শিশুকে ফেরাতে হবে খেলার মাঠে

মোহাম্মদ আবু নোমান

বয়স ১৬ বছরের কম হলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারের জন্য অভিভাবকের অনুমতি নিতে হবে। গত ২৫ অক্টোবর তথ্যেও গোপনীয়তা নিয়ে কাজ করা অস্ট্রেলিয়ার সংস্থা ‘ইনফরমেশন কমিশন’ এমন একটি আইনের খসড়া পেশ করেছে। ফেসবুক-টুইটারের মতো প্ল্যাটফর্মগুলো যদি সেই নিয়ম মানতে ব্যর্থ হয়, তবে ‘মাল্টিমিলিয়ন ডলার’ জরিমানার বিধান থাকবে। প্রস্তাবিত আইন না মানলে অস্ট্রেলিয়ায় ওই প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক টার্নওভারের ১০ শতাংশ, আইনটি ভেঙে যত আয় করেছে তার তিনগুণ কিংবা ১ কোটি অস্ট্রেলীয় ডলার জরিমানা করার বিধান করার কথা বলা হয়েছে। বর্তমানে এ ধরনের অপরাধে সর্বোচ্চ ২১ লাখ অস্ট্রেলীয় ডলার জরিমানা করা যায়।

আমাদের প্রাণপ্রিয় আদরের শিশুরা কী পেলে খুশি হবে, তা হাজির করতে বাবা-মা সর্বক্ষণ তৎপর। এখনকার শিশুদের খাবার খেতেও আপত্তি। শুধু মোবাইলে কার্টুন ছেড়ে দিলে খাবার খেতে রাজি! শিশুর মা নিরুপায় হয়ে কার্টুন ছেড়ে দিয়েই খাবার খাওয়ান। কিন্তু পরিণতিতে যা হয় তা হলো, খাওয়ানোর সময় ছাড়াও বাকি সময় শিশুরা মোবাইলে বুঁদ হয়ে থাকতে চায়, আর মোবাইল সরিয়ে নিলেই কান্নাকাটি শুরু করে। এছাড়া শিশুরা অপরিচিত, প্রতিবেশী এমনটি আপনজন কেউ বাসায় আসলে খুশি হয় না। কারণ, এতে তার মোবাইল দেখায় বাধা আসে। পাবলিক হেলথ ইংল্যান্ডের গবেষণা জানিয়েছে, যেসব শিশু কম্পিউটার, টেলিভিশন ও ভিডিও গেম নিয়ে দিনের বেশিরভাগ সময় ব্যস্ত থাকে, তারা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ও হীনমন্যতার শিকার হয় বেশি। এসব শিশুরা অন্যদের সঙ্গে ঠিকমতো মিশতে চায় না, বা পারে না। পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে ঠিকমতো কথা বলে না, নিজের দৈনন্দিন কাজগুলো ঠিক সময়ে করতে চায় না। অনেক সময় ইন্টারনেট ব্যবহার করতে না পারায় এদের মধ্যে ডিপ্রেশন দেখা দেয়। এছাড়া শিশু-কিশোরদের অটিজম, মনোযোগ হ্রাস, হতাশা ও তীব্র বিষণœতায় আক্রান্ত হওয়ার সঙ্গে ভিডিও গেম আসক্তির সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে বলে গবেষণায় এসেছে।

