জলবায়ু সম্মেলনে ৩ প্রস্তাব নিয়ে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী

জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলনে (কপ২৬) বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি সীমিত রাখা, জলবায়ু তহবিলের কার্যকর বাস্তবায়নসহ তিনটি প্রস্তাব নিয়ে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে যোগ দিতে আজ ঢাকা ছাড়বেন প্রধানমন্ত্রী। ১৩ দিনের এই সফরে লন্ডন ও প্যারিসেও যাবেন তিনি।

গতকাল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে ইউরোপের তিন দেশে প্রধানমন্ত্রীর সফরের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেন। তিনি জানান, তাপমাত্রা বৃদ্ধির মাত্রা ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নামিয়ে আনতে ‘ন্যাশনালি ডিটারমিন্ড কনট্রিবিউশনস (এনডিসি)’ ঠিক করা, ১০০ বিলিয়ন ডলারের জলবায়ু তহবিলের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানি বাড়াতে সহযোগিতা বাড়ানোর বিষয় তুলে ধরবেন প্রধানমন্ত্রী। বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করার পাশাপাশি শেখ হাসিনা এবারের জলবায়ু সম্মেলনে ঝুঁকির মুখে থাকা ৪৮ দেশের জোট ‘ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামের (সিভিএফ)’ চেয়ারপার্সন হিসাবে যাচ্ছেন।

গ্লাসগোয় ৩১ অক্টেবর থেকে ১২ নভেম্বর অনুষ্ঠিত হবে জাতিসংঘের কনফারেন্স অব দ্য পার্টিজের (কপ) ২৬তম আয়োজন। ১ ও ২ নভেম্বর সম্মেলনের শীর্ষ বৈঠকসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে যোগ দেবেন শেখ হাসিনা। সেখানে তিনি প্রথম দিনে বক্তব্য দেবেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা বলেছি, প্রত্যেক দেশ তাদের এনডিসি এমন জোরালোভাবে তৈরি করবে, যাতে পর্যায়ক্রমে আমাদের তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের মধ্যে থাকে। এখন দুই ডিগ্রির মতো হয়ে যাচ্ছে, এটা কমাতে হবে। বিশেষ করে শিল্পোন্নত দেশকে এক্ষেত্রে ভূমিকা নিতে হবে। কারণ ৮০ ভাগ কার্বন নিঃসরণ করে জি২০ দেশ। তারা যাতে জোরালোভাবে কাজ করে, এমিশনটা কমে।’

জলবায়ু তহবিলের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘২০১৫ সালে প্যারিস সম্মেলনে উন্নত দেশগুলো অঙ্গীকার করেছিল, জলবায়ু তহবিলে ২০২০ থেকে প্রতিবছর ১০০ বিলিয়ন ডলার অনুদান দেবে। আমরা চাই, এবার সেটির বাস্তবায়ন হবে, তোমরা শুধু মুখে মুখে বলো, এবার তোমাদের অবশ্যই দিতে হবে।’ অভিযোজন ও প্রশমন দুই খাতে ৫০ শতাংশ করে এই তহবিলের অর্থ খরচের দাবি আগে থেকে জানিয়ে আসছে বাংলাদেশ। নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে সহযোগিতার বাড়ানোর বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণে বাংলাদেশের অবদান শূন্য দশমিক ৪৭ শতাংশ। একেবারে নিতান্ত কম। আমরা চাই যে, আমরা আরও কমাব। কমাতে গেলে, আমরা নবায়নযোগ্য জ্বালানি অধিক পরিমাণে চাই। আমরা মুজিব প্রসপ্যারিটি প্ল্যান নিয়েছি এবং এটা খুব এগ্রেসিভ প্ল্যান।’

১ নভেম্বর সিভিএফ ও কমনওয়েলথের একটি যৌথসভা অনুষ্ঠিত হবে, যেখানে প্রধান অতিথি থাকবেন শেখ হাসিনা। সেইসঙ্গে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের আমন্ত্রণে ‘অ্যাকশন অ্যান্ড সলিডারিটি- দ্য ক্রিটিক্যাল ডিকেইড’ শীর্ষক সভায় তিনি অংশ নেবেন।

