শিক্ষাক্ষেত্রে দুর্নীতি

মাছুম বিল্লাহ

সম্প্রতি (২৯ সেপ্টেম্বর) ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল-বাংলাদেশ (টিআইবি) ‘মাধ্যমিক শিক্ষা কার্যক্রম বাস্তবায়ন : সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন পেশ করে। এতে শিক্ষাক্ষেত্রে দুর্নীতির কয়েকটি চিত্র ফুটে উঠেছে; যা যে কোন বিবেকবান মানুষকে ভাবিয়ে তুলবে।

টিআইবির রিপোর্টের ব্যাপারে শিক্ষক নেতারা বলেন, টিআইবির রিপোর্টে ঘুষের যে টাকার কথা বলা হয়েছে, সেটি কম-বেশি হতে পারে। কিন্তু বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগের পুরো প্রক্রিয়ার সঙ্গেই পরিচালনা পরিষদ জড়িত। তাদের অনৈতিক চাহিদা মেটাতে গিয়েই অনেক সময় প্রতিষ্ঠানের শিক্ষককেও অনিয়মের আশ্রয় নিতে হয়। তারা ম্যানেজিং কমিটির প্রথা বাতিলের দাবি জানান। এমপিও পেতে মাউশির মাঠপর্যায় থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত সব স্তরেই কম-বেশি ঘুষ দিতে হয়। এ ঘুষ বন্ধে একমাত্র সমাধান হলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করা।

স্থানীয় দুর্নীতিপরায়ণ ও প্রভাবশালীদের হাত থেকে বেসরকারি শিক্ষক সমাজ মুক্তি চায়, এটির সাথে আমরাও একাত্মতা ঘোষণা করছি। দেশের শিক্ষাকে, ভবিষ্যৎ উপযুক্ত নাগরিক তৈরির কারখানাগুলোকে এভাবে পেশিশক্তির অধিকারীদের নেতৃত্বে কিংবা বলয়ে থাকতে দেওয়া ঠিক নয়। যার কারণে চলছে এসব ঘুষবাণিজ্য। প্রশ্ন হচ্ছেÑ প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করা হলেই কী দুর্নীতি কমবে? সরকারি শিক্ষকদের বদলি, পদোন্নতি, পদায়ন সবক্ষেত্রেই তো দুর্নীতি বিদ্যমান। মাধ্যমিক শিক্ষা স্তরে অন্তত আট পর্যায়ে সেবাপ্রার্থীদের মোটা অঙ্কের টাকা ঘুষ দিতে হয়। এছাড়া বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের কাজে রয়েছে অনিয়ম। নিয়ম লঙ্ঘন করে শিক্ষক ও কর্মকর্তারা একই কর্মস্থলে তিন বছরের পরিবর্তে বিশ বছর পর্যন্ত অবস্থান করছেন। এভাবেই পদে পদে বিরাজ করছে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতি।

দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের অবস্থান যথেষ্ট শক্ষ না হলে দেশ থেকে দুর্নীতির মূলোৎপাটন করা কঠিন। দেশের মাধ্যমিক শিক্ষায় এমন ঘটনা ঘটলে তা কতটা ভয়াবহ সেটি এড়ানোর সুযোগ নেই। ফলে সংশ্লিষ্টদের কর্তব্য হওয়া দরকার এ প্রতিবেদন আমলে নিয়ে খতিয়ে দেখা এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে যত দ্রুত সম্ভব কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা। শিক্ষার গুণগতমান নিশ্চিতকরণে জাতীয় বিভিন্ন কৌশল নির্ধারণ করা হলেও নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে কার্যকর উদ্যোগের ঘাটতি রয়েছে।

