সাংবাদিকদের সম্পদের হিসাব

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

বাংলাদেশ ইন্টেলিজেন্স ইউনিট বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে ১১ জন সাংবাদিক নেতার ব্যাংক হিসাবের যাবতীয় লেনদেনের তথ্য চেয়েছে। যাদের তথ্য চওয়া হয়েছে তারা হলেন- জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি ফরিদা ইয়াসমিন, সাধারণ সম্পাদক ইলিয়াস খান, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি (বিএনপি সমর্থিত) আব্দুল কাদের গণি চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক মো. শহিদুল ইসলাম, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের (আওয়ামী লীগ সমর্থিত) সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ আলম খান তপু, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএনপি সমর্থিত) সভাপতি এম আব্দুল্লাহ, মহাসচিব নুরুল আমিন রোকন, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি (আওয়ামী লীগ সমর্থিত) মোল্লা জালাল, ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব আব্দুল মজিদ, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সভাপতি মোরসালীন নোমানী এবং সাধারণ সম্পাদক মশিউর রহমান খান। ঢাকার বাইরেও কিছু সাংবাদিকের হিসাব চেয়ে চিঠি দেয়া হয়েছে। সাংবাদিক নেতার ব্যাংক হিসাব তলবের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেমেছে সাংবাদিকদের ৬টি সংগঠন। সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, এমন তথ্য চাওয়া বাকস্বাধীনতা রুদ্ধ করার গভীর ষড়যন্ত্র। অনেক সাংবাদিক বিষয়টিকে সংবাদমাধ্যম এবং সাংবাদিকদের ওপরে চাপ সৃষ্টির কৌশল মনে করছেন। তারা জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে প্রতিবাদ সমাবেশ করে বলেছেন, ভয় দেখিয়ে সাংবাদিকদের কলম স্তব্ধ করা যাবে না। অবিলম্বে ব্যাংক হিসাব তলবের চিঠি প্রত্যাহারের দাবিও ছিল তাদের।

ভীতি সঞ্চার করে সাংবাদিক সমাজকে ন্যায়নীতির পথ থেকে সরিয়ে আনার দুরভিসন্ধি রয়েছে বলে সাংবাদিকরা ধারণা করছেন; এছাড়াও সাংবাদিকদের সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা দিয়ে সমাজে তাদের দুর্নীতিবাজ হিসেবে হেয় করার উদ্দেশ্যে ব্যাংকের হিসাব চাওয়া হয়েছে বলে সাংবাদিকেরা মনে করছেন। ব্যাংক হিসাবের তথ্য চাওয়ার ব্যাপারে দৃশ্যত সাংবাদিকেরা বিরুদ্ধাচারণ করছেন না, তারা বিরুদ্ধাচারণ করছেন তথ্য চাওয়ার প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে। বেছে বেছে কয়েকজন নেতার ব্যাংক হিসাবের তথ্য না নিয়ে সব সাংবাদিকের নিলে তাদের কয়েকজনকে হেয় প্রতিপন্ন হতে হয় না। তাদের আরেকটি অভিযোগ হচ্ছে, বিভিন্ন সংগঠনের নেতাদের নাম ও পদবি উল্লেখ করে ব্যক্তিগত ব্যাংক হিসাবের তথ্য চাওয়ার মধ্যে সঙ্গতি নেই। অন্যান্য পেশার লোকদের ক্ষেত্রে এভাবে গড়পড়তা হিসাবের তথ্য চাওয়ার নজির পূর্বে পরিলক্ষিত না হওয়ায় সাংবাদিকদের ব্যাংক হিসাবের তথ্য চাওয়া সাংবাদিকতা পেশার প্রতি অসৌজন্যমূলক আচরণ বলেও কিছু সাংবাদিক মনে করছেন।