স্পিচ অ্যান্ড থেরাপি বিশেষজ্ঞরা বলেন, অতিরিক্ত মোবাইল ব্যবহারে শিশুদের মধ্যে অটিজমের লক্ষণ দেখা দেয়; চিকিৎসা বিজ্ঞানে যাকে বলা হয় ‘অটিজম স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডার।’ চিকিৎসক জানান, বর্তমান সময় অসংখ্য শিশুই এ ধরনের সমস্যায় আক্রান্ত হচ্ছে, যার একমাত্র কারণ মাত্রাতিরিক্ত মোবাইল ব্যবহার। বাংলা, ইংরেজি ও মাদরাসা মাধ্যম মিলিয়ে এক হাজার ৪৮১ জন শিক্ষার্থীর ইউনিসেফের করা জরিপের তথ্য ইতিপূর্বে তুলে ধরেন ইউনিসেফ বাংলাদেশের শিশু সুরক্ষা বিশেষজ্ঞ শাবনাজ জেহরিন। তিনি বলেন, জরিপে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ৪০ শতাংশ ছেলে ও ২৪ শতাংশ মেয়ে অহরহ সাইবার বুলিংয়ের শিকার হয়েছে। ১৯ শতাংশ শিশু এমন লেখা পেয়েছে, যা তাদের জন্য উপযোগী নয়। ৫৭ শতাংশ শিশু বিভিন্ন অপরিচিত মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব করেছে। ১৪ শতাংশ শিক্ষার্থী এসব অপরিচিত মানুষের সঙ্গে দেখাও করেছে, যা উদ্বেগজনক। ১১ শতাংশ শিশু ব্যক্তিগত তথ্য আদান-প্রদানও করেছে। এই সংখ্যা যেন আর না বাড়ে, সে বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে বলে মন্তব্য করেন শাবনাজ জেহরিন। ইউনিসেফের তথ্য অনুসারে বিশ্বে প্রতি তিনজন ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর একজন শিশু। আর প্রতিদিন এক লাখ ৭৫ হাজার অর্থাৎ প্রতি আধা সেকেন্ডে একজন শিশু নতুন করে ইন্টারনেটের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। ফেসবুক ব্যবহারকারীদের ২৫ শতাংশের বয়সই ১০ বছরের কম এবং ফেসবুকসহ সব ধরনের সোশ্যাল মিডিয়ার ৯০ শতাংশ ব্যবহারকারীর বয়সই ১৮ থেকে ২৯-এর মধ্যে।

জার্নাল অব ইয়ুথ স্টাডিজ জানায়, আমেরিকান শিশু-কিশোরদের ৯২ ভাগই প্রতিদিন অনলাইনে যায়। ‘অনলাইন প্রাইভেসি বিল’ নামের প্রস্তাবিত ওই আইন পাস হলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বয়স নিয়ন্ত্রণে কঠোরতম দেশগুলোর একটি হবে অস্ট্রেলিয়া। সেই সঙ্গে বড় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টায় একধাপ এগোবে দেশটি। সংবাদমাধ্যমের কনটেন্ট নিজেদের প্ল্যাটফর্ম দেখাতে চাইলে ওই সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে চুক্তি করা এরই মধ্যে বাধ্যতামূলক করেছে দেশটির সরকার। তাছাড়া অনলাইনে ভুয়া তথ্যের প্রসার রোধেও কঠোর হচ্ছে অস্ট্রেলিয়া।

ডিজিটাল ডিজিটাল বলে আমাদের মুখে ফেনা উঠে যাচ্ছে, উন্নয়নের চরম শিখরে পৌঁছতে পৌঁছতে আমরা যে ‘ডিজি’ বাদ দিয়ে ‘টাল’ হয়ে যাচ্ছি তার খবর কে রাখে? আমরা ভাবছি, আমার সন্তানটা নিশ্চয়ই এতটা খারাপ হবে না। কোন রকম টেককেয়ার না করে এই ভালো ধারণাই যে আমার সন্তানের জন্য ‘কাল’ হয়ে আছে, তা কি আমরা একবরাও ভেবেছি? ওদের যেন এই ভুবনে কোথাও আমার হারিয়ে যেতে নেই মানা’র মতো অবস্থা। এবার পরিসংখ্যান দেখব আমরা! শিক্ষার্থীদের ইন্টারনেটের সুরক্ষা সম্পর্কে কতটুকু জ্ঞান আছে, তাও উঠে আসে ইউনিসেফের করা জরিপে। জরিপে অংশ নেওয়া ৩২ শতাংশ ছেলে বলেছে, তাদের কোন তদারকি নেই। এ নিয়ে মা-বাবা কোন প্রশ্ন করছেন না। ২৪ শতাংশ মেয়ের ক্ষেত্রেও একই ধরনের তথ্য এসেছে। ৬৩ শতাংশ শিশু নিজেদের কক্ষে ব্যক্তিগতভাবে ইন্টারনেট ব্যবহার করছে। আর জরিপে অংশ নেয়া ৩৭ শতাংশ শিশুর নিজেদের স্মার্টফোন আছে, সেখানে ইন্টারনেট ব্যবহার করছে। ৯৪ শতাংশ শিশুর সামাজিক মাধ্যমে অ্যাকাউন্ট আছে। ৪২ শতাংশ শিশু প্রতিদিন ইন্টারনেট ব্যবহার করছে।

