জলবায়ু পরিবর্তনে দেশে বাড়ছে ডেঙ্গুসহ সংক্রমণ রোগ

বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এক ঋতুর সঙ্গে আরেক ঋতুর যে তফাত তা নতুন বিপদ নিয়ে আসছে বলে জানিয়েছে বিশ্বব্যাংক। সংস্থাটি বলেছে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সংক্রামক রোগের বিস্তার ঘটছে। সেইসঙ্গে বাড়ছে মানসিক রোগ। পরিবর্তনশীল জলবায়ু পরিস্থিতি, শ্বাস-প্রশ্বাস, পানি ও মশাবাহিত রোগ বৃদ্ধির পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার মধ্যে যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বৃদ্ধির সঙ্গে আরও শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দেয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ঢাকা এবং চট্টগ্রামের মতো বড় শহরের শিশু ও বয়স্করা সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে।

গতকাল এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানিয়েছে সংস্থাটি। সংস্থাটির আয়োজনে এক ওয়েবিনারে প্রতিবেদনটি তুলে ধরা হয়েছে। এ সময় সংসদ সদস্য সাবের হোসেন চৌধুরী অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে বলা হয়েছে, সবচেয়ে দুর্বল দেশের মধ্যে থাকার পরও বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্যভাবে জলবায়ু পরিবর্তন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেছে। এটি প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিরুদ্ধে স্থিতিস্থাপকতা তৈরি করেছে এবং কৃষি উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির জন্য দেশীয় সমাধান চালু করেছে।

বিশ্ব ব্যাংকের প্রতিনিধিরা বলেন, ‘শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের উপর জলবায়ু পরিবর্তনের একটি সুস্পষ্ট প্রভাব দেখানোর আরও প্রমাণসহ বাংলাদেশকে একটি শক্তিশালী স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিশ্চিত করার জন্য অভিযোজনের ক্ষেত্রে তার সাফল্যের উপর ভিত্তি করে গড়ে তুলতে হবে। যা উদীয়মান জলবায়ু-সংবেদনশীল রোগের প্রাদুর্ভাব এড়াতে পারে।’

সংস্থাটি ঢাকা ও চট্টগ্রামের ৩ হাজার ৬১০টি পরিবারের ১৫ হাজার ৩৮৩ জনের ওপর জরিপ চালিয়ে গবেষণা প্রতিবেদনটি তৈরি করে।

বিশ্বব্যাংকের গবেষণা বলছে, বাতাসে আর্দ্রতা কমে আসার পাশাপাশি তাপমাত্রা ও বৃষ্টিপাতের মাত্রা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভবিষ্যতে রাজধানী ঢাকায় ডেঙ্গুর প্রকোপ আরও বাড়তে পারে। জলবায়ু যেভাবে বদলে যাচ্ছে, তাতে জনস্বাস্থ্যের ওপর এরই মধ্যে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। আগামী দিনগুলোতে তা আরও বাড়তে পারে বলে আভাস দিয়েছে সংস্থাটি।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ১৯৭৬ সাল থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে বাংলাদেশে গণতাপমাত্রা বেড়ে গেছে শূন্য দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর তার ফলে ধীরে ধীরে লোপ পাচ্ছে ঋতুভেদে আবহাওয়ার বৈচিত্র্য। প্রতিবছর গ্রীষ্মের সময়টা একটু একটু করে বেড়ে যাচ্ছে, সেই সঙ্গে বাড়ছে গরম। ক্যালেন্ডারে যে সময়টায় শীত থাকার কথা, তখনও তাপমাত্রা তুলনামূলকভাবে বেশি থাকছে। সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে গড় বৃষ্টিপাত বেড়ে যাওয়ায় দীর্ঘায়িত হচ্ছে বর্ষাকাল। অথচ যে সময়টায় সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি হতো আগে, সেই জুন-আগস্ট মৌসুমে গড় বৃষ্টিপাত কমে যাচ্ছে। এর ফল হচ্ছে অন্যরকম। এই সময়টায় যেসব রোগের প্রদুর্ভাব দেখা দেয়, তা আরও বেশি সময় ধরে ছড়ানোর মতো উপযুক্ত তাপমাত্রা ও বৃষ্টির পরিবেশ পাচ্ছে।

