স্বাধীনতার প্রথম গণনাট্য ‘এক নদী রক্ত’ ও শেখ কামাল

মোস্তাফা জব্বার

এক ॥

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বড় ছেলে ক্যাপ্টেন শহীদ শেখ কামালের জন্মদিন গেল ৫ আগস্ট। এবার ২০২১ সালে তার ৭২তম জন্মবার্ষিকী পালিত হলো। এই বছরটি আমাদের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। খুব সঙ্গত কারণেই আমরা তার জন্মদিনে ডাক টিকিট প্রকাশ করেছি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিজে তার জন্মদিনের ডাক টিকিট অবমুক্ত করেন। ডাক টিকিট অবমুক্তকালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী অশ্রুসজল চোখে স্মৃতি কাতর হয়ে পড়েন। শেখ কামাল সংগীত, নাটক, ক্রীড়া ও সামাজিক আন্দোলন নিয়ে যে ব্যাপক কর্মকা- করেন তার স্মৃতিচারণ করেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও তার দুই ভাই শেখ কামাল ও শেখ জামাল এবং বোন শেখ রেহানা ডাক টিকিট সংগ্রহ করতেন। তাদের মাঝে প্রতিযোগিতাও হতো। প্রধানমন্ত্রী ও শহীদ শেখ জামাল একদিকে আর অন্য দিকে শহীদ শেখ কামাল ও শেখ রেহানা থাকতেন অন্যদিকে।

এই বছরই শেখ কামাল অভিনীত মুক্তিযুদ্ধের প্রথম গণনাট্য এক নদী রক্ত মঞ্চায়নেরও সুবর্ণজয়ন্তী। সেই দিনটি ২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৭১ স্মরণ করে আরও একটি ডাক টিকিট অবমুক্ত করা হয়। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবার শুধু যে এই রাষ্ট্র গঠনে তাদের ভূমিকা রেখেছেন সেটাই নয়, স্বাধীনতা যুদ্ধ ও তার প্রস্তুতিতে তাদের রয়েছে অনন্য অবদান। বাংলাদেশ গর্বিত যে এই দেশটির প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন শেখ হাসিনা, যার হাত ধরে তলাহীন ঝুড়ির দেশ থেকে আমরা অনুকরণীয় দেশে পরিণত হয়েছি। তবে বাস্তবতা হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর বড় ছেলে শেখ কামাল বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর পরেও অনালোচিত একজন মানুষ। যে মানুষটি আজও আমার মতো সক্রিয় জীবনযাপন করতে পারত যাকে ঘাতকরা সপরিবারে মাত্র ২৬ বছর বয়সে খুন করেছে এবং ২৬ বছর জীবনের অর্জনগুলো যেখানে প্রায় নীরবে হারিয়ে যাচ্ছে তখন মনে হলো তার সম্পর্কে আমি যেটুকু জানি সেটুকু কেন দুনিয়াকে জানিয়ে যাই না। আমি নিশ্চিত শেখ কামালের জীবনের একটি অংশ যা নিয়ে আমি আলোচনা করব তা আর কেউ কোনদিন লেখেননি। অনেকেই হয়তো বিষয়টি জানেনও না। যারা লিখতে পারতেন তাদের কেউ কেউ বেঁচে নেই। যারা বেঁচে আছেন এবং যার কাছ থেকে তথ্য নিয়ে আমি সব কথা লিখছি সেই বন্ধু জালাল বহু বছর আগে শেখ কামাল, নাট্য একাডেমি ও এক নদী রক্ত নিয়ে একটি নিবন্ধ লিখেছে। আমি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সেটি প্রকাশ করেছি। তাতে শেখ কামালের বিষয়ও বেশ ভালোভাবে উল্লেখ আছে। জালালের সঙ্গে কথা বলে আমার ধারণা হয়েছে জালাল আরও বিস্তৃত করে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতে পারে। প্রয়াত আফতাব শেখ কামালের ভালো-মন্দ নিয়ে লিখতে পারত। ওর স্মৃতিশক্তি আরও প্রখর ছিল। দিন-ক্ষণ ঘটনা সবই মনে রাখতো আফতাব। কিন্তু সে আজ আর বেঁচে নেই। লিখতে পারত শাহ হেলালুর রহমান চিশতি। সে একাত্তরেই শহীদ হয়েছে। নাটক করার ১ মাস ৩ দিন পরই তাকে পাকিস্তানিরা হত্যা করে। আমি চেষ্টা করব শেখ কামালের যেসব বন্ধু এখনও বেঁচে আছেন তাদের কথাও শুনতে।