বাংলাদেশের প্রতিটি খাত এখন দুর্নীতিগ্রস্ত। অবশ্য ব্রিটিশ আমলে দুর্নীতি ছিল, পাকিস্তান আমলে দুর্নীতি হয়েছে, বাংলাদেশ আমলেও হচ্ছে এবং হবে। বাংলাদেশ কয়েকবার দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়নও হয়েছে; বর্তমানে তালিকায় উত্তরণ হলেও বাস্তবে হয়েছে বলে কেউ মনে করেন না। যারা ক্ষমতায় থাকে তাদের ধারণা, তাদের আগের আমলে আরও বেশি দুর্নীতি হয়েছে; আর যারা বিরোধী দলে থাকে, তাদের অভিমত হচ্ছে সরকারের লোকজন দেশের সব সম্পদ লুটেপুটে নিচ্ছে। দেশে দুর্নীতির ভয়াবহতা আর অর্থ পাচারের কথা পাকিস্তান আমল থেকে শুনে আসছি। সম্প্রতি কানাডায় বেগম পাড়ার কথা বেশ জোরেশোরে প্রচার পেয়েছে; ওখানে অর্থ পাচার করে যারা বাড়ি করেছেন তাদের অধিকাংশ নাকি সরকারের আমলা। মালয়েশিয়ায় নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করে বহু লোক সেকেন্ড হোম তৈরি করেছেন। আমরা জানি, আমদানির মূল্য পরিশোধ করতে ব্যাংকের মাধ্যমে যে কোন পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাঠানো গেলেও দেশের অভ্যন্তরে অর্জিত আয় বা সম্পত্তি বিক্রি করে কোন অর্থ বিদেশে নেয়া যায় না। অভিবাসন ফি, বিদেশে পড়ালেখার খরচ, চিকিৎসা খরচ, বিদেশ ভ্রমণের জন্য নির্ধারিত অর্থ বিদেশে পাঠানো বা সঙ্গে করে নেয়া যায়। আন্ডার ইনভয়েস আর ওভার ইনভয়েস করে অনেক ব্যবসায়ী তাদের আয়ের একটি অংশ বিদেশি ব্যাংক হিসাবে অবৈধভাবে জমা করছেন। সরকারের ক্ষমতাবান ব্যক্তি যারা দুর্নীতি করেন, ঘুষ খান তারাও আজকাল দেশে টাকা রাখেন না, বিদেশি একাউন্টে জমা করেন। সরকারের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা তো বিমানবন্দরে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, তাদের হাতের ব্যাগ বা দেহতল্লাশি করার রীতি অনুসৃত হতে কেউ কখনও দেখেছে বলে মনে হয় না। অবশ্য তাদের সঙ্গে বহন করারও প্রয়োজন হয় না, দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরাই তাদের বিদেশি একাউন্টে টাকা জমা করে দেন।

সরকারের কোন সেক্টরে দুর্নীতি হয় না? ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল যখন রিপোর্ট প্রণয়ন করে তখন তা সব সরকারই নাকচ করে। যখন কোন একটি সেক্টরকে সর্বাধিক দুর্নীতিগ্রস্ত হিসাবে চিহ্নিত করা হয় তখন ওই সেক্টরের কর্তাব্যক্তিরা সাফাই গাইতে থাকেন। ১৫ বছর পূর্বে তারের ছোট ছোট ছিদ্র দিয়ে পুলিশের সম্মুখে যেভাবে জেলখানার ভেতরে টাকা পাচার হতে দেখেছি তা আমাকে এখনও বিস্মিত করে। পুলিশ যখন বলল, ‘এই কি করছেন’, তখন টাকা পাচারকারী বললো, ‘ভেতরে আপনাদের পুলিশের জন্যই পাঠাচ্ছি’। পুলিশ চুপ হয়ে গেলেন। গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি প্রতিটি সেবা প্রতিষ্ঠানের কিছু লোক সবার সামনে ঘুষ খায়। স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি তো সর্বজনবিদিত। শিক্ষক দ্বারা পরিচালিত শিক্ষা বিভাগও দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত। কাস্টমস আর কর বিভাগের হয়রানির সম্মুখীন হয়নি এমন লোক কম। ব্যাংকে এখনও দুর্নীতির মহামারী শুরু হয়নি, টাকা জমা রাখলে তা এখনও ফেরত পাওয়া যায়। ঋণ মঞ্জুরীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অধিকাংশ ব্যাংকার দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত। আমদানি-রপ্তানির বীমাকরণে বীমা কোম্পানিগুলো এলসি সংশ্লিষ্ট ব্যাংকারদের সঙ্গে মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভদের মতো সম্পর্ক রাখে, এলসি কনফার্মেশনে বিদেশি ব্যাংক ও বিদেশি ব্যাংকের রিপ্রেজেন্টেটিভ অফিসগুলোর সঙ্গে এলসি সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কর্মকর্তাদের ঘুষের টাকা বৈদেশিক মুদ্রায় লেনদেন হয় বলে শুনেছি। দেশে একটি পেশার লোকও নেই, যাদের সবাই সৎ।

