মনোনয়ন সমস্যায় ৮৮টি ইউপিতে নৌকা পাচ্ছে না কেউ

ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে ‘জনপ্রিয় ও যোগ্য’ প্রার্থীরা দলীয় মনোনয়ন থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন, এমন অভিযোগ অসংখ্য। ‘টাকার লেনদেন’ আর ‘প্রভাবশালী নেতাদের সুপারিশ’- দুটোই তৃণমূল থেকে পাঠানো প্রার্থী তালিকায় প্রভাব বিস্তার করে, এ বিষয়টিও ‘ওপেন-সিক্রেট’। ফলে অনেক এলকায় প্রার্থী মনোনয়নের ক্ষেত্রে স্থানীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ছেন।

কিছুদিন আগেও কেন্দ্রীয় নির্দেশনা অনুযায়ী, যাদের নাম তৃণমূল তালিকায় নেই তারা কেন্দ্র থেকে মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করতে পারতেন না। কেন্দ্রীয় জরিপে দেখা গেছে, অনেক স্থানে ‘বিভিন্নভাবে’ প্রভাবিত হয়ে যোগ্য প্রার্থীদের নাম বাদ দিয়ে তালিকা পাঠানো হয়েছে। পরে মনোনয়নে স্বচ্ছতা আনতে ওই নির্দেশনা বাতিল করে আওয়ামী লীগ। কেন্দ্রীয় নেতাদের সুপারিশ সাপেক্ষে মনোনয়ন প্রত্যাশীদের আবেদন ফরম তোলার সুযোগ দেয়া হয়।

এরপরও তৃণমূলের নেতারা প্রভাবমুক্ত হতে পারেননি।

সোমবার স্থানীয় সরকার জনপ্রতিনিধি মনোনয়ন বোর্ডের সভা শেষ করেছে আওয়ামী লীগ। তবে তৃতীয় ধাপে শরীয়তপুর ও মাদারীপুরের ৮৮টি ইউপিতে কাউকে মনোনয়ন না দিয়ে চেয়ারম্যান পদে প্রার্থিতা উন্মুক্ত করে দেয়া হয়েছে।

আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সূত্রে জানা গেছে, সংশ্লিষ্ট উপজেলা পর্যায়ের অধিকাংশ নেতাদের মতামতের ভিত্তিতে দুই জেলার ছয়জন সংসদ সদস্যের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেন্দ্র। ফলে এসব ইউপিতে চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে ইচ্ছুক স্থানীয় আওয়ামী লীগের সবাই নির্বাচনের সুযোগ পাবেন। তবে কেউ দলীয় প্রতীক (নৌকা) পাবেন না।

এর আগে প্রথম দফার ইউপি ভোটে মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার ১৩ ইউপিতে চেয়ারম্যান পদে ভোট উন্মুক্ত রেখেছিল আওয়ামী লীগ।

এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এবং মাদারীপুর-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম সংবাদকে বলেন, সংসদ সদস্যরা আবেদন করেছেন। ভালো কিছুর প্রত্যাশায় কেন্দ্র মনোনয়ন উন্মুক্ত করে দিয়েছে। একইভাবে, অন্য ইউপিতেও মনোনয়ন উন্মুক্ত করা যেতে পারে।

স্থানীয় সূত্র বলছে, এসব ইউপিতে নৌকার মনোনয়ন প্রত্যাশী বেশি থাকায়, একক প্রার্থী নির্বাচনে জটিলতায় পড়েন দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা। মনোনয়ন তালিকায় কাকে প্রথমে রাখা হবে এ নিয়েও সমস্যায় পড়েন তারা। একজনকে মনোনয়ন দেয়া হলে, অন্যরা দলের বিপক্ষে যেতে পারেন বলেও আশঙ্কা তৈরি হয়। দলীয় ঐক্য ধরে রাখতে তারা মনোনয়ন না দিয়ে উন্মুক্ত নির্বাচনের বিষয়ে একমত হন।

তৃণমূল নেতাদের অনুরোধে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে দলীয় প্রার্থিতা উন্মুক্ত রাখার অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দেন মাদারীপুর-১ আসনের নূর-ই-আলম চৌধুরী লিটন, মাদারীপুর-২ আসনের শাজাহান খান, মাদারীপুর-৩ আসনের ড. আবদুস সোবহান গোলাপ, শরীয়তপুর-১ আসনের ইকবাল হোসেন অপু, শরীয়তপুর-২ আসনের এ কে এম এনামুল হক শামীম ও শরীয়তপুর-৩ আসনের নাহিম রাজ্জাক।

