দেবাহুতি চক্রবর্তী
সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকার পারিবারিক, পেনশনার, তিন মাস মেয়াদি বিভিন্ন সঞ্চয়পত্র এবং একটি বন্ডের সুদহার কমিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক অতিদ্রুত তা কার্যকরী করার নির্দেশ দিয়েছে। সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে অনীহা সৃষ্টির জন্য ব্যাংকগুলোর কমিশন কমানোর নির্দেশ এসেছে। যুক্তি, দীর্ঘদিন সরকারের প্রত্যাশার চেয়ে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ বেড়ে যাচ্ছে। অর্থনীতিতে যার বিরূপ প্রতিক্রিয়া হচ্ছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। এই বিনিয়োগ কমানোর জন্য ইতিপূর্বে সরকার উৎসে কর কর্তন বৃদ্ধি এবং সঞ্চয়পত্র ক্রয়ের সীমাবদ্ধতা নির্ধারণ করে। তাতেও সঞ্চয়পত্র ক্রয় কমেনি। মধ্যবিত্তের বিভিন্ন স্তরের অবসরপ্রাপ্ত সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবী, বয়স্ক, অসুস্থ, কর্মে অক্ষম নারী-পুরুষের বৃহৎ অংশ এবং ধনিক শ্রেণীর উল্লেখযোগ্য অংশ এই বিনিয়োগ অব্যাহত রাখে। সরকারের বক্তব্য ব্যাংক থেকে বা বিদেশ থেকে ঋণ গ্রহণে যে পরিমাণ সুদ দিতে হয়, সঞ্চয়পত্রের ঋণ পরিশোধে সুদের হার বেশি থাকায় প্রতি বছর ৩০-৩৫ হাজার কোটি টাকা সরকারের ভর্তুকি খাতে দাঁড়ায়। ব্যাংক এবং শেয়ারবাজারে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। অর্থনীতিতে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়। অর্থনীতিবিদরা অনেকেই এবং ব্যাংক, শেয়ারবাজার পরিচালনা কর্তৃপক্ষ সরকারের এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে।
সঞ্চয়পত্র বা বন্ড মাধ্যমে বিনিয়োগ কৃত অর্থ নাগরিকের কাছ থেকে সরকারের ঋণ। তবে ব্যাংক ইত্যাদি মহাজনের মতো নাগরিক তার বিনিয়োগকৃত অর্থের বিনিময়ে সুদের হার নির্ধারণ করতে পারে না।
তবে, নাগরিকদের মৌলিক চাহিদা পরিপূরণে সরকারের সাংবিধানিক দায়বদ্ধতা রয়েছে, যা অন্যভাবে অর্থনৈতিক নিশ্চয়তা বিধানের দায় বটে। রাষ্ট্র নাগরিক জীবনের সমতাবিধানেও দায়বদ্ধ।
দেশের জনসংখ্যা ১৭ কোটির বেশি ছাড়া কম নয়। ২০১৯-এর পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসেবে দারিদ্র্যহার ২০.৫ শতাংশ। যার মধ্যে হতদরিদ্র ১০.৫ শতাংশ। মানে সোয়া তিন কোটির বেশি মানুষ এখনও দরিদ্র। সিপিডির গবেষণা অনুযায়ী দারিদ্র্যহার ৩২ শতাংশে দাঁড়াবে। এদের সঞ্চয়পত্র ক্রয়ের দৃষ্টান্ত কম। তারা ঋণ দেয় না, শুধুই নেয়। পাড়ায়-পাড়ায়, এলাকায়-এলাকায়, অনুমোদিত-অননুমোদিত ব্যক্তি, গোষ্ঠী, প্রাতিষ্ঠানিক, অপ্রাতিষ্ঠানিক মহাজনদের কাছ থেকে। এক ঋণ শোধ করতে আর এক ঋণে জড়ায়। ঋণ গ্রহণকারীরা অধিকাংশ নারী। কিস্তির দায় মেটাতে এরা বিভিন্ন পর্যায়ে শ্রমজীবী হয়ে ঘরে-বাইরে কাজ করে। বহু অমানবিক নির্যাতনের এরা শিকার। জাতীয় মাথাপিছু ঋণ ছাড়াও এদের প্রতিটি সন্তানই পৃথক ঋণের দায় কাঁধে নিয়েই জন্মে। বিশ্বব্যাংকের বক্তব্যমতো দারিদ্র্য কমানোর প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে।
