প্রমিথিউস : মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা আন্দোলনের চিরন্তন প্রেরণা

শেখর ভট্টাচার্য

বিশ্বের প্রাচীন সব ‘পুরাণ’গুলো হলো জ্ঞানের আধার। পুরাণ বা মিথ-সমুদ্র থেকে হাজারো মুক্তো কুড়িয়ে সারা বিশ্বের দার্শনিক, চিন্তকেরা জ্ঞান বিজ্ঞানের নুতন নুতন পথ সৃষ্টি করে সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। প্রাচীন পুরাণগুলো বিষয় বৈচিত্র্য, উপস্থাপনায় অনন্য।

গ্রিকদের মতো সমৃদ্ধ ও আকর্ষণীয় পুরাকথা সম্ভবত দ্বিতীয়টি নেই পৃথিবীতে। প্রচলিত পুরাণে কিংবা প্রচলিত অনেক ধর্ম বিশ্বাসে দেবতাদেরই মহাবিশ্বের সৃষ্টিকর্তা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সৃষ্টির একমাত্র আদি সত্তা হিসেবে দেব-দেবীরাই স্বীকৃত। কিন্তু গ্রিক মিথলজিতে এই দেবতাদের আগেও আরো এক ধরনের সত্তা ছিলো বলে বিশ্বাস করা হয়, যাদের পরবর্তী প্রজন্ম হিসেবে জন্ম নিয়েছিলেন দেবতারা। দেবতাদের আগের প্রজন্মকে বলা হয়ে থাকে টাইটান। প্রাচীন গ্রিকরা বিশ্বাস করতেন, এই টাইটানরাই এ মহাবিশ্বের সৃষ্টিকর্তা। টাইটানদেরই একজন ছিলেন ক্রনোস। ক্রনোসের সন্তান ছিল জিউস, পসাইডন ও হেডিস। দেবতারা অলিম্পাস পর্বতে থাকতেন বিধায় তাদের ‘অলিম্পিয়ান’ নামে ডাকা হতো। দেবরাজ জিউস এবং অন্যান্য অলিম্পিয়ানদের সাথে যুদ্ধে হেরে যাবার আগ পর্যন্ত টাইটানরা এই মহাবিশ্ব শাসন করত। ক্রোনাসের ভাইয়ের ছেলের নাম ছিল প্রমিথিউস। প্রমিথিউস ছিলেন একজন টাইটান সত্তার চরিত্র।

প্রমিথিউস এমন একজন ব্যতিক্রমী সত্তা ছিলেন যে তিনি সব সময় দূর্বলের পক্ষে অবস্থান নিতেন। তিনি নিজে দেবতাদের থেকে শক্তিশালী টাইটান সত্তার অধিকারী ছিলেন। কিন্তু দেবতাদের সাথে যখন টাইটানদের যুদ্ধ সংঘটিত হয় সে যুদ্ধ্বে তিনি টাইটান হওয়া সত্ত্বেও দেবতাদের পক্ষ নেন। যুদ্ধে টাইটানরা হেরে গিয়েছিলো দেবতাদের সাথে। যুদ্ধের পর অনেক টাইটানকে নিশ্চিহ্ন করা হলো, কিছু টাইটানকে ছুড়ে ফেলা হলো টারটারাস নরকের চিরন্তন অগ্নিকুন্ডের ভেতরে। এ পরাজয়ের মধ্য দিয়ে উৎপীড়ক শ্রেণী অর্থাৎ টাইটানদের পতন হলো। টাইটানদের বিরুদ্ধে দেবতাদের এই যুদ্ধে ন্যায় ধর্মের পক্ষে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখায় গ্রিক পুরাণের দেব-রাজ জিউস, প্রমিথিউস ও তার ভাই এপিমিউথিউসকে পুরস্কৃত করা হয়। প্রমিথিউস নামকরণের মধ্যেও একটি আকর্ষণীয় ও শিক্ষামূলক গল্প আছে। প্রো কথাটির অর্থ পূর্বে বা আগে। প্রমিথিউস যে কোন কাজ করার পূর্বে গভীরভাবে চিন্তা করে কাজ শুরু করতেন, তাই তার নামকরণ করা হয়েছিলো ‘প্রমিথিউস’।

