চট্টগ্রামে মান্নান ফ্লাইওভারে ফাটল

নির্মাণ ত্রুটির অভিযোগ সিসিসি’র

চট্টগ্রামের বহদ্দারহাট এমএ মান্নান ফ্লাইওভারে র‌্যাম্পের পিলারে ফাটল দেখা দেয়ায় নির্মাণ ত্রুটির অভিযোগ করছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (সিসিসি)। তবে ফ্লাইওভারের র‌্যাম্পটি নির্মাণ করা হয়েছিল হালকা যানবাহন চলাচলের জন্য। কিন্তু তা দিয়ে ভারী যানবাহন চলায় এই ফাটলের কারণ বলছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)।

বহদ্দারহাটে এমএ মান্নান ফ্লাইওভারটি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (সিসিসি) রক্ষণাবেক্ষণে থাকলেও এটি নির্মাণ করেছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)। তাই র‌্যাম্পের ফাটল নিয়ে একে অপরের ওপর দোষারোপ করছে দুই সংস্থা।

স্থানীয় সূত্র জানায়, চট্টগ্রামের বহদ্দারহাট এমএ মান্নান ফ্লাইওভারে যে র‌্যাম্পের পিলারে ফাটল দেয়া দিয়েছে নকশায় র‌্যাম্পটি ছিল না। স্থানীয়দের দাবির মুখে ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে আরাকান সড়কমুখী ওই র‌্যাম্প (ফ্লাইওভারের সঙ্গে অন্য সড়কের সংযোগকারী) নির্মাণ করে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)।

সিডিএর ১০৬ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০১০ সালের ডিসেম্বরে এই ফ্লাইওভারের নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছিল। তবে তখন নকশায় র‌্যাম্পটি ছিল না। সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে ফ্লাইওভারটিতে লুপ নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়েছিল। তবে তা না মেনে লুপ ছাড়াই সেটি চালু করা হয় ২০১৩ সালে। ফ্লাইওভারটি কার্যকর না হওয়ায় স্থানীয়দের দাবির মুখে ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে আরাকান সড়কমুখী ওই র‌্যাম্প (ফ্লাইওভারের সঙ্গে অন্য সড়কের সংযোগকারী) নির্মাণের উদ্যোগ নেয় সিডিএ। ৩২৬ মিটার দীর্ঘ এবং ৬ দশমিক ৭ মিটার চওড়া র‌্যাম্পটি নির্মাণ শেষে পরের বছর তা চালু করা হয়।

চট্টগ্রামের চান্দগাঁও থানা এলাকা থেকে বহদ্দারহাট মোড় পর্যন্ত ১ দশমিক ৩৩ কিলোমিটার এ ফ্লাইওভার ২০১৩ সালে উদ্বোধন হয়। তবে যেখানে ফাটল ধরেছে, সেই র‌্যাম্পটি প্রায় চার বছর পর চালু হয়। ২০১৯ সালে সিডিএর কাছ থেকে ফ্লাইওভারটি বুঝে পায় সিসিসি। গত সোমবার রাতে ফ্লাইওভারটির একমাত্র র‌্যাম্পের পিলারে ফাটল দেখা দিলে সেটিতে যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়।

এ বিষয়ে সিডিএর প্রকৌশলী মাহফুজুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, ‘ফ্লাইওভারের র‌্যাম্পটি করা হয়েছিল হালকা যানবাহন চলার জন্য। কিন্তু তা দিয়ে ভারী যানবাহন চলাই এই ফাটলের কারণ।’ এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে তিনি দৃশ্যত সিটি করপোরেশনের রক্ষণাবেক্ষণে গলদের দিকে ইঙ্গিত করেন।

কিন্তু মঙ্গলবার দুপুরে ফাটল পরিদর্শন করে সিটি মেয়র এম রেজাউল করিম চৌধুরী ও সিসিসির প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম মানিক দু’জনই নির্মাণে ত্রুটির বিষয়ে উল্লেখ করেছেন।

ফাটলের কারণ জানতে চাইলে সিসিসির প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম মানিক সাংবাদিকদের বলেন, ‘চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে এই ফ্লাইওভারটি নির্মাণ করা হয়েছিল। দুটো কারণ থাকতে পারে। একটা হলো ডিজাইন ফেইলিউর, আরেকটা কনস্ট্রাকশনাল ফেইলিউর। এই মুহূর্তে বলা যাবে না, কোন ফেইলিউর।’

