মহাদেবপুরে দাদন ব্যবসায়ীর খপ্পরে সর্বস্বান্ত পারুলের পরিবার

স্বামী আর দুই ছেলেকে নিয়ে সুখের সংসার ছিল নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলার খাজুর ইউনিয়নের কর্ণতৈড় কুমারপাড়া গ্রামের গৃহবধূ পারুল রাণী ম-লের। নিজের ১০ কাঠা জমি। অন্যের জমি বর্গা নিয়ে পরিবারের সবাই মিলে ফসল ফলিয়ে মাটির দোতালা বাড়িও বানিয়েছেন। তার এ সুখ বেশিদিন আর সইলো না। এলাকার দাদন ব্যবসায়ীদের খপ্পড়ে পড়ে মাত্র দুই বছরে নিস্ব হয়েছে পরিবারটি। ৫০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে এখন তার মাথায় ৫০ লাখ টাকার ঋণের বোঝা। অসংখ্য মামলা। আদালতে হাজিরা দিতে হয় প্রায়ই। পুলিশ ধরেও নিয়ে যায়। তাই পুলিশের ভয়ে পালিয়ে থাকতে হয় দিনের পর দিন। তাকে নিয়ে এলাকাবাসী দাদন ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে মানববন্ধন করেছেন। সমাবেশও করেছেন। বৈঠক করেছেন স্থানীয় প্রশাসন। কিন্তু কেউই তার ঋণের বোঝা কমাতে পারেননি। পারুল রাণী জানান, তার বড় ছেলে দুলাল চন্দ্রের একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পে চাকরির জন্য ৩ বছর আগে তার প্রতিবেশী বর্তমানে কুঞ্জবন বাজারে বসবাসকারী জালাল হোসেনের স্ত্রী হাসিনা খাতুনের কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকা ঋণ নেন। প্রতি সপ্তাহে তাকে ৫ হাজার টাকা সুদ দিতে হতো। এক পর্যায়ে সুদের টাকা দিতে না পারায় ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে দেবার অজুহাতে হাসিনা খাতুন পারুল রাণীকে জনতা ব্যাংক মহাদেবপুর শাখায় নিয়ে গিয়ে একটি একাউন্ট খুলে দেন। ব্যাংকের ১০ পাতার চেক বই হাসিনা তার নিজের কাছে রেখে দেয়। এরপর টাকা পরিশোধের জন্য হাসিনা খাতুন পারুল রাণীকে তার ১০ কাঠা জমি লিখে দিতে বলেন। পারুল জমি রেজিস্ট্রি করে দিতে অস্বীকার করলে হাসিনা খাতুন পারুল রাণীর বিরুদ্ধে নওগাঁর জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে ৬ লাখ টাকার চেক ডিজঅনারের মামলা দায়ের করেন। পারুল রাণী সে মামলায় জামিন নেন। তিনি জানান, প্রতি সপ্তাহে হাসিনা খাতুনের সুদের টাকার যোগান দিতে তিনি একে একে আশ্রয়, এসোড, বেডো, ব্র্যাক, গ্রামীণ ব্যাংক, আশা, ঠেঙ্গামারা, দিশারী, বর্ষা প্রভৃতি সমিতি থেকে ঋণ নেন। ব্যক্তি পর্যায়েও কয়েকজনের কাছ থেকে চড়া সুদে ঋণ নেন। এছাড়া তার প্রতিবেশীদের অনুরোধ করে তাদের নামেও ঋণ নিয়েছেন। একটির ঋণের কিস্তি শোধ করতে অন্য আর একটি থেকে ঋণ নিয়েছেন। কিন্তু সময়মতো শোধ করতে পারেননি কোনটিই। কোন কোন সমিতি তার বিরুদ্ধে চেকের মামলা করেছে, আবার কোনটি করেনি। কিছুদিন আগে একটি মামলায় পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে যায়। পরে জামিনে ছাড়া পান। যেসব প্রতিবেশী ঋণ নিয়ে পারুলকে দিয়েছেন তাদের নামেও মামলা হয়েছে। কাউকে কাউকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। পারুল অভিযোগ করেন যে, ব্র্যাক থেকে ৫০ হাজার টাকা নিয়ে হাসিনা খাতুনকে পরিশোধ করেছেন। কিন্তু হাসিনা সে টাকা সুদ হিসেবে নিয়ে আরও টাকা দাবি করছেন। দু’বছর আগে স্থানীয় এমপির ছেলে সাকলায়েন তরফদার রকির উদ্যোগে উপজেলা সদরে এলাকার দাদন ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে বিশাল সমাবেশ ও মানববন্ধনের আয়োজন করা হয়। সে সমাবেশে পারুল খাতুন তার অসহায়ত্বের বর্ণনা দেন। পরে এ নিয়ে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান ও গণ্যমান্য ব্যক্তিসহ মহাদেবপুর থানায় বসা হয়। বৈঠকে হাসিনা খাতুনকে ৫০ হাজার টাকা নিয়ে আপোস করার কথা বলা হয়। কিন্তু তিনি তা মানেননি। কান্নাজড়িত কণ্ঠে পারুল রাণী জানান, তার ছেলের চাকরি হয়নি। দুছেলে ভিন্ন সংসার করেছে। আর তার স্বামী ঢাকায় গিয়ে দিনমজুরের কাজ করছেন। হাসিনা খাতুন জানান, পারুলের পরিবার তার ২০ বিঘা জমি বর্গা করতো। প্রতি সিজনে ২০০ মণ ধান উঠতো। এর অর্ধেকের মালিক তিনি। কিন্তু পারুল রাণী হাসিনার অংশের ধান না দিয়ে পাওনাদারদের দিয়ে দিতেন। এভাবে তার ৬ লাখ টাকা ঋণ হয়েছে। খাজুর ইউপি চেয়ারম্যান বেলাল উদ্দিন এ বিষয়ে দফায় দফায় বৈঠক হয়েছে বলে উল্লেখ করে জানান, সে টাকার সুদ, সুদের সুদ, তার সুদ হিসেব করে পুরো টাকা একবারে নিতে চান। তাই সেটা সমাধান করা সম্ভব হয়নি।

