ঘটনাচক্রে শিক্ষক

মাছুম বিল্লাহ

১৭ সেপ্টেম্বর মহান শিক্ষা দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের শিক্ষা ও মানবসম্পদবিষযক উপকমিটি আয়োজিত শিক্ষা : ২০৪১ সালের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের বাস্তবিক কৌশল’ শীর্ষক এক সেমিনারে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, “আমাদের শিক্ষকদের মধ্যে বড় একটা অংশ ঘটনাচক্রে শিক্ষক। অন্য কোন পেশায় অনেকেই যেতে পারেননি, শিক্ষকতা কোনদিন তারা চাননি। আমাদের প্রশিক্ষিত শিক্ষক প্রয়োজন। যিনি শিক্ষকতা পেশায় আসবেন তার জীবনের লক্ষ্যই হবে শিক্ষকতা পেশা। তিনি সেই লক্ষ্য নির্ধারণ করে আসবেন।’

একই দিনে ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের অন্য একটি আলোচনা সভায় বলেছেন যে, “বিশ^বিদ্যালয় প্রশাসনের দায়িত্বে যেসব শিক্ষক আছেন, তারা সেখানকার প্রভাবশালী ছাত্রনেতাদের কথায় উঠেন আর বসেন। প্রভাবশালীদের তদবিরে শিক্ষক নিয়োগ করা হয়।” ঘটনাচক্রে শিক্ষক অর্থাৎ অধিকাংশ শিক্ষিতরাই শিক্ষক হতে চাননা আবার যারা শিক্ষক হন তারা বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়েও থেকেও মেরুদন্ডহীন এবং ছাত্রনেতাদের কথায় ওঠেন আর বসেন। এ অবস্থা তো জতির জন্য চরম অবমাননাকর, দরম দুর্ভোগের কথা, চরম অবক্ষয়ের কথা। প্রাথমিক থেকে উচ্চ শিক্ষাস্তর পর্যন্ত শিক্ষার যে কি হাল সে কথা আমরা সবাই কমবেশি জানি। কিন্তু যারা সরকার পরিচালনা করেন তাদের মুখ থেকে এ ধরনের কথা শুনলে বিষয়গুলোকে যেন আরও ঘোলাটে মনে হয়। সরকার পরিচালনায় যারা থাকেন তারা তো এসব সমস্যা সমাধানের জন্যই ওইসব পদে আছেন, তারা প্রকৃতঅর্থে রাষ্ট্রের এবং প্রতিটি দপ্তর ও বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত অভিভাবক।

আমেরিকার এক গবেষণায় দেখা যায়, মানসম্মত শিক্ষার ২০ শতাংশ নির্ভর করে শিক্ষার অনুকূল পরিবেশ এবং অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধার ওপর। কিন্তু মানসম্মত শিক্ষার শতকরা ৮০ ভাগ নির্ভর করে শিক্ষকের ওপর। একজন যোগ্য শিক্ষক গাছতলায় বসেও মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে পারেন। তার মানে হচেছ প্রকৃত শিক্ষকরা সমাজকে পরিবর্তন করতে পারেন। এখন আমরা যদি তা না চাই তাহলে তো মানসম্মত শিক্ষকও চাব না, মানসম্মত শিক্ষাও চাব না। ইউনেস্কো কর্র্তৃক পরিচালিত জরিপে দেখা যায় আন্তর্জাতিক মানদন্ডে বাংলাদেশের শিক্ষার মান ২.৮ শতাংশ, ভারত ও শ্রীলঙ্কায় ২০.৮ শতাংশ এবং পাকিস্তানে ১১.৩ শতাংশ। এ নিয়ে কি আমাদের কোন চিন্তা কিংবা উদ্বেগ আছে? আমাদের শিক্ষক নিয়োগ কীভাবে হয়ে আসছে আমরা কি তা জানি না? আমরা কি সেই ব্যবস্থার সঙ্গে পরিচিত নই? সেজন্য কেউ এককভাবে তো দায়ী নয়। সেজন্য শিক্ষকদের দায়ী করলে আমরা দায় এড়াতে পারি?

