লক্ষ্মীপুরের ৫ হাসপাতালে চিকিৎসক-কর্মচারী সংকট

লক্ষ্মীপুর জেলার জনসংখ্যা প্রায় বিশ লাখ। জেলাবাসীর চিকিৎসার জন্য লক্ষ্মীপুর সদর হাসপাতাল ছাড়াও উপজেলা পর্যায়ে রয়েছে আরও ৪টি হাসপাতাল। কিন্তু জেলার কোন হাসপাতালে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নেই। গত ৫ বছরেরও বেশি সময় এই পদগুলো শূন্য রয়েছে। শুধু তাই নয় নার্স, স্বাস্থ্য সহকারী ও পরিদর্শক থেকে কর্মচারীর অনেক পদই শূন্য।

জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরসহ উচ্চ পর্যায়ে জানানোর পরও রহস্যজনক কারণে কোন পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না। ফলে লক্ষ্মীপুর জেলার চিকিৎসা ব্যবস্থার এখন বেহাল দশা বিরাজ করছে।

কয়েকজন মেডিকেল অফিসার জানান, জেলা হাসপাতালে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক না থাকায় রোগীরা যাচ্ছে, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম ও ঢাকায়। আবার মধ্যবিত্তদের মধ্যে যাদের টাকা পয়সা আছে তারা প্রাইভেট হাসপাতাল বা ডাক্তারদের চেম্বারে গিয়ে কোন মতে চিকিৎসা নিচ্ছেন। আবার অনেক চিকিৎসক প্রতি শুক্রবার লক্ষ্মীপুরে প্রাইভেট চেম্বার চালু করছেন। সেখানে গিয়ে কেউ কেউ বেশি টাকা দিয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন। যাদের টাকা নেই তারা পড়েছেন বিপাকে।

জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে জানা গেছে, গত ৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে লক্ষ্মীপুর জেলা সদর হাসপাতালে কনসালটেন্টের ৬টি পদই শূন্য রয়েছে। শূন্য পদের মধ্যে কার্ডিওলজি বিভাগ, গাইনি বিভাগ, নাক কান গলা বিভাগ, রেডিওলজি বিভাগ, চক্ষু বিভাগ ও চর্ম বিভাগ।

জেলা সদর হাসপাতালে ১৩৫ জন মেডিকেল অফিসারের পদ থাকলেও আছে ১শ জন। স্বাস্থ্য সহকারী পদের সংখ্যা ৩১২টি। তার মধ্যে শূন্য আছে ১২৩টি। চতুর্থ শ্রেণীর ১০৯টি পদই শূন্য। স্বাস্থ্য পরিদর্শকের ১৬টি পদের মধ্যে ৯টি শূন্য। এভাবে জেলা সদর হাসপাতাল ছাড়াও রামগঞ্জ, রামগতি, কমলনগর ও রায়পুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসকসহ বিভিন্ন পদগুলো বছরের পর বছর খালি রয়েছে।

স্থানীয় চিকিৎসকরা জানান, পুরো লক্ষ্মীপুর জেলার ৫টি হাসপাতালের প্রতিদিন গ্রামগঞ্জ থেকে নানা পেশার শত শত রোগী চিকিৎসার জন্য যায়। কিন্তু চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীর অভাবে রোগীরা চিকিৎসা সেবা থেকে পদে পদে বঞ্চিত হচ্ছে।

লক্ষ্মীপুরের বশিকপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা তছলিম উদ্দিন সংবাদকে মুঠোফোনে জানান, লক্ষ্মীপুর সদর হাসপাতাল ও উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলোতে এখন কোন চিকিৎসা নেই। রোগীরা নোয়াখালীর মাইজদী ও চৌমুহানী গিয়ে চিকিৎসা করেন। এখন সবচেয়ে বেশি সমস্যা হচ্ছে গাইনি বিভাগে। গর্ভবতী নারীদের চিকিৎসা পাওয়া কষ্টকর।

সম্প্রতি বশিকপুর গ্রামের এমরান হোসেন বাবু নামে এক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর স্ত্রী প্রসব ব্যথা উঠলে তাকে প্রথমে লক্ষ্মীপুর সদর হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে ডাক্তার না পেয়ে হতাশ হয়ে পরে মাইজদীতে নিয়ে তার সিজার করানো হয়েছে। শুধু গাইনির রোগীই নয়, কার্ডিওলজি সমস্যা, চর্ম রোগের সমস্যা, নাক কান গলার সমস্যাসহ জটিল রোগের চিকিৎসা লক্ষ্মীপুরে নেই। প্রতিনিয়ত এই ধরনের ঘটনা অহরহ ঘটছে।

