‘ম্যাকবেথ’-এর আলোকে বঙ্গবন্ধু ও রাজা ডানকান হত্যাকাণ্ডের প্রেক্ষাপট ও নিষ্ঠুরতা

শেখর ভট্টাচার্য

ম্যাকবেথ নাটকটি প্রথমবার পড়তে হয়েছে পাঠ্যবই হিসেবে। পরবর্তীতে নাটকটির কাহিনীতে ঘটে যাওয়া ঈর্ষা, দ্বেষ, ক্ষমতা লিপ্সার নিগুঢ় অর্থ অনুসন্ধানের জন্য বার বার পড়তে হয়েছে। মহৎ কবি, লেখক, নাট্যকার দার্শনিকরা ত্রিকালদর্শী হন। তাদের সৃষ্টিকর্ম তাই যুগোত্তীর্ণ, কালোত্তীর্ণ হয়ে ওঠে। ম্যাকবেথ কেনো পড়ি বার বার? এর প্রথম জবাব আমার কাছে, সেটি হলো মুগ্ধতা। শুধু মুগ্ধতা? মুগ্ধতার সঙ্গে একধরনের বিস্ময়ও আছে। এবার যদি “কারণের কারণ” জানতে নিজেকে প্রশ্ন করি, বিস্ময় কেন? এর সরাসরি উত্তর হলো মহৎ নাটক হিসাবে এর চিরন্তন আবেদন আমাকে বিস্মিত করে। শেক্সপিয়রের যে নাটকটি ১৬০৬ সালে প্রথম মঞ্চায়ন হয়েছিল বলে অনুমান করা হয়, সে নাটকটি পৃথিবীর ম্যাজিকেল পরিবর্তনের পরও কত প্রাসঙ্গিক একথা ভেবে বিস্মিত না হয়ে পারিনা। শেক্সপিয়রের প্রতি শ্রদ্ধায় মস্তক অবনত হয়ে পড়ে। সতেরশ শতাব্দীতে “ক্ষমতা-কেন্দ্র”কে ঘিরে থাকা মানুষের লিপ্সা, উচ্চাকাক্সক্ষা, ঈর্ষা, নিষ্ঠুরতার সঙ্গে এগিয়ে যাওয়া “সুসভ্য” পৃথিবীর মানুষের মধ্যে কোন তফাৎ খুঁজে পাই না, এগিয়ে যাওয়া সমাজ নিয়ে বিভ্রম তৈরি হয়। জ্ঞান, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে অভাবনীয় অর্জনের সঙ্গে মানবিক গুণাবলিতে সমৃদ্ধ হওয়ার সম্পর্ক খুঁজে হতাশ হই। সামগ্রিকভাবে এগিয়ে যাওয়ার সমীকরণ মেলাতে হিমশিম খেতে হয়।

ম্যাকবেথের কাহিনীতে ক্ষমতা লাভের জন্য যে জটিল ও নিষ্ঠুর দ্বন্দ্বের উপস্থিতি দেখতে পাওয়া যায়, সমসাময়িককালে পৃথিবীতে সে দ্বন্দ্ব আরও জটিল আরও নির্দয় রূপ গ্রহণ করেছে বলে মনে হয়। সতেরশ’ শতাব্দীতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যে উন্নয়ন ছিল, তার সঙ্গে গত শতাব্দী কিংবা বহমান শতাব্দীর একই ক্ষেত্রে উন্নয়নের তুলনা করলে দেখা যেবে যোজন যোজন পথ এগিয়েছে মানুষ। একইভাবে দর্শন, শিল্প, সাহিত্য, রাজনীতিতে মানুষের অগ্রগতিকে অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। যে বিষয়টি ভাবলে ধাঁ ধাঁ’র মতো মনে হয় সেটি হলো, জ্ঞান বিজ্ঞানের উন্নতির সঙ্গে মানুষের মনুষ্যত্বের বিকাশ কি সমান্তরালভাবে এগিয়েছে? বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে মানুষ দৃশ্যমানভাবে এগিয়েছে। অদৃশ্য মানবিক গুণাবলির তাৎপর্যপূর্ণ উন্নতি কতোটুকু? অর্থ, বিত্ত, ক্ষমতা অর্জনের জন্য নিষ্ঠুর, অনৈতিক, অমানবিক পথ অবলম্বন, সতেরশ’ শতাব্দীর থেকে যে আরও প্রকট হয়েছে ম্যাকবেথ নাটকটি পড়লে আমরা তা অনুভব করতে পারি। মহান কবি ও নাট্যকার শেক্সপিয়র, ক্ষমতা লাভের জন্য মানুষের নিষ্ঠুরতা, অকৃতজ্ঞতা, অমানবিকতাকে কল্পনায় যতোটুকু দেখেছেন, বর্তমান শতাব্দীতে আমরা তার কল্পনার সীমাকে অতিক্রম করেছি। ম্যাকবেথ নাটকের ভেতর ঘটে যাওয়া নিষ্ঠুরতা, অমানবিকতার সঙ্গে গত কয়েকশ’ শতাব্দীতে ঘটে যাওয়া হিংস্রতার তুলনা করলে দেখা যাবে মানবিকতার বিকাশের সূচকে আমরা সতেরশ’ শতাব্দী থেকে পিছিয়ে পড়েছি। আমাদের পরবর্তী আলোচনায় এ বিষয়টিকে আরও স্পষ্ট হবে বলে আশা করছি।