আইন অনুযায়ী রাষ্ট্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত কোন প্রতিষ্ঠান যে কোন নাগরিকের ব্যাংক হিসাব তলব বা সম্পদের হিসাব চাইতে পারে। এই দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের নিয়মিত কাজের অংশ হিসাবে কারো তথ্য চাইলে কোন প্রশ্ন কারও মনে জাগত না, কিন্তু এমন স্বচ্ছতার সঙ্গে তথ্য চাওয়া হয় না। পরিলক্ষিত হয়, সরকারের বিরুদ্ধে কেউ কথা বললেই তার সম্পদ ও ব্যাংক হিসাব বিবরণী নিয়ে টানাটানি শুরু হয়। সরকারের বিপক্ষে কথা বলার পর হেফাজতে ইসলামের নেতার ব্যাংকের হিসাব বিবরণী তলব করার ঘোষণা দেয়া হলো, হেফাজতের নেতারা সরকারের নেতৃস্থানীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে দেখা করার পর তাদের ব্যাংকের হিসাব নিয়ে আর কোন উচ্চবাচ্য শোনা যায়নি। এই কাজটি প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানও করতেন বলে পত্রিকায় পড়েছি; প্রতিপক্ষ বা প্রতিদ্বন্দীদের অপকর্মের তালিকা সংবলিত নথি তৈরি করে কেউ মাথাচাড়া দিলে তাকে ডেকে এনে তার অপকর্মের ফাইলটি পড়তে দিতেন। দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলো যথাযথ মর্যাদা দিয়ে অভিযুক্তদের সঙ্গে আচরণ করলে কোন সমস্যা থাকত না, তাদের চাহিদামতো যতই তথ্য দেয়া হোক না কেন, অভিযুক্তকে হয়রানি আর নাজেহালের সম্মুখীন হতেই হবে। দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান থেকে যারা জিজ্ঞাসাবাদ করেন তারা ভালো করেই জানেন যে, অধিকাংশ নাগরিকের আয়করের নথির আয়-ব্যয় এবং সম্পদের বিবরণীর সঙ্গে বাস্তব অবস্থার মিল নেই। যারা জিজ্ঞাসাবাদ করেন তাদের অনেকের সম্পদ এবং ব্যাংক হিসাব বিবরণীর অবস্থা একই। তিনবারের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া এবং সাবেক অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমানকেও জরিমানা দিয়ে অপ্রদর্শিত আয় নিয়মিত করতে হয়েছিল।

