে রাখা হয়েছে, সেই অপরাধ ঝুমন করেননি। তার নামে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী এসব করে দেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগানোর অপচেষ্টা করেছে। সেই সন্ত্রাসীদের খুঁজে বের করে ঝুমনকে মামলা থেকে মুক্তি দেয়া হোক। তার পরিবারকে ভরণ-পোষণ দেয়া হোক।’

সুনামগঞ্জ পুলিশ সুপার মো. মিজানুর রহমান বলেন, ‘ঝুমন দাশ জামিনে মুক্তি পেয়ে বাড়ি যাওয়ার পর তার সঙ্গে ও পরিবারের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। তাকে আমরা জানিয়েছি, তিনি বা তার পরিবার নিরাপত্তাহীনতা অনুভব করলে আমাকে অবগত করার জন্য। তাছাড়া তার নিরাপত্তার স্বার্থেই যাতে বাড়ির বাইরে গেলে আমাদের জানানো হয়, সেটা বলেছি। আশা করি, ঝুমন দাশ, তার পরিবার বা তার গ্রামে আর কোন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটবে না। আমরা এ বিষয়ে খুবই সতর্ক আছি।

রবিবার, ০৩ অক্টোবর ২০২১ , ১৮ আশ্বিন ১৪২৮ ২৪ সফর ১৪৪৩

জেলমুক্ত ঝুমন দাশ, নিরাপত্তার অজুহাতে ‘জেলায় বন্দী’, সংসার চালানোই মূল চিন্তা এখন

প্রতিনিধি, সুনামগঞ্জ

image

সুনামগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে জামিনে মুক্তি পেয়ে গত ২৮ সেপ্টেম্বর বাড়ি ফেরার পর থেকে ঝুমন দাশ তার শিশুপুত্রকে কোল থেকে যেন নামাতেই চাচ্ছেন না। এক সময় জেলা ও জেলার বাইরে বিভিন্ন পণ্য বিক্রি করে সংসার চালানো ঝুমন জেলমুক্ত হলেও নিরাপত্তার অজুহাতে ‘জেলায় বন্দি’ অবস্থায় রয়েছেন। এখন সংসার চালানোই মূল চিন্তা তার।

কথায় কথায় বললেন, সংসার চালাতে তিনি এখন কর্মসংস্থান চান। হেফাজতের সাবেক নেতা কারাবন্দি মামুনুল হকের সমালোচনা করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট দেয়ার অভিযোগে গত ১৬ মার্চ রাতে পুলিশ ঝুমন দাশকে আটক করেছিল। মামুনুলের অনুসারীরা ১৭ মার্চ নোয়াগাঁও গ্রামে হামলা ও লুটপাট চালিয়ে গ্রামটি তছনছ করেছিল। ঘটনার পর থেকেই ঝুমন ও তার পরিবার জানিয়ে আসছিল, মামুনুলকে নিয়ে বা সাম্প্রদায়িক উসকানিমূলক কোন পোস্ট তিনি দেননি।

তিনি আবারও বললেন, যে অভিযোগে তিনি জেল খেটেছেন, সেই অপরাধ তিনি করেননি। ঝুমন দাশ জানান, ২০১২ সালে তিনি ফেইসবুক আইডি খোলেন। গত ১৬ মার্চ মামুনুল হক যাতে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক কথাবার্তা বলে পরিস্থিতি উত্তপ্ত না করেন, সে জন্য তিনি গঠনমূলক একটি পোস্ট দেন। পরে তার নামে আইডি খুলে সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী উসকানিমূলক পোস্ট দিয়ে পরিস্থিতি জটিল করে।

ঝুমন জানান, তিনি যখন জেলহাজতে তখনো তার নামে ১৫-১৬টি ফেইসবুক আইডি সচল ছিল। সেসব আইডি দেশ-বিদেশ থেকে চালানো হয় বলে তিনি পরে জেনেছেন। ঝুমন দাশ বলেন, ‘আমি জেল থেকে কীভাবে ফেইসবুক আইডি সচল রাখব? সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করতেই কোন চক্র এসব করেছে। আমার মামলার এজাহারে তিনটি ফেইসবুক পোস্টের কথা বলা হয়েছে। এর মধ্যে আমি মাত্র একটি পোস্ট দিয়েছিলাম। সেটি ছিল মামুনুল হক যাতে দেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট না করেন সেই সংক্রান্ত। বাকি যে পোস্ট ফেইসবুকে ভাইরাল হয়েছে সেগুলো আমার নয়। নতুন আইডি খুলে স্ক্রিনশট দিয়ে আমার নামে সেগুলো চালিয়ে দেয়া হয়েছে।’