মঙ্গলবার, ২৬ অক্টোবর ২০২১ , ১০ কার্তিক ১৪২৮ ১৮ রবিউল আউয়াল ১৪৪৩

মহাদেবপুরে দাদন ব্যবসায়ীর খপ্পরে সর্বস্বান্ত পারুলের পরিবার

প্রতিনিধি, মহাদেবপুর (নওগাঁ)

স্বামী আর দুই ছেলেকে নিয়ে সুখের সংসার ছিল নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলার খাজুর ইউনিয়নের কর্ণতৈড় কুমারপাড়া গ্রামের গৃহবধূ পারুল রাণী ম-লের। নিজের ১০ কাঠা জমি। অন্যের জমি বর্গা নিয়ে পরিবারের সবাই মিলে ফসল ফলিয়ে মাটির দোতালা বাড়িও বানিয়েছেন। তার এ সুখ বেশিদিন আর সইলো না। এলাকার দাদন ব্যবসায়ীদের খপ্পড়ে পড়ে মাত্র দুই বছরে নিস্ব হয়েছে পরিবারটি। ৫০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে এখন তার মাথায় ৫০ লাখ টাকার ঋণের বোঝা। অসংখ্য মামলা। আদালতে হাজিরা দিতে হয় প্রায়ই। পুলিশ ধরেও নিয়ে যায়। তাই পুলিশের ভয়ে পালিয়ে থাকতে হয় দিনের পর দিন। তাকে নিয়ে এলাকাবাসী দাদন ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে মানববন্ধন করেছেন। সমাবেশও করেছেন। বৈঠক করেছেন স্থানীয় প্রশাসন। কিন্তু কেউই তার ঋণের বোঝা কমাতে পারেননি। পারুল রাণী জানান, তার বড় ছেলে দুলাল চন্দ্রের একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পে চাকরির জন্য ৩ বছর আগে তার প্রতিবেশী বর্তমানে কুঞ্জবন বাজারে বসবাসকারী জালাল হোসেনের স্ত্রী হাসিনা খাতুনের কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকা ঋণ নেন। প্রতি সপ্তাহে তাকে ৫ হাজার টাকা সুদ দিতে হতো। এক পর্যায়ে সুদের টাকা দিতে না পারায় ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে দেবার অজুহাতে হাসিনা খাতুন পারুল রাণীকে জনতা ব্যাংক মহাদেবপুর শাখায় নিয়ে গিয়ে একটি একাউন্ট খুলে দেন। ব্যাংকের ১০ পাতার চেক বই হাসিনা তার নিজের কাছে রেখে দেয়। এরপর টাকা পরিশোধের জন্য হাসিনা খাতুন পারুল রাণীকে তার ১০ কাঠা জমি লিখে দিতে বলেন। পারুল জমি রেজিস্ট্রি করে দিতে অস্বীকার করলে হাসিনা খাতুন পারুল রাণীর বিরুদ্ধে নওগাঁর জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে ৬ লাখ টাকার চেক ডিজঅনারের মামলা দায়ের করেন। পারুল রাণী সে মামলায় জামিন নেন। তিনি