সিভিএফ সভাপতি হিসেবে বাংলাদেশ কপ-২৬ সম্মেলনে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর অধিকার আদায়ে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখছে বলে দাবি করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন। তিনি বলেন, এবারের সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে ‘সিভিএফ-কপ২৬ লিডার্স ডায়ালগ’ অনুষ্ঠিত হবে। শীর্ষ বৈঠকে সিভিএফের সদস্য ও পর্যবেক্ষক দেশের রাষ্ট্র বা সরকার প্রধানরা, কপ-২৬ আয়োজনকারী দেশ যুক্তরাজ্যের শীর্ষ নেতারাসহ অন্যান্য অতিথিরা যোগ দেবেন।

এই সম্মেলনে জলবায়ু পরিবর্তন রোধ, জলবায়ু অভিযোজন ও অর্থায়নের লক্ষ্যে আহ্বান জানিয়ে ‘ঢাকা-গ্লাসগো ঘোষণা’ গৃহীত হওয়ার সম্ভাবনার কথা জানান মোমেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২ নভেম্বর জলবায়ু সম্মেলনে ‘উইমেন অ্যান্ড ক্লাইমেট’ শীর্ষক সভায় যোগ দেবেন। এছাড়া সফরে স্কটিশ পার্লামেন্টে স্কটিশ সংসদ সদস্যদের উদ্দেশে ‘এ কল ফর ক্লাইমেট প্রসপ্যারিটি’ শীর্ষক বক্তব্য দেবেন শেখ হাসিনা।

গ্লাসগোতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার লন্ডন সফরের আগেই ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। বাংলাদেশ এই বৈঠক লন্ডনে করার প্রস্তাব দিলেও কপ২৬-এ ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর ব্যস্ততার কারণে তা শেষ পর্যন্ত গ্লাসগোতেই নির্ধারিত হয়। সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন বলেন, ‘গ্লাসগোতে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর পাশাপাশি প্রিন্স চার্লস ও শ্রীলঙ্কান প্রেসিডেন্ট গোটাবে রাজাপাকসের সঙ্গেও দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করবেন প্রধানমন্ত্রী।’ জনসনের সঙ্গে বৈঠকের বিষয়ে এক প্রশ্নে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে আমাদের সবসময় আলোচনা চলে। অনেক দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় আলোচনা চলমান। সম্প্রতি আমরা তাদের সঙ্গে বিশেষভাবে আলোচনা করেছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা স্বল্পআয়ের দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের দিকে যাত্রা শুরু করছি। এর ফলে আমরা বিভিন্ন ধরনের সুবিধা যেটা পাই, ফান্ডসহ অন্যান্য কিছু, এই সুবিধা আমরা ধরে রাখতে চাই। আমরা ইতোমধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে আলাপ করে ২০২৯ সাল পর্যন্ত মোটামুটিভাবে নির্ধারণ করেছি। আমরা আরও চাই। একাধিক ইস্যু নিয়ে আলোচনা হবে।’

মোমেন বলেন, ‘ব্রিটেনের সঙ্গেতো আমাদের বহু দিকের সম্পর্ক। এমনকি আমরা প্রতিরক্ষা নিয়েও আলাপ করতেছি সাম্প্রতিককালে। আমরা যেগুলো আগে করেছিলাম, সেগুলো আরও ধারালো করা হবে।’

গ্লাসগোতে দুইদিন পার করার পর ৩ নভেম্বর ছয় দিনের লন্ডন সফরে যাবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সফরকালে ওয়েস্টমিনস্টারে যুক্তরাজ্য পার্লামেন্টের সদস্যদের উদ্দেশে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে ভাষণ দেবেন শেখ হাসিনা। এছাড়া লন্ডনে বাংলাদেশ সিকিউরিটিস অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন ও বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ আয়োজিত বিনিয়োগ সম্মেলনে তিনি ভার্চুয়ালি অংশ নেবেন। লন্ডনে বাংলাদেশ হাই কমিশনের আয়োজনে বঙ্গবন্ধু বিষয়ে গোপন দলিলপত্রের নতুন প্রকাশিত খ-সমূহের মোড়ক উন্মোচন করবেন তিনি। পরে শেখ হাসিনা লন্ডন থেকে ফ্রান্স সরকারের আমন্ত্রণে এবং ইউনেস্কোর আয়োজনে যোগ দিতে ৯ নভেম্বর প্যারিস সফরে যাবেন।