শেখ কামালের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা ঢাকা কলেজে। আমি সেই কলেজে ভর্তি হই ১৯৬৬ সালের জুলাই মাসে। তখন জুলাই মাসেই শিক্ষাবর্ষ শুরু হতো। এর আগে গ্রামের স্কুলে পড়তাম বলে ছাত্র রাজনীতির কিছু বুঝতাম না। শুধু মনে পড়ে ১৯৬২ সালে শিক্ষা আন্দোলনের সময় আমরা সেই স্কুলের ছাত্ররা নৌ মিছিল করেছিলাম। একটি লঞ্চে চড়ে অন্য একটি স্কুলে গিয়ে সেখানকার ছাত্রদের সঙ্গে মিলে হামুদুর রহমান শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে সেøাগান দিয়েছিলাম। সেই সময়ে শুধু সেভেনে পড়ি। বড়রা যা বলতেন তাই করতাম। এরপর ১৯৬৫ সালে প্রথম ঢাকা শহরে এসে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কুশপুত্তলিকা দাহ করতে দেখেছিলাম। এর বাইরে রাজনীতি কি তা জানতাম না। তবে ঢাকা কলেজের কঠিন নিয়ম-কানুন মেনে লেখাপড়া করার ফাঁকে জড়িয়ে যাই বাংলাদেশ ছাত্রলীগের রাজনীতিতে। আমার ঢাকা কলেজের ক্লাসমেট ও বন্ধু ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কামালউদ্দিন ছাত্র রাজনীতিতে অনেক বেশি সক্রিয় ছিল। বন্ধুদের সঙ্গে ছাত্রলীগ করার ঝোঁক ছাড়াও প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে আসা তরুণের জন্য বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা একটি বড় আকর্ষণের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। আমি উর্দু পছন্দ করতাম না। স্কুলে আমাকে উর্দু পড়তে বাধ্য করা হয়েছিল। আমি তাতে মাত্র ৩৩ নাম্বার পেয়েছিলাম। সেই উর্দু তথা পাকিস্তান বিদ্বেষ ছাত্রলীগের রাজনীতিতে যুক্ত হওয়ার অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে।

