এবারও ভারতকে ছাড়িয়ে বাড়ছে মাথাপিছু আয়

তবে কার বাড়তি আয়ে এই উন্নতি?

আবারও সুখবর পাওয়া গেল আইএমএফ থেকে। সংস্থাটি বলছে, ২০২১ সালে মাথাপিছু জিডিপিতে ভারতকে পেছনে ফেলবে বাংলাদেশ। এর আগে অর্থাৎ ২০২০ সালেও বাংলাদেশ প্রতিবেশী এই বড় অর্থনীতির দেশটিকে পেছনে ফেলেছিল।

তবে অর্থনীতিবিদরা বলছেন অন্য কথা। তারা বলছেন, মাথাপিছু জিডিপিতে ভারতকে পেছনে ফেললেই যে বাংলাদেশের সার্বিক অর্থনীতি ভারতের চেয়ে এগিয়ে, তা বলা যাবে না। কারণ মাথাপিছু জিডিপির মধ্যে জীবনযাত্রার মানের অনেক সূচক অন্তর্ভুক্ত থাকে না। ক্রয়ক্ষমতার সমতা বা পারচেজিং পাওয়ার প্যারিটি (পিপিপি) সূচকে ভারতের চেয়ে অনেক পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ। তবে মাথাপিছু জিডিপি বেশি হওয়াও অর্থনীতি এগিয়ে যাওয়ার একটি পূর্ব লক্ষণ।

গত মঙ্গলবার প্রকাশিত আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) এর ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুক প্রকাশিত হয়। সেই প্রতিবেদনে এই তথ্য জানায় সংস্থাটি।

আইএমএফ পূর্বাভাস অনুযায়ী, চলতি ২০২১ সালে চলতি মূল্যে বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি হবে ২ হাজার ১৩৮ দশমিক ৭৯৪ ডলার। অন্যদিকে ভারতের মাথাপিছু জিডিপি হবে ২ হাজার ১১৬ দশমিক ৪৪৪ ডলার।

অর্থাৎ ভারতের চেয়ে বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি বেশি হবে ২২ দশমিক ৩৫ ডলার। গত বছরও ভারতকে পেছনে ফেলেছিল বাংলাদেশ। সেটি হিসেব করলে পর পর দুই বছর ভারতকে পেছনে ফেলল বাংলাদেশ।

তবে গত বছর অক্টোবরে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) একটি গবেষণা প্রকাশ করে। সেই গবেষণায় বলা হয়, করোনায় প্রতি পরিবারের আয় গড়ে কমেছে ৪ হাজার টাকা। জরিপে অংশ নেয়া প্রায় ৬৮ শতাংশ পরিবার কোন না কোনভাবে আর্থিক সমস্যায় পড়েছে।

এছাড়া গত বছর এপ্রিল থেকে জুলাই পর্যন্ত দেশে বেকারত্বের হার ২২ শতাংশের ওপরে চলে যায়। ঐ বছরের মার্চের তুলনায় আগস্টে খানাভিত্তিক মাসিক গড় আয় ২০ দশমিক ২৪ শতাংশ কমেছে। যদি করোনায় দেশের প্রতিটি পরিবারের মাসিক আয় কমে, তাহলে আয় বাড়লো কার?

এই গবেষণার সত্যতা পাওয়া যায় কয়েকজন বেসরকারি চাকরিজীবীর সঙ্গে কথা বলে। তারাও বলছেন, করোনার মধ্যে তাদের মাসিক আয় কমেছে।

মিলন হোসেন নামের একজন বেসরকারি চাকরিজীবী সংবাদকে জানান, বাংলাদেশে করোনা সংক্রমণ ঘোষণার তিন মাসের মাথায় অফিস থেকে তাকে নোটিশ দিয়ে জানানো হয়, কোম্পানির আয় কমে যাওয়ায় তার বেতন ৩০ শতাংশ কমানো হয়েছে। সেই যে বেতন কমানো হলো, আজও বাড়েনি। কবে করোনার ধাক্কা কাটিয়ে উঠবে কোম্পানি, কবে পুরো বেতন পাবেন তা তিনি জানেন না।

