বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা দিবস

শারফুদ্দিন আহমেদ

‘বিজ্ঞান হচ্ছে মনের পরিশ্রমের কারুকাজ’- ফ্রান্সিস বেকনের এই উক্তির সঙ্গে আপনার দ্বিমত থাকতেই পারে, কিন্তু এটি অস্বীকার করার উপায় নেই যে, বর্তমানের আধুনিক মানব সভ্যতা বিজ্ঞানের আশির্বাদস্বরূপ। বিজ্ঞান আমাদের জীবনের সঙ্গে ওতোপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। আর বিজ্ঞানের যে শাখাটি ছাড়া মানুষ বর্তমানে তার অস্তিত্ব কল্পনা করতে পারে না সেটি হচ্ছে চিকিৎসা বিজ্ঞান।

প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক ভীষণ নিবিড়। আর প্রাচীনকালে মানুষ চিকিৎসার জন্য সম্পৃর্ণভাবে প্রকৃতির উপর নির্ভরশীল ছিল। প্রকৃতিতে অফুরান্ত উপকারী ভেষজ উপাদান রয়েছে। কিন্তু এসব উপাদানকে সঠিকভাবে প্রক্রিয়াজাতকরণ তখনকার দিনে অসম্ভব ছিল। কারণ তখন বিজ্ঞান ছিল না। ফলে দেখা যেতো ডায়েরিয়া, কলেরার মতো যেসব রোগ নিয়ে বর্তমানে কারও কিছুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই, তখনকার দিনে এসব রোগে গ্রামের পর গ্রামের মানুষ প্রাণ হারাতো। কারো এসব রোগ দেখা দিলে তাকে একঘরে রাখা হতো। যদি লতাপাতায় কাজ না হতো তবে তাদের শেষ ভরসা ছিল পানি পড়া, তাবিজ, ঝাড়ফুঁক, পীর, ফকির, ওঝা। এডাম স্মিথ বলেছিলেন, ‘উদ্দীপনা এবং কুসংস্কারের বিষের দুর্দান্ত প্রতিষেধক হলো বিজ্ঞান’।

২৭ অক্টোবর ২০২১ তারিখে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় গবেষণা দিবস। বর্তমানে দৈনন্দিন জীবন হোক বা চিকিৎসা, সব ক্ষেত্রেই আমরা পুরোপুরি বিজ্ঞানের উপর নির্ভরশীল। তবে, আজকের এই আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থা বিজ্ঞানের বহু দিনের গবেষণার ফলাফল। চিকিৎসা বিজ্ঞান ও চিকিৎসা গবেষণার ইতিহাস অতি সুপ্রাচীন। খ্রিস্ট জন্মের শত শত বছর আগেই দর্শন, বিজ্ঞান ও চিকিৎসা মাত্র একই সঙ্গে প্রতিভাত হয়। বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখার মতো এখানে গ্রিক সভ্যতা এগিয়ে ছিল। পরবর্তীকালে মিসরীয় চৈনিক মুসলিম ও ভারতীয় চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের হাত ধরে চিকিৎসা শাস্ত্র এগুতে থাকে। অষ্টাদশ শতকে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চিকিৎসা গবেষণাকে আরও বিজ্ঞানভিত্তিক কাঠামো প্রদান করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ব্যাপক প্রসার ঘটে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে আছে। তবে বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও দেশের মানুষের চিকিৎসা সেবার পাশাপাশি গবেষণায় অনেক উন্নতি সাধন করেছে। যার ফলশ্রুতিতে এই মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় বর্তমানে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মর্যাদাপূর্ণ স্থান করে নিয়েছে।

উচ্চতর মেডিকেল শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সেবায় বিশ্বমানের সঙ্গে সঙ্গে এই বিশ্ববিদ্যালয় চিকিৎসা গবেষণাও চলছে। উন্নতমানের চিকিৎসা প্রদান করার জন্য গবেষণার কোন বিকল্প নেই। বিশ্বায়নের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের নতুন নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবণের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। একমাত্র বৈজ্ঞানিক গবেষণার মাধ্যমেই এ লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব।

