রংপুরে জেলেপল্লীতে সাম্প্রদায়িক হামলা

পীরগঞ্জে গ্রেপ্তার আতঙ্কে পুরুষ শূন্য ৭ গ্রাম

মুদি দোকানি হারুনর রশীদ তান্ডবের সময় এক মাইল দূরে তার দোকানে

ছিলেন, হোটেল শ্রমিক হারুন ও রহিম-সেই সময়ে চা ও সিঙ্গারা-পুড়ি তৈরি

করছিলেন; দুই কিশোর-রনি ও মিল্লাত তা-বের পরের দিন ওই এলাকায় দেখতে গিয়েছিল; এদেরকে গ্রেপ্তার করে আসামি করা হয়েছে

পীরগঞ্জের মাঝিপাড়ায় জেলেপল্লী থেকে সোডাপীর বাজারের দূরত্ব প্রায় এক মাইল। সেই বাজারেই মুদি দোকানি হারুনর রশীদ। জেলেপাড়ায় যেদিন সাম্প্রদায়িক হামলা হলো, সেদিন প্রায় সারাদিনই হারুন তার দোকানেই ছিলেন। রাত এগারোটা পর্যন্ত দোকান করে তিনি বাড়ি ফেরেন। তার সঙ্গে রাত পৌনে এগারটায় দোকানে দেখা হয়েছে রায়পুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের। পরের দিন হারুনকে জায়গীরপাড়া গ্রামের বাড়ি থেকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে সাম্প্রদায়িক তান্ডবের মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়েছে।

গ্রামের মানুষ এবং ইউপি চেয়ারম্যান সাইদুর রহমান চৌধুরী দুলাল বলছেন, হারুন ওই তান্ডবে ‘অংশ নেয়নি’। সাইদুর জানান, তার ইউনিয়ন থেকে ১১ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এদের মধ্যে ‘৭ জন নিরাপরাধ’, তারা ঘটনার সঙ্গে ‘কোনভাবেই জড়িত ছিল না’।

বটেরহাট বাজারে হোটেল শ্রমিক হারুন ও রহিম- দুই ভাই। হামলার ঘটনার সময় তারা দুজন চা ও সিঙ্গারা তৈরির কাজ করছিল বলে জানালেন ওই হোটেলের মালিক সাহাবুল। তবে দুই ভাইকেও পুলিশ ধরে নিয়ে এই মামলায় অভিযুক্ত করেছে।

‘তান্ডবের ঘটনা ঘটেছে মাঝিপাড়ায় আর আমার হোটেল বটেরহাট এলাকায়। তারা (হারুন ও রহিম) হোটেল থেকে বেরই হয়নি। ফলে তান্ডবের ঘটনায় অংশ নেবার প্রশ্নই আসে না,’ বললেন সাহাবুল।

আর এর পর থেকে গ্রেপ্তার আতঙ্কে ৭টি গ্রাম পুরুষ শূন্য হয়ে পড়েছে বলে অভিযোগ। দশ দিন ধরে এসব গ্রামে থাকছেন না কোন পুরুষ।

গত মঙ্গলবার পীরগঞ্জ উপজেলার তান্ডবে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা ঘুরতে গিয়ে রামনাথপুর ইউনিয়নের নোকার পাড়া, জায়গীরপাড়া, বড় করিমপুর, রাজারামপুর, মজিদপুর এবং চতরা ইউনিয়নের পলিপাড়া ও সাতগাড়া গ্রামে ঘুরে পুরুষের দেখা পাওয়া গেল না। শুধুমাত্র নারী ও শিশুরা বাসায় অবস্থান করছে।

শহিদুল ইসলামের স্ত্রী আঙ্গুরী বেগম জানালেন প্রতিরাতে গ্রামে লোকজন আসে। এরা ‘পুলিশ না কোন সংস্থার লোক’ বোঝার কোন উপায় নেই। অনেকেই এসে কোন কারণ ছাড়াই বাসায় ডাকাডাকি, খোঁজাখুজি করেন।

