আফগানিস্তানে মানবিক বিপর্যয়

৫০০ ডলারে বিক্রি হচ্ছে মেয়েশিশু

বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে বড় ধরনের মানবিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হচ্ছে আফগানিস্তান। গত আগস্ট মাসে তালেবানরা দেশটির ক্ষমতা দখলের পর থেকে মানবিক পরিস্থিতির তীব্র অবনতি হতে শুরু করেছে বলে জানিয়েছে বিবিসি।

বিবিসির সাংবাদিক ইয়োগিতা লিমায়ে ও তার দল সম্প্রতি আফগানিস্তানের পশ্চিমাঞ্চলীয় হেরাত শহরের মেডিসিন্স সানস ফ্রন্ট্রিয়ার্স হাসপাতালের পাশাপাশি শহরটির গ্রামাঞ্চলে যান। হাসপাতালটি থেকে লামিয়ে বলেন, ‘বিদেশি সহায়তা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আফগানিস্তানের কমপক্ষে ১০ লাখের বেশি শিশু মৃত্যুঝুঁকিতে রয়েছে।

তিন মাস বয়সী এক শিশু ওসমান। ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের কারণে জন্মের সময় তার ওজন অনেক কম ছিল। তার বাবার হাতে এখন কোনো কাজ নেই। শুধু ওসমানের বাবা নয়, আফগানিস্তানের আরও লাখ লাখ মানুষ দীর্ঘদিন ধরে বেকার।

ওসমানের মা লামিয়েকে বলেন, ‘আমাদের হাতে কোনো অর্থ নেই। বিশ্ব যেন আমাদের সহায়তায় এগিয়ে আসে, আমরা তা চাই। আমাদের শিশুরা কষ্টে আছে। হেরাতের মেডিসিন্স সানস ফ্রন্ট্রিয়ার্সের আশপাশে কয়েক মাইলের মধ্যে আর কোনো হাসপাতাল নেই বলে জানান লামিয়ে।

তিনি বলেন, আফগানিস্তানের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার বড় অংশ বৈদেশিক সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল, যা এখন বন্ধ। হেরাতের এই হাসপাতালের চিকিৎসক ও নার্সরা গত চার মাস ধরে বেতন পাচ্ছেন না। চিকিৎসাসামগ্রী কেনার মতো অর্থ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের নেই।

লামিয়ে বলেন, হেরাতের গ্রামাঞ্চলে সন্তানদের মুখে খাবার তুলে দিতে আফগানরা অকল্পনীয় কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন।’ পরিচয় গোপন রেখে এক মা লামিয়েকে বলেন, ‘আমার সন্তানরা ক্ষুধায় মারা যাচ্ছিল। এ কারণে আমার ছোট্ট মেয়েশিশুকে বিক্রি করা ছাড়া আর কিছু করার ছিল না। আমি খুব খুশি হতাম যদি

আমার মেয়েটাকে বিক্রি করা না লাগত। লামিয়ে জানান, ওই মেয়েশিশুর বাবা আবর্জনা কুড়িয়ে সংসার চালাতেন। কিন্তু তা দিয়ে এখন আর সংসার চলছে না।

শিশুটির বাবা বলেন, ‘ঘরে তেল, ময়দা কিছু ছিল না। অনাহারে দিন কাটছিল আমাদের। আমার মেয়ে আমার সম্পর্কে কী ভাবছে জানি না। তবে তাকে বিক্রি করা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। লামিয়ে বলেন, ‘মেয়েটি একটু বড় না হওয়া পর্যন্ত সে তার মা-বাবার কাছে থাকবে। এরপর যে ব্যক্তি তাকে কিনেছেন, তিনি মেয়েটিকে নিয়ে যাবেন।

মেয়েটিকে কিনতে ওই পরিবারকে ৫০০ ডলারের বেশি দিয়েছেন ওই ব্যক্তি। এ টাকায় মেয়েটির পরিবারের কয়েক মাস চলে যাবে। পরিবারটিকে বলা হয়েছে, ওই ব্যক্তির ছেলের সঙ্গে মেয়েটির বিয়ে দেয়া হবে। তবে এ বিষয়ে কেউ নিশ্চিত নয়। লামিয়ে বলেন, ‘এখানে আরও অনেক পরিবার তাদের সন্তানদের বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে।

আমাদের দলের একজনের কাছে এক আফগান তার সন্তান বিক্রি করতে চেয়েছিলেন। এতে বোঝা যাচ্ছে, কতটা অসহায় হলে মানুষ এমনটা করতে পারে। এখানকার পরিস্থিতি বলার মতো নয়।

আফগানিস্তানের এসব বিপন্ন মানুষের কাছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের শিগগিরই পৌঁছতে হবে। তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি দেয়া হবে কী হবে না, এ বিতর্কে আটকে গেলে এখানকার লাখ লাখ শিশুকে বাঁচানো সম্ভব হবে না।

এছাড়া, বর্তমানের আফগানিস্তানের অনেক মানুষেই এখন তাদের জমিজমা বিক্রি করে দিচ্ছে বেঁচে থাকার খাবার কিনতে। নতুন তালিবান প্রশাসন বিদেশী সম্পদ দেশে আনতেও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। সরকারি চাকুরে এবং অন্যান্য পেশাজীবীর বেতনও স্থগিত রাখা হয়েছে।