সংবিধান স্বীকৃত জনগণের মৌলিক অধিকার স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করা এবং দেশের চিকিৎসা শিক্ষা, গবেষণা ও সেবার মান উন্নয়নের লক্ষ্য নিয়ে ১৯৯৮ সালের ৩ এপ্রিল তৎকালীন আইপিজিএমআর কে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে উন্নীত করার মধ্যে দিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের প্রথম স্বতন্ত্র পাবলিক মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমানে আমরা গবেষণায় গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছি, যেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ^বিদ্যালয় গবেষণায় বিশে^র বুকে রোল মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। ইতোমধ্যে কোভিড-১৯-এর জেনোম সিকোয়েন্সিং গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করেছি। গবেষণায় দেখা গেছে মোট সংক্রমণের প্রায় ৯৮ শতাংশ হচ্ছে ইন্ডিয়ান বা ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট। কোভিড-১৯-এর টিকা গ্রহীতাদের উপর গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করেছি। সেখানে দেখা গেছে টিকা গ্রহীতাদের ৯৮ শতাংশের শরীরে এন্টিবডির উপস্থিতি পাওয়া গেছে। এছাড়া ক্যাডাভারিক ট্রান্সপ্ল্যান্টের উপর গবেষণা চলমান রয়েছে।

উন্নত চিকিৎসা সেবা প্রদান উন্নত চিকিৎসা শিক্ষা ও গবেষণায় আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক সংযুক্তির মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় আন্তর্জাতিক মানের বিশ্ববিদ্যালয় হিসাবে বিশ্বের বুকে মাথা তুলে দাঁড়াবে এই প্রত্যাশা সবার। সবাই মিলে যার যে দায়িত্ব সঠিকভাবে পালনের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর নামে প্রতিষ্ঠিত এই মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় সফল হবেই।

[লেখক : উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়]

আরও খবর

বুধবার, ২৭ অক্টোবর ২০২১ , ১১ কার্তিক ১৪২৮ ১৯ রবিউল আউয়াল ১৪৪৩

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা দিবস

শারফুদ্দিন আহমেদ

‘বিজ্ঞান হচ্ছে মনের পরিশ্রমের কারুকাজ’- ফ্রান্সিস বেকনের এই উক্তির সঙ্গে আপনার দ্বিমত থাকতেই পারে, কিন্তু এটি অস্বীকার করার উপায় নেই যে, বর্তমানের আধুনিক মানব সভ্যতা বিজ্ঞানের আশির্বাদস্বরূপ। বিজ্ঞান আমাদের জীবনের সঙ্গে ওতোপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। আর বিজ্ঞানের যে শাখাটি ছাড়া মানুষ বর্তমানে তার অস্তিত্ব কল্পনা করতে পারে না সেটি হচ্ছে চিকিৎসা বিজ্ঞান।

প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক ভীষণ নিবিড়। আর প্রাচীনকালে মানুষ চিকিৎসার জন্য সম্পৃর্ণভাবে প্রকৃতির উপর নির্ভরশীল ছিল। প্রকৃতিতে অফুরান্ত উপকারী ভেষজ উপাদান রয়েছে। কিন্তু এসব উপাদানকে সঠিকভাবে প্রক্রিয়াজাতকরণ তখনকার দিনে অসম্ভব ছিল। কারণ তখন বিজ্ঞান ছিল না। ফলে দেখা যেতো ডায়েরিয়া, কলেরার মতো যেসব রোগ নিয়ে বর্তমানে কারও কিছুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই, তখনকার দিনে এসব রোগে গ্রামের পর গ্রামের মানুষ প্রাণ হারাতো। কারো এসব রোগ দেখা দিলে তাকে একঘরে রাখা হতো। যদি লতাপাতায় কাজ না হতো তবে তাদের শেষ ভরসা ছিল পানি পড়া, তাবিজ, ঝাড়ফুঁক, পীর, ফকির, ওঝা। এডাম স্মিথ বলেছিলেন, ‘উদ্দীপনা এবং কুসংস্কারের বিষের দুর্দান্ত প্রতিষেধক হলো বিজ্ঞান’।