আমরা ঢাকা কলেজে রাজনীতি শব্দটিও উচ্চারণ করতে পারতাম না। তখনকার অধ্যক্ষ জালালউদ্দিন সাহেব (শহীদ আইভি রহমানের বাবা-প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের শ্বশুর) সাহেব কারও মুখ থেকে রাজনীতি শব্দটি উচ্চারণ করতে দিতেন না। সরকারি কর্মকর্তা হবার সুবাদে আইয়ূব-মোনেমের অনুসারী এই মানুষটি ঢাকা কলেজকে রীতিমতো কারাগারে পরিণত করেছিলেন। আমরা কলেজের গেটের বাইরে এসে ছাত্রলীগের লিফলেট বিলাতাম। শেখ কামাল ৬৭ সালে ঢাকা কলেজে ভর্তি হলে কলেজে ছাত্র রাজনীতির ছকটাই বদলে যায়। কামাল অনেক এগ্রেসিভ ছিল। কলেজ চত্বরে মিছিলও করেছে। বঙ্গবন্ধুর জনপ্রিয়তা বাড়ার পাশাপাশি ছাত্রলীগের শক্তি বাড়তে থাকায় আমরা অনেক সাহসী হতে পারি। ৬৮ সাল নাগাদ আমরা কলেজের নিয়ম দারুণভাবে ভাঙতে সক্ষম হই। কলেজের অধ্যক্ষ মহোদয় অনুভব করতে থাকেন যে, ঢাকা কলেজ আর সরকারি কলেজ নেই, সেটি আন্দোলনের সূতিকাগারে পরিণত হয়েছে। তখন ঢাকা কলেজ থেকে বটতলায় বড় মিছিলটা যেত। এটি হয়তো বিস্ময়কর মনে হতে পারে যে সেই সময়ে ঢাকা কলেজে ছাত্রলীগ ছাড়া আর কোন সংগঠনও ছিল না। দেশে তখন সরকারি ছাত্র সংগঠন এনএসএফ, ছাত্র ইউনিয়ন মতিয়া ও ছাত্র ইউনিয়ন মেনন নামক ছাত্র সংগঠনগুলো জনপ্রিয় ছিল। ঢাকা কলেছে ছাত্রলীগ ছাড়া অন্যগুলোর কোন অস্তিত্ব¡ই ছিল না। ৬৬ সালের পর থেকে ছাত্র আন্দোলন জোরদার হতে থাকলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলা হয়ে ওঠে আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু। তখন ঢাকা কলেজ ছাড়াও জগন্নাথ কলেজ থেকেও আসতো বড় মিছিল। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসি ৬৮ সালে। সদ্য নির্মিত মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ হলে তখন এনএসএফের দাপট। ৬৮ সালে আমরা এক সঙ্গে ১৬০ জন ছাত্রলীগ কর্মী সেই হলে ঢুকি ও এনএসএপকে হল থেকে তাড়াতে সক্ষম হই। ঢাকা কলেজে দাপটের সঙ্গে ছাত্রলীগ করে সেই শেখ কামাল ৬৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ছাত্রলীগের কর্মী হিসেবে আমরা তখন আবারও একসঙ্গে কাজ করার সুযোগ পাই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তখন আইয়ূববিরোধী আন্দোলনের সূতিকাগার।

৬৮ সালে যেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস করতে যাই সেদিনই বটতলায় টিয়ারগ্যাস খাই। সেই ধারা অব্যাহত থাকে ৬৯ সালে শেখ কামাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করে আমাদের প্রচলিত ধারার পথচলাকে বদলে দিতে শুরু করে। তখন দেশের ছাত্র সমাজের একটি ধারণা ছিল যে ছাত্রলীগ রাজনীতি বা সভা সমাবেশ-মিছিল ছাড়া আর কিছু জানে না। অন্যদিকে ছাত্র ইউনিয়ন মতিয়া গ্রুপ সাংস্কৃতিক ধারায় অনেক উজ্জীবিত। এটা কিছুটা সত্যও বটে। ৬৮ সালে আমরা যে গ্রুপটি মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ হলে ঢুকি তাদের যেমন ছিল মেধা তেমনি সংস্কৃতি চর্চাও তাদের মাঝে ছিল। আমরা বিশেষত নাটকে আকৃষ্ট হই। আমার বন্ধু জালাল গানও গাই তো। শেখ কামাল এসে নাটক, গান, ক্রীড়া সব ক্ষেত্রেই ছাত্রলীগকে এগিয়ে নিয়ে যান। সেই সময়ে ছাত্র ইউনিয়নের নাটকের প্ল্যাটফর্ম ছিল নাট্যচক্র। আমরা নাট্য একাডেমির মাধ্যমে ছাত্রলীগের কর্মীদের সমন্বিত করার চেষ্টা করি। আমাদের ছাত্রলীগের কর্মীদের প্রথম প্রয়াস ছিল লালন ফকির। আমরা এই নাটকের মধ্য দিয়ে নিজেদের নাট্যপ্রতিভার প্রমাণ তুলে ধরতে চেয়েছিলাম। এক সময়কার বিখ্যাত নায়ক উজ্জ্বল ও বুলবুল আহমদ এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত হন। এর বাইরে আব্দুল্লা আল মামুনসহ টিভিতে কর্মরত অনেকে। শেখ কামাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার পর ছাত্রলীগ কর্মীদের নাট্য চর্চার গতিও বাড়তে থাকে।

