সংখ্যালঘু প্রশ্নে বাংলাদেশ-বিরোধী চক্রান্তের ধারাবাহিকতা

গৌতম রায়

সদ্যসমাপ্ত শারদোৎসব কালে বাংলাদেশের কোন কোন অঞ্চলে সম্পূর্ণ রাজনৈতিক আঙ্গিক থেকে সেখানকার সংখ্যালঘু হিন্দুদের ওপর অত্যন্ত নিন্দনীয় ঘটনা ঘটেছে। সেসব দুঃখজনক ঘটনাক্রমের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকার যে দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন, তেমন পদক্ষেপের অভিজ্ঞতা এই উপমহাদেশের কোন অংশে সংখ্যালঘুদের সাম্প্রতিক কালে ঘটে না। ভারতে আরএসএসের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি দ্বিতীয় পর্যায়ে একক গরিষ্ঠতা নিয়ে দিল্লিতে সরকার তৈরির পর ভারতে সংখ্যাগুরুর সাম্প্রদায়িকতা রূপান্তরিত হয়েছে সংখ্যাগুরূর আধিপত্যবাদে। তাই দিল্লি গণহত্যাসহ আসাম, ত্রিপুরা- সর্বত্র সংখ্যালঘু মুসলমানদের ওপর অত্যাচার হচ্ছে। এই অত্যাচার বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হচ্ছে রাষ্ট্রীয় মদতে। শাসকদল বিজেপি, তাদের মূল পরিচালক আরএসএস, আর তাদের হরেক রকমের সঙ্গীসাথীরা হলো এই অত্যাচারের প্রধান কুশীলব।

বাংলাদেশে আমরা দেখলাম, সেখানকার রাষ্ট্রশক্তি খুঁজে বের করেছে, পবিত্র কোরআনকে কেন্দ্র করে কে এই পরিকল্পিত ঝামেলা পাকিয়েছে। সেই বর্বরটির পেছনের শক্তিকে খুঁজে বের করতে শুধু রাষ্ট্র শক্তিই নয়, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্যোগী। আক্রান্তদের পাশে দাঁড়িয়েছে রাষ্ট্রশক্তি। তাদের ত্রাণ, পুনর্বাসনে সক্রিয় বাংলাদেশের সরকার। শেখ হাসিনার এই দৃঢ়, প্রত্যয়ী ভূমিকা দেখে বারবার মনে পড়ে যাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের প্রয়াত মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর একটি উক্তি।

ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে তখন কোথাও না কোথাও বিক্ষিপ্তভাবে দাঙ্গা হয়। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে হয় না। এই দাঙ্গা না হওয়ার রহস্যের কথা সাংবাদিকরা জানতে চেয়েছিলেন জ্যোতিবাবুর কাছে। তিনি তার স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিমায় উত্তর দিয়েছিলেন; সরকার চায় না, তাই দাঙ্গা হয় না।

জ্যোতি বসুর কথার সেই বাস্তবতাকেই আবার প্রমাণ করে দিলেন শেখ হাসিনা। তিনি বা তার সরকার চাননি, তাই দাঙ্গার আগুন ছড়ায়নি বাংলাদেশে। শেখ হাসিনা চেয়েছেন, তাই পবিত্র কোরআনকে ঘিরে কে দাঙ্গা বাধিয়েছে, পুলিশ তা খুঁজে বের করেছে। আইনানুগ ব্যবস্থা নিয়েছে। বিচার হবে সেই চক্রান্তকারীর। শাস্তিও হবে। আর বৃহত্তর তদন্তে গোটা চক্রান্তের যাবতীয় নাড়িনক্ষত্র ও জানা যাবে।

অতীতে জিয়াউর রহমান চেয়েছিল। তাই কথায় কথায় দাঙ্গা হতো বাংলাদেশে। সেখানকার সংখ্যালঘু হিন্দুদের বেশিরভাগই যেহেতু নিজেদের আর্থ-সামাজিক নিরাপত্তার স্বার্থে আওয়ামী লীগের সমর্থক, তাই তাদের ওপর রাজনৈতিক হামলা হতো। বাইরে সেই হামলাকে দেখানো হতো অনেকবেশি সাম্প্রদায়িক রঙ দিয়ে। এরশাদ থেকে খালেদা জিয়াÑ এই ট্র্র্যাডিশন চলেছে।

রাষ্ট্র শক্তি যখন এই অপচেষ্টা চালিয়েছে, তখন দলীয় রাজনীতির বৃত্তের ঘরে ও বাইরের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের মানুষ সংখ্যালঘু হিন্দুদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে বঙ্গজননী সুফিয়া কামাল, শামসুর রাহমান, কবীর চৌধুরী, কলিম শরাফি, শওকত ওসমান, জাহানারা ইমাম, অনুপম সেন, দেবেশচন্দ্র ভট্টাচার্যরা দাঁড়িয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গে যেমন সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সোচ্চার থেকেছেন সেই সময়ের ক্ষমতাসীন বামফ্রন্ট সরকার। আর নাগরিক সমাজের পক্ষে অন্নদাশঙ্কর রায়, গৌরী আইয়ুব, গৌরকিশোর ঘোষ, অশোক মিত্র, এ ডব্লিউ মাসুদ, সুকুমারী ভট্টাচার্য, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ প্রমুখেরা।

