গণতন্ত্রকে সঙ সাজিয়ে সংবিধান ভণ্ডুলের প্রবণতা

গৌতম রায়

উপনির্বাচনে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি যে জিতবেনই- এটা নিয়ে তার অতি বড় রাজনৈতিক শত্রুর ও কোনো সংশয় ছিল না। এ সংশয় না থাকা থেকেই যে প্রশ্নটা উঠে আসছে, সেটাই হলো এ মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির একটা দিকনির্ণয়ী গতিমুখ। কেন মমতার রাজনৈতিক শত্রু-মিত্র নির্বিশেষে তার উপনির্বাচনে জেতা ঘিরে এতটা নিঃসংশয়ী মানসিকতা?

মমতা গত ২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন। তারপর থেকে আজ পর্যন্ত বিভিন্ন স্তরে যে নির্বাচনগুলো হয়েছে, সেখানে কি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন একটিবারের জন্যেও ঘটেছে? লোকসভা- বিধানসভা থেকে শুরু করে স্থানীয় প্রশাসন- কোনো ক্ষেত্রেই কি অবাধ ভোটের পরিবেশ এই রাজ্যে বজায় থেকেছে? রাজ্যের নাগরিকেরা কি নিশ্চিন্তে, নির্ভয়ে তাদের নিজেদের সাংবিধানিক অধিকার প্রয়োগ করতে পেরেছেন?

এ ধারাবাহিক অভিজ্ঞতার নিরিখেই পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ মানুষের মনে ক্রমেই নির্বাচনী সংগ্রামকে ঘিরে একটা অন্যরকম নেতিবাচক ধারণা তৈরি হতে শুরু করে দিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে গত কয়েকটি ভোটের অভিজ্ঞতার নিরিখে সংবাদ জগতের সঙ্গে জড়িত একটা বড় অংশের মানুষ খবর পরিবেশনের গোটা প্রেক্ষিতটিকে নিয়ে রীতিমতো সন্দিহান মানসিকতা সমাজের বুকে প্রোথিত করতে শুরু করেছেন। ফলে উপনির্বাচন হলে ক্ষমতাসীন মুখ্যমন্ত্রী যে জিতবেনই- এটা ছিল নিশ্চিত একটি অনুধ্যানই।

নির্বাচন প্রক্রিয়াকে একটা প্রহসনে পরিণত করে বাংলাদেশে একটা সময়ে জিয়াউর রহমান বা এইচএম এরশাদ যে ধরনের সঙের গণতন্ত্র কায়েম করেছিলেন, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে পশ্চিমবঙ্গে আজকে কার্যত ঠিক সেই স্তরে নামিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছেন মমতা ব্যানার্জি। ফলে তিনি যখন কোন গণতান্ত্রিক প্র্যাকটিস বা মূল্যবোধের কথা বলেন, সেইটি কার্যত মানুষের কাছে একটা বড় রকমের হাসির খোরাকে রূপান্তরিত হয়ে যায়।

এ গণতান্ত্রিক পরিকাঠামোর ভেতরে দাঁড়িয়ে রাজ্য পরিচালনার ক্ষেত্রে যে ধরনের প্রশাসনিক কার্যক্রমের ভেতর দিয়ে মমতা চলাফেরা করেন, সেখানে আমলাতন্ত্রকেই প্রশাসনের সর্বত্র বহুধাগামিনী হিসেবে আমরা দেখি। নিজের দলের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কি প্রশাসন পরিচালনার ক্ষেত্রে সমুচিত গুরুত্ব মুখ্যমন্ত্রী মমতা দেন? এক কথায় উত্তর চলে আসে, ‘না’। মমতার দল তৃণমূল কংগ্রেসের একজন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরই প্রশাসনিক স্তরে পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা আছে কিনা- এটা এখন কোটি টাকার প্রশ্ন। পার্থ চট্টোপাধ্যায়, ফিরহাদ হাকিমের মতো একদম প্রথম সারির মন্ত্রী, আপাতদৃষ্টিতে যাদের দেখলেই মনে হতে পারে, এঁরা হলেন মমতার মন্ত্রিসভায় মুখ্যমন্ত্রীর পরেই বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, বাস্তবে দেখা যায়, এই আলঙ্কারিক গুরুত্ব পাওয়া মমতার সতীর্থেরা আদৌ রাজ্য প্রশাসনে তেমন গুরুত্বপূর্ণই নন। একটা গণতান্ত্রিক পরিবেশের আদল তৈরি করে মমতা গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত নিজের রাজনৈতিক সহকর্মীদের পর্যন্ত ঠুঁটো জগন্নাথ করে রেখে দিয়েছেন, আর সেই জায়গাতে অসীম ক্ষমতার অধিকারী হলেন খোদ মুখ্যমন্ত্রীর অনুগ্রহভোগী একটা অংশের আমলারা।