গতকাল এ বিষয়ে কথা হয় বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমানের সঙ্গে। মাথাপিছু জিডিপির হিসাব কষে যে একটি দেশের সার্বিক অর্থনীতির অবস্থা বোঝা যায় না, সেটিই তিনি উল্লেখ করেন।

তিনি সংবাদকে বলেন, ‘মাথাপিছু জিডিপির হিসেব কষে একটি দেশের সার্বিক জীবনযাত্রার মান বোঝা যায় না। জীবনযাত্রার মানের অনেক সূচক মাথাপিছু জিডিপির হিসাবের মধ্যে থাকে না। জীবনযাত্রার মান মূল্যায়ন করতে হলে আরও কিছু সূচক দেখতে হয়।’

মাথাপিছু জিডিপি দিয়ে যদি জীবনযাত্রার মান বোঝা না যায় তাহলে কোন সূচক দেখে সেটি বোঝা যায়- এমন বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়েছিল কয়েকজন অর্থনীতিবিদের কাছে।

তারা বলছেন, একটি দেশের নাগরিক অর্থনৈতিকভাবে কতটুকু শক্তিশালী সেটি জানার সবচেয়ে ভালো সূচক হলো ক্রয়ক্ষমতার সমতা বা পারচেজিং পাওয়ার প্যারিটির (পিপিপি)।

অর্থাৎ কি পরিমাণ অর্থ খরচ করলে, সেই দেশে কি পরিমাণ সেবা পাওয়া যায়, সেটিকেই ইঙ্গিত করে পিপিপি। আর এই সূচকে ভারত অনেক এগিয়ে আছে বাংলাদেশের তুলনায়।

আইএমএফের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরে পিপিপির ভিত্তিতে জিডিপির হিসাবে বিশ্বে ভারতের অংশ ৭ দশমিক শূন্য ৩৯ শতাংশ। আর বাংলাদেশের অংশ মাত্র শূন্য দশমিক ৬৫৯ শতাংশ।

একই প্রশ্ন আরও কয়েকজনকে করা হয়েছিল। তবে ফলাফল একই এসেছে। অর্থাৎ মাথাপিছু আয় বাড়লেও ক্রয়ক্ষমতা বাড়েনি বাংলাদেশের মানুষের। সেই সঙ্গে বেড়েছে অর্থনৈতিক বৈষম্য। কারণ মাথাপিছু জিডিপি হিসাব করা হয় দেশের সব নাগরিকের হিসাব করে।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, এক জন ব্যক্তি মাসে ৯০ হাজার টাকা আয় করলো। আরেকজন মাসে ১০ হাজার টাকা আয় করলো। তাহলে তাদের মাথাপিছু আয় হবে ৫০ হাজার টাকা। এখানেই মাথাপিছু জিডিপির দুর্বলতা।

বাংলাদেশের মানুষের অর্থনৈতিক বৈষম্য যে কতটা বেড়েছে তা বোঝা যায় একটি প্রতিবেদন থেকে। গত বছর ‘ওয়ার্ল্ড আলট্রা ওয়েলথ রিপোর্ট ২০১৮’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। সেই প্রতিবেদনে কি পরিমাণ সম্পদ কার দখলে আছে এসব তথ্য প্রকাশ করে।

সেই প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে ধনকুবেরদের সামগ্রিক সম্পদের বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ১৭ দশমিক ৩ শতাংশ। আর সারা বিশ্বের মধ্যে শীর্ষ দশের প্রথম স্থানটি বাংলাদেশের দখলে। অর্থাৎ দেশ হিসেবে বাংলাদেশের ধনীরাই বেশি সম্পদ কুক্ষিগত করে রেখেছে অন্য দেশের তুলনায়।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বৈষম্য এমনভাবে বাড়ছে যে জিডিপি প্রবৃদ্ধির সুফল একটা ক্ষুদ্র ধনাঢ্য গোষ্ঠীর কাছে গিয়ে জমছে।