যুদ্ধকালে দুই ভাইয়ের বীরত্বে খুশি হয়ে দেব-রাজ জিউস তার ক্ষমতাবলে এই মহাবিশ্বের সব প্রাণী সৃষ্টির মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব প্রদান করেন প্রমিথিউস ও এপিমিথিউসের ওপর। পৃথিবীতে এসে প্রমিথিউস ও তার ভাই বিভিন্ন স্থানের মাটি দিয়ে বিভিন্ন প্রাণী তৈরি করা শুরু করেন। প্রমিথিউস আগে ভাবতেন, পরে কাজ করতেন। তাই তিনি এপিমিথিউসের মতো সাধারণ পশুপাখি না বানিয়ে আরও বড় পরিকল্পনা করতে লাগলেন। পৃথিবীর সবচেয়ে উৎকৃষ্ট মাটি দিয়ে এবং স্বচ্ছ পানিতে সেই মাটি গলিয়ে নতুন এক প্রাণী বানাতে শুরু করলেন এবং তাদের দেবতাদের আকৃতি দিলেন। প্রমিথিউস এই নতুন সৃষ্টির নাম দিলেন মানুষ। মানুষ বানানো হয়ে গেলে প্রমিথিউস গেলেন অলিম্পাসে বা দেব-রাজ্যে। জ্ঞানের দেবী এথেনাকে অনুরোধ করলেন নতুন সৃষ্টিতে প্রাণদান করার জন্য। প্রমিথিউসের অনুরোধে মর্ত্যে আসলেন দেবী এথেনা। নির্জীব মানবদেহে ফুঁ দিয়ে তাতে প্রাণসঞ্চার করলেন এথেনা। এভাবেই মানব সমাজের পথচলা শুরু হলো।

দেবতার আকৃতিতে এই নতুন সৃষ্টি ‘মানুষ’কে ইতিবাচকভাবে নিতে পারেননি দেবরাজ জিউস। শুরু হলো মানুষ ও দেবতাদের দ্বন্দ্ব। দেবরাজ প্রমিথিউসের কাজে বাধাও দিতে পারলেন না। ‘মানুষ’ তৈরির পর জিউস এবার প্রমিথিউসকে বললেন, এই সৃষ্টিরা দেবতাদের আরাধনা করবে এবং সৃষ্টির জীবদের মাঝে এরাই হবে সবচেয়ে উন্নত। তবে একটি শর্ত দিয়ে দেয়া হলো। তা হচ্ছে, মানুষ নিজেরা খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে এমন প্রাণীদের বিভিন্ন দেবতার নামে উৎসর্গ করতে হবে এবং উৎসর্গের পর অবশিষ্টাংশটুকু শুধুমাত্র মানুষের জন্য থাকবে। মূলত এই শর্ত দিয়ে জিউস দেবতাদের শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রাখার চেষ্টা করেছিলেন।

প্রমিথিউস তার প্রকৃতিগত স্বভাব অনুযায়ী মানুষের অধিকার রক্ষায় ছিলেন সক্রিয়। প্রমিথিউস মানুষ ও দেবতাদের উৎসর্গীকৃত খাদ্যের ভাগ নির্ধারণের জন্য মিসোন নামক স্থানে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। এই অনুষ্ঠানটি গ্রিক মিথলজির অনন্য একটি ঘটনা। এটি ‘ট্রিক এট মিসোন’ নামে পরিচিত। প্রমিথিউস মানবজাতির স্রষ্টা হিসেবে চেয়েছিলেন মানুষের অধিকারটুকু যেভাবেই হোক বজায় রাখতে। তাই তিনি এক কৌশলের আশ্রয় নিলেন। বিভিন্ন প্রাণীর হাড়গোড় ও চর্বি একত্রিত করে তাদের সুন্দর চামড়া দিয়ে ঢেকে খুব আকর্ষণীয়ভাবে সাজিয়ে রাখলেন। আর একটি ভাগে রাখলেন জীর্ণ-শীর্ণ গাভীর পাকস্থলীর ভেতর ষাঁড়ের উৎকৃষ্ট মাংস। যথাসময়ে জিউস উৎসর্গ গ্রহণ করতে আসলেন। প্রমিথিউস তখন তাকে বলেন যেকোনো একটি বেছে নিতে। প্রমিথিউসের ধোঁকায় পড়ে জিউস চকচকে দেখতে হাড়গোড়কেই বেছে নেন। তখন থেকে এটাই নিয়ম হয় যে, মানুষ প্রাণী উৎসর্গের পর মাংস রেখে দিয়ে চর্বি ও হাড়গোড় আগুনে পুড়িয়ে দেবতাদের উৎসর্গ করবে! মানুষের অধিকার রক্ষায় এভাবেই সফল হলেন মানবপ্রেমী বীর প্রমিথিউস।