জনপ্রতিনিধিদের আইনসভার কাছে তথা মানুষের কাছে একটা বিশেষ দায়বদ্ধতা আছে। আমলাদের সেটা থাকে না। তারা নির্বাচিত নন। ফলে আইনসভার তোয়াক্কা তারা করেন না। দলীয় রাজনীতির আধিপত্য যাই-ই থাকুক না কেন, একজন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি কখনোই আইনসভাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে কিছু করতে পারেন না। প্রশাসনিক স্তরে যে পদক্ষেপই একজন মন্ত্রী বা বিধায়ক নিন না কেন, সেই সিদ্ধান্তের ব্যাখ্যা দিতে তিনি আইনসভাতে বাধ্য। তার ভোটারদের কাছে, তথা বৃহত্তর ভোটার, মানে রাজ্যের জনগণের কাছে বাধ্য। এ ধরনের বাধ্যবাধকতার লেশমাত্র কোন স্তরের আমলারই থাকে না।

মমতা এ আমলাতন্ত্রের হাতেই কার্যত রাজ্যের শাসনভার তুলে দিয়েছেন। তার নিজের দলের মন্ত্রীরা যে খুব একটা প্রশাসনিক ক্ষমতাসম্পন্ন- এটা জোর গলায় বলতে পারা যায় না। তবে আমলাতন্ত্র এসব নির্বাচিত মন্ত্রীদের নিজস্ব ধারাতে চলাফেরা করবার ক্ষেত্রে কখনো কোন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে না। অপরপক্ষে মন্ত্রীরাও করেন না আমলাদের স্বাধীন বিচরণের ক্ষেত্রে। ফলে এদের ভেতরে দ্বন্দ্ব বা সংঘাত সচরাচর দেখতে পাওয়া যায় না। মন্ত্রীরা নিজেদের সব কিছু সুন্দর ভাবে পেয়ে যাচ্ছেন। আর আমলারাও জনপ্রতিনিধি না হওয়া সত্ত্বেও বিধানসভার প্রতি কোন প্রকারের দায়বদ্ধতা ছাড়াই প্রশাসনের প্রায় সর্বোচ্চস্তরের ক্ষমতা উপভোগ করে চলেছেন সুন্দর ধারাবাহিকতার ভেতর দিয়ে।

প্রশাসনের সর্বময় কর্তৃত্ব মুখ্যমন্ত্রীর পরেই অন্যান্য প্রবীণ মন্ত্রীদের ওপর ন্যস্ত না হয়ে শীর্যস্তরের আমলাবাহিনীর ওপর বর্তানোর ফলে অনেকক্ষেত্রেই আমলাদের আচরণ কার্যত রাজনীতিকদের মতো হয়ে উঠছে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বিধানসভার উপনির্বাচনে না জিতলে পশ্চিমবঙ্গে সাংবিধানিক সংকট দেখা দেবে বলে খোদ নির্বাচন কমিশনকে জানিয়েছিলেন রাজ্যের মুখ্যসচিব হরিকৃষ্ণ দ্বিবেদির। মুখ্যসচিবের এই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মন্তব্য ঘিরে সব বিরোধী দলগুলোর কাছ থেকে যে প্রতিক্রিয়া এবং রাজনৈতিক কর্মকা- প্রত্যাশিত ছিল তার পরিবর্তে শাসক দল বিবৃতিতেই বিরোধীদের তাদের রাজনৈতিক কর্তব্য পালনে বেশি তৎপর দেখা গিয়েছে।

গণতান্ত্রিক কাঠামোয় বিশ্বাসী কোন রাজনীতিকের পক্ষে প্রশাসনের সার্বিক কর্তৃত্ব আমলাতন্ত্রের হাতে তুলে দেয়া সম্ভব নয়। পশ্চিমবঙ্গে ডা. বিধানচন্দ্র রায়ের আমল থেকে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সময়কাল- কখনোই এইরকম পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। ডা. রায় তার রাজনৈতিক অবস্থানে আমলাতন্ত্রকে বেশি গুরুত্ব দিলেও গণতান্ত্রিক কাঠামোকে আজ মমতা ব্যানার্জি যে পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছেন, তার ধারপাশ দিয়ে কখনো হাঁটেননি। সুধীর মাধব বসু, ডিএম সেন প্রমুখ আমলাদের ডা. বিধান রায় অন্য অনেক আমলাদের থেকে বেশি গুরুত্ব দিতেন। এমন কি নিজের রাজনৈতিক বক্তব্যও অনেক সময়ে তিনি নিজে না বলে বশংবদ আমলাদের দিয়ে বলাতেন। পাঁচের দশকে শিক্ষকদের প্রবল আন্দোলন, গণঅবস্থান কে বিধান রায় চরম অসম্মান, উপহাস করেছিলেন, তার ই বিশেষ অনুগত আমলা ডিএম সেনকে (অমর্ত্য সেনের মামা) দিয়ে। সেই ঘটনার তীব্র রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়াও হয়েছিল। সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় তার মুখ্যমন্ত্রিত্বকালে দুর্গা সিং, দেবী রায় প্রমুখ আমলাদের প্রতি অতিরিক্ত পক্ষপাতিত্ব করে বেশ কিছু বিতর্কের সৃষ্টি করেছিলেন।

