গুরনাহর উপন্যাসে ঔপনিবেশিকতা

লেখার যাত্রার শুরু মূলত ফেলে আসা ভূমি, মানুষ এবং মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্কের কষ্ট নিয়ে ডায়েরির পাতায় টুকিটাকি লেখার মধ্য দিয়ে। তাঁর প্রথম উপন্যাস মেমোরি অব ডিপার্চার প্রকাশিত হয় ১৯৮৭ সালে। উপন্যাসটি উপকূলীয় পূর্ব-আফ্রিকার পনেরো বছর বয়সি এক সংবেদনশীল কিশোরের জীবন-সংগ্রাম ও তার আধ্যাত্মিক পুনর্জন্মের গল্প। সমুদ্রবন্দরসংলগ্ন দারিদ্র্যপীড়িত গ্রামে পরিবারের সাথে বসবাস করা উপন্যাসের মূল চরিত্র হাসান ওমর সহিংসতা এবং হতাশার এক দুষ্টচক্র দ্বারা পরিবেষ্টিত। তার হতাশার অনুভূতিগুলো আশপাশের জীবনের ঘটনার দ্বারা আরো উজ্জীবিত হয়। তাঁর পিতা মাতাল, অত্যাচারী, লম্পট; এক বোন, যে তাদের জীবনের অন্ধগলি থেকে পালিয়ে যায়; বিভ্রান্ত বড় ভাই, যে জীবনের নানাবিধ পঙ্কিলতার হেরে যায় এবং অবশেষে একটি অদ্ভুত দুর্ঘটনায় মারা যায়; এবং তার মা তার স্বামীর নিষ্ঠুর অত্যাচারের কাছে আত্মসমর্পণ করেন। অবশেষে, হাসান তার পরিবার ছেড়ে এক চাচার সাথে থাকার জন্য নাইরোবিতে চলে যায়। সেখানে সে একটি বৃহত্তর পৃথিবী আবিষ্কার করে, যেখানে নিষ্ঠুরতা আছে কিন্তু তার পুরনো জীবন থেকে বেরিয়ে আসার আশা এবং মুক্তির উপায়ও যেন আছে। হাসানের প্রচেষ্টা শেষ পর্যন্ত আরো বড় কিছুর প্রত্যাশা করে। যদিও গুরনাহ, কেবল এই বার্তাটিই তুলে ধরেন: নায়কের আকাক্সক্ষা এবং দ্বিধা তৃতীয় বিশ্ব আফ্রিকার ঔপনিবেশিক লড়াইকে প্রতিফলিত করে। তার দারিদ্র্য এবং নিপীড়নের সাথে এবং নিজের জন্য একটি নতুন পরিচয় তৈরি করতে সে সংগ্রাম করে যায়। উপন্যাসটির আকৃতি ছোটো হলেও হাসানের আত্মমর্যাদার অবনমন এবং ঘূর্ণায়মান চেতনার পরিস্ফূটনে সহায়তা করে।

