মাল্টিমিডিয়া ক্লাস রুম : ছয় বছরে ১১৭ কোটি টাকা গচ্চা

২০১৬ সালের জুলাই থেকে ২০২০ সালের জুন- পাঁচবছর। এই সময়ে তিন হাজার ৩৪০টি হাইস্কুলে একটি করে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম করার কথা ছিল। পাঁচ বছরের জায়গায় ছয় বছর গড়িয়ে গেছে, কিন্তু মাঠে গড়ায়নি প্রকল্পটি। এই সময়ে প্রকল্পের অগ্রগতি মাত্র ৮ দশমিক ৬৬ শতাংশ। তবে প্রকল্প কর্মকর্তাদের বেতন, ভ্রমণ ও আপ্যায়ন ভাতা, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ ও প্রশিক্ষকদের সম্মানী বাবদ সরকারের ১১৭ কোটি ২৩ লাখ টাকার বেশি ব্যয় করা হয়েছে।

আবার যেসব শিক্ষা উপকরণের ওপর শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে, সেইসব উপকরণ এখন আর যুগোপযোগী নয়। বাজারে নতুন মডেলের অত্যাধুনিক উপকরণ এসেছে। এই বিবেচনায় অত্যাধুনিক মডেলের উপকরণ কেনার উদ্যোগ নিয়েছে শিক্ষা প্রশাসন। এতে শিক্ষকদের নতুন করে প্রশিক্ষণ দিতে হতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

গত ছয় বছরে নানা অভিযোগে দুই দফা ওই প্রকল্পের পরিচালক (পিডি) ও অন্যান্য কর্মকর্তা বদল হয়েছে। এখন প্রকল্পের নাম ও চরিত্রই পরিবর্তনের উদ্যোগ নিয়েছে শিক্ষা প্রশাসন। যদিও বরাদ্দ ধরে রাখতে প্রকল্পের মেয়াদ আগামী বছরের জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। তবে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সাত-আট বছর আগে তৈরি করা ডিপিপি (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা) অনুযায়ী প্রকল্পটি আর এগিয়ে নিতে চাচ্ছে না। নতুন ডিপিপি প্রণয়ন করে সব কিছু নতুন আঙ্গিকে করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

এক হাজার ৩৫৩ কোটি টাকা প্রাক্কলিত ব্যয় ধরে ‘আইসিটির মাধ্যমে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার প্রচলন (পর্যায়-২) প্রকল্প’ গ্রহণ করা হয়েছিল। মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) অধীন এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে।

জানতে চাইলে মাউশির পরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) প্রফেসর ড. একিউএম শফিউল আজম গত রোববার সংবাদকে বলেন, ‘এই মুহূর্তে ডিপিপি সংশোধন করলেও দীর্ঘসময়ের জন্য মেয়াদ বাড়াতে হবে। এ বিষয়ে মন্ত্রণালয় হয়তো কোন সিদ্ধান্ত নেবে, ডিপিপি সংশোধন করে মেয়াদ বাড়বে, নাকি যেহেতু প্রকল্পটি দুভার্গজনকভাবে বিভিন্ন জায়গায় কেইস (অভিযোগ) রয়েছে, সেক্ষেত্রে হয়তো নীতিনির্ধারকরা চিন্তাভাবনা করে ব্যবস্থা নেবেন।’

সাত-আট বছর আগে ডিপিপি তৈরির সময় যেসব শিক্ষা উপকরণ কেনার কথা বলা হয়েছে সেগুলোর প্রয়োজনীয়তা এখন কতটুকু-এমন প্রশ্নের বিষয়ে পরিচালক বলেন, ‘হয়তো এসব বিষয় ডিপিপি সংশোধনের সময় বিবেচনায় আসবে। কারণ একসঙ্গে অনেকগুলো বিষয় প্রকল্পটির। সাত-আট বছর পর এখন নতুনভাবে চিন্তাভাবনা করতে হচ্ছে। দুনিয়াতো অনেক এগিয়ে গেছে। এই সময়ে প্রজেক্ট ডিরেক্টর-অনেকেই হয়তো স্থায়ী ছিল না। কাক্সিক্ষত মাত্রায় অগ্রগতি হয়নি।’

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংবাদকে বলেন, ‘এটি ছিল সরকারের অন্যতম একটি স্বপ্নের প্রকল্প। এর লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ছিল সারাদেশের স্কুলগুলোকে ডিজিটাল শিক্ষা কার্যক্রমের আওতায় নিতে আসা। কিন্তু কয়েকজন কর্মকর্তা নেতিবাচক কর্মকা-ের কারণে প্রকল্পটিই ভেস্তে গেল।’

