আদিবাসী-হরিজনরাও মানুষ

মিথুশিলাক মুরমু

দেশের আদিবাসী-অন্ত্যজ জনগোষ্ঠী প্রায়শই বৈষম্যের শিকার হয়ে থাকেন। বৈষম্যের মধ্যে বসবাস করতে করতে তাদের হৃদয় অনেকটা পাথর হয়ে গেছে। হাটবাজারে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যখন চরমভাবে বৈষম্য-অবহেলার মুখোমুখি হন তখন তাদের মন ভেঙে যায়, নিজেদের মানুষ হিসেবে চিন্তা করতে কষ্ট হয়ে থাকে। এই অবস্থায় ইতিহাস থেকে শক্তি সঞ্চয় করা জরুরি। সবচেয়ে বড় উদাহরণগুলো পাশর্^বর্তী দেশ ভারতেই। সদ্য স্বাধীন দেশের সংবিধানপ্রণেতা ড. বি.আর. আম্বেদকর, সাবেক রাষ্ট্রপতি আর. কে নারায়ণ, বর্তমান রাষ্ট্রপতি রামানাথ কোবিন্দও হরিজন বা অচ্ছুৎ শ্রেণী থেকেই ক্ষমতা ও সম্মানের সর্বোচ্চ শিখরে আরোহণ করেছেন। পৃথিবীর ক্ষমতাধর রাষ্ট্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একদা হোটেল রেস্তোরাঁর প্রবেশদ্বারে লেখা থাকতো-Blacks and dogs are not allowed অর্থাৎ কৃষ্ণাঙ্গ এবং কুকুরের প্রবেশ নিষিদ্ধ। রেভারেন্ড মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র যুগতীর্ণ আন্দোলন এবং সচেতনতা গড়ে তোলার মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে সাদা-কালোর বৈষম্য ক্রমশই শিথিল হয়েছে। এদেশেও অনেকে লড়াই করে সমাজে টিকে আছেন। মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে আমাদের অর্থনৈতিক চাকাকে সচল করতে সর্বস্তরের মানুষের প্রচেষ্টা প্রশংসার দাবিদার কিন্তু হৃদয়ের মধ্যে থাকা মানুষে মানুষের যে বৈষম্য বিদ্যমান; সেটির মুলোৎপাটন করতে ব্যর্থ হলে, উন্নয়ন ভেস্তে যাবে।

খসড়া ‘বৈষম্য বিলোপ আইন, ২০১৪’-এর সংজ্ঞাতে উল্লেখ রয়েছেÑ১. কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক ধর্ম, বর্ণ, বয়স, নারী-পুরুষ, শারীরিক-মানসিক ও লিঙ্গ প্রতিবন্ধী, জন্মস্থান, জন্ম ও পেশার এবং অস্পৃশ্যতার অজুহাতে কৃত সর্বপ্রকার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ বৈষম্যমূলক কার্যাবলী বেআইনি এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ হইবে। নিম্নোক্ত কার্যাবলী বৈষম্যমূলক মর্মে গণ্য হবে: (ক) কোন বিশেষ ধর্ম পালন করা বা আদৌ কোন পালন না করার অজুহাতে কোন প্রকার অধিকার ভোগে বাধা প্রদান করা; (খ) সেবা লাভের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা; (গ) যে কোন প্রকারের শিক্ষা ও চিকিৎসা গ্রহণে এবং কর্ম প্রাপ্তিতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা; (ঘ) লিঙ্গ প্রতিবন্ধী হওয়ার অজুহাতে কোন শিশুকে পরিবারে প্রতিপালন না করিয়া বিশেষ কোন গোষ্ঠীর নিকট হস্তান্তর করা; (ঙ) লিঙ্গ প্রতিবন্ধী হওয়ার এবং পিতৃপরিচয় প্রদানে অসমর্থতার অজুহাতে শিশুকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তিতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন, শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করা এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হইতে বহিষ্কার করা; (চ) লিঙ্গ প্রতিবন্ধীগণকে পরিবারে বসবাসে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা; (ছ) লিঙ্গ প্রতিবন্ধীগণকে সম্পত্তিতে উত্তরাধিকার লাভ করা; (জ) কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক ধর্ম, বর্ণ, শিশু, নারীপুরুষ, শারীরিক-মানসিক ও লিঙ্গ প্রতিবন্ধী, জন্মস্থান, জন্ম ও পেশা, অস্পৃশ্যতার অজুহাতে জনস্থল, সর্বজনীন উৎসব, নিজ ধর্মীয় উপাসনালয়ে প্রবেশ ও অংশগ্রহণে বাধা প্রধান করা। ঐতিহাসিক মুক্তি সংগ্রামের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ একটি শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা এবং অন্যান্য মৌলিক অধিকারের সহিত মানবাধিকার ও সামাজিক সাম্য নিশ্চিত করিবার অঙ্গীকার রয়েছে, সংবিধানে প্রদত্ত উক্তরূপ প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে সর্বপ্রকার বৈষম্য বিলোপকল্পে বিধান করা সমীচীন ও প্রয়োজনও বটে।