গুরনাহর বেশিরভাগ উপন্যাসের স্থান ও কাল পূর্ব-আফ্রিকার উপকূলকে ঘিরে। তার উপন্যাসের একজন নায়ক ছাড়া বাকি সবাই জাঞ্জিবারের। সাহিত্যসমালোচক ব্রুস কিং বলেন, ‘গুরনাহর উপন্যাসগুলো পূর্ব আফ্রিকান নায়কদের বিস্তৃত আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে স্থান করে দিয়েছে।’ তার কথাসাহিত্যে ‘আফ্রিকানরা সর্বদা বৃহত্তর ও পরিবর্তিত বিশ্বের অংশ’ এই কথা বার বার ধ্বনিত হয়। গুরনাহর উপন্যাসের চরিত্রগুলো প্রায়শই শিকড় ওপড়ানো ও ভূমি-বিচ্ছিন্ন এবং অবাঞ্ছিত। এই বিচ্ছিন্নতা ও শেকড়হীনতার ভিতর দিয়ে তিনি তার চরিত্রদের বিশ^ দরবারে উপস্থাপন করেন। ১৯৮৮ সালে প্রকাশিত উপন্যাস পিলগ্রিমস ওয়ে-এ তিনি এমন এক যাত্রাকে আঁকেন, যেখানে আত্মপরিচয়, ম্মৃতি এবং আত্মীয়তার বোধগুলো চলে আসে প্রশ্নের সামনে। ১৯৯৪ সালে প্রকাশিত গুরনাহর চতুর্থ উপন্যাস প্যারাডাইস তাকে বিশ^ময় খ্যাতি এনে দেয়। উপনিবেশ-নির্ধারিত উপন্যাসের সীমানা অতিক্রম করে এই আখ্যান। প্যারাডাইস ১৯৯৪ সালে বুকার ও হোয়াইটব্রেড পুরস্কারের জন্য সংক্ষিপ্ত তালিকাভুক্ত হয়েছিল। উপন্যাসটি শতাব্দীর গোড়ার দিকে তানজানিয়ার যুবক ইউসুফের গল্প। ইউসুফ তার বাবা-মায়ের সঙ্গে তানজানিয়ায় থাকত। সে তার চাচা আজিজকে পছন্দ করত। যখন ইউসুফের বয়স বারো, আজিজ ইউসুফকে সঙ্গে নিয়ে যায় তার দোকানে কাজ করার জন্য। ইউসুফ কাজ করার সময় জানতে পারে যে, সে আসলে এক ধরনের দাসত্বের মধ্যে আছে। কারণ, তার বাবা আজিজের কাছে টাকা ধার করেছিলেন। ইউসুফ সেই ঋণের বিপরীতে জামিন হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। জীবদ্দশায় ইউসুফের বাবা তা পরিশোধ করতে পারেননি। ইউসুফ সুদর্শন যুবক। নারীরা তার প্রতি আকর্ষণ বোধ করে। চাচা আজিজের স্ত্রী তাকে দেখার পর সে-ও তার প্রতি আকর্ষণ বোধ করে। আজিজ প্রায়ই বাণিজ্যিক কারণে দেশের বিভিন্ন জায়গায় যায় এবং ইউসুফকে সঙ্গে নিয়ে যায়। যদিও আমরা পরে জানতে পারি যে, এটা আসলে স্ত্রীর কাছ থেকে তাকে দূরে রাখার জন্য আজিজের এক কৌশল। ক্রমান্বয়ে ইউরোপীয় অর্থাৎ জার্মানদের দেশ দখল এবং তারপর প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। অবশেষে, ইউসুফ ফিরে আসে, যুবক এবং সুঠামদেহী। ইউসুফের প্রতি আজিজের স্ত্রীর আকর্ষণ কমে না; যদিও ইউসুফ আজিজের চাকর। আজিজের স্ত্রী কি চাকরের সাথে পালাবে? আমরা কখনো এর উত্তর পাই না। কারণ গল্পটি হঠাৎ মাঝপথে থেমে যায়।

পরিচয় সংকট ও আত্মস্মৃতির উপস্থাপনা গুরনাহর আরেক প্রসিদ্ধ উপন্যাস বাই দ্য সি প্রকাশিত হয় ২০০১ সালে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। এটি পঁয়ষট্টি বছর বয়সি সালেহ ওমরের কাহিনি, যে জাঞ্জিবারের একজন বণিক শরণার্থী হয়ে ইংল্যান্ডে আশ্রয়ের জন্য আবেদন করে। বর্তমান সময়ের সিনবাদ সালেহ ওমর এমন একটি দেশ থেকে পালিয়ে এসেছে যেখানে দুষ্ট জিনরা সমকালীন কর্তৃত্ববাদ, কনসেনট্রেশন ক্যাম্প, রাইফেল, ক্যাঙ্গারু কোর্ট ইত্যাদির মাধ্যমে দেশ পরিচালনা করছে। গ্যাটউইক বিমানবন্দরে আসার পর ওমর একটি অবৈধ ভিসা উপস্থাপন করে যা আসলে তার দূর সম্পর্কের চাচাত ভাই এবং তার সবচেয়ে ঘৃণ্য শত্রু রজব শাবান মাহমুদের নামে ইস্যু করা। দৈবক্রমে তার দেখা হয় কিসওয়াহিলির ইংরেজ বিশেষজ্ঞ লতিফ মাহমুদের সাথে, যিনি আসলে রজব শাবানের পুত্র। অনিবার্যভাবে, দুজন একসঙ্গে সমুদ্রতীরবর্তী একটি ইংরেজ শহরে একত্রিত হন। লতিফ অনেক আগেই তার জাঞ্জিবার পরিবারের সাথে সব সম্পর্ক ছিন্ন করে, ষাটের দশকে ইংল্যান্ডে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তিনি ইংরেজির অধ্যাপক ও কবি। তিনি জানতে পারেন, তার বাবা রজব এবং তার স্ত্রী আশার প্রতিহিংসাপরায়ণতার স্বীকার হয়েছে সালেহ ওমর। আশা একজন প্রভাবশালী মন্ত্রীর উপপত্নীও। ওমরের উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তির ওপর লোভের জন্য সালেহ ওমরকে অবশেষে তার বাড়ি থেকে বিতাড়িত করা হয়, গ্রেফতার করা হয় এবং বিভিন্ন ক্যাম্পে বন্দি করে রাখা হয়। এ উপন্যাসে গুরনাহ উত্তর-ঔপনিবেশিক বিশ্বে শরণার্থীর প্রবাহ এবং নতুন স্থান ও সমাজে তাদের সংকটময় জীবনের ট্র্যাজেডির চিত্র তুলে ধরেন যেখানে শরণার্থীরা সর্বদা ক্রমবর্ধনশীল।