ব্যাংক হিসাব বিবরণী চাওয়াটাকে সাংবাদিকেরা অপমানজনক মনে করছেন; কিন্তু তারা যখন অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ হওয়ার পূর্বেই পত্রিকায় ছবি দিয়ে, অভিযুক্তদের ব্যক্তিগত তথ্য প্রকাশ করেন তখন কি তাদের জন্য তা অপমানজনক হয় না? জনপ্রতিনিধিদের আয়-ব্যয় এবং সম্পদের হিসাব জনসম্মুখে প্রকাশ করার ঘোষণা নির্বাচনের আগে প্রায় প্রতিটি রাজনৈতিক দলই দিয়ে থাকে; সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ছাড়া আর কেউ আয়-ব্যয় ও সম্পদের হিসাব জনসম্মুখে প্রকাশ করেছেন বলে মনে হয় না। সাংবাদিক এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাজ হচ্ছে তথ্যভিত্তিক অপরাধের উন্মোচন করা; অপরাধীরা বাঁচার জন্য এই দুটি পেশার লোকদের প্রলোভন দিয়ে প্রলুব্ধ করে থাকে। তাই সাংবাদিকদের কারও অবৈধ বা অনুপার্জিত সম্পদ নেই এমন হলফ করে বলা কঠিন। সাংবাদিকদের অবৈধ সম্পদ অর্জনের অনেক গুঞ্জন রয়েছে; এমন গুঞ্জনও রয়েছে যে, সাংবাদিকদের অবৈধ আয়ের বেশিরভাগ পুলিশ থেকে পাওয়া। কারণ পুলিশ সাংবাদিকদের ভয় করে। অপরাধের রিপোর্ট করার ভয় দেখিয়ে, ব্ল্যাকমেইল করে অর্থ আদায় করার অভিযোগ সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে কম নয়। পেশাগত কারণে সাংবাদিকেরা অগ্রাধিকারমূলক সুবিধা ভোগ করেন বলেই সরকার এবং বিরোধী রাজনৈতিক দলের অনেক নেতা ব্যাংক হিসাবের তথ্য চাওয়া বিষয়ে সাংবাদিকদের পক্ষে অবিরত কথা বলে যাচ্ছেন। সাংবাদিক সমাজকে ভয় করে না এমন বুকের পাটা কারও আছে বলে মনে হয় না।

আদালত, দুদক, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, এনবিআর এবং বাংলাদেশ ইন্টিলিজেন্স ইউনিট এমন তথ্য নিয়মিত সংগ্রহ করে পর্যালোচনা করে থাকে, পর্যালোচনা করার পর সন্দেহজনক কিছু না থাকলে আপনাআপনিই বিষয়টি নথিভুক্ত হয়ে যায়। সরকারি কর্মকর্তা এবং মন্ত্রীদের সম্পদের হিসাব বিবরণী প্রকাশের অপরিহার্যতা নিয়ে সাংবাদিকরা সোচ্চার। সমাজের সর্বত্র স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠার মহান ব্রত নিয়ে লড়াকু কোন সাংবাদিক নিজের বেলায় প্রক্রিয়া-পদ্ধতির অজুহাত তুলে জবাবদিহিতার সম্মুখীন হতে ভয় পাবেন- এমন প্রত্যাশা কেউ করে না। যাদের ব্যাংক হিসাবের তথ্য চাওয়া হয়েছে তাদের বেশিরভাগ আওয়ামী লীগপন্থি, কিন্তু এই ইস্যুতে সরকারের পক্ষের এবং সরকারবিরোধী সব সাংবাদিক এখন এক সুরে কথা বলছেন। সাংবাদিকদের তরফ থেকে প্রতিবাদের ঝড় না উঠলে বিষয়টির তাৎপর্য ও গুরুত্ব এভাবে বাড়ত বলে মনে হয় না। সাংবাদিকদের নাখোশ করে সরকার চালানো কঠিন; কারণ এরা শক্তিশালী প্রেসার গ্রুপ, এরা ক্ষেপে গেলে সরকারের সব অর্জন এক নিমিষেই ধূলিস্মাৎ হয়ে যাবে। সরকারও তা বোঝে, এই ব্যাপারে মন্ত্রী মহোদয়দের কথাবার্তা শুনলেই তা বোঝা যায়; ‘চিন্তার কিছু নেই’, হেফাজতিদের সঙ্গে সমঝোতা হতে পারলে সাংবাদিকদের সঙ্গেও হবে ইনশাআল্লাহ।

[লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক]

ahmedzeauddin0@gmail.com

রবিবার, ০৩ অক্টোবর ২০২১ , ১৮ আশ্বিন ১৪২৮ ২৪ সফর ১৪৪৩

সাংবাদিকদের সম্পদের হিসাব

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

বাংলাদেশ ইন্টেলিজেন্স ইউনিট বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে ১১ জন সাংবাদিক নেতার ব্যাংক হিসাবের যাবতীয় লেনদেনের তথ্য চেয়েছে। যাদের তথ্য চওয়া হয়েছে তারা হলেন- জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি ফরিদা ইয়াসমিন, সাধারণ সম্পাদক ইলিয়াস খান, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি (বিএনপি সমর্থিত) আব্দুল কাদের গণি চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক মো. শহিদুল ইসলাম, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের (আওয়ামী লীগ সমর্থিত) সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ আলম খান তপু, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএনপি সমর্থিত) সভাপতি এম আব্দুল্লাহ, মহাসচিব নুরুল আমিন রোকন, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি (আওয়ামী লীগ সমর্থিত) মোল্লা জালাল, ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব আব্দুল মজিদ, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সভাপতি মোরসালীন নোমানী এবং সাধারণ সম্পাদক মশিউর রহমান খান। ঢাকার বাইরেও কিছু সাংবাদিকের হিসাব চেয়ে চিঠি দেয়া হয়েছে। সাংবাদিক নেতার ব্যাংক হিসাব তলবের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেমেছে সাংবাদিকদের ৬টি সংগঠন। সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, এমন তথ্য চাওয়া বাকস্বাধীনতা রুদ্ধ করার গভীর ষড়যন্ত্র। অনেক সাংবাদিক বিষয়টিকে সংবাদমাধ্যম এবং সাংবাদিকদের ওপরে চাপ সৃষ্টির কৌশল মনে করছেন। তারা জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে প্রতিবাদ সমাবেশ করে বলেছেন, ভয় দেখিয়ে সাংবাদিকদের কলম স্তব্ধ করা যাবে না। অবিলম্বে ব্যাংক হিসাব তলবের চিঠি প্রত্যাহারের দাবিও ছিল তাদের।

ভীতি সঞ্চার করে সাংবাদিক সমাজকে ন্যায়নীতির পথ থেকে সরিয়ে আনার দুরভিসন্ধি রয়েছে বলে সাংবাদিকরা ধারণা করছেন; এছাড়াও সাংবাদিকদের সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা দিয়ে সমাজে তাদের দুর্নীতিবাজ হিসেবে হেয় করার উদ্দেশ্যে ব্যাংকের হিসাব চাওয়া হয়েছে বলে সাংবাদিকেরা মনে করছেন। ব্যাংক হিসাবের তথ্য চাওয়ার ব্যাপারে দৃশ্যত সাংবাদিকেরা বিরুদ্ধাচারণ করছেন না, তারা বিরুদ্ধাচারণ করছেন তথ্য চাওয়ার প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে। বেছে বেছে কয়েকজন নেতার ব্যাংক হিসাবের তথ্য না নিয়ে সব সাংবাদিকের নিলে তাদের কয়েকজনকে হেয় প্রতিপন্ন হতে হয় না। তাদের আরেকটি অভিযোগ হচ্ছে, বিভিন্ন সংগঠনের নেতাদের নাম ও পদবি উল্লেখ করে ব্যক্তিগত ব্যাংক হিসাবের তথ্য চাওয়ার মধ্যে সঙ্গতি নেই। অন্যান্য পেশার লোকদের ক্ষেত্রে এভাবে গড়পড়তা হিসাবের তথ্য চাওয়ার নজির পূর্বে পরিলক্ষিত না হওয়ায় সাংবাদিকদের ব্যাংক হিসাবের তথ্য চাওয়া সাংবাদিকতা পেশার প্রতি অসৌজন্যমূলক আচরণ বলেও কিছু সাংবাদিক মনে করছেন।