আজকের বাংলাদেশের পরিস্থিতি আর সেদিন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী শক্তির দ্বারা পরিচালিত সরকার যখন সেখানে ক্ষমতাসীন- এই দুই পরিস্থিতি কিন্তু এক ছিল না। কিন্তু সেদিন মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধুলোয় মিশিয়ে, হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী, ভারতের হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তি, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ, পবিত্র ইসলামের সঙ্গে নিয়ত সংঘাতরত খ্রিস্টীয় মৌলবাদÑ এসবের মিলিত রাজনৈতিক কার্যক্রমের দ্বারা রাজনৈতিক অভিসাপপ্রসূত ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িকতা এবং মৌলবাদ মুক্তিযুদ্ধোত্তর পর্বে যে ক্ষতের সৃষ্টি করেছিল, সেই ক্ষত পশ্চিমবঙ্গের সমাজজীবনেও কর্কট রোগের মতো সংক্রমণ ঘটাতে শুরু করেছিল। সেই সংক্রমণের ফলশ্রুতি এখন ঘটছে বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা ইত্যাদি জায়গাতে। আর এটাই ছিল জিয়াউর রহমান থেকে শুরু করে খালেদার আমল পর্যন্ত সাম্প্রদায়িকতার মোড়কে বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের নিয়ে রাজনীতি করা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী অংশের মূল লক্ষ্য। পাকিস্তানি হানাদারদের ছায়া উপনিবেশ হিসেবে বাংলাদেশকে উল্টো রথচক্রেই শুধু নিয়ে যেতে চায় না এরা। ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতা ধ্বংস করে, ভারতকেও রাজনৈতিক হিন্দুদের অগাধ মৃগয়াভূমিতে পরিণত করা এদের উদ্দেশ্য। জন্মসূত্রে মুসলমান, ধর্মপ্রাণ- কিন্তু সাম্প্রদায়িক নন, এমন মানুষকে সহ্য করতে পারে না বাংলাদেশের ধর্মান্ধ সংখ্যাগুরু সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদীরা। ঠিক তেমনই অবস্থা ভারতের ক্ষেত্রেও। জন্মসূত্রে হিন্দু, কিন্তু বহুত্ববাদে বিশ্বাস করেন, সাম্প্রদায়িক নন। মৌলবাদী তো ননই। কোন অবস্থাতেই মুসলমানদের অবিশ্বাস করেন না। মুসলমান বিদ্বেষী নন। আরএসএসের নাগপুরীয় হিন্দুত্বকে ঘৃণা করেন, এমন হিন্দুদের ও এখন এনআরসি, সিএএ ইত্যাদি চক্করে ফেলে নাগরিকত্ব হরণ করতে চায় ভারতের রাষ্ট্রশক্তি, যারা হিন্দু সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী চেতনার দ্বারা পরিচালিত।

এই গোটা পরিবেশ রচনার ক্ষেত্রে গোটা বিশ্বব্যাপী যে পবিত্র ইসলাম বিদ্বেষী ফোবিয়া রয়েছে, সেই প্রবণতার সঙ্গে হিন্দু- খ্রিস্টান মৌলবাদের যৌথ সংযোগের একটা বড় ভূমিকা আছে। আর সেই ভূমিকার মূর্ত প্রতীক হিসেবে তসলিমা নাসরিন আর তাকে সব থেকে বেশি প্রমোটকরা আনন্দবাজার পত্রিকার ভূমিকা কে কোন অবস্থাতেই অস্বীকার করা যায় না। আনন্দবাজার গোষ্ঠী এবং একাংশের আকমিউনিস্ট বামপন্থিরা তসলিমা নাসরিনকে সেই সময়ে পশ্চিমবঙ্গে এমনভাবে তুলে ধরেছিলেন যাতে এপার বাংলার একটা বড় অংশের সাধারণ মানুষের মনে হয়েছিল যে, বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দুদের হয়ে কথা বলবার মতো একটি ও কণ্ঠ নেই। এই কাজে আনন্দবাজার গোষ্ঠী নিজেরা সরাসরি, তাদের ঘনিষ্ঠ নিখিল সরকার (শ্রীপান্থ), শিবনারায়ণ রায়, অম্লান দত্ত, পার্থ বসু প্রমুখ অত্যন্ত সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিলেন।