ফ্রান্সের সঙ্গে সম্পর্ক মজবুত করতে চায় বাংলাদেশ

ব্রেক্সিট পরবর্তী ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) এর প্রভাবশালী দেশ ফ্রান্সের সঙ্গে সম্পর্ক আরও মজবুত করার লক্ষ্য নিয়ে প্যারিস সফরে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ফ্রান্সের সরকারের আমন্ত্রণে ৯ নভেম্বর থেকে চার দিনের সফরে দেশটির রাজধানী প্যারিসে যাবেন তিনি। প্রধানমন্ত্রীর ফ্রান্স সফরের তাৎপর্য বিষয়ে এক প্রশের উত্তরে ড. মোমেন বলেন, ‘আমরা সবগুলো দেশের সঙ্গে সম্পর্ক অনেক জোরদার করছি। প্রত্যেক দেশ বাংলাদেশের নেতৃত্বের প্রতি আস্থা ও সম্মান দেখিয়েছে। সম্মান দেখিয়েছে এজন্য যে, গত ১২ বছরে আমাদের অর্জন অভাবনীয়। ওদের সবার আমাদের ওপর আস্থা অনেক বেড়েছে। আমরা সম্পর্কগুলোকে আরও মজবুত করতে চাই। আরও সুসম্পর্ক করতে চাই।’

আগামী ৯ থেকে ১৩ নভেম্বর ফ্রান্সে সরকারি সফরকালে দ্বি-পক্ষীয় কর্মসূচির পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী ইউনেস্কোর বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশ নেবেন। সফরকালে প্রধানমন্ত্রী ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ ও প্রধানমন্ত্রী জ্যঁ ক্যাসটেক্স এর সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করবেন। ফরাসি প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বৈঠকালে বিভিন্ন বিষয়ে কয়েকটি সমঝোতা স্মারক ও লেটার অব ইনটেন্ট সই হওয়ার কথা রয়েছে বলে জানান তিনি। মোমেন বলেন, ‘সফরকালে বাংলাদেশ ও ফ্রান্সের মধ্যকার দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরও উচ্চতর পর্যায়ে নিয়ে যাবার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে বলে আশা করা যাচ্ছে।’ সাংবাদিকদের এক প্রশের জাবাবে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেন, এখানে একটি বিশেষ দিক থাকতে পারে হয়তো, সেটি হলো ইউরোপীয় ইউনিয়নের একটি প্রভাবশালী দেশ ফ্রান্স, ইইউতে কিছু পরিবর্তনের পরে বা নতুন করে এ জোট গঠিত হওয়ার পরে, ফ্রান্সে এটি প্রথম সফর।’

সফরকালে ফ্রান্সের অন্যান্য মন্ত্রী ও পার্লামেন্ট সদস্যদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর আনুষ্ঠানিক সাক্ষাতের প্রস্তাবও রয়েছে। ফ্রান্সের বেশ কিছু কোম্পানির প্রধানের পাশাপাশি ফরাসি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিনিধিত্বকারী শীর্ষস্থানীয় সংস্থা এমইডিইএফ-এর একটি প্রতিনিধিদল প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন। এছাড়া শেখ হাসিনা ১১ নভেম্বর ইউনেস্কো সদরদপ্তরে ‘ইউনেস্কো-বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ইন্টারন্যাশনাল প্রাইজ ইন দি ফিল্ড অব ক্রিয়েটিভ ইকোনমি’ প্রদান অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন। ওইদিন সাবেক ফরাসি বাণিজ্যমন্ত্রী ও বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সাবেক মহাপরিচালক প্যাসকেল ল্যামির আমন্ত্রণে প্যারিস পিস ফোরামের উচ্চ পর্যায়ের অধিবেশনে তিনি যোগ দেবেন।

