রোহিঙ্গা সংকটের শেষ কোথায়

রণেশ মৈত্র

অতি সম্প্রতি নিজ অফিসে কর্মরত থাকা অবস্থায় রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের নেতা আততায়ীর গুলিতে নিহত হন। কি কারণে এবং কারা এই হত্যাকা- ঘটলো তা তদন্তের ব্যাপার। এই ঘটনার পর পরই বাংলাদেশস্থ আমেরিকার রাষ্ট্রদূত, ব্রিটিশ হাই কমিশনার ও অপরাপর আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা দ্রুততার সঙ্গে এর প্রতিবাদ জানিয়ে দ্রুত উপযুক্ত তদন্ত দাবি করেছেন। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন তার প্রত্যয় জানিয়ে বললেন, গভীর নিষ্ঠার সঙ্গে মুহিবুল্লাহ্ হত্যার তদন্ত করতে বাংলাদেশ সরকার বদ্ধ পরিকর। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তার স্বভাবসুলভ ভাষায় বললেন, যিনি বা যারাই অপরাধী হোক না কেন সুষ্ঠু তদন্ত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

রোহিঙ্গাদের দেশে ফিরে যাওয়া নিয়ে ও তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় মুহিবুল্লাহ্ ‘আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটাস’ নামের একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ক্যাম্পের রোহিঙ্গাদের কাছে তিনি ‘মাস্টার মুহিবুল্লাহ্’ নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন।

মুহিবুল্লাহ্ রোহিঙ্গাদের এক পতাকাতলে আনতে সমর্থ হন। রোহিঙ্গাদের নিজ মাটিতে ফেরানোর স্বপ্ন দেখাতে পেরেছিলেন। সর্বশেষ মায়ানমারের গণতান্ত্রিক গ্রুপগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করে মুহিবুল্লাহ্ রোহিঙ্গাদের কথা-তাদের বোঝাতে সক্ষম হন। তার মতো ক্যারিশম্যাটিক নেতার কারণে ক্যাম্প ঘিরে আরসাসহ বিভিন্ন সশস্ত্র গ্রুপ আতঙ্কিত ছিল। তার হত্যার মধ্য দিয়ে সশস্ত্র গ্রুপগুলো তাদের কর্মকাণ্ডের বিস্তৃতি ঘটাতে সক্ষম হবে বলে অনেকেই আশঙ্কা প্রকাশ করছেন মুহিবুল্লাহ্।

অপরদিকে মায়ানমার এই হত্যাকাণ্ডের দায় তাদের কাঁধে এসে পড়তে পারে এমন আশঙ্কায় তারা অর্থাৎ রোহিঙ্গা স্যালভশন আর্মির মুখপত্র মৌলভী সোয়েব দাবি করেছেন ‘এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে আরসা কোনভাবেই জড়িত নয় মায়ানমার সরকারের এজেন্টরাই মুহিবুল্লাহ হত্যায় জড়িত।

হত্যাকণ্ডের পর মুহিবুল্লাহ্র ভাই হাবিবুল্লাহ্ এ ঘটনায় আরসার হাত রয়েছে বলে অভিযোগ করেছনে। এরপর বৃহস্পতিবার রাতে অডিও বার্তা প্রচার করে আরসা।

মৌলভী ঘোরেব বলেন, ‘আমাদের ভাই মাস্টার মুহিবুল্লাহ রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যার বিচার নিয়ে কাজ করছিলেন। পূর্ণ অধিকার প্রতিষ্ঠা করে রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরাতে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তার প্রচেষ্টা ছিল অসাধারণ। এমন একজন রোহিঙ্গা নেতাকে হত্যা রোহিঙ্গাদের জন্য একটা বড় ক্ষতি। তিনি বলেন, এর আগেও মে মাসে ১৫ তারিখে আর এক রোহিঙ্গা নেতা শত্তকত আলীকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। তাতে মুহিবুল্লাহ্ হত্রার প্রত্যক্ষদর্শী কয়েকজনের বক্তব্য রয়েছে।