আর এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ দেখা যায় সম্প্রতি দেশে কোটিপতি বৃদ্ধির হিসাবে।

সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে দেখা যায়, ছয় মাসে দেশে কোটিপতি হিসাব বেড়েছে ৬ হাজার ২৮টি। এই সংখ্যাটা বাংলাদেশের মতো দেশের জন্য খুব ছোট নয়। কারণ ১৯৭২ সালে কোটিপতির সংখ্যা ছিল মাত্র ৫টি। আর চলতি বছরের জুন পর্যন্ত এই হিসাব লাখ ছুঁই ছুঁই করছে (৯৯ হাজার ৯১৮টি)।

এই তো গেল দেশের স্বাভাবিক সময়ে ধনী-গরিবের মধ্যে বৈষম্য। চলমান করোনা মহামারী দেশের অর্থনৈতিক বৈষম্য আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।

সম্প্রতি বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) জরিপে বলা হয়েছে, করোনার প্রভাবে দেশে নতুন করে ২ কোটি ৪৫ লাখ মানুষ দরিদ্র হয়েছে। চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত নতুন দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সংখ্যা হয়েছে ১৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ। যা আগের বছরের জুন পর্যন্ত ছিল ২১ দশমিক ২৪ শতাংশ।

জরিপে আরও বলা হয়েছে, মহামারী শুরু হওয়ার পর দেশের অর্থনীতিতে কোভিড-১৯-এর প্রভাব পড়েছে। বিশেষ করে নি¤œ আয়ের মানুষের ওপর প্রভাবটা অনেক বেশি।

গবেষণায় দেখা গেছে, অতি ধনীদের তাদের হাতে এখন দেশের মোট আয়ের ৩৭.৮০ শতাংশ, যা লকডাউনের আগে ছিল ২৭.৮২ শতাংশ। এই কোভিড-১৯ এর লকডাউন আয় বৈষম্যও বাড়িয়েছে যা মারাত্মক রূপ ধারণ করেছে।

এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম সংবাদকে বলেন, ‘বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এটা ভালো খবর। তবে এর সুফল সবাই ভোগ করতে পারছেন না। গুটিকয়েক ধনীর আয় বাড়ছে। অন্যদিকে সাধারণ মানুষের আয় তুলনামূলক বাড়ছে না। এতে চরম আয়বৈষম্য সৃষ্টি হচ্ছে।’

এদিকে আইএমএফ আরও বলছে আগামীতে মাথাপিছু জিডিপি বাংলাদেশের বেশি হলেও সাধারণ জিডিপি প্রবৃদ্ধি বাংলাদেশের চেয়ে ভারতেই বেশি হবে। ২০২১ সালে ভারতের মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি হবে ৯ দশমিক ৫ শতাংশ। আর বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি হবে ৪ দশমিক ৬ শতাংশ।

তবে আগের বছর ভারতের অর্থনীতি সংকুচিত হওয়ায় পরের বছর জিডিপি বেশি হলেও মাথাপিছু আয়ে বাংলাদেশের নিচে থাকবে ভারত।

গত বছরও আইএমএফ ডব্লিউইও প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। সেখানে সংস্থাটি জানিয়েছিল, ২০২০ সালে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি হবে ৩ দশমিক ৮ শতাংশ। আর ভারতের প্রবৃদ্ধি কমে হবে ঋণাত্মক, অর্থাৎ (-) ১০ দশমিক ৩ শতাংশ। এর ফলে ২০২০ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি হবে ১ হাজার ৮৮৮ ডলার ও ভারতের হবে ১ হাজার ৮৮৭ ডলার। সুতরাং গতবার বাংলাদেশ ছিল ঠিক এক ডলারে এগিয়ে। তবে সেটি ছিল পূর্বাভাস।