গুরনাহর সৃষ্ট চরিত্ররা তাদের নতুন পরিবেশের সাথে খাপ-খাইয়ে নিতে নিজেদের জন্য একটি নতুন পরিচয় তৈরি করার চেষ্টা করে। তারা ক্রমাগত তাদের নতুন জীবন এবং তাদের অতীত অস্তিত্বের মধ্যে সংযোগ তৈরির চেষ্টা করে যায়। তার আখ্যানগুলোয় নতুন ভৌগোলিক এবং সামাজিক প্রেক্ষাপটে অভিবাসনপ্রত্যাশী ও অভিবাসীগণ পরিচয় নির্মাণের জন্য সংগ্রাম করে। জীবনের ক্রমাগত পরিবর্তন এবং তার উপন্যাসের প্রধান চরিত্রদের নতুন পরিচয়ের অনুসন্ধান যেন অন্য মানুষের নির্দিষ্ট পরিচয়কেও অস্থির করে তোলে। আমরা দেখি, যেখানে তারা স্থানান্তরিত হয় সেখানকার পরিবেশের বিরূপতার মুখোমুখি হতে হয় তাদের। ১৯৯৬ সালে প্রকাশিত অ্যাডমায়ারিং সাইলেন্স উপন্যাসের নামহীন বর্ণনাকারী যখন তার প্রেমিকা এমার বাবা-মাকে জানায় যে, তার মেয়ে গর্ভবতী, তখন তারা তাকে ঘৃণার চোখে দেখে কারণ তারা মনে করে এখন থেকে তাদের মেয়েকে সারা জীবন এক ধরনের দূষণের সাথে থাকতে হবে। এই দূষণ মূলত অভিবাসীদের দ্বারা। এই অনামা জাঞ্জিবারিয়ান বিশ বছর পরে দেশে ফিরে যায় যখন সে তার মায়ের কাছ থেকে একটি চিঠি পায়। চিঠিতে উল্লেখ করা হয় যে, যারা অবৈধভাবে দেশ ছেড়েছে তাদের জন্য ক্ষমা ঘোষণা করা হয়েছে। জাঞ্জিবারে থাকা তার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগের সময় সে তার স্ত্রী এমা ও মেয়ে এমেলিয়ার কথা কখনো উল্লেখ করে না। সে জাঞ্জিবারে ফিরে যায়। পুনরায় ইংল্যান্ডে ফিরে এসে দেখে যে তার স্ত্রী আবদ্ধ হয়েছে অন্য প্রেমিকের সাথে। এই উপন্যাসের মূল শক্তি ক্রমাগত অসাধু মূল চরিত্র ও উপন্যাসের ন্যারেটরের নিখুঁত মনস্তাত্ত্বিক অসততার মধ্যে নিহিত। সে একসময় উপলব্ধি করে, জাঞ্জিবারে তার মূল পরিবারকে পরিত্যাগ এবং ইংল্যান্ডে নতুন করে তৈরি পরিবার থেকে বিচ্ছিন্নতা মূলত তার মানসিক নির্বাসনেরই অংশ, যে মানসিক অসততা তৈরির পশ্চাতে কাজ করেছে দেশান্তর, শরণার্থী জীবন।