ভারী যানবাহন চলা ফাটল সৃষ্টিতে প্রভাব ফেলেছে বলে স্বীকার করলেও মূল কারণ হিসেবে নির্মাণ পর্যায়ে ত্রুটির কথাই বলেন তিনি। তার ভাষায়, ‘ফল্ট না হলে ক্র্যাক আসত না’।

রফিকুল বলেন, ‘নির্মাণের সঙ্গে যে প্রতিষ্ঠান ম্যাক্স, তাদের সঙ্গে কথা হয়েছে। যা জেনেছি, এই লুপটা ডিজাইনে ছিল না। পরবর্তীতে যোগ করা হয়েছে। যেহেতু মূল ডিজাইনে ছিল না, তাই ধারণা করছি ডিজাইনের একটা ফল্ট থাকতে পারে। সিডিএ নকশা করেছিল। তারা নিশ্চয় হিসেব করে ডিজাইন করেছিল।’

মেয়র রেজাউল করিম বলেন, ‘আসলে আমি তো আর প্রকৌশলী না। কারণটা আমি বলতে পারব না। সাধারণভাবে যেটা বলতে পারব, সেটা হচ্ছে নির্মাণে ত্রুটি আছে। যার ফলে ফাটলটা সৃষ্টি হয়েছে। যেহেতু এ কাজ আমরা করিনি। এটা করেছে সিডিএ’র অধীনে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ম্যাক্স। আজকেই সিডিএকে চিঠি দেব। এটার জন্য ত্বরিত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে।’

সিডিএর গাফিলতি ছিল কি না- প্রশ্ন করলে মেয়র বলেন, ‘যারা কনস্ট্রাকশন করেছে, তারা বলতে পারবে। তদন্তপূর্বক বের করা যাবে। উনারা বের করবেন যে সমস্ত কন্ট্রাক্টর এখানে কাজ করেছে, তাদের কোন নির্মাণ ত্রুটি আছে কিনা। আমাদের সহযোগিতা চাইলে, করব।’

সিডিএর তত্ত্বাবধানে ঠিকাদার হিসেবে ম্যাক্স গ্রুপের তৈরি করা এই ফ্লাইওভার নির্মাণের সময় গার্ডার ধসে পড়ার কথাও বলেন মেয়র রেজাউল। ২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর এই ফ্লাইওভারের গার্ডার ধসে অন্তত ১৪ জনের মৃত্যু হয়েছিল। তার আগে ওই বছরের ২৯ জুন গার্ডার ভেঙে এক রিকশাচালক আহত হয়েছিলেন।

মান্নান ফ্লাইওভারের প্রকল্প পরিচালক সিডিএর প্রকৌশলী মাহফুজুর বলেছিলেন, উদ্বোধনের সময় এই র‌্যাম্পে বড় গাড়ি ওঠা আটকাতে হাইট ব্যারিয়ার (প্রতিবন্ধকতা) ও সাইনবোর্ড ছিল, কিন্তু পরে তা ভেঙে ফেলা হয়।

তবে মেয়র বলেন, ‘কোন হাইট ব্যারিয়ার ছিল না। এটা ভিত্তিহীন কথা।’ দুর্ঘটনা এড়াতে ফ্লাইওভারের র‌্যাম্পটি আপাতত বন্ধ করে দেয়া হয়েছে বলে জানান মেয়র।

‘যেভাবে ফাটলটা সৃষ্টি হয়েছে এটা আমি নিজেও দেখে হতভম্ব হয়ে গেছি। যে কোন সময় একটা দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। আমাদের প্রকৌশলীরা সবাই এখানে উপস্থিত আছেন। সিদ্ধান্ত নিয়েছি, এদিক দিয়ে কোন গাড়ি চলাচল আপাতত হবে না।’

এই ফাটল কতটা ঝুঁকিপূর্ণ- জানতে চাইলে সিসিসির প্রকৌশলী রফিকুল বলেন, ‘যে কোন ফাটল ঝুঁকির। গাড়ি চলাচল বন্ধ রেখেছি।’

চট্টগ্রাম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণে সম্ভাব্যতা যাচাই কমিটির চেয়ারম্যান চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক মাহমুদ ওমর ইমাম বলেন, ওই ফ্লাইওভারের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের সময় লুপ করার বিষয়টি নিয়ে তিনি নিজেও সভায় কথা বলেছিলেন। কিন্তু পরে আর তাদের সম্পৃক্ত রাখা হয়নি।