“ম্যাকবেথ” নাটকের সেনাপতি ম্যাকবেথ স্কটল্যান্ডের রাজা ডানকানের পরম বিশ্বস্ত সেনাপতি ছিলেন। এই বিশ্বস্ততার কারনেই রাজা ডানকান, “কডরের আমাত্য” ম্যাকডোনাল্ডের বিদ্রোহ দমনের জন্য তাকে দায়িত্ব প্রদান করেন। ম্যাকডোনাল্ডের বিদ্রোহ ঘোষণার সুযোগ নিয়ে নরওয়ের সেনাবাহিনীও বিদ্রোহ করে বসে। এ রকম বিপদাপন্ন অবস্থায় বিদ্রোহ দমনের জন্য ম্যাকবেথ ও তার সমমর্যাদার সহকর্মী জেনারেল ব্যাঙ্কোসহ বেশ কয়েকজন সেনাপতি দুঃসময়ে রাজার পাশে এসে দাঁড়ান। ম্যাকবেথ থেন অভ গ্ল্যামিস, দক্ষ সাহসী যোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃত। স্কটল্যান্ডের রাজা ডানকান, অভিজাতশ্রেণীর লোকজন এবং সাধারণ মানুষের অতি প্রিয়পাত্র ছিলেন ম্যাকবেথ। রাজা ডানকানের আরোপিত দায়িত্ব সেনাপতি ম্যাকবেথ দক্ষতা ও বীরত্বের সঙ্গে পালন করেন। সেনাপতি ম্যাকবেথ অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে বিদ্রোহ দমন করে স্কটল্যান্ডকে বিপদ মুক্ত করেন। বিদ্রোহ দমনের পর “অদৃষ্ট” ম্যাকবেথ এবং লেডি ম্যাকবেথের অবচেতন মনে লুকিয়ে থাকা লোভ , লালসা ও উচ্চাকাক্সক্ষার পরীক্ষা নিতে শুরু করেন।

ম্যাকবেথ ও তার সহকর্মী ব্যাঙ্কো যখন ফিরে আসছিলেন জন্মভূমি স্কটল্যান্ডে তখন এক ঊষর প্রান্তরে তাদের সঙ্গে দেখা হয় তিন ডাইনীর। তিন জন ডাইনি ম্যাকবেথ ও ব্যাঙ্কোকে অভিবাদন জানিয়ে তিনটি ভবিষ্যৎবাণী উচ্চারণ করেন। ব্যাঙ্কো তাদের প্রতি সন্দেহ প্রকাশ করলে তারা ম্যাকবেথকে অভিবাদন জানান। তিনটি ভবিষ্যদ্বাণীর সর্বশেষটি ছিল ম্যাকবেথ স্কটল্যান্ডের রাজা হবেন নিকট ভবিষ্যতে। এ ছাড়াও তাকে অচিরেই কডরের আমাত্য বা থেন হিসাবে নিয়োগ দেয়া হবে অচিরেই। তবে ম্যাকবেথের সহকর্মী ব্যাঙ্কো ডাইনিদের ভবিষ্যদ্বাণীর প্রতি সন্দেহ প্রকাশ করেন। তখন ডাইনিরা তাকে জানান যে ব্যাঙ্কো নিজে রাজা না হলেও রাজবংশের জনক হবেন। ভবিষ্যদ্বাণীগুলো শুনিয়ে ডাইনিরা অদৃশ্য হয়ে যায়। ডাইনিরা অদৃশ্য হওয়ার পরপর “রস” নামে অপর এক আমাত্য দূত হয়ে ম্যাকবেথের কাছে বার্তা নিয়ে আসেন। তিনি জানান ম্যাকবেথকে “থেন অফ কডর” উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছে। এইভাবে প্রথম ভবিষ্যদ্বাণীটি ফলে যায় এবং ম্যাকবেথের মনের ভেতরে রাজা হওয়ার প্রবল বাসনা নোংরাভাবে জেগে ওঠে।

