জাবেদ ইকবালের যাবজ্জীবন
চট্টগ্রাম আদালত ভবনে ১৬ বছর আগে আত্মঘাতী বোমা হামলা মামলায় নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জেএমবির নেতা মিজানুর রহমানকে মৃত্যুদন্ড দিয়েছেন আদালত। গতকাল চট্টগ্রামের সন্ত্রাসবিরোধী ট্রাইব্যুনালের বিচারক বিশেষ জজ আবদুল হালিম এ রায় ঘোষণা করেন। একই রায়ে আদালত জাবেদ ইকবাল নামে আরেক জঙ্গিকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দিয়েছেন। মোট ৩২ জন সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে আদালত এই রায় ঘোষণা করেন। মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত মিজানুর রহমান পলাতক। তিনি নিষিদ্ধ ঘোষিত জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) বোমা বিশেষজ্ঞ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত জাবেদ ইকবাল জেএমবির আঞ্চলিক কমান্ডার ছিলেন। তিনি কারাগারে আছেন। রায় ঘোষণার সময় তাকে কারাগার থেকে হাজির করা হয়। সন্ত্রাসবিরোধী ট্রাইব্যুনালের পিপি মনোরঞ্জন দাশ বিষয়টি জানিয়েছেন।
জানা গেছে, বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বাধীন চার দলীয় জোট সরকারের আমলে ২০০৫ সালের ২৯ নভেম্বর সকালে চট্টগ্রাম আদালত ভবনের পুলিশ চেকপোস্টের সামনে বোমা হামলার ঘটনা ঘটে। এতে ঘটনাস্থলে মারা যান পুলিশ কনস্টেবল রাজীব বড়ুয়াসহ দুইজন। আহত হন পুলিশ কনস্টেবল আবু রায়হান, সামসুল কবির, রফিকুল ইসলাম ও আবদুল মজিদসহ ১০ জন। জেএমবি এ হামলার দায় স্বীকার করে। ঘটনার পরদিন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আত্মঘাতী হামলাকারী জঙ্গি মারা যান।
এ ঘটনায় কোতোয়ালি থানায় মামলা দায়েরের পর ২০০৬ সালের ১৮ মে পাঁচজনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে পুলিশ। ওই বছরের ১৬ জুলাই আসামিদের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগ গঠন করা হয়। আসামিদের মধ্যে শায়খ আবদুর রহমান, সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলা ভাই এবং আতাউর রহমান সানীর ভিন্ন মামলায় আগেই মত্যুদন্ড কার্যকর হয়েছে। এর ফলে তাদের বিচারিক কার্যক্রম থেকে বাদ দেয়া হয়।
এদিকে জাবেদ ইকবাল তার কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত হওয়ায় আদালত মৃত্যুদন্ডের পরিবর্তে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দিয়েছে বলে ঘোষিত রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে।
জেএমবির চট্টগ্রাম বিভাগীয় সাবেক কমান্ডার জাবেদ ইকবাল ‘অনুতপ্ত’ হওয়ায় ও আইনি প্রক্রিয়ায় সাহায্য করায় যাবজ্জীবন কারাদন্ড ও অর্থ দন্ড দেয়া হয়েছে বলে আদালত তার পর্যবেক্ষণে জানিয়েছে।
আদালত পর্যবেক্ষণে বলেছেন, আসামি জাবেদ ইকবাল মামলার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বিচার কাজে সহযোগিতা করেছে। ঘটনার সময় সে ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র। ঘটনার বিষয়ে অনুতপ্ত ছিল বলে আদালতকে জানিয়েছে। তা বিবেচনায় নিয়ে তাকে যাবজ্জীবন দেয়া হয়েছে। ওই হামলা বহুদিনের পরিকল্পিত ঘটনা। নীলনকশার পরিকল্পনা জাবেদ ইকবাল ও জাহিদুল ইসলাম মিজানসহ আসামিরা বাস্তবায়ন করেছে।
মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী খন্দকার আরিফুল ইসলাম বলেন, রায়ে আমরা পুরোপুরি সন্তুষ্ট নই। জাবেদকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেয়া হয়েছে। এই রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করবো। কারণ জাবেদ হামলার পরিকল্পনাকারী, সহায়তাকারী।
ট্রাইব্যুনাল সূত্র জানায়, গুরুত্বপূর্ণ এ মামলায় গত ৯ মার্চ সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়। ৭৭ জন সাক্ষীর মধ্যে ৩২ জনের সাক্ষ্য নেয়া হয়। এর আগে ২০১৬ সালের ১৮ মে জাবেদ ইকবালসহ ৫ জনের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দাখিল করা হয়। অন্য একটি মামলায় আবদুর রহমান, সিদ্দিকুর রহমান ওরফে বাংলা ভাই ও আতাউর রহমান নামের তিন আসামির ফাঁসির আদেশ হওয়ায় তাদের এ মামলা থেকে বাদ দেয়া হয়।
সেই বোমা হামলায় আহত এবং মামলার প্রথম তদন্ত কর্মকর্তা মাহফুজুর রহমান সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বলেছিলেন, তল্লাশি চৌকিতে ওই জঙ্গিকে থামার সংকেত দিতেই সে দুই পায়ে বাঁধা বোমার বিস্ফোরণ ঘটালে তার দুই পা উড়ে যায়। পরে সে মারা গিয়েছিল। পুলিশ সদস্য রাজীব বড়ুয়া এবং বিচারপ্রার্থী শাহাবুদ্দিন মারা যান। আরও অনেক পুলিশ সদস্য ও সাধারণ মানুষ আহত হন। বলা হয়, একুশ শতকের শুরুর দিকে পাকিস্তানি জঙ্গি সংগঠন লস্কর-ই-তৈইয়েবার কুখ্যাত জঙ্গি নসরুল্লাহর কাছ থেকে বোমা বানানোর প্রশিক্ষণ পেয়েছিলেন মিজান। পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে লস্কর-ই-তৈইয়েবার ক্যাম্পে তিনি প্রশিক্ষণ নেন এবং ভারতে বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের বোমা বিশেষজ্ঞদের সঙ্গেও তার যোগাযোগ ছিল। বোমা তৈরির দক্ষতার কারণেই সংগঠনে তার নাম হয় ‘বোমা মিজান’ বা ‘ বোমারু মিজান’। ত্রিশালের ঘটনার পর পালিয়ে ভারতে চলে যান মিজান। সেখানে জেএমবিকে সংগঠিত করে জঙ্গি তৎপরতা শুরু করেন। ২০১৪ সালের অক্টোবরে বর্ধমানের খাগড়াগড়ের বিস্ফোরণের পর আবারও মিজানের নাম আলোচনায় আসে। তারপর ২০১৮ সালের আগস্টে ভারতের বেঙ্গালুরুতে গ্রেপ্তার হন মিজান। বর্ধমান বিস্ফোরণের মামলায় চলতি বছরের ১০ ফেব্রুয়ারি তাকে ২৯ বছরের সাজা দেয় ভারতের একটি আদালত। এছাড়া দেশেও বিভিন্ন মামলায় মিজানের যাবজ্জীবন কারাদন্ডসহ বিভিন্ন মেয়াদে কারাদন্ডের রায় হয়েছে এর আগে।
জানা গেছে, জেএমবির আঞ্চলিক কমান্ডার জাবেদ ইকবাল ওরফে মহম্মদের সারাদেশে ৩০টির বেশি মামলায় প্রায় ৪০০ বছরের সাজা হয়েছে। আর মিজানুর রহমানকে ২০১৪ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি আদালতে হাজির করার সময় ময়মনসিংহের ত্রিশালে প্রিজনভ্যান থেকে ছিনতাই করে নেয় জঙ্গিরা।
সোমবার, ০৪ অক্টোবর ২০২১ , ১৯ আশ্বিন ১৪২৮ ২৫ সফর ১৪৪৩