দেশটির অর্ধেক জনগোষ্ঠী প্রায় ২ কোটি ২০ লাখ ৮০ হাজার মানুষ চরম খাদ্য অনিশ্চয়তার মধ্যে আছে। একই সঙ্গে পাঁচ বছরের কম বয়সী ৩০ লাখ ২০ হাজার শিশু চরম অপুষ্টির ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে বলে সংস্থাটি দাবি করেছে। ডব্লিউএফপি’র নির্বাহী পরিচালক ডেভিড বিসলে বলেছেন, আফগানিস্তান বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বড় মানবিক বিপর্যয়ের মধ্যে রয়েছে।

এ বিষয়ে এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এতদিন যেসব আন্তর্জাতিক সহায়তার মাধ্যমে দেশটির ভঙ্গুর অর্থনীতি টিকে ছিল সেটা বন্ধ হয়ে গেছে এবং তালেবান সরকারের সঙ্গে কীভাবে কাজ করবে সে বিষয়ে বিশ্বজুড়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে।

জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) সতর্ক করে জানায়, আসছে শীতে অর্ধেকের বেশি আফগান চরম খাদ্যসংকটে ভুগবে। খাদ্যের অভাবে লাখ লাখ মানুষের মৃত্যু হবে, যদি না দ্রুতই আফগানিস্তানে ত্রাণ পাঠানো হয়। দেশটির হেরাত অঞ্চল ঘুরে বিভিন্ন মানবিক বিপর্যয়ের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে বিবিসির একটি ভিডিও প্রতিবেদনে।

তালেবান ক্ষমতা দখলের পর ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে আফগানিস্তান। দীর্ঘ দুই দশক যুদ্ধ চলাকালে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা দেশটিকে

সহায়তা করে। যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত সরকারকে আগস্টে তালেবান ক্ষমতাচ্যুত করার পর ওই সব সহায়তা বন্ধ হয়ে যায়।

তালেবানের নতুন সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক কেমন হবে, তা নিয়ে এখন পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেনি পশ্চিমা বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সিদ্ধান্তহীনতার ফল ভুগতে হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ার দেশটির লাখ লাখ মানুষকে।

বুধবার, ২৭ অক্টোবর ২০২১ , ১১ কার্তিক ১৪২৮ ১৯ রবিউল আউয়াল ১৪৪৩

আফগানিস্তানে মানবিক বিপর্যয়

৫০০ ডলারে বিক্রি হচ্ছে মেয়েশিশু

image

হেরাতে পরিবারের অন্য সদস্যদের মুখে খাবার তুলে দিতে এই মেয়েশিশুকে ৫০০ ডলারে বিক্রি করতে বাধ্য হয় তার পরিবার -বিবিসি

বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে বড় ধরনের মানবিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হচ্ছে আফগানিস্তান। গত আগস্ট মাসে তালেবানরা দেশটির ক্ষমতা দখলের পর থেকে মানবিক পরিস্থিতির তীব্র অবনতি হতে শুরু করেছে বলে জানিয়েছে বিবিসি।

বিবিসির সাংবাদিক ইয়োগিতা লিমায়ে ও তার দল সম্প্রতি আফগানিস্তানের পশ্চিমাঞ্চলীয় হেরাত শহরের মেডিসিন্স সানস ফ্রন্ট্রিয়ার্স হাসপাতালের পাশাপাশি শহরটির গ্রামাঞ্চলে যান। হাসপাতালটি থেকে লামিয়ে বলেন, ‘বিদেশি সহায়তা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আফগানিস্তানের কমপক্ষে ১০ লাখের বেশি শিশু মৃত্যুঝুঁকিতে রয়েছে।

তিন মাস বয়সী এক শিশু ওসমান। ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের কারণে জন্মের সময় তার ওজন অনেক কম ছিল। তার বাবার হাতে এখন কোনো কাজ নেই। শুধু ওসমানের বাবা নয়, আফগানিস্তানের আরও লাখ লাখ মানুষ দীর্ঘদিন ধরে বেকার।

ওসমানের মা লামিয়েকে বলেন, ‘আমাদের হাতে কোনো অর্থ নেই। বিশ্ব যেন আমাদের সহায়তায় এগিয়ে আসে, আমরা তা চাই। আমাদের শিশুরা কষ্টে আছে। হেরাতের মেডিসিন্স সানস ফ্রন্ট্রিয়ার্সের আশপাশে কয়েক মাইলের মধ্যে আর কোনো হাসপাতাল নেই বলে জানান লামিয়ে।

তিনি বলেন, আফগানিস্তানের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার বড় অংশ বৈদেশিক সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল, যা এখন বন্ধ। হেরাতের এই হাসপাতালের চিকিৎসক ও নার্সরা গত চার মাস ধরে বেতন পাচ্ছেন না। চিকিৎসাসামগ্রী কেনার মতো অর্থ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের নেই।

