২৮ বছর পর বাচ্চু মণ্ডলের সন্ধান পেল পরিবার

অভিমান করে বাড়ি ছেড়েছিলেন

বাচ্চু মণ্ডল (৬৪)। কুড়িগ্রামের সদর উপজেলার পলাশপুর গ্রামের মৃত কান্দুরা মাহমুদ মণ্ডলের ছেলে। কিন্তু কেউ তার ঠিকানা জানত না। তার ঠিকানা ছিল যশোরের অভয়নগর উপজেলার সুন্দলী ইউনিয়ন পরিষদ। ২৮ বছর আগে অভিমান করে ঘর ছেড়ে এখানেই ঠাঁই নিয়েছিলেন তিনি। এখানে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সঙ্গে মিলেমিশে দীর্ঘ এ সময় বসবাস করেছেন। অবশেষে সন্ধান পাওয়ার পর পরিবারের সদস্যরা গত মঙ্গলবার রাতে তাকে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে গেছেন। অভয়নগরের সুন্দলী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বিকাশ রায় কপিলের মধ্যস্ততায় সব ইউপি সদস্য, সাংবাদিক ও সুধীজনদের উপস্থিতিতে গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ইউনিয়ন পরিষদ থেকে বাচ্চু মণ্ডলকে তার পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

দীর্ঘ ২৮ বছর সুন্দলী ইউনিয়নে বসবাস করেছেন বাচ্চু মণ্ডল। তিনি জানান, স্ত্রী জাহেদা বেগমের ওপর অভিমান করে ৩৬ বছর বয়সে আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ি। বিভিন্ন যানবাহনে করে যশোর মণিহার সিনেমা হলের সামনে পৌঁছাই। সেখান থেকে অভয়নগরের নওয়াপাড়া বাজার হয়ে সুন্দলী ইউনিয়নের সুন্দলী বাজারে পৌঁছালে রাত হয়ে যায়। তখন ওই ইউনিয়নের আড়পাড়া গ্রামের নগেন্দ্রনাথ রায় আমাকে তার বাড়িতে নিয়ে যান। সেখানে খাওয়া-থাকার শর্তে তার কৃষি জমি ও বাড়ির কাজ করতে শুরু করি।

আনুমানিক তিন বছর পর ওই ইউনিয়নের গোবিন্দপুর গ্রামের মুকুন্দ মল্লিক আমাকে তার বাড়িতে থাকার অনুরোধ করেন। সেখানে দুই বছর থাকার পর একই গ্রামের চারু মল্লিকের বাড়িতে চলে যাই।

২০০৬ সালে সুন্দলী ইউনিয়ন পরিষদের তৎকালীন চেয়ারম্যান বিকাশ মল্লিক ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে বাচ্চু পরিবহন লেখা একটি ভ্যান আমাকে উপহার দেন। যে ভ্যান চালিয়ে আমি জীবিকা নির্বাহ শুরু করি। পরবর্তীতে আমাকে ইউনিয়ন পরিষদের অস্থায়ী পরিচ্ছন্ন কর্মী হিসেবে কাজ দেয়া হয়। সেই সময় ইউনিয়ন পরিষদের গ্রাম পুলিশ শেখর বিশ্বাস আমাকে তার বাড়িতে থাকতে দেন। পরবর্তীতে ২০১০ সালে সুন্দলী ইউনিয়ন পরিষদের নতুন ভবনের দ্বিতীয় তলার একটি কক্ষে বসবাস করার সুযোগ করে দেন পরিষদের তৎকালীন চেয়ারম্যান ও মেম্বাররা। সেই থেকে অদ্যাবধি আমার ঘরবাড়ি সুন্দলী ইউনিয়ন পরিষদ।

দু’চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়া জল মুছে বাচ্চু মণ্ডল আরও বলেন, আমার মা-বাবা দুজনের কেউ বেঁচে নেই। চার ভাইয়ের মধ্যে আমি সেজ। স্ত্রী-সন্তান ও আত্মীয়-বন্ধুদের ফেলে দীর্ঘ ২৮ বছর ধরে আমি সনাতন ধর্মের মানুষের সঙ্গে বসবাস করেছি। এ ইউনিয়নে ৯৯ শতাংশ হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ। তারা আমাকে তাদের ভাই হিসেবে সম্মান ও শ্রদ্ধা করেছে। থাকতে দিয়েছে, ভালো খেতে দিয়েছে, ভালো ব্যবহার করেছে। কখনও অন্য ধর্মের মানুষ হিসেবে আমাকে ঘৃণা করেনি। আমি সুন্দলী ইউনিয়নবাসীর কাছে ঋণী। বাড়ি ফিরে গেলেও মনের টানে অভয়নগরের সুন্দলী ইউনিয়নে সপরিবারে বেড়াতে আসবেন বলে তিনি জানান।