একটি জাতীয় দৈনিকে ১ অক্টোবর “হরিজন’ তাই রেস্তোরাঁয় বসে খেতে বারণ” শিরোনামে খবর প্রকাশিত হয়েছে। ঘটনাটি ঘটেছে উত্তরাঞ্চলের জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমনূরা রেলওয়ে জংশন এলাকায়। রেস্তোরাঁর মালিক বলেছেন, ‘সংখ্যাগরিষ্ঠ গ্রাহকদের আপত্তির কারণে জেলার রেস্তোরাঁগুলোতে হরিজন সম্প্রদায়ের সদস্যদের ঢুকতে দেয়া হয় না।’ দীপক ভূঁইমালী আমনূরা কেএম উচ্চবিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীর ছাত্র। সহপাঠীদের সঙ্গে বিদ্যালয়ের আসনে পাশাপাশি বসে ও মাঠে খেলাধুলা করে কিন্তু বিপত্তি বাধে বন্ধুদের সঙ্গে রেস্তোরাঁয় খাবার খেতে গেলেই। দীপকদের পরিবার হরিজন সম্প্রদায়ের। স্থানীয় রেস্তোরাঁর মালিকরা তাকে ও তার পরিবারকে জানে ও চেনে। হরিজন সম্প্রদায়ের হওয়ার কারণেই রেস্তোরাঁর মালিকেরা বসে খাবার খেতে দেন না। মালিকদের ঘোর আপত্তি রয়েছে। হরিজন কলোনীর মুরব্বি শিবরাজ বাঁশফোঁড় ও চঞ্চলী ভূঁইমালী। কলোনীতে প্রায় ১৫টির অধিক পরিবার বসবাস করে।

দীপকের সম্পর্কে শিবরাজ বাঁশফোঁড় জানান, দীপক আমনূরা দলের হয়ে জেলার ক্রিকেট লীগে অংশ নিয়েছেন। উপজেলার বাইরে গিয়েও দলের সদস্যদের সঙ্গে রেস্তোরাঁয় খেয়েছেন; থেকেছেন কিন্ত সর্বদা শুধু নিজ এলাকাতেই সমস্যায় পড়তে হয়। একই জেলার নাচোল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে কাজ করেন সঞ্জয় দত্ত গঙ্গাপুত্র। তিনি জানান, স্থানীয় এক রেস্তোরাঁয় তার খাবার খাওয়ার সুযোগ হয়েছিল কিন্তু বের হওয়ার সময় রেস্তোরাঁ মালিক ডেকে বলেছিলেন, ‘কর্মচারীরা তোমাকে চিনতে পারেনি বলে ভুল করে খাবার দিয়েছে। এরপর থেকে আর আসবে না।’