নাটকটিতে ম্যাকবেথের থেকেও লেডি ম্যাকবেথের লোভ লালসা, উচ্চাকাক্সক্ষার মাত্রা প্রবলতর বলে মনে হয়। বিদ্রোহ দমনের পুরস্কার হিসেবে ম্যাকবেথকে বিশেষ সম্মান প্রদর্শন করতে চাইলেন রাজা ডানকান। প্রথা অনুযায়ী তিনি ম্যাকবেথের দুর্গে অবস্থান করে সে সম্মান প্রদর্শনের ঘোষণা দেন। রাজা ডানকানের দুর্গে আসার সংবাদ প্রাপ্তির পরপরই ক্ষমতা লাভের সমস্ত ছক প্রস্তুত করেন লেডি ম্যাকবেথ। তিনি সিদ্ধান্ত নেন প্রথম রাতেই রাজা ডানকানকে দুর্গে হত্যা করতে হবে। বিদ্রোহ দমনে ম্যাকবেথের ভূমিকার কারণে রাজার প্রতি ম্যাকবেথের যে আনুগত্য প্রকাশিত হয়েছে, সে কারণে হত্যাকাণ্ডের পর ম্যাকবেথের প্রতি কেউ অঙ্গুলি নির্দেশ করতে পারবে না বলে তার মনে হয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী অতিথি রাজা ডানকান, যিনি ম্যাকবেথকে সম্মানিত করতে তার দুর্গে এসেছিলেন তাকে নিষ্ঠুরভাবে প্রথম রাতেই হত্যা করা হয়।

এ হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে কিছু মানসিক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া আমরা নাটকটিতে দেখতে পাই। ঘুমে অচেতন, রাজার কক্ষে পা টিপে টিপে ছুরি হাতে এগোতেই নিজের মৃত বাবার কথা মনে পড়ে যায় লেডি ম্যাকবেথের। মানসিক শক্তি হারিয়ে পিছিয়ে আসেন তিনি। ছুরিটা ধরিয়ে দেন অপেক্ষমাণ স্বামীর হাতে । ‘যাও,’ ‘রাজাকে খুন করে এসো, এভাবে রাজাকে হত্যা করার নির্দেশ দেন স্বামীকে। হত্যা করতে গিয়ে নিজের পিতার মুখের কথা মনে পড়ে যাওয়া, মানবিক দুর্বলতা এগুলো দেখে আমরা কিছুটা চমকে উঠি। ম্যাকবেথ তুলনামূলকভাবে কোমল চরিত্রের মানুষ হিসেবে উপস্থাপিত হন। তাই এ হত্যাকাণ্ডের জন্য লেডি ম্যাকবেথকে তাকে নানাভাবে প্ররোচিত করতে হয়। রাজা ডানকানকে নিজ হস্তে হত্যার পর ম্যাকবেথের মধ্যে কিছুটা অনুতাপ, কিছুটা বিভ্রমেরও প্রকাশ ঘটে। হত্যা করে ক্ষমতারোহননের কাজটি চরম অনৈতিকভাবে সংঘটিত হলেও পরিকল্পনা ও হত্যাকাণ্ডের সময় ও পরে আমরা অনেক মানবিক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করি সেনাপতি ম্যাকবেথ এবং লেডি ম্যাকবেথের আচরণের মধ্যে।

আমরা যদি বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে সঙ্গে রাজা ডানকানের হত্যাকাণ্ডের একটু তুলনামুলক বিশ্লেষণ করি তাহলে দেখতে পাবো বঙ্গবন্ধুকেও কিন্তু তার অনুগত সেনারা হত্যা করে। সব হত্যাকাণ্ডের পেছনে ছিলেন খন্দকার মোশতাক। মোশতাক, লেডি ম্যাকবেথের মতো হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশগ্রহণ করেননি কিন্তু প্ররোচনায় যুক্ত ছিলেন মুক্তিযুদ্ধকালীন সময় থেকে। লেডি ম্যাকবেথ তার কৃত্রিম আন্তরিকতা ও আতিথেয়তার মাধ্যমে রাজাকে মোহিত করেন। হত্যাকাণ্ডের কিছু সময় পূর্বেও তার আতিথেয়তা অব্যাহত ছিল। খন্দকার মোশতাককে ও হত্যাকাণ্ডের পূর্বে নানরকমে বিশ্বস্ততার ভান করতে দেখা যায়। ম্যাকবেথ যেমন বিশ্বস্ত ছিলেন রাজা ডানকানের বঙ্গবন্ধুর খুনি মোশতাকও একইভাবে বিশ্বস্ততা অর্জন করেছিলেন। ম্যাকবেথের পেছনে আর কোন জেনারেল ছিলেন না কিন্তু খন্দকার মোশতাকের পেছনে মাস্টারমাইন্ড হিসাবে জেনারেল কাজ করেছিলেন, এই একটি পার্থক্য শুধু লক্ষ্য করা যায়। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করতে একটির পর আর একটি হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হতে দেখতে পাই। ম্যাকবেথকেও ক্ষমতাকে সংহত করতে অনেকগুলো হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করতে দেখা যায়।