এছাড়াও বহু প্রবীণ রোগী চোখের চিকিৎসার জন্য লক্ষ্মীপুর সদর হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গিয়ে হতাশ হয়ে ফিরে চট্টগ্রামে চোখের চিকিৎসার জন্য যান। তবে প্রতি শুক্রবার ঢাকায় চিকিৎসা বিজ্ঞানের উপর স্নাতকোত্তর কোর্স করা ছাত্ররা জেলা সদরে গিয়ে প্রাইভেট চেম্বারে রোগী দেখেন। এভাবে জোড়াতালি দিয়ে জেলা হাসপাতালের চিকিৎসা কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। সর্বশেষ খবরে জানা গেছে, জেলা নাক কান গলার ভালো ডাক্তার লক্ষ্মীপুরে না পেয়ে শাহজাহান নামে একজন দরিদ্র রোগী নিজ বাসায় মারা গেছেন। এভাবে এলাকায় বহু রোগী দুঃখে মরছে। প্রত্যন্ত গ্রামের হাতুড়ে ডাক্তারই তাদের শেষ ভরসা। শেষ মুহূর্তে হাতুড়ে ডাক্তারদের পরামর্শে প্রাইভেট হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গিয়ে জমি, গরু বিক্রি করে চিকিৎসা করেন। ততক্ষণে জটিল রোগে আক্রান্ত রোগীরা আরও বেশি অসুস্থ হয়ে পড়েন। এই ধরনের ঘটনা প্রায় ঘটছে।

এ সম্পর্কে মহাখালী স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল) ডা. ফরিদ হোসেন মিয়ার সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করলে তিনি জেলা সিভিল সার্জনের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন। আর জানান, বিষয়টি তিনি খোঁজ নিয়ে দেখবেন।

জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের কয়েকজন কর্মকর্তা সংবাদকে বলেন, কনসালটেন্ট ও মেডিকেল অফিসারের শূন্য পদসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে একাধিকবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও মন্ত্রলালয়কে জানানো হয়েছে। এরপরও কাজ হচ্ছে না।

বুধবার, ২৭ অক্টোবর ২০২১ , ১১ কার্তিক ১৪২৮ ১৯ রবিউল আউয়াল ১৪৪৩

লক্ষ্মীপুরের ৫ হাসপাতালে চিকিৎসক-কর্মচারী সংকট

বাকী বিল্লাহ

লক্ষ্মীপুর জেলার জনসংখ্যা প্রায় বিশ লাখ। জেলাবাসীর চিকিৎসার জন্য লক্ষ্মীপুর সদর হাসপাতাল ছাড়াও উপজেলা পর্যায়ে রয়েছে আরও ৪টি হাসপাতাল। কিন্তু জেলার কোন হাসপাতালে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নেই। গত ৫ বছরেরও বেশি সময় এই পদগুলো শূন্য রয়েছে। শুধু তাই নয় নার্স, স্বাস্থ্য সহকারী ও পরিদর্শক থেকে কর্মচারীর অনেক পদই শূন্য।

জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরসহ উচ্চ পর্যায়ে জানানোর পরও রহস্যজনক কারণে কোন পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না। ফলে লক্ষ্মীপুর জেলার চিকিৎসা ব্যবস্থার এখন বেহাল দশা বিরাজ করছে।

কয়েকজন মেডিকেল অফিসার জানান, জেলা হাসপাতালে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক না থাকায় রোগীরা যাচ্ছে, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম ও ঢাকায়। আবার মধ্যবিত্তদের মধ্যে যাদের টাকা পয়সা আছে তারা প্রাইভেট হাসপাতাল বা ডাক্তারদের চেম্বারে গিয়ে কোন মতে চিকিৎসা নিচ্ছেন। আবার অনেক চিকিৎসক প্রতি শুক্রবার লক্ষ্মীপুরে প্রাইভেট চেম্বার চালু করছেন। সেখানে গিয়ে কেউ কেউ বেশি টাকা দিয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন। যাদের টাকা নেই তারা পড়েছেন বিপাকে।

জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে জানা গেছে, গত ৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে লক্ষ্মীপুর জেলা সদর হাসপাতালে কনসালটেন্টের ৬টি পদই শূন্য রয়েছে। শূন্য পদের মধ্যে কার্ডিওলজি বিভাগ, গাইনি বিভাগ, নাক কান গলা বিভাগ, রেডিওলজি বিভাগ, চক্ষু বিভাগ ও চর্ম বিভাগ।

