ছয় মাসের মধ্যে করোনার টিকা উৎপাদনে যেতে চায় সরকার

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানি ডায়াডিকের উদ্ভাবিত ফর্মুলা ও টেকনোলজি প্রয়োগের মাধ্যমে দেশে করোনার ভ্যাকসিন উৎপাদনের পরিকল্পনা করছে সরকার। রাষ্ট্রায়াত্ত ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান এসেনসিয়াল ড্রাগস কোম্পানি লিমিটেড (ইডিসিএল) এই ভ্যাকসিন উৎপাদন করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ নিচ্ছে বলে জানা গেছে।

মার্কিন ফর্মুলায় দেশেই কোভিড-নাইনটিন ভ্যাকসিন উৎপাদন হবে জানালেন ভ্যাকসিন উৎপাদন বিষয়ক টেকনিক্যাল কমিটির আহ্বায়ক ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক এবিএম খুরশীদ আলম। তিনি বলেন, ‘আন্তর্জাতিক কোম্পানি আমেরিকার ডায়াডিক। এই কোম্পানির সঙ্গে আলোচনা চলছে, তারা যদি টেকনোলজি ট্রান্সফার করতে রাজি হয়, তাহলে ভ্যাকসিন উৎপাদনে ৬ মাসের মধ্যেই যাওয়া যাবে। আর তা যদি না হয় তাহলে ভ্যাকসিন বাক্সে করে এনে ফিল ফিনিশ করা হবে।’

দেশে করোনা ভ্যাকসিন উৎপাদনের লক্ষ্যে ডায়াডিকের ফর্মুলা ও টেকনোলজি পেতে অনেক দূর এগিয়েছে এর কার্যক্রম। এরই মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানি ডায়াডিকের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক (এমওইউ), স্টিলের স্ট্রাকচারে ভ্যাকসিন প্লান্ট স্থাপন এবং জমি অধিগ্রহণ ও প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়া দ্রুত সম্পন্ন করার উদ্যোগও নেয়া হচ্ছে। সবকিছু পরিকল্পনা অনুযায়ী এগুলে আগামী ছয় মাসের মধ্যে দেশে প্রোটিন ভ্যাকসিন উৎপাদন শুরু হওয়ার সম্ভাবনা দেখছেন সংশ্লিষ্টরা।

আন্তর্জাতিক পুরস্কারপ্রাপ্ত বিজ্ঞানী ড. ফেরদৌসী কাদরী দেশে টিকা উৎপাদন নিয়ে সংবাদকে বলেন, করোনা থেকে যেতে পারে আরও কয়েক বছর। কতদিন আর অন্য দেশের দিকে চেয়ে থাকব আমরা। টিকা উৎপাদনে যেতে পারলে খুব ভালো। তবে তা যেন নিয়ম মেনে হয়।

ফেরদৌসী কাদরী বলেন, মানুষের শরীরে এপ্লাই করার আগে বেশ কয়েকটা ধাপ পার করতে হয়। যারা কাজ করেন তারা এসব খুব ভালো জানেন। তারা প্রচুর লেখাপড়া করেন। ভ্যাকসিন উৎপাদন দেশে শুরু হওয়াটা খুব ভালো পদক্ষেপ।

মহামারী মোকাবিলায় সরকার শুরুতে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের উৎপাদিত অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় উদ্ভাবিত অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন কিনে আনে। কিন্তু ভারতে করোনা সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় ভারত ভ্যাকসিন রপ্তানি বন্ধ করে দেয়। এরপর সরকার দ্রুত ফাইজার, মর্ডানা ও সিনোফার্মের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয় এবং সেই মোতাবেক এখন টিকা দেয়া হচ্ছে। মহামারীর এমন পরিস্থিতি মোকাবিলায় নিজেদের দেশেই ভ্যাকসিন উৎপাদনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে সরকার। আর এই আলোচনার পর ভ্যাকসিন উৎপাদনে ডায়াডিকের ফর্মুলা ও টেকনোলজি ট্রান্সফারের বিষয়ে বেশি এগিয়েছে বাংলাদেশ।