প্রতিবেদনে তারা জানিয়েছে, ১৯৯০ সালের পর থেকে পুরো বিশ্বেই এডিস মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গুর প্রকোপ প্রতি এক দশকে দ্বিগুণ হচ্ছে। বর্ষাকালের তুলনায় শুকনো মৌসুমে সংক্রামক রোগের প্রবণতা ১৯.৭ শতাংশ কমে আসে। ডেঙ্গু বা ম্যালেরিয়ার মতো মশাবাহিত রোগের ক্ষেত্রে এটা আরও বেশি প্রযোজ্য। ডেঙ্গুতে প্রতিবছর যে পরিমাণ মানুষ আক্রান্ত হয়, তার ২৫ শতাংশ হয় বর্ষাকালে, আর শীতকালে হয় ১৪ শতাংশ। এর মানে হলো, বর্ষাকালের দৈর্ঘ্য বাড়লে এসব রোগের মৌসুমও দীর্ঘ হবে।

প্রতিবেদনে ২০১৯ সালের দেশে ডেঙ্গুর বড় প্রাদুর্ভাবের তথ্য তুলে ধরে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সারাদেশে যত মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিল, তার অর্ধেকই ঢাকার। আর ঢাকায় ডেঙ্গুতে মৃত্যুর হার ছিল সারাদেশের ৭৭ শতাংশ। সে সময় ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় ভারি বর্ষণের সঙ্গে পরের মাসগুলোর অনুকূল তাপমাত্রা আর আর্দ্রতা ডেঙ্গুর ব্যাপক বিস্তারে ভূমিকা রেখেছিল।

প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশের আবহাওয়া যেভাবে বদলে যাচ্ছে, তাতে ঢাকা, চট্টগ্রামের মতো বড় শহরগুলোতে বর্ষকালে ডেঙ্গুর মতো বাহকনির্ভর রোগের প্রকোপ বাড়ছে। অপরপক্ষে, শুকনো মৌসুমে শ্বাসতন্ত্রের রোগ, যাতে মূল ভূমিকা রাখছে বায়ু দূষণ।

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে মানুষিক স্বাস্থ্যর পরিবর্তনের কথাও উল্লেখ করেছে বিশ্বব্যাংক। তারা প্রতিবেদনে বলছে, তাপমাত্রা ও আর্দ্র্রতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের উদ্বেগে ভোগার প্রবণতাও বেড়ে যায়। আর গ্রামের তুলনায় শহরের মানুষের ওপর এর প্রভাব পড়ে বেশি। নারীদের তুলনায় পুরুষরা বেশি মাত্রায় উদ্বেগে ভোগেন। এসব ঘটছে মানসিক স্বাস্থ্যের ওপরও জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব পড়ার কারণে। জলবায়ু বদলে যাওয়ার প্রবণতা যত দ্রুত হচ্ছে, স্বাস্থ্যের ওপর এর নেতিবাচক প্রভাবও ততই বাড়ার শঙ্কা দেখা যাচ্ছে।

তাপমাত্রা ১ ডিগ্রি বাড়লে শ্বাসকষ্টের আক্রান্তের হার বাড়ে ৫.৭%। আর আর্দ্রতা ১% বাড়লে শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে ১.৫%। কিন্তু তাপমাত্রা বাড়লে পানিবাহিত রোগ এবং ডেঙ্গুর মতো রোগ কমে উল্লেখ করা হয়েছে। বিশ্বব্যাংক বলছে, ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের গড় তাপমাত্রা ১.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে যেতে পারে। আর ২১০০ সাল নাগাদ তা বেড়ে যেতে পারে ২.৪ ডিগ্রি পর্যন্ত। ২০৪০ থেকে ২০৫৯ সালের মধ্যে বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বাড়তে পারে ৭৪ মিলিমিটার।

বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তনের ধারা যেভাবে এগোচ্ছে, তাতে অবস্থা যদি সবচেয়ে বেশি খারাপ হয়, পৃথিবীর তাপমাত্রা যদি ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বেড়ে যায়, তাহলে স্বাস্থ্য সমস্যা এতটাই বেড়ে যাবে এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ওপর এতটাই চাপ পড়বে যে খাপ খাইয়ে নেয়ার ধারণা তখন আর কোন কাজে আসবে না।

বিশ্বব্যাংকের সুপারিশ

প্রথমত, স্থানীয়ভাবে আবহাওয়ার পরিবর্তনের তথ্য সংগ্রহে আরও মনোযোগ দিতে হবে, সেই সঙ্গে বাড়াতে হবে মৌসুমি রোগের বিস্তারের ওপর নজরদারি। সেজন্য আঞ্চলিক আবহাওয়া অফিসের সংখ্যা এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পর্যবেক্ষণ সক্ষমতা বাড়াতে হবে।

দ্বিতীয়ত, আবহাওয়ার তথ্যের ওপর নির্ভর করে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাবের বিষয়ে আগাম সতর্কতা জারি বা পূর্বাভাস দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।

তৃতীয়ত, মশা নিয়ন্ত্রণে প্রজননস্থল ধ্বংসের মতো কাজে স্থানীয় বাসিন্দদের আরও বেশি মাত্রায় সম্পৃক্ত করতে হবে।

সর্বশেষ, নাগরিকদের মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে জরুরি ভিত্তিতে নজর দিতে হবে। বাংলাদেশের সামাজিক বাস্তবতায় এমনিতে যেহেতু হতাশা, উদ্বেগের মতো মানসিক সমস্যাগুলো এড়িয়ে যাওয়া হয়, সেহেতু এখনও এ বিষয়ে বাড়তি গুরুত্ব দেয়ার পরামর্শ দিচ্ছে বিশ্বব্যাংক।

শুক্রবার, ০৮ অক্টোবর ২০২১ , ২৩ আশ্বিন ১৪২৮ ৩০ সফর ১৪৪৩

জলবায়ু পরিবর্তনে দেশে বাড়ছে ডেঙ্গুসহ সংক্রমণ রোগ

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক

বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এক ঋতুর সঙ্গে আরেক ঋতুর যে তফাত তা নতুন বিপদ নিয়ে আসছে বলে জানিয়েছে বিশ্বব্যাংক। সংস্থাটি বলেছে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সংক্রামক রোগের বিস্তার ঘটছে। সেইসঙ্গে বাড়ছে মানসিক রোগ। পরিবর্তনশীল জলবায়ু পরিস্থিতি, শ্বাস-প্রশ্বাস, পানি ও মশাবাহিত রোগ বৃদ্ধির পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার মধ্যে যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বৃদ্ধির সঙ্গে আরও শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দেয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ঢাকা এবং চট্টগ্রামের মতো বড় শহরের শিশু ও বয়স্করা সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে।

গতকাল এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানিয়েছে সংস্থাটি। সংস্থাটির আয়োজনে এক ওয়েবিনারে প্রতিবেদনটি তুলে ধরা হয়েছে। এ সময় সংসদ সদস্য সাবের হোসেন চৌধুরী অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে বলা হয়েছে, সবচেয়ে দুর্বল দেশের মধ্যে থাকার পরও বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্যভাবে জলবায়ু পরিবর্তন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেছে। এটি প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিরুদ্ধে স্থিতিস্থাপকতা তৈরি করেছে এবং কৃষি উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির জন্য দেশীয় সমাধান চালু করেছে।

বিশ্ব ব্যাংকের প্রতিনিধিরা বলেন, ‘শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের উপর জলবায়ু পরিবর্তনের একটি সুস্পষ্ট প্রভাব দেখানোর আরও প্রমাণসহ বাংলাদেশকে একটি শক্তিশালী স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিশ্চিত করার জন্য অভিযোজনের ক্ষেত্রে তার সাফল্যের উপর ভিত্তি করে গড়ে তুলতে হবে। যা উদীয়মান জলবায়ু-সংবেদনশীল রোগের প্রাদুর্ভাব এড়াতে পারে।’