শিক্ষকরা তো সমাজের বাইরের কেউ নন, তারা তো এই সমাজেরই অংশ। এই সমাজ যখন চায় শিক্ষক নিয়োগ দিবেন যাদের পেশীশক্তি আছে তারা, যারা তাদের সঙ্গে সখ্যতা গড়তে পারবেন তারা হবেন শিক্ষক, অধ্যক্ষ, শিক্ষা প্রশাসক, ভাইস-চ্যান্সেলর ইত্যাদি। তাহলে শুধু শিক্ষকদের দোষ কোথায়? তাদের তো জীবিকা নির্বাহ করতে হবে, তাদের তো বেঁচে থাকতে হবে। বিভিন্ন বাহিনীতে চাকরি করেন উপরোস্থদের অস্ত্রধারী বাহিনী তাদের স্কট করে রাখেন, গাড়িতে পাহাড়া দিয়ে কোথাও নিয়ে যান, তাদের গাড়ির সামনে পেছনে অস্ত্রধারী ও পোশাকধারী বাহিনী থাকেন। এমনকি সিভিল প্রশাসনেও উপরোস্থদের নিরাপত্তার জন্য গানম্যান থাকেন। কিন্তু আমাদের অধ্যক্ষদের, ভিসিদের কি অবস্থা? তারা যদি আইনানুগ কোন কাজ করতে যান তারা কি তা করতে পারেন জীবনের ভয়ে? পেশীশক্তির অধিকারীরা তাদের সামান্যতম বিরুদ্ধে কোন সিদ্ধান্ত গেলেই তো সঙ্গে সঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়েন ঐসব শিক্ষক, অধ্যক্ষ ও ভিসিদের ওপর। আমরা কি রাষ্ট্র থেকে তাদের কোন নিরাপত্তা দিয়ে থাকি? ধরা হয় সভ্য সমাজে শিক্ষকদের, শিক্ষক প্রশাসকদের অন্যান্য বাহিনী কিংবা প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের মতো অস্ত্রধারী গার্ড বা রক্ষক থাকার দরকার নেই। কিন্তু আমরা সে করম সভ্য হয়েছি? কলেজ ও বিশ^বিদ্যালয়গুলোতে যারা শিক্ষকদের ওপর চড়াও হন, তাদের কথামতো কাজ না করেন তারা কি ক্যাম্পাসে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে টিকে থাকতে পারেন? তাদের কি কেউ কখনও সত্যিকারার্থে সাপোর্ট দেন? নিরাপত্তা দেন? তাদের বিরুদ্ধে কেউ কিছু করলে এমনকি হত্যার হুমকি দিলেও তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা কি নেয়া হয়? এগুলো তো সবাই আমরা জানি, তাহলে শুধু শিক্ষকদের দোষ দিয়ে কি লাভ?

আমরা যদি আসলেই চাই যে, দলমতের ঊর্ধ্বে থাকবে যোগ্যতা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পবিত্র স্থান, জাতি গড়ার কারখানা ... এ কারখানাগুলোকে তথাকথিত রাজনীতি থেকে মুক্ত রাখতে হবে, তাহলে কি- তা আমরা করতে পারি না? আমরা যদি চাই, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা হবে, গবেষণা হবে, মানুষ তৈরি হবে, বিজ্ঞানী সৃষ্টি হবে, শিক্ষক সৃষ্টি হবেন, প্রকৃত রাজনীতিক তৈরি হবেন, তাহলে আমরা তা করতে পারি না? আমরা চাই কি না সেখানেই প্রশ্ন। হয়তো চাইলেও একদিনে বা দ্রুত সম্ভব নয় কারণ যে ব্যধি সৃষ্টি হয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শরীরে ও মনে, সেই ব্যধি সারানো একদিনে সম্ভব নয়। কিন্তু আগে তো তা চাইতে হবে। আমরা যদি চাই শিক্ষকরা, প্রশাসকরা বিধি অনুযায়ী কাজ করবেন, তাদের কোন ছাত্র সংগঠন কোন ধরনের বাঁধা সৃষ্টি করতে পারবে না। কেউ করলে সঙ্গে সঙ্গে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে যা হবে না লোক দেখানো। তাহলে তো পরিবর্তন অন্তত শুরু হবে। সেই শুরুটা কি আমরা করতে পারি না?