এছাড়া মার্কিন বায়োটেকনোলজি কোম্পানি ডায়াডিক ইতোমধ্যেই টিকা উৎপাদনে তাদের টেকনোলজির ব্যবহার বেশ সুনাম কুড়িয়েছে। চলতি বছরের জুলাই মাসে দক্ষিণ আফ্রিকার রুবিক কনসোর্টিয়ামের সঙ্গে টেকনোলজি ট্রান্সফার এবং লাইসেন্সিং চুক্তির ঘোষণা দেয়। আর এ বছরই কোভিড-নাইনটিন ভ্যাকসিন ট্রায়ালের জন্য অনুমতি চাইতে পারে বলেও জানা গেছে। তারা দ্রুতই টেকনোলজি ট্রান্সফার শুরু করবে। অক্টোবর বা নভেম্বরের শুরুতেই ডায়াডিকের ট্রায়াল শুরু হওয়ার কথা বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়। অন্যান্য দেশের মতো আফ্রিকাও কোভিড-নাইনটিন ভ্যাকসিন উৎপাদনের প্রতিযোগিতায় যোগ দিয়েছে।

পৃথিবীজুড়ে এখন কোভিড-নাইনটিন ভ্যাকসিন তৈরির প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশও একজন। আর এই মুহূর্তে ডায়াডিকের সঙ্গে চুক্তিতে না আসতে পারলে টিকা উৎপাদনে পিছিয়ে পড়তে পারে দেশÑ বলে জানালেন এসেনসিয়াল ড্রাগস কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. এহসানুল কবির জগলুল।

তিনি বলেন, ভ্যাকসিন উৎপাদনের বিষয়ে ডায়াডিক কোম্পানির সঙ্গে আলোচনা হয়েছে, বিভিন্ন ডকুমেন্টস এক্সচেঞ্জ করেছি। ডায়াডিক এখন একটি এমওইউ করতে চায়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের গঠিত কমিটির অনুমতি পেলে ভ্যাকসিন উৎপাদনের বিষয়ে সেটি করা হবে। তবে এমওইউ-এর প্রক্রিয়া চলছে। এমওইউ না করলে তাদের অন্য কোন দেশের সঙ্গে চুক্তি হয়ে যেতে পারে তাদের চলে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।’

তবে, ডায়াডিকের সঙ্গে কাঁচামাল ও টেকোনলজি ট্রান্সফারের বিষয়ে সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) যে চুক্তি হবে এ বিষয়ে একটি খসড়া ইতোমধ্যে তৈরি করা হয়েছে। তবে সরকারের নির্দেশনার পরই সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হবে।

জানা যায়, এ বিষয়ে আলোচনার শুরুর পর ইডিসিএল ডায়াডিক কোম্পানির সঙ্গে বেশ কয়েকবার বৈঠক করেছে।

এদিকে গত ১৩ অক্টোবর স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির বৈঠকে জানানো হয় ডায়াডিক ছাড়াও রাশিয়ার স্পুটনিক-ভি ও অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় উদ্ভাবিত প্রোটিন ভ্যাকসিন তৈরির আলোচনাও চলছে। ওই বৈঠকে আলোচনার পর দেশে দ্রুত ভ্যাকসিন উৎপাদনে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ বাস্তবায়নে সুপারিশ করা হয়েছে।