পক্ষান্তরে, বাংলাদেশে কোটি টাকার ঊর্ধ্বে অর্থের মালিকদের ধনী হিসেবে ভাবা হয়। ১৯৭২ সনে স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে কোটিপতি ৫ জন, ১৯৭৫ সনে ৪৭ জন, ১৯৯০ সনে ৯৪৩ জন, ১৯৯৬ থেকে ২০১৯ অবধি ৯৩,৮৯০ জন। এখন হয়তো লাখের ঊর্ধ্বে। তাদের প্রদর্শিত ব্যাংক আমানতের হিসাব অনুযায়ী। ২৫০ কোটি টাকার ওপরে যাদের হিসাব, তাদের অতি ধনী বলা হয়। বিশ্বে এই অতি ধনী মানুষের সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধির প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ বর্তমানে প্রথম স্থানে রয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার করোনাকালীন সময়ের পূর্বে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় ঈর্ষণীয় স্থানে ছিল। মহামারী চলাকালীন সময়েও এই প্রবৃদ্ধির হার ৫ শতাংশের বেশি। প্রবৃদ্ধির এই লাফিয়ে লাফিয়ে হার বৃদ্ধি সামগ্রিক অর্থনৈতিক চিত্রর সঙ্গে কতটা যৌক্তিক বা সামঞ্জস্যপূর্ণ তা ভাবার সময় এসেছে। এই প্রবৃদ্ধির সুফল মূলত জমা হচ্ছে দেশের মোট জনসংখ্যার ৫ শতাংশের বেশি মানুষের হাতে। এরাও নামে-বেনামে সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগ অব্যাহত রাখে। আয়করের স্বচ্ছতা বিধানসহ অন্যান্য উদ্দেশে। মোট সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগের একটা বড় অংশ ধনী ও অতিধনীদের দখলে। এ যেন সেই প্রবাদের অংশ ... ‘গাছেরও খায়, তলারও কুড়ায়।’
মাঝে রয়ে গেল সেই মধ্যবিত্ত শ্রেণী। এদের স্তর বিভাগে যাচ্ছি না। যাদের মধ্যে ৬৫ ঊর্ধ্বের মানুষ ৬ শতাংশ। যাদের অর্ধেক নারী-পুরুষ প্রায় সমান সমান। এদের মধ্যে রয়েছে সরকারি-বেসরকারি অবসরপ্রাপ্ত চাকরিজীবী। রয়েছে পঙ্গু, অসুস্থ, নানা কারণে কর্মে অক্ষম মানুষ। এমন অনেকে আছে, যারা নিজেদের জায়গা জমি বিক্রি করে সঞ্চয়পত্র কেনে। মাটির গন্ধ যত মোহময় হোক, সক্ষম ব্যক্তি ছাড়া মাটি থেকে উপার্জন তো হয়ই না। বরং বিভিন্ন পরিস্থিতিতে বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। এদের যার যতটুকু সংগ্রহ তা দিয়ে সঞ্চয়পত্র কেনে। নগদ টাকা যে কোনোভাবে মানুষের হাত থেকে বেরিয়ে যায়। চুরি, ডাকাতি, অপহরণ নিত্যদিনের ঘটনা। ব্যাংক সুদ আর কর্তনের হিসাবে লাভের খতিয়ান খুবই কম। যে শেয়ারবাজারের ইতিবাচক ক্ষেত্র তৈরি এই সুদের হার কমানোর অন্যতম লক্ষ্য, সেই শেয়ারবাজার মূলত ফটকাবাজ ও অতিধনী শ্রেণীর