প্রযুক্তি নির্মাতারা পুরো বিশ্বে প্রযুক্তি প্রসার ঘটালেও নিজের সন্তানদের কিন্তু এ থেকে নিরাপদ দূরত্বে রেখেছেন। মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা বিশ্বের সবচেয়ে বড় ধনকুবের বিল গেটসের সন্তানরা দিনে ৪৫ মিনিটের বেশি কম্পিউটার ব্যবহারের সুযোগ পায় না। শুধু তাই নয়, সন্তানদের বয়স ১৪ হওয়ার আগে বিল গেটস স্মার্টফোন তো দূরের কথা, মোবাইল ফোনই কিনে দেননি। আইফোন ও আইপ্যাডের গ্যাজেট নিয়ে বিশ্বব্যাপী এত মাতামাতি, তার নির্মাতা অ্যাপলের কর্ণধার স্টিভ জবস তার সন্তানদের আইপ্যাড ব্যবহার করতে দেননি। আইপ্যাড যখন বাজারে এলো, স্টিভ জবসকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, তার সন্তানরা এটা পছন্দ করেছে কিনা, এর জবাবে তিনি বলেছিলেন, ওরা এটা ব্যবহার করেনি। কেননা, সন্তানরা কতটা প্রযুক্তি ব্যবহার করবে তার সীমারেখা তাদের বেঁধে দেয়া হয়। অর্থাৎ প্রযুক্তির হর্তাকর্তারা নিজেদের সন্তানদের কিন্তু ঠিকই প্রযুক্তির আগ্রাসী আসক্তি থেকে নিরাপদ দূরত্বে রেখেছেন। কারণ তারা এর ক্ষতিকর দিকগুলো সম্পর্কে ভালোভাবেই জানেন।

বাংলাদেশে অনেক মা-বাবা সন্তানের স্মার্টফোন আসক্তি নিয়ে অভিযোগ করেন। প্রশ্ন আসে, এ দায় কার? শিশুরা কী খাবে, কোন স্কুলে পড়বে, কোন খেলনা দিয়ে খেলবে, অবসর সময় কীভাবে কাটাবে প্রভৃতি সব সিদ্ধান্ত মা-বাবার। স্মার্টফোনের ব্যবহার বাড়ার ফলে সন্তানের প্রতি মা-বাবার মনোযোগ কমে। তারা শিশুদের সঙ্গে খেলাধুলা, গল্প বলা, কথা বলায় সময় দিচ্ছেন না। এর ফলে শিশুর আবেগময় ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ ব্যাহত হচ্ছে। স্মার্টফোন নিয়ে ব্যস্ত থাকার সময় বাধা এলে সন্তানকে অহেতুক বকাঝকা করার প্রবণতাও দেখা যায়, যা দীর্ঘ মেয়াদে মা-বাবার সঙ্গে সন্তানের সম্পর্কে ফাটল ধরায়। আমরা অত্যন্ত জরুরি মনে করি, শিশুদের খেলাধুলার মাঠে ফিরিয়ে আনা। পর্যাপ্ত ঘুম নিশ্চিতের পাশাপাশি, অবসর সময়কে খেলাধুলার সময়ে রূপান্তরিত করা। আমাদের দেশের খেলার মাঠ দখল করে বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। স্থানীয় এলাকাভিত্তিক সাংস্কৃতিক কার্যক্রম স্থবির। পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করার চাপে শিশুরা দিশেহারা। এ পরিস্থিতির পরিবর্তন আবশ্যক। মা-বাবাকে নিজের ও সন্তানের স্ক্রিনে কাটানো সময় নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখতে হবে। পাশাপাশি রাষ্ট্রের দায়িত্ব শিশুদের খেলাধুলা ও সৃজনশীল কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের ব্যবস্থা করা। তথ্যেও গোপনীয়তা নিয়ে কাজ করা অস্ট্রেলিয়ার সংস্থা ‘ইনফরমেশন কমিশনারে’র মতো শিশুদের পরিপূর্ণ বিকাশে বাংলাদেশেরও রাষ্ট্রের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে আইন করতে হবে। এছাড়া শিশুরা যাতে আনন্দের সঙ্গে সময় কাটাতে পারে, তার জন্য রাষ্ট্রের সঙ্গে সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে।