কক্সবাজারের মাঠপর্যায়ের আর এক কর্মকর্তা বলেছেন, রোহ্গিা সশস্ত্র গ্রুপগুলোর হাতে শুটার গান ছাড়াও অল্পসংখ্যক ৭.৬৫ বোরের পিস্তল ও আইএমএস পিস্তল রয়েছে। মুহিবুল্লাহ্কে হত্যা করা হয়েছে। তা না হলে একসঙ্গে এতগুলো গুলি ছোঁড়া সম্ভব ছিল না। এই হত্যাকাণ্ডকে সশস্ত্র বাহিনীর গ্রুপগুলোর পক্ষ থেকে একটি তাৎপর্যপূর্ণ বার্তা বলে মনে করা হচ্ছে। এটা একাধারে যেমন রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নিরাপত্তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে, তেমনি রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে একটা অনিশ্চয়তাও তৈরি করতে পারে। সংশ্লিষ্টরা এতও বলেছেন, কক্সবাজারকে ঘিরে সরকারের একাধিক মেগা প্রকল্পের কাজ চলছে। সেখানে নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিরাপদ রাখা অত্যন্ত জরুরি। দেশি-বিদেশি অশুভ তৎপরতার বিরুদ্ধে ভবিষ্যতে অনেক বেশি তৎপর ও সতর্ক থাকার বিষয়টি জোরালোভাবে বিবেচনায় নেয়ার কথা বলছেন অনেকে।

জানা যায়, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বিভিন্ন নামে যে সব বাহিনী রয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে রকি বাহিনী শুক্কুর বাহিনী, আবদুল হাকিম বাহিনী, সাদ্দাম গ্রুপ, জাকির বাহিনী, মুন্না নবী হোসেন ও জফির বাহিনী। ক্যাম্পে প্রায় নিয়মিত হানা দিচ্ছে তারা, গুলিও চালাচ্ছে। সাধারণ রোহিঙ্গারা তাদের কাজে জিম্মি হয়ে পড়েছে নিতান্তর অসহায় হয়ে। এই পরিস্থিতিতে দেশি-বিদেশি এনজিও রাও শংকিত। কক্সবাজারের বিভিন্ন রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ব্লক বা ক্যাম্প ইন চার্জেদের স্থানীয়ভাবে মাঝি বলা হয়। তারা সাধারণত: ক্যাম্পের যাবতীয় সমস্যা নিরসনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে তথ্য দিয়ে কার্যক্রম সমন্বয় করে। অভিযোগ উঠেছে, অনেক মাঝিই রোহিঙ্গা অপরাধী চক্রকে সহায়তা করছে।

ক্যাম্প ঘিরে সক্রিয় এসব সশস্ত্র গ্রুপের অপরাধ তৎপরতার মধ্যে রয়েছে অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়। এছাড়াও অনেকে ইয়াবা ও অস্ত্র কারবারের নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। আবার নাবীদের জিম্মি করে অনৈতিক কাজে জড়াতে বাধ্য করে সশস্ত্র গ্রুপগুলোর অনেক সদস্য। সাধারণ রোহিঙ্গাদের অন্য দেশে পাচার করেও অনেকে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে। অপর সশস্ত্র গ্রুপের আস্তানায় অভিযানে গেলে র‌্যাবের ওপর গুলি চালায়। ২০১০ সালের ৩০ ডিসেম্বর নয়াপাড়া ক্যাম্পের পাশে একটি সশস্ত্র গ্রুপের আস্তানায় অভিযানে গেলে র‌্যাবের ওপর গুলি চালায় একটি বাহিনী। এতে কক্সবাজার র‌্যাব-১৫ এর সিপিসি-২ হোয়াইক্যাং ক্যাম্পের সৈনিক ইমরান ও করপোরাল শাহাবুদ্দিন গুলিবিদ্ধ হন। চলতি বছরের জুলাই এ টেকনাফ থেকে সিএনজিচালিত অটোচালক মাহমুদুল করিমকে অপহরণ করে তার পরিবারের কাছে ১০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে তার পরিবারের কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকা দেয়া হলেও তাকে জীবিত পাওয়া যায়নি। পরে বনবিভাগ জঙ্গল পরিষ্কার করতে গেলে একটি কংকাল দেখতে পায়। সেই কংকালের পরণের পোশাক দেখে তাকে মাহমুদুল করিম হিসেবে চিহ্নিত করে তার পরিবার। এই ঘটনায়ও রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গ্রুপগুলো জড়িত বলে জানা যায়। এছাড়া রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের পক্ষ থেকে বিভিন্ন ব্যবসায়ীকে কল করে চাঁদাও দাবি করা হয়। জানা যায়, কাপড় ব্যবসায়ী নূর নবীর কাছ থেকে চাঁদাও আদায় করেছিল সন্ত্রাসীরা। এই করুণ এবং ভয়াবহ বা নারকীয় ইতিহাসের শেষ নেই যেন।