আইসিটিসহ মাউশির অধীনে বর্তমানে ৯টি বিনিয়োগ প্রকল্প ও একটি কারিগরি সহায়তা প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। প্রকল্পের অগ্রগতি জানতে মাউশি কর্তৃপক্ষ এক-দেড় মাস পরপর নিয়মিত সভা করে। এ সংক্রান্ত বিষয়ে মাউশির সর্বশেষ সভা হয় গত ৩১ আগস্ট। গত ৯ সেপ্টেম্বর ওই সভার কার্যবিবরণী প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, এ পর্যন্ত আইসিটি প্রকল্পের ১১৭ কোটি ২৩ লাখ ২৫ হাজার টাকা ব্যয় হয়েছে, যা মোট প্রাক্কলিত ব্যয়ের ৮ দশমিক ৬৬ শতাংশ। আর চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রকল্পের অনুকূলে ১৪৯ কোটি ৮৫ লাখ টাকা এডিপিতে (বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি) বরাদ্দ ছিল। গত আগস্ট পর্যন্ত ২৩ লাখ ১৬ হাজার টাকা ব্যয় হয়েছে, যা মোট বরাদ্দের ০.১৫ শতাংশ।

মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপনের কার্যক্রম পিছিয়ে পড়ার কারণ জানতে চাইলে ‘আইসিটির মাধ্যমে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার প্রচলন’ প্রকল্পের পিডি অধ্যাপক ড. মোরশীদুল হাসান গত রোববার সংবাদকে জানান, তিনি কোন কিছুই বলতে পারবেন না। ডিপিপি সংশোধন, বাস্তবায়ন ও ক্রয় প্রক্রিয়া- সবকিছুই মন্ত্রণালয় করছে।

পিডি সম্প্রতি মাউশির সভায় বলেছেন, ‘প্রকল্পের কার্যক্রম পরিচালনায় সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো প্রকল্প দলিল (ডিপিপি) সংশোধন। প্রকল্পের মূল কার্যক্রম দুটোÑ মূলধন খাতে ক্রয় কার্যক্রম পরিচালনা এবং রাজস্ব খাতের আওতায় মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষকদের আইসিটি বিষয়ে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা করা।’

চলতি অর্থ বছরে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ৫২ হাজার শিক্ষককে প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্য এওপি (অ্যানুয়াল অপারেশন প্ল্যান) প্রস্তুত করা হয়েছে জানিয়ে পিডি মোরশীদুল হাসান বলেন, ‘সংশোধিত ডিপিপিতে ট্রেনিং কনসালট্যান্ট এবং প্রকিউরমেন্ট কনসালট্যান্টের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থান রেখে এবং সংশোধিত ডিপিপি অনুমোদন হয়া সাপেক্ষে কনসালট্যান্ট নিয়োগের উদ্যোগ নেয়া হবে। তবে এই প্রক্রিয়া সময়সাপেক্ষ।’

ভেস্তে গেছে পুরো প্রশিক্ষণ

মাউশির পরিকল্পনা ও উন্নয়ন শাখার দুজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংবাদকে জানান, প্রকল্পের পুরো প্রশিক্ষণ কার্যক্রমই ভেস্তে যাচ্ছে। কারণ শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টের, ল্যাপটপ, সাউন্ডবক্স ও মোডেম পরিচালনার ওপর। কিন্তু সংশোধিত ডিপিপিতে ওইসব শিক্ষা উপকরণের সবকটি থাকছে না। স্কুলে নতুন মডেলের ‘অত্যাধুনিক ও যুগোপযোগী’ শিক্ষা উপকরণ সরবরাহের নির্দেশ দিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী।

সাত-আট বছর আগে যখন প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয়, সেই সময় ওইসব উপকরণ আধুনিকই ছিল; কিন্তু বর্তমানে আরও আধুনিক শিক্ষা উপকরণ বাজারে এসেছে। এ কারণে সংশোধিত ডিপিপির আলোকে নতুন করে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে বলে মাউশি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

আইসিটি প্রকল্পের মাধ্যমে প্রতিটি বিদ্যালয়ে একটি করে মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর, ল্যাপটপ, সাউন্ডবক্স ও মোডেম- ইত্যাদি শিক্ষা উপকরণ সরবরাহ করে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপনের কথা ছিল। গড়ে প্রতিটি স্কুলে মাল্টিমিডিয়া শ্রেণীকক্ষ স্থাপনে ব্যয় ধরা হয় এক লাখ ৬০ হাজার টাকা।