দুর্গন্ধের ভয়ে জানালা বন্ধ করা যাবে না। সুগন্ধ চিনতে পারার সঙ্গে সুগন্ধ নেয়াটাই প্রকৃত সচেতনতার কাজ। কিন্তু কথা হলো-যারা সুগন্ধ বা দুর্গন্ধ চেনার বয়স হয়নি ভাবনা তো তাদের নিয়েই। এ জন্য দরকার সন্তানদের পারিবারিকভাবে কঠোর পর্যবেক্ষণ, ধর্মীয় অনুশাসন ও সামাজিক প্রতিরোধ। আমরা সচরাচর শিশু-কিশোর-তরুণ প্রজন্মকে স্ক্রিনবন্দি জীবনে আসক্ত হিসেবে চিহ্নিত করি। কিন্তু আমরা যারা পরিণত প্রজন্মের প্রতিনিধিত্ব করছি, তারা কি সত্যিকার অর্থে এই আসক্তি থেকে দূরে আছি? আমরা নিজেরা কি হারাতে বসিনি সামাজিকতা, মূল্যবোধ আর শিষ্টাচারের শিক্ষা? ফেসবুকে ভুয়া তথ্যের ভিত্তিতে যেসব অঘটনগুলো ঘটেছে এজন্য দায়ী কী শিশু-কিশোররা? না বড়রা? আমরা যদি আমাদের দেশটাকে এগিয়ে নিতে চাই তবে আমাদের সন্তান, শিক্ষার্থী ও তরুণ সমাজকে অবশ্যই নৈতিকতার মানদণ্ডে উত্তীর্ণ হতে হবে। নতুন প্রজন্ম নিরাপদ না থাকলে দেশ নিরাপদ হবে না, ভবিষ্যৎও নিরাপদ হবে না।

শনিবার, ৩০ অক্টোবর ২০২১ , ১৪ কার্তিক ১৪২৮ ২২ রবিউল আউয়াল ১৪৪৩

শিশুকে ফেরাতে হবে খেলার মাঠে

মোহাম্মদ আবু নোমান

বয়স ১৬ বছরের কম হলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারের জন্য অভিভাবকের অনুমতি নিতে হবে। গত ২৫ অক্টোবর তথ্যেও গোপনীয়তা নিয়ে কাজ করা অস্ট্রেলিয়ার সংস্থা ‘ইনফরমেশন কমিশন’ এমন একটি আইনের খসড়া পেশ করেছে। ফেসবুক-টুইটারের মতো প্ল্যাটফর্মগুলো যদি সেই নিয়ম মানতে ব্যর্থ হয়, তবে ‘মাল্টিমিলিয়ন ডলার’ জরিমানার বিধান থাকবে। প্রস্তাবিত আইন না মানলে অস্ট্রেলিয়ায় ওই প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক টার্নওভারের ১০ শতাংশ, আইনটি ভেঙে যত আয় করেছে তার তিনগুণ কিংবা ১ কোটি অস্ট্রেলীয় ডলার জরিমানা করার বিধান করার কথা বলা হয়েছে। বর্তমানে এ ধরনের অপরাধে সর্বোচ্চ ২১ লাখ অস্ট্রেলীয় ডলার জরিমানা করা যায়।