তখনই তার সঙ্গে আমরা নাট্য একাডেমির কর্মীরা পরিচিত হই। এক নদী রক্ত নামক দেশের প্রথম গণনাট্য আমাদেরই প্রযোজনা ছিল। শেখ কামাল ছিল সেই নাটকের অভিনেতা আর আমি ছিলাম এর লেখক। তার লেখায় নাটকটি সম্পর্কে বলা হয়েছে, “এক নদী রক্ত : একটি সফল গণনাটক : গণনাটক হিসেবে এক নদী রক্ত ছিল এ দেশের প্রথম সফল প্রয়াস। দর্শকবৃন্দের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়াই তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ। নাটকে মিলিটারি মেজর (মহসীন ভাই) যখন ধমক দিয়েছিল, “কে গায়? স্তব্ধ করে দাও ওই কণ্ঠকে,” তখন দর্শকদের ভেতর থেকে বিকট শব্দে উচ্চারিত হয়েছিল, “তোর বাবা গায়, শালা।” শুধু তাই নয়, শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নাটকের ওঠানামার সঙ্গে দর্শকবৃন্দের অনুভূতি ও অভিব্যক্তি তরঙ্গায়িত হয়েছে। নাটকের প্রতিটি মিছিলে, সেøাগানে, সংঘর্ষে সব দর্শকই নিজের উপস্থিতি খুঁজে পেয়েছেন। উত্তেজিত হয়েছেন, পাকিস্তানি শাসকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী আক্রোশে নিজের মধ্যেই গর্জে উঠেছেন। মানুষের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের স্তূপে আগুনের শলাকার মতো আঘাত করে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে দিয়েছে এক নদী রক্ত। (চলমান)

ঢাকা। ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১২। সর্বশেষ সম্পাদনা: ০৭ আগস্ট, ২০২১।

[লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, কলামিস্ট, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাসের চেয়ারম্যান- সাংবাদিক, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যারের জনক]

মঙ্গলবার, ২৬ অক্টোবর ২০২১ , ১০ কার্তিক ১৪২৮ ১৮ রবিউল আউয়াল ১৪৪৩

স্বাধীনতার প্রথম গণনাট্য ‘এক নদী রক্ত’ ও শেখ কামাল

মোস্তাফা জব্বার

এক ॥

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বড় ছেলে ক্যাপ্টেন শহীদ শেখ কামালের জন্মদিন গেল ৫ আগস্ট। এবার ২০২১ সালে তার ৭২তম জন্মবার্ষিকী পালিত হলো। এই বছরটি আমাদের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। খুব সঙ্গত কারণেই আমরা তার জন্মদিনে ডাক টিকিট প্রকাশ করেছি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিজে তার জন্মদিনের ডাক টিকিট অবমুক্ত করেন। ডাক টিকিট অবমুক্তকালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী অশ্রুসজল চোখে স্মৃতি কাতর হয়ে পড়েন। শেখ কামাল সংগীত, নাটক, ক্রীড়া ও সামাজিক আন্দোলন নিয়ে যে ব্যাপক কর্মকা- করেন তার স্মৃতিচারণ করেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও তার দুই ভাই শেখ কামাল ও শেখ জামাল এবং বোন শেখ রেহানা ডাক টিকিট সংগ্রহ করতেন। তাদের মাঝে প্রতিযোগিতাও হতো। প্রধানমন্ত্রী ও শহীদ শেখ জামাল একদিকে আর অন্য দিকে শহীদ শেখ কামাল ও শেখ রেহানা থাকতেন অন্যদিকে।