সঞ্জয় দত্ত গঙ্গাপুত্র এ ঘটনার পর রেস্তোরাঁয় বসে খাবার অধিকার নিশ্চিত করতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কাছে লিখিত আবেদন করেন। ইউএনও সাবিহা সুলতানা রেস্তোরাঁর মালিকদের ডেকে বৈঠক করেন। এরপর কিছু রেস্তোরাঁয় বসে খাওয়া গেলেও অনেকে ঢুকতে দেন না। ক্ষোভের সঙ্গেই বাংলাদেশ হরিজন ঐক্য পরিষদের চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা শাখার সভাপতি রাজেন হরিজন বলেছেন, হরিজন সম্প্রদায়ের ছেলেমেয়েরা কিছু খাওয়ার ইচ্ছা হলেও রেস্তোরাঁয় গিয়ে খেতে পারে না। গোটা জেলাতেই একই অবস্থা। ইউএনও সাবিহা সুলতানা যে উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন, সেটিকে ফলোআপ করা প্রয়োজন। সত্যিকারভাবেই এক সময় মানুষের চেতনা আসে যে, স্র্রষ্টার সৃষ্টি মানুষের মধ্যে ভেদাভেদ তৈরি করা স্রষ্টারই বিরুদ্ধচারণ করা। ঈশ^র আশরাফুল মাকলুকাত হিসেবে আমাদের সৃষ্টি করেছেন, প্রাণ বায়ু দিয়েছেন। ভেদাভেদের জন্ম মানুষের দ্বারাই কৃত্রিমভাবে সৃষ্ট। সমাজ, রাষ্ট্র থেকে বৈষম্যকে বিতাড়নে প্রশাসনকেই এগিয়ে আসতে হবে। দেশের সর্বোচ্চ আইন সংবিধানে মানুষকে মানুষ হিসেবেই চিহ্নিত করেছে, মর্যাদা দিয়েছে।

মানুষে মানুষে ভেদাভেদ নিরসনে স্থানীয় মেম্বার-চেয়ারম্যান, উপজেলা চেয়ারম্যান এ বিষয়ে ব্যাপক সচেতনতা গড়ে তুলতে পারেন। ডিসি, ওসি, ইউএনও বিষয়টি সতর্কভাবে তদারকি করতে পারেন। স্কুল, কলেজ এবং আর্থ-সামাজিক প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা অগ্রগণ্য হওয়া আবশ্যক।

মহান মুক্তিযুদ্ধে জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণ ছিল। সংবিধানের প্রস্তবনায় উল্লিখিত আছে, ‘...গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠাÑ যেখানে সব নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে’। নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারবিষয়ক আন্তর্জাতিক চুক্তির ৬.১-এ বর্ণিত রয়েছে-‘ প্রত্যেক মানুষের বাঁচার সহজাত অধিকার রয়েছে। এ অধিকার আইনের দ্বারা রক্ষিত হবে। কোন ব্যক্তিকে খেয়াল খুশিমতো জীবন থেকে বঞ্চিত করা যাবে না।’ মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণাপত্র-এর ১ ধারায় রয়েছেÑ ‘সব মানুষই (শৃঙ্খলহীন) স্বাধীন অবস্থায় এবং সম-মর্যাদা ও অধিকার নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। তারা সবাই বুদ্ধি ও বিবেকের অধিকারী। অতএব, তাদের একে অন্যের প্রতি ভ্রাতৃসুলভ আচরণ করা উচিত।’

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে সাদা-কালো বৈষম্যকে উৎখাত করতে ‘আমরা করব জয়’ গানটি জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। আজো অধিকারহারা মানুষের হৃদয়কে গানটি আন্দোলিত করে তোলে। ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র থেকে বৈষম্যের বেড়াজালকে ছিন্ন করতে আসুন কণ্ঠ মেলাইÑ

আমরা করব জয়, আমরা করব জয়/ আমরা করব জয় নিশ্চয়।/ আহা বুকের গভীর, আছে প্রত্যয়,/আমরা করব জয় নিশ্চয়। আমরা করব জয়, আমরা করব জয়/আমরা করব জয় নিশ্চয়।