ম্যাকবেথ নাটকের প্রথম মঞ্চায়নের সময় ধরে গণনা শুরু করলে আমরা প্রায় চারশ’ বছরেরো ওপর সময় অতিক্রম করেছি। এ সময়ে আমরা সমস্ত পৃথিবীতে অসংখ্য নিষ্ঠুর ক্ষমতার দ্বন্দ্ব দেখতে পেয়েছি। ক্ষমতা লাভের জন্য ষড়যন্ত্র, হত্যা, গুপ্ত হত্যার মতো কতো নিষ্ঠুরতা আমাদের দেখতে হয়েছে। এই নিষ্ঠুরতা সপ্তদশ শতাব্দীর নিষ্ঠুরতাকে অতিক্রম করতে সক্ষম হয়েছে। ম্যাকবেথ নাটকে রাজা ডানকানের দুই পুত্র যারা তার সঙ্গে দুর্গে অবস্থান করেছিলেন তাদের হত্যা করার কোন পরিকল্পনা ছিল না এবং তাদের হত্যা করা হয়নি। বঙ্গবন্ধু পরিবারের প্রতিটি সদস্য এমনকি বৃহত্তর পরিবারের সদস্য যারা সেদিন ঢাকায় অবস্থান করছিলেন তাদের সবাইকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়। ম্যাকবেথ নাটকে রাজা ডানকানকে হত্যার পর হত্যার দায়িত্ব প্রহরীদের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল অর্থাৎ হত্যাকারী ম্যাকবেথ নিজে খুনের দায় নিতে চাননি। বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীরা হত্যাযজ্ঞ শেষে রীতিমতো বেতারে ঘোষণা দিয়েছে নির্লজ্জভাবে। নারকীয় ঘটনার সফল সমাপ্তির পর উল্লাস প্রকাশ করেছে খুনিরা। হত্যাকাণ্ডের সুবিধাভোগীরা তাদের সূর্যসন্তান বলেও অভিহিত করেছে।

এই যে প্রথমে বলেছিলাম, সপ্তদশ শতাব্দীর মানুষের মানবিক গুণাবলি আমাদের গত শতক কিংবা বহমান শতকের থেকে উচ্চতর ছিল। রাজা ডানকানকে হত্যা করার সময়, পূর্বে এবং পরে উল্লেখিত মানবিক প্রতিক্রিয়া আমাদের এ কথাটির পক্ষে জোরালো সাক্ষী প্রদান করে। হত্যাকাণ্ডের পর রক্তমাখা হাত দেখে অনুতাপে ভোগা ম্যাকবেথের স্বগতোক্তি আমাদের তার মানবিক শক্তি জেগে উঠার ইঙ্গিত প্রদান করে। রক্ত মাখা হাতের দিকে তাকিয়ে ম্যাকবেথের স্বগতোক্তি, ‘সমুদ্রের সব পানি দিয়ে ধুলেও কি এ দাগ যাবে?’ দাগ বলতে শেক্সপিয়র পাপ বা অনৈতিক কাজের কথা বুঝিয়েছিলেন।

ম্যাকবেথ নাটকের মাধ্যমে মহান নাট্যকার ও কবি শেক্সপিয়র একটি সময়ের রাজনৈতিক ক্ষমতার দ্বন্দ্বকে তুলে ধরেছেন। আমরা সে সময়ে লক্ষ্য অর্জনের জন্য যে উপায় অবলম্বন করতে দেখি তার মধ্যে নিষ্ঠুরতা যেমন দেখতে পাই একইভাবে মানবিক গুণের জাগ্রত হওয়ার সম্ভাবনাকেও লক্ষ্য করি। বঙ্গবন্ধু কোন নাটকের চরিত্র নন তিনি বাংলাদেশের ইতিহাসের রাখাল রাজা। তার নেতৃত্ব, সততা, নিবেদন, জনগণের জন্য ভালোবাসা ছিল প্রশ্নাতীত, তাকে দৃশ্যপট থেকে সরিয়ে দেয়ার জন্য যে পন্থা অবলম্বল করা হয় তা নিঃসন্দেহে সতেরশ শতাব্দীর পন্থা থেকে নির্মমমতর। যে কথা শুরুতে বলেছিলাম, ম্যাকবেথ নাটকের কাহিনী যদি একটি সময়কে প্রতিনিধিত্ব করে তাহলে আমাদের বলতে হয়, আমরা জ্ঞানে, বিজ্ঞানে অনেকদূর এগিয়ে গেলেও মানবিক গুণের উৎকর্ষতা অর্জনে অনেক পিছিয়ে আছি। এ কথাটি যতটুকু সত্য সারা পৃথিবীর জন্য একই মাত্রায় সত্য বাংলাদেশের জন্যও।

[লেখক : উন্নয়ন গবেষক]