ক্যাডার সার্ভিসে যারা চাকরি করেন তারা কি সবাই সন্তষ্ট? তারাও অনেকে কেউ কেউ ঘটনাচক্রে পোস্টাল ক্যাডার কিংবা সমবায় ক্যাডার। ক্যাডারের যত মজা সব প্রশাসন, ফরেন ক্যাডারে আর পুলিশ ক্যাডারে। বাকি ক্যাডাররা তো ঘটনাচক্রে ঐসব ক্যাডার। তারাও তো ডিসি হতে চেয়েছিলেন, সচিব হতে চেয়েছিলেন। লেখাপড়া করে সবাইকেই প্রশাসন, ফরেন কিংবা পুলিশ ক্যাডারে যেতে হবে, বাকিগুলোর কোন দাম নেই? বাকিগুলোকে অবহেলা করতে হবে যে, যারা ভালো করেছে তারাই এই তিনটি ক্যাডারে আছেন, বাকিরা কোন কাজের নয় বা তাদের মেধা নেই? প্রচলিত পদ্ধতিতে কিংবা যে কোন পদ্ধতিতেই হোক না কেন সঠিক মূল্যায়ন কি সব সময় হয়? সব মেধাবীরাই প্রশাসন আর পুলিশ ক্যাডারে, বাকিদের মেধা নেই সেটিও কি আমরা হলফ করে বলতে পারি? একইভাবে, অন্য চাকরি না পেয়ে অনেকে শিক্ষক হয়েছেন, এই কথা কি আমরা বলতে পারি? মেধা থাকে ঘুমন্ত, তাকে জাগানো সব পরিবেশে, সব অবস্থায় সম্ভব নয়। আমরা মানবিক যেসব পদ্ধতি প্রয়োগ করে যাদেরকে মেধাবী বলি, তারা সব সময় সেটি নাও হতে পারে। তাই যে অবস্থায়ই হোক না কেন শিক্ষকতা পেশায় ঢুকেছেন, তাদের উন্নত করতে হবে, যুগোপযোগী করতে হবে, এটি দেশ, সমাজ ও রাষ্ট্রের দায়িত্ব। দেশের বৃহত্তর কল্যাণেই তা করতে হবে। কারণ একটি দেশের শিক্ষায় প্রকৃত পরিবর্তন আসলে অন্য সবক্ষেত্রে পজিটিভ পরিবর্তন আসবে।

শিক্ষকতা পেশায় প্রকৃতপক্ষে যাদের প্রয়োজন তারাই যাতে শিক্ষকতায় আসেন রাষ্ট্রকেই সেই ব্যবস্থা নিতে হবে। শিক্ষা ক্ষেত্রে যে অবস্থা বিরাজ করছে সেটি একদিনে হয়নি, কিন্তু এর সমাধান প্রয়োজন। সেই প্রয়োজনে সরকারকে যেমন নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে পুরো বিষয়টিকে পুনর্নির্মাণে এগিয়ে আসতে হবে, তেমনি গোটা শিক্ষক সমাজকে আপাত লাভের দিকে না তাকিয়ে প্রকৃত পেশাদারিত্বের মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে চরম অবক্ষয়ের হাত থেকে শিক্ষাকে রক্ষার জন্য। এটি আমাদের পবিত্র দায়িত্ব।

[লেখক : ব্যাক শিক্ষা কর্মসূচিতে কর্মরত]