জানান, প্রতি সপ্তাহে হাসিনা খাতুনের সুদের টাকার যোগান দিতে তিনি একে একে আশ্রয়, এসোড, বেডো, ব্র্যাক, গ্রামীণ ব্যাংক, আশা, ঠেঙ্গামারা, দিশারী, বর্ষা প্রভৃতি সমিতি থেকে ঋণ নেন। ব্যক্তি পর্যায়েও কয়েকজনের কাছ থেকে চড়া সুদে ঋণ নেন। এছাড়া তার প্রতিবেশীদের অনুরোধ করে তাদের নামেও ঋণ নিয়েছেন। একটির ঋণের কিস্তি শোধ করতে অন্য আর একটি থেকে ঋণ নিয়েছেন। কিন্তু সময়মতো শোধ করতে পারেননি কোনটিই। কোন কোন সমিতি তার বিরুদ্ধে চেকের মামলা করেছে, আবার কোনটি করেনি। কিছুদিন আগে একটি মামলায় পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে যায়। পরে জামিনে ছাড়া পান। যেসব প্রতিবেশী ঋণ নিয়ে পারুলকে দিয়েছেন তাদের নামেও মামলা হয়েছে। কাউকে কাউকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। পারুল অভিযোগ করেন যে, ব্র্যাক থেকে ৫০ হাজার টাকা নিয়ে হাসিনা খাতুনকে পরিশোধ করেছেন। কিন্তু হাসিনা সে টাকা সুদ হিসেবে নিয়ে আরও টাকা দাবি করছেন। দু’বছর আগে স্থানীয় এমপির ছেলে সাকলায়েন তরফদার রকির উদ্যোগে উপজেলা সদরে এলাকার দাদন ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে বিশাল সমাবেশ ও মানববন্ধনের আয়োজন করা হয়। সে সমাবেশে পারুল খাতুন তার অসহায়ত্বের বর্ণনা দেন। পরে এ নিয়ে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান ও গণ্যমান্য ব্যক্তিসহ মহাদেবপুর থানায় বসা হয়। বৈঠকে হাসিনা খাতুনকে ৫০ হাজার টাকা নিয়ে আপোস করার কথা বলা হয়। কিন্তু তিনি তা মানেননি। কান্নাজড়িত কণ্ঠে পারুল রাণী জানান, তার ছেলের চাকরি হয়নি। দুছেলে ভিন্ন সংসার করেছে। আর তার স্বামী ঢাকায় গিয়ে দিনমজুরের কাজ করছেন। হাসিনা খাতুন জানান, পারুলের পরিবার তার ২০ বিঘা জমি বর্গা করতো। প্রতি সিজনে ২০০ মণ ধান উঠতো। এর অর্ধেকের মালিক তিনি। কিন্তু পারুল রাণী হাসিনার অংশের ধান না দিয়ে পাওনাদারদের দিয়ে দিতেন। এভাবে তার ৬ লাখ টাকা ঋণ হয়েছে। খাজুর ইউপি চেয়ারম্যান বেলাল উদ্দিন এ বিষয়ে দফায় দফায় বৈঠক হয়েছে বলে উল্লেখ করে জানান, সে টাকার সুদ, সুদের সুদ, তার সুদ হিসেব করে পুরো টাকা একবারে নিতে চান। তাই সেটা সমাধান করা সম্ভব হয়নি।