জানা গেছে, মাদারীপুর থেকে গত ২৬ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ সভাপতিকে পাঠানো চিঠিতে বিগত ইউপি নির্বাচনের প্রেক্ষাপট ও ফলাফল তুলে ধর হয়। সে সময় প্রার্থী বাছাইয়ের সময় জনপ্রিয় প্রার্থীরা মনোনয়ন বঞ্চিত, প্রার্থী বাছাইয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের পছন্দ-অপছন্দে গুরুত্ব প্রদান এবং কোন কোন ক্ষেত্রে প্রার্থী বাছাইয়ে অনিয়মের কারণে নৌকার সব প্রার্থী জয়ী হতে পারেনি, এমনটি বলা হয় ওই চিঠিতে। নির্বাচনে নৌকা প্রতীক জয়লাভ না করায় জনমনে বিরূপ প্রভাব পড়েছে উল্লেখ করে চিঠিতে বলা হয়, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ইউনিয়নের সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের মধ্যে সুদৃঢ় ঐক্যের বন্ধন বিনষ্ট হয়েছে। স্থানীয় সংসদ সদস্য, উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে নেতাদের প্রতি তৃণমূল নেতাকর্মীদের আস্থার ঘাটতি হয়েছে। চিঠিতে বলা হয়, এখানে নৌকা প্রতীক না দিলে আমাদের নির্বাচনী এলাকার নেতাকর্মীদের মধ্যে ঐক্য বিনষ্ট হবে না। এটা হলে জনপ্রতিনিধিসহ উপজেলা ও জেলা কমিটির নেতারা বিব্রতকর পরিস্থিতি থেকে মুক্ত থাকবেন বলেও চিঠিতে উল্লেখ করা হয়।

ডিসেম্বরের মধ্যে দেশের প্রায় সব ইউপিতে ভোট করার প্রক্রিয় শুরু করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। বিএনপি এ নির্বাচন বয়কট করেছে। তবে আওয়ামী লীগ প্রার্থী মনোনয়ন দিচ্ছে। ফলে ভোটের মাঠে নৌকার শক্তিশালী প্রতিপক্ষ নেই। এই প্রেক্ষাপটে দেশের বেশিরভাগ ইউপিতে নৌকার মনোনয়ন প্রত্যাশীদের সংখ্যা অনেক।

শরীয়তপুর ও মাদারীপুরের পরিস্থিতি দেশের অনেক এলাকায়। মনোনয়ন প্রদানে নিয়েও নানামুখী চাপের স্বীকার হচ্ছেন তৃণমূলের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, অনেক ইউপিতে প্রার্থিতা উন্মুক্ত করার পক্ষে স্থানীয় নেতাকর্মীদের অবস্থান। তবে দাবি আমলে নিচ্ছেন না দায়িত্বপ্রাপ্তরা।

তৃণমূল পর্যায়ের এসব নির্বাচন দলীয় প্রতীকে করার পক্ষে-বিপক্ষে মতামত রয়েছে। একসময় নির্বাচনী বিশ্লেষকদের অনেকে স্থানীয় সরকার নির্বাচন দলীয় প্রতীকে করার পক্ষে বলেছিলেন। তবে মাঠের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে এখন আবার কেউ কেউ এই বিধান বাতিলের কথাও বলছেন।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন, দলীয়ভাবে ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌরসভা নির্বাচনের শীর্ষ (চেয়ারম্যন, মেয়র) পদে নির্বাচনের আইনের ভালো-মন্দ দুটো দিকই আছে।

তাদের মতে, তৃণমূলে এক নেতার নেতৃত্বে দলীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠায় এই আইন কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। এ ক্ষেত্রে মনোনয়ন দিতে হবে সতর্কতার সঙ্গে সৎ, যোগ্য এবং জনপ্রিয় ব্যক্তিকে। আবার মনোনয়নের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর ভুল সিদ্ধান্ত তৃণমূলে বিভক্তির কারণ হতে পারে। আর খারাপ দিক হচ্ছে, এ ক্ষেত্রে তৃণমূল নেতাদের অবৈধ অর্থনৈতিক সুবিধা গ্রহণের সুযোগ তৈরি হয়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কেন্দ্র থেকে যোগ্য প্রার্থী নির্বাচন অত্যন্ত জটিল বিষয় বলে মনে করেন তারা।

আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় এক নেতা সংবাদকে বলেন, তৃণমূলে প্রার্থী তালিকা প্রণয়নে টাকা লেনদেনের অভিযোগ কেন্দ্রেও আসে। তবে ঢালাওভাবে এসব অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায় না। দলীয় প্রতীকে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে তিনি বলেন, যদিও কেন্দ্র থেকে চূড়ান্ত মনোনয়ন দেয়া হয়। সমস্যাটা হয় তৃণমূলে। যারা মনোনয়ন বঞ্চিত হন, তারা তৃণমূল নেতাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। ফলে স্থানীয় ঐক্য নষ্ট হয়ে নেতাকর্মীদের মধ্যে দূরত্ব ও বিভাজন তৈরি হয়।

স্থানীয় সরকার নির্বাচন আইন অনুযায়ী, ২০১৫ সালে পৌরসভা নির্বাচনে মেয়র পদে দলীয় মনোনয়নের মাধ্যমে দেশে প্রথমবারের মতো স্থানীয় সরকার পরিষদের নির্বাচন দলীয়ভাবে শুরু হয়। এর ধারাবাহিকতায় ২০১৬ সালে ইউপি চেয়ারম্যান পদেও প্রার্থী মনোনয়ন দেয় আওয়ামী লীগসহ নিবন্ধিত বেশকিছু রাজনৈতিক দল।

এরপর থেকে দলীয় প্রতীকে এসব নির্বাচন হচ্ছে। তবে আওয়ামী লীগের তৃণমূলে কোন্দল-সংঘাত বাড়ছে। জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে দলের নেতাকর্মীদের মধ্যেও দূরত্ব বাড়ছে। এ কারণে দলের স্থানীয় সরকার মনোনয়ন বোর্ডসহ বিভিন্ন ফোরামে দলীয় প্রতীক না দেয়ার প্রস্তাবও এসেছে। মনোনয়ন বোর্ডের একাধিক সদস্য দলীয় প্রধান শেখ হাসিনাকে তৃণমূলের দ্বন্দ্ব-সংঘাতের চিত্র তুলে ধরে ইতোপূর্বে দলীয় ভিত্তিতে ইউপি নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিধান বিলোপের অনুরোধও করেন।

বুধবার, ২৭ অক্টোবর ২০২১ , ১১ কার্তিক ১৪২৮ ১৯ রবিউল আউয়াল ১৪৪৩

মনোনয়ন সমস্যায় ৮৮টি ইউপিতে নৌকা পাচ্ছে না কেউ

ফয়েজ আহমেদ তুষার

ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে ‘জনপ্রিয় ও যোগ্য’ প্রার্থীরা দলীয় মনোনয়ন থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন, এমন অভিযোগ অসংখ্য। ‘টাকার লেনদেন’ আর ‘প্রভাবশালী নেতাদের সুপারিশ’- দুটোই তৃণমূল থেকে পাঠানো প্রার্থী তালিকায় প্রভাব বিস্তার করে, এ বিষয়টিও ‘ওপেন-সিক্রেট’। ফলে অনেক এলকায় প্রার্থী মনোনয়নের ক্ষেত্রে স্থানীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ছেন।

কিছুদিন আগেও কেন্দ্রীয় নির্দেশনা অনুযায়ী, যাদের নাম তৃণমূল তালিকায় নেই তারা কেন্দ্র থেকে মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করতে পারতেন না। কেন্দ্রীয় জরিপে দেখা গেছে, অনেক স্থানে ‘বিভিন্নভাবে’ প্রভাবিত হয়ে যোগ্য প্রার্থীদের নাম বাদ দিয়ে তালিকা পাঠানো হয়েছে। পরে মনোনয়নে স্বচ্ছতা আনতে ওই নির্দেশনা বাতিল করে আওয়ামী লীগ। কেন্দ্রীয় নেতাদের সুপারিশ সাপেক্ষে মনোনয়ন প্রত্যাশীদের আবেদন ফরম তোলার সুযোগ দেয়া হয়।

এরপরও তৃণমূলের নেতারা প্রভাবমুক্ত হতে পারেননি।

সোমবার স্থানীয় সরকার জনপ্রতিনিধি মনোনয়ন বোর্ডের সভা শেষ করেছে আওয়ামী লীগ। তবে তৃতীয় ধাপে শরীয়তপুর ও মাদারীপুরের ৮৮টি ইউপিতে কাউকে মনোনয়ন না দিয়ে চেয়ারম্যান পদে প্রার্থিতা উন্মুক্ত করে দেয়া হয়েছে।

আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সূত্রে জানা গেছে, সংশ্লিষ্ট উপজেলা পর্যায়ের অধিকাংশ নেতাদের মতামতের ভিত্তিতে দুই জেলার ছয়জন সংসদ সদস্যের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেন্দ্র। ফলে এসব ইউপিতে চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে ইচ্ছুক স্থানীয় আওয়ামী লীগের সবাই নির্বাচনের সুযোগ পাবেন। তবে কেউ দলীয় প্রতীক (নৌকা) পাবেন না।

এর আগে প্রথম দফার ইউপি ভোটে মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার ১৩ ইউপিতে চেয়ারম্যান পদে ভোট উন্মুক্ত রেখেছিল আওয়ামী লীগ।

এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এবং মাদারীপুর-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম সংবাদকে বলেন, সংসদ সদস্যরা আবেদন করেছেন। ভালো কিছুর প্রত্যাশায় কেন্দ্র মনোনয়ন উন্মুক্ত করে দিয়েছে। একইভাবে, অন্য ইউপিতেও মনোনয়ন উন্মুক্ত করা যেতে পারে।

স্থানীয় সূত্র বলছে, এসব ইউপিতে নৌকার মনোনয়ন প্রত্যাশী বেশি থাকায়, একক প্রার্থী নির্বাচনে জটিলতায় পড়েন দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা। মনোনয়ন তালিকায় কাকে প্রথমে রাখা হবে এ নিয়েও সমস্যায় পড়েন তারা। একজনকে মনোনয়ন দেয়া হলে, অন্যরা দলের বিপক্ষে যেতে পারেন বলেও আশঙ্কা তৈরি হয়। দলীয় ঐক্য ধরে রাখতে তারা মনোনয়ন না দিয়ে উন্মুক্ত নির্বাচনের বিষয়ে একমত হন।

তৃণমূল নেতাদের অনুরোধে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে দলীয় প্রার্থিতা উন্মুক্ত রাখার অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দেন মাদারীপুর-১ আসনের নূর-ই-আলম চৌধুরী লিটন, মাদারীপুর-২ আসনের শাজাহান খান, মাদারীপুর-৩ আসনের ড. আবদুস সোবহান গোলাপ, শরীয়তপুর-১ আসনের ইকবাল হোসেন অপু, শরীয়তপুর-২ আসনের এ কে এম এনামুল হক শামীম ও শরীয়তপুর-৩ আসনের নাহিম রাজ্জাক।

জানা গেছে, মাদারীপুর থেকে গত ২৬ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ সভাপতিকে পাঠানো চিঠিতে বিগত ইউপি নির্বাচনের প্রেক্ষাপট ও ফলাফল তুলে ধর হয়। সে সময় প্রার্থী বাছাইয়ের সময় জনপ্রিয় প্রার্থীরা মনোনয়ন বঞ্চিত, প্রার্থী বাছাইয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের পছন্দ-অপছন্দে গুরুত্ব প্রদান এবং কোন কোন ক্ষেত্রে প্রার্থী বাছাইয়ে অনিয়মের কারণে নৌকার সব প্রার্থী জয়ী হতে পারেনি, এমনটি বলা হয় ওই চিঠিতে। নির্বাচনে নৌকা প্রতীক জয়লাভ না করায় জনমনে বিরূপ প্রভাব পড়েছে উল্লেখ করে চিঠিতে বলা হয়, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ইউনিয়নের সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের মধ্যে সুদৃঢ় ঐক্যের বন্ধন বিনষ্ট হয়েছে। স্থানীয় সংসদ সদস্য, উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে নেতাদের প্রতি তৃণমূল নেতাকর্মীদের আস্থার ঘাটতি হয়েছে। চিঠিতে বলা হয়, এখানে নৌকা প্রতীক না দিলে আমাদের নির্বাচনী এলাকার নেতাকর্মীদের মধ্যে ঐক্য বিনষ্ট হবে না। এটা হলে জনপ্রতিনিধিসহ উপজেলা ও জেলা কমিটির নেতারা বিব্রতকর পরিস্থিতি থেকে মুক্ত থাকবেন বলেও চিঠিতে উল্লেখ করা হয়।

ডিসেম্বরের মধ্যে দেশের প্রায় সব ইউপিতে ভোট করার প্রক্রিয় শুরু করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। বিএনপি এ নির্বাচন বয়কট করেছে। তবে আওয়ামী লীগ প্রার্থী মনোনয়ন দিচ্ছে। ফলে ভোটের মাঠে নৌকার শক্তিশালী প্রতিপক্ষ নেই। এই প্রেক্ষাপটে দেশের বেশিরভাগ ইউপিতে নৌকার মনোনয়ন প্রত্যাশীদের সংখ্যা অনেক।