সিপিআই (এম) তসলিমা সম্পর্কে প্রথম থেকেই রাজনৈতিক মূল্যায়ণ করেছে। তারা কোন অবস্থাতেই বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের ঘিরে তসলিমার রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কথাকে সমর্থন করেনি। তবে বামফ্রন্ট সরকারের সেই সময়ের অর্থমন্ত্রী ড. অসীম দাশগুপ্তের মা মৃণালিনী দাশগুপ্ত তাদের দলের অবস্থানের বাইরে গিয়ে তসলিমার ক্ষেত্রে যে ভূমিকা নিয়েছিলেন, সেটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে আড়াল করতে তসলিমার যে উদ্যোগ, সুফিয়া কামালদের মতো মানুষদের গোটা জীবনব্যাপী সংখ্যালঘুর অধিকারের প্রশ্নে যে লড়াই, তাকে আড়াল করতে, চেপে দিতে তসলিমার যে চক্রান্ত, সেই গতিমুখকেই ফলবতী করেছিল। এক ই কথা প্রযোজ্য একদা কিংবদন্তি ইলা মিত্র এবং ফরোয়ার্ড ব্লক নেত্রী অপরাজিতা গোপ্পী সম্পর্কেও। কিন্তু সিপিআই নেত্রী তথা ভারতীয় সংসদের সেই সময়ের সদস্যা গীতা মুখোপাধ্যায় কিন্তু সঠিকভাবে চিনতে পেরেছিলেন তসলিমার অভিপ্রায়টিকে এবং তিনি সতর্ক ও করেছিলেন অন্নদাশঙ্কর রায়কে।

নয়ের দশকের গোড়ায় তসলিমার প্রচার গোটা বাংলাদেশটা ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদীতেই ভর্তি হয়ে গিয়েছে। জামায়াত-বিএনপির রাজনৈতিক উদ্দেশে সংখ্যালঘুদের ওপর সাম্প্রদায়িক হামলার গতিমুখকে শুধু সাম্প্রদায়িক দিকে তাক করা, বাংলাদেশের গোটো নাগরিক সমাজকে, সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়কে সার্বিকভাবে সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী, সংখ্যালঘু হিন্দুবিরোধী হিসেবে দেখানো, সুফিয়া কামাল, শামসুর রাহমান, কলিম শরাফিদের জোরালো প্রতিবাদ, প্রতিরোধকে বেমালুম চেপে যাওয়া, যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় পর্যায়ের গণ-আন্দোলন সেই সময়ের বাংলাদেশে তীব্র হয়ে উঠছিল, তাকেও চেপে যাওয়া- এর ফল পশ্চিমবঙ্গের নাগরিক সমাজে বিষময় হয়েছে। বামপন্থিদের রাজনৈতিক ক্ষমতার জন্যে ভোটের নিরিখে পশ্চিমবঙ্গে তখন বিজেপি সুবিধা করতে না পারলেও, সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ, মুসলমান বিদ্বেষ ছড়িয়ে বিজেপির সুবিধা করে দেয়া আর বাংলাদেশে সংখ্যালঘু বিদ্বেষের ক্ষেত্রে জামায়াত-বিএনপিকে আরও শাসে জলে টইটম্বুর করে দেয়ার ক্ষেত্রে তসলিমার ভূমিকা এবং অবদানটিকে এক কথায় ঐতিহাসিক বলা যেতে পারে। সে সময়ে তসলিমার নিজের হাতে পোঁতা বিষবৃক্ষটি পুঁতেছিলেন, আজকের ভারতে আরএসএস-বিজেপির এই বাড়বাড়ন্তের জন্য সেদিনের সেই বিষগাছটির ফল আজ ক্যান্সারের মতো, এখানকার আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক পরিম-লকে ছেয়ে ফেলেছে। বাংলাদেশসহ গোটো দক্ষিণ এশিয়াজুড়েই কমবেশি তার প্রভাব পড়ছে। আর এতটা উপকার করেছিলেন বলেই, ভারতের বিজেপি সরকার আজ কার্যত জামাই আদর দিচ্ছেন তসলিমাকে দিল্লিতে। এই তসলিমাই কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে লাগামহীনভাবে মন্তব্য করে চলেছেন ভারতে বসবাসকারী একজন বিদেশি নাগরিক হয়ে। তার আক্রমণ চলছে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতি। অথচ দিল্লি গণহত্যা, রাষ্ট্রীয় মদতে সেখানে নির্বিচারে মুসলমান হত্যাÑ এসব নিয়ে তসলিমার মুখ থেকে একটি শব্দ উচ্চারিত হয়নি। পাছে বিজেপি- আরএসএস রেগে যায়, তাই তসলিমা ভারতে রাষ্ট্রশক্তির মদতে, শাসকদলের মদতে এখানকার সংখ্যালঘু মুসলমানদের ওপর যাবতীয় নির্যাতন ঘিরে নীরব। যেমন দক্ষিণেশ্বর কালী মন্দিরের প্রসাদ খেয়ে পুণ্যার্থীদের অসুস্থ হওয়ার কথা লিখে বুদ্ধবাবুর আমলে যখন এখানে দাঙ্গা ছড়াতে চেয়েছিলেন তসলিমা, আনন্দবাজার সেই লেখা না ছাপার পর তার সেই বিদ্রোহিনী ইমেজ অন্তর্হিত হয়েছিল, বিষয়টা অনেকটা তেমনই।