তবে এইসব রাজনীতিকদের ভেতরে কেউই প্রশাসনের সার্বিক দায়িত্ব আমলাকুলের ওপরে কখনো তুলে দেননি। মুখ্যমন্ত্রীর রাজনৈতিক ভাগ্য নিয়ন্ত্রণে এই হরিকৃষ্ণ দ্বিবেদির আগে কোনো আমলা প্রকাশ্যে একটাও কথা বলেছেন- এমন কোনো দৃষ্টান্ত অতীতে কখনো পশ্চিমবঙ্গে দেখা যায়নি। রাজনৈতিক পরিসরের বাইরে নিজের বা নিজের দলের রাজনৈতিক ভবিষৎ ঘিরে সরব হয়েছেন, মমতা ব্যানার্জি আগে এমন কোন মুখ্যমন্ত্রী কখনো পশ্চিমবঙ্গ পায়নি। আর প্রশাসনিক পরিমণ্ডলকে অতিক্রম করে নিছক মুখ্যমন্ত্রীর রাজনৈতিক ভবিষৎ নিয়ে মাথা ঘামিয়েছেন প্রকাশ্যে, নির্বাচন কমিশনের কাছে অ্যাডভোকেসি করেছেন- হরিকৃষ্ণ দ্বিবেদির আগে এমন কোনো আমলাও পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক বা প্রশাসনিক পরিমণ্ডলে ঘটেনি কখনো।

গণতান্ত্রিক পরিকাঠামোকে ছাপিয়ে বা অতিক্রম করে অথবা সোজাসাপটা কথায় পাশ কাটিয়ে আমলাতন্ত্রের নিরঙ্কুশ ক্ষমতাবৃদ্ধির একটা অতি পরাক্রমী রাজনৈতিক অভিসন্ধি থাকে। সেই অভিসন্ধিটা হলো, ধীরে ধীরে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে অকেজো করে দিয়ে সংবিধানের গ্রহণযোগ্যতা ঘিরে একটা প্রশ্নের পরিবেশ তৈরি করা। অতীতে বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ষড়যন্ত্রে যারা লিপ্ত থেকেছে, তারাই ঠারেঠোরে ’৭২-এর মহান ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান ঘিরে নানা ভাবে প্রশ্ন তোলার পরিমণ্ডল তৈরি করেছে। তারপর বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার পর, প্রথম সুযোগেই বাংলাদেশের মহান ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানকে ধ্বংস করেছে।

সংবিধান ধ্বংসের যে পরিকাঠামো আরএসএস, তার রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি, নরেন্দ্র মোদির প্রশাসন তৈরি করেছে, তার সঙ্গে কি তড়িঘড়ি ভবাণীপুরের উপনির্বাচনে মমতা না জিতলে সাংবিধানিক সংকট হবে বলে যে কথা প্রকাশ্যে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যসচিব হরিকৃষ্ণ দ্বিবেদি বলেছেন, তার ন্যূনতম সাদৃশ্য পাচ্ছেন পাঠক? ভারতের সংবিধান কি এতটাই ঠুনকো যে মাত্র কয়েক মাস আগে নন্দীগ্রামে হেরে যাওয়া মুখ্যমন্ত্রী এই কোভিড পরিস্থিতির ভেতরেও, রাজ্যের পৌরসভাগুলোর মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে গেলেও সেই কোভিডের দোহাই দিয়ে নির্বাচন না করে, ঘুরিয়ে নাক দেখানোর মতো, নিজের দলের শাসন কায়েম করেও, ভবানীপুরের উপনির্বাচনে জিতে, নিজের মুখ্যমন্ত্রিত্বের তখত সুনিশ্চিত না করতে পারলে ভারতের ঐতিহ্যময় সংবিধান রক্ষা পাবে না? পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যসচিব একজন আমলা হয়ে কি করে জানলেন, তৃণমূল কংগ্রেস নামক রাজনৈতিক দলটি ভবানীপুরের উপনির্বাচনে মমতাকেই প্রার্থী করবেন? মুখ্যসচিবের সঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেসের কি বিশেষ কোনো সম্পর্ক আছে যে, তৃণমূল তাদের প্রার্থীর নাম ঘোষণা করবার অনেক আগেই খোদ রাজ্যের মুখ্যসচিব জেনে যাচ্ছেন, শাসক দল কি করতে চাইছে। কাকে শাসক শিবির প্রার্থী করতে চাইছে উপনির্বাচনে, সেটা শাসক শিবিরের ঘোষণার আগেই মুখ্যসচিবের শ্রীমুখ থেকে নিঃসৃত হওয়ায়, এই প্রশ্নই তীব্র হয়ে উঠছে যে, তৃণমূল কংগ্রেস কি তাদের দলের মুখপাত্রের দায়িত্ব দিয়েছে রাজ্যের মুখ্যসচিব কে? নাকি মুখ্যসচিব রাজ্যের শাসকদলের হাঁড়ির খবর নির্বাচন কমিশনের মতো সংস্থাকে জানিয়ে হাটে হাঁড়ি ভেঙে দিতে চাইছেন রাজ্যের শাসকদল তৃণমূলের? সেই জলের উপর পানি, না পানির উপর জল— লালন ফকিরের গূঢ় তত্ত্বের আধুনিক সংস্করণ নয় তো?