শরীয়তপুর ও মাদারীপুরের পরিস্থিতি দেশের অনেক এলাকায়। মনোনয়ন প্রদানে নিয়েও নানামুখী চাপের স্বীকার হচ্ছেন তৃণমূলের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, অনেক ইউপিতে প্রার্থিতা উন্মুক্ত করার পক্ষে স্থানীয় নেতাকর্মীদের অবস্থান। তবে দাবি আমলে নিচ্ছেন না দায়িত্বপ্রাপ্তরা।

তৃণমূল পর্যায়ের এসব নির্বাচন দলীয় প্রতীকে করার পক্ষে-বিপক্ষে মতামত রয়েছে। একসময় নির্বাচনী বিশ্লেষকদের অনেকে স্থানীয় সরকার নির্বাচন দলীয় প্রতীকে করার পক্ষে বলেছিলেন। তবে মাঠের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে এখন আবার কেউ কেউ এই বিধান বাতিলের কথাও বলছেন।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন, দলীয়ভাবে ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌরসভা নির্বাচনের শীর্ষ (চেয়ারম্যন, মেয়র) পদে নির্বাচনের আইনের ভালো-মন্দ দুটো দিকই আছে।

তাদের মতে, তৃণমূলে এক নেতার নেতৃত্বে দলীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠায় এই আইন কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। এ ক্ষেত্রে মনোনয়ন দিতে হবে সতর্কতার সঙ্গে সৎ, যোগ্য এবং জনপ্রিয় ব্যক্তিকে। আবার মনোনয়নের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর ভুল সিদ্ধান্ত তৃণমূলে বিভক্তির কারণ হতে পারে। আর খারাপ দিক হচ্ছে, এ ক্ষেত্রে তৃণমূল নেতাদের অবৈধ অর্থনৈতিক সুবিধা গ্রহণের সুযোগ তৈরি হয়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কেন্দ্র থেকে যোগ্য প্রার্থী নির্বাচন অত্যন্ত জটিল বিষয় বলে মনে করেন তারা।

আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় এক নেতা সংবাদকে বলেন, তৃণমূলে প্রার্থী তালিকা প্রণয়নে টাকা লেনদেনের অভিযোগ কেন্দ্রেও আসে। তবে ঢালাওভাবে এসব অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায় না। দলীয় প্রতীকে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে তিনি বলেন, যদিও কেন্দ্র থেকে চূড়ান্ত মনোনয়ন দেয়া হয়। সমস্যাটা হয় তৃণমূলে। যারা মনোনয়ন বঞ্চিত হন, তারা তৃণমূল নেতাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। ফলে স্থানীয় ঐক্য নষ্ট হয়ে নেতাকর্মীদের মধ্যে দূরত্ব ও বিভাজন তৈরি হয়।

স্থানীয় সরকার নির্বাচন আইন অনুযায়ী, ২০১৫ সালে পৌরসভা নির্বাচনে মেয়র পদে দলীয় মনোনয়নের মাধ্যমে দেশে প্রথমবারের মতো স্থানীয় সরকার পরিষদের নির্বাচন দলীয়ভাবে শুরু হয়। এর ধারাবাহিকতায় ২০১৬ সালে ইউপি চেয়ারম্যান পদেও প্রার্থী মনোনয়ন দেয় আওয়ামী লীগসহ নিবন্ধিত বেশকিছু রাজনৈতিক দল।

এরপর থেকে দলীয় প্রতীকে এসব নির্বাচন হচ্ছে। তবে আওয়ামী লীগের তৃণমূলে কোন্দল-সংঘাত বাড়ছে। জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে দলের নেতাকর্মীদের মধ্যেও দূরত্ব বাড়ছে। এ কারণে দলের স্থানীয় সরকার মনোনয়ন বোর্ডসহ বিভিন্ন ফোরামে দলীয় প্রতীক না দেয়ার প্রস্তাবও এসেছে। মনোনয়ন বোর্ডের একাধিক সদস্য দলীয় প্রধান শেখ হাসিনাকে তৃণমূলের দ্বন্দ্ব-সংঘাতের চিত্র তুলে ধরে ইতোপূর্বে দলীয় ভিত্তিতে ইউপি নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিধান বিলোপের অনুরোধও করেন।