আগাছা-পরগাছা ভর করে বটবৃক্ষে

এম এ কবীর

অর্থ ছাড়া প্রয়োজন মেটে না। তাই অর্থ উপার্জন করতেই হয়। এই প্রতিযোগিতায় সবাই লিপ্ত। আমাদের বেশিরভাগ আয়োজন প্রয়োজনকে ঘিরেই। তবে চাইলেই অর্থ আয়ের জন্য যেকোনো কাজকে বেছে নেয়া যায় না। রাষ্ট্রীয় আইন, বিবেক, ধর্মের বিধিনিষেধ মেনে শ্রম ব্যয় করে অর্থ আয় করতে হয়। বৈধ-অবৈধতার মানদণ্ডে নির্ভেজাল থাকতে হয়। ছোটবেলা থেকে শিশুকে মন্ত্র শেখানো হয়; বড় হওয়ার মন্ত্র। কীভাবে অর্থ-কড়ির মালিক হওয়া যায়। কিছু বিত্তশালী মানুষকে আদর্শরূপে হাজির করা হয় প্রজন্মের সামনে। তারা ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার কিংবা আরও বড় পেশায় গিয়ে টাকা আয় করছে। তাই তাকেও এমন কিছু করতে হবে যাতে তাদের মতো টাকা রোজগার করা যায়। মোটা অঙ্কের টাকা। আর বড় বড় পদের লোভ দেখিয়ে প্রতিযোগিতায় নামানো হয় শৈশবেই।

এই প্রজন্ম বড় হয়ে লোভকে সংবরণ করবে কীভাবে? লোভকে সংবরণ করতে না পেরে সমাজে, দেশে ঘটায় হরেকরকম অপরাধ,নৈরাজ্য-বিশৃঙ্খলা। আপনজনের নামে আচমকা কোনো দুর্নাম শুনলে খারাপ লাগে, চোখে জলও আসে। কিন্তু তাকে যে লোভ দেখিয়ে বড় করা হয়েছে সে সেই লোভের পশ্চাতে তো ছুটবেই। নতুন প্রজন্মের পথচলায় অনুপ্রেরণা হবে মানুষের মতো মানুষরা, কোনো টাকার কুমির নয়। কিন্তু সমাজ বিত্তশালী এবং উচ্চপদে আসীন হওয়া ছাড়া মূল্য দেয় না।

বিত্তশালীরা কীভাবে টাকার মালিক হলেন, কোনপথে উচ্চপদ দখল করলেন- তা কখনো খতিয়ে দেখে না। শিশুকে খেতে, বসতে, ঘুমাতে যখন উচ্চপদ আর টাকার লোভ দেখানো হয় তখন তার ভেতরের নিষ্পাপ সত্তা এ কথাগুলো বারবার জপে।

মানুষের জন্য যারা জীবন দিয়ে পৃথিবীর ইতিহাসে স্মরণীয় হয়েছেন, তাদের কথা বললে কিংবা লিখিত বই নতুন প্রজন্মের হাতে দিলে পাঠ করে এক সময় মানবদরদি একটা প্রজন্ম গড়ে উঠবে। কিন্তু সমাজের উচ্চবর্গের কাতারে শামিল হতে বলা হয়Ñ যে কোনো উপায়ে। লোভনীয় চাকরির স্বপ্ন দেখিয়ে লালন করা হয়। এজন্য প্রজন্মের পর প্রজন্ম পদ লোভার্ত হয়ে গড়ে ওঠে।

তাদের লোভে বেপরোয়া হয়ে দুর্নীতি, ষড়যন্ত্র, খুন হানাহানির আশ্রয় নেয়। এমনকি হিটলার, মুসোলিনি হওয়ার আশঙ্কাও থাকে। সমাজের স্থুলবুদ্ধিসম্পন্ন লোকরা ভবিষ্যতের এই ভয়াবহ অবস্থার কথাগুলো ভাবেন না। তারা সেই ঘৃণিত নিয়মেই একটি প্রজন্মের গোড়াপত্তন করে। এমনই একটি প্রজন্মের অধীনে বাস করে সমাজ, দেশ, জাতি। কারণ, সমাজই তাকে এগুলো শিখিয়ে থাকে। এই সমাজ মুখে বলে লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু, অতি লোভে তাঁতি নষ্ট ইত্যাদি প্রবাদ। কিন্তু কাজে প্রতীয়মান হয় তার বিপরীত চিত্র ও চরিত্র। প্রত্যেক ধর্মে লোভকে সংবরণ করতে বলা হয়েছে। বিপরীতে দেয়া হয়েছে মানবতা এবং ধৈর্যের শিক্ষা। কিন্তু সেই কথাগুলো সমাজের চোখে পড়লেও মস্তিষ্কে গাঁথে না।