হালিম মিয়ার স্ত্রী লাইজু বেগম অভিযোগ করলেন তান্ডবের ঘটনার পরের দিন গ্রামে পুলিশ আসার পর তার স্বামী বাড়িতে আসে না। অথচ তান্ডবের ঘটনা সম্পর্কে সে কিছুই জানে না।

একই কথা জানালেন আয়েশা ছিদ্দিকা নামে এক গৃহবধূ। তিনি জানান, তার স্বামী বিভিন্ন এলাকায় রাজমিস্ত্রির কাজ করে। গ্রেপ্তারের ভয়ে ৮ দিন ধরে বাসায় আসে না। ফলে অর্থের অভাবে পরিবার-পরিজন নিয়ে অনাহারে-অর্ধাহারে আছেন তারা। এরকমই অভিযোগ নাখার পাড়া গ্রামের মমতাজ বেগম, লাইলী বেগম, জায়গীরহাট গ্রামের মাহমুদা বেগম, রাজারামপুর গ্রামের মকসুদা, বড় করিমপুর গ্রামে সাদেকা, হালিমাসহ অনেকেরই।

তবে এই আতঙ্ক শুধু পুরুষদের তা নয়। গ্রেপ্তার আতঙ্কে এসএসসি পরীক্ষার্থীসহ অনেক শিক্ষার্থী কোচিং করার জন্য বাড়ি থেকে বাইরে বের হতে পারছে না বলেও অভিযোগ। কারণ তান্ডবের ঘটনার পর বেশ কয়েকজন কিশোরকে ধরে নিয়ে মামলায় চালান দিয়েছে পুলিশ।

এদের মধ্যে রনি মিয়া (১৬), একরামুল হক (১৫), আতিক তালুকদার, মিরাজুল (১৭) এরা যে শিশু-কিশোর তা পুলিশ গ্রেপ্তার করার পর আদালতে চালান দেবার সময় ফরওয়াডিং রিপোর্টে উল্লেখ করেছে। এই চারজনের শিশু আদালতে বিচারিক কার্যক্রম চলছে।

এ ব্যাপারে কোর্ট সিএসআই শহিদুল ইসলাম জানিয়েছেন, ওই ৪ জন শিশু অর্থাৎ বয়স ১৮ বছরের কম হওয়ায় তাদের সহিংসতার মামলার অন্য আসামিদের সঙ্গে আদালতে আনা হয় না। তাদের শিশু আদালতে নেয়া হয়। তিনি বলছেন, তাদের ‘বিশেষ ব্যবস্থায়’ রাখা হয়েছে।

তান্ডবের ঘটনার পর থেকে মাঝিপাড়া কসবা এলাকার আশপাশের সোডাপীর বাজার, সাতগাড়া বাজার, নেংটি ছিড়ার বাজার, বটেরহাট, গনির বাজার ও মন্ডলের বাজার এই ৬টি ছোট ছোট বাজার সন্ধ্যার পর পুরুষ শূন্য হয়ে পড়ছে। দোকানিরা বললেন, গ্রেপ্তার আতঙ্কে বাজার করতে আসে না আশপাশের গ্রামের মানুষ। ফলে এসব বাজারের ব্যবসায়ীরা বলছেন, তাদের বিক্রি-বাট্টায় ‘চরম মন্দা’।

গ্রামবাসীর অভিযোগ তান্ডবের ঘটনায় যে ৭১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে তাদের বেশিরভাগই নিরীহ

অভিযোগ, রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদের নামে থানায় এনে ‘নির্যাতন করে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়ার জন্য চাপ দিচ্ছে’

তবে পুলিশ বলছে, ‘যারা ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিল না তাদের বাড়িতে থাকতে কোন সমস্যা নেই। নিরাপরাধ কাউকেই ধরা হবে না’।