আব্দুলরাজাক গুরনাহর সবশেষ উপন্যাস আফটারলাইভস প্রকাশিত হয় ২০২০ সালে। ঐতিহাসিক এ উপন্যাসটি পূর্ব আফ্রিকান উপকূলে মাজি মাজি বিদ্রোহের সময়কে ধারণ করে রচিত। স্থানীয় অধিবাসীদের জোর করে তুলা উৎপাদনে জার্মান কলোনিয়াল সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে শুরু হয় বিদ্রোহ। আফটারলাইভস চারটি প্রধান চরিত্রের গল্প বলে, যাদের জীবন একে অপরের সাথে প্রেম ও আত্মীয়তায় গাঁথা। চরিত্রগুলোর নিজ ভূমিতে জীবন ও সম্পর্কগুলো তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরের শক্তি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। প্রধান চার চরিত্র খলিফা, হামজা, ইলিয়াস ও আফিয়া। ইলিয়াসকে পিতা-মাতার কাছ থেকে জার্মান ঔপনিবেশিক সৈন্যরা চুরি করে। একজন অফিসার দ্বারা যৌন নির্যাতনের স্বীকার হয় সে। কয়েক বছর যুদ্ধের পর সে তার গ্রামে ফিরে আসে। তার বোন আফিয়া, যে একটি পরিবারে পালিত হয় ও দাস হিসেবে থাকে, তাকে সে উদ্ধার করে। অন্যদিকে, হামজা চুরি হয়নি, তবে বিক্রি হয়েছিল। জার্মান কলোনিয়াল সেনাদের হয়ে তারা যুদ্ধ করেছে। অথচ হামজা এবং ইলিয়াসের মতো আফ্রিকানরা, যারা জার্মানির হয়ে লড়াই করেছে, তাদের ধোঁকা দেওয়া হয়েছে, ঠকানো হয়েছে বা নানাবিধ শর্তে আবদ্ধ করে ফেলা হয়েছে। উপন্যাসটি বর্ণবাদ, আত্মসমর্পণ এবং আত্মত্যাগের গল্প। উপন্যাসটি পূর্ব আফ্রিকার নাৎসিদের অবাস্তব পরিকল্পনা এবং উপনিবেশবাদের দীর্ঘমেয়াদী প্রভাবও অনুসন্ধান করে। আফ্রিকার পূর্ব উপকূলে সা¤্রাজ্যের আগুন জ্বলছে অথচ জার্মান এবং ব্রিটিশ, ফরাসি এবং বেলজিয়ানরা নানা ধরনের চুক্তি স্বাক্ষরে ব্যস্ত। আফটারলাইভস পরিবার, প্রেম, বন্ধুত্ব, স্থানচ্যুতি সা¤্রাজ্য বিস্তার এবং যুদ্ধ সম্পর্কে একটি মহাকাব্যিক উপন্যাস।

উত্তর-উপনিবেশবাদের অধ্যাপক ও গবেষক আব্দুলরাজাক গুরনাহর নোবেল প্রদানের প্রাইজ মোটিভেশনে বলা হয়েছে: ঔপনিবেশিকতার প্রভাব এবং সংস্কৃতি ও মহাদেশগুলোর মধ্যকার আবর্তে শরণার্থীদের ভাগ্যের আপসহীন ও সহানুভূতিশীল উপস্থাপনার জন্য। সুইডিশ একাডেমির চেয়ারম্যান এন্ডার্স ওলসন বলেন, সত্যের প্রতি গুরনাহর আত্মোৎসর্গ এবং সরলীকরণের প্রতি তার বিরাগ উল্লেখযোগ্যভাবে লক্ষণীয়। আব্দুলরাজাক গুরনাহ অসীম নিবিষ্টতায় ঔপনিবেশিকতা, উত্তর-উপনিবেশবাদ, ঔপনিবেশিকতার প্রভাব, সাংস্কৃতিক সংকট ও সংঘাত, পরিচয়হীনতা ও নতুন পরিচয়ের সন্ধান এবং বাস্তুচ্যুতির বিষয় নিয়ে লিখে চলেছেন। এভাবে, তার দশটি উপন্যাস ও ছোটগল্পের মূল বিষয় হয়ে ওঠে ঔপনিবেশিক সময়ের দুঃসহ স্মৃতি, বাস্তুচ্যুতির বেদনা আর অভিবাসী জীবনের সংকটময় অভিজ্ঞতার ট্রমা।

বৃহস্পতিবার, ১৪ অক্টোবর ২০২১ , ২৯ আশ্বিন ১৪২৮ ০৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৩