এক দিনে নিয়োগের ২১টি পরিক্ষা হলো। এমনিতেই অফিসপাড়ায় ছাঁটাইয়ের কালো থাবা বিপর্যস্ত করেছে চাকরিজীবীদের। এবার তার সঙ্গে যোগ হলো চাকরি প্রার্থীদের অসহায়ত্ব। বিবেচনাহীন সিদ্ধান্তে এ রকম কান্ডজ্ঞানহীন আচরণে চাকরি প্রার্থীরা যে ক্ষুব্ধ ও আশাহত তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। বহুকাল ধরেই সরকারি বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের সমন্বয়হীনতা দেখে আসছেন নাগরিকরা। জ্যেষ্ঠ নাগরিকেরা নিশ্চয়ই ভুলে যাননি তাদের সড়কের ভাঙা-গড়ার ইতিহাস। ঝাঁ-চকচকে রাস্তা তৈরি করার কিছুদিন পরই দেখা যায় সেই রাস্তার পেট কাটার জন্য হাজির হয়েছে পয়োনিষ্কাশন কর্তৃপক্ষ।

পয়োনিষ্কাশনের কাজ শেষ হওয়ার পর আধামাধাভাবে সে রাস্তার ক্ষত ঢেকে দেয়ার পরপরই আবার খুঁড়েছে ওয়াসা। এ রকম একটার পর একটা কর্তৃপক্ষ রাস্তা খুঁড়েছে আর জুড়েছে। ফলে যে মসৃণ সড়কটি তৈরি হয়েছিল, তা অল্পদিনের মধ্যেই তার জৌলুশ হারিয়ে অস্ত্রোপচারের রোগীর মতো ধুঁকেছে।

ওরা পাসপোর্ট করবে, ভোগান্তি। ওরা ভিসা নেবে, জালিয়াতি। ওরা বিদেশে যাবে, টিকিট নেই। ওরা যেখানেই যাবে, দুর্ভোগ ওদের পিছু ছাড়ে না। ওরা প্রবাসী। বাংলাদেশের অর্থনীতি বাঁচিয়ে রাখার শক্তি জোগায় ওরা। ওদের সমস্যাগুলোর সমাধান হয় না। এখন ভোগান্তি টিকা নিয়ে। করোনাকালে যখন সব বন্ধ, অচল, তখন প্রবাসীরা সবচেয়ে বেশি রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন। নিজেরা খেয়ে না-খেয়ে সংকটের মধ্যেও পরিবারের কাছে টাকা পাঠিয়েছেন। তারা বিদেশে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে কত রকমের শারীরিক, মানসিক নির্যাতন সহ্য করেও যা আয় করেন তা দেশে পাঠান। এই টাকায় দেশের অর্থনীতির গতি বাড়ে। সরকার বৈদেশিক মুদ্রায় আমদানির খরচ মেটায়, মেগা প্রকল্পের সরঞ্জাম কেনে। কত কিছুই না হয় তাঁদের টাকায়।

প্রবাসীরা নিজেদের সবটুকু উজাড় করে দেন দেশের জন্য। অথচ সেবা পাওয়ার বেলায় তারা থাকেন তলানিতে। অনেকের ভিসা বাতিল হয়ে যায়, অনেক দেশ বাংলাদেশের কর্মীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করে। অনেকে বেকার হয়ে যান। এরপর আবারও তারা জমিজমা বন্ধক রেখে ভাগ্যের খোঁজে বিদেশে যাওয়ার ভিসা নেন। নিজেরা যখন সব প্রস্তুতি শেষ করে আনেন, তখনই নতুন বিপত্তিতে পড়েন তারা।