তবে গ্রামবাসীর অভিযোগ তান্ডবের ঘটনায় এ পর্যন্ত যে ৭১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে তাদের ‘বেশিরভাগই নিরীহ। ঘটনার সঙ্গে কোন সম্প্রিক্ততা নেই’। অভিযোগ পুলিশ ‘নিরীহ মানুষদের ধরে’ মামলায় আসামি করে আদালতে চালান দিচ্ছে। আর রিমান্ডে জ্ঞিাসাবাদের নামে থানায় এনে ‘নির্যাতন করে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেবার জন্য চাপ দিচ্ছে’।

এদিকে ক্ষতিগ্রস্ত বেশ কয়েকজন হিন্দু পরিবারের সদস্য জানিয়েছেন, নাখারপাড়া, জায়গীরপাড়াসহ কয়েকটি গ্রামের লোকজন তান্ডবের ঘটনায় অংশ নেয়নি। যদি ২/৪ জন অংশ নিয়েও থাকে শুধু তাদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেয়া হোক। তাদের আশা নিরাপরাধ কেউ যেন হয়রানির শিকার না হয়। তবে তারা কেউ নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি।

এ ব্যাপারে স্থানীয় রামনাথপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা সাদেকুল ইসলাম বিএসসি বলেন, ‘আমরা গ্রামবাসীকে বাড়িতে থাকতে বার বার আহ্বান জানিয়েছি।’ তবে তিনিও বললেন, যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন নিরাপরাধ। তবে তার মন্তব্য- পুলিশ বলেছে, তদন্ত করে পদক্ষেপ নেবে।

পীরগঞ্জ পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের ধনশালা মহল্লার রনি ও মিল্লাত দুজনই কিশোর। পুলিশ তাদের ধরে নিয়ে সহিংসতার মামলায় ‘জড়িয়ে দিয়েছে’।

এ ব্যাপারে ওই এলাকার মানবাধিকার কর্মী ও সমাজ সেবক মোজাম্মেল হক সরকার খুদু বলেন, ‘রনি ও মিল্লাত দুজনের বয়স ১৮ বছরের নিচে। তারা তান্ডবের ঘটনার পরের দিন ১৮ অক্টোবর ওই এলাকায় দেখতে গিয়েছিল। সেখান থেকেই পুলিশ তাদের গ্রেপ্তার করেছে। তারা তান্ডবের ঘটনার সঙ্গে সংম্পৃক্ত নয়।’ একই কথা জানালেন ওই ওয়ার্ডের নারী অধিকার কর্মী মমতাজ বেগম।

সাম্প্রদায়িক তান্ডবের ঘটনার পর পীরগঞ্জ থানা পুলিশ সহিংসতার ঘটনায় এ পর্যন্ত ৭১ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। পীরগঞ্জ থানার ওসি সরেস চন্দ্র জানিয়েছেন তান্ডবের ঘটনায় এ পর্যন্ত মামলা হয়েছে ৪টি। এর মধ্যে ৩টি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ও একটি সহিংসতার ঘটনায়। এর মধ্যে ‘ধর্মীয় অবমানার’ পোস্ট দেবার ঘটনায় পরিতোষ রায়ের বিরুদ্ধে একটি, তার সহযোগী উজ্জল ও আল আমিনের বিরুদ্ধে একটি এবং কারমাইকেল কলেজ শাখার ছাত্রলীগ নেতা সৈকত মন্ডলের বিরুদ্ধে একটি। বাকি ৬৭ জনকে সহিংসতার ঘটনায় করা মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে।

এদিকে পীরগঞ্জ উপজেলা পূজা উদযাপন কমিটির আহ্বায়ক সুধির চন্দ্র জানান, বুধবার মাঝিপাড়ায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারসহ হিন্দু সম্প্রদায়ের সঙ্গে পুলিশ মতবিনিময় করেছে। সেখানে রংপুর রেঞ্জের ডিআইজি দেবদাস ভট্টাচার্য, পুলিশ সুপার বিপ্লব কুমারসহ পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। সুধির চন্দ্র বলেন, ‘আমি তাদের বলেছি, ঘটনার সঙ্গে যারা সত্যি সত্যি জড়িত শুধু তাদের গ্রেপ্তার করা হোক, কোন নিরাপরাধ মানুষকে যেন গ্রেপ্তার করা না হয়।’