গুরনাহর উপন্যাসে ঔপনিবেশিকতা

image

লেখার যাত্রার শুরু মূলত ফেলে আসা ভূমি, মানুষ এবং মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্কের কষ্ট নিয়ে ডায়েরির পাতায় টুকিটাকি লেখার মধ্য দিয়ে। তাঁর প্রথম উপন্যাস মেমোরি অব ডিপার্চার প্রকাশিত হয় ১৯৮৭ সালে। উপন্যাসটি উপকূলীয় পূর্ব-আফ্রিকার পনেরো বছর বয়সি এক সংবেদনশীল কিশোরের জীবন-সংগ্রাম ও তার আধ্যাত্মিক পুনর্জন্মের গল্প। সমুদ্রবন্দরসংলগ্ন দারিদ্র্যপীড়িত গ্রামে পরিবারের সাথে বসবাস করা উপন্যাসের মূল চরিত্র হাসান ওমর সহিংসতা এবং হতাশার এক দুষ্টচক্র দ্বারা পরিবেষ্টিত। তার হতাশার অনুভূতিগুলো আশপাশের জীবনের ঘটনার দ্বারা আরো উজ্জীবিত হয়। তাঁর পিতা মাতাল, অত্যাচারী, লম্পট; এক বোন, যে তাদের জীবনের অন্ধগলি থেকে পালিয়ে যায়; বিভ্রান্ত বড় ভাই, যে জীবনের নানাবিধ পঙ্কিলতার হেরে যায় এবং অবশেষে একটি অদ্ভুত দুর্ঘটনায় মারা যায়; এবং তার মা তার স্বামীর নিষ্ঠুর অত্যাচারের কাছে আত্মসমর্পণ করেন। অবশেষে, হাসান তার পরিবার ছেড়ে এক চাচার সাথে থাকার জন্য নাইরোবিতে চলে যায়। সেখানে সে একটি বৃহত্তর পৃথিবী আবিষ্কার করে, যেখানে নিষ্ঠুরতা আছে কিন্তু তার পুরনো জীবন থেকে বেরিয়ে আসার আশা এবং মুক্তির উপায়ও যেন আছে। হাসানের প্রচেষ্টা শেষ পর্যন্ত আরো বড় কিছুর প্রত্যাশা করে। যদিও গুরনাহ, কেবল এই বার্তাটিই তুলে ধরেন: নায়কের আকাক্সক্ষা এবং দ্বিধা তৃতীয় বিশ্ব আফ্রিকার ঔপনিবেশিক লড়াইকে প্রতিফলিত করে। তার দারিদ্র্য এবং নিপীড়নের সাথে এবং নিজের জন্য একটি নতুন পরিচয় তৈরি করতে সে সংগ্রাম করে যায়। উপন্যাসটির আকৃতি ছোটো হলেও হাসানের আত্মমর্যাদার অবনমন এবং ঘূর্ণায়মান চেতনার পরিস্ফূটনে সহায়তা করে।