বাংলাদেশের সরকার দেশটার আর্থ-সামাজিক চিত্র ধীরে ধীরে বদলে দিয়েছেন। ক্ষুধার ভূগোলে ভারতকে পেছনে ফেলে দিয়েছে বাংলাদেশ। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচার হয়েছে। ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানে ফেরার পথে অনেকখানি এগিয়ে গিয়েছে বাংলাদেশ। তাই এখন যে কোন উপায়ে শেখ হাসিনাকে আগাত করাটাই গোটা দক্ষিণ এশিয়ার কায়েমি শক্তি, হানাদার পাকিস্তিানিরা, তাদের দেশীয় জারজেরা, ভারতীয় হিন্দুত্ববাদী বন্ধুরা, বিপ্লবী বামবুলি কপচানো একাংশের ছদ্মপ্রগতিশীলেরা উঠে পড়ে লেগেছে। ভুলে গেলে চলবে না, এই অতি বামেদের কি ভূমিকা ছিল মহান মুক্তিযুদ্ধে। স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্মের পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে দেশে-বিদেশে হেনস্তা করতে এই অতি বাম, চিনপন্থিদের বদমাইশিগুলো কি এত সহজে বন্ধু হয়ে গিয়েছে বলে মনে করেন পাঠক? ভারতে যেমন প্রকৃত বামপন্থাকে বিনষ্ট করতে যেভাবে একদিন সক্রিয় হয়েছিল সংকীর্ণতাবাদীরা, সেই প্রচেষ্টা তো বাংলাদেশেও অতিবামেরা এখনো চালাচ্ছে শেখ হাসিনাকে উৎখাত করতে সব ধরনের মৌলবাদী, সাম্প্রদায়িক, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী শক্তিকে সঙ্গে নিয়ে। তারাই এপার বাংলাতে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে বাংলাদেশ এবং সেখানকার সরকারকে ঘিরে। এই শক্তিই এখন পশ্চিমবঙ্গের বুকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে কলঙ্কিত করে নতুন করে উদ্ভাসিত করতে চায় মৌলানা ভাসানীকে। সম্প্রতি ভাসানীকে ঘিরে এপার বাংলায় বিচ্ছিন্নতাবাদের সঙ্গে সংযুক্ত একাংশের শৌখিন মজদুরি করা উগ্র বামেদের কর্মতৎপরতাও ব্যাপকভাবে বেড়েছে।

বাংলাদেশে অস্তিরতা তৈরি করতে পারলে ভারতে আরএসএস-বিজেপির লাভ। শেখ হাসিনা বাংলাদেশের একজন ব্যর্থ শাসকÑএই প্রচারের ঢক্কানিনাদ বিজেপির ঘরে ফসল দেবে। নিজের দেশের সংখ্যালঘুদের ওপর নিজেরা যতই পাশবিক আচরণ করুক না কেন বিজেপির সরকার এবং দলের সবস্তরের লোকেরা, বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা দিতে পারছেন না শেখ হাসিনাÑ এই প্রচার চালিয়ে ভারতে মুসলমানদের ওপর অত্যাচার চালানোর সুযোগ অনেক বাড়বে আরএসএস-বিজেপির। শেখ হাসিনাকে কমজোরি করলে লাভবান হবে পাকিস্তান। আর পাকিস্তানের কূটনৈতিক লাভ মানে সে দেশের ধর্মান্ধ মৌলবাদীদের দাপট আরও বৃদ্ধি। সেই বৃদ্ধি অবশ্যই চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ জোগাবে সম্মিলিতভাবে জামায়াত-আরএসএস-বিএনপি-বিজেপিকে। উপমহাদেশে অস্থিরতা যত বাড়াতে পারবে ধর্মান্ধ মৌলবাদী, সাম্প্রদায়িক, সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ততই আড়ালে চলে যাবে মানুষের রুটি-রুজির প্রশ্ন। কর্মসংস্থানের প্রশ্ন। কোণঠাসা করে ফেলা সম্ভব হবে বামপন্থিদের। ফলে এই অশুভ শক্তির নিজেদের বাঁচার তাগিদেই বাংলাদেশে অস্থিরতা তৈরি করা দরকার। সেই অস্থিরতাকে জিইয়ে রাখা দরকার। সেই অস্থিরতা ঘিরে অসত্য প্রচার চালানো প্রয়োজন। নচেৎ এই কায়েমি শক্তির অস্তিত্বই যে বিপন্ন হয়ে পড়বে!