সোমবার, ০৪ অক্টোবর ২০২১ , ১৯ আশ্বিন ১৪২৮ ২৫ সফর ১৪৪৩

ঘটনাচক্রে শিক্ষক

মাছুম বিল্লাহ

১৭ সেপ্টেম্বর মহান শিক্ষা দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের শিক্ষা ও মানবসম্পদবিষযক উপকমিটি আয়োজিত শিক্ষা : ২০৪১ সালের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের বাস্তবিক কৌশল’ শীর্ষক এক সেমিনারে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, “আমাদের শিক্ষকদের মধ্যে বড় একটা অংশ ঘটনাচক্রে শিক্ষক। অন্য কোন পেশায় অনেকেই যেতে পারেননি, শিক্ষকতা কোনদিন তারা চাননি। আমাদের প্রশিক্ষিত শিক্ষক প্রয়োজন। যিনি শিক্ষকতা পেশায় আসবেন তার জীবনের লক্ষ্যই হবে শিক্ষকতা পেশা। তিনি সেই লক্ষ্য নির্ধারণ করে আসবেন।’

একই দিনে ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের অন্য একটি আলোচনা সভায় বলেছেন যে, “বিশ^বিদ্যালয় প্রশাসনের দায়িত্বে যেসব শিক্ষক আছেন, তারা সেখানকার প্রভাবশালী ছাত্রনেতাদের কথায় উঠেন আর বসেন। প্রভাবশালীদের তদবিরে শিক্ষক নিয়োগ করা হয়।” ঘটনাচক্রে শিক্ষক অর্থাৎ অধিকাংশ শিক্ষিতরাই শিক্ষক হতে চাননা আবার যারা শিক্ষক হন তারা বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়েও থেকেও মেরুদন্ডহীন এবং ছাত্রনেতাদের কথায় ওঠেন আর বসেন। এ অবস্থা তো জতির জন্য চরম অবমাননাকর, দরম দুর্ভোগের কথা, চরম অবক্ষয়ের কথা। প্রাথমিক থেকে উচ্চ শিক্ষাস্তর পর্যন্ত শিক্ষার যে কি হাল সে কথা আমরা সবাই কমবেশি জানি। কিন্তু যারা সরকার পরিচালনা করেন তাদের মুখ থেকে এ ধরনের কথা শুনলে বিষয়গুলোকে যেন আরও ঘোলাটে মনে হয়। সরকার পরিচালনায় যারা থাকেন তারা তো এসব সমস্যা সমাধানের জন্যই ওইসব পদে আছেন, তারা প্রকৃতঅর্থে রাষ্ট্রের এবং প্রতিটি দপ্তর ও বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত অভিভাবক।

আমেরিকার এক গবেষণায় দেখা যায়, মানসম্মত শিক্ষার ২০ শতাংশ নির্ভর করে শিক্ষার অনুকূল পরিবেশ এবং অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধার ওপর। কিন্তু মানসম্মত শিক্ষার শতকরা ৮০ ভাগ নির্ভর করে শিক্ষকের ওপর। একজন যোগ্য শিক্ষক গাছতলায় বসেও মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে পারেন। তার মানে হচেছ প্রকৃত শিক্ষকরা সমাজকে পরিবর্তন করতে পারেন। এখন আমরা যদি তা না চাই তাহলে তো মানসম্মত শিক্ষকও চাব না, মানসম্মত শিক্ষাও চাব না। ইউনেস্কো কর্র্তৃক পরিচালিত জরিপে দেখা যায় আন্তর্জাতিক মানদন্ডে বাংলাদেশের শিক্ষার মান ২.৮ শতাংশ, ভারত ও শ্রীলঙ্কায় ২০.৮ শতাংশ এবং পাকিস্তানে ১১.৩ শতাংশ। এ নিয়ে কি আমাদের কোন চিন্তা কিংবা উদ্বেগ আছে? আমাদের শিক্ষক নিয়োগ কীভাবে হয়ে আসছে আমরা কি তা জানি না? আমরা কি সেই ব্যবস্থার সঙ্গে পরিচিত নই? সেজন্য কেউ এককভাবে তো দায়ী নয়। সেজন্য শিক্ষকদের দায়ী করলে আমরা দায় এড়াতে পারি?