ইতিহাসেরও অনেক ক্ষণ থাকে। আড়াল থাকে। আগাছা-পরগাছা ভর করে বটবৃক্ষে। জঙ্গলে ঢেকে যায় চারপাশটা। খাঁটিরা নীরব অভিমানে দূরে সরে যায়। শুরু হয় নকলদের সুসময়। চকচকে ভাবের কারণে আসল-নকল আলাদা করা যায় না। উঁইপোকা মাটির ঢিবি বানায় সুন্দর করে, কিন্তু সে মাটি কোনো কাজে লাগে না। কোনো কিছু উৎপাদনও হয় না। ঝুরঝুরে মাটিতে পা রাখলেই শেষ। ঘুণপোকার খেয়ে ফেলা কাঠ দেখতে শৈল্পিক মনে হয়। কিন্তু মানুষের বসতঘর শেষ হয়ে যায়।

সামাজিকমাধ্যমে একটা ভিডিও রয়েছে। পুলিশ ম্যানহোলে পড়ে থাকা হাঁসের বাচ্চা উদ্ধার করছে। একটা নয় এমন অসংখ্য ভিডিও রয়েছে পুলিশকে নিয়ে। আর এর সবকটিই উন্নত বিশে^র। তারা কেন উন্নত হয়েছে তার অনেকটা প্রমানই এসব ভিডিও।

শিশু অঙ্ক মেলাতে পারছে না, ফোন করলো পুলিশকে। পুলিশ অফিসার এলেন ফোন পেয়ে, তিনিও অঙ্কটি মেলাতে পারলেন না। ডাকলেন আরেক সহকর্মীকে। সেই সহকর্মী এসে শিশুটির অঙ্ক মিলিয়ে দিলেন। একজন শিশুও জানে পুলিশকে ফোন দিলে সব সমস্যার সমাধান হয়। এ ঘটনাটিও আমাদের দেশের নয়, প্রথম বিশে^র একটি দেশের।

আমাদের কোন শিশু যদি পুলিশকে ফোন দেয় অঙ্ক মেলানোর জন্য তবে কী হবে? সম্ভবত বাচ্চার পরিবারের ওপর দিয়ে যাবে তার কাফফরা। পুলিশকে অযথা হয়রানির দায়ে ভুগতে হবে তাদের।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার ‘কারাগারের রোজনামচা’ বইয়ের ৪৩ পৃষ্ঠায় লিখেছেনÑ

দুপুর বেলা দেখা এক মওলানা সাহেবের সঙ্গে, কোরআনে হাফেজ, তার বাবাও খুব বড় পীর ছিলেন, কুমিল্লায় বাড়ি। হাজতিদের মধ্যে নামাজ পড়বার আগে বক্তৃতা করছেন, হাজতিরা বসে শুনছে। আমি দূরে দাঁড়াইয়া তার বক্তৃতা শুনছি। তিনি বলছেন খুব জোরে দরুদ শরীফ পড়। শয়তান দূর হয়ে যাবে। জোরে পড়। অনেকক্ষণ বক্তৃতা করলেন; সুন্দর চেহারা, অল্প বয়স, চমৎকার বলার কায়দা। তবে জামাটা খুব বড়। ঐটা দেখেই মনে সন্দেহ হলো।

একদম পা পর্যন্ত জামা। বোধহয় ছয় সাত গজ হবে কমপক্ষে। তজবি হাতেই আছে। মাঝে মাঝে চক্ষু বুজে কথা বলেন। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘এই মাওলানা সাহেব কী মামলায় এসেছেন?’ আমাকে এক ‘পাহারাদার’ বললো, ‘জানেন না, রেপ কেস’; একটা ছাত্রীকে পড়াতো তার ওপর পাশবিক অত্যাচার করেছে, মসজিদের ভিতর। মেয়েটার ১২-১৩ বৎসর বয়স, চিৎকার করে উঠলে লোক এসে দেখে ফেলে। তারপর ধরে আচ্ছামতো মারধর করে। জেলে এসে কয়দিন তো হাসপাতালেই থাকতে হয়েছে। আমি বললাম, ‘হাজতে এসে ধর্ম প্রচার শুরু করেছে’। বেটা তো খুব ভণ্ড। জমাইছে তো বেশ।