বৃহস্পতিবার, ০৭ অক্টোবর ২০২১ , ২২ আশ্বিন ১৪২৮ ২৮ সফর ১৪৪৩

আদিবাসী-হরিজনরাও মানুষ

মিথুশিলাক মুরমু

দেশের আদিবাসী-অন্ত্যজ জনগোষ্ঠী প্রায়শই বৈষম্যের শিকার হয়ে থাকেন। বৈষম্যের মধ্যে বসবাস করতে করতে তাদের হৃদয় অনেকটা পাথর হয়ে গেছে। হাটবাজারে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যখন চরমভাবে বৈষম্য-অবহেলার মুখোমুখি হন তখন তাদের মন ভেঙে যায়, নিজেদের মানুষ হিসেবে চিন্তা করতে কষ্ট হয়ে থাকে। এই অবস্থায় ইতিহাস থেকে শক্তি সঞ্চয় করা জরুরি। সবচেয়ে বড় উদাহরণগুলো পাশর্^বর্তী দেশ ভারতেই। সদ্য স্বাধীন দেশের সংবিধানপ্রণেতা ড. বি.আর. আম্বেদকর, সাবেক রাষ্ট্রপতি আর. কে নারায়ণ, বর্তমান রাষ্ট্রপতি রামানাথ কোবিন্দও হরিজন বা অচ্ছুৎ শ্রেণী থেকেই ক্ষমতা ও সম্মানের সর্বোচ্চ শিখরে আরোহণ করেছেন। পৃথিবীর ক্ষমতাধর রাষ্ট্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একদা হোটেল রেস্তোরাঁর প্রবেশদ্বারে লেখা থাকতো-Blacks and dogs are not allowed অর্থাৎ কৃষ্ণাঙ্গ এবং কুকুরের প্রবেশ নিষিদ্ধ। রেভারেন্ড মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র যুগতীর্ণ আন্দোলন এবং সচেতনতা গড়ে তোলার মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে সাদা-কালোর বৈষম্য ক্রমশই শিথিল হয়েছে। এদেশেও অনেকে লড়াই করে সমাজে টিকে আছেন। মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে আমাদের অর্থনৈতিক চাকাকে সচল করতে সর্বস্তরের মানুষের প্রচেষ্টা প্রশংসার দাবিদার কিন্তু হৃদয়ের মধ্যে থাকা মানুষে মানুষের যে বৈষম্য বিদ্যমান; সেটির মুলোৎপাটন করতে ব্যর্থ হলে, উন্নয়ন ভেস্তে যাবে।

খসড়া ‘বৈষম্য বিলোপ আইন, ২০১৪’-এর সংজ্ঞাতে উল্লেখ রয়েছেÑ১. কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক ধর্ম, বর্ণ, বয়স, নারী-পুরুষ, শারীরিক-মানসিক ও লিঙ্গ প্রতিবন্ধী, জন্মস্থান, জন্ম ও পেশার এবং অস্পৃশ্যতার অজুহাতে কৃত সর্বপ্রকার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ বৈষম্যমূলক কার্যাবলী বেআইনি এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ হইবে। নিম্নোক্ত কার্যাবলী বৈষম্যমূলক মর্মে গণ্য হবে: (ক) কোন বিশেষ ধর্ম পালন করা বা আদৌ কোন পালন না করার অজুহাতে কোন প্রকার অধিকার ভোগে বাধা প্রদান করা; (খ) সেবা লাভের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা; (গ) যে কোন প্রকারের শিক্ষা ও চিকিৎসা গ্রহণে এবং কর্ম প্রাপ্তিতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা; (ঘ) লিঙ্গ প্রতিবন্ধী হওয়ার অজুহাতে কোন শিশুকে পরিবারে প্রতিপালন না করিয়া বিশেষ কোন গোষ্ঠীর নিকট হস্তান্তর করা; (ঙ) লিঙ্গ প্রতিবন্ধী হওয়ার এবং পিতৃপরিচয় প্রদানে অসমর্থতার অজুহাতে শিশুকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তিতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন, শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করা এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হইতে বহিষ্কার করা; (চ) লিঙ্গ প্রতিবন্ধীগণকে পরিবারে বসবাসে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা; (ছ) লিঙ্গ প্রতিবন্ধীগণকে সম্পত্তিতে উত্তরাধিকার লাভ করা; (জ) কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক ধর্ম, বর্ণ, শিশু, নারীপুরুষ, শারীরিক-মানসিক ও লিঙ্গ প্রতিবন্ধী, জন্মস্থান, জন্ম ও পেশা, অস্পৃশ্যতার অজুহাতে জনস্থল, সর্বজনীন উৎসব, নিজ ধর্মীয় উপাসনালয়ে প্রবেশ ও অংশগ্রহণে বাধা প্রধান করা। ঐতিহাসিক মুক্তি সংগ্রামের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ একটি শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা এবং অন্যান্য মৌলিক অধিকারের সহিত মানবাধিকার ও সামাজিক সাম্য নিশ্চিত করিবার অঙ্গীকার রয়েছে, সংবিধানে প্রদত্ত উক্তরূপ প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে সর্বপ্রকার বৈষম্য বিলোপকল্পে বিধান করা সমীচীন ও প্রয়োজনও বটে।