গত বিধানসভার ভোটে (২০২১) নন্দীগ্রাম থেকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা হেরে গিয়েছিলেন। মুখ্যমন্ত্রীর সেই পরাজয়, ব্যক্তি মমতার বা তার দল তৃণমূল কংগ্রেসের পরাজয় ঘিরে শাসক শিবিরে যে সংকট তৈরি হয়েছিল, অনিশ্চয়তার পরিবেশ রচিত হয়েছিল, তাকে সাংবিধানিক সংকট বলে কেন অভিহিত করলেন পশ্চিমবঙ্গের শীর্ষস্থানীয় আমলা? সংবিধানের মূল পরিকাঠামোকে বদলে দেয়ার যে চক্রান্ত হিন্দু সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী শিবির থেকে করা হচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যসচিবের কল্পিত সাংবিধানিক সংকটের সঙ্গে তার কি কোনো রকমের যোগসূত্র রয়েছে?

এভাবে আমলাতন্ত্র নির্ভর যে প্রশাসন মমতা দীর্ঘ দশ বছরেরও বেশি সময় ধরে পরিচালনা করে চলেছেন, তা কি আদৌ তার দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মী মেনে নিতে পারছেন? আমলাতন্ত্রের এই সর্বোময় কর্তৃত্বের ফলে গণতান্ত্রিক পরিকাঠামোতে যে সংকট তৈরি হচ্ছে তা কি সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ধারক-বাহকদের একটা বিশেষ রকমের সুবিধা করে দিচ্ছে না? গণতন্ত্রের সঙ্কোচনে যদি আমলাতন্ত্র ক্ষমতাবান হয়ে ওঠে, তবে সেই বিপদ কাদের? আমলাতন্ত্র যদি নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের ছাপিয়ে যেতে শুরু করে, তবে সেই সংকট কি স্বৈরতন্ত্রের চরম পর্যায়কে অতিক্রম করে একটা বীভৎস প্রবণতার দিকে গোটা শাসনব্যবস্থাকেই অচিরে ঠেলে দেবে না? গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে যদি আমলাতন্ত্রের দ্যোতনায় বিচার করা হয়, বিশ্লেষণ করা হয়, ভারতে আজকের সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী রাজনীতির বাড়বাড়ন্তের কালে তা কি কোন ইতিবাচক বার্তা দিতে সক্ষম হবে?

ডা. বিধানচন্দ্র রায়ের জীবদ্দশার শেষ ভোটে বৌবাজার কেন্দ্রে তাকে পোস্টাল জেতাবার ক্ষেত্রে আমলাতন্ত্রের ভূমিকা পশ্চিমবঙ্গের সংসদীয় রাজনীতির ইতিহাসে একটা বিতর্কিত অধ্যায়। সেই অধ্যায়কে ছাপিয়ে গেল ভবানীপুর কেন্দ্রের উপনির্বাচন ঘিরে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যসচিবের আচরণ। এই বিষয়ে মামলাটি মহামান্য কোর্টের বিচারাধীন। আজ হোক, কাল হোক আদালত একটা সিদ্ধান্ত দেবেন। সেই সিদ্ধান্ত সবার কাছে পরিত্যাজ্য হবে, এমনটা ভাববার যেমন কোন কারণ নেই, আবার সবারই কাছে গ্রহণযোগ্য হবে- তেমনটা ভেবে নেয়ারও কোন কারণ নেই। কিন্তু এসব ছাপিয়েও শাসককে তুষ্ট করতে আমলাতন্ত্রের ভূমিকা বা শাসক আমলাতন্ত্র কে কিভাবে নিজের ক্রীড়নক ভৃত্যে পরিণত করেছেÑ এই বিতর্ক কিন্তু চলতেই থাকবে।

[লেখক : ভারতীয় ইতিহাসবিদ]