১২ নভেম্বর ইউনেস্কোর ৭৫তম বার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে একটি উচ্চ পর্যায়ের সভায় অংশ নেয়ার আমন্ত্রণও রয়েছে তার। এসময় ইউনেস্কোর মহাপরিচালক অদ্রে আজুলের সঙ্গে একটি দ্বিপক্ষীয় বৈঠকও হবে প্রধানমন্ত্রীর। ফ্রান্সে প্রবাসী বাংলাদেশিদের সঙ্গে ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানেও তিনি যোগ দেবেন। শাহরিয়ার আলম বলেন, ‘প্যারিসে এনজেগমেন্টটা খুবই এক্সটেনসিভ। সেখানে তিনটি স্থানে প্রধানমন্ত্রীকে গার্ড অব অনার প্রদান করা হবে এবং এ সফরে প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে যথাযথ দ্বিপক্ষীয় বৈঠক হবে। ফ্রান্সের বেশ কিছু কোম্পানি যারা বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে, তাদের পণ্য বিক্রি করতে আগ্রহী এবং আমরাও সেখানে রপ্তানি বাড়াতে আগ্রহী।’

ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক ও বিনিয়োগ বাড়ানোর বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘ফ্রান্সে আমরা আগে যখন গিয়েছিলাম, সেখানে অনেক আকর্ষণ দেখা গিয়েছিল। ফ্রান্সের কয়েকটা কোম্পানি, তারা দুনিয়ার সব জায়গায় বিনিয়োগ করে। এটা হবে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক। ফ্রান্সে এখনও সরাসরি ফ্লাইট নাই। এভিয়েশনের সঙ্গে আলাপ করব, আশা করি আমরা পাব। আমাদের যে কমিউনিটি, তারাও অনেক দিন ধরে প্যারিসে সরাসরি ফ্লাইটের জন্য চেষ্টা করছে।’

রবিবার, ৩১ অক্টোবর ২০২১ , ১৫ কার্তিক ১৪২৮ ২৩ রবিউল আউয়াল ১৪৪৩

জলবায়ু সম্মেলনে ৩ প্রস্তাব নিয়ে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক

জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলনে (কপ২৬) বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি সীমিত রাখা, জলবায়ু তহবিলের কার্যকর বাস্তবায়নসহ তিনটি প্রস্তাব নিয়ে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে যোগ দিতে আজ ঢাকা ছাড়বেন প্রধানমন্ত্রী। ১৩ দিনের এই সফরে লন্ডন ও প্যারিসেও যাবেন তিনি।

গতকাল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে ইউরোপের তিন দেশে প্রধানমন্ত্রীর সফরের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেন। তিনি জানান, তাপমাত্রা বৃদ্ধির মাত্রা ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নামিয়ে আনতে ‘ন্যাশনালি ডিটারমিন্ড কনট্রিবিউশনস (এনডিসি)’ ঠিক করা, ১০০ বিলিয়ন ডলারের জলবায়ু তহবিলের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানি বাড়াতে সহযোগিতা বাড়ানোর বিষয় তুলে ধরবেন প্রধানমন্ত্রী। বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করার পাশাপাশি শেখ হাসিনা এবারের জলবায়ু সম্মেলনে ঝুঁকির মুখে থাকা ৪৮ দেশের জোট ‘ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামের (সিভিএফ)’ চেয়ারপার্সন হিসাবে যাচ্ছেন।

গ্লাসগোয় ৩১ অক্টেবর থেকে ১২ নভেম্বর অনুষ্ঠিত হবে জাতিসংঘের কনফারেন্স অব দ্য পার্টিজের (কপ) ২৬তম আয়োজন। ১ ও ২ নভেম্বর সম্মেলনের শীর্ষ বৈঠকসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে যোগ দেবেন শেখ হাসিনা। সেখানে তিনি প্রথম দিনে বক্তব্য দেবেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা বলেছি, প্রত্যেক দেশ তাদের এনডিসি এমন জোরালোভাবে তৈরি করবে, যাতে পর্যায়ক্রমে আমাদের তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের মধ্যে থাকে। এখন দুই ডিগ্রির মতো হয়ে যাচ্ছে, এটা কমাতে হবে। বিশেষ করে শিল্পোন্নত দেশকে এক্ষেত্রে ভূমিকা নিতে হবে। কারণ ৮০ ভাগ কার্বন নিঃসরণ করে জি২০ দেশ। তারা যাতে জোরালোভাবে কাজ করে, এমিশনটা কমে।’