এই বছরই শেখ কামাল অভিনীত মুক্তিযুদ্ধের প্রথম গণনাট্য এক নদী রক্ত মঞ্চায়নেরও সুবর্ণজয়ন্তী। সেই দিনটি ২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৭১ স্মরণ করে আরও একটি ডাক টিকিট অবমুক্ত করা হয়। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবার শুধু যে এই রাষ্ট্র গঠনে তাদের ভূমিকা রেখেছেন সেটাই নয়, স্বাধীনতা যুদ্ধ ও তার প্রস্তুতিতে তাদের রয়েছে অনন্য অবদান। বাংলাদেশ গর্বিত যে এই দেশটির প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন শেখ হাসিনা, যার হাত ধরে তলাহীন ঝুড়ির দেশ থেকে আমরা অনুকরণীয় দেশে পরিণত হয়েছি। তবে বাস্তবতা হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর বড় ছেলে শেখ কামাল বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর পরেও অনালোচিত একজন মানুষ। যে মানুষটি আজও আমার মতো সক্রিয় জীবনযাপন করতে পারত যাকে ঘাতকরা সপরিবারে মাত্র ২৬ বছর বয়সে খুন করেছে এবং ২৬ বছর জীবনের অর্জনগুলো যেখানে প্রায় নীরবে হারিয়ে যাচ্ছে তখন মনে হলো তার সম্পর্কে আমি যেটুকু জানি সেটুকু কেন দুনিয়াকে জানিয়ে যাই না। আমি নিশ্চিত শেখ কামালের জীবনের একটি অংশ যা নিয়ে আমি আলোচনা করব তা আর কেউ কোনদিন লেখেননি। অনেকেই হয়তো বিষয়টি জানেনও না। যারা লিখতে পারতেন তাদের কেউ কেউ বেঁচে নেই। যারা বেঁচে আছেন এবং যার কাছ থেকে তথ্য নিয়ে আমি সব কথা লিখছি সেই বন্ধু জালাল বহু বছর আগে শেখ কামাল, নাট্য একাডেমি ও এক নদী রক্ত নিয়ে একটি নিবন্ধ লিখেছে। আমি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সেটি প্রকাশ করেছি। তাতে শেখ কামালের বিষয়ও বেশ ভালোভাবে উল্লেখ আছে। জালালের সঙ্গে কথা বলে আমার ধারণা হয়েছে জালাল আরও বিস্তৃত করে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতে পারে। প্রয়াত আফতাব শেখ কামালের ভালো-মন্দ নিয়ে লিখতে পারত। ওর স্মৃতিশক্তি আরও প্রখর ছিল। দিন-ক্ষণ ঘটনা সবই মনে রাখতো আফতাব। কিন্তু সে আজ আর বেঁচে নেই। লিখতে পারত শাহ হেলালুর রহমান চিশতি। সে একাত্তরেই শহীদ হয়েছে। নাটক করার ১ মাস ৩ দিন পরই তাকে পাকিস্তানিরা হত্যা করে। আমি চেষ্টা করব শেখ কামালের যেসব বন্ধু এখনও বেঁচে আছেন তাদের কথাও শুনতে।

শেখ কামালের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা ঢাকা কলেজে। আমি সেই কলেজে ভর্তি হই ১৯৬৬ সালের জুলাই মাসে। তখন জুলাই মাসেই শিক্ষাবর্ষ শুরু হতো। এর আগে গ্রামের স্কুলে পড়তাম বলে ছাত্র রাজনীতির কিছু বুঝতাম না। শুধু মনে পড়ে ১৯৬২ সালে শিক্ষা আন্দোলনের সময় আমরা সেই স্কুলের ছাত্ররা নৌ মিছিল করেছিলাম। একটি লঞ্চে চড়ে অন্য একটি স্কুলে গিয়ে সেখানকার ছাত্রদের সঙ্গে মিলে হামুদুর রহমান শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে সেøাগান দিয়েছিলাম। সেই সময়ে শুধু সেভেনে পড়ি। বড়রা যা বলতেন তাই করতাম। এরপর ১৯৬৫ সালে প্রথম ঢাকা শহরে এসে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কুশপুত্তলিকা দাহ করতে দেখেছিলাম। এর বাইরে রাজনীতি কি তা জানতাম না। তবে ঢাকা কলেজের কঠিন নিয়ম-কানুন মেনে লেখাপড়া করার ফাঁকে জড়িয়ে যাই বাংলাদেশ ছাত্রলীগের রাজনীতিতে। আমার ঢাকা কলেজের ক্লাসমেট ও বন্ধু ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কামালউদ্দিন ছাত্র রাজনীতিতে অনেক বেশি সক্রিয় ছিল। বন্ধুদের সঙ্গে ছাত্রলীগ করার ঝোঁক ছাড়াও প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে আসা তরুণের জন্য বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা একটি বড় আকর্ষণের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। আমি উর্দু পছন্দ করতাম না। স্কুলে আমাকে উর্দু পড়তে বাধ্য করা হয়েছিল। আমি তাতে মাত্র ৩৩ নাম্বার পেয়েছিলাম। সেই উর্দু তথা পাকিস্তান বিদ্বেষ ছাত্রলীগের রাজনীতিতে যুক্ত হওয়ার অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে।