আমাদের প্রাণপ্রিয় আদরের শিশুরা কী পেলে খুশি হবে, তা হাজির করতে বাবা-মা সর্বক্ষণ তৎপর। এখনকার শিশুদের খাবার খেতেও আপত্তি। শুধু মোবাইলে কার্টুন ছেড়ে দিলে খাবার খেতে রাজি! শিশুর মা নিরুপায় হয়ে কার্টুন ছেড়ে দিয়েই খাবার খাওয়ান। কিন্তু পরিণতিতে যা হয় তা হলো, খাওয়ানোর সময় ছাড়াও বাকি সময় শিশুরা মোবাইলে বুঁদ হয়ে থাকতে চায়, আর মোবাইল সরিয়ে নিলেই কান্নাকাটি শুরু করে। এছাড়া শিশুরা অপরিচিত, প্রতিবেশী এমনটি আপনজন কেউ বাসায় আসলে খুশি হয় না। কারণ, এতে তার মোবাইল দেখায় বাধা আসে। পাবলিক হেলথ ইংল্যান্ডের গবেষণা জানিয়েছে, যেসব শিশু কম্পিউটার, টেলিভিশন ও ভিডিও গেম নিয়ে দিনের বেশিরভাগ সময় ব্যস্ত থাকে, তারা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ও হীনমন্যতার শিকার হয় বেশি। এসব শিশুরা অন্যদের সঙ্গে ঠিকমতো মিশতে চায় না, বা পারে না। পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে ঠিকমতো কথা বলে না, নিজের দৈনন্দিন কাজগুলো ঠিক সময়ে করতে চায় না। অনেক সময় ইন্টারনেট ব্যবহার করতে না পারায় এদের মধ্যে ডিপ্রেশন দেখা দেয়। এছাড়া শিশু-কিশোরদের অটিজম, মনোযোগ হ্রাস, হতাশা ও তীব্র বিষণœতায় আক্রান্ত হওয়ার সঙ্গে ভিডিও গেম আসক্তির সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে বলে গবেষণায় এসেছে।

স্পিচ অ্যান্ড থেরাপি বিশেষজ্ঞরা বলেন, অতিরিক্ত মোবাইল ব্যবহারে শিশুদের মধ্যে অটিজমের লক্ষণ দেখা দেয়; চিকিৎসা বিজ্ঞানে যাকে বলা হয় ‘অটিজম স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডার।’ চিকিৎসক জানান, বর্তমান সময় অসংখ্য শিশুই এ ধরনের সমস্যায় আক্রান্ত হচ্ছে, যার একমাত্র কারণ মাত্রাতিরিক্ত মোবাইল ব্যবহার। বাংলা, ইংরেজি ও মাদরাসা মাধ্যম মিলিয়ে এক হাজার ৪৮১ জন শিক্ষার্থীর ইউনিসেফের করা জরিপের তথ্য ইতিপূর্বে তুলে ধরেন ইউনিসেফ বাংলাদেশের শিশু সুরক্ষা বিশেষজ্ঞ শাবনাজ জেহরিন। তিনি বলেন, জরিপে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ৪০ শতাংশ ছেলে ও ২৪ শতাংশ মেয়ে অহরহ সাইবার বুলিংয়ের শিকার হয়েছে। ১৯ শতাংশ শিশু এমন লেখা পেয়েছে, যা তাদের জন্য উপযোগী নয়। ৫৭ শতাংশ শিশু বিভিন্ন অপরিচিত মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব করেছে। ১৪ শতাংশ শিক্ষার্থী এসব অপরিচিত মানুষের সঙ্গে দেখাও করেছে, যা উদ্বেগজনক। ১১ শতাংশ শিশু ব্যক্তিগত তথ্য আদান-প্রদানও করেছে। এই সংখ্যা যেন আর না বাড়ে, সে বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে বলে মন্তব্য করেন শাবনাজ জেহরিন। ইউনিসেফের তথ্য অনুসারে বিশ্বে প্রতি তিনজন ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর একজন শিশু। আর প্রতিদিন এক লাখ ৭৫ হাজার অর্থাৎ প্রতি আধা সেকেন্ডে একজন শিশু নতুন করে ইন্টারনেটের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। ফেসবুক ব্যবহারকারীদের ২৫ শতাংশের বয়সই ১০ বছরের কম এবং ফেসবুকসহ সব ধরনের সোশ্যাল মিডিয়ার ৯০ শতাংশ ব্যবহারকারীর বয়সই ১৮ থেকে ২৯-এর মধ্যে।