বাচ্চু মণ্ডলের ভাইপো শফিকুল ইসলাম জানান, চাচা নিখোঁজ হওয়ার পর আমরা অনেক খোঁজাখুজি করেছি। একপর্যায়ে চাচার আশা ছেড়েই দিয়েছিলাম। সম্প্রতি আমাদের এলাকার গ্রাম পুলিশ অসিত বিশ্বাসের মাধ্যমে চাচার সন্ধান মেলে। রাতেই চাচাকে নিয়ে বাড়ির পথে রওনা হয়েছি। তিনি আরও জানান, চাচি অন্তঃসত্ত্বা থাকতে চাচা নিখোঁজ হয়েছিলেন। বর্তমানে জাহিদুল ইসলাম নামে চাচার একটি ছেলে রয়েছে। তার বয়স এখন প্রায় ২৭ বছর। পরিবারের পক্ষ থেকে আমরা চাচাকে নিয়ে যাচ্ছি। এ এলাকার মানুষ সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।

সুন্দলী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বিকাশ রায় কপিল জানান, বাচ্চু মণ্ডলের পরিবার আছে, এমন কথা সে কোনদিন কাউকে বলেননি। দীর্ঘ ২৮ বছর ধরে তিনি আমাদের ইউনিয়নে রয়েছেন। ২০১০ সাল থেকে পরিষদের দ্বিতীয় তলার একটি কক্ষে থাকতেন। খুব ভালো মনের মানুষ তিনি। সবাই তাকে বাচ্চু ভাই বলে ডাকত। তবে ২৮ বছর পর মানুষটিকে তার পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দিতে পেরে আমরা আত্মতৃপ্তি পেয়েছি।

আরও খবর
জাতীয় যে কোন প্রয়োজনে সেনাবাহিনী সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত : প্রধানমন্ত্রী
২০ কোটি ডলার ঋণ দিচ্ছে বিশ্বব্যাংক
ঢাবির দুই শিক্ষকের গবেষণায় চোর্যবৃত্তি, তদন্তে গড়িমসি
কাপ্তাইয়ে নির্বাচনী সহিংসতায় ইউপি মেম্বার নিহত
হরিণার বিলে অবৈধ মাছের ঘের দেড় হাজার বিঘার ধান পচে গেছে
গণটিকার দ্বিতীয় ডোজ আজ শুরু
আমাদের লক্ষ্য শিক্ষাকে জীবন ও সংস্কৃতিমুখী করা : শিক্ষামন্ত্রী
ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত ২৩ হাজার ছাড়িয়েছে
গুলশানে আবাসিক ভবনে আগুন : ৩ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক
বাবুলের নারাজি আবেদনে আদেশ ৩ নভেম্বর
ছয় কোটি টাকার সম্পদের মালিক হয়েও বিনা চিকিৎসায় মারা যান পঙ্গু ইরান
রেইনট্রি ধর্ষণ মামলার রায় ঘোষণা ফের পেছালো

বৃহস্পতিবার, ২৮ অক্টোবর ২০২১ , ১২ কার্তিক ১৪২৮ ২০ রবিউল আউয়াল ১৪৪৩

২৮ বছর পর বাচ্চু মণ্ডলের সন্ধান পেল পরিবার

অভিমান করে বাড়ি ছেড়েছিলেন

যশোর অফিস

বাচ্চু মণ্ডল (৬৪)। কুড়িগ্রামের সদর উপজেলার পলাশপুর গ্রামের মৃত কান্দুরা মাহমুদ মণ্ডলের ছেলে। কিন্তু কেউ তার ঠিকানা জানত না। তার ঠিকানা ছিল যশোরের অভয়নগর উপজেলার সুন্দলী ইউনিয়ন পরিষদ। ২৮ বছর আগে অভিমান করে ঘর ছেড়ে এখানেই ঠাঁই নিয়েছিলেন তিনি। এখানে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সঙ্গে মিলেমিশে দীর্ঘ এ সময় বসবাস করেছেন। অবশেষে সন্ধান পাওয়ার পর পরিবারের সদস্যরা গত মঙ্গলবার রাতে তাকে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে গেছেন। অভয়নগরের সুন্দলী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বিকাশ রায় কপিলের মধ্যস্ততায় সব ইউপি সদস্য, সাংবাদিক ও সুধীজনদের উপস্থিতিতে গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ইউনিয়ন পরিষদ থেকে বাচ্চু মণ্ডলকে তার পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