বাংলাদেশের প্রতিটি খাত এখন দুর্নীতিগ্রস্ত। অবশ্য ব্রিটিশ আমলে দুর্নীতি ছিল, পাকিস্তান আমলে দুর্নীতি হয়েছে, বাংলাদেশ আমলেও হচ্ছে এবং হবে। বাংলাদেশ কয়েকবার দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়নও হয়েছে; বর্তমানে তালিকায় উত্তরণ হলেও বাস্তবে হয়েছে বলে কেউ মনে করেন না। যারা ক্ষমতায় থাকে তাদের ধারণা, তাদের আগের আমলে আরও বেশি দুর্নীতি হয়েছে; আর যারা বিরোধী দলে থাকে, তাদের অভিমত হচ্ছে সরকারের লোকজন দেশের সব সম্পদ লুটেপুটে নিচ্ছে। দেশে দুর্নীতির ভয়াবহতা আর অর্থ পাচারের কথা পাকিস্তান আমল থেকে শুনে আসছি। সম্প্রতি কানাডায় বেগম পাড়ার কথা বেশ জোরেশোরে প্রচার পেয়েছে; ওখানে অর্থ পাচার করে যারা বাড়ি করেছেন তাদের অধিকাংশ নাকি সরকারের আমলা। মালয়েশিয়ায় নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করে বহু লোক সেকেন্ড হোম তৈরি করেছেন। আমরা জানি, আমদানির মূল্য পরিশোধ করতে ব্যাংকের মাধ্যমে যে কোন পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাঠানো গেলেও দেশের অভ্যন্তরে অর্জিত আয় বা সম্পত্তি বিক্রি করে কোন অর্থ বিদেশে নেয়া যায় না। অভিবাসন ফি, বিদেশে পড়ালেখার খরচ, চিকিৎসা খরচ, বিদেশ ভ্রমণের জন্য নির্ধারিত অর্থ বিদেশে পাঠানো বা সঙ্গে করে নেয়া যায়। আন্ডার ইনভয়েস আর ওভার ইনভয়েস করে অনেক ব্যবসায়ী তাদের আয়ের একটি অংশ বিদেশি ব্যাংক হিসাবে অবৈধভাবে জমা করছেন। সরকারের ক্ষমতাবান ব্যক্তি যারা দুর্নীতি করেন, ঘুষ খান তারাও আজকাল দেশে টাকা রাখেন না, বিদেশি একাউন্টে জমা করেন। সরকারের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা তো বিমানবন্দরে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, তাদের হাতের ব্যাগ বা দেহতল্লাশি করার রীতি অনুসৃত হতে কেউ কখনও দেখেছে বলে মনে হয় না। অবশ্য তাদের সঙ্গে বহন করারও প্রয়োজন হয় না, দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরাই তাদের বিদেশি একাউন্টে টাকা জমা করে দেন।

সরকারের কোন সেক্টরে দুর্নীতি হয় না? ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল যখন রিপোর্ট প্রণয়ন করে তখন তা সব সরকারই নাকচ করে। যখন কোন একটি সেক্টরকে সর্বাধিক দুর্নীতিগ্রস্ত হিসাবে চিহ্নিত করা হয় তখন ওই সেক্টরের কর্তাব্যক্তিরা সাফাই গাইতে থাকেন। ১৫ বছর পূর্বে তারের ছোট ছোট ছিদ্র দিয়ে পুলিশের সম্মুখে যেভাবে জেলখানার ভেতরে টাকা পাচার হতে দেখেছি তা আমাকে এখনও বিস্মিত করে। পুলিশ যখন বলল, ‘এই কি করছেন’, তখন টাকা পাচারকারী বললো, ‘ভেতরে আপনাদের পুলিশের জন্যই পাঠাচ্ছি’। পুলিশ চুপ হয়ে গেলেন। গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি প্রতিটি সেবা প্রতিষ্ঠানের কিছু লোক সবার সামনে ঘুষ খায়। স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি তো সর্বজনবিদিত। শিক্ষক দ্বারা পরিচালিত শিক্ষা বিভাগও দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত। কাস্টমস আর কর বিভাগের হয়রানির সম্মুখীন হয়নি এমন লোক কম। ব্যাংকে এখনও দুর্নীতির মহামারী শুরু হয়নি, টাকা জমা রাখলে তা এখনও ফেরত পাওয়া যায়। ঋণ মঞ্জুরীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অধিকাংশ ব্যাংকার দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত। আমদানি-রপ্তানির বীমাকরণে বীমা কোম্পানিগুলো এলসি সংশ্লিষ্ট ব্যাংকারদের সঙ্গে মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভদের মতো সম্পর্ক রাখে, এলসি কনফার্মেশনে বিদেশি ব্যাংক ও বিদেশি ব্যাংকের রিপ্রেজেন্টেটিভ অফিসগুলোর সঙ্গে এলসি সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কর্মকর্তাদের ঘুষের টাকা বৈদেশিক মুদ্রায় লেনদেন হয় বলে শুনেছি। দেশে একটি পেশার লোকও নেই, যাদের সবাই সৎ।