পীরগঞ্জের তান্ডবের ঘটনাস্থল ঘুরে এসেছেন মানবাধিকার কর্মী এবং সুজনের রংপুর জেলা সম্পাদক অধ্যক্ষ খায়রুল আনাম বেঞ্জু। এরপর পুরো বিষয় পর্যবেক্ষণ করছেন তিনি। তার বক্তব্য প্রযুক্তির মাধ্যমে দায়ীদের অনেককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কিন্তু তাই বলে ‘গ্রাম শূন্য করে দিয়ে নতুন করে আতঙ্ক সৃষ্টি’ করা, সাধারণ মানুষ যাতে ‘হয়রানির শিকার’ না হয় সেটা প্রশাসনের দেখা দরকার।

তবে পীরগঞ্জ থানার ওসি সরেস চন্দ্র জানিয়েছেন, ‘নিরীহ কোন ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়নি ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাবার পরেই গ্রেপ্তার’ করা হয়েছে। সাত গ্রামে কোন পুরুষ নেই একথা সত্য নয়- দাবি করে তিনি বলেন, ‘আমরা বলেছি, যারা ঘটনার সঙ্গে জড়িত নয়, তারা বাসায় থাকবেন। অন্যায়ভাবে কাউকেই গ্রেপ্তার করা হয়নি, হবেও না।’

রায়পুর ইউপি চেয়ারম্যান সাইদুর রহমান চৌধুরী বললেন, ‘অন্যায়ভাবে গ্রেপ্তার’ ব্যক্তিদের নাম ঠিকানাসহ তালিকা তিনি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে দিয়েছেন।

উল্লেখ্য, শারদীয় দুর্গাপূজার মহা অষ্টমীর দিন ১৩ অক্টোবর ভোরে কুমিল্লা শহরের নানুয়াদিঘির উত্তরপাড়ে দর্পণ সংঘের উদ্যোগে আয়োজিত অস্থায়ী পূজামন্ডপে পবিত্র কোরআন দেখা যায়। এরপর কোরআন অবমাননার অভিযোগ তুলে ওই মন্ডপে হামলা চালায় একদল লোক। সেখানে ব্যাপক ভাঙচুর চালানো হয়।

ওই ঘটনায় প্রাপ্ত সিসিটিভি ফুটেজে ইকবাল নামের এক ব্যক্তিকে দেখা যায়। সিসিটিভি’র সে ফুটেজে দেখা যায়, অভিযুক্ত ইকবাল হোসেন কীভাবে, কখন মসজিদে যান এবং বের হন। এরপর মন্ডপের দিকে যান এবং মন্ডপ থেকে গদা হাতে ফেরেন তা ফুটেজে অনেকটা স্পষ্ট। পরবর্তীতে ২১ অক্টোবর রাত সাড়ে ১০টার দিকে ইকবালকে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের সুগন্ধা পয়েন্ট থেকে আটক করা হয়।

এদিকে, কুমিল্লার ঘটনার পর ১৩ থেকে ১৮ অক্টোবর পর্যন্ত নোয়াখালী, চাঁদপুর, ফেনী, চট্টগ্রাম ও রংপুরে হিন্দু সম্প্রদায়ের দুর্গাপূজার মন্ডপ, মন্দির, বসতি, জীবন ও সম্পত্তির ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের পক্ষ থেকে ক্ষয়ক্ষতির একটি তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। তাদের হিসাব অনুযায়ী, ১৩ অক্টোবর কুমিল্লায় আটটি মন্দিরে হামলার পর দেশের ২৩ জেলায় শতাধিক মন্দির ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। সমপরিমাণ বাড়িঘরে হামলা ও আগুনের ঘটনা ঘটেছে। তবে তারা এর আর্থিক ক্ষতি নির্ণয় করেননি।