আমরা ঢাকা কলেজে রাজনীতি শব্দটিও উচ্চারণ করতে পারতাম না। তখনকার অধ্যক্ষ জালালউদ্দিন সাহেব (শহীদ আইভি রহমানের বাবা-প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের শ্বশুর) সাহেব কারও মুখ থেকে রাজনীতি শব্দটি উচ্চারণ করতে দিতেন না। সরকারি কর্মকর্তা হবার সুবাদে আইয়ূব-মোনেমের অনুসারী এই মানুষটি ঢাকা কলেজকে রীতিমতো কারাগারে পরিণত করেছিলেন। আমরা কলেজের গেটের বাইরে এসে ছাত্রলীগের লিফলেট বিলাতাম। শেখ কামাল ৬৭ সালে ঢাকা কলেজে ভর্তি হলে কলেজে ছাত্র রাজনীতির ছকটাই বদলে যায়। কামাল অনেক এগ্রেসিভ ছিল। কলেজ চত্বরে মিছিলও করেছে। বঙ্গবন্ধুর জনপ্রিয়তা বাড়ার পাশাপাশি ছাত্রলীগের শক্তি বাড়তে থাকায় আমরা অনেক সাহসী হতে পারি। ৬৮ সাল নাগাদ আমরা কলেজের নিয়ম দারুণভাবে ভাঙতে সক্ষম হই। কলেজের অধ্যক্ষ মহোদয় অনুভব করতে থাকেন যে, ঢাকা কলেজ আর সরকারি কলেজ নেই, সেটি আন্দোলনের সূতিকাগারে পরিণত হয়েছে। তখন ঢাকা কলেজ থেকে বটতলায় বড় মিছিলটা যেত। এটি হয়তো বিস্ময়কর মনে হতে পারে যে সেই সময়ে ঢাকা কলেজে ছাত্রলীগ ছাড়া আর কোন সংগঠনও ছিল না। দেশে তখন সরকারি ছাত্র সংগঠন এনএসএফ, ছাত্র ইউনিয়ন মতিয়া ও ছাত্র ইউনিয়ন মেনন নামক ছাত্র সংগঠনগুলো জনপ্রিয় ছিল। ঢাকা কলেছে ছাত্রলীগ ছাড়া অন্যগুলোর কোন অস্তিত্ব¡ই ছিল না। ৬৬ সালের পর থেকে ছাত্র আন্দোলন জোরদার হতে থাকলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলা হয়ে ওঠে আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু। তখন ঢাকা কলেজ ছাড়াও জগন্নাথ কলেজ থেকেও আসতো বড় মিছিল। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসি ৬৮ সালে। সদ্য নির্মিত মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ হলে তখন এনএসএফের দাপট। ৬৮ সালে আমরা এক সঙ্গে ১৬০ জন ছাত্রলীগ কর্মী সেই হলে ঢুকি ও এনএসএপকে হল থেকে তাড়াতে সক্ষম হই। ঢাকা কলেজে দাপটের সঙ্গে ছাত্রলীগ করে সেই শেখ কামাল ৬৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ছাত্রলীগের কর্মী হিসেবে আমরা তখন আবারও একসঙ্গে কাজ করার সুযোগ পাই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তখন আইয়ূববিরোধী আন্দোলনের সূতিকাগার।