আইন অনুযায়ী রাষ্ট্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত কোন প্রতিষ্ঠান যে কোন নাগরিকের ব্যাংক হিসাব তলব বা সম্পদের হিসাব চাইতে পারে। এই দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের নিয়মিত কাজের অংশ হিসাবে কারো তথ্য চাইলে কোন প্রশ্ন কারও মনে জাগত না, কিন্তু এমন স্বচ্ছতার সঙ্গে তথ্য চাওয়া হয় না। পরিলক্ষিত হয়, সরকারের বিরুদ্ধে কেউ কথা বললেই তার সম্পদ ও ব্যাংক হিসাব বিবরণী নিয়ে টানাটানি শুরু হয়। সরকারের বিপক্ষে কথা বলার পর হেফাজতে ইসলামের নেতার ব্যাংকের হিসাব বিবরণী তলব করার ঘোষণা দেয়া হলো, হেফাজতের নেতারা সরকারের নেতৃস্থানীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে দেখা করার পর তাদের ব্যাংকের হিসাব নিয়ে আর কোন উচ্চবাচ্য শোনা যায়নি। এই কাজটি প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানও করতেন বলে পত্রিকায় পড়েছি; প্রতিপক্ষ বা প্রতিদ্বন্দীদের অপকর্মের তালিকা সংবলিত নথি তৈরি করে কেউ মাথাচাড়া দিলে তাকে ডেকে এনে তার অপকর্মের ফাইলটি পড়তে দিতেন। দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলো যথাযথ মর্যাদা দিয়ে অভিযুক্তদের সঙ্গে আচরণ করলে কোন সমস্যা থাকত না, তাদের চাহিদামতো যতই তথ্য দেয়া হোক না কেন, অভিযুক্তকে হয়রানি আর নাজেহালের সম্মুখীন হতেই হবে। দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান থেকে যারা জিজ্ঞাসাবাদ করেন তারা ভালো করেই জানেন যে, অধিকাংশ নাগরিকের আয়করের নথির আয়-ব্যয় এবং সম্পদের বিবরণীর সঙ্গে বাস্তব অবস্থার মিল নেই। যারা জিজ্ঞাসাবাদ করেন তাদের অনেকের সম্পদ এবং ব্যাংক হিসাব বিবরণীর অবস্থা একই। তিনবারের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া এবং সাবেক অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমানকেও জরিমানা দিয়ে অপ্রদর্শিত আয় নিয়মিত করতে হয়েছিল।

