সংকট অনেক গভীরে

শঙ্কর প্রসাদ দে

১৩ অক্টোবর ২০২১ থেকে সপ্তাহ ধরে হিন্দুদের ওপর অব্যাহত হামলা সবাইকে ভাবিয়ে তুলেছে। শেখ হাসিনার মতো অসাম্প্রদায়িক ব্যক্তিত্বের শাসনামলে এত বিস্তৃত পরিসরে হিন্দুদের প্রতি সহিংসতা কেমন করে সম্ভব হলো? মুক্তিযুদ্ধের প্রাণ সংগঠন আওয়ামী লীগের অংগ সংগঠন ছাত্রলীগ, যুবলীগ, মহিলা লীগ, কৃষক লীগ, শ্রমিক লীগের (আরো অনেক সংগঠন আছে যাদের নাম আমার জানা নেই) কর্মীরা কেন হামলা হতে যাচ্ছে জেনেও এগিয়ে গেল না? চৌমুহনীর ঘটনাতো রীতিমতো অশনি সংকেত। ডিসি মো. খোরশেদ আলম, এসপি শহীদুল ইসলাম উভয়ে জানতেন শুক্রবার নামাজের পর হামলা হবে। তারা স্বীকারও করেছেন বৃহস্পতিবার বিকাল বেলা চৌমুহনীর ২টি থানা এলাকায় মাইকিং হয়েছিল। আমরা দেখলাম, নামাজের পর আনুমানিক ২টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত মধ্যযুগীয় পৈশাচিকতায় ইসকন, রামঠাকুর মন্দিরসহ সমস্ত দেবালয়গুলোতে তান্ডব অব্যাহত থাকে। হামলাকারীদের সংখ্যা ৩ থেকে ৫শ’য়ের মধ্যে হবে।

প্রশ্ন হলো পুলিশ প্রশাসন কি ইচ্ছে করে পর্যাপ্ত পুলিশ, র‌্যাব, বিডিআর নামায়নি? ৪ ঘণ্টা ধরে মৃত্যুপথযাত্রী মানুষের আর্তনাদ কানে পৌঁছার পরও নোয়াখালীর ডিসি-এসপি ঘটনাস্থলে ফোর্স পাঠালেন না। এর সহজ ব্যাখ্যা হলো- তোমরা যা করার করে চলে যাও। চাঁদপুরের এসপি মিলন মাহমুদ গুলির নির্দেশ দিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করেছেন। নোয়াখালীর এসপি শহীদুল ইসলাম পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের কোন উদ্যেগ নিলেন না কেন? এখনো অবধি প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী ১২টি জেলায় শত শত মন্ডপ ও মন্দির ভাংচুর হয়েছে এবং চৌমুহনীতে যতন সাহা, প্রান্ত দাশ ও দীলিপ দাসের হত্যা সরকার স্বীকৃত। তথ্য স্পষ্ট না হলেও সিলেটে মায়ের সাথে ১০ বছরের এক বালিকাও ধর্ষণের অভিযোগ বাতাসে ঘুরছে। কুমিল্লার সংশ্লিষ্ট ওসি কোরআনটি উদ্ধার করতে গিয়েছিলেন। তাৎক্ষণিকভাবে উদ্ধারপর্বটি মো. ফয়েজ উস্কানিমূলকভাবে লাইভ প্রচার করছিলেন। ওসি সাহেব তাৎক্ষণিকভাবে ফয়েজকে নিবৃত্ত করেননি। প্রশ্ন উঠেছে যে, ওসি সাহেবও কি মনঃক্ষুণ্ন ছিলেন হয়তো এই ভেবে যে, হিন্দুরা আমার পবিত্র কোরআনকে অবমাননা করল? ওসি সাহেব কেন, আমার সহকর্মী অনেককে প্রতিক্রিয়া জানাতে দেখলাম- যেন হিন্দুদের এত সাহস? বুঝলাম মুসলিম জনগণের একটি ক্ষুদ্র অথচ যুদ্ধংদেহী অংশ হয়ে উঠেছে চরম সংখ্যালঘুবিদ্বেষী। রামুর ঘটনা আর চৌমুহনীর ঘটনার চরিত্র একই। ২০১২ সালে রামুর বৌদ্ধমন্দির হামলায় যুদ্ধংদেহী জনতার নেতৃত্ব দিয়েছিল আওয়ামী পরিবারের স্থানীয় নেতৃত্ব। হাজীগঞ্জ ও পীরগঞ্জে সরাসরি আওয়ামী পরিবারের সদস্যদের নাম উঠে এসেছে। ২০১২ এবং ২০২১ সালের ঘটনাগুলোর বিশ্লেষণ করলে বুঝা যায়, পুলিশ প্রশাসনের, সিভিল প্রশাসনের শক্তিশালী একটি অংশ আওয়ামী লীগ, বিএনপি নির্বিশেষে রাজনৈতিক দলের মধ্যে ছোট একটি অংশ হয়ে উঠেছে, সংখ্যালঘুবিদ্বেষী। দিনকে দিন হিন্দুবিদ্বেষী এ প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রশ্ন হলো কেন?