সন্ধ্যার পর আমাদের তালাবন্ধ করে দিয়েছে। আমাদের উপরের কোঠায় সেই হাফেজ সাহেব থাকতেন। মাগরিবের পর চলল তার ‘মিলাদ’ অনেকক্ষণ, তারপর দরুদ, তারপর চলল কোরআন তেলাওয়াত। তিনিও যে কোরআনে হাফেজ সেইটাই দেখাতে ব্যস্ত আছেন বলে আমার মনে হলো। মামলায় তার চার বৎসর সশ্রম কারাদ- হয়। তিনি দরখাস্ত করেছিলেন ডিভিশন পাওয়ার জন্য। যদিও তার গ্রামের রিপোর্টে জানা গিয়েছিল তিনি সম্মানী ঘরের থেকে এসেছেন। তবে তাকে ডিভিশন দেওয়া হয় নাই, কারণ তিনি পাশবিক অত্যাচারের অপরাধে অপরাধী।

যুগ যুগ ধরে প্রজন্মকে সম্পদের জন্য প্রলুব্ধ করে গড়ে তোলা হচ্ছে। এভাবে একটি সম্ভাবনাময় প্রজন্মকে কাঁধে নিয়ে বছরের পর বছর সমাজ চলতে পারে না।

নতুন প্রজন্মকে ফেরাতে হবে সুস্থধারায়, শোনাতে হবে মানবতার সে্লাগান। অঢেল সম্পদ অর্জন নয়- দিতে হবে মনুষ্যত্ব অর্জনের শিক্ষা। মানুষের মধ্যে যারা মানুষ হিসেবেই গণ্য হয়েছেন তাদের দলভুক্ত হওয়ার কথাই শোনাতে হবে। সততাকে আদর্শ হিসেবে ধারণ করলে হয়তো জীবনে কিছু পরিক্ষা আসতে পারে; কিন্তু কেউ অন্তত না খেয়ে মরবে না। একটা হিংসা-বিদ্বেষ, লোভ-লালসামুক্ত প্রজন্ম গড়ে উঠলে শুধু দেশেরই লাভ নয় বরং সমাজ, পৃথিবী অর্থাৎ গোটা মানব জাতিরই মঙ্গল।

‘বিংশ শতাব্দীতে মানুষের শোকের আয়ু বড়জোর এক বছর’; কিন্তু স্মৃতির আয়ুর কি কোনো সময় আছে, না হতে পারে?

[লেখক : সভাপতি,

ঝিনাইদহ জেলা রিপোর্টার্স ইউনিটি]

সোমবার, ১১ অক্টোবর ২০২১ , ২৬ আশ্বিন ১৪২৮ ০৩ রবিউল আউয়াল ১৪৪৩

আগাছা-পরগাছা ভর করে বটবৃক্ষে

এম এ কবীর

অর্থ ছাড়া প্রয়োজন মেটে না। তাই অর্থ উপার্জন করতেই হয়। এই প্রতিযোগিতায় সবাই লিপ্ত। আমাদের বেশিরভাগ আয়োজন প্রয়োজনকে ঘিরেই। তবে চাইলেই অর্থ আয়ের জন্য যেকোনো কাজকে বেছে নেয়া যায় না। রাষ্ট্রীয় আইন, বিবেক, ধর্মের বিধিনিষেধ মেনে শ্রম ব্যয় করে অর্থ আয় করতে হয়। বৈধ-অবৈধতার মানদণ্ডে নির্ভেজাল থাকতে হয়। ছোটবেলা থেকে শিশুকে মন্ত্র শেখানো হয়; বড় হওয়ার মন্ত্র। কীভাবে অর্থ-কড়ির মালিক হওয়া যায়। কিছু বিত্তশালী মানুষকে আদর্শরূপে হাজির করা হয় প্রজন্মের সামনে। তারা ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার কিংবা আরও বড় পেশায় গিয়ে টাকা আয় করছে। তাই তাকেও এমন কিছু করতে হবে যাতে তাদের মতো টাকা রোজগার করা যায়। মোটা অঙ্কের টাকা। আর বড় বড় পদের লোভ দেখিয়ে প্রতিযোগিতায় নামানো হয় শৈশবেই।

এই প্রজন্ম বড় হয়ে লোভকে সংবরণ করবে কীভাবে? লোভকে সংবরণ করতে না পেরে সমাজে, দেশে ঘটায় হরেকরকম অপরাধ,নৈরাজ্য-বিশৃঙ্খলা। আপনজনের নামে আচমকা কোনো দুর্নাম শুনলে খারাপ লাগে, চোখে জলও আসে। কিন্তু তাকে যে লোভ দেখিয়ে বড় করা হয়েছে সে সেই লোভের পশ্চাতে তো ছুটবেই। নতুন প্রজন্মের পথচলায় অনুপ্রেরণা হবে মানুষের মতো মানুষরা, কোনো টাকার কুমির নয়। কিন্তু সমাজ বিত্তশালী এবং উচ্চপদে আসীন হওয়া ছাড়া মূল্য দেয় না।