লড়াই থেমে থাকল না। প্রমিথিউসের খাদ্য অধিকার রক্ষার কৌশল জেনে দেবরাজ জিউস প্রচন্ড ক্ষেপে যান এবং মানবজাতি যাতে দেবতার কিছু উৎসর্গ করতে না পারে সেজন্য জিউস পৃথিবী থেকে সব আগুন তুলে নিয়ে যান। মানবজাতির স্রষ্টা প্রমিথিউস এতে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন! কারণ আগুন ছাড়া মানুষ বাঁচতে পারবে না। অদম্য প্রমিথিউস মানুষের জন্য স্বর্গ থেকে একটি শূন্য গোলকের ভেতর আগুনের শিখাকে লুকিয়ে নিয়ে নিরাপদে পৃথিবীতে পৌঁছেন। আগুন থেকে মানবজাতি নতুন করে শক্তি অর্জন করলো। আগুন পাওয়ার পর মানুষ নিজেদের জন্য খাদ্য প্রস্তুত করা শিখলো, প্রচন্ড শীতে নিজেদের উষ্ণ করার উপায় খুঁজে পেলো। আগুনের সাহায্যে বিভিন্ন রকম ধাতু দিয়ে তৈরি করল নানা অস্ত্রশস্ত্র। প্রমিথিউসের আপ্রাণ চেষ্টায় প্রাপ্ত আগুন মানবসভ্যতাকে দ্রুত সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে গেলো।

মানুষের অগ্রগতি দেবরাজ জিউস কোনভাবে সহ্য করতে পারলেন না। অগ্রগতির পেছনের কারিগর হিসেবে প্রমিথিউসের ওপর প্রচন্ড রেগে গেলেন দেবরাজ। প্রমিথিউসকে ককেশাসের এক খাড়া পর্বতগাত্রে অনন্তকালের জন্য শৃঙ্খলিত করে রাখার নির্দেশ দেয়া হলো। প্রতিদিন সকালে শেকলবদ্ধ প্রমিথিউসের কাছে একটি ঈগল আসত। ঈগলটি প্রমিথিউসের কলিজা ঠুকরে ঠুকরে খেত সারাদিন। রাতে আবার প্রমিথিউসের শরীরে নতুন কলিজা প্রতিস্থাপন করা হতো, পরদিন ঈগলটি যাতে আবার এসে খেতে পারে।

এভাবেই চলছিলো প্রমিথিউসের জীবন। উপকথায় বর্ণিত- অনেক অনেক বছর পর হারকিউলিস ককেশাসের সেই পাহাড়ি রাস্তা ধরে যাচ্ছিলো। যাবার পথে সে প্রমিথিউসকে দেখতে পায়। সে জানতো না যে, প্রমিথিউস এখনও বন্দী অবস্থায় বেঁচে আছে। প্রমিথিউসকে দেখতে পেয়ে সে শেকল ভেঙে কলিজাখেকো ঈগলকে মেরে প্রমিথিউসকে উদ্ধার করে। শেষ হয় প্রমিথিউসের দীর্ঘ যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির মেয়াদ।

