ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে তাণ্ডব

পাঁচ বছরেও বিচার শুরু হয়নি

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে ফেইসবুকে আপত্তিকর ছবি পোস্ট দেয়াকে কেন্দ্র করে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মন্দিরে, বাড়িঘরে হামলা, ভাঙচুর লুট, অগ্নিসংযোগের ঘটনার দীর্ঘ পাঁচ বছরেও বিচার কাজ শুরু হয়নি। হামলার ঘটনায় দায়ের হওয়া আট মামলার মধ্যে সাত মামলারই তদন্ত কাজ শেষ করে আদালতে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) জমা দিতে পারেনি পুলিশ। ক্ষতিগ্রস্তদের দায়ের করা আটটি মামলায় অজ্ঞাত দুই হাজারেরও বেশি মানুষকে আসামি করা হয় এবং ভিডিও ফুটেজ ও ছবি দেখে পুলিশ একশ ২৫ জনকে গ্রেপ্তার করে। কিন্তু গ্রেপ্তারকৃতরা এখন জামিনে রয়েছে। আলোচিত এ ঘটনার চার্জশিট জমা না হওয়ায় পুলিশের গাফিলতি রয়েছে বলে অভিযোগ এবং বিচার নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন অনেকে।

তবে, সেখানে পরিস্থিতি এখন স্বাভাবিক। এ বছরে নাসিরনগরে বিভিন্ন মন্দিরে যথাযথভাবে ধুমধামে দুর্গাপূজাসহ বিভিন্ন পূজা-পার্বন অনুষ্ঠিত হয়েছে। সংঘটিত ঘটনায় প্রকৃত দোষীদের আইনের আওতায় এনে দ্রুত বিচারকাজ এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি এলাকাবাসীর।

২০১৬ সালের ২৭ অক্টোবর নাসিরনগরের হরিপুর ইউনিয়নের হরিণবেড় গ্রামের জগন্নাথ দাসের ছেলে রসরাজ দাসের ফেইসবুক আইডি ব্যবহার করে ধর্ম অবমাননা করে একটি পোস্ট দেয়া হয়। ওই পোস্টটি ছড়িয়ে পড়লে উত্তেজনা দেখা দেয়। পরে ২৯ অক্টোবর রসরাজকে আটক করে তার বিরুদ্ধে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) আইনে মামলা করে পুলিশ। রসরাজ তখন পুলিশের কাছে ওই পোস্ট করেননি বলে দাবি করেন। ৩০ অক্টোবর নাসিরনগর উপজেলা সদরে হিন্দু অধ্যুষিত কয়েকটি এলাকায় হামলা চালিয়ে অন্তত ১০টি মন্দির ও শতাধিক ঘরবাড়ি ভাঙচুর এবং লুটপাট করে দুষ্কৃতকারীরা। এ ঘটনার পর দুষ্কৃতকারীরা ফের ৪ নভেম্বর ও ১৩ নভেম্বর হিন্দুদের অন্তত ছয়টি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। পরিস্থিতি সামাল দিতে ব্যর্থ হওয়ায় নাসিরনগর উপজেলার তৎকালীন ইউএনও ও থানার ওসিকে প্রত্যাহার করা হয়। হামলার ঘটনায় পুলিশ ও ক্ষতিগ্রস্তদের দায়ের করা আটটি মামলায় অজ্ঞাত দুই হাজারেরও বেশি মানুষকে আসামি করা হয়। তখন হামলার ভিডিও ফুটেজ ও ছবি দেখে ১২৫ জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তবে গ্রেপ্তারকৃতরা সবাই এখন জামিনে।

এদিকে, ঘটনার ১৩ মাস পর ২০১৭ সালের ১১ ডিসেম্বর গৌরমন্দির ভাঙচুর মামলায় পুলিশ নাসিরনগর সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবুল হাশেম ও হরিপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান দেওয়ান আতিকুর রহমান আঁখিসহ ২২৮ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয়। তবে বাকি সাত মামলার তদন্ত কাজ শেষ করতে পারেনি পুলিশ। বিশিষ্টজনদের মতে, নাসিরনগরের ঘটনায় দোষীদের বিচার হচ্ছে না বলেই দেশের বিভিন্ন স্থানে একের পর এক সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা ঘটছে।

নাসিরনগর উপজেলা সদরের দত্তবাড়ি মন্দির ভাঙচুর মামলার বাদী কাজল জ্যোতি দত্ত বলেন, এ বিষয়ে তার কোন প্রতিক্রিয়া নেই। কারণ, এ নিয়ে এখন আর কেউ মাথা ঘামায় না। প্রথমদিকে পুলিশ যেভাবে তৎপর ছিল এবং মামলার বিষয়ে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখত, এখন সেটি হয় না বললেই চলে।