শিক্ষকরা তো সমাজের বাইরের কেউ নন, তারা তো এই সমাজেরই অংশ। এই সমাজ যখন চায় শিক্ষক নিয়োগ দিবেন যাদের পেশীশক্তি আছে তারা, যারা তাদের সঙ্গে সখ্যতা গড়তে পারবেন তারা হবেন শিক্ষক, অধ্যক্ষ, শিক্ষা প্রশাসক, ভাইস-চ্যান্সেলর ইত্যাদি। তাহলে শুধু শিক্ষকদের দোষ কোথায়? তাদের তো জীবিকা নির্বাহ করতে হবে, তাদের তো বেঁচে থাকতে হবে। বিভিন্ন বাহিনীতে চাকরি করেন উপরোস্থদের অস্ত্রধারী বাহিনী তাদের স্কট করে রাখেন, গাড়িতে পাহাড়া দিয়ে কোথাও নিয়ে যান, তাদের গাড়ির সামনে পেছনে অস্ত্রধারী ও পোশাকধারী বাহিনী থাকেন। এমনকি সিভিল প্রশাসনেও উপরোস্থদের নিরাপত্তার জন্য গানম্যান থাকেন। কিন্তু আমাদের অধ্যক্ষদের, ভিসিদের কি অবস্থা? তারা যদি আইনানুগ কোন কাজ করতে যান তারা কি তা করতে পারেন জীবনের ভয়ে? পেশীশক্তির অধিকারীরা তাদের সামান্যতম বিরুদ্ধে কোন সিদ্ধান্ত গেলেই তো সঙ্গে সঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়েন ঐসব শিক্ষক, অধ্যক্ষ ও ভিসিদের ওপর। আমরা কি রাষ্ট্র থেকে তাদের কোন নিরাপত্তা দিয়ে থাকি? ধরা হয় সভ্য সমাজে শিক্ষকদের, শিক্ষক প্রশাসকদের অন্যান্য বাহিনী কিংবা প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের মতো অস্ত্রধারী গার্ড বা রক্ষক থাকার দরকার নেই। কিন্তু আমরা সে করম সভ্য হয়েছি? কলেজ ও বিশ^বিদ্যালয়গুলোতে যারা শিক্ষকদের ওপর চড়াও হন, তাদের কথামতো কাজ না করেন তারা কি ক্যাম্পাসে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে টিকে থাকতে পারেন? তাদের কি কেউ কখনও সত্যিকারার্থে সাপোর্ট দেন? নিরাপত্তা দেন? তাদের বিরুদ্ধে কেউ কিছু করলে এমনকি হত্যার হুমকি দিলেও তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা কি নেয়া হয়? এগুলো তো সবাই আমরা জানি, তাহলে শুধু শিক্ষকদের দোষ দিয়ে কি লাভ?

আমরা যদি আসলেই চাই যে, দলমতের ঊর্ধ্বে থাকবে যোগ্যতা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পবিত্র স্থান, জাতি গড়ার কারখানা ... এ কারখানাগুলোকে তথাকথিত রাজনীতি থেকে মুক্ত রাখতে হবে, তাহলে কি- তা আমরা করতে পারি না? আমরা যদি চাই, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা হবে, গবেষণা হবে, মানুষ তৈরি হবে, বিজ্ঞানী সৃষ্টি হবে, শিক্ষক সৃষ্টি হবেন, প্রকৃত রাজনীতিক তৈরি হবেন, তাহলে আমরা তা করতে পারি না? আমরা চাই কি না সেখানেই প্রশ্ন। হয়তো চাইলেও একদিনে বা দ্রুত সম্ভব নয় কারণ যে ব্যধি সৃষ্টি হয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শরীরে ও মনে, সেই ব্যধি সারানো একদিনে সম্ভব নয়। কিন্তু আগে তো তা চাইতে হবে। আমরা যদি চাই শিক্ষকরা, প্রশাসকরা বিধি অনুযায়ী কাজ করবেন, তাদের কোন ছাত্র সংগঠন কোন ধরনের বাঁধা সৃষ্টি করতে পারবে না। কেউ করলে সঙ্গে সঙ্গে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে যা হবে না লোক দেখানো। তাহলে তো পরিবর্তন অন্তত শুরু হবে। সেই শুরুটা কি আমরা করতে পারি না?