দীর্ঘ ২৮ বছর সুন্দলী ইউনিয়নে বসবাস করেছেন বাচ্চু মণ্ডল। তিনি জানান, স্ত্রী জাহেদা বেগমের ওপর অভিমান করে ৩৬ বছর বয়সে আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ি। বিভিন্ন যানবাহনে করে যশোর মণিহার সিনেমা হলের সামনে পৌঁছাই। সেখান থেকে অভয়নগরের নওয়াপাড়া বাজার হয়ে সুন্দলী ইউনিয়নের সুন্দলী বাজারে পৌঁছালে রাত হয়ে যায়। তখন ওই ইউনিয়নের আড়পাড়া গ্রামের নগেন্দ্রনাথ রায় আমাকে তার বাড়িতে নিয়ে যান। সেখানে খাওয়া-থাকার শর্তে তার কৃষি জমি ও বাড়ির কাজ করতে শুরু করি।

আনুমানিক তিন বছর পর ওই ইউনিয়নের গোবিন্দপুর গ্রামের মুকুন্দ মল্লিক আমাকে তার বাড়িতে থাকার অনুরোধ করেন। সেখানে দুই বছর থাকার পর একই গ্রামের চারু মল্লিকের বাড়িতে চলে যাই।

২০০৬ সালে সুন্দলী ইউনিয়ন পরিষদের তৎকালীন চেয়ারম্যান বিকাশ মল্লিক ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে বাচ্চু পরিবহন লেখা একটি ভ্যান আমাকে উপহার দেন। যে ভ্যান চালিয়ে আমি জীবিকা নির্বাহ শুরু করি। পরবর্তীতে আমাকে ইউনিয়ন পরিষদের অস্থায়ী পরিচ্ছন্ন কর্মী হিসেবে কাজ দেয়া হয়। সেই সময় ইউনিয়ন পরিষদের গ্রাম পুলিশ শেখর বিশ্বাস আমাকে তার বাড়িতে থাকতে দেন। পরবর্তীতে ২০১০ সালে সুন্দলী ইউনিয়ন পরিষদের নতুন ভবনের দ্বিতীয় তলার একটি কক্ষে বসবাস করার সুযোগ করে দেন পরিষদের তৎকালীন চেয়ারম্যান ও মেম্বাররা। সেই থেকে অদ্যাবধি আমার ঘরবাড়ি সুন্দলী ইউনিয়ন পরিষদ।

দু’চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়া জল মুছে বাচ্চু মণ্ডল আরও বলেন, আমার মা-বাবা দুজনের কেউ বেঁচে নেই। চার ভাইয়ের মধ্যে আমি সেজ। স্ত্রী-সন্তান ও আত্মীয়-বন্ধুদের ফেলে দীর্ঘ ২৮ বছর ধরে আমি সনাতন ধর্মের মানুষের সঙ্গে বসবাস করেছি। এ ইউনিয়নে ৯৯ শতাংশ হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ। তারা আমাকে তাদের ভাই হিসেবে সম্মান ও শ্রদ্ধা করেছে। থাকতে দিয়েছে, ভালো খেতে দিয়েছে, ভালো ব্যবহার করেছে। কখনও অন্য ধর্মের মানুষ হিসেবে আমাকে ঘৃণা করেনি। আমি সুন্দলী ইউনিয়নবাসীর কাছে ঋণী। বাড়ি ফিরে গেলেও মনের টানে অভয়নগরের সুন্দলী ইউনিয়নে সপরিবারে বেড়াতে আসবেন বলে তিনি জানান।

বাচ্চু মণ্ডলের ভাইপো শফিকুল ইসলাম জানান, চাচা নিখোঁজ হওয়ার পর আমরা অনেক খোঁজাখুজি করেছি। একপর্যায়ে চাচার আশা ছেড়েই দিয়েছিলাম। সম্প্রতি আমাদের এলাকার গ্রাম পুলিশ অসিত বিশ্বাসের মাধ্যমে চাচার সন্ধান মেলে। রাতেই চাচাকে নিয়ে বাড়ির পথে রওনা হয়েছি। তিনি আরও জানান, চাচি অন্তঃসত্ত্বা থাকতে চাচা নিখোঁজ হয়েছিলেন। বর্তমানে জাহিদুল ইসলাম নামে চাচার একটি ছেলে রয়েছে। তার বয়স এখন প্রায় ২৭ বছর। পরিবারের পক্ষ থেকে আমরা চাচাকে নিয়ে যাচ্ছি। এ এলাকার মানুষ সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।

সুন্দলী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বিকাশ রায় কপিল জানান, বাচ্চু মণ্ডলের পরিবার আছে, এমন কথা সে কোনদিন কাউকে বলেননি। দীর্ঘ ২৮ বছর ধরে তিনি আমাদের ইউনিয়নে রয়েছেন। ২০১০ সাল থেকে পরিষদের দ্বিতীয় তলার একটি কক্ষে থাকতেন। খুব ভালো মনের মানুষ তিনি। সবাই তাকে বাচ্চু ভাই বলে ডাকত। তবে ২৮ বছর পর মানুষটিকে তার পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দিতে পেরে আমরা আত্মতৃপ্তি পেয়েছি।