দুর্গতিনাশিনী দেবী ফিরলেন দেবালয়ে

‘বিদায় দেবার আগে মা তোর/গাল দু’খানি ছুঁই/ আসছে বছর এই শরতে/আবার আসিস তুই।’ দেবী দুর্গার বিদায় বেলায় ভক্তমনের আকূল আকুতিই যেন ফুটে উঠেছিল এই পঙিতে। প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের পাঁচ দিনব্যাপী সর্ববৃহৎ ধর্মীয় উৎসব ‘শারদীয় দুর্গাপূজা’ শেষ হলো।

চণ্ডীপাঠ, বোধন এবং দেবীর অধিবাসের মধ্য দিয়ে ১১ অক্টোবর থেকে শুরু হয় বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা। এরপর হাসি-আনন্দ আর পূজা-অর্চনার মধ্য দিয়ে কেটে গেছে চার দিন। সপ্তমীতে চক্ষুদানের মাধ্যমে প্রতিমায় যে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল, গতকাল সকালে দর্পণ বিসর্জনের মধ্য দিয়ে বিদায় জানানো হয় দেবী দুর্গাকে। মর্ত্য ছেড়ে কৈলাসে স্বামীগৃহে ফিরে যাবেন দেবী দুর্গা। পেছনে ফেলে যাবেন ভক্তদের চারদিনের আনন্দ-উল্লাস আর বিজয়ার দিনের অশ্রু। প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে শেষ হয় সনাতন ধর্মাবলম্বীদের প্রধান ধর্মীয় এই উৎসব।

গতকাল বিকেল ৪টা থেকে শুরু হয় প্রতিমা বিসর্জন। করোনার প্রাদুর্ভাব কমলেও এবারও বিজয়া দশমীতে শোভযাত্রা হয়নি।

দেবী মাকে বিসর্জন শেষে বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক নির্মল কুমার চ্যাটার্জী বলেন, ‘আমরা অশুভকে বিসর্জন দিলাম। মা ফিরে গেছেন। আমরা সব শুভকে গ্রহণ করেছি। সব অমঙ্গল দূর হোক এটাই প্রত্যাশা। এ বছর সারাদেশে ৩২ হাজার ১১৮টি মণ্ডপে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়েছে আর ঢাকা মহানগরে এ বছর ২৩৮টি পূজা হয়। গতবারের চেয়ে এবার চারটি পূজামণ্ডপ বেশি হয়েছে বলেও জানান তিনি।

আনন্দ আর বেদনার মিশ্রণে মাকে বিসর্জনের সময় আবেগী হয়ে যায় দেবীর ভক্তরা। মাকে বিসর্জন দিতে মণ্ডপে মণ্ডপে জড়ো হয়েছিলেন অনেকেই। গতবারের মতো এবারও শোভাযাত্রা না হওয়ায় এবং সীমিত পরিসরে সব আয়োজন করায় আনন্দ কিছুটা ফিকে হয়ে গেছে বলে জানান রাজধানীর ফার্মগেটের মণ্ডপে আসা জয়া প্রসাদ। স্বামী স্বপন প্রসাদের সঙ্গে জয়া প্রসাদ প্রতিমা বিসর্জন দিতে যাওয়ার সময় আরও বলেন, আমাদের বিশ্বাস প্রতিবছর মা পৃথিবীতে আসেন সব অশুভ শক্তিকে বিনাশ করতে। বিনাশ করে তিনি আবার মর্তে চলে যান। এবারও তিনি তাই করবেন। মাকে বিসর্জনের মধ্য দিয়ে আমরাও নিজেদের অশুভ শক্তিকে বিসর্জন দেই। এ সময় কথা হয় আজিমপুরের বাসিন্দা তুলসি সাহার সঙ্গে। তিনি বলেন, একদিকে করোনা মহামারী নিয়ে আমরা অস্বস্তিতে ছিলাম। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে কুমিল্লাসহ বিভিন্ন স্থানে দেবী ভাঙচুর, মারামারির ঘটনা। এতে আমরা কিছুটা আতঙ্কিত আছি।’ মাকে বিসর্জন দিতে তাই একাই যাবেন জানিয়ে তিনি বলেন ‘শেষ বেলায় ভালোভাবে মাকে বিসর্জন দিতে পারলাম না। এই দুঃখটাই কষ্ট দিচ্ছে। মা নিশ্চয় বুঝবেন।’