বৃহস্পতিবার, ১৪ অক্টোবর ২০২১ , ২৯ আশ্বিন ১৪২৮ ০৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৩

‘ম্যাকবেথ’-এর আলোকে বঙ্গবন্ধু ও রাজা ডানকান হত্যাকাণ্ডের প্রেক্ষাপট ও নিষ্ঠুরতা

শেখর ভট্টাচার্য

ম্যাকবেথ নাটকটি প্রথমবার পড়তে হয়েছে পাঠ্যবই হিসেবে। পরবর্তীতে নাটকটির কাহিনীতে ঘটে যাওয়া ঈর্ষা, দ্বেষ, ক্ষমতা লিপ্সার নিগুঢ় অর্থ অনুসন্ধানের জন্য বার বার পড়তে হয়েছে। মহৎ কবি, লেখক, নাট্যকার দার্শনিকরা ত্রিকালদর্শী হন। তাদের সৃষ্টিকর্ম তাই যুগোত্তীর্ণ, কালোত্তীর্ণ হয়ে ওঠে। ম্যাকবেথ কেনো পড়ি বার বার? এর প্রথম জবাব আমার কাছে, সেটি হলো মুগ্ধতা। শুধু মুগ্ধতা? মুগ্ধতার সঙ্গে একধরনের বিস্ময়ও আছে। এবার যদি “কারণের কারণ” জানতে নিজেকে প্রশ্ন করি, বিস্ময় কেন? এর সরাসরি উত্তর হলো মহৎ নাটক হিসাবে এর চিরন্তন আবেদন আমাকে বিস্মিত করে। শেক্সপিয়রের যে নাটকটি ১৬০৬ সালে প্রথম মঞ্চায়ন হয়েছিল বলে অনুমান করা হয়, সে নাটকটি পৃথিবীর ম্যাজিকেল পরিবর্তনের পরও কত প্রাসঙ্গিক একথা ভেবে বিস্মিত না হয়ে পারিনা। শেক্সপিয়রের প্রতি শ্রদ্ধায় মস্তক অবনত হয়ে পড়ে। সতেরশ শতাব্দীতে “ক্ষমতা-কেন্দ্র”কে ঘিরে থাকা মানুষের লিপ্সা, উচ্চাকাক্সক্ষা, ঈর্ষা, নিষ্ঠুরতার সঙ্গে এগিয়ে যাওয়া “সুসভ্য” পৃথিবীর মানুষের মধ্যে কোন তফাৎ খুঁজে পাই না, এগিয়ে যাওয়া সমাজ নিয়ে বিভ্রম তৈরি হয়। জ্ঞান, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে অভাবনীয় অর্জনের সঙ্গে মানবিক গুণাবলিতে সমৃদ্ধ হওয়ার সম্পর্ক খুঁজে হতাশ হই। সামগ্রিকভাবে এগিয়ে যাওয়ার সমীকরণ মেলাতে হিমশিম খেতে হয়।

ম্যাকবেথের কাহিনীতে ক্ষমতা লাভের জন্য যে জটিল ও নিষ্ঠুর দ্বন্দ্বের উপস্থিতি দেখতে পাওয়া যায়, সমসাময়িককালে পৃথিবীতে সে দ্বন্দ্ব আরও জটিল আরও নির্দয় রূপ গ্রহণ করেছে বলে মনে হয়। সতেরশ’ শতাব্দীতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যে উন্নয়ন ছিল, তার সঙ্গে গত শতাব্দী কিংবা বহমান শতাব্দীর একই ক্ষেত্রে উন্নয়নের তুলনা করলে দেখা যেবে যোজন যোজন পথ এগিয়েছে মানুষ। একইভাবে দর্শন, শিল্প, সাহিত্য, রাজনীতিতে মানুষের অগ্রগতিকে অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। যে বিষয়টি ভাবলে ধাঁ ধাঁ’র মতো মনে হয় সেটি হলো, জ্ঞান বিজ্ঞানের উন্নতির সঙ্গে মানুষের মনুষ্যত্বের বিকাশ কি সমান্তরালভাবে এগিয়েছে? বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে মানুষ দৃশ্যমানভাবে এগিয়েছে। অদৃশ্য মানবিক গুণাবলির তাৎপর্যপূর্ণ উন্নতি কতোটুকু? অর্থ, বিত্ত, ক্ষমতা অর্জনের জন্য নিষ্ঠুর, অনৈতিক, অমানবিক পথ অবলম্বন, সতেরশ’ শতাব্দীর থেকে যে আরও প্রকট হয়েছে ম্যাকবেথ নাটকটি পড়লে আমরা তা অনুভব করতে পারি। মহান কবি ও নাট্যকার শেক্সপিয়র, ক্ষমতা লাভের জন্য মানুষের নিষ্ঠুরতা, অকৃতজ্ঞতা, অমানবিকতাকে কল্পনায় যতোটুকু দেখেছেন, বর্তমান শতাব্দীতে আমরা তার কল্পনার সীমাকে অতিক্রম করেছি। ম্যাকবেথ নাটকের ভেতর ঘটে যাওয়া নিষ্ঠুরতা, অমানবিকতার সঙ্গে গত কয়েকশ’ শতাব্দীতে ঘটে যাওয়া হিংস্রতার তুলনা করলে দেখা যাবে মানবিকতার বিকাশের সূচকে আমরা সতেরশ’ শতাব্দী থেকে পিছিয়ে পড়েছি। আমাদের পরবর্তী আলোচনায় এ বিষয়টিকে আরও স্পষ্ট হবে বলে আশা করছি।