শনিবার, ০৯ অক্টোবর ২০২১ , ২৪ আশ্বিন ১৪২৮ ০১ রবিউল আউয়াল ১৪৪৩

গণতন্ত্রকে সঙ সাজিয়ে সংবিধান ভণ্ডুলের প্রবণতা

গৌতম রায়

গৌতম রায়

উপনির্বাচনে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি যে জিতবেনই- এটা নিয়ে তার অতি বড় রাজনৈতিক শত্রুর ও কোনো সংশয় ছিল না। এ সংশয় না থাকা থেকেই যে প্রশ্নটা উঠে আসছে, সেটাই হলো এ মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির একটা দিকনির্ণয়ী গতিমুখ। কেন মমতার রাজনৈতিক শত্রু-মিত্র নির্বিশেষে তার উপনির্বাচনে জেতা ঘিরে এতটা নিঃসংশয়ী মানসিকতা?

মমতা গত ২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন। তারপর থেকে আজ পর্যন্ত বিভিন্ন স্তরে যে নির্বাচনগুলো হয়েছে, সেখানে কি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন একটিবারের জন্যেও ঘটেছে? লোকসভা- বিধানসভা থেকে শুরু করে স্থানীয় প্রশাসন- কোনো ক্ষেত্রেই কি অবাধ ভোটের পরিবেশ এই রাজ্যে বজায় থেকেছে? রাজ্যের নাগরিকেরা কি নিশ্চিন্তে, নির্ভয়ে তাদের নিজেদের সাংবিধানিক অধিকার প্রয়োগ করতে পেরেছেন?

এ ধারাবাহিক অভিজ্ঞতার নিরিখেই পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ মানুষের মনে ক্রমেই নির্বাচনী সংগ্রামকে ঘিরে একটা অন্যরকম নেতিবাচক ধারণা তৈরি হতে শুরু করে দিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে গত কয়েকটি ভোটের অভিজ্ঞতার নিরিখে সংবাদ জগতের সঙ্গে জড়িত একটা বড় অংশের মানুষ খবর পরিবেশনের গোটা প্রেক্ষিতটিকে নিয়ে রীতিমতো সন্দিহান মানসিকতা সমাজের বুকে প্রোথিত করতে শুরু করেছেন। ফলে উপনির্বাচন হলে ক্ষমতাসীন মুখ্যমন্ত্রী যে জিতবেনই- এটা ছিল নিশ্চিত একটি অনুধ্যানই।

নির্বাচন প্রক্রিয়াকে একটা প্রহসনে পরিণত করে বাংলাদেশে একটা সময়ে জিয়াউর রহমান বা এইচএম এরশাদ যে ধরনের সঙের গণতন্ত্র কায়েম করেছিলেন, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে পশ্চিমবঙ্গে আজকে কার্যত ঠিক সেই স্তরে নামিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছেন মমতা ব্যানার্জি। ফলে তিনি যখন কোন গণতান্ত্রিক প্র্যাকটিস বা মূল্যবোধের কথা বলেন, সেইটি কার্যত মানুষের কাছে একটা বড় রকমের হাসির খোরাকে রূপান্তরিত হয়ে যায়।

এ গণতান্ত্রিক পরিকাঠামোর ভেতরে দাঁড়িয়ে রাজ্য পরিচালনার ক্ষেত্রে যে ধরনের প্রশাসনিক কার্যক্রমের ভেতর দিয়ে মমতা চলাফেরা করেন, সেখানে আমলাতন্ত্রকেই প্রশাসনের সর্বত্র বহুধাগামিনী হিসেবে আমরা দেখি। নিজের দলের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কি প্রশাসন পরিচালনার ক্ষেত্রে সমুচিত গুরুত্ব মুখ্যমন্ত্রী মমতা দেন? এক কথায় উত্তর চলে আসে, ‘না’। মমতার দল তৃণমূল কংগ্রেসের একজন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরই প্রশাসনিক স্তরে পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা আছে কিনা- এটা এখন কোটি টাকার প্রশ্ন। পার্থ চট্টোপাধ্যায়, ফিরহাদ হাকিমের মতো একদম প্রথম সারির মন্ত্রী, আপাতদৃষ্টিতে যাদের দেখলেই মনে হতে পারে, এঁরা হলেন মমতার মন্ত্রিসভায় মুখ্যমন্ত্রীর পরেই বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, বাস্তবে দেখা যায়, এই আলঙ্কারিক গুরুত্ব পাওয়া মমতার সতীর্থেরা আদৌ রাজ্য প্রশাসনে তেমন গুরুত্বপূর্ণই নন। একটা গণতান্ত্রিক পরিবেশের আদল তৈরি করে মমতা গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত নিজের রাজনৈতিক সহকর্মীদের পর্যন্ত ঠুঁটো জগন্নাথ করে রেখে দিয়েছেন, আর সেই জায়গাতে অসীম ক্ষমতার অধিকারী হলেন খোদ মুখ্যমন্ত্রীর অনুগ্রহভোগী একটা অংশের আমলারা।