জার্নাল অব ইয়ুথ স্টাডিজ জানায়, আমেরিকান শিশু-কিশোরদের ৯২ ভাগই প্রতিদিন অনলাইনে যায়। ‘অনলাইন প্রাইভেসি বিল’ নামের প্রস্তাবিত ওই আইন পাস হলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বয়স নিয়ন্ত্রণে কঠোরতম দেশগুলোর একটি হবে অস্ট্রেলিয়া। সেই সঙ্গে বড় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টায় একধাপ এগোবে দেশটি। সংবাদমাধ্যমের কনটেন্ট নিজেদের প্ল্যাটফর্ম দেখাতে চাইলে ওই সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে চুক্তি করা এরই মধ্যে বাধ্যতামূলক করেছে দেশটির সরকার। তাছাড়া অনলাইনে ভুয়া তথ্যের প্রসার রোধেও কঠোর হচ্ছে অস্ট্রেলিয়া।

ডিজিটাল ডিজিটাল বলে আমাদের মুখে ফেনা উঠে যাচ্ছে, উন্নয়নের চরম শিখরে পৌঁছতে পৌঁছতে আমরা যে ‘ডিজি’ বাদ দিয়ে ‘টাল’ হয়ে যাচ্ছি তার খবর কে রাখে? আমরা ভাবছি, আমার সন্তানটা নিশ্চয়ই এতটা খারাপ হবে না। কোন রকম টেককেয়ার না করে এই ভালো ধারণাই যে আমার সন্তানের জন্য ‘কাল’ হয়ে আছে, তা কি আমরা একবরাও ভেবেছি? ওদের যেন এই ভুবনে কোথাও আমার হারিয়ে যেতে নেই মানা’র মতো অবস্থা। এবার পরিসংখ্যান দেখব আমরা! শিক্ষার্থীদের ইন্টারনেটের সুরক্ষা সম্পর্কে কতটুকু জ্ঞান আছে, তাও উঠে আসে ইউনিসেফের করা জরিপে। জরিপে অংশ নেওয়া ৩২ শতাংশ ছেলে বলেছে, তাদের কোন তদারকি নেই। এ নিয়ে মা-বাবা কোন প্রশ্ন করছেন না। ২৪ শতাংশ মেয়ের ক্ষেত্রেও একই ধরনের তথ্য এসেছে। ৬৩ শতাংশ শিশু নিজেদের কক্ষে ব্যক্তিগতভাবে ইন্টারনেট ব্যবহার করছে। আর জরিপে অংশ নেয়া ৩৭ শতাংশ শিশুর নিজেদের স্মার্টফোন আছে, সেখানে ইন্টারনেট ব্যবহার করছে। ৯৪ শতাংশ শিশুর সামাজিক মাধ্যমে অ্যাকাউন্ট আছে। ৪২ শতাংশ শিশু প্রতিদিন ইন্টারনেট ব্যবহার করছে।

প্রযুক্তি নির্মাতারা পুরো বিশ্বে প্রযুক্তি প্রসার ঘটালেও নিজের সন্তানদের কিন্তু এ থেকে নিরাপদ দূরত্বে রেখেছেন। মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা বিশ্বের সবচেয়ে বড় ধনকুবের বিল গেটসের সন্তানরা দিনে ৪৫ মিনিটের বেশি কম্পিউটার ব্যবহারের সুযোগ পায় না। শুধু তাই নয়, সন্তানদের বয়স ১৪ হওয়ার আগে বিল গেটস স্মার্টফোন তো দূরের কথা, মোবাইল ফোনই কিনে দেননি। আইফোন ও আইপ্যাডের গ্যাজেট নিয়ে বিশ্বব্যাপী এত মাতামাতি, তার নির্মাতা অ্যাপলের কর্ণধার স্টিভ জবস তার সন্তানদের আইপ্যাড ব্যবহার করতে দেননি। আইপ্যাড যখন বাজারে এলো, স্টিভ জবসকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, তার সন্তানরা এটা পছন্দ করেছে কিনা, এর জবাবে তিনি বলেছিলেন, ওরা এটা ব্যবহার করেনি। কেননা, সন্তানরা কতটা প্রযুক্তি ব্যবহার করবে তার সীমারেখা তাদের বেঁধে দেয়া হয়। অর্থাৎ প্রযুক্তির হর্তাকর্তারা নিজেদের সন্তানদের কিন্তু ঠিকই প্রযুক্তির আগ্রাসী আসক্তি থেকে নিরাপদ দূরত্বে রেখেছেন। কারণ তারা এর ক্ষতিকর দিকগুলো সম্পর্কে ভালোভাবেই জানেন।