৯ সদস্যবিশিষ্ট ভ্যাকসিন উৎপাদন কারিগরি কমিটি সূত্রে জানা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের ডায়াডিকের উদ্ভাবিত ভ্যাকসিন ফর্মুলায় কার্যকারিতার হার ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নির্ণয়ে দেশে ট্রায়ালের অনুমতির সুপারিশ করেছিল এই কারিগরি কমিটি। কারণ ডায়াডিক ফর্মুলা উদ্ভাবন করলেও ট্রায়াল সম্পন্ন করতে পারেনি। বাংলাদেশে ভ্যাকসিন উৎপাদন করবে এমন শর্তে ট্রায়ালের অনুমতি দিলে দ্রুততম সময়ে ভ্যাকসিন উৎপাদন করা যেতে পারে বলে মনে করে এই কমিটি। এছাড়াও করোনার ভ্যাকসিনের বিশ্বব্যাপী ব্যাপক চাহিদার কারণে ভ্যাকসিনের কাঁচামালেরও সংকট রয়েছে। তবে ডায়াডিকের প্রোটিন ভ্যাকসিন উৎপাদনে কাঁচামালের তেমন সংকট হবে না বলেও সুপারিশ করেছে ভ্যাকসিন উৎপাদন কারিগরি কমিটি।

এসেনসিয়াল ড্রাগস কোম্পানি লিমিটেডের ওয়েবসাইটের তথ্য অনুসারে- ১৯৬২ সালে কোম্পানিটি সরকারি ফার্মাসিউটিক্যালস ল্যাবরেটরির (জিপিএল) অধীনে পরিচালিত হতো। পরবর্তীকালে ১৯৭৯ সালে ফার্মাসিউটিক্যালস প্রোডাকশন ইউনিট (পিপিইউ) নামে নামকরণ করা হয়েছিল। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় এ কোম্পানিটির নিয়ন্ত্রণ করে।

অতি পুরনো এই ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানটিতে করোনা ভ্যাকসিন উৎপাদনে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও আধুনিক ল্যাবরেটরি নেই। বিদ্যমান অবকাঠামোতেও ভ্যাকসিন উৎপাদন সম্ভব নয়। তবে ভ্যাকসিন উৎপাদনে সরকার ব্যাপক গুরুত্ব দেয়ায় অবকাঠামো উন্নয়নের জটিলতা দূর হয়েছে। অবকাঠামো নির্মাণের অংশ হিসেবে ভবন নির্মাণ সময়সাপেক্ষ হওয়ায় স্টিলের স্ট্রাকচারে ভবন নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। যার জন্য এসেনসিয়াল ড্রাগস কোম্পানির পাশে গোপালগঞ্জে ৮ একর জয়গা অধিগ্রহণ করা হয়েছে। যাতে স্টিলের অবকাঠামোর উপর ভ্যাকসিন উৎপাদনের প্রয়োজনীয় ল্যাব নির্মাণ ও যন্ত্রপাতি বসানো হবে।

বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে ২ থেকে ৮ ডিগ্রি সেন্ট্রিগ্রেড তাপমাত্রায় ম্যানুফ্যাকচারিং প্লান্টের কোল্ডরুম এবং কুলরুম নির্মাণের মাধ্যমে ভ্যাকসিন সংরক্ষণ করা হবে। দ্রুততম সময়ে উৎপাদনে যাওয়ার জন্য সেখানে স্ট্রিলের স্ট্রাকচার তৈরি করা হবে। এছাড়া কনসালটেন্ট ও একজন বিজ্ঞানী নিয়োগের বিষয়টিও প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। যা অতি দ্রুতই সম্পন্ন করা হবে বলে বলছেন কর্মকর্তারা।

এদিকে দেশের ওষুধ কোম্পানি ইনসেপটা, পপুলার ও হেলথকেয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস এই তিন কোম্পানি টিকা তৈরিতে আগ্রহ দেখালে এ বছরের ৫ মে এই তিনটি ওষুধ কোম্পানির সক্ষমতা যাচাই করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। তাদের সক্ষমতা যাচাই করা হলেও টিকা উৎপাদনের জন্য চূড়ান্ত করা হয়নি। পাঁচটি সূচককে সামনে রেখে এই সক্ষমতা যাচাই করা হয়। সূচকগুলো হলো, কোম্পানি কত দ্রুত উৎপাদনে যেতে পারবে, টিকা উৎপাদনের পরিমাণ কত হবে, টিকার মান কেমন হবে, কোম্পানির অভিজ্ঞতা এবং পরিশেষে তাদের জনবল বা অবকাঠামো কেমন আছে। এই পাঁচ সূচকে ইনসেপটা এগিয়ে আছে বলেও জানা যায়।