দেশে হিন্দু-মুসলিম বিরোধের সূত্রপাত ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ থেকে। সাতচল্লিশের দেশভাগ এক ধরনের ইসলামী পরিণতি নিয়ে আসে। মুসলমানদের দেশ পূর্ববাংলা থেকে লক্ষ লক্ষ হিন্দুকে বিতাড়িত করা হলো। ১৯৪৬ সালের ১১ অক্টোবর নোয়াখালীতে হিন্দু নিধন যজ্ঞের মূল লক্ষ্যই ছিল হিন্দুদের বিতাড়িত করা। ১৯৫৪ সালে পূর্ববাংলা হলো পূর্বপাকিস্তান। ১৯৭১ সালে এসে ঐতিহাসিক যে ঘটনাটি ঘটল তার নাম মুক্তিযুদ্ধ। এ জাতির সৌভাগ্য হলো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ, কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাপ, ব্যক্তিগতভাবে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এবং একঝাঁক সাহিত্য ও সংস্কৃতিসেবী বাঙালি জাতিসত্তাকে অনেকটা পরিপূর্ণ রূপ দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। ১৬ ডিসেম্বর আমরা খুশিতে গদগদ হয়ে বলতে লাগলাম হিন্দু-মুসলিম বিরোধের সমাপ্তি হয়েছে।

আমরা খেয়াল করলাম না- যে ভূমিখেকো হিন্দুর সম্পত্তির ওপর নজর রাখছিল, সে অসন্তুষ্ট হলো। বাহাত্তরে হিন্দুরা যদি ফেরত না আসতো তবে সাম্প্রদায়িক সমস্যার বর্তমান চেহারার উদ্ভব হতো না। বঙ্গবন্ধুর জীবদ্দশাতেই ১৯৭২ সালে অষ্টমী পূজার দিন একযোগে গোটা দেশে হামলা চালানো হলো। এটার সহজ ব্যাখ্যা হলো, ভূমিদস্যুরা বুঝাতে চেয়েছে তোমার গিয়েছিল তো ভালোই হয়েছিল; দেশ স্বাধীন হয়েছো তো ভালোই। তোমরা কেন ফিরে এলে? খাতুনগঞ্জের মুসলিম ব্যবসায়ীরা দেখল আবার যে বাবুরা এসে গেল। হিন্দু হেডমাস্টারের জন্য মুসলিম শিক্ষকটি হেডস্যার হতে পারছিল না। অধ্যক্ষ গোপাল মুহুরি হত্যাকান্ডটি তার প্রমাণ। স্বর্ণের ও মহাজনী ব্যবসা একচেটিয়া হিন্দুদের হাতে থাকায় তাদের তাড়িয়ে দেয়া নিতান্ত স্বার্থের কারণে সামনে চলে আসে। এ দেশের গ্রামের শতকরা নব্বইভাগ মুসলমান অসাম্প্রদায়িক কিন্তু দ্বিজাতি তত্ত্বের ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ায় শক্তিশালী একটি গ্রুপ ঠিকই মুসলমানের বাংলাদেশ ভাবনা নিয়ে এগোল। আমরা আগে বাঙালি আর পরে হিন্দু বা মুসলমান- বঙ্গবন্ধুর এই দর্শনকে দ্রুত উচ্ছেদের প্রক্রিয়া শুরু হলো। আমি মনে করি, বঙ্গবন্ধু যদি বলতেন- আমি আগে মুসলমান আর পরে বাঙালি তবে তাকে এভাবে মরতে হতো না।