রাজধানীর দুটি সরকারি হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক সংবাদকে জানান, তাদের স্কুলের চারজন শিক্ষক আইসিটি প্রকল্পের প্রশিক্ষণ পেলেও মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম দেখে যেতে পারেননি। তারা ইতোমধ্যে অবসরে চলে গেছেন।

অনিয়মেই শুরু প্রকল্পের বাস্তবায়ন

প্রতিযোগিতাপূর্ণ ক্রয়প্রক্রিয়া ‘ই-জিপি’ টেন্ডার বাদ দিয়ে ডিপিএমে (ডিরেক্ট প্রকিউরমেন্ট মেথড) পছন্দের প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষা উপকরণ কেনার উদ্যোগ নেয়া হয়। প্রথম পর্যায়ে ডিপিএম প্রক্রিয়ায় ১৭ হাজার ৪৫০টি মাল্টিমিডিয়া শ্রেণীকক্ষ সৃজনের জন্য ল্যাপটপ, মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর (স্ক্রীনসহ), ইন্টারনেট ওয়্যারলেস মোডেম ও স্পিকার (শব্দযন্ত্র) ক্রয়ের জন্য ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে শিক্ষা সচিবের কাছে একটি প্রস্তাব জমা দেয় মাউশি কর্তৃপক্ষ।

ওই সময় ১৭ হাজার ৪৫০টি মাল্টিমিডিয়া শ্রেণীকক্ষ সৃজনের জন্য প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয় ২৮৪ কোটি ৪৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা। ডিপিএমএ সেই পরিমাণ অর্থের পণ্যসামগ্রী ক্রয়ের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হলে এ বিষয়ে অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির সুপারিশ প্রয়োজন। মহাপরিচালকের এই প্রস্তাব অনুমোদনের জন্য সম্প্রতি অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে পাঠানো হয়।

এরপর ওই প্রক্রিয়া নিয়ে অনিয়মের অভিযোগ উঠে। অভিযোগ তদন্তে একটি কমিটি গঠন করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। ওই কমিটির প্রতিবেদনে প্রকল্পের মোট ১৩টি পর্যবেক্ষণ দেয়া হয়, যার মধ্যে অনিয়ম ও দুর্নীতি সংক্রান্ত ১২টি অভিযোগ প্রমাণিত হয়। এরপর পিডিকে সরিয়ে দেয়া হয়, কিন্তু মূল অভিযুক্তরা বহাল তবিয়তেই থেকে যায় বলে জানিয়েছে সূত্র।

পরবর্তীতে ২০১৯ সালের নভেম্বর মাউশির এক তদন্তে আইসিটি প্রকল্পে শিক্ষক প্রশিক্ষণের নামে প্রায় ৭৫ কোটি টাকা তছরুপের প্রমাণ মেলে। এতে দেখা যায়, একই কর্মকর্তা দিনে ভিন্ন ভিন্ন জেলায় ১০/১৫টি প্রশিক্ষণে অংশ নেয়ার কথা বলে নিয়ে মোটা অঙ্কের সম্মানী নিয়েছেন। কিন্তু একটি প্রভাবশালী মহলের চাপে মূল তদন্ত প্রতিবেদন ধামাচাপা দিয়ে দায়সারাগোছের একটি ‘বিকল্প’ প্রতিবেদন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়া হয়।

এরপর অভিযুক্তদের আড়াল করে তদন্ত কমিটির প্রধানকেই শাস্তিমূলক বদলি করা হয়, পরবর্তীতে নানা বিতর্কের মুখে প্রকল্পের পিডিকে ‘ওএসডি’ করা হয়। যদিও অভিযুক্ত দুই কর্মকর্তা এখনও প্রকল্পেই বহাল তবিয়তে রয়েছেন।

ওই প্রতিবেদনে ভুয়া বিল-ভাউচারে অর্থ আত্মসাত ও একটি বিশেষ প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষা উপকরণ কেনা, সরকারি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের ভাড়া দেখিয়ে অর্থ লুপাট, একই কেন্দ্রে একাধিক ওয়াইফাই সংযোগ দেখিয়ে অর্থ নয়-ছয়সহ বেশকিছু অনিয়মের প্রমাণ মেলে।