আবার গত ১৮ মার্চ স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক আশুলিয়ার জিরাবো এলাকায় ইনসেপটা ভ্যাকসিন লিমিটেডের ভ্যাকসিন প্ল্যান্ট পরিদর্শন করেন। সেদিন তিনি বলেন, ‘আমরা জানতে পেরেছি ইনসেপটা ভ্যাকসিন প্ল্যান্ট ইতোমধ্যে ইনফ্রাস্ট্রাকচার অ্যান্ড গুড ম্যানুফ্যাকচারিং প্র্যাকটিস (জিএমপি) মান অনুযায়ী ভ্যাকসিন উৎপাদনে বিশ্বমানের সক্ষমতা অর্জন করেছে। সুতরাং আমি মনে করি, অন্য দেশগুলোও ভ্যাকসিন উৎপাদনের জন্য এই প্ল্যান্ট ব্যবহার করতে পারে। প্ল্যান্টটি প্রতি বছর ১৮ কোটি ডোজ ভ্যাকসিন তৈরির ক্ষমতা রাখে।’

আবার ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মাহবুবুর রহমান ওই সময় বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের ভ্যাকসিন উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে। আমাদের তিনটি ফার্মাসিউটিক্যালস ইনসেপটা, পপুলার ও হেলথ কেয়ার ভ্যাকসিন তৈরি করতে পারে। ইনসেপটা ইতোমধ্যে এ নিয়ে কথা বলেছে রাশিয়ার সঙ্গে।’ দেশে ভ্যাকসিন তৈরির সক্ষমতা নিয়ে কোন সন্দেহ নেই মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘ইনসেপটা ফার্মাসিউটিক্যাল বর্তমানে ১৪টি ভ্যাকসিন তৈরি করছে। সেগুলো রপ্তানিও হচ্ছে।’

সোমবার, ২৫ অক্টোবর ২০২১ , ০৯ কার্তিক ১৪২৮ ১৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৩

ছয় মাসের মধ্যে করোনার টিকা উৎপাদনে যেতে চায় সরকার

জাহিদা পারভেজ ছন্দা

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানি ডায়াডিকের উদ্ভাবিত ফর্মুলা ও টেকনোলজি প্রয়োগের মাধ্যমে দেশে করোনার ভ্যাকসিন উৎপাদনের পরিকল্পনা করছে সরকার। রাষ্ট্রায়াত্ত ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান এসেনসিয়াল ড্রাগস কোম্পানি লিমিটেড (ইডিসিএল) এই ভ্যাকসিন উৎপাদন করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ নিচ্ছে বলে জানা গেছে।

মার্কিন ফর্মুলায় দেশেই কোভিড-নাইনটিন ভ্যাকসিন উৎপাদন হবে জানালেন ভ্যাকসিন উৎপাদন বিষয়ক টেকনিক্যাল কমিটির আহ্বায়ক ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক এবিএম খুরশীদ আলম। তিনি বলেন, ‘আন্তর্জাতিক কোম্পানি আমেরিকার ডায়াডিক। এই কোম্পানির সঙ্গে আলোচনা চলছে, তারা যদি টেকনোলজি ট্রান্সফার করতে রাজি হয়, তাহলে ভ্যাকসিন উৎপাদনে ৬ মাসের মধ্যেই যাওয়া যাবে। আর তা যদি না হয় তাহলে ভ্যাকসিন বাক্সে করে এনে ফিল ফিনিশ করা হবে।’

দেশে করোনা ভ্যাকসিন উৎপাদনের লক্ষ্যে ডায়াডিকের ফর্মুলা ও টেকনোলজি পেতে অনেক দূর এগিয়েছে এর কার্যক্রম। এরই মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানি ডায়াডিকের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক (এমওইউ), স্টিলের স্ট্রাকচারে ভ্যাকসিন প্লান্ট স্থাপন এবং জমি অধিগ্রহণ ও প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়া দ্রুত সম্পন্ন করার উদ্যোগও নেয়া হচ্ছে। সবকিছু পরিকল্পনা অনুযায়ী এগুলে আগামী ছয় মাসের মধ্যে দেশে প্রোটিন ভ্যাকসিন উৎপাদন শুরু হওয়ার সম্ভাবনা দেখছেন সংশ্লিষ্টরা।