এই রকম র‌্যাম্প ডিজাইনে ছিল না। মূল ডিজাইন মেনে এটা করা হয়নি। এখানে ডানমুখী আরেকটি লুপের প্রস্তাব করা হয়েছিল। এখন শুধু একটি র‌্যাম্প ধরে যদি উভয়মুখী যানবাহন চলাচল করে তাহলে লোড ট্রান্সফারের (ওজন স্থানান্তর) কারণেও ফাটল হয়ে থাকতে পারে।

অধ্যাপক ইমাম বলেন, সিডিএ কীভাবে এটা করেছে জানি না। এখনকার ফাটল বড় কিছু নয়। তবে ডিজাইন পরিবর্তন না করে যদি এ কাজ করা হয়ে থাকে, তাহলে ভবিষ্যতে ফাটল আরও ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে।

চট্টগ্রাম ব্যুবো জানায়, চট্টগ্রাম মহানগরীর বহদ্দারহাট ফ্লাইওভারের চান্দগাঁও র?্যাম্পে দুটি পিলারে ফাটল ধরার ঘটনায় এলাকাজুড়ে আতঙ্ক বিরাজ করছে। একই সঙ্গে সব ধরনের যান চলাচল বন্ধ থাকায় সৃষ্টি হয়েছে ব্যাপক যানজট। এতে ভোগান্তিতে পড়ে চলাচলরত যাত্রীরা। এদিকে নির্মাণ ত্রুটির কারণে বহদ্দারহাট এমএ মান্নান ফ্লাইওভারের দুটি পিলারে ফাটল দেখা দিয়েছে বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী। গতকাল বহদ্দারহাটে ফ্লাইওভারের পিলারের ফাটল পরিদর্শনে এসে তিনি এমন মন্তব্য করেন।

মেয়র বলেন, ফ্লাইওভারটি নির্মাণ কাজ করেছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)। পিলারে ফাটলের ব্যাপারে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়ার জন্য সিডিএকে আজকেই (গতকাল) চিঠি দেয়া হবে। দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে যেকোন সময় দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। যেভাবে ফাটলটা সৃষ্টি হয়েছে তা দেখে আমি হতবাক হয়েছি। এর আগেও এই ফ্লাইওভারের গার্ডার ধসে কয়েকজন মারা গিয়েছিল।

চসিক মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, ফ্লাইওভারটি কী কারণে ফাটল দেখা দিয়েছে তা বিস্তারিত তদন্ত করে বলা যাবে। যেসব ঠিকাদার ফ্লাইওভারটি নির্মাণ করেছে তাদের ত্রুটি আছে কি-না তা খুঁজে বের করবে সিডিএ। আমাদের পক্ষ থেকে আমরা সহযোগিতা করব।

এদিকে, দুই পিলারের ফাটলের খবর পেয়ে গত সোমবার রাতেই চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নির্বাহী প্রকৌশলী ও স্থানীয় দুই কাউন্সিলর এবং চান্দগাঁও থানার ওসি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। এ সময় তারাও পিলারের নিচের অংশে থাকা অস্থায়ী দোকান ও বিভিন্ন গাড়িগুলো সরিয়ে দেন। পাশাপাশি একটি পিলারের অংশে ব্যারিকেড দিয়েও রাখা হয়েছে। এ বিষয়ে ৪নং ওয়ার্ডের (চান্দগাঁও) কাউন্সিলর এসরারুল হক এসরাল বলেন, ইতোমধ্যে বিষয়টি মেয়র মহোদয়কে জানানো হয়েছে। আপাতত যান চলাচল বন্ধ রয়েছে।

গত সোমবার সন্ধ্যা থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুকে একটি পিলারের ফাটলের তিনটি ছবি ছড়িয়ে পড়ে। যা মুহূর্তের মধ্যেই ভাইরাল হয়ে যায়। এর পরপরই নজরে আসে পুলিশ, কাউন্সিলরসহ সংশ্লিষ্টদের। নজরে আসার পরেই তাৎক্ষণিক যানচলাচল বন্ধ করা হয়। এ বিষয়ে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শাহীন জানান, ফেইসবুকের মাধ্যমে বহদ্দারহাট ফ্লাইওভারের পিলারে ফাটল ধরেছে এমন খবর পেয়ে আমরা ঘটনাস্থলে এসেছি। আপাতত যান চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।