সংস্থাটি ঢাকা ও চট্টগ্রামের ৩ হাজার ৬১০টি পরিবারের ১৫ হাজার ৩৮৩ জনের ওপর জরিপ চালিয়ে গবেষণা প্রতিবেদনটি তৈরি করে।

বিশ্বব্যাংকের গবেষণা বলছে, বাতাসে আর্দ্রতা কমে আসার পাশাপাশি তাপমাত্রা ও বৃষ্টিপাতের মাত্রা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভবিষ্যতে রাজধানী ঢাকায় ডেঙ্গুর প্রকোপ আরও বাড়তে পারে। জলবায়ু যেভাবে বদলে যাচ্ছে, তাতে জনস্বাস্থ্যের ওপর এরই মধ্যে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। আগামী দিনগুলোতে তা আরও বাড়তে পারে বলে আভাস দিয়েছে সংস্থাটি।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ১৯৭৬ সাল থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে বাংলাদেশে গণতাপমাত্রা বেড়ে গেছে শূন্য দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর তার ফলে ধীরে ধীরে লোপ পাচ্ছে ঋতুভেদে আবহাওয়ার বৈচিত্র্য। প্রতিবছর গ্রীষ্মের সময়টা একটু একটু করে বেড়ে যাচ্ছে, সেই সঙ্গে বাড়ছে গরম। ক্যালেন্ডারে যে সময়টায় শীত থাকার কথা, তখনও তাপমাত্রা তুলনামূলকভাবে বেশি থাকছে। সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে গড় বৃষ্টিপাত বেড়ে যাওয়ায় দীর্ঘায়িত হচ্ছে বর্ষাকাল। অথচ যে সময়টায় সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি হতো আগে, সেই জুন-আগস্ট মৌসুমে গড় বৃষ্টিপাত কমে যাচ্ছে। এর ফল হচ্ছে অন্যরকম। এই সময়টায় যেসব রোগের প্রদুর্ভাব দেখা দেয়, তা আরও বেশি সময় ধরে ছড়ানোর মতো উপযুক্ত তাপমাত্রা ও বৃষ্টির পরিবেশ পাচ্ছে।

প্রতিবেদনে তারা জানিয়েছে, ১৯৯০ সালের পর থেকে পুরো বিশ্বেই এডিস মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গুর প্রকোপ প্রতি এক দশকে দ্বিগুণ হচ্ছে। বর্ষাকালের তুলনায় শুকনো মৌসুমে সংক্রামক রোগের প্রবণতা ১৯.৭ শতাংশ কমে আসে। ডেঙ্গু বা ম্যালেরিয়ার মতো মশাবাহিত রোগের ক্ষেত্রে এটা আরও বেশি প্রযোজ্য। ডেঙ্গুতে প্রতিবছর যে পরিমাণ মানুষ আক্রান্ত হয়, তার ২৫ শতাংশ হয় বর্ষাকালে, আর শীতকালে হয় ১৪ শতাংশ। এর মানে হলো, বর্ষাকালের দৈর্ঘ্য বাড়লে এসব রোগের মৌসুমও দীর্ঘ হবে।

প্রতিবেদনে ২০১৯ সালের দেশে ডেঙ্গুর বড় প্রাদুর্ভাবের তথ্য তুলে ধরে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সারাদেশে যত মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিল, তার অর্ধেকই ঢাকার। আর ঢাকায় ডেঙ্গুতে মৃত্যুর হার ছিল সারাদেশের ৭৭ শতাংশ। সে সময় ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় ভারি বর্ষণের সঙ্গে পরের মাসগুলোর অনুকূল তাপমাত্রা আর আর্দ্রতা ডেঙ্গুর ব্যাপক বিস্তারে ভূমিকা রেখেছিল।