২০১০ সালে জাতীয় শিক্ষানীতি হলেও এখনও অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বাস্তবায়ন হয়নি। দীর্ঘদিন অতিবাহিত হলেও নীতিগতভাবে প্রাধান্য না পাওয়ায় শিক্ষা আইনটি এখন পর্যন্ত পাস হয়নি। জাতীয় বাজেটে শিক্ষা খাতের বরাদ্দ আন্তর্জাতিক মানদন্ড অনুযায়ী নয় এবং জাতীয় বাজেটে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষায় বরাদ্দ আন্তর্জাতিক মানদ- অনুযায়ী নয় এবং জাতীয় বাজেটে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষায় বরাদ্দ টাকার অঙ্কে ক্রমান্বয়ে বাড়লেও শতাংশের ক্ষেত্রে এটি গড়ে ৫ থেকে ৬ শতাংশের মধ্যে রয়েছে।

মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষার মাঠপর্যায়ের প্রশাসনিক কার্যক্রম বাস্তবায়নে সমন্বিত জনবল কাঠামোর অনুপস্থিতি এবং জনবল সক্ষমতার ঘাটতিতে সুষ্ঠু তত্ত্বাবধান ও পরিদর্শনের অভাব পরিলক্ষিত হয়েছে টিআইবির গবেষণা প্রতিবেদনে। স্বচ্ছতা ও জবাবাদিহিতা নিশ্চিত করতে পদক্ষেপের ঘাটতিতে অনিয়ম ও দুর্নীতির বিস্তার ঘটছে এবং শিক্ষা কার্যক্রম প্রক্রিয়ায় দীর্ঘদিন ধরে রাজনেতিক প্রভাব, অনিয়ম ও আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ অব্যাহত রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে দুর্নীতির প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ হয়েছে।

অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধে এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পর্যায়ক্রমে জাতীয়করণ করা এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনায় কমিটির সভাপতি ও সদস্যদের শিক্ষাগত যোগ্যতা নির্ধারণের সুপারিশ করেছে টিআইবি। দুর্নীতির দুষ্টচক্র থেকে পুরো শিক্ষা ব্যবস্থাকে মুক্ত করতে হবে দেশের স্বার্থে, শিক্ষার স্বার্থে এবং সর্বোপরি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা স্মরণে রেখে।

[লেখক : ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচিতে কর্মরত]

শনিবার, ২৩ অক্টোবর ২০২১ , ০৭ কার্তিক ১৪২৮ ১৫ রবিউল আউয়াল ১৪৪৩

শিক্ষাক্ষেত্রে দুর্নীতি

মাছুম বিল্লাহ

সম্প্রতি (২৯ সেপ্টেম্বর) ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল-বাংলাদেশ (টিআইবি) ‘মাধ্যমিক শিক্ষা কার্যক্রম বাস্তবায়ন : সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন পেশ করে। এতে শিক্ষাক্ষেত্রে দুর্নীতির কয়েকটি চিত্র ফুটে উঠেছে; যা যে কোন বিবেকবান মানুষকে ভাবিয়ে তুলবে।

টিআইবির রিপোর্টের ব্যাপারে শিক্ষক নেতারা বলেন, টিআইবির রিপোর্টে ঘুষের যে টাকার কথা বলা হয়েছে, সেটি কম-বেশি হতে পারে। কিন্তু বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগের পুরো প্রক্রিয়ার সঙ্গেই পরিচালনা পরিষদ জড়িত। তাদের অনৈতিক চাহিদা মেটাতে গিয়েই অনেক সময় প্রতিষ্ঠানের শিক্ষককেও অনিয়মের আশ্রয় নিতে হয়। তারা ম্যানেজিং কমিটির প্রথা বাতিলের দাবি জানান। এমপিও পেতে মাউশির মাঠপর্যায় থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত সব স্তরেই কম-বেশি ঘুষ দিতে হয়। এ ঘুষ বন্ধে একমাত্র সমাধান হলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করা।