জনপ্রতিনিধিদের আইনসভার কাছে তথা মানুষের কাছে একটা বিশেষ দায়বদ্ধতা আছে। আমলাদের সেটা থাকে না। তারা নির্বাচিত নন। ফলে আইনসভার তোয়াক্কা তারা করেন না। দলীয় রাজনীতির আধিপত্য যাই-ই থাকুক না কেন, একজন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি কখনোই আইনসভাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে কিছু করতে পারেন না। প্রশাসনিক স্তরে যে পদক্ষেপই একজন মন্ত্রী বা বিধায়ক নিন না কেন, সেই সিদ্ধান্তের ব্যাখ্যা দিতে তিনি আইনসভাতে বাধ্য। তার ভোটারদের কাছে, তথা বৃহত্তর ভোটার, মানে রাজ্যের জনগণের কাছে বাধ্য। এ ধরনের বাধ্যবাধকতার লেশমাত্র কোন স্তরের আমলারই থাকে না।

মমতা এ আমলাতন্ত্রের হাতেই কার্যত রাজ্যের শাসনভার তুলে দিয়েছেন। তার নিজের দলের মন্ত্রীরা যে খুব একটা প্রশাসনিক ক্ষমতাসম্পন্ন- এটা জোর গলায় বলতে পারা যায় না। তবে আমলাতন্ত্র এসব নির্বাচিত মন্ত্রীদের নিজস্ব ধারাতে চলাফেরা করবার ক্ষেত্রে কখনো কোন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে না। অপরপক্ষে মন্ত্রীরাও করেন না আমলাদের স্বাধীন বিচরণের ক্ষেত্রে। ফলে এদের ভেতরে দ্বন্দ্ব বা সংঘাত সচরাচর দেখতে পাওয়া যায় না। মন্ত্রীরা নিজেদের সব কিছু সুন্দর ভাবে পেয়ে যাচ্ছেন। আর আমলারাও জনপ্রতিনিধি না হওয়া সত্ত্বেও বিধানসভার প্রতি কোন প্রকারের দায়বদ্ধতা ছাড়াই প্রশাসনের প্রায় সর্বোচ্চস্তরের ক্ষমতা উপভোগ করে চলেছেন সুন্দর ধারাবাহিকতার ভেতর দিয়ে।

প্রশাসনের সর্বময় কর্তৃত্ব মুখ্যমন্ত্রীর পরেই অন্যান্য প্রবীণ মন্ত্রীদের ওপর ন্যস্ত না হয়ে শীর্যস্তরের আমলাবাহিনীর ওপর বর্তানোর ফলে অনেকক্ষেত্রেই আমলাদের আচরণ কার্যত রাজনীতিকদের মতো হয়ে উঠছে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বিধানসভার উপনির্বাচনে না জিতলে পশ্চিমবঙ্গে সাংবিধানিক সংকট দেখা দেবে বলে খোদ নির্বাচন কমিশনকে জানিয়েছিলেন রাজ্যের মুখ্যসচিব হরিকৃষ্ণ দ্বিবেদির। মুখ্যসচিবের এই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মন্তব্য ঘিরে সব বিরোধী দলগুলোর কাছ থেকে যে প্রতিক্রিয়া এবং রাজনৈতিক কর্মকা- প্রত্যাশিত ছিল তার পরিবর্তে শাসক দল বিবৃতিতেই বিরোধীদের তাদের রাজনৈতিক কর্তব্য পালনে বেশি তৎপর দেখা গিয়েছে।

গণতান্ত্রিক কাঠামোয় বিশ্বাসী কোন রাজনীতিকের পক্ষে প্রশাসনের সার্বিক কর্তৃত্ব আমলাতন্ত্রের হাতে তুলে দেয়া সম্ভব নয়। পশ্চিমবঙ্গে ডা. বিধানচন্দ্র রায়ের আমল থেকে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সময়কাল- কখনোই এইরকম পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। ডা. রায় তার রাজনৈতিক অবস্থানে আমলাতন্ত্রকে বেশি গুরুত্ব দিলেও গণতান্ত্রিক কাঠামোকে আজ মমতা ব্যানার্জি যে পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছেন, তার ধারপাশ দিয়ে কখনো হাঁটেননি। সুধীর মাধব বসু, ডিএম সেন প্রমুখ আমলাদের ডা. বিধান রায় অন্য অনেক আমলাদের থেকে বেশি গুরুত্ব দিতেন। এমন কি নিজের রাজনৈতিক বক্তব্যও অনেক সময়ে তিনি নিজে না বলে বশংবদ আমলাদের দিয়ে বলাতেন। পাঁচের দশকে শিক্ষকদের প্রবল আন্দোলন, গণঅবস্থান কে বিধান রায় চরম অসম্মান, উপহাস করেছিলেন, তার ই বিশেষ অনুগত আমলা ডিএম সেনকে (অমর্ত্য সেনের মামা) দিয়ে। সেই ঘটনার তীব্র রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়াও হয়েছিল। সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় তার মুখ্যমন্ত্রিত্বকালে দুর্গা সিং, দেবী রায় প্রমুখ আমলাদের প্রতি অতিরিক্ত পক্ষপাতিত্ব করে বেশ কিছু বিতর্কের সৃষ্টি করেছিলেন।