জেলা সদর হাসপাতালে ১৩৫ জন মেডিকেল অফিসারের পদ থাকলেও আছে ১শ জন। স্বাস্থ্য সহকারী পদের সংখ্যা ৩১২টি। তার মধ্যে শূন্য আছে ১২৩টি। চতুর্থ শ্রেণীর ১০৯টি পদই শূন্য। স্বাস্থ্য পরিদর্শকের ১৬টি পদের মধ্যে ৯টি শূন্য। এভাবে জেলা সদর হাসপাতাল ছাড়াও রামগঞ্জ, রামগতি, কমলনগর ও রায়পুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসকসহ বিভিন্ন পদগুলো বছরের পর বছর খালি রয়েছে।

স্থানীয় চিকিৎসকরা জানান, পুরো লক্ষ্মীপুর জেলার ৫টি হাসপাতালের প্রতিদিন গ্রামগঞ্জ থেকে নানা পেশার শত শত রোগী চিকিৎসার জন্য যায়। কিন্তু চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীর অভাবে রোগীরা চিকিৎসা সেবা থেকে পদে পদে বঞ্চিত হচ্ছে।

লক্ষ্মীপুরের বশিকপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা তছলিম উদ্দিন সংবাদকে মুঠোফোনে জানান, লক্ষ্মীপুর সদর হাসপাতাল ও উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলোতে এখন কোন চিকিৎসা নেই। রোগীরা নোয়াখালীর মাইজদী ও চৌমুহানী গিয়ে চিকিৎসা করেন। এখন সবচেয়ে বেশি সমস্যা হচ্ছে গাইনি বিভাগে। গর্ভবতী নারীদের চিকিৎসা পাওয়া কষ্টকর।

সম্প্রতি বশিকপুর গ্রামের এমরান হোসেন বাবু নামে এক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর স্ত্রী প্রসব ব্যথা উঠলে তাকে প্রথমে লক্ষ্মীপুর সদর হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে ডাক্তার না পেয়ে হতাশ হয়ে পরে মাইজদীতে নিয়ে তার সিজার করানো হয়েছে। শুধু গাইনির রোগীই নয়, কার্ডিওলজি সমস্যা, চর্ম রোগের সমস্যা, নাক কান গলার সমস্যাসহ জটিল রোগের চিকিৎসা লক্ষ্মীপুরে নেই। প্রতিনিয়ত এই ধরনের ঘটনা অহরহ ঘটছে।

এছাড়াও বহু প্রবীণ রোগী চোখের চিকিৎসার জন্য লক্ষ্মীপুর সদর হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গিয়ে হতাশ হয়ে ফিরে চট্টগ্রামে চোখের চিকিৎসার জন্য যান। তবে প্রতি শুক্রবার ঢাকায় চিকিৎসা বিজ্ঞানের উপর স্নাতকোত্তর কোর্স করা ছাত্ররা জেলা সদরে গিয়ে প্রাইভেট চেম্বারে রোগী দেখেন। এভাবে জোড়াতালি দিয়ে জেলা হাসপাতালের চিকিৎসা কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। সর্বশেষ খবরে জানা গেছে, জেলা নাক কান গলার ভালো ডাক্তার লক্ষ্মীপুরে না পেয়ে শাহজাহান নামে একজন দরিদ্র রোগী নিজ বাসায় মারা গেছেন। এভাবে এলাকায় বহু রোগী দুঃখে মরছে। প্রত্যন্ত গ্রামের হাতুড়ে ডাক্তারই তাদের শেষ ভরসা। শেষ মুহূর্তে হাতুড়ে ডাক্তারদের পরামর্শে প্রাইভেট হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গিয়ে জমি, গরু বিক্রি করে চিকিৎসা করেন। ততক্ষণে জটিল রোগে আক্রান্ত রোগীরা আরও বেশি অসুস্থ হয়ে পড়েন। এই ধরনের ঘটনা প্রায় ঘটছে।

এ সম্পর্কে মহাখালী স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল) ডা. ফরিদ হোসেন মিয়ার সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করলে তিনি জেলা সিভিল সার্জনের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন। আর জানান, বিষয়টি তিনি খোঁজ নিয়ে দেখবেন।

জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের কয়েকজন কর্মকর্তা সংবাদকে বলেন, কনসালটেন্ট ও মেডিকেল অফিসারের শূন্য পদসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে একাধিকবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও মন্ত্রলালয়কে জানানো হয়েছে। এরপরও কাজ হচ্ছে না।