জেলা নাগরিক ফোরামের সভাপতি পীযূষ কান্তি আচার্য বলেন, বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণেই বার বার সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা ঘটছে। প্রতিটি সাম্প্রদায়িক হামলার বিচার মানবতাবিরোধী অপরাধের মতো বিশেষ ট্রাইব্যুনালে নিষ্পত্তি করা উচিত। অন্তত একটি সাম্প্রদায়িক ঘটনারও দৃষ্টান্তমূলক বিচার হলে এ ধরনের ঘটনা আর ঘটবে না বলে আমাদের বিশ্বাস।

এ ব্যাপারে নাসিরনগর গৌর মন্দির পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক নির্মল দাস বলেন, ঘটনার দ্রুত বিচারকাজ সম্পন্নের জোর দাবি জানাই।

নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র জানায়, ফরেনসিক বিভাগের প্রতিবেদনে রসরাজের মোবাইলে বিতর্কিত ছবিটি পাওয়া যায়নি। দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, কিছু দিনের মধ্যে বাকি মামলাগুলোর তদন্ত প্রতিবেদন দেয়া হবে। বিশেষ ট্রাইব্যুনালে বিচারকাজ হবে বলেও একটি সূত্র জানায়।

রসরাজের আইনজীবী নাসির মিয়া জানান, মামলার বিষয়ে পুলিশ প্রতিবেদন না পাওয়া পর্যন্ত রসরাজকে জামিন দিয়েছিলেন আদালত। কিন্তু, পুলিশ এখন পর্যন্ত আদালতে প্রতিবেদন জমা দিতে পারেনি। ফলে ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে রসরাজের জামিন মঞ্জুর করে আদালতের দেয়া আদেশ এখন বলবৎ আছে। পুলিশের প্রতিবেদন পাওয়ার পর মামলার কার্যক্রম আবার শুরু হবে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন ও অপরাধ) মোল্লা মোহাম্মদ শাহীন বলেন, মামলাগুলোর তদন্ত শেষ করে সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যেই আদালতে চার্জশিট জমা দিতে পারব বলে আশা করছি। প্রথম চার্জশিট হওয়া মামলাটিতে যাদের অভিযুক্ত করা হয়েছে, তাদের বাকি মামলাগুলোতেও অভিযুক্ত করে চার্জশিট দেয়া হবে।

তিনি আরও বলেন, রসরাজের মামলাটির তদন্ত কাজও শেষ পর্যায়ে। ফরেনসিক প্রতিবেদনের জন্য আদালতে প্রতিবেদন দিতে বিলম্ব হচ্ছিল। সম্প্রতি ফরেনসিক প্রতিবেদন পেয়েছি। এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বর্তমানে প্রশিক্ষণে আছেন। তিনি প্রশিক্ষণ শেষ করে এলেই এই মামলাটিও শেষ করতে পারব।

রবিবার, ৩১ অক্টোবর ২০২১ , ১৫ কার্তিক ১৪২৮ ২৩ রবিউল আউয়াল ১৪৪৩

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে তাণ্ডব

পাঁচ বছরেও বিচার শুরু হয়নি

আল আমীন শাহীন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া

image

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে ফেইসবুকে আপত্তিকর ছবি পোস্ট দেয়াকে কেন্দ্র করে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মন্দিরে, বাড়িঘরে হামলা, ভাঙচুর লুট, অগ্নিসংযোগের ঘটনার দীর্ঘ পাঁচ বছরেও বিচার কাজ শুরু হয়নি। হামলার ঘটনায় দায়ের হওয়া আট মামলার মধ্যে সাত মামলারই তদন্ত কাজ শেষ করে আদালতে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) জমা দিতে পারেনি পুলিশ। ক্ষতিগ্রস্তদের দায়ের করা আটটি মামলায় অজ্ঞাত দুই হাজারেরও বেশি মানুষকে আসামি করা হয় এবং ভিডিও ফুটেজ ও ছবি দেখে পুলিশ একশ ২৫ জনকে গ্রেপ্তার করে। কিন্তু গ্রেপ্তারকৃতরা এখন জামিনে রয়েছে। আলোচিত এ ঘটনার চার্জশিট জমা না হওয়ায় পুলিশের গাফিলতি রয়েছে বলে অভিযোগ এবং বিচার নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন অনেকে।

তবে, সেখানে পরিস্থিতি এখন স্বাভাবিক। এ বছরে নাসিরনগরে বিভিন্ন মন্দিরে যথাযথভাবে ধুমধামে দুর্গাপূজাসহ বিভিন্ন পূজা-পার্বন অনুষ্ঠিত হয়েছে। সংঘটিত ঘটনায় প্রকৃত দোষীদের আইনের আওতায় এনে দ্রুত বিচারকাজ এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি এলাকাবাসীর।