শুক্রবার, ২৯ অক্টোবর ২০২১ , ১৩ কার্তিক ১৪২৮ ২১ রবিউল আউয়াল ১৪৪৩

রংপুরে জেলেপল্লীতে সাম্প্রদায়িক হামলা

পীরগঞ্জে গ্রেপ্তার আতঙ্কে পুরুষ শূন্য ৭ গ্রাম

লিয়াকত আলী বাদল, রংপুর

image

পুরুষ শূন্য পীরগঞ্জের নাখারপাড়া গ্রাম -সংবাদ

মুদি দোকানি হারুনর রশীদ তান্ডবের সময় এক মাইল দূরে তার দোকানে

ছিলেন, হোটেল শ্রমিক হারুন ও রহিম-সেই সময়ে চা ও সিঙ্গারা-পুড়ি তৈরি

করছিলেন; দুই কিশোর-রনি ও মিল্লাত তা-বের পরের দিন ওই এলাকায় দেখতে গিয়েছিল; এদেরকে গ্রেপ্তার করে আসামি করা হয়েছে

পীরগঞ্জের মাঝিপাড়ায় জেলেপল্লী থেকে সোডাপীর বাজারের দূরত্ব প্রায় এক মাইল। সেই বাজারেই মুদি দোকানি হারুনর রশীদ। জেলেপাড়ায় যেদিন সাম্প্রদায়িক হামলা হলো, সেদিন প্রায় সারাদিনই হারুন তার দোকানেই ছিলেন। রাত এগারোটা পর্যন্ত দোকান করে তিনি বাড়ি ফেরেন। তার সঙ্গে রাত পৌনে এগারটায় দোকানে দেখা হয়েছে রায়পুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের। পরের দিন হারুনকে জায়গীরপাড়া গ্রামের বাড়ি থেকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে সাম্প্রদায়িক তান্ডবের মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়েছে।

গ্রামের মানুষ এবং ইউপি চেয়ারম্যান সাইদুর রহমান চৌধুরী দুলাল বলছেন, হারুন ওই তান্ডবে ‘অংশ নেয়নি’। সাইদুর জানান, তার ইউনিয়ন থেকে ১১ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এদের মধ্যে ‘৭ জন নিরাপরাধ’, তারা ঘটনার সঙ্গে ‘কোনভাবেই জড়িত ছিল না’।

বটেরহাট বাজারে হোটেল শ্রমিক হারুন ও রহিম- দুই ভাই। হামলার ঘটনার সময় তারা দুজন চা ও সিঙ্গারা তৈরির কাজ করছিল বলে জানালেন ওই হোটেলের মালিক সাহাবুল। তবে দুই ভাইকেও পুলিশ ধরে নিয়ে এই মামলায় অভিযুক্ত করেছে।

‘তান্ডবের ঘটনা ঘটেছে মাঝিপাড়ায় আর আমার হোটেল বটেরহাট এলাকায়। তারা (হারুন ও রহিম) হোটেল থেকে বেরই হয়নি। ফলে তান্ডবের ঘটনায় অংশ নেবার প্রশ্নই আসে না,’ বললেন সাহাবুল।

আর এর পর থেকে গ্রেপ্তার আতঙ্কে ৭টি গ্রাম পুরুষ শূন্য হয়ে পড়েছে বলে অভিযোগ। দশ দিন ধরে এসব গ্রামে থাকছেন না কোন পুরুষ।

গত মঙ্গলবার পীরগঞ্জ উপজেলার তান্ডবে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা ঘুরতে গিয়ে রামনাথপুর ইউনিয়নের নোকার পাড়া, জায়গীরপাড়া, বড় করিমপুর, রাজারামপুর, মজিদপুর এবং চতরা ইউনিয়নের পলিপাড়া ও সাতগাড়া গ্রামে ঘুরে পুরুষের দেখা পাওয়া গেল না। শুধুমাত্র নারী ও শিশুরা বাসায় অবস্থান করছে।

শহিদুল ইসলামের স্ত্রী আঙ্গুরী বেগম জানালেন প্রতিরাতে গ্রামে লোকজন আসে। এরা ‘পুলিশ না কোন সংস্থার লোক’ বোঝার কোন উপায় নেই। অনেকেই এসে কোন কারণ ছাড়াই বাসায় ডাকাডাকি, খোঁজাখুজি করেন।