মুক্তিযুদ্ধে হিন্দু-মুসলিম বিরোধের মীমাংসা হয়নি। সব মুক্তিযোদ্ধা বাঙালি জাতিসত্তায়ও বিশ^াস করতেন না। জিয়াউর রহমান তো সংবিধান সংশোধন করে বাঙালি জাতীয়তাবাদ শব্দটিই কেটে দিলেন। ‘বিসমিল্লাহ’ শব্দ কোটি মানুষের কাছে নিশ্চিত একটি পুণ্যার্থবাহী শব্দ। জিয়া এই দুর্বলতাকে ব্যবহার করলেন চমৎকারভাবে। সংবিধানের শুরুতে যোগ করলেন, ‘বিসমিল্লাহ’। বুঝা গেল বীরউত্তম জিয়ার মতো মুক্তিযোদ্ধারা ইসলামী বাংলাদেশের জন্য যুদ্ধ করেছিলেন। জিয়ার মুসলিম বাংলাদেশকে এরশাদ এগিয়ে নিয়েছেন দক্ষতার সাথে।

এতক্ষণ ধরে সম্পত্তির লোভ, ব্যবসার লোভ নিয়ে যা বললাম তার সাথে যোগ হয়েছে রাজনীতি। এখন খোলাখুলি বলার সময় এসেছে। জিয়াপন্থি অর্থাৎ পাকিস্তানপন্থিদের মূল বক্তব্য হলো- হিন্দুদের ভোটই হলো আওয়ামী লীগের প্রধান শক্তিকেন্দ্র। হিন্দুরা যত বেশি ভারতে যাবে ততই বিএনপিপন্থিদের লাভ। সম্পত্তি লাভ, ব্যবসায় লাভ, পেশায় লাভ, চাকরিতে লাভ ও ক্ষমতা লাভ মিলে- গোটা সমাজ ব্যবস্থায় শক্তিশালী এক মতাদর্শের সৃষ্টি হয়েছে। এক কথায় এটির নাম হিন্দুবিদ্বেষ বা ভারতবিদ্বেষ যা বাঙালি জাতিসত্তাবিদ্বেষী। এ বিদ্বেষ নিতান্তই আদর্শিক, রাজনৈতিক এবং সামাজিক। এ বিরোধ অনেক গভীর।

সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন হলেই কি সমস্যার স্থায়ী সমাধান সম্ভব? আমার তা মনে হয় না। অনেকে বলেছেন, অ্যাসিড নিক্ষেপ ও হেরোইন অপরাধে মৃত্যুদন্ড চালু হওয়ায় অপরাধ কমে গেছে। মনে রাখতে হবে অ্যাসিড নিক্ষেপে ডাক্তারি সনদপত্র ও হেরোইন মামলায় পুলিশের সাক্ষ্যই দন্ডাদেশের জন্য যথেষ্ট। বর্তমান আইনে দ্রুতবিচার বা বিশেষ ট্রাইব্যুনাল, যেখানেই বিচার হোক ক্ষতিগ্রস্ত হিন্দুদের এসে সাক্ষী দিতে হবে। অভিজ্ঞতা বলছে কেউ সাক্ষী দেয়ার সাহস দেখাবে না। আইনজীবী হিসেবে আমার প্রস্তাব হলো- ‘সংখ্যালঘু সুরক্ষা ও নির্যাতন অপরাধ আইন’ প্রণয়ন করে মৌখিক সাক্ষ্যের পরিবর্তে তথ্যপ্রযুক্তি ও পুলিশি সাক্ষ্যের ওপর বিচার অনুষ্ঠিত হওয়ার ধারা সংযোজন করতে হবে। হেরোইন পাচার মামলায় শুধু পুলিশের সাক্ষ্য ও বিশেষজ্ঞের মতামতের ওপর বিচার শেষ করা যায়। একইভাবে ফেসবুকে যার ছবি দেখা গেছে তাকে বিশেষজ্ঞ দ্বারা শনাক্ত করা গেলে শুধু বিশেষজ্ঞ রিপোর্ট আর পুলিশের সাক্ষ্যের ওপর বিচার শেষ করা যাবে। কঠোর আইন, দ্রুতবিচার নিশ্চিতভাবে পরিস্থিতির স্বল্পমেয়াদি উন্নতি ঘটাবে।

প্রশ্ন হলো- সমাজের গভীরে যে হিন্দুবিদ্বেষ স্বার্থের কারণে, গোঁড়ামীর কারণে, রাজনীতির কারণে জেঁকে বসে আছে, সেখান থেকে বের হওয়ার উপায় কী? উপায় হলো মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও বাঙালি জাতীয়তাবাদ প্রশ্নে কঠোরতম পন্থা অবলম্বন কর। কারো যদি মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ভালো না লাগে তবে তিনি পাকিস্তানে বা আফগানিস্তানে চলে যেতেই পারেন। যেমন গিয়েছেন রাজা ত্রিদিব রায়। সম্পত্তির লোভ সব কিছুর কেন্দ্রবিন্দু। ‘ক’ তফশিল মামলায় অনেকে রায় পেয়েছে। কিন্তু সমস্যা সৃষ্টি করছে ডিসি অফিস আর কোন কোন আইনজীবী। তারা নিজ নিজ স্বার্থে খামোখা আপিল মামলা টুকে দিয়ে আরো ১০-২০ বছরের জন্য প্রর্ত্যপণ ঝুলিয়ে দিচ্ছে। ভূমি প্রশাসনের চাকুরেরা বাবু ঢুকলেই জ্ঞাত কারণেই খুশি হয়ে যান। বাপ-দাদার সম্পত্তি উদ্ধারে হিন্দুরা তহশিলদার, কানুনগো, এসিল্যান্ড, এডিসিল্যান্ড অফিস সরকারী, ভিপি আইনজীবীসহ কোথায় ঘুষ দেয়নি। ঘামেভেজা কচকচে নোট খরচ করেও গত ৫৫ বছরের দুর্দশার শেষ যে আজও হলো না। কবে হবে তাও জানি না।

তবুও আশার আলো দেখি। যখন মাননীয় প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ তাদের দুঃখ-বেদনা, উদ্বিগ্নতা জাতির সাথে শেয়ার করেন। তখন ভাবি এ দেশে জন্মেছি, এ দেশেই মরতে চাই। আমার সোজা প্রস্তাব, যত ঝড়-ঝাপটা আসুক বাহাত্তরের সংবিধানে ফেরাই প্রথম এবং শেষ বিকল্প।

[লেখক : আইনজীবী, হাইকোর্ট]

image

সাম্প্রদায়িক হামলায় ল্ডভন্ড হয়েছে রংপুরের পীরগঞ্জের জেলেপল্লী

আরও খবর
সম্প্রীতির আলোচনা ও সংখ্যালঘুদের নীরবতা
বেসরকারি কলেজে অনার্স-মাস্টার্স কোর্স বিতর্ক