গুরনাহর বেশিরভাগ উপন্যাসের স্থান ও কাল পূর্ব-আফ্রিকার উপকূলকে ঘিরে। তার উপন্যাসের একজন নায়ক ছাড়া বাকি সবাই জাঞ্জিবারের। সাহিত্যসমালোচক ব্রুস কিং বলেন, ‘গুরনাহর উপন্যাসগুলো পূর্ব আফ্রিকান নায়কদের বিস্তৃত আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে স্থান করে দিয়েছে।’ তার কথাসাহিত্যে ‘আফ্রিকানরা সর্বদা বৃহত্তর ও পরিবর্তিত বিশ্বের অংশ’ এই কথা বার বার ধ্বনিত হয়। গুরনাহর উপন্যাসের চরিত্রগুলো প্রায়শই শিকড় ওপড়ানো ও ভূমি-বিচ্ছিন্ন এবং অবাঞ্ছিত। এই বিচ্ছিন্নতা ও শেকড়হীনতার ভিতর দিয়ে তিনি তার চরিত্রদের বিশ^ দরবারে উপস্থাপন করেন। ১৯৮৮ সালে প্রকাশিত উপন্যাস পিলগ্রিমস ওয়ে-এ তিনি এমন এক যাত্রাকে আঁকেন, যেখানে আত্মপরিচয়, ম্মৃতি এবং আত্মীয়তার বোধগুলো চলে আসে প্রশ্নের সামনে। ১৯৯৪ সালে প্রকাশিত গুরনাহর চতুর্থ উপন্যাস প্যারাডাইস তাকে বিশ^ময় খ্যাতি এনে দেয়। উপনিবেশ-নির্ধারিত উপন্যাসের সীমানা অতিক্রম করে এই আখ্যান। প্যারাডাইস ১৯৯৪ সালে বুকার ও হোয়াইটব্রেড পুরস্কারের জন্য সংক্ষিপ্ত তালিকাভুক্ত হয়েছিল। উপন্যাসটি শতাব্দীর গোড়ার দিকে তানজানিয়ার যুবক ইউসুফের গল্প। ইউসুফ তার বাবা-মায়ের সঙ্গে তানজানিয়ায় থাকত। সে তার চাচা আজিজকে পছন্দ করত। যখন ইউসুফের বয়স বারো, আজিজ ইউসুফকে সঙ্গে নিয়ে যায় তার দোকানে কাজ করার জন্য। ইউসুফ কাজ করার সময় জানতে পারে যে, সে আসলে এক ধরনের দাসত্বের মধ্যে আছে। কারণ, তার বাবা আজিজের কাছে টাকা ধার করেছিলেন। ইউসুফ সেই ঋণের বিপরীতে জামিন হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। জীবদ্দশায় ইউসুফের বাবা তা পরিশোধ করতে পারেননি। ইউসুফ সুদর্শন যুবক। নারীরা তার প্রতি আকর্ষণ বোধ করে। চাচা আজিজের স্ত্রী তাকে দেখার পর সে-ও তার প্রতি আকর্ষণ বোধ করে। আজিজ প্রায়ই বাণিজ্যিক কারণে দেশের বিভিন্ন জায়গায় যায় এবং ইউসুফকে সঙ্গে নিয়ে যায়। যদিও আমরা পরে জানতে পারি যে, এটা আসলে স্ত্রীর কাছ থেকে তাকে দূরে রাখার জন্য আজিজের এক কৌশল। ক্রমান্বয়ে ইউরোপীয় অর্থাৎ জার্মানদের দেশ দখল এবং তারপর প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। অবশেষে, ইউসুফ ফিরে আসে, যুবক এবং সুঠামদেহী। ইউসুফের প্রতি আজিজের স্ত্রীর আকর্ষণ কমে না; যদিও ইউসুফ আজিজের চাকর। আজিজের স্ত্রী কি চাকরের সাথে পালাবে? আমরা কখনো এর উত্তর পাই না। কারণ গল্পটি হঠাৎ মাঝপথে থেমে যায়।

পরিচয় সংকট ও আত্মস্মৃতির উপস্থাপনা গুরনাহর আরেক প্রসিদ্ধ উপন্যাস বাই দ্য সি প্রকাশিত হয় ২০০১ সালে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। এটি পঁয়ষট্টি বছর বয়সি সালেহ ওমরের কাহিনি, যে জাঞ্জিবারের একজন বণিক শরণার্থী হয়ে ইংল্যান্ডে আশ্রয়ের জন্য আবেদন করে। বর্তমান সময়ের সিনবাদ সালেহ ওমর এমন একটি দেশ থেকে পালিয়ে এসেছে যেখানে দুষ্ট জিনরা সমকালীন কর্তৃত্ববাদ, কনসেনট্রেশন ক্যাম্প, রাইফেল, ক্যাঙ্গারু কোর্ট ইত্যাদির মাধ্যমে দেশ পরিচালনা করছে। গ্যাটউইক বিমানবন্দরে আসার পর ওমর একটি অবৈধ ভিসা উপস্থাপন করে যা আসলে তার দূর সম্পর্কের চাচাত ভাই এবং তার সবচেয়ে ঘৃণ্য শত্রু রজব শাবান মাহমুদের নামে ইস্যু করা। দৈবক্রমে তার দেখা হয় কিসওয়াহিলির ইংরেজ বিশেষজ্ঞ লতিফ মাহমুদের সাথে, যিনি আসলে রজব শাবানের পুত্র। অনিবার্যভাবে, দুজন একসঙ্গে সমুদ্রতীরবর্তী একটি ইংরেজ শহরে একত্রিত হন। লতিফ অনেক আগেই তার জাঞ্জিবার পরিবারের সাথে সব সম্পর্ক ছিন্ন করে, ষাটের দশকে ইংল্যান্ডে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তিনি ইংরেজির অধ্যাপক ও কবি। তিনি জানতে পারেন, তার বাবা রজব এবং তার স্ত্রী আশার প্রতিহিংসাপরায়ণতার স্বীকার হয়েছে সালেহ ওমর। আশা একজন প্রভাবশালী মন্ত্রীর উপপত্নীও। ওমরের উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তির ওপর লোভের জন্য সালেহ ওমরকে অবশেষে তার বাড়ি থেকে বিতাড়িত করা হয়, গ্রেফতার করা হয় এবং বিভিন্ন ক্যাম্পে বন্দি করে রাখা হয়। এ উপন্যাসে গুরনাহ উত্তর-ঔপনিবেশিক বিশ্বে শরণার্থীর প্রবাহ এবং নতুন স্থান ও সমাজে তাদের সংকটময় জীবনের ট্র্যাজেডির চিত্র তুলে ধরেন যেখানে শরণার্থীরা সর্বদা ক্রমবর্ধনশীল।