[লেখক : ভারতীয় ইতিহাসবিদ]

শনিবার, ৩০ অক্টোবর ২০২১ , ১৪ কার্তিক ১৪২৮ ২২ রবিউল আউয়াল ১৪৪৩

সংখ্যালঘু প্রশ্নে বাংলাদেশ-বিরোধী চক্রান্তের ধারাবাহিকতা

গৌতম রায়

সদ্যসমাপ্ত শারদোৎসব কালে বাংলাদেশের কোন কোন অঞ্চলে সম্পূর্ণ রাজনৈতিক আঙ্গিক থেকে সেখানকার সংখ্যালঘু হিন্দুদের ওপর অত্যন্ত নিন্দনীয় ঘটনা ঘটেছে। সেসব দুঃখজনক ঘটনাক্রমের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকার যে দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন, তেমন পদক্ষেপের অভিজ্ঞতা এই উপমহাদেশের কোন অংশে সংখ্যালঘুদের সাম্প্রতিক কালে ঘটে না। ভারতে আরএসএসের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি দ্বিতীয় পর্যায়ে একক গরিষ্ঠতা নিয়ে দিল্লিতে সরকার তৈরির পর ভারতে সংখ্যাগুরুর সাম্প্রদায়িকতা রূপান্তরিত হয়েছে সংখ্যাগুরূর আধিপত্যবাদে। তাই দিল্লি গণহত্যাসহ আসাম, ত্রিপুরা- সর্বত্র সংখ্যালঘু মুসলমানদের ওপর অত্যাচার হচ্ছে। এই অত্যাচার বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হচ্ছে রাষ্ট্রীয় মদতে। শাসকদল বিজেপি, তাদের মূল পরিচালক আরএসএস, আর তাদের হরেক রকমের সঙ্গীসাথীরা হলো এই অত্যাচারের প্রধান কুশীলব।

বাংলাদেশে আমরা দেখলাম, সেখানকার রাষ্ট্রশক্তি খুঁজে বের করেছে, পবিত্র কোরআনকে কেন্দ্র করে কে এই পরিকল্পিত ঝামেলা পাকিয়েছে। সেই বর্বরটির পেছনের শক্তিকে খুঁজে বের করতে শুধু রাষ্ট্র শক্তিই নয়, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্যোগী। আক্রান্তদের পাশে দাঁড়িয়েছে রাষ্ট্রশক্তি। তাদের ত্রাণ, পুনর্বাসনে সক্রিয় বাংলাদেশের সরকার। শেখ হাসিনার এই দৃঢ়, প্রত্যয়ী ভূমিকা দেখে বারবার মনে পড়ে যাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের প্রয়াত মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর একটি উক্তি।

ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে তখন কোথাও না কোথাও বিক্ষিপ্তভাবে দাঙ্গা হয়। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে হয় না। এই দাঙ্গা না হওয়ার রহস্যের কথা সাংবাদিকরা জানতে চেয়েছিলেন জ্যোতিবাবুর কাছে। তিনি তার স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিমায় উত্তর দিয়েছিলেন; সরকার চায় না, তাই দাঙ্গা হয় না।

জ্যোতি বসুর কথার সেই বাস্তবতাকেই আবার প্রমাণ করে দিলেন শেখ হাসিনা। তিনি বা তার সরকার চাননি, তাই দাঙ্গার আগুন ছড়ায়নি বাংলাদেশে। শেখ হাসিনা চেয়েছেন, তাই পবিত্র কোরআনকে ঘিরে কে দাঙ্গা বাধিয়েছে, পুলিশ তা খুঁজে বের করেছে। আইনানুগ ব্যবস্থা নিয়েছে। বিচার হবে সেই চক্রান্তকারীর। শাস্তিও হবে। আর বৃহত্তর তদন্তে গোটা চক্রান্তের যাবতীয় নাড়িনক্ষত্র ও জানা যাবে।

অতীতে জিয়াউর রহমান চেয়েছিল। তাই কথায় কথায় দাঙ্গা হতো বাংলাদেশে। সেখানকার সংখ্যালঘু হিন্দুদের বেশিরভাগই যেহেতু নিজেদের আর্থ-সামাজিক নিরাপত্তার স্বার্থে আওয়ামী লীগের সমর্থক, তাই তাদের ওপর রাজনৈতিক হামলা হতো। বাইরে সেই হামলাকে দেখানো হতো অনেকবেশি সাম্প্রদায়িক রঙ দিয়ে। এরশাদ থেকে খালেদা জিয়াÑ এই ট্র্র্যাডিশন চলেছে।

রাষ্ট্র শক্তি যখন এই অপচেষ্টা চালিয়েছে, তখন দলীয় রাজনীতির বৃত্তের ঘরে ও বাইরের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের মানুষ সংখ্যালঘু হিন্দুদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে বঙ্গজননী সুফিয়া কামাল, শামসুর রাহমান, কবীর চৌধুরী, কলিম শরাফি, শওকত ওসমান, জাহানারা ইমাম, অনুপম সেন, দেবেশচন্দ্র ভট্টাচার্যরা দাঁড়িয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গে যেমন সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সোচ্চার থেকেছেন সেই সময়ের ক্ষমতাসীন বামফ্রন্ট সরকার। আর নাগরিক সমাজের পক্ষে অন্নদাশঙ্কর রায়, গৌরী আইয়ুব, গৌরকিশোর ঘোষ, অশোক মিত্র, এ ডব্লিউ মাসুদ, সুকুমারী ভট্টাচার্য, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ প্রমুখেরা।