মঙ্গলবার, ১২ অক্টোবর ২০২১ , ২৭ আশ্বিন ১৪২৮ ০৪ রবিউল আউয়াল ১৪৪৩

মাল্টিমিডিয়া ক্লাস রুম : ছয় বছরে ১১৭ কোটি টাকা গচ্চা

রাকিব উদ্দিন

২০১৬ সালের জুলাই থেকে ২০২০ সালের জুন- পাঁচবছর। এই সময়ে তিন হাজার ৩৪০টি হাইস্কুলে একটি করে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম করার কথা ছিল। পাঁচ বছরের জায়গায় ছয় বছর গড়িয়ে গেছে, কিন্তু মাঠে গড়ায়নি প্রকল্পটি। এই সময়ে প্রকল্পের অগ্রগতি মাত্র ৮ দশমিক ৬৬ শতাংশ। তবে প্রকল্প কর্মকর্তাদের বেতন, ভ্রমণ ও আপ্যায়ন ভাতা, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ ও প্রশিক্ষকদের সম্মানী বাবদ সরকারের ১১৭ কোটি ২৩ লাখ টাকার বেশি ব্যয় করা হয়েছে।

আবার যেসব শিক্ষা উপকরণের ওপর শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে, সেইসব উপকরণ এখন আর যুগোপযোগী নয়। বাজারে নতুন মডেলের অত্যাধুনিক উপকরণ এসেছে। এই বিবেচনায় অত্যাধুনিক মডেলের উপকরণ কেনার উদ্যোগ নিয়েছে শিক্ষা প্রশাসন। এতে শিক্ষকদের নতুন করে প্রশিক্ষণ দিতে হতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

গত ছয় বছরে নানা অভিযোগে দুই দফা ওই প্রকল্পের পরিচালক (পিডি) ও অন্যান্য কর্মকর্তা বদল হয়েছে। এখন প্রকল্পের নাম ও চরিত্রই পরিবর্তনের উদ্যোগ নিয়েছে শিক্ষা প্রশাসন। যদিও বরাদ্দ ধরে রাখতে প্রকল্পের মেয়াদ আগামী বছরের জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। তবে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সাত-আট বছর আগে তৈরি করা ডিপিপি (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা) অনুযায়ী প্রকল্পটি আর এগিয়ে নিতে চাচ্ছে না। নতুন ডিপিপি প্রণয়ন করে সব কিছু নতুন আঙ্গিকে করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

এক হাজার ৩৫৩ কোটি টাকা প্রাক্কলিত ব্যয় ধরে ‘আইসিটির মাধ্যমে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার প্রচলন (পর্যায়-২) প্রকল্প’ গ্রহণ করা হয়েছিল। মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) অধীন এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে।

জানতে চাইলে মাউশির পরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) প্রফেসর ড. একিউএম শফিউল আজম গত রোববার সংবাদকে বলেন, ‘এই মুহূর্তে ডিপিপি সংশোধন করলেও দীর্ঘসময়ের জন্য মেয়াদ বাড়াতে হবে। এ বিষয়ে মন্ত্রণালয় হয়তো কোন সিদ্ধান্ত নেবে, ডিপিপি সংশোধন করে মেয়াদ বাড়বে, নাকি যেহেতু প্রকল্পটি দুভার্গজনকভাবে বিভিন্ন জায়গায় কেইস (অভিযোগ) রয়েছে, সেক্ষেত্রে হয়তো নীতিনির্ধারকরা চিন্তাভাবনা করে ব্যবস্থা নেবেন।’

সাত-আট বছর আগে ডিপিপি তৈরির সময় যেসব শিক্ষা উপকরণ কেনার কথা বলা হয়েছে সেগুলোর প্রয়োজনীয়তা এখন কতটুকু-এমন প্রশ্নের বিষয়ে পরিচালক বলেন, ‘হয়তো এসব বিষয় ডিপিপি সংশোধনের সময় বিবেচনায় আসবে। কারণ একসঙ্গে অনেকগুলো বিষয় প্রকল্পটির। সাত-আট বছর পর এখন নতুনভাবে চিন্তাভাবনা করতে হচ্ছে। দুনিয়াতো অনেক এগিয়ে গেছে। এই সময়ে প্রজেক্ট ডিরেক্টর-অনেকেই হয়তো স্থায়ী ছিল না। কাক্সিক্ষত মাত্রায় অগ্রগতি হয়নি।’