বুধবার, ২৭ অক্টোবর ২০২১ , ১১ কার্তিক ১৪২৮ ১৯ রবিউল আউয়াল ১৪৪৩

চট্টগ্রামে মান্নান ফ্লাইওভারে ফাটল

নির্মাণ ত্রুটির অভিযোগ সিসিসি’র

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক

image

চট্টগ্রাম মান্নান ফ্লাইওভারে র‌্যাম্পের পিলারে ফাটল

চট্টগ্রামের বহদ্দারহাট এমএ মান্নান ফ্লাইওভারে র‌্যাম্পের পিলারে ফাটল দেখা দেয়ায় নির্মাণ ত্রুটির অভিযোগ করছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (সিসিসি)। তবে ফ্লাইওভারের র‌্যাম্পটি নির্মাণ করা হয়েছিল হালকা যানবাহন চলাচলের জন্য। কিন্তু তা দিয়ে ভারী যানবাহন চলায় এই ফাটলের কারণ বলছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)।

বহদ্দারহাটে এমএ মান্নান ফ্লাইওভারটি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (সিসিসি) রক্ষণাবেক্ষণে থাকলেও এটি নির্মাণ করেছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)। তাই র‌্যাম্পের ফাটল নিয়ে একে অপরের ওপর দোষারোপ করছে দুই সংস্থা।

স্থানীয় সূত্র জানায়, চট্টগ্রামের বহদ্দারহাট এমএ মান্নান ফ্লাইওভারে যে র‌্যাম্পের পিলারে ফাটল দেয়া দিয়েছে নকশায় র‌্যাম্পটি ছিল না। স্থানীয়দের দাবির মুখে ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে আরাকান সড়কমুখী ওই র‌্যাম্প (ফ্লাইওভারের সঙ্গে অন্য সড়কের সংযোগকারী) নির্মাণ করে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)।

সিডিএর ১০৬ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০১০ সালের ডিসেম্বরে এই ফ্লাইওভারের নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছিল। তবে তখন নকশায় র‌্যাম্পটি ছিল না। সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে ফ্লাইওভারটিতে লুপ নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়েছিল। তবে তা না মেনে লুপ ছাড়াই সেটি চালু করা হয় ২০১৩ সালে। ফ্লাইওভারটি কার্যকর না হওয়ায় স্থানীয়দের দাবির মুখে ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে আরাকান সড়কমুখী ওই র‌্যাম্প (ফ্লাইওভারের সঙ্গে অন্য সড়কের সংযোগকারী) নির্মাণের উদ্যোগ নেয় সিডিএ। ৩২৬ মিটার দীর্ঘ এবং ৬ দশমিক ৭ মিটার চওড়া র‌্যাম্পটি নির্মাণ শেষে পরের বছর তা চালু করা হয়।

চট্টগ্রামের চান্দগাঁও থানা এলাকা থেকে বহদ্দারহাট মোড় পর্যন্ত ১ দশমিক ৩৩ কিলোমিটার এ ফ্লাইওভার ২০১৩ সালে উদ্বোধন হয়। তবে যেখানে ফাটল ধরেছে, সেই র‌্যাম্পটি প্রায় চার বছর পর চালু হয়। ২০১৯ সালে সিডিএর কাছ থেকে ফ্লাইওভারটি বুঝে পায় সিসিসি। গত সোমবার রাতে ফ্লাইওভারটির একমাত্র র‌্যাম্পের পিলারে ফাটল দেখা দিলে সেটিতে যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়।

এ বিষয়ে সিডিএর প্রকৌশলী মাহফুজুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, ‘ফ্লাইওভারের র‌্যাম্পটি করা হয়েছিল হালকা যানবাহন চলার জন্য। কিন্তু তা দিয়ে ভারী যানবাহন চলাই এই ফাটলের কারণ।’ এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে তিনি দৃশ্যত সিটি করপোরেশনের রক্ষণাবেক্ষণে গলদের দিকে ইঙ্গিত করেন।

কিন্তু মঙ্গলবার দুপুরে ফাটল পরিদর্শন করে সিটি মেয়র এম রেজাউল করিম চৌধুরী ও সিসিসির প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম মানিক দু’জনই নির্মাণে ত্রুটির বিষয়ে উল্লেখ করেছেন।

ফাটলের কারণ জানতে চাইলে সিসিসির প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম মানিক সাংবাদিকদের বলেন, ‘চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে এই ফ্লাইওভারটি নির্মাণ করা হয়েছিল। দুটো কারণ থাকতে পারে। একটা হলো ডিজাইন ফেইলিউর, আরেকটা কনস্ট্রাকশনাল ফেইলিউর। এই মুহূর্তে বলা যাবে না, কোন ফেইলিউর।’