প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশের আবহাওয়া যেভাবে বদলে যাচ্ছে, তাতে ঢাকা, চট্টগ্রামের মতো বড় শহরগুলোতে বর্ষকালে ডেঙ্গুর মতো বাহকনির্ভর রোগের প্রকোপ বাড়ছে। অপরপক্ষে, শুকনো মৌসুমে শ্বাসতন্ত্রের রোগ, যাতে মূল ভূমিকা রাখছে বায়ু দূষণ।

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে মানুষিক স্বাস্থ্যর পরিবর্তনের কথাও উল্লেখ করেছে বিশ্বব্যাংক। তারা প্রতিবেদনে বলছে, তাপমাত্রা ও আর্দ্র্রতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের উদ্বেগে ভোগার প্রবণতাও বেড়ে যায়। আর গ্রামের তুলনায় শহরের মানুষের ওপর এর প্রভাব পড়ে বেশি। নারীদের তুলনায় পুরুষরা বেশি মাত্রায় উদ্বেগে ভোগেন। এসব ঘটছে মানসিক স্বাস্থ্যের ওপরও জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব পড়ার কারণে। জলবায়ু বদলে যাওয়ার প্রবণতা যত দ্রুত হচ্ছে, স্বাস্থ্যের ওপর এর নেতিবাচক প্রভাবও ততই বাড়ার শঙ্কা দেখা যাচ্ছে।

তাপমাত্রা ১ ডিগ্রি বাড়লে শ্বাসকষ্টের আক্রান্তের হার বাড়ে ৫.৭%। আর আর্দ্রতা ১% বাড়লে শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে ১.৫%। কিন্তু তাপমাত্রা বাড়লে পানিবাহিত রোগ এবং ডেঙ্গুর মতো রোগ কমে উল্লেখ করা হয়েছে। বিশ্বব্যাংক বলছে, ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের গড় তাপমাত্রা ১.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে যেতে পারে। আর ২১০০ সাল নাগাদ তা বেড়ে যেতে পারে ২.৪ ডিগ্রি পর্যন্ত। ২০৪০ থেকে ২০৫৯ সালের মধ্যে বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বাড়তে পারে ৭৪ মিলিমিটার।

বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তনের ধারা যেভাবে এগোচ্ছে, তাতে অবস্থা যদি সবচেয়ে বেশি খারাপ হয়, পৃথিবীর তাপমাত্রা যদি ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বেড়ে যায়, তাহলে স্বাস্থ্য সমস্যা এতটাই বেড়ে যাবে এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ওপর এতটাই চাপ পড়বে যে খাপ খাইয়ে নেয়ার ধারণা তখন আর কোন কাজে আসবে না।

বিশ্বব্যাংকের সুপারিশ

প্রথমত, স্থানীয়ভাবে আবহাওয়ার পরিবর্তনের তথ্য সংগ্রহে আরও মনোযোগ দিতে হবে, সেই সঙ্গে বাড়াতে হবে মৌসুমি রোগের বিস্তারের ওপর নজরদারি। সেজন্য আঞ্চলিক আবহাওয়া অফিসের সংখ্যা এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পর্যবেক্ষণ সক্ষমতা বাড়াতে হবে।

দ্বিতীয়ত, আবহাওয়ার তথ্যের ওপর নির্ভর করে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাবের বিষয়ে আগাম সতর্কতা জারি বা পূর্বাভাস দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।

তৃতীয়ত, মশা নিয়ন্ত্রণে প্রজননস্থল ধ্বংসের মতো কাজে স্থানীয় বাসিন্দদের আরও বেশি মাত্রায় সম্পৃক্ত করতে হবে।

সর্বশেষ, নাগরিকদের মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে জরুরি ভিত্তিতে নজর দিতে হবে। বাংলাদেশের সামাজিক বাস্তবতায় এমনিতে যেহেতু হতাশা, উদ্বেগের মতো মানসিক সমস্যাগুলো এড়িয়ে যাওয়া হয়, সেহেতু এখনও এ বিষয়ে বাড়তি গুরুত্ব দেয়ার পরামর্শ দিচ্ছে বিশ্বব্যাংক।