তবে এইসব রাজনীতিকদের ভেতরে কেউই প্রশাসনের সার্বিক দায়িত্ব আমলাকুলের ওপরে কখনো তুলে দেননি। মুখ্যমন্ত্রীর রাজনৈতিক ভাগ্য নিয়ন্ত্রণে এই হরিকৃষ্ণ দ্বিবেদির আগে কোনো আমলা প্রকাশ্যে একটাও কথা বলেছেন- এমন কোনো দৃষ্টান্ত অতীতে কখনো পশ্চিমবঙ্গে দেখা যায়নি। রাজনৈতিক পরিসরের বাইরে নিজের বা নিজের দলের রাজনৈতিক ভবিষৎ ঘিরে সরব হয়েছেন, মমতা ব্যানার্জি আগে এমন কোন মুখ্যমন্ত্রী কখনো পশ্চিমবঙ্গ পায়নি। আর প্রশাসনিক পরিমণ্ডলকে অতিক্রম করে নিছক মুখ্যমন্ত্রীর রাজনৈতিক ভবিষৎ নিয়ে মাথা ঘামিয়েছেন প্রকাশ্যে, নির্বাচন কমিশনের কাছে অ্যাডভোকেসি করেছেন- হরিকৃষ্ণ দ্বিবেদির আগে এমন কোনো আমলাও পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক বা প্রশাসনিক পরিমণ্ডলে ঘটেনি কখনো।

গণতান্ত্রিক পরিকাঠামোকে ছাপিয়ে বা অতিক্রম করে অথবা সোজাসাপটা কথায় পাশ কাটিয়ে আমলাতন্ত্রের নিরঙ্কুশ ক্ষমতাবৃদ্ধির একটা অতি পরাক্রমী রাজনৈতিক অভিসন্ধি থাকে। সেই অভিসন্ধিটা হলো, ধীরে ধীরে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে অকেজো করে দিয়ে সংবিধানের গ্রহণযোগ্যতা ঘিরে একটা প্রশ্নের পরিবেশ তৈরি করা। অতীতে বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ষড়যন্ত্রে যারা লিপ্ত থেকেছে, তারাই ঠারেঠোরে ’৭২-এর মহান ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান ঘিরে নানা ভাবে প্রশ্ন তোলার পরিমণ্ডল তৈরি করেছে। তারপর বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার পর, প্রথম সুযোগেই বাংলাদেশের মহান ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানকে ধ্বংস করেছে।

সংবিধান ধ্বংসের যে পরিকাঠামো আরএসএস, তার রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি, নরেন্দ্র মোদির প্রশাসন তৈরি করেছে, তার সঙ্গে কি তড়িঘড়ি ভবাণীপুরের উপনির্বাচনে মমতা না জিতলে সাংবিধানিক সংকট হবে বলে যে কথা প্রকাশ্যে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যসচিব হরিকৃষ্ণ দ্বিবেদি বলেছেন, তার ন্যূনতম সাদৃশ্য পাচ্ছেন পাঠক? ভারতের সংবিধান কি এতটাই ঠুনকো যে মাত্র কয়েক মাস আগে নন্দীগ্রামে হেরে যাওয়া মুখ্যমন্ত্রী এই কোভিড পরিস্থিতির ভেতরেও, রাজ্যের পৌরসভাগুলোর মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে গেলেও সেই কোভিডের দোহাই দিয়ে নির্বাচন না করে, ঘুরিয়ে নাক দেখানোর মতো, নিজের দলের শাসন কায়েম করেও, ভবানীপুরের উপনির্বাচনে জিতে, নিজের মুখ্যমন্ত্রিত্বের তখত সুনিশ্চিত না করতে পারলে ভারতের ঐতিহ্যময় সংবিধান রক্ষা পাবে না? পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যসচিব একজন আমলা হয়ে কি করে জানলেন, তৃণমূল কংগ্রেস নামক রাজনৈতিক দলটি ভবানীপুরের উপনির্বাচনে মমতাকেই প্রার্থী করবেন? মুখ্যসচিবের সঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেসের কি বিশেষ কোনো সম্পর্ক আছে যে, তৃণমূল তাদের প্রার্থীর নাম ঘোষণা করবার অনেক আগেই খোদ রাজ্যের মুখ্যসচিব জেনে যাচ্ছেন, শাসক দল কি করতে চাইছে। কাকে শাসক শিবির প্রার্থী করতে চাইছে উপনির্বাচনে, সেটা শাসক শিবিরের ঘোষণার আগেই মুখ্যসচিবের শ্রীমুখ থেকে নিঃসৃত হওয়ায়, এই প্রশ্নই তীব্র হয়ে উঠছে যে, তৃণমূল কংগ্রেস কি তাদের দলের মুখপাত্রের দায়িত্ব দিয়েছে রাজ্যের মুখ্যসচিব কে? নাকি মুখ্যসচিব রাজ্যের শাসকদলের হাঁড়ির খবর নির্বাচন কমিশনের মতো সংস্থাকে জানিয়ে হাটে হাঁড়ি ভেঙে দিতে চাইছেন রাজ্যের শাসকদল তৃণমূলের? সেই জলের উপর পানি, না পানির উপর জল— লালন ফকিরের গূঢ় তত্ত্বের আধুনিক সংস্করণ নয় তো?