ভারী যানবাহন চলা ফাটল সৃষ্টিতে প্রভাব ফেলেছে বলে স্বীকার করলেও মূল কারণ হিসেবে নির্মাণ পর্যায়ে ত্রুটির কথাই বলেন তিনি। তার ভাষায়, ‘ফল্ট না হলে ক্র্যাক আসত না’।

রফিকুল বলেন, ‘নির্মাণের সঙ্গে যে প্রতিষ্ঠান ম্যাক্স, তাদের সঙ্গে কথা হয়েছে। যা জেনেছি, এই লুপটা ডিজাইনে ছিল না। পরবর্তীতে যোগ করা হয়েছে। যেহেতু মূল ডিজাইনে ছিল না, তাই ধারণা করছি ডিজাইনের একটা ফল্ট থাকতে পারে। সিডিএ নকশা করেছিল। তারা নিশ্চয় হিসেব করে ডিজাইন করেছিল।’

মেয়র রেজাউল করিম বলেন, ‘আসলে আমি তো আর প্রকৌশলী না। কারণটা আমি বলতে পারব না। সাধারণভাবে যেটা বলতে পারব, সেটা হচ্ছে নির্মাণে ত্রুটি আছে। যার ফলে ফাটলটা সৃষ্টি হয়েছে। যেহেতু এ কাজ আমরা করিনি। এটা করেছে সিডিএ’র অধীনে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ম্যাক্স। আজকেই সিডিএকে চিঠি দেব। এটার জন্য ত্বরিত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে।’

সিডিএর গাফিলতি ছিল কি না- প্রশ্ন করলে মেয়র বলেন, ‘যারা কনস্ট্রাকশন করেছে, তারা বলতে পারবে। তদন্তপূর্বক বের করা যাবে। উনারা বের করবেন যে সমস্ত কন্ট্রাক্টর এখানে কাজ করেছে, তাদের কোন নির্মাণ ত্রুটি আছে কিনা। আমাদের সহযোগিতা চাইলে, করব।’

সিডিএর তত্ত্বাবধানে ঠিকাদার হিসেবে ম্যাক্স গ্রুপের তৈরি করা এই ফ্লাইওভার নির্মাণের সময় গার্ডার ধসে পড়ার কথাও বলেন মেয়র রেজাউল। ২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর এই ফ্লাইওভারের গার্ডার ধসে অন্তত ১৪ জনের মৃত্যু হয়েছিল। তার আগে ওই বছরের ২৯ জুন গার্ডার ভেঙে এক রিকশাচালক আহত হয়েছিলেন।

মান্নান ফ্লাইওভারের প্রকল্প পরিচালক সিডিএর প্রকৌশলী মাহফুজুর বলেছিলেন, উদ্বোধনের সময় এই র‌্যাম্পে বড় গাড়ি ওঠা আটকাতে হাইট ব্যারিয়ার (প্রতিবন্ধকতা) ও সাইনবোর্ড ছিল, কিন্তু পরে তা ভেঙে ফেলা হয়।

তবে মেয়র বলেন, ‘কোন হাইট ব্যারিয়ার ছিল না। এটা ভিত্তিহীন কথা।’ দুর্ঘটনা এড়াতে ফ্লাইওভারের র‌্যাম্পটি আপাতত বন্ধ করে দেয়া হয়েছে বলে জানান মেয়র।

‘যেভাবে ফাটলটা সৃষ্টি হয়েছে এটা আমি নিজেও দেখে হতভম্ব হয়ে গেছি। যে কোন সময় একটা দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। আমাদের প্রকৌশলীরা সবাই এখানে উপস্থিত আছেন। সিদ্ধান্ত নিয়েছি, এদিক দিয়ে কোন গাড়ি চলাচল আপাতত হবে না।’

এই ফাটল কতটা ঝুঁকিপূর্ণ- জানতে চাইলে সিসিসির প্রকৌশলী রফিকুল বলেন, ‘যে কোন ফাটল ঝুঁকির। গাড়ি চলাচল বন্ধ রেখেছি।’

চট্টগ্রাম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণে সম্ভাব্যতা যাচাই কমিটির চেয়ারম্যান চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক মাহমুদ ওমর ইমাম বলেন, ওই ফ্লাইওভারের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের সময় লুপ করার বিষয়টি নিয়ে তিনি নিজেও সভায় কথা বলেছিলেন। কিন্তু পরে আর তাদের সম্পৃক্ত রাখা হয়নি।