নিয়ন্ত্রণে। ১৯৯৬ সনে সুপরিকল্পিতভাবে শেয়ারবাজারের ধস পুঁজি বিনিয়োগকারী সাধারণ মানুষকে মানে এই মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে পথে নামিয়েছে। ২০০৯-১১ অবধি এই শেয়ারবাজারের অস্থির পরিস্থিতি বারবার আলোচনায় এসেছে। ২০১৯ এ শেয়ারবাজারে ২৭,০০০ কোটি টাকার ১৫ দিনে লাগামহীন পতন হয়েছে। পুঁজিবাজারে ঋণগ্রস্ত বিনিয়োগকারীরা সর্বস্ব খুঁইয়েছে। অব্যাহত এই শেয়ার কেলেঙ্কারির ও ব্যাংক লুটের সঙ্গে জড়িত মূল খল নায়কদের অদ্যাবধি বিচার জনগণ দেখেনি। সাধারণ মানুষ ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যেখানে যখন টাকা লগ্নি করতে গেছে সেখানেই ঠকেছে। ইউনিপেটু, যুবক, ডেসটিনি, হলমার্ক, ই-কমার্স, এরফান গ্রুপ খ্যাত- অখ্যাত, ছোট-বড় সবখানেই এক অবস্থা। সুস্থ ও নিরাপদ বিনিয়োগের নিশ্চয়তার প্রকা- শূন্যতা মানুষকে এই সঞ্চয়পত্রমুখী করেছে। সব জায়গা থেকেই প্রতারণা ও আত্মসাৎজনিত অপরাধের দুর্গন্ধ চুইয়ে পড়ছে। আর, এর প্রধানতম কারণ দেশে সুশাসনের অভাব আর সর্বগ্রাসী দুর্নীতি। একজন কর্ম - অক্ষম ব্যক্তি যার ওপর চার-পাঁচজন নির্ভরশীল বর্তমান বাজারে তার টিকে থাকতে ন্যূনতম কত লাগে? বাসস্থান, খাদ্য, পোশাক, যাতায়াত, চিকিৎসা, শিক্ষা, গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানি প্রভৃতির বিল আনুসঙ্গিক সব মিলিয়ে অর্থ-মন্ত্রণালয়ে কোন পরিসংখ্যান আছে কি?
বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি মানুষের আয় থেকে ব্যয় বেশি। আয়-ব্যয়ের ভারসাম্য বিধানের আমৃত্যু প্রচেষ্টায় জর্জরিত এই মধ্যবিত্ত শ্রেণী। সমাজে এই শ্রেণী আসলেই একরকম বালাই। না পারছে সরকারের নানাবিধ ভাতা সংগ্রহের জন্য পায়ে পায়ে ঘুরতে। না পারছে ধনী শ্রেণীর মতো শুধু টাকা ওড়ানোর জন্য বিলাসবহুল জায়গার সন্ধান করে ফিরতে। মাথাপিছু ২৫,০০০/ টাকা ঋণ কিন্তু প্রত্যেককেই জ্ঞাত - অজ্ঞাতসারে বহন করতে হচ্ছে। সরকার রাজস্ব সংগ্রহ করছে বহুবিধ ক্ষেত্র থেকে। আয়কর দেয়া নাগরিক কর্তব্য। কিন্তু তার সিলিং ও সঠিক হয়েছে কিনা প্রশ্নবিদ্ধ। উন্নত দেশগুলোয় আয়ের ৩০ শতাংশ সরকার কর হিসেবে কেটে নেয়। সেখানকার নাগরিকরা স্বাচ্ছন্দ্য চিত্তে এই ভার বহন করে। কারণ কল্যাণমুখী রাষ্ট্রগুলোয় খাদ্য, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসার দায়িত্ব রাষ্ট্র বহন করে। আমাদের মৌলিক চাহিদার কতটুকু রাষ্ট্র বহন করে? কেন এত অনিশ্চয়তা জীবনের? যে কোন একটা কঠিন অসুখ বা দুর্ঘটনার জেরে একটা পরিবারকে ভিটেমাটি বিক্রি করতে হয়। অবসরপ্রাপ্ত সরকারি চাকরিজীবী পেনশনের পুরো টাকা যদি একবার না পায়, সেই অর্ধেক টাকা কি অচল হয়ে বসে থাকে? সরকার কি ব্যক্তির অব্যবহৃত টাকায় লাভবান হচ্ছে না?
সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগকৃত অলস টাকাও নানাভাবে সচল হয়ে ঘুরছে। সরকার যদি সর্বগ্রাসী দুর্নীতির লাগাম টানতে পারে, তবে বিভিন্ন জরুরি পরিষেবা প্রাইভেট সেক্টরে এত দেয়ার দরকার পড়ে না।
এই করোনাকালীন সময়ে ছোট ব্যবসায়ী, ছোট পুঁজির মানুষ এমনিতেই বিপর্যস্ত। সঞ্চয়পত্রের ওপর নির্ভরশীল নারী, ওয়েজ আর্নার বন্ডের ক্ষেত্রে প্রবাসীরা সরকারের এই সিদ্ধান্তে অধিকতর ক্ষতির সম্মুখীন হবে। ১৫ লাখ টাকার এবং তদুপরি বিভিন্ন ধাপের টাকার যে সুদহার নির্ণয় করা হয়েছে তা সাধারণ মানুষের স্বার্থের অনুকূল নয়। আর পাঁচ লাখ বাড়ালেও নয়।
এদেশে সঞ্চয়পত্র বা বিভিন্ন বন্ডের মুনাফার ওপর যাদের জীবন নির্ভরশীল তাদের জন্য এই ‘সামান্য ক্ষতি’ ... কত বড় ক্ষতি তা সরকারের উপলব্ধি করা দরকার। ধনীক শ্রেণীর সঞ্চয়পত্রে নামে-বেনামে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সরকারের বিরুদ্ধ পদক্ষেপ নেয়া জরুরি । সে সঙ্গে সাধারণ মানুষের একক নামে বর্তমান সর্বোচ্চ যে সিলিং রয়েছে তার সুদহার ঠিক রাখা দরকার। তা না হলে অন্যত্র বিনিয়োগের নিশ্চিত পরিবেশ অবশ্যই সরকারকে সৃষ্টি করতে হবে। মুনাফাখোরদের হাত থেকে সব শ্রেণীর নাগরিককে রক্ষা করতে হবে। নিত্যপণ্যর বাজার, স্বাস্থ্য-শিক্ষা ব্যয় সংগতিপূর্ণ থাকছে না। অস্থিতিশীল বাজার ও মুদ্রাস্ফীতিতে এমনিতেই বিনিয়োগকৃত টাকার মান অহরহ কমছে। কভিড-১৯ মহামারীজনিত বিপর্যয় সামলে ওঠা সাধারণের জন্য খুবই কঠিন। গার্মেন্ট খাতে করোনাকালীন প্রণোদনার কথা শোনা গেছে। পরিবহন খাত রক্ষায় ভাড়া বৃদ্ধি হয়েছে। ইন্টারনেট জগতের ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্তরা নানা সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে। সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য পদ বৃদ্ধি করা হয়েছে। বেতন বেড়েছে অল্পসময়ে বিশাল অঙ্কের। শত শত কোটি টাকা খেলাপি ঋণগ্রহীতারা দুই কোটি টাকা শোধ করে ঋণ পুনঃতফসিলের সুযোগ পাচ্ছে। কালো টাকা সাদা হচ্ছে ফি বছর। এই সবই নানাভাবে সংগৃহীত সাধারণ জনগণের টাকা। এবং তা কভিড বিপর্যস্ত মানুষকেও রেহাই দিচ্ছে না।
বিত্তহীন এই মধ্যবিত্ত শ্রেণী এখন প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর পর্যায়ে। তাদের দোদুল্যমান শিক্ষা আর আত্মাভিমান দিন যাপনের গ্লানি বহনের অপরিসীম সহ্যশক্তি দিয়েছে বটে। কিন্তু তা রাষ্ট্রের অন্তঃসারশূন্যতা ত্বরান্বিত করছে। ভেতর থেকে দেখার পদ্ধতিগত চর্চা থাকলে দেখা যাবে, সাধারণ মধ্যবিত্তের সঞ্চয়পত্র ক্রয় আদৌ সঞ্চয় নয়, জীবন ও জীবিকা ধারণের প্রধানতম মূলধন বিনিয়োগ। সঞ্চয় সেটাই যা মৌলিক প্রয়োজন মিটিয়ে উদ্বৃত্ত অংশ হিসেবে গচ্ছিত রাখা যায়। সাধারণ মধ্যবিত্তর ক্ষেত্রে বিষয়টা বিপরীত।