বিত্তশালীরা কীভাবে টাকার মালিক হলেন, কোনপথে উচ্চপদ দখল করলেন- তা কখনো খতিয়ে দেখে না। শিশুকে খেতে, বসতে, ঘুমাতে যখন উচ্চপদ আর টাকার লোভ দেখানো হয় তখন তার ভেতরের নিষ্পাপ সত্তা এ কথাগুলো বারবার জপে।

মানুষের জন্য যারা জীবন দিয়ে পৃথিবীর ইতিহাসে স্মরণীয় হয়েছেন, তাদের কথা বললে কিংবা লিখিত বই নতুন প্রজন্মের হাতে দিলে পাঠ করে এক সময় মানবদরদি একটা প্রজন্ম গড়ে উঠবে। কিন্তু সমাজের উচ্চবর্গের কাতারে শামিল হতে বলা হয়Ñ যে কোনো উপায়ে। লোভনীয় চাকরির স্বপ্ন দেখিয়ে লালন করা হয়। এজন্য প্রজন্মের পর প্রজন্ম পদ লোভার্ত হয়ে গড়ে ওঠে।

তাদের লোভে বেপরোয়া হয়ে দুর্নীতি, ষড়যন্ত্র, খুন হানাহানির আশ্রয় নেয়। এমনকি হিটলার, মুসোলিনি হওয়ার আশঙ্কাও থাকে। সমাজের স্থুলবুদ্ধিসম্পন্ন লোকরা ভবিষ্যতের এই ভয়াবহ অবস্থার কথাগুলো ভাবেন না। তারা সেই ঘৃণিত নিয়মেই একটি প্রজন্মের গোড়াপত্তন করে। এমনই একটি প্রজন্মের অধীনে বাস করে সমাজ, দেশ, জাতি। কারণ, সমাজই তাকে এগুলো শিখিয়ে থাকে। এই সমাজ মুখে বলে লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু, অতি লোভে তাঁতি নষ্ট ইত্যাদি প্রবাদ। কিন্তু কাজে প্রতীয়মান হয় তার বিপরীত চিত্র ও চরিত্র। প্রত্যেক ধর্মে লোভকে সংবরণ করতে বলা হয়েছে। বিপরীতে দেয়া হয়েছে মানবতা এবং ধৈর্যের শিক্ষা। কিন্তু সেই কথাগুলো সমাজের চোখে পড়লেও মস্তিষ্কে গাঁথে না।

এক দিনে নিয়োগের ২১টি পরিক্ষা হলো। এমনিতেই অফিসপাড়ায় ছাঁটাইয়ের কালো থাবা বিপর্যস্ত করেছে চাকরিজীবীদের। এবার তার সঙ্গে যোগ হলো চাকরি প্রার্থীদের অসহায়ত্ব। বিবেচনাহীন সিদ্ধান্তে এ রকম কান্ডজ্ঞানহীন আচরণে চাকরি প্রার্থীরা যে ক্ষুব্ধ ও আশাহত তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। বহুকাল ধরেই সরকারি বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের সমন্বয়হীনতা দেখে আসছেন নাগরিকরা। জ্যেষ্ঠ নাগরিকেরা নিশ্চয়ই ভুলে যাননি তাদের সড়কের ভাঙা-গড়ার ইতিহাস। ঝাঁ-চকচকে রাস্তা তৈরি করার কিছুদিন পরই দেখা যায় সেই রাস্তার পেট কাটার জন্য হাজির হয়েছে পয়োনিষ্কাশন কর্তৃপক্ষ।

পয়োনিষ্কাশনের কাজ শেষ হওয়ার পর আধামাধাভাবে সে রাস্তার ক্ষত ঢেকে দেয়ার পরপরই আবার খুঁড়েছে ওয়াসা। এ রকম একটার পর একটা কর্তৃপক্ষ রাস্তা খুঁড়েছে আর জুড়েছে। ফলে যে মসৃণ সড়কটি তৈরি হয়েছিল, তা অল্পদিনের মধ্যেই তার জৌলুশ হারিয়ে অস্ত্রোপচারের রোগীর মতো ধুঁকেছে।