এই রকম র‌্যাম্প ডিজাইনে ছিল না। মূল ডিজাইন মেনে এটা করা হয়নি। এখানে ডানমুখী আরেকটি লুপের প্রস্তাব করা হয়েছিল। এখন শুধু একটি র‌্যাম্প ধরে যদি উভয়মুখী যানবাহন চলাচল করে তাহলে লোড ট্রান্সফারের (ওজন স্থানান্তর) কারণেও ফাটল হয়ে থাকতে পারে।

অধ্যাপক ইমাম বলেন, সিডিএ কীভাবে এটা করেছে জানি না। এখনকার ফাটল বড় কিছু নয়। তবে ডিজাইন পরিবর্তন না করে যদি এ কাজ করা হয়ে থাকে, তাহলে ভবিষ্যতে ফাটল আরও ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে।

চট্টগ্রাম ব্যুবো জানায়, চট্টগ্রাম মহানগরীর বহদ্দারহাট ফ্লাইওভারের চান্দগাঁও র?্যাম্পে দুটি পিলারে ফাটল ধরার ঘটনায় এলাকাজুড়ে আতঙ্ক বিরাজ করছে। একই সঙ্গে সব ধরনের যান চলাচল বন্ধ থাকায় সৃষ্টি হয়েছে ব্যাপক যানজট। এতে ভোগান্তিতে পড়ে চলাচলরত যাত্রীরা। এদিকে নির্মাণ ত্রুটির কারণে বহদ্দারহাট এমএ মান্নান ফ্লাইওভারের দুটি পিলারে ফাটল দেখা দিয়েছে বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী। গতকাল বহদ্দারহাটে ফ্লাইওভারের পিলারের ফাটল পরিদর্শনে এসে তিনি এমন মন্তব্য করেন।

মেয়র বলেন, ফ্লাইওভারটি নির্মাণ কাজ করেছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)। পিলারে ফাটলের ব্যাপারে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়ার জন্য সিডিএকে আজকেই (গতকাল) চিঠি দেয়া হবে। দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে যেকোন সময় দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। যেভাবে ফাটলটা সৃষ্টি হয়েছে তা দেখে আমি হতবাক হয়েছি। এর আগেও এই ফ্লাইওভারের গার্ডার ধসে কয়েকজন মারা গিয়েছিল।

চসিক মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, ফ্লাইওভারটি কী কারণে ফাটল দেখা দিয়েছে তা বিস্তারিত তদন্ত করে বলা যাবে। যেসব ঠিকাদার ফ্লাইওভারটি নির্মাণ করেছে তাদের ত্রুটি আছে কি-না তা খুঁজে বের করবে সিডিএ। আমাদের পক্ষ থেকে আমরা সহযোগিতা করব।

এদিকে, দুই পিলারের ফাটলের খবর পেয়ে গত সোমবার রাতেই চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নির্বাহী প্রকৌশলী ও স্থানীয় দুই কাউন্সিলর এবং চান্দগাঁও থানার ওসি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। এ সময় তারাও পিলারের নিচের অংশে থাকা অস্থায়ী দোকান ও বিভিন্ন গাড়িগুলো সরিয়ে দেন। পাশাপাশি একটি পিলারের অংশে ব্যারিকেড দিয়েও রাখা হয়েছে। এ বিষয়ে ৪নং ওয়ার্ডের (চান্দগাঁও) কাউন্সিলর এসরারুল হক এসরাল বলেন, ইতোমধ্যে বিষয়টি মেয়র মহোদয়কে জানানো হয়েছে। আপাতত যান চলাচল বন্ধ রয়েছে।

গত সোমবার সন্ধ্যা থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুকে একটি পিলারের ফাটলের তিনটি ছবি ছড়িয়ে পড়ে। যা মুহূর্তের মধ্যেই ভাইরাল হয়ে যায়। এর পরপরই নজরে আসে পুলিশ, কাউন্সিলরসহ সংশ্লিষ্টদের। নজরে আসার পরেই তাৎক্ষণিক যানচলাচল বন্ধ করা হয়। এ বিষয়ে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শাহীন জানান, ফেইসবুকের মাধ্যমে বহদ্দারহাট ফ্লাইওভারের পিলারে ফাটল ধরেছে এমন খবর পেয়ে আমরা ঘটনাস্থলে এসেছি। আপাতত যান চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।