আজকের বাংলাদেশের পরিস্থিতি আর সেদিন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী শক্তির দ্বারা পরিচালিত সরকার যখন সেখানে ক্ষমতাসীন- এই দুই পরিস্থিতি কিন্তু এক ছিল না। কিন্তু সেদিন মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধুলোয় মিশিয়ে, হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী, ভারতের হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তি, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ, পবিত্র ইসলামের সঙ্গে নিয়ত সংঘাতরত খ্রিস্টীয় মৌলবাদÑ এসবের মিলিত রাজনৈতিক কার্যক্রমের দ্বারা রাজনৈতিক অভিসাপপ্রসূত ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িকতা এবং মৌলবাদ মুক্তিযুদ্ধোত্তর পর্বে যে ক্ষতের সৃষ্টি করেছিল, সেই ক্ষত পশ্চিমবঙ্গের সমাজজীবনেও কর্কট রোগের মতো সংক্রমণ ঘটাতে শুরু করেছিল। সেই সংক্রমণের ফলশ্রুতি এখন ঘটছে বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা ইত্যাদি জায়গাতে। আর এটাই ছিল জিয়াউর রহমান থেকে শুরু করে খালেদার আমল পর্যন্ত সাম্প্রদায়িকতার মোড়কে বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের নিয়ে রাজনীতি করা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী অংশের মূল লক্ষ্য। পাকিস্তানি হানাদারদের ছায়া উপনিবেশ হিসেবে বাংলাদেশকে উল্টো রথচক্রেই শুধু নিয়ে যেতে চায় না এরা। ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতা ধ্বংস করে, ভারতকেও রাজনৈতিক হিন্দুদের অগাধ মৃগয়াভূমিতে পরিণত করা এদের উদ্দেশ্য। জন্মসূত্রে মুসলমান, ধর্মপ্রাণ- কিন্তু সাম্প্রদায়িক নন, এমন মানুষকে সহ্য করতে পারে না বাংলাদেশের ধর্মান্ধ সংখ্যাগুরু সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদীরা। ঠিক তেমনই অবস্থা ভারতের ক্ষেত্রেও। জন্মসূত্রে হিন্দু, কিন্তু বহুত্ববাদে বিশ্বাস করেন, সাম্প্রদায়িক নন। মৌলবাদী তো ননই। কোন অবস্থাতেই মুসলমানদের অবিশ্বাস করেন না। মুসলমান বিদ্বেষী নন। আরএসএসের নাগপুরীয় হিন্দুত্বকে ঘৃণা করেন, এমন হিন্দুদের ও এখন এনআরসি, সিএএ ইত্যাদি চক্করে ফেলে নাগরিকত্ব হরণ করতে চায় ভারতের রাষ্ট্রশক্তি, যারা হিন্দু সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী চেতনার দ্বারা পরিচালিত।

এই গোটা পরিবেশ রচনার ক্ষেত্রে গোটা বিশ্বব্যাপী যে পবিত্র ইসলাম বিদ্বেষী ফোবিয়া রয়েছে, সেই প্রবণতার সঙ্গে হিন্দু- খ্রিস্টান মৌলবাদের যৌথ সংযোগের একটা বড় ভূমিকা আছে। আর সেই ভূমিকার মূর্ত প্রতীক হিসেবে তসলিমা নাসরিন আর তাকে সব থেকে বেশি প্রমোটকরা আনন্দবাজার পত্রিকার ভূমিকা কে কোন অবস্থাতেই অস্বীকার করা যায় না। আনন্দবাজার গোষ্ঠী এবং একাংশের আকমিউনিস্ট বামপন্থিরা তসলিমা নাসরিনকে সেই সময়ে পশ্চিমবঙ্গে এমনভাবে তুলে ধরেছিলেন যাতে এপার বাংলার একটা বড় অংশের সাধারণ মানুষের মনে হয়েছিল যে, বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দুদের হয়ে কথা বলবার মতো একটি ও কণ্ঠ নেই। এই কাজে আনন্দবাজার গোষ্ঠী নিজেরা সরাসরি, তাদের ঘনিষ্ঠ নিখিল সরকার (শ্রীপান্থ), শিবনারায়ণ রায়, অম্লান দত্ত, পার্থ বসু প্রমুখ অত্যন্ত সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিলেন।