ব্যাংক হিসাব বিবরণী চাওয়াটাকে সাংবাদিকেরা অপমানজনক মনে করছেন; কিন্তু তারা যখন অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ হওয়ার পূর্বেই পত্রিকায় ছবি দিয়ে, অভিযুক্তদের ব্যক্তিগত তথ্য প্রকাশ করেন তখন কি তাদের জন্য তা অপমানজনক হয় না? জনপ্রতিনিধিদের আয়-ব্যয় এবং সম্পদের হিসাব জনসম্মুখে প্রকাশ করার ঘোষণা নির্বাচনের আগে প্রায় প্রতিটি রাজনৈতিক দলই দিয়ে থাকে; সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ছাড়া আর কেউ আয়-ব্যয় ও সম্পদের হিসাব জনসম্মুখে প্রকাশ করেছেন বলে মনে হয় না। সাংবাদিক এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাজ হচ্ছে তথ্যভিত্তিক অপরাধের উন্মোচন করা; অপরাধীরা বাঁচার জন্য এই দুটি পেশার লোকদের প্রলোভন দিয়ে প্রলুব্ধ করে থাকে। তাই সাংবাদিকদের কারও অবৈধ বা অনুপার্জিত সম্পদ নেই এমন হলফ করে বলা কঠিন। সাংবাদিকদের অবৈধ সম্পদ অর্জনের অনেক গুঞ্জন রয়েছে; এমন গুঞ্জনও রয়েছে যে, সাংবাদিকদের অবৈধ আয়ের বেশিরভাগ পুলিশ থেকে পাওয়া। কারণ পুলিশ সাংবাদিকদের ভয় করে। অপরাধের রিপোর্ট করার ভয় দেখিয়ে, ব্ল্যাকমেইল করে অর্থ আদায় করার অভিযোগ সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে কম নয়। পেশাগত কারণে সাংবাদিকেরা অগ্রাধিকারমূলক সুবিধা ভোগ করেন বলেই সরকার এবং বিরোধী রাজনৈতিক দলের অনেক নেতা ব্যাংক হিসাবের তথ্য চাওয়া বিষয়ে সাংবাদিকদের পক্ষে অবিরত কথা বলে যাচ্ছেন। সাংবাদিক সমাজকে ভয় করে না এমন বুকের পাটা কারও আছে বলে মনে হয় না।

আদালত, দুদক, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, এনবিআর এবং বাংলাদেশ ইন্টিলিজেন্স ইউনিট এমন তথ্য নিয়মিত সংগ্রহ করে পর্যালোচনা করে থাকে, পর্যালোচনা করার পর সন্দেহজনক কিছু না থাকলে আপনাআপনিই বিষয়টি নথিভুক্ত হয়ে যায়। সরকারি কর্মকর্তা এবং মন্ত্রীদের সম্পদের হিসাব বিবরণী প্রকাশের অপরিহার্যতা নিয়ে সাংবাদিকরা সোচ্চার। সমাজের সর্বত্র স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠার মহান ব্রত নিয়ে লড়াকু কোন সাংবাদিক নিজের বেলায় প্রক্রিয়া-পদ্ধতির অজুহাত তুলে জবাবদিহিতার সম্মুখীন হতে ভয় পাবেন- এমন প্রত্যাশা কেউ করে না। যাদের ব্যাংক হিসাবের তথ্য চাওয়া হয়েছে তাদের বেশিরভাগ আওয়ামী লীগপন্থি, কিন্তু এই ইস্যুতে সরকারের পক্ষের এবং সরকারবিরোধী সব সাংবাদিক এখন এক সুরে কথা বলছেন। সাংবাদিকদের তরফ থেকে প্রতিবাদের ঝড় না উঠলে বিষয়টির তাৎপর্য ও গুরুত্ব এভাবে বাড়ত বলে মনে হয় না। সাংবাদিকদের নাখোশ করে সরকার চালানো কঠিন; কারণ এরা শক্তিশালী প্রেসার গ্রুপ, এরা ক্ষেপে গেলে সরকারের সব অর্জন এক নিমিষেই ধূলিস্মাৎ হয়ে যাবে। সরকারও তা বোঝে, এই ব্যাপারে মন্ত্রী মহোদয়দের কথাবার্তা শুনলেই তা বোঝা যায়; ‘চিন্তার কিছু নেই’, হেফাজতিদের সঙ্গে সমঝোতা হতে পারলে সাংবাদিকদের সঙ্গেও হবে ইনশাআল্লাহ।

[লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক]

ahmedzeauddin0@gmail.com