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংবাদকে বলেন, ‘এটি ছিল সরকারের অন্যতম একটি স্বপ্নের প্রকল্প। এর লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ছিল সারাদেশের স্কুলগুলোকে ডিজিটাল শিক্ষা কার্যক্রমের আওতায় নিতে আসা। কিন্তু কয়েকজন কর্মকর্তা নেতিবাচক কর্মকা-ের কারণে প্রকল্পটিই ভেস্তে গেল।’

আইসিটিসহ মাউশির অধীনে বর্তমানে ৯টি বিনিয়োগ প্রকল্প ও একটি কারিগরি সহায়তা প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। প্রকল্পের অগ্রগতি জানতে মাউশি কর্তৃপক্ষ এক-দেড় মাস পরপর নিয়মিত সভা করে। এ সংক্রান্ত বিষয়ে মাউশির সর্বশেষ সভা হয় গত ৩১ আগস্ট। গত ৯ সেপ্টেম্বর ওই সভার কার্যবিবরণী প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, এ পর্যন্ত আইসিটি প্রকল্পের ১১৭ কোটি ২৩ লাখ ২৫ হাজার টাকা ব্যয় হয়েছে, যা মোট প্রাক্কলিত ব্যয়ের ৮ দশমিক ৬৬ শতাংশ। আর চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রকল্পের অনুকূলে ১৪৯ কোটি ৮৫ লাখ টাকা এডিপিতে (বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি) বরাদ্দ ছিল। গত আগস্ট পর্যন্ত ২৩ লাখ ১৬ হাজার টাকা ব্যয় হয়েছে, যা মোট বরাদ্দের ০.১৫ শতাংশ।

মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপনের কার্যক্রম পিছিয়ে পড়ার কারণ জানতে চাইলে ‘আইসিটির মাধ্যমে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার প্রচলন’ প্রকল্পের পিডি অধ্যাপক ড. মোরশীদুল হাসান গত রোববার সংবাদকে জানান, তিনি কোন কিছুই বলতে পারবেন না। ডিপিপি সংশোধন, বাস্তবায়ন ও ক্রয় প্রক্রিয়া- সবকিছুই মন্ত্রণালয় করছে।

পিডি সম্প্রতি মাউশির সভায় বলেছেন, ‘প্রকল্পের কার্যক্রম পরিচালনায় সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো প্রকল্প দলিল (ডিপিপি) সংশোধন। প্রকল্পের মূল কার্যক্রম দুটোÑ মূলধন খাতে ক্রয় কার্যক্রম পরিচালনা এবং রাজস্ব খাতের আওতায় মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষকদের আইসিটি বিষয়ে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা করা।’

চলতি অর্থ বছরে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ৫২ হাজার শিক্ষককে প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্য এওপি (অ্যানুয়াল অপারেশন প্ল্যান) প্রস্তুত করা হয়েছে জানিয়ে পিডি মোরশীদুল হাসান বলেন, ‘সংশোধিত ডিপিপিতে ট্রেনিং কনসালট্যান্ট এবং প্রকিউরমেন্ট কনসালট্যান্টের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থান রেখে এবং সংশোধিত ডিপিপি অনুমোদন হয়া সাপেক্ষে কনসালট্যান্ট নিয়োগের উদ্যোগ নেয়া হবে। তবে এই প্রক্রিয়া সময়সাপেক্ষ।’

ভেস্তে গেছে পুরো প্রশিক্ষণ

মাউশির পরিকল্পনা ও উন্নয়ন শাখার দুজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংবাদকে জানান, প্রকল্পের পুরো প্রশিক্ষণ কার্যক্রমই ভেস্তে যাচ্ছে। কারণ শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টের, ল্যাপটপ, সাউন্ডবক্স ও মোডেম পরিচালনার ওপর। কিন্তু সংশোধিত ডিপিপিতে ওইসব শিক্ষা উপকরণের সবকটি থাকছে না। স্কুলে নতুন মডেলের ‘অত্যাধুনিক ও যুগোপযোগী’ শিক্ষা উপকরণ সরবরাহের নির্দেশ দিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী।

সাত-আট বছর আগে যখন প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয়, সেই সময় ওইসব উপকরণ আধুনিকই ছিল; কিন্তু বর্তমানে আরও আধুনিক শিক্ষা উপকরণ বাজারে এসেছে। এ কারণে সংশোধিত ডিপিপির আলোকে নতুন করে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে বলে মাউশি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