২৭ অক্টোবর ২০২১ তারিখে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় গবেষণা দিবস। বর্তমানে দৈনন্দিন জীবন হোক বা চিকিৎসা, সব ক্ষেত্রেই আমরা পুরোপুরি বিজ্ঞানের উপর নির্ভরশীল। তবে, আজকের এই আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থা বিজ্ঞানের বহু দিনের গবেষণার ফলাফল। চিকিৎসা বিজ্ঞান ও চিকিৎসা গবেষণার ইতিহাস অতি সুপ্রাচীন। খ্রিস্ট জন্মের শত শত বছর আগেই দর্শন, বিজ্ঞান ও চিকিৎসা মাত্র একই সঙ্গে প্রতিভাত হয়। বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখার মতো এখানে গ্রিক সভ্যতা এগিয়ে ছিল। পরবর্তীকালে মিসরীয় চৈনিক মুসলিম ও ভারতীয় চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের হাত ধরে চিকিৎসা শাস্ত্র এগুতে থাকে। অষ্টাদশ শতকে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চিকিৎসা গবেষণাকে আরও বিজ্ঞানভিত্তিক কাঠামো প্রদান করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ব্যাপক প্রসার ঘটে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে আছে। তবে বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও দেশের মানুষের চিকিৎসা সেবার পাশাপাশি গবেষণায় অনেক উন্নতি সাধন করেছে। যার ফলশ্রুতিতে এই মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় বর্তমানে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মর্যাদাপূর্ণ স্থান করে নিয়েছে।

উচ্চতর মেডিকেল শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সেবায় বিশ্বমানের সঙ্গে সঙ্গে এই বিশ্ববিদ্যালয় চিকিৎসা গবেষণাও চলছে। উন্নতমানের চিকিৎসা প্রদান করার জন্য গবেষণার কোন বিকল্প নেই। বিশ্বায়নের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের নতুন নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবণের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। একমাত্র বৈজ্ঞানিক গবেষণার মাধ্যমেই এ লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব।

সংবিধান স্বীকৃত জনগণের মৌলিক অধিকার স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করা এবং দেশের চিকিৎসা শিক্ষা, গবেষণা ও সেবার মান উন্নয়নের লক্ষ্য নিয়ে ১৯৯৮ সালের ৩ এপ্রিল তৎকালীন আইপিজিএমআর কে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে উন্নীত করার মধ্যে দিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের প্রথম স্বতন্ত্র পাবলিক মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমানে আমরা গবেষণায় গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছি, যেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ^বিদ্যালয় গবেষণায় বিশে^র বুকে রোল মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। ইতোমধ্যে কোভিড-১৯-এর জেনোম সিকোয়েন্সিং গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করেছি। গবেষণায় দেখা গেছে মোট সংক্রমণের প্রায় ৯৮ শতাংশ হচ্ছে ইন্ডিয়ান বা ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট। কোভিড-১৯-এর টিকা গ্রহীতাদের উপর গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করেছি। সেখানে দেখা গেছে টিকা গ্রহীতাদের ৯৮ শতাংশের শরীরে এন্টিবডির উপস্থিতি পাওয়া গেছে। এছাড়া ক্যাডাভারিক ট্রান্সপ্ল্যান্টের উপর গবেষণা চলমান রয়েছে।

উন্নত চিকিৎসা সেবা প্রদান উন্নত চিকিৎসা শিক্ষা ও গবেষণায় আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক সংযুক্তির মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় আন্তর্জাতিক মানের বিশ্ববিদ্যালয় হিসাবে বিশ্বের বুকে মাথা তুলে দাঁড়াবে এই প্রত্যাশা সবার। সবাই মিলে যার যে দায়িত্ব সঠিকভাবে পালনের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর নামে প্রতিষ্ঠিত এই মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় সফল হবেই।

[লেখক : উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়]