গুরনাহর সৃষ্ট চরিত্ররা তাদের নতুন পরিবেশের সাথে খাপ-খাইয়ে নিতে নিজেদের জন্য একটি নতুন পরিচয় তৈরি করার চেষ্টা করে। তারা ক্রমাগত তাদের নতুন জীবন এবং তাদের অতীত অস্তিত্বের মধ্যে সংযোগ তৈরির চেষ্টা করে যায়। তার আখ্যানগুলোয় নতুন ভৌগোলিক এবং সামাজিক প্রেক্ষাপটে অভিবাসনপ্রত্যাশী ও অভিবাসীগণ পরিচয় নির্মাণের জন্য সংগ্রাম করে। জীবনের ক্রমাগত পরিবর্তন এবং তার উপন্যাসের প্রধান চরিত্রদের নতুন পরিচয়ের অনুসন্ধান যেন অন্য মানুষের নির্দিষ্ট পরিচয়কেও অস্থির করে তোলে। আমরা দেখি, যেখানে তারা স্থানান্তরিত হয় সেখানকার পরিবেশের বিরূপতার মুখোমুখি হতে হয় তাদের। ১৯৯৬ সালে প্রকাশিত অ্যাডমায়ারিং সাইলেন্স উপন্যাসের নামহীন বর্ণনাকারী যখন তার প্রেমিকা এমার বাবা-মাকে জানায় যে, তার মেয়ে গর্ভবতী, তখন তারা তাকে ঘৃণার চোখে দেখে কারণ তারা মনে করে এখন থেকে তাদের মেয়েকে সারা জীবন এক ধরনের দূষণের সাথে থাকতে হবে। এই দূষণ মূলত অভিবাসীদের দ্বারা। এই অনামা জাঞ্জিবারিয়ান বিশ বছর পরে দেশে ফিরে যায় যখন সে তার মায়ের কাছ থেকে একটি চিঠি পায়। চিঠিতে উল্লেখ করা হয় যে, যারা অবৈধভাবে দেশ ছেড়েছে তাদের জন্য ক্ষমা ঘোষণা করা হয়েছে। জাঞ্জিবারে থাকা তার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগের সময় সে তার স্ত্রী এমা ও মেয়ে এমেলিয়ার কথা কখনো উল্লেখ করে না। সে জাঞ্জিবারে ফিরে যায়। পুনরায় ইংল্যান্ডে ফিরে এসে দেখে যে তার স্ত্রী আবদ্ধ হয়েছে অন্য প্রেমিকের সাথে। এই উপন্যাসের মূল শক্তি ক্রমাগত অসাধু মূল চরিত্র ও উপন্যাসের ন্যারেটরের নিখুঁত মনস্তাত্ত্বিক অসততার মধ্যে নিহিত। সে একসময় উপলব্ধি করে, জাঞ্জিবারে তার মূল পরিবারকে পরিত্যাগ এবং ইংল্যান্ডে নতুন করে তৈরি পরিবার থেকে বিচ্ছিন্নতা মূলত তার মানসিক নির্বাসনেরই অংশ, যে মানসিক অসততা তৈরির পশ্চাতে কাজ করেছে দেশান্তর, শরণার্থী জীবন।