জনপ্রিয় রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহকে হত্যার পর কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নিরাপত্তা নিয়ে নতুন উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। অনেক সাধারণ রোহিঙ্গার মনে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ক্যাম্প ঘিরে একগুচ্ছ নতুন পরিকল্পনা নিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নীতিনির্ধারকরা। লাম্বাশিয়ায় সে ক্যাম্পে মুহিবুল্লাহকে খুন করা হয় সেখানে আর্মড পুলিশ ব্যাটেলিয়ানের (এপিবিএন) সদস্য সংখ্যা চারগুণ বাড়ানো হয়েছে। এর একটি দায়িত্ব পালন করবে ভাসানচরে অপরটি কক্সবাজারে। টানা ব্লক রেইড ও চিরুনি অভিযান চালানোরও সিদ্ধান্ত হয়েছে।

মুহিবুল্লাহকে হত্যার আগে গোয়েন্দা এবং দেশীয় আইন রক্ষাকারী বাহিনী ব্যর্থ হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে প্রশ্ন ওঠে যে,

রোহিঙ্গাদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করতে সরকার এবং বিদেশিরা যারা মুহিবুল্লা হত্যায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন তারা কি আদৌ আন্তরিক এবং তৎপর।

সীমিত আয়তনের বাংলাদেশ কি অনির্দিষ্টকালের জন্য লাখ লাখ রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে সক্ষম?

বিদেশি রাষ্ট্রগুলো কি উপযুক্ত পরিমাণে মায়ানমারের ওপর চাপ দিচ্ছে।

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আদালত ও সংস্থাগুলো রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে সত্যই ফেরাতে চান, নাকি তাদের বাংলাদেশে রেখে নানা স্বার্থ হাসিল করতে চান? যে করেই হোক, রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠাতে হবে-নইলে সংকট বাড়বেই।

[লেখক : সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ]

raneshmaitra@gmail.com

সোমবার, ১১ অক্টোবর ২০২১ , ২৬ আশ্বিন ১৪২৮ ০৩ রবিউল আউয়াল ১৪৪৩

রোহিঙ্গা সংকটের শেষ কোথায়

রণেশ মৈত্র

অতি সম্প্রতি নিজ অফিসে কর্মরত থাকা অবস্থায় রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের নেতা আততায়ীর গুলিতে নিহত হন। কি কারণে এবং কারা এই হত্যাকা- ঘটলো তা তদন্তের ব্যাপার। এই ঘটনার পর পরই বাংলাদেশস্থ আমেরিকার রাষ্ট্রদূত, ব্রিটিশ হাই কমিশনার ও অপরাপর আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা দ্রুততার সঙ্গে এর প্রতিবাদ জানিয়ে দ্রুত উপযুক্ত তদন্ত দাবি করেছেন। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন তার প্রত্যয় জানিয়ে বললেন, গভীর নিষ্ঠার সঙ্গে মুহিবুল্লাহ্ হত্যার তদন্ত করতে বাংলাদেশ সরকার বদ্ধ পরিকর। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তার স্বভাবসুলভ ভাষায় বললেন, যিনি বা যারাই অপরাধী হোক না কেন সুষ্ঠু তদন্ত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

রোহিঙ্গাদের দেশে ফিরে যাওয়া নিয়ে ও তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় মুহিবুল্লাহ্ ‘আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটাস’ নামের একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ক্যাম্পের রোহিঙ্গাদের কাছে তিনি ‘মাস্টার মুহিবুল্লাহ্’ নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন।

মুহিবুল্লাহ্ রোহিঙ্গাদের এক পতাকাতলে আনতে সমর্থ হন। রোহিঙ্গাদের নিজ মাটিতে ফেরানোর স্বপ্ন দেখাতে পেরেছিলেন। সর্বশেষ মায়ানমারের গণতান্ত্রিক গ্রুপগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করে মুহিবুল্লাহ্ রোহিঙ্গাদের কথা-তাদের বোঝাতে সক্ষম হন। তার মতো ক্যারিশম্যাটিক নেতার কারণে ক্যাম্প ঘিরে আরসাসহ বিভিন্ন সশস্ত্র গ্রুপ আতঙ্কিত ছিল। তার হত্যার মধ্য দিয়ে সশস্ত্র গ্রুপগুলো তাদের কর্মকাণ্ডের বিস্তৃতি ঘটাতে সক্ষম হবে বলে অনেকেই আশঙ্কা প্রকাশ করছেন মুহিবুল্লাহ্।