হালিম মিয়ার স্ত্রী লাইজু বেগম অভিযোগ করলেন তান্ডবের ঘটনার পরের দিন গ্রামে পুলিশ আসার পর তার স্বামী বাড়িতে আসে না। অথচ তান্ডবের ঘটনা সম্পর্কে সে কিছুই জানে না।

একই কথা জানালেন আয়েশা ছিদ্দিকা নামে এক গৃহবধূ। তিনি জানান, তার স্বামী বিভিন্ন এলাকায় রাজমিস্ত্রির কাজ করে। গ্রেপ্তারের ভয়ে ৮ দিন ধরে বাসায় আসে না। ফলে অর্থের অভাবে পরিবার-পরিজন নিয়ে অনাহারে-অর্ধাহারে আছেন তারা। এরকমই অভিযোগ নাখার পাড়া গ্রামের মমতাজ বেগম, লাইলী বেগম, জায়গীরহাট গ্রামের মাহমুদা বেগম, রাজারামপুর গ্রামের মকসুদা, বড় করিমপুর গ্রামে সাদেকা, হালিমাসহ অনেকেরই।

তবে এই আতঙ্ক শুধু পুরুষদের তা নয়। গ্রেপ্তার আতঙ্কে এসএসসি পরীক্ষার্থীসহ অনেক শিক্ষার্থী কোচিং করার জন্য বাড়ি থেকে বাইরে বের হতে পারছে না বলেও অভিযোগ। কারণ তান্ডবের ঘটনার পর বেশ কয়েকজন কিশোরকে ধরে নিয়ে মামলায় চালান দিয়েছে পুলিশ।

এদের মধ্যে রনি মিয়া (১৬), একরামুল হক (১৫), আতিক তালুকদার, মিরাজুল (১৭) এরা যে শিশু-কিশোর তা পুলিশ গ্রেপ্তার করার পর আদালতে চালান দেবার সময় ফরওয়াডিং রিপোর্টে উল্লেখ করেছে। এই চারজনের শিশু আদালতে বিচারিক কার্যক্রম চলছে।

এ ব্যাপারে কোর্ট সিএসআই শহিদুল ইসলাম জানিয়েছেন, ওই ৪ জন শিশু অর্থাৎ বয়স ১৮ বছরের কম হওয়ায় তাদের সহিংসতার মামলার অন্য আসামিদের সঙ্গে আদালতে আনা হয় না। তাদের শিশু আদালতে নেয়া হয়। তিনি বলছেন, তাদের ‘বিশেষ ব্যবস্থায়’ রাখা হয়েছে।

তান্ডবের ঘটনার পর থেকে মাঝিপাড়া কসবা এলাকার আশপাশের সোডাপীর বাজার, সাতগাড়া বাজার, নেংটি ছিড়ার বাজার, বটেরহাট, গনির বাজার ও মন্ডলের বাজার এই ৬টি ছোট ছোট বাজার সন্ধ্যার পর পুরুষ শূন্য হয়ে পড়ছে। দোকানিরা বললেন, গ্রেপ্তার আতঙ্কে বাজার করতে আসে না আশপাশের গ্রামের মানুষ। ফলে এসব বাজারের ব্যবসায়ীরা বলছেন, তাদের বিক্রি-বাট্টায় ‘চরম মন্দা’।

গ্রামবাসীর অভিযোগ তান্ডবের ঘটনায় যে ৭১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে তাদের বেশিরভাগই নিরীহ

অভিযোগ, রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদের নামে থানায় এনে ‘নির্যাতন করে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়ার জন্য চাপ দিচ্ছে’

তবে পুলিশ বলছে, ‘যারা ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিল না তাদের বাড়িতে থাকতে কোন সমস্যা নেই। নিরাপরাধ কাউকেই ধরা হবে না’।