একটি জাতীয় দৈনিকে ১ অক্টোবর “হরিজন’ তাই রেস্তোরাঁয় বসে খেতে বারণ” শিরোনামে খবর প্রকাশিত হয়েছে। ঘটনাটি ঘটেছে উত্তরাঞ্চলের জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমনূরা রেলওয়ে জংশন এলাকায়। রেস্তোরাঁর মালিক বলেছেন, ‘সংখ্যাগরিষ্ঠ গ্রাহকদের আপত্তির কারণে জেলার রেস্তোরাঁগুলোতে হরিজন সম্প্রদায়ের সদস্যদের ঢুকতে দেয়া হয় না।’ দীপক ভূঁইমালী আমনূরা কেএম উচ্চবিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীর ছাত্র। সহপাঠীদের সঙ্গে বিদ্যালয়ের আসনে পাশাপাশি বসে ও মাঠে খেলাধুলা করে কিন্তু বিপত্তি বাধে বন্ধুদের সঙ্গে রেস্তোরাঁয় খাবার খেতে গেলেই। দীপকদের পরিবার হরিজন সম্প্রদায়ের। স্থানীয় রেস্তোরাঁর মালিকরা তাকে ও তার পরিবারকে জানে ও চেনে। হরিজন সম্প্রদায়ের হওয়ার কারণেই রেস্তোরাঁর মালিকেরা বসে খাবার খেতে দেন না। মালিকদের ঘোর আপত্তি রয়েছে। হরিজন কলোনীর মুরব্বি শিবরাজ বাঁশফোঁড় ও চঞ্চলী ভূঁইমালী। কলোনীতে প্রায় ১৫টির অধিক পরিবার বসবাস করে।

দীপকের সম্পর্কে শিবরাজ বাঁশফোঁড় জানান, দীপক আমনূরা দলের হয়ে জেলার ক্রিকেট লীগে অংশ নিয়েছেন। উপজেলার বাইরে গিয়েও দলের সদস্যদের সঙ্গে রেস্তোরাঁয় খেয়েছেন; থেকেছেন কিন্ত সর্বদা শুধু নিজ এলাকাতেই সমস্যায় পড়তে হয়। একই জেলার নাচোল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে কাজ করেন সঞ্জয় দত্ত গঙ্গাপুত্র। তিনি জানান, স্থানীয় এক রেস্তোরাঁয় তার খাবার খাওয়ার সুযোগ হয়েছিল কিন্তু বের হওয়ার সময় রেস্তোরাঁ মালিক ডেকে বলেছিলেন, ‘কর্মচারীরা তোমাকে চিনতে পারেনি বলে ভুল করে খাবার দিয়েছে। এরপর থেকে আর আসবে না।’