রাষ্ট্র জনগণের মৌলিক চাহিদা মেটানোর ও সমতাপূর্ণ সমাজব্যবস্থা সৃষ্টির দায় বহন করে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ রাষ্ট্র অনেক পিছিয়ে। সাধারণ মানুষ তার নিজের জীবনের ন্যূনতম নিশ্চয়তার দায় নিজে বহন করছে। বলা যায়, তাদের প্রতি রাষ্ট্রের দায়ভারে অংশীদারিত্ব পালন করছে। সেক্ষেত্রে, সঞ্চয়পত্রে সুদহার কমানোর বিষয়টি পুনর্বিবেচনা জরুরি।
[লেখক : আইনজীবী]
রবিবার, ০৩ অক্টোবর ২০২১ , ১৮ আশ্বিন ১৪২৮ ২৪ সফর ১৪৪৩
দেবাহুতি চক্রবর্তী
সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকার পারিবারিক, পেনশনার, তিন মাস মেয়াদি বিভিন্ন সঞ্চয়পত্র এবং একটি বন্ডের সুদহার কমিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক অতিদ্রুত তা কার্যকরী করার নির্দেশ দিয়েছে। সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে অনীহা সৃষ্টির জন্য ব্যাংকগুলোর কমিশন কমানোর নির্দেশ এসেছে। যুক্তি, দীর্ঘদিন সরকারের প্রত্যাশার চেয়ে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ বেড়ে যাচ্ছে। অর্থনীতিতে যার বিরূপ প্রতিক্রিয়া হচ্ছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। এই বিনিয়োগ কমানোর জন্য ইতিপূর্বে সরকার উৎসে কর কর্তন বৃদ্ধি এবং সঞ্চয়পত্র ক্রয়ের সীমাবদ্ধতা নির্ধারণ করে। তাতেও সঞ্চয়পত্র ক্রয় কমেনি। মধ্যবিত্তের বিভিন্ন স্তরের অবসরপ্রাপ্ত সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবী, বয়স্ক, অসুস্থ, কর্মে অক্ষম নারী-পুরুষের বৃহৎ অংশ এবং ধনিক শ্রেণীর উল্লেখযোগ্য অংশ এই বিনিয়োগ অব্যাহত রাখে। সরকারের বক্তব্য ব্যাংক থেকে বা বিদেশ থেকে ঋণ গ্রহণে যে পরিমাণ সুদ দিতে হয়, সঞ্চয়পত্রের ঋণ পরিশোধে সুদের হার বেশি থাকায় প্রতি বছর ৩০-৩৫ হাজার কোটি টাকা সরকারের ভর্তুকি খাতে দাঁড়ায়। ব্যাংক এবং শেয়ারবাজারে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। অর্থনীতিতে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়। অর্থনীতিবিদরা অনেকেই এবং ব্যাংক, শেয়ারবাজার পরিচালনা কর্তৃপক্ষ সরকারের এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে।
সঞ্চয়পত্র বা বন্ড মাধ্যমে বিনিয়োগ কৃত অর্থ নাগরিকের কাছ থেকে সরকারের ঋণ। তবে ব্যাংক ইত্যাদি মহাজনের মতো নাগরিক তার বিনিয়োগকৃত অর্থের বিনিময়ে সুদের হার নির্ধারণ করতে পারে না।
তবে, নাগরিকদের মৌলিক চাহিদা পরিপূরণে সরকারের সাংবিধানিক দায়বদ্ধতা রয়েছে, যা অন্যভাবে অর্থনৈতিক নিশ্চয়তা বিধানের দায় বটে। রাষ্ট্র নাগরিক জীবনের সমতাবিধানেও দায়বদ্ধ।