অপরদিকে মায়ানমার এই হত্যাকাণ্ডের দায় তাদের কাঁধে এসে পড়তে পারে এমন আশঙ্কায় তারা অর্থাৎ রোহিঙ্গা স্যালভশন আর্মির মুখপত্র মৌলভী সোয়েব দাবি করেছেন ‘এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে আরসা কোনভাবেই জড়িত নয় মায়ানমার সরকারের এজেন্টরাই মুহিবুল্লাহ হত্যায় জড়িত।

হত্যাকণ্ডের পর মুহিবুল্লাহ্র ভাই হাবিবুল্লাহ্ এ ঘটনায় আরসার হাত রয়েছে বলে অভিযোগ করেছনে। এরপর বৃহস্পতিবার রাতে অডিও বার্তা প্রচার করে আরসা।

মৌলভী ঘোরেব বলেন, ‘আমাদের ভাই মাস্টার মুহিবুল্লাহ রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যার বিচার নিয়ে কাজ করছিলেন। পূর্ণ অধিকার প্রতিষ্ঠা করে রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরাতে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তার প্রচেষ্টা ছিল অসাধারণ। এমন একজন রোহিঙ্গা নেতাকে হত্যা রোহিঙ্গাদের জন্য একটা বড় ক্ষতি। তিনি বলেন, এর আগেও মে মাসে ১৫ তারিখে আর এক রোহিঙ্গা নেতা শত্তকত আলীকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। তাতে মুহিবুল্লাহ্ হত্রার প্রত্যক্ষদর্শী কয়েকজনের বক্তব্য রয়েছে।

কক্সবাজারের মাঠপর্যায়ের আর এক কর্মকর্তা বলেছেন, রোহ্গিা সশস্ত্র গ্রুপগুলোর হাতে শুটার গান ছাড়াও অল্পসংখ্যক ৭.৬৫ বোরের পিস্তল ও আইএমএস পিস্তল রয়েছে। মুহিবুল্লাহ্কে হত্যা করা হয়েছে। তা না হলে একসঙ্গে এতগুলো গুলি ছোঁড়া সম্ভব ছিল না। এই হত্যাকাণ্ডকে সশস্ত্র বাহিনীর গ্রুপগুলোর পক্ষ থেকে একটি তাৎপর্যপূর্ণ বার্তা বলে মনে করা হচ্ছে। এটা একাধারে যেমন রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নিরাপত্তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে, তেমনি রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে একটা অনিশ্চয়তাও তৈরি করতে পারে। সংশ্লিষ্টরা এতও বলেছেন, কক্সবাজারকে ঘিরে সরকারের একাধিক মেগা প্রকল্পের কাজ চলছে। সেখানে নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিরাপদ রাখা অত্যন্ত জরুরি। দেশি-বিদেশি অশুভ তৎপরতার বিরুদ্ধে ভবিষ্যতে অনেক বেশি তৎপর ও সতর্ক থাকার বিষয়টি জোরালোভাবে বিবেচনায় নেয়ার কথা বলছেন অনেকে।

জানা যায়, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বিভিন্ন নামে যে সব বাহিনী রয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে রকি বাহিনী শুক্কুর বাহিনী, আবদুল হাকিম বাহিনী, সাদ্দাম গ্রুপ, জাকির বাহিনী, মুন্না নবী হোসেন ও জফির বাহিনী। ক্যাম্পে প্রায় নিয়মিত হানা দিচ্ছে তারা, গুলিও চালাচ্ছে। সাধারণ রোহিঙ্গারা তাদের কাজে জিম্মি হয়ে পড়েছে নিতান্তর অসহায় হয়ে। এই পরিস্থিতিতে দেশি-বিদেশি এনজিও রাও শংকিত। কক্সবাজারের বিভিন্ন রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ব্লক বা ক্যাম্প ইন চার্জেদের স্থানীয়ভাবে মাঝি বলা হয়। তারা সাধারণত: ক্যাম্পের যাবতীয় সমস্যা নিরসনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে তথ্য দিয়ে কার্যক্রম সমন্বয় করে। অভিযোগ উঠেছে, অনেক মাঝিই রোহিঙ্গা অপরাধী চক্রকে সহায়তা করছে।