এদিকে দেবী মাকে বিসর্জনের আগে বিবাহিত নারীদের সিঁদুর খেলার মধ্য দিয়ে হয় ‘দেবীবরণ’। দুর্গাপূজায় সবশেষ রীতিটি হচ্ছে ‘দেবীবরণ’। রীতি অনুযায়ী, সধবা নারীরা স্বামীর মঙ্গল কামনায় দশমীর দিন সিঁদুর, পান ও মিষ্টি নিয়ে দুর্গা মাকে সিঁদুর ছোঁয়ান। দেবীর পায়ে সিঁদুর ছোঁয়ানোর পর সেই সিঁদুর প্রথমে নিজ সিঁথিতে মাখান, পরে একে-অন্যের সিঁথি ও মুখে মাখেন। মুখ রঙিন করে হাসিমুখে মাকে বিদায় জানানোর জন্যই এই সিঁদুর খেলা। ভক্তদের বিশ্বাস, দুর্গা আগামী বছর আবারও সঙ্গে করে শাঁখা-সিঁদুর নিয়ে আসবেন। সেই শাঁখা-সিঁদুরেই স্বামীর মঙ্গল হবে।

দেবী দুর্গা এবার মর্ত্যলোকে এসেছিলেন ঘোটকে বা ঘোড়ায় চড়ে। এর ফল হচ্ছে ছত্রভঙ্গ। আর দেবী সপরিবারে স্বর্গালোকে বিদায় নেবেন দোলায় বা পালকি চড়ে, যার ফল হচ্ছে মড়ক। দেবীর আসা ও যাওয়ার লক্ষণ শুভ না হলেও ভক্তের বিশ্বাস, দেবী মঙ্গলময়ী। তিনি জগতের মঙ্গলই করবেন। সন্তানদের আশীষ দেবেন দু’হাত ভরে।

পুরাণ মতে, রাজা সুরথ প্রথম দেবী দুর্গার আরাধনা শুরু করেন। বসন্তে তিনি পূজার আয়োজন করায় দেবীর এ পূজাকে বাসন্তী পূজা বলা হয়। কিন্তু রাবণের হাত থেকে সীতাকে উদ্ধার করতে লঙ্কা যাত্রার আগে শ্রী রামচন্দ্র দেবীর পূজার আয়োজন করেছিলেন শরৎকালের অমাবস্যা তিথিতে, যা শারদীয় দুর্গোৎসব নামে পরিচিত। দেবীর শরৎকালের পূজাকে এ জন্যই হিন্দুমতে অকাল বোধনও বলা হয়।

বিজয়া দশমী উপলক্ষে বাংলাদেশ বেতার, বাংলাদেশ টেলিভিশনসহ অন্যান্য বেসরকারি টিভি চ্যানেল ও রেডিও স্টেশন বিশেষ অনুষ্ঠানমালা সম্প্রচার করেছে। আর জাতীয় দৈনিকগুলোও রেখেছিল বিশেষ আয়োজন।

শনিবার, ১৬ অক্টোবর ২০২১ , ৩১ আশ্বিন ১৪২৮ ০৮ রবিউল আউয়াল ১৪৪৩

দুর্গতিনাশিনী দেবী ফিরলেন দেবালয়ে

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক

‘বিদায় দেবার আগে মা তোর/গাল দু’খানি ছুঁই/ আসছে বছর এই শরতে/আবার আসিস তুই।’ দেবী দুর্গার বিদায় বেলায় ভক্তমনের আকূল আকুতিই যেন ফুটে উঠেছিল এই পঙিতে। প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের পাঁচ দিনব্যাপী সর্ববৃহৎ ধর্মীয় উৎসব ‘শারদীয় দুর্গাপূজা’ শেষ হলো।

চণ্ডীপাঠ, বোধন এবং দেবীর অধিবাসের মধ্য দিয়ে ১১ অক্টোবর থেকে শুরু হয় বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা। এরপর হাসি-আনন্দ আর পূজা-অর্চনার মধ্য দিয়ে কেটে গেছে চার দিন। সপ্তমীতে চক্ষুদানের মাধ্যমে প্রতিমায় যে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল, গতকাল সকালে দর্পণ বিসর্জনের মধ্য দিয়ে বিদায় জানানো হয় দেবী দুর্গাকে। মর্ত্য ছেড়ে কৈলাসে স্বামীগৃহে ফিরে যাবেন দেবী দুর্গা। পেছনে ফেলে যাবেন ভক্তদের চারদিনের আনন্দ-উল্লাস আর বিজয়ার দিনের অশ্রু। প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে শেষ হয় সনাতন ধর্মাবলম্বীদের প্রধান ধর্মীয় এই উৎসব।

গতকাল বিকেল ৪টা থেকে শুরু হয় প্রতিমা বিসর্জন। করোনার প্রাদুর্ভাব কমলেও এবারও বিজয়া দশমীতে শোভযাত্রা হয়নি।

দেবী মাকে বিসর্জন শেষে বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক নির্মল কুমার চ্যাটার্জী বলেন, ‘আমরা অশুভকে বিসর্জন দিলাম। মা ফিরে গেছেন। আমরা সব শুভকে গ্রহণ করেছি। সব অমঙ্গল দূর হোক এটাই প্রত্যাশা। এ বছর সারাদেশে ৩২ হাজার ১১৮টি মণ্ডপে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়েছে আর ঢাকা মহানগরে এ বছর ২৩৮টি পূজা হয়। গতবারের চেয়ে এবার চারটি পূজামণ্ডপ বেশি হয়েছে বলেও জানান তিনি।

