তিস্তা অববাহিকায় বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। তবে অসময়ের এই বন্যা কৃষকের সোনালি ফসল কেড়ে নিয়েছে। আর এই কারণেই তিস্তাপাড়ের কৃষকের চোখে-মুখে এখন অভাবের ছাপ। ফসল তো গিলে খেলো তিস্তা, এখন কি করে বছরের বাকি সময় পরিবার-পরিজন নিয়ে কাটবে তা নিয়ে বড় দুশ্চিন্তায় রয়েছেন কৃষকরা।
জেলার তিস্তা নদীবেষ্টিত সদর, আদিতমারি, কালিগঞ্জ, হাতীবান্ধা ও পাটগ্রামে সৃষ্ট এ বন্যায় বেশি ক্ষতির সম্মুখীন কৃষকরা। কার্তিকে পানিশূন্যে তিস্তার বুকে শীতকালীন শাকসবজি ছাড়াও বাদাম, আগাম আলু, মিষ্টি কুমড়া, ধান ও অন্যান্য ফসল বুনেছিলেন তারা। কিন্তু হঠাৎ ভারতের উজান থেকে ভাটিতে আসা পানিতে সবকিছু যেন শেষ হয়ে গেছে। নদী তীরবর্তী গ্রাম প্লাবিত হওয়ায় ফসলের চরম ক্ষতি হয়েছে।
বন্যায় ফসল হারিয়ে দিশেহারা লালমনিরহাটের কালিগঞ্জ উপজেলার চররুদ্রেশ্বর গ্রামের সাইদুর রহমান। কয়েক বিঘা জমিতে আমন ধান আবাদ করেছিলেন তিনি। একদিনের বন্যায় তার সব ফসল নষ্ট হয়ে গেছে। পরিবার-পরিজন নিয়ে কিভাবে বছরের বাকিটা সময় তিনি পার করবেনÑ তা নিয়ে পড়েছেন চরম দুশ্চিন্তায়।
কৃষি বিভাগ বলছে, আকস্মিক বন্যায় লালমনিরহাটের ৫টি উপজেলার নদীর তীরবর্তী ১৬ ইউনিয়নে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এক রাতের বন্যায় উঠতি আমন ধান ও অন্যান্য সবজির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। তাদের হিসেব মতে, জেলার ২ হাজার ৯৯৫ হেক্টর জমির আমন ধান ও অন্যান্য ফসল এই বন্যায় সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গেছে। এসব ফসল হারিয়ে চরম বেকায়দায় পড়েছেন কৃষকরা। তারা বলেন, আর অল্প কিছু দিনের মধ্যেই ধান ঘরে আসত। কিন্তু বন্যার পানি তাদের সব শেষ করে দিয়েছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, পানি কমে গেলেও বিভিন্ন ফসলের খেতগুলো এখনও পানিতে তলিয়ে আছে। স্থানীয় কৃষকরা জানায়, কিছু খেত থেকে পানি সরে গেলেও এসব খেতে ফসল আবাদ নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন তারা। পানি সরে যাওয়ার পর ফসলে পচন দেখা দিতে পারে।
কাকিনা ইউনিয়নের আফজাল হোসেন খান গ্রামের কৃষক নাছিমুুদ্দী বকস বলেন, ‘হামার আবাদি জমি সোগ তলে গেইচে। এ্যালা তিস্তার পানিত ধান, আলু, শাকসবজি সোগ ডুবি আছে। হঠাৎ এদোন করি ভারত পানি ছাড়লে হামরা বাঁচমো ক্যামন করি? একে তো গেল বানোত (বন্যা) হামার মেলা ক্ষয়ক্ষতি হইছে। তার ওপর এই অসময়ে ফির বান! নদী পাড়োত হামার সুখ-শান্তি নাই।’
রুদ্রেশ্বর গ্রামের কৃষক জয়নাল মিয়া বলেন, ??‘মহিপুর সেতুর কাছে চরোত একনা আগাম আলু আর মিষ্টিকুমড়া নাগাচুং (চাষাবাদ করা)। শীতের সময় নয়া আলুর দাম বেশি পাওয়া যায়। কিন্তু হঠাৎ তিস্তাত পানি বাড়ছে। হু হু করি পানি ঢুকি আবাদসুবাদ সোগে তলে গেইচে।’
কাকিনা ইউপি চেয়ারম্যান শহিদুল ইসলাম বলেন, অনেক এলাকায় এখনও মানুষজন পানিবন্দী রয়েছে। ফসলি জমির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। দহগ্রাম, গড্ডিমারি, সানিয়াযান, সিঙ্গিমারি, সির্ন্দুনা, ভোটমারি, মহিষখোচা, রাজপুর, খুনিয়াগাছ ও গোকুন্ড ইউনিয়নের অসংখ্য গ্রামের ফসলও পানির নিচে তলিয়ে গেছে বলে জানান সেখানকার চেয়ারম্যানরা।