৬৮ সালে যেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস করতে যাই সেদিনই বটতলায় টিয়ারগ্যাস খাই। সেই ধারা অব্যাহত থাকে ৬৯ সালে শেখ কামাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করে আমাদের প্রচলিত ধারার পথচলাকে বদলে দিতে শুরু করে। তখন দেশের ছাত্র সমাজের একটি ধারণা ছিল যে ছাত্রলীগ রাজনীতি বা সভা সমাবেশ-মিছিল ছাড়া আর কিছু জানে না। অন্যদিকে ছাত্র ইউনিয়ন মতিয়া গ্রুপ সাংস্কৃতিক ধারায় অনেক উজ্জীবিত। এটা কিছুটা সত্যও বটে। ৬৮ সালে আমরা যে গ্রুপটি মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ হলে ঢুকি তাদের যেমন ছিল মেধা তেমনি সংস্কৃতি চর্চাও তাদের মাঝে ছিল। আমরা বিশেষত নাটকে আকৃষ্ট হই। আমার বন্ধু জালাল গানও গাই তো। শেখ কামাল এসে নাটক, গান, ক্রীড়া সব ক্ষেত্রেই ছাত্রলীগকে এগিয়ে নিয়ে যান। সেই সময়ে ছাত্র ইউনিয়নের নাটকের প্ল্যাটফর্ম ছিল নাট্যচক্র। আমরা নাট্য একাডেমির মাধ্যমে ছাত্রলীগের কর্মীদের সমন্বিত করার চেষ্টা করি। আমাদের ছাত্রলীগের কর্মীদের প্রথম প্রয়াস ছিল লালন ফকির। আমরা এই নাটকের মধ্য দিয়ে নিজেদের নাট্যপ্রতিভার প্রমাণ তুলে ধরতে চেয়েছিলাম। এক সময়কার বিখ্যাত নায়ক উজ্জ্বল ও বুলবুল আহমদ এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত হন। এর বাইরে আব্দুল্লা আল মামুনসহ টিভিতে কর্মরত অনেকে। শেখ কামাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার পর ছাত্রলীগ কর্মীদের নাট্য চর্চার গতিও বাড়তে থাকে।

তখনই তার সঙ্গে আমরা নাট্য একাডেমির কর্মীরা পরিচিত হই। এক নদী রক্ত নামক দেশের প্রথম গণনাট্য আমাদেরই প্রযোজনা ছিল। শেখ কামাল ছিল সেই নাটকের অভিনেতা আর আমি ছিলাম এর লেখক। তার লেখায় নাটকটি সম্পর্কে বলা হয়েছে, “এক নদী রক্ত : একটি সফল গণনাটক : গণনাটক হিসেবে এক নদী রক্ত ছিল এ দেশের প্রথম সফল প্রয়াস। দর্শকবৃন্দের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়াই তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ। নাটকে মিলিটারি মেজর (মহসীন ভাই) যখন ধমক দিয়েছিল, “কে গায়? স্তব্ধ করে দাও ওই কণ্ঠকে,” তখন দর্শকদের ভেতর থেকে বিকট শব্দে উচ্চারিত হয়েছিল, “তোর বাবা গায়, শালা।” শুধু তাই নয়, শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নাটকের ওঠানামার সঙ্গে দর্শকবৃন্দের অনুভূতি ও অভিব্যক্তি তরঙ্গায়িত হয়েছে। নাটকের প্রতিটি মিছিলে, সেøাগানে, সংঘর্ষে সব দর্শকই নিজের উপস্থিতি খুঁজে পেয়েছেন। উত্তেজিত হয়েছেন, পাকিস্তানি শাসকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী আক্রোশে নিজের মধ্যেই গর্জে উঠেছেন। মানুষের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের স্তূপে আগুনের শলাকার মতো আঘাত করে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে দিয়েছে এক নদী রক্ত। (চলমান)

ঢাকা। ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১২। সর্বশেষ সম্পাদনা: ০৭ আগস্ট, ২০২১।

[লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, কলামিস্ট, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাসের চেয়ারম্যান- সাংবাদিক, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যারের জনক]