ঝুমন দাশ আরও বলেন, ‘এ ঘটনায় শুধু আমি নই, আমার পরিবার, গ্রাম ও এলাকার মানুষও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এখন আমাকে বাড়িতেই থাকতে হবে। আমি আগে মার্কেটে পণ্য বিক্রি করতাম। এ দিয়েই আমার সংসার চলত। জেল থেকে বেরুলেও এখন আমাকে ‘জেলায় বন্দি’ থাকতে হবে। আমি বাইরে বের হব, এমন পরিস্থিতিও নেই। তাই আমাকে বিভিন্নজনের পরামর্শে বাড়িতেই কর্মহীন থাকতে হবে। কিন্তু এই অবস্থায় আমার স্ত্রী, শিশুপুত্র, মা-বোনকে কী দিয়ে লালন-পালন করব? এ নিয়ে এখন আমি দুশ্চিন্তায় আছি। আমার এলাকায় একটি কর্মসংস্থান বা সংসার চালানোর কোন ব্যবস্থা হলে সংসারের হাল ধরে রাখতে পারব।’

ঝুমন দাশের স্ত্রী সুইটি রানী দাশ বলেন, ‘আমার স্বামীর নিঃশর্ত মুক্তি দেয়া হোক। এখন আমাদের খারাপ অবস্থা। মানসিক ট্রমা থেকে বেরোতে সময় লাগবে। আমার স্বামী অপরাধ না করেও জেল খেটেছেন। তাকে অভিযুক্ত করার ঘটনাটি সম্পূর্ণ মিথ্যা। আমার স্বামীর সারা জীবনের নিরাপত্তা চাই। আমরা আগে যেভাবে ছিলাম, সেই অবস্থানে ফিরতে চাই।’

ঝুমনের মা নিভা রানী দাশ বলেন, ‘ঝুমনই আমার পরিবারের প্রধান উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। সে সিলেট, বিয়ানীবাজার, ঢাকা, সুনামগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পণ্য বিক্রি করে আমাদের সংসার চালাত। এখন তার জেলার বাইরে যাওয়া নিষেধ আছে। তাছাড়া গ্রামে হামলার কারণেও আমাদের ভেতরে ডর আছে। গত দুই দিন হলো সে জামিনে বাড়ি এসেছে। আমি তাকে চোখে চোখে রাখছি। এখন এই অবস্থায় কীভাবে খাব, চলব, কীভাবে বাঁচব? আমার ছেলের জীবনের নিরাপত্তার পাশাপাশি আমাদের সংসার চালানোর সুযোগও চাই। না হলে না খেয়ে মরতে হবে আমাদের।’

নোয়াগাঁও গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা অনিল চন্দ্র দাশ বলেন, ‘আমরা শুরু থেকেই বলে আসছি, যে অপরাধে ঝুমনকে জেলে রাখা হয়েছে, সেই অপরাধ ঝুমন করেননি। তার নামে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী এসব করে দেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগানোর অপচেষ্টা করেছে। সেই সন্ত্রাসীদের খুঁজে বের করে ঝুমনকে মামলা থেকে মুক্তি দেয়া হোক। তার পরিবারকে ভরণ-পোষণ দেয়া হোক।’

সুনামগঞ্জ পুলিশ সুপার মো. মিজানুর রহমান বলেন, ‘ঝুমন দাশ জামিনে মুক্তি পেয়ে বাড়ি যাওয়ার পর তার সঙ্গে ও পরিবারের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। তাকে আমরা জানিয়েছি, তিনি বা তার পরিবার নিরাপত্তাহীনতা অনুভব করলে আমাকে অবগত করার জন্য। তাছাড়া তার নিরাপত্তার স্বার্থেই যাতে বাড়ির বাইরে গেলে আমাদের জানানো হয়, সেটা বলেছি। আশা করি, ঝুমন দাশ, তার পরিবার বা তার গ্রামে আর কোন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটবে না। আমরা এ বিষয়ে খুবই সতর্ক আছি।