সিপিআই (এম) তসলিমা সম্পর্কে প্রথম থেকেই রাজনৈতিক মূল্যায়ণ করেছে। তারা কোন অবস্থাতেই বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের ঘিরে তসলিমার রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কথাকে সমর্থন করেনি। তবে বামফ্রন্ট সরকারের সেই সময়ের অর্থমন্ত্রী ড. অসীম দাশগুপ্তের মা মৃণালিনী দাশগুপ্ত তাদের দলের অবস্থানের বাইরে গিয়ে তসলিমার ক্ষেত্রে যে ভূমিকা নিয়েছিলেন, সেটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে আড়াল করতে তসলিমার যে উদ্যোগ, সুফিয়া কামালদের মতো মানুষদের গোটা জীবনব্যাপী সংখ্যালঘুর অধিকারের প্রশ্নে যে লড়াই, তাকে আড়াল করতে, চেপে দিতে তসলিমার যে চক্রান্ত, সেই গতিমুখকেই ফলবতী করেছিল। এক ই কথা প্রযোজ্য একদা কিংবদন্তি ইলা মিত্র এবং ফরোয়ার্ড ব্লক নেত্রী অপরাজিতা গোপ্পী সম্পর্কেও। কিন্তু সিপিআই নেত্রী তথা ভারতীয় সংসদের সেই সময়ের সদস্যা গীতা মুখোপাধ্যায় কিন্তু সঠিকভাবে চিনতে পেরেছিলেন তসলিমার অভিপ্রায়টিকে এবং তিনি সতর্ক ও করেছিলেন অন্নদাশঙ্কর রায়কে।

নয়ের দশকের গোড়ায় তসলিমার প্রচার গোটা বাংলাদেশটা ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদীতেই ভর্তি হয়ে গিয়েছে। জামায়াত-বিএনপির রাজনৈতিক উদ্দেশে সংখ্যালঘুদের ওপর সাম্প্রদায়িক হামলার গতিমুখকে শুধু সাম্প্রদায়িক দিকে তাক করা, বাংলাদেশের গোটো নাগরিক সমাজকে, সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়কে সার্বিকভাবে সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী, সংখ্যালঘু হিন্দুবিরোধী হিসেবে দেখানো, সুফিয়া কামাল, শামসুর রাহমান, কলিম শরাফিদের জোরালো প্রতিবাদ, প্রতিরোধকে বেমালুম চেপে যাওয়া, যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় পর্যায়ের গণ-আন্দোলন সেই সময়ের বাংলাদেশে তীব্র হয়ে উঠছিল, তাকেও চেপে যাওয়া- এর ফল পশ্চিমবঙ্গের নাগরিক সমাজে বিষময় হয়েছে। বামপন্থিদের রাজনৈতিক ক্ষমতার জন্যে ভোটের নিরিখে পশ্চিমবঙ্গে তখন বিজেপি সুবিধা করতে না পারলেও, সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ, মুসলমান বিদ্বেষ ছড়িয়ে বিজেপির সুবিধা করে দেয়া আর বাংলাদেশে সংখ্যালঘু বিদ্বেষের ক্ষেত্রে জামায়াত-বিএনপিকে আরও শাসে জলে টইটম্বুর করে দেয়ার ক্ষেত্রে তসলিমার ভূমিকা এবং অবদানটিকে এক কথায় ঐতিহাসিক বলা যেতে পারে। সে সময়ে তসলিমার নিজের হাতে পোঁতা বিষবৃক্ষটি পুঁতেছিলেন, আজকের ভারতে আরএসএস-বিজেপির এই বাড়বাড়ন্তের জন্য সেদিনের সেই বিষগাছটির ফল আজ ক্যান্সারের মতো, এখানকার আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক পরিম-লকে ছেয়ে ফেলেছে। বাংলাদেশসহ গোটো দক্ষিণ এশিয়াজুড়েই কমবেশি তার প্রভাব পড়ছে। আর এতটা উপকার করেছিলেন বলেই, ভারতের বিজেপি সরকার আজ কার্যত জামাই আদর দিচ্ছেন তসলিমাকে দিল্লিতে। এই তসলিমাই কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে লাগামহীনভাবে মন্তব্য করে চলেছেন ভারতে বসবাসকারী একজন বিদেশি নাগরিক হয়ে। তার আক্রমণ চলছে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতি। অথচ দিল্লি গণহত্যা, রাষ্ট্রীয় মদতে সেখানে নির্বিচারে মুসলমান হত্যাÑ এসব নিয়ে তসলিমার মুখ থেকে একটি শব্দ উচ্চারিত হয়নি। পাছে বিজেপি- আরএসএস রেগে যায়, তাই তসলিমা ভারতে রাষ্ট্রশক্তির মদতে, শাসকদলের মদতে এখানকার সংখ্যালঘু মুসলমানদের ওপর যাবতীয় নির্যাতন ঘিরে নীরব। যেমন দক্ষিণেশ্বর কালী মন্দিরের প্রসাদ খেয়ে পুণ্যার্থীদের অসুস্থ হওয়ার কথা লিখে বুদ্ধবাবুর আমলে যখন এখানে দাঙ্গা ছড়াতে চেয়েছিলেন তসলিমা, আনন্দবাজার সেই লেখা না ছাপার পর তার সেই বিদ্রোহিনী ইমেজ অন্তর্হিত হয়েছিল, বিষয়টা অনেকটা তেমনই।