দেশের জনসংখ্যা ১৭ কোটির বেশি ছাড়া কম নয়। ২০১৯-এর পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসেবে দারিদ্র্যহার ২০.৫ শতাংশ। যার মধ্যে হতদরিদ্র ১০.৫ শতাংশ। মানে সোয়া তিন কোটির বেশি মানুষ এখনও দরিদ্র। সিপিডির গবেষণা অনুযায়ী দারিদ্র্যহার ৩২ শতাংশে দাঁড়াবে। এদের সঞ্চয়পত্র ক্রয়ের দৃষ্টান্ত কম। তারা ঋণ দেয় না, শুধুই নেয়। পাড়ায়-পাড়ায়, এলাকায়-এলাকায়, অনুমোদিত-অননুমোদিত ব্যক্তি, গোষ্ঠী, প্রাতিষ্ঠানিক, অপ্রাতিষ্ঠানিক মহাজনদের কাছ থেকে। এক ঋণ শোধ করতে আর এক ঋণে জড়ায়। ঋণ গ্রহণকারীরা অধিকাংশ নারী। কিস্তির দায় মেটাতে এরা বিভিন্ন পর্যায়ে শ্রমজীবী হয়ে ঘরে-বাইরে কাজ করে। বহু অমানবিক নির্যাতনের এরা শিকার। জাতীয় মাথাপিছু ঋণ ছাড়াও এদের প্রতিটি সন্তানই পৃথক ঋণের দায় কাঁধে নিয়েই জন্মে। বিশ্বব্যাংকের বক্তব্যমতো দারিদ্র্য কমানোর প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে।
পক্ষান্তরে, বাংলাদেশে কোটি টাকার ঊর্ধ্বে অর্থের মালিকদের ধনী হিসেবে ভাবা হয়। ১৯৭২ সনে স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে কোটিপতি ৫ জন, ১৯৭৫ সনে ৪৭ জন, ১৯৯০ সনে ৯৪৩ জন, ১৯৯৬ থেকে ২০১৯ অবধি ৯৩,৮৯০ জন। এখন হয়তো লাখের ঊর্ধ্বে। তাদের প্রদর্শিত ব্যাংক আমানতের হিসাব অনুযায়ী। ২৫০ কোটি টাকার ওপরে যাদের হিসাব, তাদের অতি ধনী বলা হয়। বিশ্বে এই অতি ধনী মানুষের সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধির প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ বর্তমানে প্রথম স্থানে রয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার করোনাকালীন সময়ের পূর্বে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় ঈর্ষণীয় স্থানে ছিল। মহামারী চলাকালীন সময়েও এই প্রবৃদ্ধির হার ৫ শতাংশের বেশি। প্রবৃদ্ধির এই লাফিয়ে লাফিয়ে হার বৃদ্ধি সামগ্রিক অর্থনৈতিক চিত্রর সঙ্গে কতটা যৌক্তিক বা সামঞ্জস্যপূর্ণ তা ভাবার সময় এসেছে। এই প্রবৃদ্ধির সুফল মূলত জমা হচ্ছে দেশের মোট জনসংখ্যার ৫ শতাংশের বেশি মানুষের হাতে। এরাও নামে-বেনামে সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগ অব্যাহত রাখে। আয়করের স্বচ্ছতা বিধানসহ অন্যান্য উদ্দেশে। মোট সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগের একটা বড় অংশ ধনী ও অতিধনীদের দখলে। এ যেন সেই প্রবাদের অংশ ... ‘গাছেরও খায়, তলারও কুড়ায়।’
মাঝে রয়ে গেল সেই মধ্যবিত্ত শ্রেণী। এদের স্তর বিভাগে যাচ্ছি না। যাদের মধ্যে ৬৫ ঊর্ধ্বের মানুষ ৬ শতাংশ। যাদের অর্ধেক নারী-পুরুষ প্রায় সমান সমান। এদের মধ্যে রয়েছে সরকারি-বেসরকারি অবসরপ্রাপ্ত চাকরিজীবী। রয়েছে পঙ্গু, অসুস্থ, নানা কারণে কর্মে অক্ষম মানুষ। এমন অনেকে আছে, যারা নিজেদের জায়গা জমি বিক্রি করে সঞ্চয়পত্র কেনে। মাটির গন্ধ যত মোহময় হোক, সক্ষম ব্যক্তি ছাড়া মাটি থেকে উপার্জন তো হয়ই না। বরং বিভিন্ন পরিস্থিতিতে বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। এদের যার যতটুকু সংগ্রহ তা দিয়ে সঞ্চয়পত্র কেনে। নগদ টাকা যে কোনোভাবে মানুষের হাত থেকে বেরিয়ে যায়। চুরি, ডাকাতি, অপহরণ নিত্যদিনের ঘটনা। ব্যাংক সুদ আর কর্তনের হিসাবে লাভের খতিয়ান খুবই