এখন সংস্থাটি বলছে, ২০২০ সালে প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩ দশমিক ৫ শতাংশ। আর ভারতের প্রবৃদ্ধি ছিল ঋণাত্মক (-) ৭ দশমিক ৩ শতাংশ। ফলে শেষ পর্যন্ত তাদের হিসাবে ২০২০ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি হয় ১ হাজার ৯৬১ দশমিক ৬১৪ ডলার এবং ভারতের ১ হাজার ৯২৯ দশমিক ৬৭৭ ডলার। সুতরাং আসলে শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি বেশি হয়েছিল ৩১ দশমিক ৯৩৭ ডলার।

আইএমএফএর প্রতিবেদনে আরও দেখা যায়, ২০০৪ সাল থেকেই বাংলাদেশ ও ভারতের অর্থনীতি অনেক বেশি দ্রুত হারে এগিয়েছে। এই এগিয়ে যাওয়া বজায় ছিল ২০১৬ সাল পর্যন্ত। তবে পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করে ২০১৭ থেকে। এর পর থেকে ভারতের অর্থনীতির এগিয়ে যাওয়া শ্লথ হয়ে পড়ে। আর বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির হার বেড়েছে দ্রুতগতিতে।

এছাড়া সরকারি বিভিন্ন পরিসংখ্যানে দেখা যায়, করোনার মধ্যেও বাংলাদেশের অর্থনীতি তুলনামূলক ভালো করেছে। আইএমএফের পূর্বাভাস হলো, চলতি বছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৪ দশমিক ৬ শতাংশ হতে পারে, যা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে তৃতীয় সর্বোচ্চ। সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধি হবে মালদ্বীপে-১৮ দশমিক ৯ শতাংশ, এরপর ভারতে সাড়ে ৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হবে।

এ ছাড়া পাকিস্তান ৩ দশমিক ৯ শতাংশ, শ্রীলঙ্কা ৩ দশমিক ৬ শতাংশ, নেপালে ১ দশমিক ৮ এবং ভুটানে মাইনাস ১ দশমিক ৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হতে পারে। তবে আফগানিস্তানের জন্য কোন পূর্বাভাস দেয়নি আইএমএফ।

বৃহস্পতিবার, ১৪ অক্টোবর ২০২১ , ২৯ আশ্বিন ১৪২৮ ০৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৩

এবারও ভারতকে ছাড়িয়ে বাড়ছে মাথাপিছু আয়

তবে কার বাড়তি আয়ে এই উন্নতি?

রেজাউল করিম

আবারও সুখবর পাওয়া গেল আইএমএফ থেকে। সংস্থাটি বলছে, ২০২১ সালে মাথাপিছু জিডিপিতে ভারতকে পেছনে ফেলবে বাংলাদেশ। এর আগে অর্থাৎ ২০২০ সালেও বাংলাদেশ প্রতিবেশী এই বড় অর্থনীতির দেশটিকে পেছনে ফেলেছিল।

তবে অর্থনীতিবিদরা বলছেন অন্য কথা। তারা বলছেন, মাথাপিছু জিডিপিতে ভারতকে পেছনে ফেললেই যে বাংলাদেশের সার্বিক অর্থনীতি ভারতের চেয়ে এগিয়ে, তা বলা যাবে না। কারণ মাথাপিছু জিডিপির মধ্যে জীবনযাত্রার মানের অনেক সূচক অন্তর্ভুক্ত থাকে না। ক্রয়ক্ষমতার সমতা বা পারচেজিং পাওয়ার প্যারিটি (পিপিপি) সূচকে ভারতের চেয়ে অনেক পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ। তবে মাথাপিছু জিডিপি বেশি হওয়াও অর্থনীতি এগিয়ে যাওয়ার একটি পূর্ব লক্ষণ।

গত মঙ্গলবার প্রকাশিত আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) এর ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুক প্রকাশিত হয়। সেই প্রতিবেদনে এই তথ্য জানায় সংস্থাটি।

আইএমএফ পূর্বাভাস অনুযায়ী, চলতি ২০২১ সালে চলতি মূল্যে বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি হবে ২ হাজার ১৩৮ দশমিক ৭৯৪ ডলার। অন্যদিকে ভারতের মাথাপিছু জিডিপি হবে ২ হাজার ১১৬ দশমিক ৪৪৪ ডলার।