ওরা পাসপোর্ট করবে, ভোগান্তি। ওরা ভিসা নেবে, জালিয়াতি। ওরা বিদেশে যাবে, টিকিট নেই। ওরা যেখানেই যাবে, দুর্ভোগ ওদের পিছু ছাড়ে না। ওরা প্রবাসী। বাংলাদেশের অর্থনীতি বাঁচিয়ে রাখার শক্তি জোগায় ওরা। ওদের সমস্যাগুলোর সমাধান হয় না। এখন ভোগান্তি টিকা নিয়ে। করোনাকালে যখন সব বন্ধ, অচল, তখন প্রবাসীরা সবচেয়ে বেশি রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন। নিজেরা খেয়ে না-খেয়ে সংকটের মধ্যেও পরিবারের কাছে টাকা পাঠিয়েছেন। তারা বিদেশে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে কত রকমের শারীরিক, মানসিক নির্যাতন সহ্য করেও যা আয় করেন তা দেশে পাঠান। এই টাকায় দেশের অর্থনীতির গতি বাড়ে। সরকার বৈদেশিক মুদ্রায় আমদানির খরচ মেটায়, মেগা প্রকল্পের সরঞ্জাম কেনে। কত কিছুই না হয় তাঁদের টাকায়।

প্রবাসীরা নিজেদের সবটুকু উজাড় করে দেন দেশের জন্য। অথচ সেবা পাওয়ার বেলায় তারা থাকেন তলানিতে। অনেকের ভিসা বাতিল হয়ে যায়, অনেক দেশ বাংলাদেশের কর্মীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করে। অনেকে বেকার হয়ে যান। এরপর আবারও তারা জমিজমা বন্ধক রেখে ভাগ্যের খোঁজে বিদেশে যাওয়ার ভিসা নেন। নিজেরা যখন সব প্রস্তুতি শেষ করে আনেন, তখনই নতুন বিপত্তিতে পড়েন তারা।

ইতিহাসেরও অনেক ক্ষণ থাকে। আড়াল থাকে। আগাছা-পরগাছা ভর করে বটবৃক্ষে। জঙ্গলে ঢেকে যায় চারপাশটা। খাঁটিরা নীরব অভিমানে দূরে সরে যায়। শুরু হয় নকলদের সুসময়। চকচকে ভাবের কারণে আসল-নকল আলাদা করা যায় না। উঁইপোকা মাটির ঢিবি বানায় সুন্দর করে, কিন্তু সে মাটি কোনো কাজে লাগে না। কোনো কিছু উৎপাদনও হয় না। ঝুরঝুরে মাটিতে পা রাখলেই শেষ। ঘুণপোকার খেয়ে ফেলা কাঠ দেখতে শৈল্পিক মনে হয়। কিন্তু মানুষের বসতঘর শেষ হয়ে যায়।

সামাজিকমাধ্যমে একটা ভিডিও রয়েছে। পুলিশ ম্যানহোলে পড়ে থাকা হাঁসের বাচ্চা উদ্ধার করছে। একটা নয় এমন অসংখ্য ভিডিও রয়েছে পুলিশকে নিয়ে। আর এর সবকটিই উন্নত বিশে^র। তারা কেন উন্নত হয়েছে তার অনেকটা প্রমানই এসব ভিডিও।

শিশু অঙ্ক মেলাতে পারছে না, ফোন করলো পুলিশকে। পুলিশ অফিসার এলেন ফোন পেয়ে, তিনিও অঙ্কটি মেলাতে পারলেন না। ডাকলেন আরেক সহকর্মীকে। সেই সহকর্মী এসে শিশুটির অঙ্ক মিলিয়ে দিলেন। একজন শিশুও জানে পুলিশকে ফোন দিলে সব সমস্যার সমাধান হয়। এ ঘটনাটিও আমাদের দেশের নয়, প্রথম বিশে^র একটি দেশের।

আমাদের কোন শিশু যদি পুলিশকে ফোন দেয় অঙ্ক মেলানোর জন্য তবে কী হবে? সম্ভবত বাচ্চার পরিবারের ওপর দিয়ে যাবে তার কাফফরা। পুলিশকে অযথা হয়রানির দায়ে ভুগতে হবে তাদের।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার ‘কারাগারের রোজনামচা’ বইয়ের ৪৩ পৃষ্ঠায় লিখেছেনÑ