জলবায়ু তহবিলের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘২০১৫ সালে প্যারিস সম্মেলনে উন্নত দেশগুলো অঙ্গীকার করেছিল, জলবায়ু তহবিলে ২০২০ থেকে প্রতিবছর ১০০ বিলিয়ন ডলার অনুদান দেবে। আমরা চাই, এবার সেটির বাস্তবায়ন হবে, তোমরা শুধু মুখে মুখে বলো, এবার তোমাদের অবশ্যই দিতে হবে।’ অভিযোজন ও প্রশমন দুই খাতে ৫০ শতাংশ করে এই তহবিলের অর্থ খরচের দাবি আগে থেকে জানিয়ে আসছে বাংলাদেশ। নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে সহযোগিতার বাড়ানোর বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণে বাংলাদেশের অবদান শূন্য দশমিক ৪৭ শতাংশ। একেবারে নিতান্ত কম। আমরা চাই যে, আমরা আরও কমাব। কমাতে গেলে, আমরা নবায়নযোগ্য জ্বালানি অধিক পরিমাণে চাই। আমরা মুজিব প্রসপ্যারিটি প্ল্যান নিয়েছি এবং এটা খুব এগ্রেসিভ প্ল্যান।’

১ নভেম্বর সিভিএফ ও কমনওয়েলথের একটি যৌথসভা অনুষ্ঠিত হবে, যেখানে প্রধান অতিথি থাকবেন শেখ হাসিনা। সেইসঙ্গে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের আমন্ত্রণে ‘অ্যাকশন অ্যান্ড সলিডারিটি- দ্য ক্রিটিক্যাল ডিকেইড’ শীর্ষক সভায় তিনি অংশ নেবেন।

সিভিএফ সভাপতি হিসেবে বাংলাদেশ কপ-২৬ সম্মেলনে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর অধিকার আদায়ে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখছে বলে দাবি করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন। তিনি বলেন, এবারের সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে ‘সিভিএফ-কপ২৬ লিডার্স ডায়ালগ’ অনুষ্ঠিত হবে। শীর্ষ বৈঠকে সিভিএফের সদস্য ও পর্যবেক্ষক দেশের রাষ্ট্র বা সরকার প্রধানরা, কপ-২৬ আয়োজনকারী দেশ যুক্তরাজ্যের শীর্ষ নেতারাসহ অন্যান্য অতিথিরা যোগ দেবেন।

এই সম্মেলনে জলবায়ু পরিবর্তন রোধ, জলবায়ু অভিযোজন ও অর্থায়নের লক্ষ্যে আহ্বান জানিয়ে ‘ঢাকা-গ্লাসগো ঘোষণা’ গৃহীত হওয়ার সম্ভাবনার কথা জানান মোমেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২ নভেম্বর জলবায়ু সম্মেলনে ‘উইমেন অ্যান্ড ক্লাইমেট’ শীর্ষক সভায় যোগ দেবেন। এছাড়া সফরে স্কটিশ পার্লামেন্টে স্কটিশ সংসদ সদস্যদের উদ্দেশে ‘এ কল ফর ক্লাইমেট প্রসপ্যারিটি’ শীর্ষক বক্তব্য দেবেন শেখ হাসিনা।