“ম্যাকবেথ” নাটকের সেনাপতি ম্যাকবেথ স্কটল্যান্ডের রাজা ডানকানের পরম বিশ্বস্ত সেনাপতি ছিলেন। এই বিশ্বস্ততার কারনেই রাজা ডানকান, “কডরের আমাত্য” ম্যাকডোনাল্ডের বিদ্রোহ দমনের জন্য তাকে দায়িত্ব প্রদান করেন। ম্যাকডোনাল্ডের বিদ্রোহ ঘোষণার সুযোগ নিয়ে নরওয়ের সেনাবাহিনীও বিদ্রোহ করে বসে। এ রকম বিপদাপন্ন অবস্থায় বিদ্রোহ দমনের জন্য ম্যাকবেথ ও তার সমমর্যাদার সহকর্মী জেনারেল ব্যাঙ্কোসহ বেশ কয়েকজন সেনাপতি দুঃসময়ে রাজার পাশে এসে দাঁড়ান। ম্যাকবেথ থেন অভ গ্ল্যামিস, দক্ষ সাহসী যোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃত। স্কটল্যান্ডের রাজা ডানকান, অভিজাতশ্রেণীর লোকজন এবং সাধারণ মানুষের অতি প্রিয়পাত্র ছিলেন ম্যাকবেথ। রাজা ডানকানের আরোপিত দায়িত্ব সেনাপতি ম্যাকবেথ দক্ষতা ও বীরত্বের সঙ্গে পালন করেন। সেনাপতি ম্যাকবেথ অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে বিদ্রোহ দমন করে স্কটল্যান্ডকে বিপদ মুক্ত করেন। বিদ্রোহ দমনের পর “অদৃষ্ট” ম্যাকবেথ এবং লেডি ম্যাকবেথের অবচেতন মনে লুকিয়ে থাকা লোভ , লালসা ও উচ্চাকাক্সক্ষার পরীক্ষা নিতে শুরু করেন।

ম্যাকবেথ ও তার সহকর্মী ব্যাঙ্কো যখন ফিরে আসছিলেন জন্মভূমি স্কটল্যান্ডে তখন এক ঊষর প্রান্তরে তাদের সঙ্গে দেখা হয় তিন ডাইনীর। তিন জন ডাইনি ম্যাকবেথ ও ব্যাঙ্কোকে অভিবাদন জানিয়ে তিনটি ভবিষ্যৎবাণী উচ্চারণ করেন। ব্যাঙ্কো তাদের প্রতি সন্দেহ প্রকাশ করলে তারা ম্যাকবেথকে অভিবাদন জানান। তিনটি ভবিষ্যদ্বাণীর সর্বশেষটি ছিল ম্যাকবেথ স্কটল্যান্ডের রাজা হবেন নিকট ভবিষ্যতে। এ ছাড়াও তাকে অচিরেই কডরের আমাত্য বা থেন হিসাবে নিয়োগ দেয়া হবে অচিরেই। তবে ম্যাকবেথের সহকর্মী ব্যাঙ্কো ডাইনিদের ভবিষ্যদ্বাণীর প্রতি সন্দেহ প্রকাশ করেন। তখন ডাইনিরা তাকে জানান যে ব্যাঙ্কো নিজে রাজা না হলেও রাজবংশের জনক হবেন। ভবিষ্যদ্বাণীগুলো শুনিয়ে ডাইনিরা অদৃশ্য হয়ে যায়। ডাইনিরা অদৃশ্য হওয়ার পরপর “রস” নামে অপর এক আমাত্য দূত হয়ে ম্যাকবেথের কাছে বার্তা নিয়ে আসেন। তিনি জানান ম্যাকবেথকে “থেন অফ কডর” উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছে। এইভাবে প্রথম ভবিষ্যদ্বাণীটি ফলে যায় এবং ম্যাকবেথের মনের ভেতরে রাজা হওয়ার প্রবল বাসনা নোংরাভাবে জেগে ওঠে।