কৃষি অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক শামীম আশরাফ বলেন, পানি কমে আসাতে এখন ক্ষতিগ্রস্ত ফসলি জমিগুলো একটু একটু দেখা যাচ্ছে। তবে এখনও ক্ষয়ক্ষতি নিরুপণ করা সম্ভব হয়নি। যেভাবে পানির স্রোত ছিল, তাতে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। পানি আরেকটু কমলে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের তালিকা করা হবে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) লালমনিরহাট কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী মিজানুর রহমান বলেন, দেশের উজানে ভারতের সিকিম, দার্জিলিং, জলপাইগুড়িতে ভারী বৃষ্টিপাত হয়েছে। সেখান থেকে ভাটির দিকে আসা পানিতে ফুলে ফেঁপে উঠেছে তিস্তা। পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে তিস্তা ব্যারাজের সবকটি জলকপাট খুলে রাখা হয়েছে। বর্তমানে বিপদসীমার নিচ দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। এদিকে তিস্তাপাড়ে সৃষ্ট বন্যার পানি নামতে শুরু করেছে। পানি কমে ভাঙন তীব্র হওয়াতে নদীগর্ভে বিলীন হচ্ছে ঘরবাড়ি, গাছগাছালিসহ বসতভিটা।
লালমনিরহাট : তিস্তায় হঠাৎ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ফসলের মাঠে কৃষকের হাহাকার -সংবাদ
আরও খবরমঙ্গলবার, ২৬ অক্টোবর ২০২১ , ১০ কার্তিক ১৪২৮ ১৮ রবিউল আউয়াল ১৪৪৩
মনিরুজ্জামান সরকার, লালমনিরহাট
লালমনিরহাট : তিস্তায় হঠাৎ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ফসলের মাঠে কৃষকের হাহাকার -সংবাদ
তিস্তা অববাহিকায় বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। তবে অসময়ের এই বন্যা কৃষকের সোনালি ফসল কেড়ে নিয়েছে। আর এই কারণেই তিস্তাপাড়ের কৃষকের চোখে-মুখে এখন অভাবের ছাপ। ফসল তো গিলে খেলো তিস্তা, এখন কি করে বছরের বাকি সময় পরিবার-পরিজন নিয়ে কাটবে তা নিয়ে বড় দুশ্চিন্তায় রয়েছেন কৃষকরা।
জেলার তিস্তা নদীবেষ্টিত সদর, আদিতমারি, কালিগঞ্জ, হাতীবান্ধা ও পাটগ্রামে সৃষ্ট এ বন্যায় বেশি ক্ষতির সম্মুখীন কৃষকরা। কার্তিকে পানিশূন্যে তিস্তার বুকে শীতকালীন শাকসবজি ছাড়াও বাদাম, আগাম আলু, মিষ্টি কুমড়া, ধান ও অন্যান্য ফসল বুনেছিলেন তারা। কিন্তু হঠাৎ ভারতের উজান থেকে ভাটিতে আসা পানিতে সবকিছু যেন শেষ হয়ে গেছে। নদী তীরবর্তী গ্রাম প্লাবিত হওয়ায় ফসলের চরম ক্ষতি হয়েছে।
বন্যায় ফসল হারিয়ে দিশেহারা লালমনিরহাটের কালিগঞ্জ উপজেলার চররুদ্রেশ্বর গ্রামের সাইদুর রহমান। কয়েক বিঘা জমিতে আমন ধান আবাদ করেছিলেন তিনি। একদিনের বন্যায় তার সব ফসল নষ্ট হয়ে গেছে। পরিবার-পরিজন নিয়ে কিভাবে বছরের বাকিটা সময় তিনি পার করবেনÑ তা নিয়ে পড়েছেন চরম দুশ্চিন্তায়।