প্রমিথিউসের মানবমুক্তির আন্দোলনকে মর্যাদার সাথে লক্ষ্য করেন বিশ্বের সমস্ত দার্শনিকরা। বিভিন্ন গ্রিক লেখনিতে প্রমিথিউসকে মহান হিসেবে দেখানো হয়েছে। প্রমিথিউসের মাহাত্ম্য ও ত্যাগের উদাহরণ বিভিন্ন কাব্যে উল্লেখ করা হয়েছে বারবার। বিখ্যাত ইংরেজ কবি শেলী প্রমিথিউসের গল্প থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ‘মুক্ত প্রমিথিউস’ নামে একটি গীতিনাট্য লিখেছিলেন। সেখানে তিনি প্রমিথিউসকে একজন রোমান্টিক নায়ক হিসেবে কল্পনা করেন; যে শৃঙ্খল ভেঙে মানুষের মাঝে আবার মুক্তির বার্তা নিয়ে আসে। দেবতাদের অনাচার ও প্রতিপত্তির বিপরীতে মানবপ্রেমী হিসেবে প্রমিথিউস গ্রিক পুরাণে সবসময়ই এক অনবদ্য চরিত্র।

প্রমিথিউস হলেন মানবমুক্তির জন্য অনন্তকাল ধরে শুরু হওয়া লড়াইয়ের মূল প্রেরণা দানকারী। আধুনিক যুগে শোষক ও শোষিতের দ্বন্দ্ব, শ্রেণী সংগ্রামের প্রেরণা, প্রমিথিউসের আদর্শ থেকে মানুষের কাছে বারবার ফিরে আসে। পৃথিবীর এ কঠিন সংগ্রামে মানুষরূপী প্রমিথিউসদের সংখ্যা দিনে দিনে কমে আসছে। এ বিশ্বকে মানুষের বাসযোগ্য করে তোলার জন্য, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আমরা চাই প্রমিথিউসের লড়াইয়ের প্রেরণা। প্রমিথিউসের আদর্শ, ত্যাগ এবং নিবেদন বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষকে এখনও পথ দেখাতে সক্ষম বলে মানুষ বিশ্বাস করে।

[লেখক : প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন গবেষক]

শুক্রবার, ০৮ অক্টোবর ২০২১ , ২৩ আশ্বিন ১৪২৮ ৩০ সফর ১৪৪৩

প্রমিথিউস : মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা আন্দোলনের চিরন্তন প্রেরণা

শেখর ভট্টাচার্য

বিশ্বের প্রাচীন সব ‘পুরাণ’গুলো হলো জ্ঞানের আধার। পুরাণ বা মিথ-সমুদ্র থেকে হাজারো মুক্তো কুড়িয়ে সারা বিশ্বের দার্শনিক, চিন্তকেরা জ্ঞান বিজ্ঞানের নুতন নুতন পথ সৃষ্টি করে সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। প্রাচীন পুরাণগুলো বিষয় বৈচিত্র্য, উপস্থাপনায় অনন্য।

গ্রিকদের মতো সমৃদ্ধ ও আকর্ষণীয় পুরাকথা সম্ভবত দ্বিতীয়টি নেই পৃথিবীতে। প্রচলিত পুরাণে কিংবা প্রচলিত অনেক ধর্ম বিশ্বাসে দেবতাদেরই মহাবিশ্বের সৃষ্টিকর্তা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সৃষ্টির একমাত্র আদি সত্তা হিসেবে দেব-দেবীরাই স্বীকৃত। কিন্তু গ্রিক মিথলজিতে এই দেবতাদের আগেও আরো এক ধরনের সত্তা ছিলো বলে বিশ্বাস করা হয়, যাদের পরবর্তী প্রজন্ম হিসেবে জন্ম নিয়েছিলেন দেবতারা। দেবতাদের আগের প্রজন্মকে বলা হয়ে থাকে টাইটান। প্রাচীন গ্রিকরা বিশ্বাস করতেন, এই টাইটানরাই এ মহাবিশ্বের সৃষ্টিকর্তা। টাইটানদেরই একজন ছিলেন ক্রনোস। ক্রনোসের সন্তান ছিল জিউস, পসাইডন ও হেডিস। দেবতারা অলিম্পাস পর্বতে থাকতেন বিধায় তাদের ‘অলিম্পিয়ান’ নামে ডাকা হতো। দেবরাজ জিউস এবং অন্যান্য অলিম্পিয়ানদের সাথে যুদ্ধে হেরে যাবার আগ পর্যন্ত টাইটানরা এই মহাবিশ্ব শাসন করত। ক্রোনাসের ভাইয়ের ছেলের নাম ছিল প্রমিথিউস। প্রমিথিউস ছিলেন একজন টাইটান সত্তার চরিত্র।