কম। যে শেয়ারবাজারের ইতিবাচক ক্ষেত্র তৈরি এই সুদের হার কমানোর অন্যতম লক্ষ্য, সেই শেয়ারবাজার মূলত ফটকাবাজ ও অতিধনী শ্রেণীর নিয়ন্ত্রণে। ১৯৯৬ সনে সুপরিকল্পিতভাবে শেয়ারবাজারের ধস পুঁজি বিনিয়োগকারী সাধারণ মানুষকে মানে এই মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে পথে নামিয়েছে। ২০০৯-১১ অবধি এই শেয়ারবাজারের অস্থির পরিস্থিতি বারবার আলোচনায় এসেছে। ২০১৯ এ শেয়ারবাজারে ২৭,০০০ কোটি টাকার ১৫ দিনে লাগামহীন পতন হয়েছে। পুঁজিবাজারে ঋণগ্রস্ত বিনিয়োগকারীরা সর্বস্ব খুঁইয়েছে। অব্যাহত এই শেয়ার কেলেঙ্কারির ও ব্যাংক লুটের সঙ্গে জড়িত মূল খল নায়কদের অদ্যাবধি বিচার জনগণ দেখেনি। সাধারণ মানুষ ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যেখানে যখন টাকা লগ্নি করতে গেছে সেখানেই ঠকেছে। ইউনিপেটু, যুবক, ডেসটিনি, হলমার্ক, ই-কমার্স, এরফান গ্রুপ খ্যাত- অখ্যাত, ছোট-বড় সবখানেই এক অবস্থা। সুস্থ ও নিরাপদ বিনিয়োগের নিশ্চয়তার প্রকা- শূন্যতা মানুষকে এই সঞ্চয়পত্রমুখী করেছে। সব জায়গা থেকেই প্রতারণা ও আত্মসাৎজনিত অপরাধের দুর্গন্ধ চুইয়ে পড়ছে। আর, এর প্রধানতম কারণ দেশে সুশাসনের অভাব আর সর্বগ্রাসী দুর্নীতি। একজন কর্ম - অক্ষম ব্যক্তি যার ওপর চার-পাঁচজন নির্ভরশীল বর্তমান বাজারে তার টিকে থাকতে ন্যূনতম কত লাগে? বাসস্থান, খাদ্য, পোশাক, যাতায়াত, চিকিৎসা, শিক্ষা, গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানি প্রভৃতির বিল আনুসঙ্গিক সব মিলিয়ে অর্থ-মন্ত্রণালয়ে কোন পরিসংখ্যান আছে কি?
বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি মানুষের আয় থেকে ব্যয় বেশি। আয়-ব্যয়ের ভারসাম্য বিধানের আমৃত্যু প্রচেষ্টায় জর্জরিত এই মধ্যবিত্ত শ্রেণী। সমাজে এই শ্রেণী আসলেই একরকম বালাই। না পারছে সরকারের নানাবিধ ভাতা সংগ্রহের জন্য পায়ে পায়ে ঘুরতে। না পারছে ধনী শ্রেণীর মতো শুধু টাকা ওড়ানোর জন্য বিলাসবহুল জায়গার সন্ধান করে ফিরতে। মাথাপিছু ২৫,০০০/ টাকা ঋণ কিন্তু প্রত্যেককেই জ্ঞাত - অজ্ঞাতসারে বহন করতে হচ্ছে। সরকার রাজস্ব সংগ্রহ করছে বহুবিধ ক্ষেত্র থেকে। আয়কর দেয়া নাগরিক কর্তব্য। কিন্তু তার সিলিং ও সঠিক হয়েছে কিনা প্রশ্নবিদ্ধ। উন্নত দেশগুলোয় আয়ের ৩০ শতাংশ সরকার কর হিসেবে কেটে নেয়। সেখানকার নাগরিকরা স্বাচ্ছন্দ্য চিত্তে এই ভার বহন করে। কারণ কল্যাণমুখী রাষ্ট্রগুলোয় খাদ্য, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসার দায়িত্ব রাষ্ট্র বহন করে। আমাদের মৌলিক চাহিদার কতটুকু রাষ্ট্র বহন করে? কেন এত অনিশ্চয়তা জীবনের? যে কোন একটা কঠিন অসুখ বা দুর্ঘটনার জেরে একটা পরিবারকে ভিটেমাটি বিক্রি করতে হয়। অবসরপ্রাপ্ত সরকারি চাকরিজীবী পেনশনের পুরো টাকা যদি একবার না পায়, সেই অর্ধেক টাকা কি অচল হয়ে বসে থাকে? সরকার কি ব্যক্তির অব্যবহৃত টাকায় লাভবান হচ্ছে না?
সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগকৃত অলস টাকাও নানাভাবে সচল হয়ে ঘুরছে। সরকার যদি সর্বগ্রাসী দুর্নীতির লাগাম টানতে পারে, তবে বিভিন্ন জরুরি পরিষেবা প্রাইভেট সেক্টরে এত দেয়ার দরকার পড়ে না।
এই করোনাকালীন সময়ে ছোট ব্যবসায়ী, ছোট পুঁজির মানুষ এমনিতেই বিপর্যস্ত। সঞ্চয়পত্রের ওপর নির্ভরশীল নারী, ওয়েজ আর্নার বন্ডের ক্ষেত্রে প্রবাসীরা সরকারের এই সিদ্ধান্তে অধিকতর ক্ষতির সম্মুখীন হবে। ১৫ লাখ টাকার এবং তদুপরি বিভিন্ন ধাপের টাকার যে সুদহার নির্ণয় করা হয়েছে তা সাধারণ মানুষের স্বার্থের অনুকূল নয়। আর পাঁচ লাখ বাড়ালেও নয়।
এদেশে সঞ্চয়পত্র বা বিভিন্ন বন্ডের মুনাফার ওপর যাদের জীবন নির্ভরশীল তাদের জন্য এই ‘সামান্য ক্ষতি’ ... কত বড় ক্ষতি তা সরকারের উপলব্ধি করা দরকার। ধনীক শ্রেণীর সঞ্চয়পত্রে নামে-বেনামে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সরকারের বিরুদ্ধ পদক্ষেপ নেয়া জরুরি । সে সঙ্গে সাধারণ মানুষের একক নামে বর্তমান সর্বোচ্চ যে সিলিং রয়েছে তার সুদহার ঠিক রাখা দরকার। তা না হলে অন্যত্র বিনিয়োগের নিশ্চিত পরিবেশ অবশ্যই সরকারকে সৃষ্টি করতে হবে। মুনাফাখোরদের হাত থেকে সব শ্রেণীর নাগরিককে রক্ষা করতে হবে। নিত্যপণ্যর বাজার, স্বাস্থ্য-শিক্ষা ব্যয় সংগতিপূর্ণ থাকছে না। অস্থিতিশীল বাজার ও মুদ্রাস্ফীতিতে এমনিতেই বিনিয়োগকৃত টাকার মান অহরহ কমছে। কভিড-১৯ মহামারীজনিত বিপর্যয় সামলে ওঠা সাধারণের জন্য খুবই কঠিন। গার্মেন্ট খাতে করোনাকালীন প্রণোদনার কথা শোনা গেছে। পরিবহন খাত রক্ষায় ভাড়া বৃদ্ধি হয়েছে। ইন্টারনেট জগতের ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্তরা নানা সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে। সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য পদ বৃদ্ধি করা হয়েছে। বেতন বেড়েছে অল্পসময়ে বিশাল অঙ্কের। শত শত কোটি টাকা খেলাপি ঋণগ্রহীতারা দুই কোটি টাকা শোধ করে ঋণ পুনঃতফসিলের সুযোগ পাচ্ছে। কালো টাকা সাদা হচ্ছে ফি বছর। এই সবই নানাভাবে সংগৃহীত সাধারণ জনগণের টাকা। এবং তা কভিড বিপর্যস্ত মানুষকেও রেহাই দিচ্ছে না।
বিত্তহীন এই মধ্যবিত্ত শ্রেণী এখন প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর পর্যায়ে। তাদের দোদুল্যমান শিক্ষা আর আত্মাভিমান দিন যাপনের গ্লানি বহনের অপরিসীম সহ্যশক্তি দিয়েছে বটে। কিন্তু তা রাষ্ট্রের অন্তঃসারশূন্যতা ত্বরান্বিত করছে। ভেতর থেকে দেখার পদ্ধতিগত চর্চা থাকলে দেখা যাবে, সাধারণ মধ্যবিত্তের সঞ্চয়পত্র ক্রয় আদৌ সঞ্চয় নয়, জীবন ও জীবিকা ধারণের প্রধানতম মূলধন বিনিয়োগ। সঞ্চয় সেটাই যা মৌলিক প্রয়োজন মিটিয়ে উদ্বৃত্ত অংশ হিসেবে গচ্ছিত রাখা যায়। সাধারণ মধ্যবিত্তর ক্ষেত্রে বিষয়টা বিপরীত।
রাষ্ট্র জনগণের মৌলিক চাহিদা মেটানোর ও সমতাপূর্ণ সমাজব্যবস্থা সৃষ্টির দায় বহন করে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ রাষ্ট্র অনেক পিছিয়ে। সাধারণ মানুষ তার নিজের জীবনের ন্যূনতম নিশ্চয়তার দায় নিজে বহন করছে। বলা যায়, তাদের প্রতি রাষ্ট্রের দায়ভারে অংশীদারিত্ব পালন করছে। সেক্ষেত্রে, সঞ্চয়পত্রে সুদহার কমানোর বিষয়টি পুনর্বিবেচনা জরুরি।
[লেখক : আইনজীবী]