নাটকটিতে ম্যাকবেথের থেকেও লেডি ম্যাকবেথের লোভ লালসা, উচ্চাকাক্সক্ষার মাত্রা প্রবলতর বলে মনে হয়। বিদ্রোহ দমনের পুরস্কার হিসেবে ম্যাকবেথকে বিশেষ সম্মান প্রদর্শন করতে চাইলেন রাজা ডানকান। প্রথা অনুযায়ী তিনি ম্যাকবেথের দুর্গে অবস্থান করে সে সম্মান প্রদর্শনের ঘোষণা দেন। রাজা ডানকানের দুর্গে আসার সংবাদ প্রাপ্তির পরপরই ক্ষমতা লাভের সমস্ত ছক প্রস্তুত করেন লেডি ম্যাকবেথ। তিনি সিদ্ধান্ত নেন প্রথম রাতেই রাজা ডানকানকে দুর্গে হত্যা করতে হবে। বিদ্রোহ দমনে ম্যাকবেথের ভূমিকার কারণে রাজার প্রতি ম্যাকবেথের যে আনুগত্য প্রকাশিত হয়েছে, সে কারণে হত্যাকাণ্ডের পর ম্যাকবেথের প্রতি কেউ অঙ্গুলি নির্দেশ করতে পারবে না বলে তার মনে হয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী অতিথি রাজা ডানকান, যিনি ম্যাকবেথকে সম্মানিত করতে তার দুর্গে এসেছিলেন তাকে নিষ্ঠুরভাবে প্রথম রাতেই হত্যা করা হয়।

এ হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে কিছু মানসিক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া আমরা নাটকটিতে দেখতে পাই। ঘুমে অচেতন, রাজার কক্ষে পা টিপে টিপে ছুরি হাতে এগোতেই নিজের মৃত বাবার কথা মনে পড়ে যায় লেডি ম্যাকবেথের। মানসিক শক্তি হারিয়ে পিছিয়ে আসেন তিনি। ছুরিটা ধরিয়ে দেন অপেক্ষমাণ স্বামীর হাতে । ‘যাও,’ ‘রাজাকে খুন করে এসো, এভাবে রাজাকে হত্যা করার নির্দেশ দেন স্বামীকে। হত্যা করতে গিয়ে নিজের পিতার মুখের কথা মনে পড়ে যাওয়া, মানবিক দুর্বলতা এগুলো দেখে আমরা কিছুটা চমকে উঠি। ম্যাকবেথ তুলনামূলকভাবে কোমল চরিত্রের মানুষ হিসেবে উপস্থাপিত হন। তাই এ হত্যাকাণ্ডের জন্য লেডি ম্যাকবেথকে তাকে নানাভাবে প্ররোচিত করতে হয়। রাজা ডানকানকে নিজ হস্তে হত্যার পর ম্যাকবেথের মধ্যে কিছুটা অনুতাপ, কিছুটা বিভ্রমেরও প্রকাশ ঘটে। হত্যা করে ক্ষমতারোহননের কাজটি চরম অনৈতিকভাবে সংঘটিত হলেও পরিকল্পনা ও হত্যাকাণ্ডের সময় ও পরে আমরা অনেক মানবিক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করি সেনাপতি ম্যাকবেথ এবং লেডি ম্যাকবেথের আচরণের মধ্যে।

আমরা যদি বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে সঙ্গে রাজা ডানকানের হত্যাকাণ্ডের একটু তুলনামুলক বিশ্লেষণ করি তাহলে দেখতে পাবো বঙ্গবন্ধুকেও কিন্তু তার অনুগত সেনারা হত্যা করে। সব হত্যাকাণ্ডের পেছনে ছিলেন খন্দকার মোশতাক। মোশতাক, লেডি ম্যাকবেথের মতো হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশগ্রহণ করেননি কিন্তু প্ররোচনায় যুক্ত ছিলেন মুক্তিযুদ্ধকালীন সময় থেকে। লেডি ম্যাকবেথ তার কৃত্রিম আন্তরিকতা ও আতিথেয়তার মাধ্যমে রাজাকে মোহিত করেন। হত্যাকাণ্ডের কিছু সময় পূর্বেও তার আতিথেয়তা অব্যাহত ছিল। খন্দকার মোশতাককে ও হত্যাকাণ্ডের পূর্বে নানরকমে বিশ্বস্ততার ভান করতে দেখা যায়। ম্যাকবেথ যেমন বিশ্বস্ত ছিলেন রাজা ডানকানের বঙ্গবন্ধুর খুনি মোশতাকও একইভাবে বিশ্বস্ততা অর্জন করেছিলেন। ম্যাকবেথের পেছনে আর কোন জেনারেল ছিলেন না কিন্তু খন্দকার মোশতাকের পেছনে মাস্টারমাইন্ড হিসাবে জেনারেল কাজ করেছিলেন, এই একটি পার্থক্য শুধু লক্ষ্য করা যায়। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করতে একটির পর আর একটি হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হতে দেখতে পাই। ম্যাকবেথকেও ক্ষমতাকে সংহত করতে অনেকগুলো হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করতে দেখা যায়।