গ্লাসগোতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার লন্ডন সফরের আগেই ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। বাংলাদেশ এই বৈঠক লন্ডনে করার প্রস্তাব দিলেও কপ২৬-এ ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর ব্যস্ততার কারণে তা শেষ পর্যন্ত গ্লাসগোতেই নির্ধারিত হয়। সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন বলেন, ‘গ্লাসগোতে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর পাশাপাশি প্রিন্স চার্লস ও শ্রীলঙ্কান প্রেসিডেন্ট গোটাবে রাজাপাকসের সঙ্গেও দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করবেন প্রধানমন্ত্রী।’ জনসনের সঙ্গে বৈঠকের বিষয়ে এক প্রশ্নে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে আমাদের সবসময় আলোচনা চলে। অনেক দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় আলোচনা চলমান। সম্প্রতি আমরা তাদের সঙ্গে বিশেষভাবে আলোচনা করেছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা স্বল্পআয়ের দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের দিকে যাত্রা শুরু করছি। এর ফলে আমরা বিভিন্ন ধরনের সুবিধা যেটা পাই, ফান্ডসহ অন্যান্য কিছু, এই সুবিধা আমরা ধরে রাখতে চাই। আমরা ইতোমধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে আলাপ করে ২০২৯ সাল পর্যন্ত মোটামুটিভাবে নির্ধারণ করেছি। আমরা আরও চাই। একাধিক ইস্যু নিয়ে আলোচনা হবে।’

মোমেন বলেন, ‘ব্রিটেনের সঙ্গেতো আমাদের বহু দিকের সম্পর্ক। এমনকি আমরা প্রতিরক্ষা নিয়েও আলাপ করতেছি সাম্প্রতিককালে। আমরা যেগুলো আগে করেছিলাম, সেগুলো আরও ধারালো করা হবে।’

গ্লাসগোতে দুইদিন পার করার পর ৩ নভেম্বর ছয় দিনের লন্ডন সফরে যাবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সফরকালে ওয়েস্টমিনস্টারে যুক্তরাজ্য পার্লামেন্টের সদস্যদের উদ্দেশে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে ভাষণ দেবেন শেখ হাসিনা। এছাড়া লন্ডনে বাংলাদেশ সিকিউরিটিস অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন ও বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ আয়োজিত বিনিয়োগ সম্মেলনে তিনি ভার্চুয়ালি অংশ নেবেন। লন্ডনে বাংলাদেশ হাই কমিশনের আয়োজনে বঙ্গবন্ধু বিষয়ে গোপন দলিলপত্রের নতুন প্রকাশিত খ-সমূহের মোড়ক উন্মোচন করবেন তিনি। পরে শেখ হাসিনা লন্ডন থেকে ফ্রান্স সরকারের আমন্ত্রণে এবং ইউনেস্কোর আয়োজনে যোগ দিতে ৯ নভেম্বর প্যারিস সফরে যাবেন।

ফ্রান্সের সঙ্গে সম্পর্ক মজবুত করতে চায় বাংলাদেশ

ব্রেক্সিট পরবর্তী ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) এর প্রভাবশালী দেশ ফ্রান্সের সঙ্গে সম্পর্ক আরও মজবুত করার লক্ষ্য নিয়ে প্যারিস সফরে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ফ্রান্সের সরকারের আমন্ত্রণে ৯ নভেম্বর থেকে চার দিনের সফরে দেশটির রাজধানী প্যারিসে যাবেন তিনি। প্রধানমন্ত্রীর ফ্রান্স সফরের তাৎপর্য বিষয়ে এক প্রশের উত্তরে ড. মোমেন বলেন, ‘আমরা সবগুলো দেশের সঙ্গে সম্পর্ক অনেক জোরদার করছি। প্রত্যেক দেশ বাংলাদেশের নেতৃত্বের প্রতি আস্থা ও সম্মান দেখিয়েছে। সম্মান দেখিয়েছে এজন্য যে, গত ১২ বছরে আমাদের অর্জন অভাবনীয়। ওদের সবার আমাদের ওপর আস্থা অনেক বেড়েছে। আমরা সম্পর্কগুলোকে আরও মজবুত করতে চাই। আরও সুসম্পর্ক করতে চাই।’