দুপুর বেলা দেখা এক মওলানা সাহেবের সঙ্গে, কোরআনে হাফেজ, তার বাবাও খুব বড় পীর ছিলেন, কুমিল্লায় বাড়ি। হাজতিদের মধ্যে নামাজ পড়বার আগে বক্তৃতা করছেন, হাজতিরা বসে শুনছে। আমি দূরে দাঁড়াইয়া তার বক্তৃতা শুনছি। তিনি বলছেন খুব জোরে দরুদ শরীফ পড়। শয়তান দূর হয়ে যাবে। জোরে পড়। অনেকক্ষণ বক্তৃতা করলেন; সুন্দর চেহারা, অল্প বয়স, চমৎকার বলার কায়দা। তবে জামাটা খুব বড়। ঐটা দেখেই মনে সন্দেহ হলো।

একদম পা পর্যন্ত জামা। বোধহয় ছয় সাত গজ হবে কমপক্ষে। তজবি হাতেই আছে। মাঝে মাঝে চক্ষু বুজে কথা বলেন। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘এই মাওলানা সাহেব কী মামলায় এসেছেন?’ আমাকে এক ‘পাহারাদার’ বললো, ‘জানেন না, রেপ কেস’; একটা ছাত্রীকে পড়াতো তার ওপর পাশবিক অত্যাচার করেছে, মসজিদের ভিতর। মেয়েটার ১২-১৩ বৎসর বয়স, চিৎকার করে উঠলে লোক এসে দেখে ফেলে। তারপর ধরে আচ্ছামতো মারধর করে। জেলে এসে কয়দিন তো হাসপাতালেই থাকতে হয়েছে। আমি বললাম, ‘হাজতে এসে ধর্ম প্রচার শুরু করেছে’। বেটা তো খুব ভণ্ড। জমাইছে তো বেশ।

সন্ধ্যার পর আমাদের তালাবন্ধ করে দিয়েছে। আমাদের উপরের কোঠায় সেই হাফেজ সাহেব থাকতেন। মাগরিবের পর চলল তার ‘মিলাদ’ অনেকক্ষণ, তারপর দরুদ, তারপর চলল কোরআন তেলাওয়াত। তিনিও যে কোরআনে হাফেজ সেইটাই দেখাতে ব্যস্ত আছেন বলে আমার মনে হলো। মামলায় তার চার বৎসর সশ্রম কারাদ- হয়। তিনি দরখাস্ত করেছিলেন ডিভিশন পাওয়ার জন্য। যদিও তার গ্রামের রিপোর্টে জানা গিয়েছিল তিনি সম্মানী ঘরের থেকে এসেছেন। তবে তাকে ডিভিশন দেওয়া হয় নাই, কারণ তিনি পাশবিক অত্যাচারের অপরাধে অপরাধী।

যুগ যুগ ধরে প্রজন্মকে সম্পদের জন্য প্রলুব্ধ করে গড়ে তোলা হচ্ছে। এভাবে একটি সম্ভাবনাময় প্রজন্মকে কাঁধে নিয়ে বছরের পর বছর সমাজ চলতে পারে না।

নতুন প্রজন্মকে ফেরাতে হবে সুস্থধারায়, শোনাতে হবে মানবতার সে্লাগান। অঢেল সম্পদ অর্জন নয়- দিতে হবে মনুষ্যত্ব অর্জনের শিক্ষা। মানুষের মধ্যে যারা মানুষ হিসেবেই গণ্য হয়েছেন তাদের দলভুক্ত হওয়ার কথাই শোনাতে হবে। সততাকে আদর্শ হিসেবে ধারণ করলে হয়তো জীবনে কিছু পরিক্ষা আসতে পারে; কিন্তু কেউ অন্তত না খেয়ে মরবে না। একটা হিংসা-বিদ্বেষ, লোভ-লালসামুক্ত প্রজন্ম গড়ে উঠলে শুধু দেশেরই লাভ নয় বরং সমাজ, পৃথিবী অর্থাৎ গোটা মানব জাতিরই মঙ্গল।

‘বিংশ শতাব্দীতে মানুষের শোকের আয়ু বড়জোর এক বছর’; কিন্তু স্মৃতির আয়ুর কি কোনো সময় আছে, না হতে পারে?

[লেখক : সভাপতি,

ঝিনাইদহ জেলা রিপোর্টার্স ইউনিটি]