প্রমিথিউস এমন একজন ব্যতিক্রমী সত্তা ছিলেন যে তিনি সব সময় দূর্বলের পক্ষে অবস্থান নিতেন। তিনি নিজে দেবতাদের থেকে শক্তিশালী টাইটান সত্তার অধিকারী ছিলেন। কিন্তু দেবতাদের সাথে যখন টাইটানদের যুদ্ধ সংঘটিত হয় সে যুদ্ধ্বে তিনি টাইটান হওয়া সত্ত্বেও দেবতাদের পক্ষ নেন। যুদ্ধে টাইটানরা হেরে গিয়েছিলো দেবতাদের সাথে। যুদ্ধের পর অনেক টাইটানকে নিশ্চিহ্ন করা হলো, কিছু টাইটানকে ছুড়ে ফেলা হলো টারটারাস নরকের চিরন্তন অগ্নিকুন্ডের ভেতরে। এ পরাজয়ের মধ্য দিয়ে উৎপীড়ক শ্রেণী অর্থাৎ টাইটানদের পতন হলো। টাইটানদের বিরুদ্ধে দেবতাদের এই যুদ্ধে ন্যায় ধর্মের পক্ষে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখায় গ্রিক পুরাণের দেব-রাজ জিউস, প্রমিথিউস ও তার ভাই এপিমিউথিউসকে পুরস্কৃত করা হয়। প্রমিথিউস নামকরণের মধ্যেও একটি আকর্ষণীয় ও শিক্ষামূলক গল্প আছে। প্রো কথাটির অর্থ পূর্বে বা আগে। প্রমিথিউস যে কোন কাজ করার পূর্বে গভীরভাবে চিন্তা করে কাজ শুরু করতেন, তাই তার নামকরণ করা হয়েছিলো ‘প্রমিথিউস’।

যুদ্ধকালে দুই ভাইয়ের বীরত্বে খুশি হয়ে দেব-রাজ জিউস তার ক্ষমতাবলে এই মহাবিশ্বের সব প্রাণী সৃষ্টির মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব প্রদান করেন প্রমিথিউস ও এপিমিথিউসের ওপর। পৃথিবীতে এসে প্রমিথিউস ও তার ভাই বিভিন্ন স্থানের মাটি দিয়ে বিভিন্ন প্রাণী তৈরি করা শুরু করেন। প্রমিথিউস আগে ভাবতেন, পরে কাজ করতেন। তাই তিনি এপিমিথিউসের মতো সাধারণ পশুপাখি না বানিয়ে আরও বড় পরিকল্পনা করতে লাগলেন। পৃথিবীর সবচেয়ে উৎকৃষ্ট মাটি দিয়ে এবং স্বচ্ছ পানিতে সেই মাটি গলিয়ে নতুন এক প্রাণী বানাতে শুরু করলেন এবং তাদের দেবতাদের আকৃতি দিলেন। প্রমিথিউস এই নতুন সৃষ্টির নাম দিলেন মানুষ। মানুষ বানানো হয়ে গেলে প্রমিথিউস গেলেন অলিম্পাসে বা দেব-রাজ্যে। জ্ঞানের দেবী এথেনাকে অনুরোধ করলেন নতুন সৃষ্টিতে প্রাণদান করার জন্য। প্রমিথিউসের অনুরোধে মর্ত্যে আসলেন দেবী এথেনা। নির্জীব মানবদেহে ফুঁ দিয়ে তাতে প্রাণসঞ্চার করলেন এথেনা। এভাবেই মানব সমাজের পথচলা শুরু হলো।