আব্দুলরাজাক গুরনাহর সবশেষ উপন্যাস আফটারলাইভস প্রকাশিত হয় ২০২০ সালে। ঐতিহাসিক এ উপন্যাসটি পূর্ব আফ্রিকান উপকূলে মাজি মাজি বিদ্রোহের সময়কে ধারণ করে রচিত। স্থানীয় অধিবাসীদের জোর করে তুলা উৎপাদনে জার্মান কলোনিয়াল সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে শুরু হয় বিদ্রোহ। আফটারলাইভস চারটি প্রধান চরিত্রের গল্প বলে, যাদের জীবন একে অপরের সাথে প্রেম ও আত্মীয়তায় গাঁথা। চরিত্রগুলোর নিজ ভূমিতে জীবন ও সম্পর্কগুলো তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরের শক্তি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। প্রধান চার চরিত্র খলিফা, হামজা, ইলিয়াস ও আফিয়া। ইলিয়াসকে পিতা-মাতার কাছ থেকে জার্মান ঔপনিবেশিক সৈন্যরা চুরি করে। একজন অফিসার দ্বারা যৌন নির্যাতনের স্বীকার হয় সে। কয়েক বছর যুদ্ধের পর সে তার গ্রামে ফিরে আসে। তার বোন আফিয়া, যে একটি পরিবারে পালিত হয় ও দাস হিসেবে থাকে, তাকে সে উদ্ধার করে। অন্যদিকে, হামজা চুরি হয়নি, তবে বিক্রি হয়েছিল। জার্মান কলোনিয়াল সেনাদের হয়ে তারা যুদ্ধ করেছে। অথচ হামজা এবং ইলিয়াসের মতো আফ্রিকানরা, যারা জার্মানির হয়ে লড়াই করেছে, তাদের ধোঁকা দেওয়া হয়েছে, ঠকানো হয়েছে বা নানাবিধ শর্তে আবদ্ধ করে ফেলা হয়েছে। উপন্যাসটি বর্ণবাদ, আত্মসমর্পণ এবং আত্মত্যাগের গল্প। উপন্যাসটি পূর্ব আফ্রিকার নাৎসিদের অবাস্তব পরিকল্পনা এবং উপনিবেশবাদের দীর্ঘমেয়াদী প্রভাবও অনুসন্ধান করে। আফ্রিকার পূর্ব উপকূলে সা¤্রাজ্যের আগুন জ্বলছে অথচ জার্মান এবং ব্রিটিশ, ফরাসি এবং বেলজিয়ানরা নানা ধরনের চুক্তি স্বাক্ষরে ব্যস্ত। আফটারলাইভস পরিবার, প্রেম, বন্ধুত্ব, স্থানচ্যুতি সা¤্রাজ্য বিস্তার এবং যুদ্ধ সম্পর্কে একটি মহাকাব্যিক উপন্যাস।

উত্তর-উপনিবেশবাদের অধ্যাপক ও গবেষক আব্দুলরাজাক গুরনাহর নোবেল প্রদানের প্রাইজ মোটিভেশনে বলা হয়েছে: ঔপনিবেশিকতার প্রভাব এবং সংস্কৃতি ও মহাদেশগুলোর মধ্যকার আবর্তে শরণার্থীদের ভাগ্যের আপসহীন ও সহানুভূতিশীল উপস্থাপনার জন্য। সুইডিশ একাডেমির চেয়ারম্যান এন্ডার্স ওলসন বলেন, সত্যের প্রতি গুরনাহর আত্মোৎসর্গ এবং সরলীকরণের প্রতি তার বিরাগ উল্লেখযোগ্যভাবে লক্ষণীয়। আব্দুলরাজাক গুরনাহ অসীম নিবিষ্টতায় ঔপনিবেশিকতা, উত্তর-উপনিবেশবাদ, ঔপনিবেশিকতার প্রভাব, সাংস্কৃতিক সংকট ও সংঘাত, পরিচয়হীনতা ও নতুন পরিচয়ের সন্ধান এবং বাস্তুচ্যুতির বিষয় নিয়ে লিখে চলেছেন। এভাবে, তার দশটি উপন্যাস ও ছোটগল্পের মূল বিষয় হয়ে ওঠে ঔপনিবেশিক সময়ের দুঃসহ স্মৃতি, বাস্তুচ্যুতির বেদনা আর অভিবাসী জীবনের সংকটময় অভিজ্ঞতার ট্রমা।