জাবেদ ইকবালের যাবজ্জীবন
চট্টগ্রাম ব্যুরো
চট্টগ্রাম আদালত ভবনে ১৬ বছর আগে আত্মঘাতী বোমা হামলা মামলায় নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জেএমবির নেতা মিজানুর রহমানকে মৃত্যুদন্ড দিয়েছেন আদালত। গতকাল চট্টগ্রামের সন্ত্রাসবিরোধী ট্রাইব্যুনালের বিচারক বিশেষ জজ আবদুল হালিম এ রায় ঘোষণা করেন। একই রায়ে আদালত জাবেদ ইকবাল নামে আরেক জঙ্গিকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দিয়েছেন। মোট ৩২ জন সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে আদালত এই রায় ঘোষণা করেন। মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত মিজানুর রহমান পলাতক। তিনি নিষিদ্ধ ঘোষিত জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) বোমা বিশেষজ্ঞ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত জাবেদ ইকবাল জেএমবির আঞ্চলিক কমান্ডার ছিলেন। তিনি কারাগারে আছেন। রায় ঘোষণার সময় তাকে কারাগার থেকে হাজির করা হয়। সন্ত্রাসবিরোধী ট্রাইব্যুনালের পিপি মনোরঞ্জন দাশ বিষয়টি জানিয়েছেন।
জানা গেছে, বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বাধীন চার দলীয় জোট সরকারের আমলে ২০০৫ সালের ২৯ নভেম্বর সকালে চট্টগ্রাম আদালত ভবনের পুলিশ চেকপোস্টের সামনে বোমা হামলার ঘটনা ঘটে। এতে ঘটনাস্থলে মারা যান পুলিশ কনস্টেবল রাজীব বড়ুয়াসহ দুইজন। আহত হন পুলিশ কনস্টেবল আবু রায়হান, সামসুল কবির, রফিকুল ইসলাম ও আবদুল মজিদসহ ১০ জন। জেএমবি এ হামলার দায় স্বীকার করে। ঘটনার পরদিন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আত্মঘাতী হামলাকারী জঙ্গি মারা যান।
এ ঘটনায় কোতোয়ালি থানায় মামলা দায়েরের পর ২০০৬ সালের ১৮ মে পাঁচজনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে পুলিশ। ওই বছরের ১৬ জুলাই আসামিদের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগ গঠন করা হয়। আসামিদের মধ্যে শায়খ আবদুর রহমান, সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলা ভাই এবং আতাউর রহমান সানীর ভিন্ন মামলায় আগেই মত্যুদন্ড কার্যকর হয়েছে। এর ফলে তাদের বিচারিক কার্যক্রম থেকে বাদ দেয়া হয়।
এদিকে জাবেদ ইকবাল তার কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত হওয়ায় আদালত মৃত্যুদন্ডের পরিবর্তে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দিয়েছে বলে ঘোষিত রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে।
জেএমবির চট্টগ্রাম বিভাগীয় সাবেক কমান্ডার জাবেদ ইকবাল ‘অনুতপ্ত’ হওয়ায় ও আইনি প্রক্রিয়ায় সাহায্য করায় যাবজ্জীবন কারাদন্ড ও অর্থ দন্ড দেয়া হয়েছে বলে আদালত তার পর্যবেক্ষণে জানিয়েছে।
আদালত পর্যবেক্ষণে বলেছেন, আসামি জাবেদ ইকবাল মামলার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বিচার কাজে সহযোগিতা করেছে। ঘটনার সময় সে ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র। ঘটনার বিষয়ে অনুতপ্ত ছিল বলে আদালতকে জানিয়েছে। তা বিবেচনায় নিয়ে তাকে যাবজ্জীবন দেয়া হয়েছে। ওই হামলা বহুদিনের পরিকল্পিত ঘটনা। নীলনকশার পরিকল্পনা জাবেদ ইকবাল ও জাহিদুল ইসলাম মিজানসহ আসামিরা বাস্তবায়ন করেছে।
মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী খন্দকার আরিফুল ইসলাম বলেন, রায়ে আমরা পুরোপুরি সন্তুষ্ট নই। জাবেদকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেয়া হয়েছে। এই রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করবো। কারণ জাবেদ হামলার পরিকল্পনাকারী, সহায়তাকারী।
ট্রাইব্যুনাল সূত্র জানায়, গুরুত্বপূর্ণ এ মামলায় গত ৯ মার্চ সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়। ৭৭ জন সাক্ষীর মধ্যে ৩২ জনের সাক্ষ্য নেয়া হয়। এর আগে ২০১৬ সালের ১৮ মে জাবেদ ইকবালসহ ৫ জনের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দাখিল করা হয়। অন্য একটি মামলায় আবদুর রহমান, সিদ্দিকুর রহমান ওরফে বাংলা ভাই ও আতাউর রহমান নামের তিন আসামির ফাঁসির আদেশ হওয়ায় তাদের এ মামলা থেকে বাদ দেয়া হয়।
সেই বোমা হামলায় আহত এবং মামলার প্রথম তদন্ত কর্মকর্তা মাহফুজুর রহমান সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বলেছিলেন, তল্লাশি চৌকিতে ওই জঙ্গিকে থামার সংকেত দিতেই সে দুই পায়ে বাঁধা বোমার বিস্ফোরণ ঘটালে তার দুই পা উড়ে যায়। পরে সে মারা গিয়েছিল। পুলিশ সদস্য রাজীব বড়ুয়া এবং বিচারপ্রার্থী শাহাবুদ্দিন মারা যান। আরও অনেক পুলিশ সদস্য ও সাধারণ মানুষ আহত হন। বলা হয়, একুশ শতকের শুরুর দিকে পাকিস্তানি জঙ্গি সংগঠন লস্কর-ই-তৈইয়েবার কুখ্যাত জঙ্গি নসরুল্লাহর কাছ থেকে বোমা বানানোর প্রশিক্ষণ পেয়েছিলেন মিজান। পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে লস্কর-ই-তৈইয়েবার ক্যাম্পে তিনি প্রশিক্ষণ নেন এবং ভারতে বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের বোমা বিশেষজ্ঞদের সঙ্গেও তার যোগাযোগ ছিল। বোমা তৈরির দক্ষতার কারণেই সংগঠনে তার নাম হয় ‘বোমা মিজান’ বা ‘ বোমারু মিজান’। ত্রিশালের ঘটনার পর পালিয়ে ভারতে চলে যান মিজান। সেখানে জেএমবিকে সংগঠিত করে জঙ্গি তৎপরতা শুরু করেন। ২০১৪ সালের অক্টোবরে বর্ধমানের খাগড়াগড়ের বিস্ফোরণের পর আবারও মিজানের নাম আলোচনায় আসে। তারপর ২০১৮ সালের আগস্টে ভারতের বেঙ্গালুরুতে গ্রেপ্তার হন মিজান। বর্ধমান বিস্ফোরণের মামলায় চলতি বছরের ১০ ফেব্রুয়ারি তাকে ২৯ বছরের সাজা দেয় ভারতের একটি আদালত। এছাড়া দেশেও বিভিন্ন মামলায় মিজানের যাবজ্জীবন কারাদন্ডসহ বিভিন্ন মেয়াদে কারাদন্ডের রায় হয়েছে এর আগে।
জানা গেছে, জেএমবির আঞ্চলিক কমান্ডার জাবেদ ইকবাল ওরফে মহম্মদের সারাদেশে ৩০টির বেশি মামলায় প্রায় ৪০০ বছরের সাজা হয়েছে। আর মিজানুর রহমানকে ২০১৪ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি আদালতে হাজির করার সময় ময়মনসিংহের ত্রিশালে প্রিজনভ্যান থেকে ছিনতাই করে নেয় জঙ্গিরা।