শুক্রবার, ২৯ অক্টোবর ২০২১ , ১৩ কার্তিক ১৪২৮ ২১ রবিউল আউয়াল ১৪৪৩

সংকট অনেক গভীরে

শঙ্কর প্রসাদ দে

image

সাম্প্রদায়িক হামলায় ল্ডভন্ড হয়েছে রংপুরের পীরগঞ্জের জেলেপল্লী

১৩ অক্টোবর ২০২১ থেকে সপ্তাহ ধরে হিন্দুদের ওপর অব্যাহত হামলা সবাইকে ভাবিয়ে তুলেছে। শেখ হাসিনার মতো অসাম্প্রদায়িক ব্যক্তিত্বের শাসনামলে এত বিস্তৃত পরিসরে হিন্দুদের প্রতি সহিংসতা কেমন করে সম্ভব হলো? মুক্তিযুদ্ধের প্রাণ সংগঠন আওয়ামী লীগের অংগ সংগঠন ছাত্রলীগ, যুবলীগ, মহিলা লীগ, কৃষক লীগ, শ্রমিক লীগের (আরো অনেক সংগঠন আছে যাদের নাম আমার জানা নেই) কর্মীরা কেন হামলা হতে যাচ্ছে জেনেও এগিয়ে গেল না? চৌমুহনীর ঘটনাতো রীতিমতো অশনি সংকেত। ডিসি মো. খোরশেদ আলম, এসপি শহীদুল ইসলাম উভয়ে জানতেন শুক্রবার নামাজের পর হামলা হবে। তারা স্বীকারও করেছেন বৃহস্পতিবার বিকাল বেলা চৌমুহনীর ২টি থানা এলাকায় মাইকিং হয়েছিল। আমরা দেখলাম, নামাজের পর আনুমানিক ২টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত মধ্যযুগীয় পৈশাচিকতায় ইসকন, রামঠাকুর মন্দিরসহ সমস্ত দেবালয়গুলোতে তান্ডব অব্যাহত থাকে। হামলাকারীদের সংখ্যা ৩ থেকে ৫শ’য়ের মধ্যে হবে।

প্রশ্ন হলো পুলিশ প্রশাসন কি ইচ্ছে করে পর্যাপ্ত পুলিশ, র‌্যাব, বিডিআর নামায়নি? ৪ ঘণ্টা ধরে মৃত্যুপথযাত্রী মানুষের আর্তনাদ কানে পৌঁছার পরও নোয়াখালীর ডিসি-এসপি ঘটনাস্থলে ফোর্স পাঠালেন না। এর সহজ ব্যাখ্যা হলো- তোমরা যা করার করে চলে যাও। চাঁদপুরের এসপি মিলন মাহমুদ গুলির নির্দেশ দিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করেছেন। নোয়াখালীর এসপি শহীদুল ইসলাম পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের কোন উদ্যেগ নিলেন না কেন? এখনো অবধি প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী ১২টি জেলায় শত শত মন্ডপ ও মন্দির ভাংচুর হয়েছে এবং চৌমুহনীতে যতন সাহা, প্রান্ত দাশ ও দীলিপ দাসের হত্যা সরকার স্বীকৃত। তথ্য স্পষ্ট না হলেও সিলেটে মায়ের সাথে ১০ বছরের এক বালিকাও ধর্ষণের অভিযোগ বাতাসে ঘুরছে। কুমিল্লার সংশ্লিষ্ট ওসি কোরআনটি উদ্ধার করতে গিয়েছিলেন। তাৎক্ষণিকভাবে উদ্ধারপর্বটি মো. ফয়েজ উস্কানিমূলকভাবে লাইভ প্রচার করছিলেন। ওসি সাহেব তাৎক্ষণিকভাবে ফয়েজকে নিবৃত্ত করেননি। প্রশ্ন উঠেছে যে, ওসি সাহেবও কি মনঃক্ষুণ্ন ছিলেন হয়তো এই ভেবে যে, হিন্দুরা আমার পবিত্র কোরআনকে অবমাননা করল? ওসি সাহেব কেন, আমার সহকর্মী অনেককে প্রতিক্রিয়া জানাতে দেখলাম- যেন হিন্দুদের এত সাহস? বুঝলাম মুসলিম জনগণের একটি ক্ষুদ্র অথচ যুদ্ধংদেহী অংশ হয়ে উঠেছে চরম সংখ্যালঘুবিদ্বেষী। রামুর ঘটনা আর চৌমুহনীর ঘটনার চরিত্র একই। ২০১২ সালে রামুর বৌদ্ধমন্দির হামলায় যুদ্ধংদেহী জনতার নেতৃত্ব দিয়েছিল আওয়ামী পরিবারের স্থানীয় নেতৃত্ব। হাজীগঞ্জ ও পীরগঞ্জে সরাসরি আওয়ামী পরিবারের সদস্যদের নাম উঠে এসেছে। ২০১২ এবং ২০২১ সালের ঘটনাগুলোর বিশ্লেষণ করলে বুঝা যায়, পুলিশ প্রশাসনের, সিভিল প্রশাসনের শক্তিশালী একটি অংশ আওয়ামী লীগ, বিএনপি নির্বিশেষে রাজনৈতিক দলের মধ্যে ছোট একটি অংশ হয়ে উঠেছে, সংখ্যালঘুবিদ্বেষী। দিনকে দিন হিন্দুবিদ্বেষী এ প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রশ্ন হলো কেন?