দেবতার আকৃতিতে এই নতুন সৃষ্টি ‘মানুষ’কে ইতিবাচকভাবে নিতে পারেননি দেবরাজ জিউস। শুরু হলো মানুষ ও দেবতাদের দ্বন্দ্ব। দেবরাজ প্রমিথিউসের কাজে বাধাও দিতে পারলেন না। ‘মানুষ’ তৈরির পর জিউস এবার প্রমিথিউসকে বললেন, এই সৃষ্টিরা দেবতাদের আরাধনা করবে এবং সৃষ্টির জীবদের মাঝে এরাই হবে সবচেয়ে উন্নত। তবে একটি শর্ত দিয়ে দেয়া হলো। তা হচ্ছে, মানুষ নিজেরা খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে এমন প্রাণীদের বিভিন্ন দেবতার নামে উৎসর্গ করতে হবে এবং উৎসর্গের পর অবশিষ্টাংশটুকু শুধুমাত্র মানুষের জন্য থাকবে। মূলত এই শর্ত দিয়ে জিউস দেবতাদের শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রাখার চেষ্টা করেছিলেন।

প্রমিথিউস তার প্রকৃতিগত স্বভাব অনুযায়ী মানুষের অধিকার রক্ষায় ছিলেন সক্রিয়। প্রমিথিউস মানুষ ও দেবতাদের উৎসর্গীকৃত খাদ্যের ভাগ নির্ধারণের জন্য মিসোন নামক স্থানে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। এই অনুষ্ঠানটি গ্রিক মিথলজির অনন্য একটি ঘটনা। এটি ‘ট্রিক এট মিসোন’ নামে পরিচিত। প্রমিথিউস মানবজাতির স্রষ্টা হিসেবে চেয়েছিলেন মানুষের অধিকারটুকু যেভাবেই হোক বজায় রাখতে। তাই তিনি এক কৌশলের আশ্রয় নিলেন। বিভিন্ন প্রাণীর হাড়গোড় ও চর্বি একত্রিত করে তাদের সুন্দর চামড়া দিয়ে ঢেকে খুব আকর্ষণীয়ভাবে সাজিয়ে রাখলেন। আর একটি ভাগে রাখলেন জীর্ণ-শীর্ণ গাভীর পাকস্থলীর ভেতর ষাঁড়ের উৎকৃষ্ট মাংস। যথাসময়ে জিউস উৎসর্গ গ্রহণ করতে আসলেন। প্রমিথিউস তখন তাকে বলেন যেকোনো একটি বেছে নিতে। প্রমিথিউসের ধোঁকায় পড়ে জিউস চকচকে দেখতে হাড়গোড়কেই বেছে নেন। তখন থেকে এটাই নিয়ম হয় যে, মানুষ প্রাণী উৎসর্গের পর মাংস রেখে দিয়ে চর্বি ও হাড়গোড় আগুনে পুড়িয়ে দেবতাদের উৎসর্গ করবে! মানুষের অধিকার রক্ষায় এভাবেই সফল হলেন মানবপ্রেমী বীর প্রমিথিউস।

লড়াই থেমে থাকল না। প্রমিথিউসের খাদ্য অধিকার রক্ষার কৌশল জেনে দেবরাজ জিউস প্রচন্ড ক্ষেপে যান এবং মানবজাতি যাতে দেবতার কিছু উৎসর্গ করতে না পারে সেজন্য জিউস পৃথিবী থেকে সব আগুন তুলে নিয়ে যান। মানবজাতির স্রষ্টা প্রমিথিউস এতে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন! কারণ আগুন ছাড়া মানুষ বাঁচতে পারবে না। অদম্য প্রমিথিউস মানুষের জন্য স্বর্গ থেকে একটি শূন্য গোলকের ভেতর আগুনের শিখাকে লুকিয়ে নিয়ে নিরাপদে পৃথিবীতে পৌঁছেন। আগুন থেকে মানবজাতি নতুন করে শক্তি অর্জন করলো। আগুন পাওয়ার পর মানুষ নিজেদের জন্য খাদ্য প্রস্তুত করা শিখলো, প্রচন্ড শীতে নিজেদের উষ্ণ করার উপায় খুঁজে পেলো। আগুনের সাহায্যে বিভিন্ন রকম ধাতু দিয়ে তৈরি করল নানা অস্ত্রশস্ত্র। প্রমিথিউসের আপ্রাণ চেষ্টায় প্রাপ্ত আগুন মানবসভ্যতাকে দ্রুত সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে গেলো।