তবে গ্রামবাসীর অভিযোগ তান্ডবের ঘটনায় এ পর্যন্ত যে ৭১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে তাদের ‘বেশিরভাগই নিরীহ। ঘটনার সঙ্গে কোন সম্প্রিক্ততা নেই’। অভিযোগ পুলিশ ‘নিরীহ মানুষদের ধরে’ মামলায় আসামি করে আদালতে চালান দিচ্ছে। আর রিমান্ডে জ্ঞিাসাবাদের নামে থানায় এনে ‘নির্যাতন করে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেবার জন্য চাপ দিচ্ছে’।

এদিকে ক্ষতিগ্রস্ত বেশ কয়েকজন হিন্দু পরিবারের সদস্য জানিয়েছেন, নাখারপাড়া, জায়গীরপাড়াসহ কয়েকটি গ্রামের লোকজন তান্ডবের ঘটনায় অংশ নেয়নি। যদি ২/৪ জন অংশ নিয়েও থাকে শুধু তাদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেয়া হোক। তাদের আশা নিরাপরাধ কেউ যেন হয়রানির শিকার না হয়। তবে তারা কেউ নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি।

এ ব্যাপারে স্থানীয় রামনাথপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা সাদেকুল ইসলাম বিএসসি বলেন, ‘আমরা গ্রামবাসীকে বাড়িতে থাকতে বার বার আহ্বান জানিয়েছি।’ তবে তিনিও বললেন, যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন নিরাপরাধ। তবে তার মন্তব্য- পুলিশ বলেছে, তদন্ত করে পদক্ষেপ নেবে।

পীরগঞ্জ পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের ধনশালা মহল্লার রনি ও মিল্লাত দুজনই কিশোর। পুলিশ তাদের ধরে নিয়ে সহিংসতার মামলায় ‘জড়িয়ে দিয়েছে’।

এ ব্যাপারে ওই এলাকার মানবাধিকার কর্মী ও সমাজ সেবক মোজাম্মেল হক সরকার খুদু বলেন, ‘রনি ও মিল্লাত দুজনের বয়স ১৮ বছরের নিচে। তারা তান্ডবের ঘটনার পরের দিন ১৮ অক্টোবর ওই এলাকায় দেখতে গিয়েছিল। সেখান থেকেই পুলিশ তাদের গ্রেপ্তার করেছে। তারা তান্ডবের ঘটনার সঙ্গে সংম্পৃক্ত নয়।’ একই কথা জানালেন ওই ওয়ার্ডের নারী অধিকার কর্মী মমতাজ বেগম।

সাম্প্রদায়িক তান্ডবের ঘটনার পর পীরগঞ্জ থানা পুলিশ সহিংসতার ঘটনায় এ পর্যন্ত ৭১ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। পীরগঞ্জ থানার ওসি সরেস চন্দ্র জানিয়েছেন তান্ডবের ঘটনায় এ পর্যন্ত মামলা হয়েছে ৪টি। এর মধ্যে ৩টি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ও একটি সহিংসতার ঘটনায়। এর মধ্যে ‘ধর্মীয় অবমানার’ পোস্ট দেবার ঘটনায় পরিতোষ রায়ের বিরুদ্ধে একটি, তার সহযোগী উজ্জল ও আল আমিনের বিরুদ্ধে একটি এবং কারমাইকেল কলেজ শাখার ছাত্রলীগ নেতা সৈকত মন্ডলের বিরুদ্ধে একটি। বাকি ৬৭ জনকে সহিংসতার ঘটনায় করা মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে।

এদিকে পীরগঞ্জ উপজেলা পূজা উদযাপন কমিটির আহ্বায়ক সুধির চন্দ্র জানান, বুধবার মাঝিপাড়ায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারসহ হিন্দু সম্প্রদায়ের সঙ্গে পুলিশ মতবিনিময় করেছে। সেখানে রংপুর রেঞ্জের ডিআইজি দেবদাস ভট্টাচার্য, পুলিশ সুপার বিপ্লব কুমারসহ পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। সুধির চন্দ্র বলেন, ‘আমি তাদের বলেছি, ঘটনার সঙ্গে যারা সত্যি সত্যি জড়িত শুধু তাদের গ্রেপ্তার করা হোক, কোন নিরাপরাধ মানুষকে যেন গ্রেপ্তার করা না হয়।’