অর্থাৎ ভারতের চেয়ে বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি বেশি হবে ২২ দশমিক ৩৫ ডলার। গত বছরও ভারতকে পেছনে ফেলেছিল বাংলাদেশ। সেটি হিসেব করলে পর পর দুই বছর ভারতকে পেছনে ফেলল বাংলাদেশ।

তবে গত বছর অক্টোবরে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) একটি গবেষণা প্রকাশ করে। সেই গবেষণায় বলা হয়, করোনায় প্রতি পরিবারের আয় গড়ে কমেছে ৪ হাজার টাকা। জরিপে অংশ নেয়া প্রায় ৬৮ শতাংশ পরিবার কোন না কোনভাবে আর্থিক সমস্যায় পড়েছে।

এছাড়া গত বছর এপ্রিল থেকে জুলাই পর্যন্ত দেশে বেকারত্বের হার ২২ শতাংশের ওপরে চলে যায়। ঐ বছরের মার্চের তুলনায় আগস্টে খানাভিত্তিক মাসিক গড় আয় ২০ দশমিক ২৪ শতাংশ কমেছে। যদি করোনায় দেশের প্রতিটি পরিবারের মাসিক আয় কমে, তাহলে আয় বাড়লো কার?

এই গবেষণার সত্যতা পাওয়া যায় কয়েকজন বেসরকারি চাকরিজীবীর সঙ্গে কথা বলে। তারাও বলছেন, করোনার মধ্যে তাদের মাসিক আয় কমেছে।

মিলন হোসেন নামের একজন বেসরকারি চাকরিজীবী সংবাদকে জানান, বাংলাদেশে করোনা সংক্রমণ ঘোষণার তিন মাসের মাথায় অফিস থেকে তাকে নোটিশ দিয়ে জানানো হয়, কোম্পানির আয় কমে যাওয়ায় তার বেতন ৩০ শতাংশ কমানো হয়েছে। সেই যে বেতন কমানো হলো, আজও বাড়েনি। কবে করোনার ধাক্কা কাটিয়ে উঠবে কোম্পানি, কবে পুরো বেতন পাবেন তা তিনি জানেন না।

গতকাল এ বিষয়ে কথা হয় বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমানের সঙ্গে। মাথাপিছু জিডিপির হিসাব কষে যে একটি দেশের সার্বিক অর্থনীতির অবস্থা বোঝা যায় না, সেটিই তিনি উল্লেখ করেন।

তিনি সংবাদকে বলেন, ‘মাথাপিছু জিডিপির হিসেব কষে একটি দেশের সার্বিক জীবনযাত্রার মান বোঝা যায় না। জীবনযাত্রার মানের অনেক সূচক মাথাপিছু জিডিপির হিসাবের মধ্যে থাকে না। জীবনযাত্রার মান মূল্যায়ন করতে হলে আরও কিছু সূচক দেখতে হয়।’

মাথাপিছু জিডিপি দিয়ে যদি জীবনযাত্রার মান বোঝা না যায় তাহলে কোন সূচক দেখে সেটি বোঝা যায়- এমন বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়েছিল কয়েকজন অর্থনীতিবিদের কাছে।

তারা বলছেন, একটি দেশের নাগরিক অর্থনৈতিকভাবে কতটুকু শক্তিশালী সেটি জানার সবচেয়ে ভালো সূচক হলো ক্রয়ক্ষমতার সমতা বা পারচেজিং পাওয়ার প্যারিটির (পিপিপি)।

অর্থাৎ কি পরিমাণ অর্থ খরচ করলে, সেই দেশে কি পরিমাণ সেবা পাওয়া যায়, সেটিকেই ইঙ্গিত করে পিপিপি। আর এই সূচকে ভারত অনেক এগিয়ে আছে বাংলাদেশের তুলনায়।

আইএমএফের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরে পিপিপির ভিত্তিতে জিডিপির হিসাবে বিশ্বে ভারতের অংশ ৭ দশমিক শূন্য ৩৯ শতাংশ। আর বাংলাদেশের অংশ মাত্র শূন্য দশমিক ৬৫৯ শতাংশ।