বাংলাদেশের সরকার দেশটার আর্থ-সামাজিক চিত্র ধীরে ধীরে বদলে দিয়েছেন। ক্ষুধার ভূগোলে ভারতকে পেছনে ফেলে দিয়েছে বাংলাদেশ। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচার হয়েছে। ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানে ফেরার পথে অনেকখানি এগিয়ে গিয়েছে বাংলাদেশ। তাই এখন যে কোন উপায়ে শেখ হাসিনাকে আগাত করাটাই গোটা দক্ষিণ এশিয়ার কায়েমি শক্তি, হানাদার পাকিস্তিানিরা, তাদের দেশীয় জারজেরা, ভারতীয় হিন্দুত্ববাদী বন্ধুরা, বিপ্লবী বামবুলি কপচানো একাংশের ছদ্মপ্রগতিশীলেরা উঠে পড়ে লেগেছে। ভুলে গেলে চলবে না, এই অতি বামেদের কি ভূমিকা ছিল মহান মুক্তিযুদ্ধে। স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্মের পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে দেশে-বিদেশে হেনস্তা করতে এই অতি বাম, চিনপন্থিদের বদমাইশিগুলো কি এত সহজে বন্ধু হয়ে গিয়েছে বলে মনে করেন পাঠক? ভারতে যেমন প্রকৃত বামপন্থাকে বিনষ্ট করতে যেভাবে একদিন সক্রিয় হয়েছিল সংকীর্ণতাবাদীরা, সেই প্রচেষ্টা তো বাংলাদেশেও অতিবামেরা এখনো চালাচ্ছে শেখ হাসিনাকে উৎখাত করতে সব ধরনের মৌলবাদী, সাম্প্রদায়িক, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী শক্তিকে সঙ্গে নিয়ে। তারাই এপার বাংলাতে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে বাংলাদেশ এবং সেখানকার সরকারকে ঘিরে। এই শক্তিই এখন পশ্চিমবঙ্গের বুকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে কলঙ্কিত করে নতুন করে উদ্ভাসিত করতে চায় মৌলানা ভাসানীকে। সম্প্রতি ভাসানীকে ঘিরে এপার বাংলায় বিচ্ছিন্নতাবাদের সঙ্গে সংযুক্ত একাংশের শৌখিন মজদুরি করা উগ্র বামেদের কর্মতৎপরতাও ব্যাপকভাবে বেড়েছে।

বাংলাদেশে অস্তিরতা তৈরি করতে পারলে ভারতে আরএসএস-বিজেপির লাভ। শেখ হাসিনা বাংলাদেশের একজন ব্যর্থ শাসকÑএই প্রচারের ঢক্কানিনাদ বিজেপির ঘরে ফসল দেবে। নিজের দেশের সংখ্যালঘুদের ওপর নিজেরা যতই পাশবিক আচরণ করুক না কেন বিজেপির সরকার এবং দলের সবস্তরের লোকেরা, বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা দিতে পারছেন না শেখ হাসিনাÑ এই প্রচার চালিয়ে ভারতে মুসলমানদের ওপর অত্যাচার চালানোর সুযোগ অনেক বাড়বে আরএসএস-বিজেপির। শেখ হাসিনাকে কমজোরি করলে লাভবান হবে পাকিস্তান। আর পাকিস্তানের কূটনৈতিক লাভ মানে সে দেশের ধর্মান্ধ মৌলবাদীদের দাপট আরও বৃদ্ধি। সেই বৃদ্ধি অবশ্যই চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ জোগাবে সম্মিলিতভাবে জামায়াত-আরএসএস-বিএনপি-বিজেপিকে। উপমহাদেশে অস্থিরতা যত বাড়াতে পারবে ধর্মান্ধ মৌলবাদী, সাম্প্রদায়িক, সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ততই আড়ালে চলে যাবে মানুষের রুটি-রুজির প্রশ্ন। কর্মসংস্থানের প্রশ্ন। কোণঠাসা করে ফেলা সম্ভব হবে বামপন্থিদের। ফলে এই অশুভ শক্তির নিজেদের বাঁচার তাগিদেই বাংলাদেশে অস্থিরতা তৈরি করা দরকার। সেই অস্থিরতাকে জিইয়ে রাখা দরকার। সেই অস্থিরতা ঘিরে অসত্য প্রচার চালানো প্রয়োজন। নচেৎ এই কায়েমি শক্তির অস্তিত্বই যে বিপন্ন হয়ে পড়বে!

[লেখক : ভারতীয় ইতিহাসবিদ]