পীরগঞ্জের তান্ডবের ঘটনাস্থল ঘুরে এসেছেন মানবাধিকার কর্মী এবং সুজনের রংপুর জেলা সম্পাদক অধ্যক্ষ খায়রুল আনাম বেঞ্জু। এরপর পুরো বিষয় পর্যবেক্ষণ করছেন তিনি। তার বক্তব্য প্রযুক্তির মাধ্যমে দায়ীদের অনেককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কিন্তু তাই বলে ‘গ্রাম শূন্য করে দিয়ে নতুন করে আতঙ্ক সৃষ্টি’ করা, সাধারণ মানুষ যাতে ‘হয়রানির শিকার’ না হয় সেটা প্রশাসনের দেখা দরকার।

তবে পীরগঞ্জ থানার ওসি সরেস চন্দ্র জানিয়েছেন, ‘নিরীহ কোন ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়নি ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাবার পরেই গ্রেপ্তার’ করা হয়েছে। সাত গ্রামে কোন পুরুষ নেই একথা সত্য নয়- দাবি করে তিনি বলেন, ‘আমরা বলেছি, যারা ঘটনার সঙ্গে জড়িত নয়, তারা বাসায় থাকবেন। অন্যায়ভাবে কাউকেই গ্রেপ্তার করা হয়নি, হবেও না।’

রায়পুর ইউপি চেয়ারম্যান সাইদুর রহমান চৌধুরী বললেন, ‘অন্যায়ভাবে গ্রেপ্তার’ ব্যক্তিদের নাম ঠিকানাসহ তালিকা তিনি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে দিয়েছেন।

উল্লেখ্য, শারদীয় দুর্গাপূজার মহা অষ্টমীর দিন ১৩ অক্টোবর ভোরে কুমিল্লা শহরের নানুয়াদিঘির উত্তরপাড়ে দর্পণ সংঘের উদ্যোগে আয়োজিত অস্থায়ী পূজামন্ডপে পবিত্র কোরআন দেখা যায়। এরপর কোরআন অবমাননার অভিযোগ তুলে ওই মন্ডপে হামলা চালায় একদল লোক। সেখানে ব্যাপক ভাঙচুর চালানো হয়।

ওই ঘটনায় প্রাপ্ত সিসিটিভি ফুটেজে ইকবাল নামের এক ব্যক্তিকে দেখা যায়। সিসিটিভি’র সে ফুটেজে দেখা যায়, অভিযুক্ত ইকবাল হোসেন কীভাবে, কখন মসজিদে যান এবং বের হন। এরপর মন্ডপের দিকে যান এবং মন্ডপ থেকে গদা হাতে ফেরেন তা ফুটেজে অনেকটা স্পষ্ট। পরবর্তীতে ২১ অক্টোবর রাত সাড়ে ১০টার দিকে ইকবালকে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের সুগন্ধা পয়েন্ট থেকে আটক করা হয়।

এদিকে, কুমিল্লার ঘটনার পর ১৩ থেকে ১৮ অক্টোবর পর্যন্ত নোয়াখালী, চাঁদপুর, ফেনী, চট্টগ্রাম ও রংপুরে হিন্দু সম্প্রদায়ের দুর্গাপূজার মন্ডপ, মন্দির, বসতি, জীবন ও সম্পত্তির ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের পক্ষ থেকে ক্ষয়ক্ষতির একটি তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। তাদের হিসাব অনুযায়ী, ১৩ অক্টোবর কুমিল্লায় আটটি মন্দিরে হামলার পর দেশের ২৩ জেলায় শতাধিক মন্দির ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। সমপরিমাণ বাড়িঘরে হামলা ও আগুনের ঘটনা ঘটেছে। তবে তারা এর আর্থিক ক্ষতি নির্ণয় করেননি।