আন্তর্জাতিক পুরস্কারপ্রাপ্ত বিজ্ঞানী ড. ফেরদৌসী কাদরী দেশে টিকা উৎপাদন নিয়ে সংবাদকে বলেন, করোনা থেকে যেতে পারে আরও কয়েক বছর। কতদিন আর অন্য দেশের দিকে চেয়ে থাকব আমরা। টিকা উৎপাদনে যেতে পারলে খুব ভালো। তবে তা যেন নিয়ম মেনে হয়।

ফেরদৌসী কাদরী বলেন, মানুষের শরীরে এপ্লাই করার আগে বেশ কয়েকটা ধাপ পার করতে হয়। যারা কাজ করেন তারা এসব খুব ভালো জানেন। তারা প্রচুর লেখাপড়া করেন। ভ্যাকসিন উৎপাদন দেশে শুরু হওয়াটা খুব ভালো পদক্ষেপ।

মহামারী মোকাবিলায় সরকার শুরুতে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের উৎপাদিত অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় উদ্ভাবিত অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন কিনে আনে। কিন্তু ভারতে করোনা সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় ভারত ভ্যাকসিন রপ্তানি বন্ধ করে দেয়। এরপর সরকার দ্রুত ফাইজার, মর্ডানা ও সিনোফার্মের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয় এবং সেই মোতাবেক এখন টিকা দেয়া হচ্ছে। মহামারীর এমন পরিস্থিতি মোকাবিলায় নিজেদের দেশেই ভ্যাকসিন উৎপাদনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে সরকার। আর এই আলোচনার পর ভ্যাকসিন উৎপাদনে ডায়াডিকের ফর্মুলা ও টেকনোলজি ট্রান্সফারের বিষয়ে বেশি এগিয়েছে বাংলাদেশ।

এছাড়া মার্কিন বায়োটেকনোলজি কোম্পানি ডায়াডিক ইতোমধ্যেই টিকা উৎপাদনে তাদের টেকনোলজির ব্যবহার বেশ সুনাম কুড়িয়েছে। চলতি বছরের জুলাই মাসে দক্ষিণ আফ্রিকার রুবিক কনসোর্টিয়ামের সঙ্গে টেকনোলজি ট্রান্সফার এবং লাইসেন্সিং চুক্তির ঘোষণা দেয়। আর এ বছরই কোভিড-নাইনটিন ভ্যাকসিন ট্রায়ালের জন্য অনুমতি চাইতে পারে বলেও জানা গেছে। তারা দ্রুতই টেকনোলজি ট্রান্সফার শুরু করবে। অক্টোবর বা নভেম্বরের শুরুতেই ডায়াডিকের ট্রায়াল শুরু হওয়ার কথা বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়। অন্যান্য দেশের মতো আফ্রিকাও কোভিড-নাইনটিন ভ্যাকসিন উৎপাদনের প্রতিযোগিতায় যোগ দিয়েছে।

পৃথিবীজুড়ে এখন কোভিড-নাইনটিন ভ্যাকসিন তৈরির প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশও একজন। আর এই মুহূর্তে ডায়াডিকের সঙ্গে চুক্তিতে না আসতে পারলে টিকা উৎপাদনে পিছিয়ে পড়তে পারে দেশÑ বলে জানালেন এসেনসিয়াল ড্রাগস কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. এহসানুল কবির জগলুল।