মানুষের অগ্রগতি দেবরাজ জিউস কোনভাবে সহ্য করতে পারলেন না। অগ্রগতির পেছনের কারিগর হিসেবে প্রমিথিউসের ওপর প্রচন্ড রেগে গেলেন দেবরাজ। প্রমিথিউসকে ককেশাসের এক খাড়া পর্বতগাত্রে অনন্তকালের জন্য শৃঙ্খলিত করে রাখার নির্দেশ দেয়া হলো। প্রতিদিন সকালে শেকলবদ্ধ প্রমিথিউসের কাছে একটি ঈগল আসত। ঈগলটি প্রমিথিউসের কলিজা ঠুকরে ঠুকরে খেত সারাদিন। রাতে আবার প্রমিথিউসের শরীরে নতুন কলিজা প্রতিস্থাপন করা হতো, পরদিন ঈগলটি যাতে আবার এসে খেতে পারে।

এভাবেই চলছিলো প্রমিথিউসের জীবন। উপকথায় বর্ণিত- অনেক অনেক বছর পর হারকিউলিস ককেশাসের সেই পাহাড়ি রাস্তা ধরে যাচ্ছিলো। যাবার পথে সে প্রমিথিউসকে দেখতে পায়। সে জানতো না যে, প্রমিথিউস এখনও বন্দী অবস্থায় বেঁচে আছে। প্রমিথিউসকে দেখতে পেয়ে সে শেকল ভেঙে কলিজাখেকো ঈগলকে মেরে প্রমিথিউসকে উদ্ধার করে। শেষ হয় প্রমিথিউসের দীর্ঘ যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির মেয়াদ।

প্রমিথিউসের মানবমুক্তির আন্দোলনকে মর্যাদার সাথে লক্ষ্য করেন বিশ্বের সমস্ত দার্শনিকরা। বিভিন্ন গ্রিক লেখনিতে প্রমিথিউসকে মহান হিসেবে দেখানো হয়েছে। প্রমিথিউসের মাহাত্ম্য ও ত্যাগের উদাহরণ বিভিন্ন কাব্যে উল্লেখ করা হয়েছে বারবার। বিখ্যাত ইংরেজ কবি শেলী প্রমিথিউসের গল্প থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ‘মুক্ত প্রমিথিউস’ নামে একটি গীতিনাট্য লিখেছিলেন। সেখানে তিনি প্রমিথিউসকে একজন রোমান্টিক নায়ক হিসেবে কল্পনা করেন; যে শৃঙ্খল ভেঙে মানুষের মাঝে আবার মুক্তির বার্তা নিয়ে আসে। দেবতাদের অনাচার ও প্রতিপত্তির বিপরীতে মানবপ্রেমী হিসেবে প্রমিথিউস গ্রিক পুরাণে সবসময়ই এক অনবদ্য চরিত্র।

প্রমিথিউস হলেন মানবমুক্তির জন্য অনন্তকাল ধরে শুরু হওয়া লড়াইয়ের মূল প্রেরণা দানকারী। আধুনিক যুগে শোষক ও শোষিতের দ্বন্দ্ব, শ্রেণী সংগ্রামের প্রেরণা, প্রমিথিউসের আদর্শ থেকে মানুষের কাছে বারবার ফিরে আসে। পৃথিবীর এ কঠিন সংগ্রামে মানুষরূপী প্রমিথিউসদের সংখ্যা দিনে দিনে কমে আসছে। এ বিশ্বকে মানুষের বাসযোগ্য করে তোলার জন্য, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আমরা চাই প্রমিথিউসের লড়াইয়ের প্রেরণা। প্রমিথিউসের আদর্শ, ত্যাগ এবং নিবেদন বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষকে এখনও পথ দেখাতে সক্ষম বলে মানুষ বিশ্বাস করে।

[লেখক : প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন গবেষক]