স্থানীয় দুর্নীতিপরায়ণ ও প্রভাবশালীদের হাত থেকে বেসরকারি শিক্ষক সমাজ মুক্তি চায়, এটির সাথে আমরাও একাত্মতা ঘোষণা করছি। দেশের শিক্ষাকে, ভবিষ্যৎ উপযুক্ত নাগরিক তৈরির কারখানাগুলোকে এভাবে পেশিশক্তির অধিকারীদের নেতৃত্বে কিংবা বলয়ে থাকতে দেওয়া ঠিক নয়। যার কারণে চলছে এসব ঘুষবাণিজ্য। প্রশ্ন হচ্ছেÑ প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করা হলেই কী দুর্নীতি কমবে? সরকারি শিক্ষকদের বদলি, পদোন্নতি, পদায়ন সবক্ষেত্রেই তো দুর্নীতি বিদ্যমান। মাধ্যমিক শিক্ষা স্তরে অন্তত আট পর্যায়ে সেবাপ্রার্থীদের মোটা অঙ্কের টাকা ঘুষ দিতে হয়। এছাড়া বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের কাজে রয়েছে অনিয়ম। নিয়ম লঙ্ঘন করে শিক্ষক ও কর্মকর্তারা একই কর্মস্থলে তিন বছরের পরিবর্তে বিশ বছর পর্যন্ত অবস্থান করছেন। এভাবেই পদে পদে বিরাজ করছে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতি।

দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের অবস্থান যথেষ্ট শক্ষ না হলে দেশ থেকে দুর্নীতির মূলোৎপাটন করা কঠিন। দেশের মাধ্যমিক শিক্ষায় এমন ঘটনা ঘটলে তা কতটা ভয়াবহ সেটি এড়ানোর সুযোগ নেই। ফলে সংশ্লিষ্টদের কর্তব্য হওয়া দরকার এ প্রতিবেদন আমলে নিয়ে খতিয়ে দেখা এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে যত দ্রুত সম্ভব কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা। শিক্ষার গুণগতমান নিশ্চিতকরণে জাতীয় বিভিন্ন কৌশল নির্ধারণ করা হলেও নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে কার্যকর উদ্যোগের ঘাটতি রয়েছে।

২০১০ সালে জাতীয় শিক্ষানীতি হলেও এখনও অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বাস্তবায়ন হয়নি। দীর্ঘদিন অতিবাহিত হলেও নীতিগতভাবে প্রাধান্য না পাওয়ায় শিক্ষা আইনটি এখন পর্যন্ত পাস হয়নি। জাতীয় বাজেটে শিক্ষা খাতের বরাদ্দ আন্তর্জাতিক মানদন্ড অনুযায়ী নয় এবং জাতীয় বাজেটে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষায় বরাদ্দ আন্তর্জাতিক মানদ- অনুযায়ী নয় এবং জাতীয় বাজেটে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষায় বরাদ্দ টাকার অঙ্কে ক্রমান্বয়ে বাড়লেও শতাংশের ক্ষেত্রে এটি গড়ে ৫ থেকে ৬ শতাংশের মধ্যে রয়েছে।

মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষার মাঠপর্যায়ের প্রশাসনিক কার্যক্রম বাস্তবায়নে সমন্বিত জনবল কাঠামোর অনুপস্থিতি এবং জনবল সক্ষমতার ঘাটতিতে সুষ্ঠু তত্ত্বাবধান ও পরিদর্শনের অভাব পরিলক্ষিত হয়েছে টিআইবির গবেষণা প্রতিবেদনে। স্বচ্ছতা ও জবাবাদিহিতা নিশ্চিত করতে পদক্ষেপের ঘাটতিতে অনিয়ম ও দুর্নীতির বিস্তার ঘটছে এবং শিক্ষা কার্যক্রম প্রক্রিয়ায় দীর্ঘদিন ধরে রাজনেতিক প্রভাব, অনিয়ম ও আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ অব্যাহত রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে দুর্নীতির প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ হয়েছে।

অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধে এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পর্যায়ক্রমে জাতীয়করণ করা এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনায় কমিটির সভাপতি ও সদস্যদের শিক্ষাগত যোগ্যতা নির্ধারণের সুপারিশ করেছে টিআইবি। দুর্নীতির দুষ্টচক্র থেকে পুরো শিক্ষা ব্যবস্থাকে মুক্ত করতে হবে দেশের স্বার্থে, শিক্ষার স্বার্থে এবং সর্বোপরি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা স্মরণে রেখে।

[লেখক : ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচিতে কর্মরত]