ক্যাডার সার্ভিসে যারা চাকরি করেন তারা কি সবাই সন্তষ্ট? তারাও অনেকে কেউ কেউ ঘটনাচক্রে পোস্টাল ক্যাডার কিংবা সমবায় ক্যাডার। ক্যাডারের যত মজা সব প্রশাসন, ফরেন ক্যাডারে আর পুলিশ ক্যাডারে। বাকি ক্যাডাররা তো ঘটনাচক্রে ঐসব ক্যাডার। তারাও তো ডিসি হতে চেয়েছিলেন, সচিব হতে চেয়েছিলেন। লেখাপড়া করে সবাইকেই প্রশাসন, ফরেন কিংবা পুলিশ ক্যাডারে যেতে হবে, বাকিগুলোর কোন দাম নেই? বাকিগুলোকে অবহেলা করতে হবে যে, যারা ভালো করেছে তারাই এই তিনটি ক্যাডারে আছেন, বাকিরা কোন কাজের নয় বা তাদের মেধা নেই? প্রচলিত পদ্ধতিতে কিংবা যে কোন পদ্ধতিতেই হোক না কেন সঠিক মূল্যায়ন কি সব সময় হয়? সব মেধাবীরাই প্রশাসন আর পুলিশ ক্যাডারে, বাকিদের মেধা নেই সেটিও কি আমরা হলফ করে বলতে পারি? একইভাবে, অন্য চাকরি না পেয়ে অনেকে শিক্ষক হয়েছেন, এই কথা কি আমরা বলতে পারি? মেধা থাকে ঘুমন্ত, তাকে জাগানো সব পরিবেশে, সব অবস্থায় সম্ভব নয়। আমরা মানবিক যেসব পদ্ধতি প্রয়োগ করে যাদেরকে মেধাবী বলি, তারা সব সময় সেটি নাও হতে পারে। তাই যে অবস্থায়ই হোক না কেন শিক্ষকতা পেশায় ঢুকেছেন, তাদের উন্নত করতে হবে, যুগোপযোগী করতে হবে, এটি দেশ, সমাজ ও রাষ্ট্রের দায়িত্ব। দেশের বৃহত্তর কল্যাণেই তা করতে হবে। কারণ একটি দেশের শিক্ষায় প্রকৃত পরিবর্তন আসলে অন্য সবক্ষেত্রে পজিটিভ পরিবর্তন আসবে।

শিক্ষকতা পেশায় প্রকৃতপক্ষে যাদের প্রয়োজন তারাই যাতে শিক্ষকতায় আসেন রাষ্ট্রকেই সেই ব্যবস্থা নিতে হবে। শিক্ষা ক্ষেত্রে যে অবস্থা বিরাজ করছে সেটি একদিনে হয়নি, কিন্তু এর সমাধান প্রয়োজন। সেই প্রয়োজনে সরকারকে যেমন নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে পুরো বিষয়টিকে পুনর্নির্মাণে এগিয়ে আসতে হবে, তেমনি গোটা শিক্ষক সমাজকে আপাত লাভের দিকে না তাকিয়ে প্রকৃত পেশাদারিত্বের মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে চরম অবক্ষয়ের হাত থেকে শিক্ষাকে রক্ষার জন্য। এটি আমাদের পবিত্র দায়িত্ব।

[লেখক : ব্যাক শিক্ষা কর্মসূচিতে কর্মরত]