ম্যাকবেথ নাটকের প্রথম মঞ্চায়নের সময় ধরে গণনা শুরু করলে আমরা প্রায় চারশ’ বছরেরো ওপর সময় অতিক্রম করেছি। এ সময়ে আমরা সমস্ত পৃথিবীতে অসংখ্য নিষ্ঠুর ক্ষমতার দ্বন্দ্ব দেখতে পেয়েছি। ক্ষমতা লাভের জন্য ষড়যন্ত্র, হত্যা, গুপ্ত হত্যার মতো কতো নিষ্ঠুরতা আমাদের দেখতে হয়েছে। এই নিষ্ঠুরতা সপ্তদশ শতাব্দীর নিষ্ঠুরতাকে অতিক্রম করতে সক্ষম হয়েছে। ম্যাকবেথ নাটকে রাজা ডানকানের দুই পুত্র যারা তার সঙ্গে দুর্গে অবস্থান করেছিলেন তাদের হত্যা করার কোন পরিকল্পনা ছিল না এবং তাদের হত্যা করা হয়নি। বঙ্গবন্ধু পরিবারের প্রতিটি সদস্য এমনকি বৃহত্তর পরিবারের সদস্য যারা সেদিন ঢাকায় অবস্থান করছিলেন তাদের সবাইকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়। ম্যাকবেথ নাটকে রাজা ডানকানকে হত্যার পর হত্যার দায়িত্ব প্রহরীদের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল অর্থাৎ হত্যাকারী ম্যাকবেথ নিজে খুনের দায় নিতে চাননি। বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীরা হত্যাযজ্ঞ শেষে রীতিমতো বেতারে ঘোষণা দিয়েছে নির্লজ্জভাবে। নারকীয় ঘটনার সফল সমাপ্তির পর উল্লাস প্রকাশ করেছে খুনিরা। হত্যাকাণ্ডের সুবিধাভোগীরা তাদের সূর্যসন্তান বলেও অভিহিত করেছে।

এই যে প্রথমে বলেছিলাম, সপ্তদশ শতাব্দীর মানুষের মানবিক গুণাবলি আমাদের গত শতক কিংবা বহমান শতকের থেকে উচ্চতর ছিল। রাজা ডানকানকে হত্যা করার সময়, পূর্বে এবং পরে উল্লেখিত মানবিক প্রতিক্রিয়া আমাদের এ কথাটির পক্ষে জোরালো সাক্ষী প্রদান করে। হত্যাকাণ্ডের পর রক্তমাখা হাত দেখে অনুতাপে ভোগা ম্যাকবেথের স্বগতোক্তি আমাদের তার মানবিক শক্তি জেগে উঠার ইঙ্গিত প্রদান করে। রক্ত মাখা হাতের দিকে তাকিয়ে ম্যাকবেথের স্বগতোক্তি, ‘সমুদ্রের সব পানি দিয়ে ধুলেও কি এ দাগ যাবে?’ দাগ বলতে শেক্সপিয়র পাপ বা অনৈতিক কাজের কথা বুঝিয়েছিলেন।

ম্যাকবেথ নাটকের মাধ্যমে মহান নাট্যকার ও কবি শেক্সপিয়র একটি সময়ের রাজনৈতিক ক্ষমতার দ্বন্দ্বকে তুলে ধরেছেন। আমরা সে সময়ে লক্ষ্য অর্জনের জন্য যে উপায় অবলম্বন করতে দেখি তার মধ্যে নিষ্ঠুরতা যেমন দেখতে পাই একইভাবে মানবিক গুণের জাগ্রত হওয়ার সম্ভাবনাকেও লক্ষ্য করি। বঙ্গবন্ধু কোন নাটকের চরিত্র নন তিনি বাংলাদেশের ইতিহাসের রাখাল রাজা। তার নেতৃত্ব, সততা, নিবেদন, জনগণের জন্য ভালোবাসা ছিল প্রশ্নাতীত, তাকে দৃশ্যপট থেকে সরিয়ে দেয়ার জন্য যে পন্থা অবলম্বল করা হয় তা নিঃসন্দেহে সতেরশ শতাব্দীর পন্থা থেকে নির্মমমতর। যে কথা শুরুতে বলেছিলাম, ম্যাকবেথ নাটকের কাহিনী যদি একটি সময়কে প্রতিনিধিত্ব করে তাহলে আমাদের বলতে হয়, আমরা জ্ঞানে, বিজ্ঞানে অনেকদূর এগিয়ে গেলেও মানবিক গুণের উৎকর্ষতা অর্জনে অনেক পিছিয়ে আছি। এ কথাটি যতটুকু সত্য সারা পৃথিবীর জন্য একই মাত্রায় সত্য বাংলাদেশের জন্যও।

[লেখক : উন্নয়ন গবেষক]