ক্যাম্প ঘিরে সক্রিয় এসব সশস্ত্র গ্রুপের অপরাধ তৎপরতার মধ্যে রয়েছে অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়। এছাড়াও অনেকে ইয়াবা ও অস্ত্র কারবারের নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। আবার নাবীদের জিম্মি করে অনৈতিক কাজে জড়াতে বাধ্য করে সশস্ত্র গ্রুপগুলোর অনেক সদস্য। সাধারণ রোহিঙ্গাদের অন্য দেশে পাচার করেও অনেকে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে। অপর সশস্ত্র গ্রুপের আস্তানায় অভিযানে গেলে র‌্যাবের ওপর গুলি চালায়। ২০১০ সালের ৩০ ডিসেম্বর নয়াপাড়া ক্যাম্পের পাশে একটি সশস্ত্র গ্রুপের আস্তানায় অভিযানে গেলে র‌্যাবের ওপর গুলি চালায় একটি বাহিনী। এতে কক্সবাজার র‌্যাব-১৫ এর সিপিসি-২ হোয়াইক্যাং ক্যাম্পের সৈনিক ইমরান ও করপোরাল শাহাবুদ্দিন গুলিবিদ্ধ হন। চলতি বছরের জুলাই এ টেকনাফ থেকে সিএনজিচালিত অটোচালক মাহমুদুল করিমকে অপহরণ করে তার পরিবারের কাছে ১০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে তার পরিবারের কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকা দেয়া হলেও তাকে জীবিত পাওয়া যায়নি। পরে বনবিভাগ জঙ্গল পরিষ্কার করতে গেলে একটি কংকাল দেখতে পায়। সেই কংকালের পরণের পোশাক দেখে তাকে মাহমুদুল করিম হিসেবে চিহ্নিত করে তার পরিবার। এই ঘটনায়ও রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গ্রুপগুলো জড়িত বলে জানা যায়। এছাড়া রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের পক্ষ থেকে বিভিন্ন ব্যবসায়ীকে কল করে চাঁদাও দাবি করা হয়। জানা যায়, কাপড় ব্যবসায়ী নূর নবীর কাছ থেকে চাঁদাও আদায় করেছিল সন্ত্রাসীরা। এই করুণ এবং ভয়াবহ বা নারকীয় ইতিহাসের শেষ নেই যেন।

জনপ্রিয় রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহকে হত্যার পর কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নিরাপত্তা নিয়ে নতুন উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। অনেক সাধারণ রোহিঙ্গার মনে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ক্যাম্প ঘিরে একগুচ্ছ নতুন পরিকল্পনা নিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নীতিনির্ধারকরা। লাম্বাশিয়ায় সে ক্যাম্পে মুহিবুল্লাহকে খুন করা হয় সেখানে আর্মড পুলিশ ব্যাটেলিয়ানের (এপিবিএন) সদস্য সংখ্যা চারগুণ বাড়ানো হয়েছে। এর একটি দায়িত্ব পালন করবে ভাসানচরে অপরটি কক্সবাজারে। টানা ব্লক রেইড ও চিরুনি অভিযান চালানোরও সিদ্ধান্ত হয়েছে।

মুহিবুল্লাহকে হত্যার আগে গোয়েন্দা এবং দেশীয় আইন রক্ষাকারী বাহিনী ব্যর্থ হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে প্রশ্ন ওঠে যে,

রোহিঙ্গাদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করতে সরকার এবং বিদেশিরা যারা মুহিবুল্লা হত্যায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন তারা কি আদৌ আন্তরিক এবং তৎপর।

সীমিত আয়তনের বাংলাদেশ কি অনির্দিষ্টকালের জন্য লাখ লাখ রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে সক্ষম?

বিদেশি রাষ্ট্রগুলো কি উপযুক্ত পরিমাণে মায়ানমারের ওপর চাপ দিচ্ছে।

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আদালত ও সংস্থাগুলো রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে সত্যই ফেরাতে চান, নাকি তাদের বাংলাদেশে রেখে নানা স্বার্থ হাসিল করতে চান? যে করেই হোক, রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠাতে হবে-নইলে সংকট বাড়বেই।

[লেখক : সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ]

raneshmaitra@gmail.com