দেশে হিন্দু-মুসলিম বিরোধের সূত্রপাত ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ থেকে। সাতচল্লিশের দেশভাগ এক ধরনের ইসলামী পরিণতি নিয়ে আসে। মুসলমানদের দেশ পূর্ববাংলা থেকে লক্ষ লক্ষ হিন্দুকে বিতাড়িত করা হলো। ১৯৪৬ সালের ১১ অক্টোবর নোয়াখালীতে হিন্দু নিধন যজ্ঞের মূল লক্ষ্যই ছিল হিন্দুদের বিতাড়িত করা। ১৯৫৪ সালে পূর্ববাংলা হলো পূর্বপাকিস্তান। ১৯৭১ সালে এসে ঐতিহাসিক যে ঘটনাটি ঘটল তার নাম মুক্তিযুদ্ধ। এ জাতির সৌভাগ্য হলো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ, কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাপ, ব্যক্তিগতভাবে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এবং একঝাঁক সাহিত্য ও সংস্কৃতিসেবী বাঙালি জাতিসত্তাকে অনেকটা পরিপূর্ণ রূপ দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। ১৬ ডিসেম্বর আমরা খুশিতে গদগদ হয়ে বলতে লাগলাম হিন্দু-মুসলিম বিরোধের সমাপ্তি হয়েছে।