একই প্রশ্ন আরও কয়েকজনকে করা হয়েছিল। তবে ফলাফল একই এসেছে। অর্থাৎ মাথাপিছু আয় বাড়লেও ক্রয়ক্ষমতা বাড়েনি বাংলাদেশের মানুষের। সেই সঙ্গে বেড়েছে অর্থনৈতিক বৈষম্য। কারণ মাথাপিছু জিডিপি হিসাব করা হয় দেশের সব নাগরিকের হিসাব করে।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, এক জন ব্যক্তি মাসে ৯০ হাজার টাকা আয় করলো। আরেকজন মাসে ১০ হাজার টাকা আয় করলো। তাহলে তাদের মাথাপিছু আয় হবে ৫০ হাজার টাকা। এখানেই মাথাপিছু জিডিপির দুর্বলতা।

বাংলাদেশের মানুষের অর্থনৈতিক বৈষম্য যে কতটা বেড়েছে তা বোঝা যায় একটি প্রতিবেদন থেকে। গত বছর ‘ওয়ার্ল্ড আলট্রা ওয়েলথ রিপোর্ট ২০১৮’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। সেই প্রতিবেদনে কি পরিমাণ সম্পদ কার দখলে আছে এসব তথ্য প্রকাশ করে।

সেই প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে ধনকুবেরদের সামগ্রিক সম্পদের বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ১৭ দশমিক ৩ শতাংশ। আর সারা বিশ্বের মধ্যে শীর্ষ দশের প্রথম স্থানটি বাংলাদেশের দখলে। অর্থাৎ দেশ হিসেবে বাংলাদেশের ধনীরাই বেশি সম্পদ কুক্ষিগত করে রেখেছে অন্য দেশের তুলনায়।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বৈষম্য এমনভাবে বাড়ছে যে জিডিপি প্রবৃদ্ধির সুফল একটা ক্ষুদ্র ধনাঢ্য গোষ্ঠীর কাছে গিয়ে জমছে।

আর এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ দেখা যায় সম্প্রতি দেশে কোটিপতি বৃদ্ধির হিসাবে।

সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে দেখা যায়, ছয় মাসে দেশে কোটিপতি হিসাব বেড়েছে ৬ হাজার ২৮টি। এই সংখ্যাটা বাংলাদেশের মতো দেশের জন্য খুব ছোট নয়। কারণ ১৯৭২ সালে কোটিপতির সংখ্যা ছিল মাত্র ৫টি। আর চলতি বছরের জুন পর্যন্ত এই হিসাব লাখ ছুঁই ছুঁই করছে (৯৯ হাজার ৯১৮টি)।

এই তো গেল দেশের স্বাভাবিক সময়ে ধনী-গরিবের মধ্যে বৈষম্য। চলমান করোনা মহামারী দেশের অর্থনৈতিক বৈষম্য আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।

সম্প্রতি বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) জরিপে বলা হয়েছে, করোনার প্রভাবে দেশে নতুন করে ২ কোটি ৪৫ লাখ মানুষ দরিদ্র হয়েছে। চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত নতুন দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সংখ্যা হয়েছে ১৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ। যা আগের বছরের জুন পর্যন্ত ছিল ২১ দশমিক ২৪ শতাংশ।

জরিপে আরও বলা হয়েছে, মহামারী শুরু হওয়ার পর দেশের অর্থনীতিতে কোভিড-১৯-এর প্রভাব পড়েছে। বিশেষ করে নি¤œ আয়ের মানুষের ওপর প্রভাবটা অনেক বেশি।

গবেষণায় দেখা গেছে, অতি ধনীদের তাদের হাতে এখন দেশের মোট আয়ের ৩৭.৮০ শতাংশ, যা লকডাউনের আগে ছিল ২৭.৮২ শতাংশ। এই কোভিড-১৯ এর লকডাউন আয় বৈষম্যও বাড়িয়েছে যা মারাত্মক রূপ ধারণ করেছে।

এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম সংবাদকে বলেন, ‘বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এটা ভালো খবর। তবে এর সুফল সবাই ভোগ করতে পারছেন না। গুটিকয়েক ধনীর আয় বাড়ছে। অন্যদিকে সাধারণ মানুষের আয় তুলনামূলক বাড়ছে না। এতে চরম আয়বৈষম্য সৃষ্টি হচ্ছে।’

এদিকে আইএমএফ আরও বলছে আগামীতে মাথাপিছু জিডিপি বাংলাদেশের বেশি হলেও সাধারণ জিডিপি প্রবৃদ্ধি বাংলাদেশের চেয়ে ভারতেই বেশি হবে। ২০২১ সালে ভারতের মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি হবে ৯ দশমিক ৫ শতাংশ। আর বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি হবে ৪ দশমিক ৬ শতাংশ।

তবে আগের বছর ভারতের অর্থনীতি সংকুচিত হওয়ায় পরের বছর জিডিপি বেশি হলেও মাথাপিছু আয়ে বাংলাদেশের নিচে থাকবে ভারত।

গত বছরও আইএমএফ ডব্লিউইও প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। সেখানে সংস্থাটি জানিয়েছিল, ২০২০ সালে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি হবে ৩ দশমিক ৮ শতাংশ। আর ভারতের প্রবৃদ্ধি কমে হবে ঋণাত্মক, অর্থাৎ (-) ১০ দশমিক ৩ শতাংশ। এর ফলে ২০২০ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি হবে ১ হাজার ৮৮৮ ডলার ও ভারতের হবে ১ হাজার ৮৮৭ ডলার। সুতরাং গতবার বাংলাদেশ ছিল ঠিক এক ডলারে এগিয়ে। তবে সেটি ছিল পূর্বাভাস।

এখন সংস্থাটি বলছে, ২০২০ সালে প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩ দশমিক ৫ শতাংশ। আর ভারতের প্রবৃদ্ধি ছিল ঋণাত্মক (-) ৭ দশমিক ৩ শতাংশ। ফলে শেষ পর্যন্ত তাদের হিসাবে ২০২০ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি হয় ১ হাজার ৯৬১ দশমিক ৬১৪ ডলার এবং ভারতের ১ হাজার ৯২৯ দশমিক ৬৭৭ ডলার। সুতরাং আসলে শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি বেশি হয়েছিল ৩১ দশমিক ৯৩৭ ডলার।

আইএমএফএর প্রতিবেদনে আরও দেখা যায়, ২০০৪ সাল থেকেই বাংলাদেশ ও ভারতের অর্থনীতি অনেক বেশি দ্রুত হারে এগিয়েছে। এই এগিয়ে যাওয়া বজায় ছিল ২০১৬ সাল পর্যন্ত। তবে পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করে ২০১৭ থেকে। এর পর থেকে ভারতের অর্থনীতির এগিয়ে যাওয়া শ্লথ হয়ে পড়ে। আর বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির হার বেড়েছে দ্রুতগতিতে।

এছাড়া সরকারি বিভিন্ন পরিসংখ্যানে দেখা যায়, করোনার মধ্যেও বাংলাদেশের অর্থনীতি তুলনামূলক ভালো করেছে। আইএমএফের পূর্বাভাস হলো, চলতি বছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৪ দশমিক ৬ শতাংশ হতে পারে, যা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে তৃতীয় সর্বোচ্চ। সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধি হবে মালদ্বীপে-১৮ দশমিক ৯ শতাংশ, এরপর ভারতে সাড়ে ৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হবে।

এ ছাড়া পাকিস্তান ৩ দশমিক ৯ শতাংশ, শ্রীলঙ্কা ৩ দশমিক ৬ শতাংশ, নেপালে ১ দশমিক ৮ এবং ভুটানে মাইনাস ১ দশমিক ৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হতে পারে। তবে আফগানিস্তানের জন্য কোন পূর্বাভাস দেয়নি আইএমএফ।