বাংলাদেশে অনেক মা-বাবা সন্তানের স্মার্টফোন আসক্তি নিয়ে অভিযোগ করেন। প্রশ্ন আসে, এ দায় কার? শিশুরা কী খাবে, কোন স্কুলে পড়বে, কোন খেলনা দিয়ে খেলবে, অবসর সময় কীভাবে কাটাবে প্রভৃতি সব সিদ্ধান্ত মা-বাবার। স্মার্টফোনের ব্যবহার বাড়ার ফলে সন্তানের প্রতি মা-বাবার মনোযোগ কমে। তারা শিশুদের সঙ্গে খেলাধুলা, গল্প বলা, কথা বলায় সময় দিচ্ছেন না। এর ফলে শিশুর আবেগময় ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ ব্যাহত হচ্ছে। স্মার্টফোন নিয়ে ব্যস্ত থাকার সময় বাধা এলে সন্তানকে অহেতুক বকাঝকা করার প্রবণতাও দেখা যায়, যা দীর্ঘ মেয়াদে মা-বাবার সঙ্গে সন্তানের সম্পর্কে ফাটল ধরায়। আমরা অত্যন্ত জরুরি মনে করি, শিশুদের খেলাধুলার মাঠে ফিরিয়ে আনা। পর্যাপ্ত ঘুম নিশ্চিতের পাশাপাশি, অবসর সময়কে খেলাধুলার সময়ে রূপান্তরিত করা। আমাদের দেশের খেলার মাঠ দখল করে বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। স্থানীয় এলাকাভিত্তিক সাংস্কৃতিক কার্যক্রম স্থবির। পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করার চাপে শিশুরা দিশেহারা। এ পরিস্থিতির পরিবর্তন আবশ্যক। মা-বাবাকে নিজের ও সন্তানের স্ক্রিনে কাটানো সময় নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখতে হবে। পাশাপাশি রাষ্ট্রের দায়িত্ব শিশুদের খেলাধুলা ও সৃজনশীল কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের ব্যবস্থা করা। তথ্যেও গোপনীয়তা নিয়ে কাজ করা অস্ট্রেলিয়ার সংস্থা ‘ইনফরমেশন কমিশনারে’র মতো শিশুদের পরিপূর্ণ বিকাশে বাংলাদেশেরও রাষ্ট্রের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে আইন করতে হবে। এছাড়া শিশুরা যাতে আনন্দের সঙ্গে সময় কাটাতে পারে, তার জন্য রাষ্ট্রের সঙ্গে সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে।

দুর্গন্ধের ভয়ে জানালা বন্ধ করা যাবে না। সুগন্ধ চিনতে পারার সঙ্গে সুগন্ধ নেয়াটাই প্রকৃত সচেতনতার কাজ। কিন্তু কথা হলো-যারা সুগন্ধ বা দুর্গন্ধ চেনার বয়স হয়নি ভাবনা তো তাদের নিয়েই। এ জন্য দরকার সন্তানদের পারিবারিকভাবে কঠোর পর্যবেক্ষণ, ধর্মীয় অনুশাসন ও সামাজিক প্রতিরোধ। আমরা সচরাচর শিশু-কিশোর-তরুণ প্রজন্মকে স্ক্রিনবন্দি জীবনে আসক্ত হিসেবে চিহ্নিত করি। কিন্তু আমরা যারা পরিণত প্রজন্মের প্রতিনিধিত্ব করছি, তারা কি সত্যিকার অর্থে এই আসক্তি থেকে দূরে আছি? আমরা নিজেরা কি হারাতে বসিনি সামাজিকতা, মূল্যবোধ আর শিষ্টাচারের শিক্ষা? ফেসবুকে ভুয়া তথ্যের ভিত্তিতে যেসব অঘটনগুলো ঘটেছে এজন্য দায়ী কী শিশু-কিশোররা? না বড়রা? আমরা যদি আমাদের দেশটাকে এগিয়ে নিতে চাই তবে আমাদের সন্তান, শিক্ষার্থী ও তরুণ সমাজকে অবশ্যই নৈতিকতার মানদণ্ডে উত্তীর্ণ হতে হবে। নতুন প্রজন্ম নিরাপদ না থাকলে দেশ নিরাপদ হবে না, ভবিষ্যৎও নিরাপদ হবে না।