আগামী ৯ থেকে ১৩ নভেম্বর ফ্রান্সে সরকারি সফরকালে দ্বি-পক্ষীয় কর্মসূচির পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী ইউনেস্কোর বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশ নেবেন। সফরকালে প্রধানমন্ত্রী ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ ও প্রধানমন্ত্রী জ্যঁ ক্যাসটেক্স এর সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করবেন। ফরাসি প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বৈঠকালে বিভিন্ন বিষয়ে কয়েকটি সমঝোতা স্মারক ও লেটার অব ইনটেন্ট সই হওয়ার কথা রয়েছে বলে জানান তিনি। মোমেন বলেন, ‘সফরকালে বাংলাদেশ ও ফ্রান্সের মধ্যকার দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরও উচ্চতর পর্যায়ে নিয়ে যাবার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে বলে আশা করা যাচ্ছে।’ সাংবাদিকদের এক প্রশের জাবাবে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেন, এখানে একটি বিশেষ দিক থাকতে পারে হয়তো, সেটি হলো ইউরোপীয় ইউনিয়নের একটি প্রভাবশালী দেশ ফ্রান্স, ইইউতে কিছু পরিবর্তনের পরে বা নতুন করে এ জোট গঠিত হওয়ার পরে, ফ্রান্সে এটি প্রথম সফর।’

সফরকালে ফ্রান্সের অন্যান্য মন্ত্রী ও পার্লামেন্ট সদস্যদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর আনুষ্ঠানিক সাক্ষাতের প্রস্তাবও রয়েছে। ফ্রান্সের বেশ কিছু কোম্পানির প্রধানের পাশাপাশি ফরাসি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিনিধিত্বকারী শীর্ষস্থানীয় সংস্থা এমইডিইএফ-এর একটি প্রতিনিধিদল প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন। এছাড়া শেখ হাসিনা ১১ নভেম্বর ইউনেস্কো সদরদপ্তরে ‘ইউনেস্কো-বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ইন্টারন্যাশনাল প্রাইজ ইন দি ফিল্ড অব ক্রিয়েটিভ ইকোনমি’ প্রদান অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন। ওইদিন সাবেক ফরাসি বাণিজ্যমন্ত্রী ও বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সাবেক মহাপরিচালক প্যাসকেল ল্যামির আমন্ত্রণে প্যারিস পিস ফোরামের উচ্চ পর্যায়ের অধিবেশনে তিনি যোগ দেবেন।

১২ নভেম্বর ইউনেস্কোর ৭৫তম বার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে একটি উচ্চ পর্যায়ের সভায় অংশ নেয়ার আমন্ত্রণও রয়েছে তার। এসময় ইউনেস্কোর মহাপরিচালক অদ্রে আজুলের সঙ্গে একটি দ্বিপক্ষীয় বৈঠকও হবে প্রধানমন্ত্রীর। ফ্রান্সে প্রবাসী বাংলাদেশিদের সঙ্গে ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানেও তিনি যোগ দেবেন। শাহরিয়ার আলম বলেন, ‘প্যারিসে এনজেগমেন্টটা খুবই এক্সটেনসিভ। সেখানে তিনটি স্থানে প্রধানমন্ত্রীকে গার্ড অব অনার প্রদান করা হবে এবং এ সফরে প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে যথাযথ দ্বিপক্ষীয় বৈঠক হবে। ফ্রান্সের বেশ কিছু কোম্পানি যারা বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে, তাদের পণ্য বিক্রি করতে আগ্রহী এবং আমরাও সেখানে রপ্তানি বাড়াতে আগ্রহী।’

ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক ও বিনিয়োগ বাড়ানোর বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘ফ্রান্সে আমরা আগে যখন গিয়েছিলাম, সেখানে অনেক আকর্ষণ দেখা গিয়েছিল। ফ্রান্সের কয়েকটা কোম্পানি, তারা দুনিয়ার সব জায়গায় বিনিয়োগ করে। এটা হবে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক। ফ্রান্সে এখনও সরাসরি ফ্লাইট নাই। এভিয়েশনের সঙ্গে আলাপ করব, আশা করি আমরা পাব। আমাদের যে কমিউনিটি, তারাও অনেক দিন ধরে প্যারিসে সরাসরি ফ্লাইটের জন্য চেষ্টা করছে।’