কৃষি বিভাগ বলছে, আকস্মিক বন্যায় লালমনিরহাটের ৫টি উপজেলার নদীর তীরবর্তী ১৬ ইউনিয়নে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এক রাতের বন্যায় উঠতি আমন ধান ও অন্যান্য সবজির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। তাদের হিসেব মতে, জেলার ২ হাজার ৯৯৫ হেক্টর জমির আমন ধান ও অন্যান্য ফসল এই বন্যায় সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গেছে। এসব ফসল হারিয়ে চরম বেকায়দায় পড়েছেন কৃষকরা। তারা বলেন, আর অল্প কিছু দিনের মধ্যেই ধান ঘরে আসত। কিন্তু বন্যার পানি তাদের সব শেষ করে দিয়েছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, পানি কমে গেলেও বিভিন্ন ফসলের খেতগুলো এখনও পানিতে তলিয়ে আছে। স্থানীয় কৃষকরা জানায়, কিছু খেত থেকে পানি সরে গেলেও এসব খেতে ফসল আবাদ নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন তারা। পানি সরে যাওয়ার পর ফসলে পচন দেখা দিতে পারে।
কাকিনা ইউনিয়নের আফজাল হোসেন খান গ্রামের কৃষক নাছিমুুদ্দী বকস বলেন, ‘হামার আবাদি জমি সোগ তলে গেইচে। এ্যালা তিস্তার পানিত ধান, আলু, শাকসবজি সোগ ডুবি আছে। হঠাৎ এদোন করি ভারত পানি ছাড়লে হামরা বাঁচমো ক্যামন করি? একে তো গেল বানোত (বন্যা) হামার মেলা ক্ষয়ক্ষতি হইছে। তার ওপর এই অসময়ে ফির বান! নদী পাড়োত হামার সুখ-শান্তি নাই।’
রুদ্রেশ্বর গ্রামের কৃষক জয়নাল মিয়া বলেন, ??‘মহিপুর সেতুর কাছে চরোত একনা আগাম আলু আর মিষ্টিকুমড়া নাগাচুং (চাষাবাদ করা)। শীতের সময় নয়া আলুর দাম বেশি পাওয়া যায়। কিন্তু হঠাৎ তিস্তাত পানি বাড়ছে। হু হু করি পানি ঢুকি আবাদসুবাদ সোগে তলে গেইচে।’
কাকিনা ইউপি চেয়ারম্যান শহিদুল ইসলাম বলেন, অনেক এলাকায় এখনও মানুষজন পানিবন্দী রয়েছে। ফসলি জমির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। দহগ্রাম, গড্ডিমারি, সানিয়াযান, সিঙ্গিমারি, সির্ন্দুনা, ভোটমারি, মহিষখোচা, রাজপুর, খুনিয়াগাছ ও গোকুন্ড ইউনিয়নের অসংখ্য গ্রামের ফসলও পানির নিচে তলিয়ে গেছে বলে জানান সেখানকার চেয়ারম্যানরা।
কৃষি অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক শামীম আশরাফ বলেন, পানি কমে আসাতে এখন ক্ষতিগ্রস্ত ফসলি জমিগুলো একটু একটু দেখা যাচ্ছে। তবে এখনও ক্ষয়ক্ষতি নিরুপণ করা সম্ভব হয়নি। যেভাবে পানির স্রোত ছিল, তাতে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। পানি আরেকটু কমলে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের তালিকা করা হবে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) লালমনিরহাট কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী মিজানুর রহমান বলেন, দেশের উজানে ভারতের সিকিম, দার্জিলিং, জলপাইগুড়িতে ভারী বৃষ্টিপাত হয়েছে। সেখান থেকে ভাটির দিকে আসা পানিতে ফুলে ফেঁপে উঠেছে তিস্তা। পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে তিস্তা ব্যারাজের সবকটি জলকপাট খুলে রাখা হয়েছে। বর্তমানে বিপদসীমার নিচ দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। এদিকে তিস্তাপাড়ে সৃষ্ট বন্যার পানি নামতে শুরু করেছে। পানি কমে ভাঙন তীব্র হওয়াতে নদীগর্ভে বিলীন হচ্ছে ঘরবাড়ি, গাছগাছালিসহ বসতভিটা।