তিনি বলেন, ভ্যাকসিন উৎপাদনের বিষয়ে ডায়াডিক কোম্পানির সঙ্গে আলোচনা হয়েছে, বিভিন্ন ডকুমেন্টস এক্সচেঞ্জ করেছি। ডায়াডিক এখন একটি এমওইউ করতে চায়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের গঠিত কমিটির অনুমতি পেলে ভ্যাকসিন উৎপাদনের বিষয়ে সেটি করা হবে। তবে এমওইউ-এর প্রক্রিয়া চলছে। এমওইউ না করলে তাদের অন্য কোন দেশের সঙ্গে চুক্তি হয়ে যেতে পারে তাদের চলে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।’

তবে, ডায়াডিকের সঙ্গে কাঁচামাল ও টেকোনলজি ট্রান্সফারের বিষয়ে সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) যে চুক্তি হবে এ বিষয়ে একটি খসড়া ইতোমধ্যে তৈরি করা হয়েছে। তবে সরকারের নির্দেশনার পরই সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হবে।

জানা যায়, এ বিষয়ে আলোচনার শুরুর পর ইডিসিএল ডায়াডিক কোম্পানির সঙ্গে বেশ কয়েকবার বৈঠক করেছে।

এদিকে গত ১৩ অক্টোবর স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির বৈঠকে জানানো হয় ডায়াডিক ছাড়াও রাশিয়ার স্পুটনিক-ভি ও অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় উদ্ভাবিত প্রোটিন ভ্যাকসিন তৈরির আলোচনাও চলছে। ওই বৈঠকে আলোচনার পর দেশে দ্রুত ভ্যাকসিন উৎপাদনে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ বাস্তবায়নে সুপারিশ করা হয়েছে।

৯ সদস্যবিশিষ্ট ভ্যাকসিন উৎপাদন কারিগরি কমিটি সূত্রে জানা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের ডায়াডিকের উদ্ভাবিত ভ্যাকসিন ফর্মুলায় কার্যকারিতার হার ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নির্ণয়ে দেশে ট্রায়ালের অনুমতির সুপারিশ করেছিল এই কারিগরি কমিটি। কারণ ডায়াডিক ফর্মুলা উদ্ভাবন করলেও ট্রায়াল সম্পন্ন করতে পারেনি। বাংলাদেশে ভ্যাকসিন উৎপাদন করবে এমন শর্তে ট্রায়ালের অনুমতি দিলে দ্রুততম সময়ে ভ্যাকসিন উৎপাদন করা যেতে পারে বলে মনে করে এই কমিটি। এছাড়াও করোনার ভ্যাকসিনের বিশ্বব্যাপী ব্যাপক চাহিদার কারণে ভ্যাকসিনের কাঁচামালেরও সংকট রয়েছে। তবে ডায়াডিকের প্রোটিন ভ্যাকসিন উৎপাদনে কাঁচামালের তেমন সংকট হবে না বলেও সুপারিশ করেছে ভ্যাকসিন উৎপাদন কারিগরি কমিটি।

এসেনসিয়াল ড্রাগস কোম্পানি লিমিটেডের ওয়েবসাইটের তথ্য অনুসারে- ১৯৬২ সালে কোম্পানিটি সরকারি ফার্মাসিউটিক্যালস ল্যাবরেটরির (জিপিএল) অধীনে পরিচালিত হতো। পরবর্তীকালে ১৯৭৯ সালে ফার্মাসিউটিক্যালস প্রোডাকশন ইউনিট (পিপিইউ) নামে নামকরণ করা হয়েছিল। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় এ কোম্পানিটির নিয়ন্ত্রণ করে।

অতি পুরনো এই ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানটিতে করোনা ভ্যাকসিন উৎপাদনে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও আধুনিক ল্যাবরেটরি নেই। বিদ্যমান অবকাঠামোতেও ভ্যাকসিন উৎপাদন সম্ভব নয়। তবে ভ্যাকসিন উৎপাদনে সরকার ব্যাপক গুরুত্ব দেয়ায় অবকাঠামো উন্নয়নের জটিলতা দূর হয়েছে। অবকাঠামো নির্মাণের অংশ হিসেবে ভবন নির্মাণ সময়সাপেক্ষ হওয়ায় স্টিলের স্ট্রাকচারে ভবন নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। যার জন্য এসেনসিয়াল ড্রাগস কোম্পানির পাশে গোপালগঞ্জে ৮ একর জয়গা অধিগ্রহণ করা হয়েছে। যাতে স্টিলের অবকাঠামোর উপর ভ্যাকসিন উৎপাদনের প্রয়োজনীয় ল্যাব নির্মাণ ও যন্ত্রপাতি বসানো হবে।

বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে ২ থেকে ৮ ডিগ্রি সেন্ট্রিগ্রেড তাপমাত্রায় ম্যানুফ্যাকচারিং প্লান্টের কোল্ডরুম এবং কুলরুম নির্মাণের মাধ্যমে ভ্যাকসিন সংরক্ষণ করা হবে। দ্রুততম সময়ে উৎপাদনে যাওয়ার জন্য সেখানে স্ট্রিলের স্ট্রাকচার তৈরি করা হবে। এছাড়া কনসালটেন্ট ও একজন বিজ্ঞানী নিয়োগের বিষয়টিও প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। যা অতি দ্রুতই সম্পন্ন করা হবে বলে বলছেন কর্মকর্তারা।

এদিকে দেশের ওষুধ কোম্পানি ইনসেপটা, পপুলার ও হেলথকেয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস এই তিন কোম্পানি টিকা তৈরিতে আগ্রহ দেখালে এ বছরের ৫ মে এই তিনটি ওষুধ কোম্পানির সক্ষমতা যাচাই করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। তাদের সক্ষমতা যাচাই করা হলেও টিকা উৎপাদনের জন্য চূড়ান্ত করা হয়নি। পাঁচটি সূচককে সামনে রেখে এই সক্ষমতা যাচাই করা হয়। সূচকগুলো হলো, কোম্পানি কত দ্রুত উৎপাদনে যেতে পারবে, টিকা উৎপাদনের পরিমাণ কত হবে, টিকার মান কেমন হবে, কোম্পানির অভিজ্ঞতা এবং পরিশেষে তাদের জনবল বা অবকাঠামো কেমন আছে। এই পাঁচ সূচকে ইনসেপটা এগিয়ে আছে বলেও জানা যায়।

আবার গত ১৮ মার্চ স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক আশুলিয়ার জিরাবো এলাকায় ইনসেপটা ভ্যাকসিন লিমিটেডের ভ্যাকসিন প্ল্যান্ট পরিদর্শন করেন। সেদিন তিনি বলেন, ‘আমরা জানতে পেরেছি ইনসেপটা ভ্যাকসিন প্ল্যান্ট ইতোমধ্যে ইনফ্রাস্ট্রাকচার অ্যান্ড গুড ম্যানুফ্যাকচারিং প্র্যাকটিস (জিএমপি) মান অনুযায়ী ভ্যাকসিন উৎপাদনে বিশ্বমানের সক্ষমতা অর্জন করেছে। সুতরাং আমি মনে করি, অন্য দেশগুলোও ভ্যাকসিন উৎপাদনের জন্য এই প্ল্যান্ট ব্যবহার করতে পারে। প্ল্যান্টটি প্রতি বছর ১৮ কোটি ডোজ ভ্যাকসিন তৈরির ক্ষমতা রাখে।’

আবার ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মাহবুবুর রহমান ওই সময় বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের ভ্যাকসিন উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে। আমাদের তিনটি ফার্মাসিউটিক্যালস ইনসেপটা, পপুলার ও হেলথ কেয়ার ভ্যাকসিন তৈরি করতে পারে। ইনসেপটা ইতোমধ্যে এ নিয়ে কথা বলেছে রাশিয়ার সঙ্গে।’ দেশে ভ্যাকসিন তৈরির সক্ষমতা নিয়ে কোন সন্দেহ নেই মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘ইনসেপটা ফার্মাসিউটিক্যাল বর্তমানে ১৪টি ভ্যাকসিন তৈরি করছে। সেগুলো রপ্তানিও হচ্ছে।’