গত বিধানসভার ভোটে (২০২১) নন্দীগ্রাম থেকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা হেরে গিয়েছিলেন। মুখ্যমন্ত্রীর সেই পরাজয়, ব্যক্তি মমতার বা তার দল তৃণমূল কংগ্রেসের পরাজয় ঘিরে শাসক শিবিরে যে সংকট তৈরি হয়েছিল, অনিশ্চয়তার পরিবেশ রচিত হয়েছিল, তাকে সাংবিধানিক সংকট বলে কেন অভিহিত করলেন পশ্চিমবঙ্গের শীর্ষস্থানীয় আমলা? সংবিধানের মূল পরিকাঠামোকে বদলে দেয়ার যে চক্রান্ত হিন্দু সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী শিবির থেকে করা হচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যসচিবের কল্পিত সাংবিধানিক সংকটের সঙ্গে তার কি কোনো রকমের যোগসূত্র রয়েছে?

এভাবে আমলাতন্ত্র নির্ভর যে প্রশাসন মমতা দীর্ঘ দশ বছরেরও বেশি সময় ধরে পরিচালনা করে চলেছেন, তা কি আদৌ তার দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মী মেনে নিতে পারছেন? আমলাতন্ত্রের এই সর্বোময় কর্তৃত্বের ফলে গণতান্ত্রিক পরিকাঠামোতে যে সংকট তৈরি হচ্ছে তা কি সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ধারক-বাহকদের একটা বিশেষ রকমের সুবিধা করে দিচ্ছে না? গণতন্ত্রের সঙ্কোচনে যদি আমলাতন্ত্র ক্ষমতাবান হয়ে ওঠে, তবে সেই বিপদ কাদের? আমলাতন্ত্র যদি নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের ছাপিয়ে যেতে শুরু করে, তবে সেই সংকট কি স্বৈরতন্ত্রের চরম পর্যায়কে অতিক্রম করে একটা বীভৎস প্রবণতার দিকে গোটা শাসনব্যবস্থাকেই অচিরে ঠেলে দেবে না? গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে যদি আমলাতন্ত্রের দ্যোতনায় বিচার করা হয়, বিশ্লেষণ করা হয়, ভারতে আজকের সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী রাজনীতির বাড়বাড়ন্তের কালে তা কি কোন ইতিবাচক বার্তা দিতে সক্ষম হবে?

ডা. বিধানচন্দ্র রায়ের জীবদ্দশার শেষ ভোটে বৌবাজার কেন্দ্রে তাকে পোস্টাল জেতাবার ক্ষেত্রে আমলাতন্ত্রের ভূমিকা পশ্চিমবঙ্গের সংসদীয় রাজনীতির ইতিহাসে একটা বিতর্কিত অধ্যায়। সেই অধ্যায়কে ছাপিয়ে গেল ভবানীপুর কেন্দ্রের উপনির্বাচন ঘিরে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যসচিবের আচরণ। এই বিষয়ে মামলাটি মহামান্য কোর্টের বিচারাধীন। আজ হোক, কাল হোক আদালত একটা সিদ্ধান্ত দেবেন। সেই সিদ্ধান্ত সবার কাছে পরিত্যাজ্য হবে, এমনটা ভাববার যেমন কোন কারণ নেই, আবার সবারই কাছে গ্রহণযোগ্য হবে- তেমনটা ভেবে নেয়ারও কোন কারণ নেই। কিন্তু এসব ছাপিয়েও শাসককে তুষ্ট করতে আমলাতন্ত্রের ভূমিকা বা শাসক আমলাতন্ত্র কে কিভাবে নিজের ক্রীড়নক ভৃত্যে পরিণত করেছেÑ এই বিতর্ক কিন্তু চলতেই থাকবে।

[লেখক : ভারতীয় ইতিহাসবিদ]