আমরা খেয়াল করলাম না- যে ভূমিখেকো হিন্দুর সম্পত্তির ওপর নজর রাখছিল, সে অসন্তুষ্ট হলো। বাহাত্তরে হিন্দুরা যদি ফেরত না আসতো তবে সাম্প্রদায়িক সমস্যার বর্তমান চেহারার উদ্ভব হতো না। বঙ্গবন্ধুর জীবদ্দশাতেই ১৯৭২ সালে অষ্টমী পূজার দিন একযোগে গোটা দেশে হামলা চালানো হলো। এটার সহজ ব্যাখ্যা হলো, ভূমিদস্যুরা বুঝাতে চেয়েছে তোমার গিয়েছিল তো ভালোই হয়েছিল; দেশ স্বাধীন হয়েছো তো ভালোই। তোমরা কেন ফিরে এলে? খাতুনগঞ্জের মুসলিম ব্যবসায়ীরা দেখল আবার যে বাবুরা এসে গেল। হিন্দু হেডমাস্টারের জন্য মুসলিম শিক্ষকটি হেডস্যার হতে পারছিল না। অধ্যক্ষ গোপাল মুহুরি হত্যাকান্ডটি তার প্রমাণ। স্বর্ণের ও মহাজনী ব্যবসা একচেটিয়া হিন্দুদের হাতে থাকায় তাদের তাড়িয়ে দেয়া নিতান্ত স্বার্থের কারণে সামনে চলে আসে। এ দেশের গ্রামের শতকরা নব্বইভাগ মুসলমান অসাম্প্রদায়িক কিন্তু দ্বিজাতি তত্ত্বের ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ায় শক্তিশালী একটি গ্রুপ ঠিকই মুসলমানের বাংলাদেশ ভাবনা নিয়ে এগোল। আমরা আগে বাঙালি আর পরে হিন্দু বা মুসলমান- বঙ্গবন্ধুর এই দর্শনকে দ্রুত উচ্ছেদের প্রক্রিয়া শুরু হলো। আমি মনে করি, বঙ্গবন্ধু যদি বলতেন- আমি আগে মুসলমান আর পরে বাঙালি তবে তাকে এভাবে মরতে হতো না।

মুক্তিযুদ্ধে হিন্দু-মুসলিম বিরোধের মীমাংসা হয়নি। সব মুক্তিযোদ্ধা বাঙালি জাতিসত্তায়ও বিশ^াস করতেন না। জিয়াউর রহমান তো সংবিধান সংশোধন করে বাঙালি জাতীয়তাবাদ শব্দটিই কেটে দিলেন। ‘বিসমিল্লাহ’ শব্দ কোটি মানুষের কাছে নিশ্চিত একটি পুণ্যার্থবাহী শব্দ। জিয়া এই দুর্বলতাকে ব্যবহার করলেন চমৎকারভাবে। সংবিধানের শুরুতে যোগ করলেন, ‘বিসমিল্লাহ’। বুঝা গেল বীরউত্তম জিয়ার মতো মুক্তিযোদ্ধারা ইসলামী বাংলাদেশের জন্য যুদ্ধ করেছিলেন। জিয়ার মুসলিম বাংলাদেশকে এরশাদ এগিয়ে নিয়েছেন দক্ষতার সাথে।

এতক্ষণ ধরে সম্পত্তির লোভ, ব্যবসার লোভ নিয়ে যা বললাম তার সাথে যোগ হয়েছে রাজনীতি। এখন খোলাখুলি বলার সময় এসেছে। জিয়াপন্থি অর্থাৎ পাকিস্তানপন্থিদের মূল বক্তব্য হলো- হিন্দুদের ভোটই হলো আওয়ামী লীগের প্রধান শক্তিকেন্দ্র। হিন্দুরা যত বেশি ভারতে যাবে ততই বিএনপিপন্থিদের লাভ। সম্পত্তি লাভ, ব্যবসায় লাভ, পেশায় লাভ, চাকরিতে লাভ ও ক্ষমতা লাভ মিলে- গোটা সমাজ ব্যবস্থায় শক্তিশালী এক মতাদর্শের সৃষ্টি হয়েছে। এক কথায় এটির নাম হিন্দুবিদ্বেষ বা ভারতবিদ্বেষ যা বাঙালি জাতিসত্তাবিদ্বেষী। এ বিদ্বেষ নিতান্তই আদর্শিক, রাজনৈতিক এবং সামাজিক। এ বিরোধ অনেক গভীর।

সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন হলেই কি সমস্যার স্থায়ী সমাধান সম্ভব? আমার তা মনে হয় না। অনেকে বলেছেন, অ্যাসিড নিক্ষেপ ও হেরোইন অপরাধে মৃত্যুদন্ড চালু হওয়ায় অপরাধ কমে গেছে। মনে রাখতে হবে অ্যাসিড নিক্ষেপে ডাক্তারি সনদপত্র ও হেরোইন মামলায় পুলিশের সাক্ষ্যই দন্ডাদেশের জন্য যথেষ্ট। বর্তমান আইনে দ্রুতবিচার বা বিশেষ ট্রাইব্যুনাল, যেখানেই বিচার হোক ক্ষতিগ্রস্ত হিন্দুদের এসে সাক্ষী দিতে হবে। অভিজ্ঞতা বলছে কেউ সাক্ষী দেয়ার সাহস দেখাবে না। আইনজীবী হিসেবে আমার প্রস্তাব হলো- ‘সংখ্যালঘু সুরক্ষা ও নির্যাতন অপরাধ আইন’ প্রণয়ন করে মৌখিক সাক্ষ্যের পরিবর্তে তথ্যপ্রযুক্তি ও পুলিশি সাক্ষ্যের ওপর বিচার অনুষ্ঠিত হওয়ার ধারা সংযোজন করতে হবে। হেরোইন পাচার মামলায় শুধু পুলিশের সাক্ষ্য ও বিশেষজ্ঞের মতামতের ওপর বিচার শেষ করা যায়। একইভাবে ফেসবুকে যার ছবি দেখা গেছে তাকে বিশেষজ্ঞ দ্বারা শনাক্ত করা গেলে শুধু বিশেষজ্ঞ রিপোর্ট আর পুলিশের সাক্ষ্যের ওপর বিচার শেষ করা যাবে। কঠোর আইন, দ্রুতবিচার নিশ্চিতভাবে পরিস্থিতির স্বল্পমেয়াদি উন্নতি ঘটাবে।

প্রশ্ন হলো- সমাজের গভীরে যে হিন্দুবিদ্বেষ স্বার্থের কারণে, গোঁড়ামীর কারণে, রাজনীতির কারণে জেঁকে বসে আছে, সেখান থেকে বের হওয়ার উপায় কী? উপায় হলো মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও বাঙালি জাতীয়তাবাদ প্রশ্নে কঠোরতম পন্থা অবলম্বন কর। কারো যদি মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ভালো না লাগে তবে তিনি পাকিস্তানে বা আফগানিস্তানে চলে যেতেই পারেন। যেমন গিয়েছেন রাজা ত্রিদিব রায়। সম্পত্তির লোভ সব কিছুর কেন্দ্রবিন্দু। ‘ক’ তফশিল মামলায় অনেকে রায় পেয়েছে। কিন্তু সমস্যা সৃষ্টি করছে ডিসি অফিস আর কোন কোন আইনজীবী। তারা নিজ নিজ স্বার্থে খামোখা আপিল মামলা টুকে দিয়ে আরো ১০-২০ বছরের জন্য প্রর্ত্যপণ ঝুলিয়ে দিচ্ছে। ভূমি প্রশাসনের চাকুরেরা বাবু ঢুকলেই জ্ঞাত কারণেই খুশি হয়ে যান। বাপ-দাদার সম্পত্তি উদ্ধারে হিন্দুরা তহশিলদার, কানুনগো, এসিল্যান্ড, এডিসিল্যান্ড অফিস সরকারী, ভিপি আইনজীবীসহ কোথায় ঘুষ দেয়নি। ঘামেভেজা কচকচে নোট খরচ করেও গত ৫৫ বছরের দুর্দশার শেষ যে আজও হলো না। কবে হবে তাও জানি না।

তবুও আশার আলো দেখি। যখন মাননীয় প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ তাদের দুঃখ-বেদনা, উদ্বিগ্নতা জাতির সাথে শেয়ার করেন। তখন ভাবি এ দেশে জন্মেছি, এ দেশেই মরতে চাই। আমার সোজা প্রস্তাব, যত ঝড়-ঝাপটা আসুক বাহাত্তরের সংবিধানে ফেরাই প্রথম এবং শেষ বিকল্প।

[লেখক : আইনজীবী, হাইকোর্ট]