সঞ্জয় দত্ত গঙ্গাপুত্র এ ঘটনার পর রেস্তোরাঁয় বসে খাবার অধিকার নিশ্চিত করতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কাছে লিখিত আবেদন করেন। ইউএনও সাবিহা সুলতানা রেস্তোরাঁর মালিকদের ডেকে বৈঠক করেন। এরপর কিছু রেস্তোরাঁয় বসে খাওয়া গেলেও অনেকে ঢুকতে দেন না। ক্ষোভের সঙ্গেই বাংলাদেশ হরিজন ঐক্য পরিষদের চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা শাখার সভাপতি রাজেন হরিজন বলেছেন, হরিজন সম্প্রদায়ের ছেলেমেয়েরা কিছু খাওয়ার ইচ্ছা হলেও রেস্তোরাঁয় গিয়ে খেতে পারে না। গোটা জেলাতেই একই অবস্থা। ইউএনও সাবিহা সুলতানা যে উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন, সেটিকে ফলোআপ করা প্রয়োজন। সত্যিকারভাবেই এক সময় মানুষের চেতনা আসে যে, স্র্রষ্টার সৃষ্টি মানুষের মধ্যে ভেদাভেদ তৈরি করা স্রষ্টারই বিরুদ্ধচারণ করা। ঈশ^র আশরাফুল মাকলুকাত হিসেবে আমাদের সৃষ্টি করেছেন, প্রাণ বায়ু দিয়েছেন। ভেদাভেদের জন্ম মানুষের দ্বারাই কৃত্রিমভাবে সৃষ্ট। সমাজ, রাষ্ট্র থেকে বৈষম্যকে বিতাড়নে প্রশাসনকেই এগিয়ে আসতে হবে। দেশের সর্বোচ্চ আইন সংবিধানে মানুষকে মানুষ হিসেবেই চিহ্নিত করেছে, মর্যাদা দিয়েছে।

মানুষে মানুষে ভেদাভেদ নিরসনে স্থানীয় মেম্বার-চেয়ারম্যান, উপজেলা চেয়ারম্যান এ বিষয়ে ব্যাপক সচেতনতা গড়ে তুলতে পারেন। ডিসি, ওসি, ইউএনও বিষয়টি সতর্কভাবে তদারকি করতে পারেন। স্কুল, কলেজ এবং আর্থ-সামাজিক প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা অগ্রগণ্য হওয়া আবশ্যক।

মহান মুক্তিযুদ্ধে জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণ ছিল। সংবিধানের প্রস্তবনায় উল্লিখিত আছে, ‘...গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠাÑ যেখানে সব নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে’। নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারবিষয়ক আন্তর্জাতিক চুক্তির ৬.১-এ বর্ণিত রয়েছে-‘ প্রত্যেক মানুষের বাঁচার সহজাত অধিকার রয়েছে। এ অধিকার আইনের দ্বারা রক্ষিত হবে। কোন ব্যক্তিকে খেয়াল খুশিমতো জীবন থেকে বঞ্চিত করা যাবে না।’ মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণাপত্র-এর ১ ধারায় রয়েছেÑ ‘সব মানুষই (শৃঙ্খলহীন) স্বাধীন অবস্থায় এবং সম-মর্যাদা ও অধিকার নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। তারা সবাই বুদ্ধি ও বিবেকের অধিকারী। অতএব, তাদের একে অন্যের প্রতি ভ্রাতৃসুলভ আচরণ করা উচিত।’

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে সাদা-কালো বৈষম্যকে উৎখাত করতে ‘আমরা করব জয়’ গানটি জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। আজো অধিকারহারা মানুষের হৃদয়কে গানটি আন্দোলিত করে তোলে। ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র থেকে বৈষম্যের বেড়াজালকে ছিন্ন করতে আসুন কণ্ঠ মেলাইÑ

আমরা করব জয়, আমরা করব জয়/ আমরা করব জয় নিশ্চয়।/ আহা বুকের গভীর, আছে প্রত্যয়,/আমরা করব জয় নিশ্চয়। আমরা করব জয়, আমরা করব জয়/আমরা করব জয় নিশ্চয়।