আনন্দ আর বেদনার মিশ্রণে মাকে বিসর্জনের সময় আবেগী হয়ে যায় দেবীর ভক্তরা। মাকে বিসর্জন দিতে মণ্ডপে মণ্ডপে জড়ো হয়েছিলেন অনেকেই। গতবারের মতো এবারও শোভাযাত্রা না হওয়ায় এবং সীমিত পরিসরে সব আয়োজন করায় আনন্দ কিছুটা ফিকে হয়ে গেছে বলে জানান রাজধানীর ফার্মগেটের মণ্ডপে আসা জয়া প্রসাদ। স্বামী স্বপন প্রসাদের সঙ্গে জয়া প্রসাদ প্রতিমা বিসর্জন দিতে যাওয়ার সময় আরও বলেন, আমাদের বিশ্বাস প্রতিবছর মা পৃথিবীতে আসেন সব অশুভ শক্তিকে বিনাশ করতে। বিনাশ করে তিনি আবার মর্তে চলে যান। এবারও তিনি তাই করবেন। মাকে বিসর্জনের মধ্য দিয়ে আমরাও নিজেদের অশুভ শক্তিকে বিসর্জন দেই। এ সময় কথা হয় আজিমপুরের বাসিন্দা তুলসি সাহার সঙ্গে। তিনি বলেন, একদিকে করোনা মহামারী নিয়ে আমরা অস্বস্তিতে ছিলাম। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে কুমিল্লাসহ বিভিন্ন স্থানে দেবী ভাঙচুর, মারামারির ঘটনা। এতে আমরা কিছুটা আতঙ্কিত আছি।’ মাকে বিসর্জন দিতে তাই একাই যাবেন জানিয়ে তিনি বলেন ‘শেষ বেলায় ভালোভাবে মাকে বিসর্জন দিতে পারলাম না। এই দুঃখটাই কষ্ট দিচ্ছে। মা নিশ্চয় বুঝবেন।’

এদিকে দেবী মাকে বিসর্জনের আগে বিবাহিত নারীদের সিঁদুর খেলার মধ্য দিয়ে হয় ‘দেবীবরণ’। দুর্গাপূজায় সবশেষ রীতিটি হচ্ছে ‘দেবীবরণ’। রীতি অনুযায়ী, সধবা নারীরা স্বামীর মঙ্গল কামনায় দশমীর দিন সিঁদুর, পান ও মিষ্টি নিয়ে দুর্গা মাকে সিঁদুর ছোঁয়ান। দেবীর পায়ে সিঁদুর ছোঁয়ানোর পর সেই সিঁদুর প্রথমে নিজ সিঁথিতে মাখান, পরে একে-অন্যের সিঁথি ও মুখে মাখেন। মুখ রঙিন করে হাসিমুখে মাকে বিদায় জানানোর জন্যই এই সিঁদুর খেলা। ভক্তদের বিশ্বাস, দুর্গা আগামী বছর আবারও সঙ্গে করে শাঁখা-সিঁদুর নিয়ে আসবেন। সেই শাঁখা-সিঁদুরেই স্বামীর মঙ্গল হবে।

দেবী দুর্গা এবার মর্ত্যলোকে এসেছিলেন ঘোটকে বা ঘোড়ায় চড়ে। এর ফল হচ্ছে ছত্রভঙ্গ। আর দেবী সপরিবারে স্বর্গালোকে বিদায় নেবেন দোলায় বা পালকি চড়ে, যার ফল হচ্ছে মড়ক। দেবীর আসা ও যাওয়ার লক্ষণ শুভ না হলেও ভক্তের বিশ্বাস, দেবী মঙ্গলময়ী। তিনি জগতের মঙ্গলই করবেন। সন্তানদের আশীষ দেবেন দু’হাত ভরে।

পুরাণ মতে, রাজা সুরথ প্রথম দেবী দুর্গার আরাধনা শুরু করেন। বসন্তে তিনি পূজার আয়োজন করায় দেবীর এ পূজাকে বাসন্তী পূজা বলা হয়। কিন্তু রাবণের হাত থেকে সীতাকে উদ্ধার করতে লঙ্কা যাত্রার আগে শ্রী রামচন্দ্র দেবীর পূজার আয়োজন করেছিলেন শরৎকালের অমাবস্যা তিথিতে, যা শারদীয় দুর্গোৎসব নামে পরিচিত। দেবীর শরৎকালের পূজাকে এ জন্যই হিন্দুমতে অকাল বোধনও বলা হয়।

বিজয়া দশমী উপলক্ষে বাংলাদেশ বেতার, বাংলাদেশ টেলিভিশনসহ অন্যান্য বেসরকারি টিভি চ্যানেল ও রেডিও স্টেশন বিশেষ অনুষ্ঠানমালা সম্প্রচার করেছে। আর জাতীয় দৈনিকগুলোও রেখেছিল বিশেষ আয়োজন।