লামিয়ে বলেন, হেরাতের গ্রামাঞ্চলে সন্তানদের মুখে খাবার তুলে দিতে আফগানরা অকল্পনীয় কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন।’ পরিচয় গোপন রেখে এক মা লামিয়েকে বলেন, ‘আমার সন্তানরা ক্ষুধায় মারা যাচ্ছিল। এ কারণে আমার ছোট্ট মেয়েশিশুকে বিক্রি করা ছাড়া আর কিছু করার ছিল না। আমি খুব খুশি হতাম যদি

আমার মেয়েটাকে বিক্রি করা না লাগত। লামিয়ে জানান, ওই মেয়েশিশুর বাবা আবর্জনা কুড়িয়ে সংসার চালাতেন। কিন্তু তা দিয়ে এখন আর সংসার চলছে না।

শিশুটির বাবা বলেন, ‘ঘরে তেল, ময়দা কিছু ছিল না। অনাহারে দিন কাটছিল আমাদের। আমার মেয়ে আমার সম্পর্কে কী ভাবছে জানি না। তবে তাকে বিক্রি করা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। লামিয়ে বলেন, ‘মেয়েটি একটু বড় না হওয়া পর্যন্ত সে তার মা-বাবার কাছে থাকবে। এরপর যে ব্যক্তি তাকে কিনেছেন, তিনি মেয়েটিকে নিয়ে যাবেন।

মেয়েটিকে কিনতে ওই পরিবারকে ৫০০ ডলারের বেশি দিয়েছেন ওই ব্যক্তি। এ টাকায় মেয়েটির পরিবারের কয়েক মাস চলে যাবে। পরিবারটিকে বলা হয়েছে, ওই ব্যক্তির ছেলের সঙ্গে মেয়েটির বিয়ে দেয়া হবে। তবে এ বিষয়ে কেউ নিশ্চিত নয়। লামিয়ে বলেন, ‘এখানে আরও অনেক পরিবার তাদের সন্তানদের বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে।

আমাদের দলের একজনের কাছে এক আফগান তার সন্তান বিক্রি করতে চেয়েছিলেন। এতে বোঝা যাচ্ছে, কতটা অসহায় হলে মানুষ এমনটা করতে পারে। এখানকার পরিস্থিতি বলার মতো নয়।

আফগানিস্তানের এসব বিপন্ন মানুষের কাছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের শিগগিরই পৌঁছতে হবে। তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি দেয়া হবে কী হবে না, এ বিতর্কে আটকে গেলে এখানকার লাখ লাখ শিশুকে বাঁচানো সম্ভব হবে না।

এছাড়া, বর্তমানের আফগানিস্তানের অনেক মানুষেই এখন তাদের জমিজমা বিক্রি করে দিচ্ছে বেঁচে থাকার খাবার কিনতে। নতুন তালিবান প্রশাসন বিদেশী সম্পদ দেশে আনতেও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। সরকারি চাকুরে এবং অন্যান্য পেশাজীবীর বেতনও স্থগিত রাখা হয়েছে।

দেশটির অর্ধেক জনগোষ্ঠী প্রায় ২ কোটি ২০ লাখ ৮০ হাজার মানুষ চরম খাদ্য অনিশ্চয়তার মধ্যে আছে। একই সঙ্গে পাঁচ বছরের কম বয়সী ৩০ লাখ ২০ হাজার শিশু চরম অপুষ্টির ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে বলে সংস্থাটি দাবি করেছে। ডব্লিউএফপি’র নির্বাহী পরিচালক ডেভিড বিসলে বলেছেন, আফগানিস্তান বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বড় মানবিক বিপর্যয়ের মধ্যে রয়েছে।

এ বিষয়ে এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এতদিন যেসব আন্তর্জাতিক সহায়তার মাধ্যমে দেশটির ভঙ্গুর অর্থনীতি টিকে ছিল সেটা বন্ধ হয়ে গেছে এবং তালেবান সরকারের সঙ্গে কীভাবে কাজ করবে সে বিষয়ে বিশ্বজুড়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে।

জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) সতর্ক করে জানায়, আসছে শীতে অর্ধেকের বেশি আফগান চরম খাদ্যসংকটে ভুগবে। খাদ্যের অভাবে লাখ লাখ মানুষের মৃত্যু হবে, যদি না দ্রুতই আফগানিস্তানে ত্রাণ পাঠানো হয়। দেশটির হেরাত অঞ্চল ঘুরে বিভিন্ন মানবিক বিপর্যয়ের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে বিবিসির একটি ভিডিও প্রতিবেদনে।

তালেবান ক্ষমতা দখলের পর ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে আফগানিস্তান। দীর্ঘ দুই দশক যুদ্ধ চলাকালে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা দেশটিকে

সহায়তা করে। যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত সরকারকে আগস্টে তালেবান ক্ষমতাচ্যুত করার পর ওই সব সহায়তা বন্ধ হয়ে যায়।

তালেবানের নতুন সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক কেমন হবে, তা নিয়ে এখন পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেনি পশ্চিমা বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সিদ্ধান্তহীনতার ফল ভুগতে হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ার দেশটির লাখ লাখ মানুষকে।