আইসিটি প্রকল্পের মাধ্যমে প্রতিটি বিদ্যালয়ে একটি করে মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর, ল্যাপটপ, সাউন্ডবক্স ও মোডেম- ইত্যাদি শিক্ষা উপকরণ সরবরাহ করে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপনের কথা ছিল। গড়ে প্রতিটি স্কুলে মাল্টিমিডিয়া শ্রেণীকক্ষ স্থাপনে ব্যয় ধরা হয় এক লাখ ৬০ হাজার টাকা।

রাজধানীর দুটি সরকারি হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক সংবাদকে জানান, তাদের স্কুলের চারজন শিক্ষক আইসিটি প্রকল্পের প্রশিক্ষণ পেলেও মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম দেখে যেতে পারেননি। তারা ইতোমধ্যে অবসরে চলে গেছেন।

অনিয়মেই শুরু প্রকল্পের বাস্তবায়ন

প্রতিযোগিতাপূর্ণ ক্রয়প্রক্রিয়া ‘ই-জিপি’ টেন্ডার বাদ দিয়ে ডিপিএমে (ডিরেক্ট প্রকিউরমেন্ট মেথড) পছন্দের প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষা উপকরণ কেনার উদ্যোগ নেয়া হয়। প্রথম পর্যায়ে ডিপিএম প্রক্রিয়ায় ১৭ হাজার ৪৫০টি মাল্টিমিডিয়া শ্রেণীকক্ষ সৃজনের জন্য ল্যাপটপ, মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর (স্ক্রীনসহ), ইন্টারনেট ওয়্যারলেস মোডেম ও স্পিকার (শব্দযন্ত্র) ক্রয়ের জন্য ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে শিক্ষা সচিবের কাছে একটি প্রস্তাব জমা দেয় মাউশি কর্তৃপক্ষ।

ওই সময় ১৭ হাজার ৪৫০টি মাল্টিমিডিয়া শ্রেণীকক্ষ সৃজনের জন্য প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয় ২৮৪ কোটি ৪৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা। ডিপিএমএ সেই পরিমাণ অর্থের পণ্যসামগ্রী ক্রয়ের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হলে এ বিষয়ে অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির সুপারিশ প্রয়োজন। মহাপরিচালকের এই প্রস্তাব অনুমোদনের জন্য সম্প্রতি অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে পাঠানো হয়।

এরপর ওই প্রক্রিয়া নিয়ে অনিয়মের অভিযোগ উঠে। অভিযোগ তদন্তে একটি কমিটি গঠন করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। ওই কমিটির প্রতিবেদনে প্রকল্পের মোট ১৩টি পর্যবেক্ষণ দেয়া হয়, যার মধ্যে অনিয়ম ও দুর্নীতি সংক্রান্ত ১২টি অভিযোগ প্রমাণিত হয়। এরপর পিডিকে সরিয়ে দেয়া হয়, কিন্তু মূল অভিযুক্তরা বহাল তবিয়তেই থেকে যায় বলে জানিয়েছে সূত্র।

পরবর্তীতে ২০১৯ সালের নভেম্বর মাউশির এক তদন্তে আইসিটি প্রকল্পে শিক্ষক প্রশিক্ষণের নামে প্রায় ৭৫ কোটি টাকা তছরুপের প্রমাণ মেলে। এতে দেখা যায়, একই কর্মকর্তা দিনে ভিন্ন ভিন্ন জেলায় ১০/১৫টি প্রশিক্ষণে অংশ নেয়ার কথা বলে নিয়ে মোটা অঙ্কের সম্মানী নিয়েছেন। কিন্তু একটি প্রভাবশালী মহলের চাপে মূল তদন্ত প্রতিবেদন ধামাচাপা দিয়ে দায়সারাগোছের একটি ‘বিকল্প’ প্রতিবেদন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়া হয়।

এরপর অভিযুক্তদের আড়াল করে তদন্ত কমিটির প্রধানকেই শাস্তিমূলক বদলি করা হয়, পরবর্তীতে নানা বিতর্কের মুখে প্রকল্পের পিডিকে ‘ওএসডি’ করা হয়। যদিও অভিযুক্ত দুই কর্মকর্তা এখনও প্রকল্পেই বহাল তবিয়তে রয়েছেন।

ওই প্রতিবেদনে ভুয়া বিল-ভাউচারে অর্থ আত্মসাত ও একটি বিশেষ প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষা উপকরণ কেনা, সরকারি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের ভাড়া দেখিয়ে অর্থ লুপাট, একই কেন্দ্রে একাধিক ওয়াইফাই সংযোগ দেখিয়ে অর্থ নয়-ছয়সহ বেশকিছু অনিয়মের প্রমাণ মেলে।