২০১৬ সালের ২৭ অক্টোবর নাসিরনগরের হরিপুর ইউনিয়নের হরিণবেড় গ্রামের জগন্নাথ দাসের ছেলে রসরাজ দাসের ফেইসবুক আইডি ব্যবহার করে ধর্ম অবমাননা করে একটি পোস্ট দেয়া হয়। ওই পোস্টটি ছড়িয়ে পড়লে উত্তেজনা দেখা দেয়। পরে ২৯ অক্টোবর রসরাজকে আটক করে তার বিরুদ্ধে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) আইনে মামলা করে পুলিশ। রসরাজ তখন পুলিশের কাছে ওই পোস্ট করেননি বলে দাবি করেন। ৩০ অক্টোবর নাসিরনগর উপজেলা সদরে হিন্দু অধ্যুষিত কয়েকটি এলাকায় হামলা চালিয়ে অন্তত ১০টি মন্দির ও শতাধিক ঘরবাড়ি ভাঙচুর এবং লুটপাট করে দুষ্কৃতকারীরা। এ ঘটনার পর দুষ্কৃতকারীরা ফের ৪ নভেম্বর ও ১৩ নভেম্বর হিন্দুদের অন্তত ছয়টি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। পরিস্থিতি সামাল দিতে ব্যর্থ হওয়ায় নাসিরনগর উপজেলার তৎকালীন ইউএনও ও থানার ওসিকে প্রত্যাহার করা হয়। হামলার ঘটনায় পুলিশ ও ক্ষতিগ্রস্তদের দায়ের করা আটটি মামলায় অজ্ঞাত দুই হাজারেরও বেশি মানুষকে আসামি করা হয়। তখন হামলার ভিডিও ফুটেজ ও ছবি দেখে ১২৫ জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তবে গ্রেপ্তারকৃতরা সবাই এখন জামিনে।

এদিকে, ঘটনার ১৩ মাস পর ২০১৭ সালের ১১ ডিসেম্বর গৌরমন্দির ভাঙচুর মামলায় পুলিশ নাসিরনগর সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবুল হাশেম ও হরিপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান দেওয়ান আতিকুর রহমান আঁখিসহ ২২৮ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয়। তবে বাকি সাত মামলার তদন্ত কাজ শেষ করতে পারেনি পুলিশ। বিশিষ্টজনদের মতে, নাসিরনগরের ঘটনায় দোষীদের বিচার হচ্ছে না বলেই দেশের বিভিন্ন স্থানে একের পর এক সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা ঘটছে।

নাসিরনগর উপজেলা সদরের দত্তবাড়ি মন্দির ভাঙচুর মামলার বাদী কাজল জ্যোতি দত্ত বলেন, এ বিষয়ে তার কোন প্রতিক্রিয়া নেই। কারণ, এ নিয়ে এখন আর কেউ মাথা ঘামায় না। প্রথমদিকে পুলিশ যেভাবে তৎপর ছিল এবং মামলার বিষয়ে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখত, এখন সেটি হয় না বললেই চলে।

জেলা নাগরিক ফোরামের সভাপতি পীযূষ কান্তি আচার্য বলেন, বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণেই বার বার সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা ঘটছে। প্রতিটি সাম্প্রদায়িক হামলার বিচার মানবতাবিরোধী অপরাধের মতো বিশেষ ট্রাইব্যুনালে নিষ্পত্তি করা উচিত। অন্তত একটি সাম্প্রদায়িক ঘটনারও দৃষ্টান্তমূলক বিচার হলে এ ধরনের ঘটনা আর ঘটবে না বলে আমাদের বিশ্বাস।

এ ব্যাপারে নাসিরনগর গৌর মন্দির পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক নির্মল দাস বলেন, ঘটনার দ্রুত বিচারকাজ সম্পন্নের জোর দাবি জানাই।

নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র জানায়, ফরেনসিক বিভাগের প্রতিবেদনে রসরাজের মোবাইলে বিতর্কিত ছবিটি পাওয়া যায়নি। দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, কিছু দিনের মধ্যে বাকি মামলাগুলোর তদন্ত প্রতিবেদন দেয়া হবে। বিশেষ ট্রাইব্যুনালে বিচারকাজ হবে বলেও একটি সূত্র জানায়।

রসরাজের আইনজীবী নাসির মিয়া জানান, মামলার বিষয়ে পুলিশ প্রতিবেদন না পাওয়া পর্যন্ত রসরাজকে জামিন দিয়েছিলেন আদালত। কিন্তু, পুলিশ এখন পর্যন্ত আদালতে প্রতিবেদন জমা দিতে পারেনি। ফলে ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে রসরাজের জামিন মঞ্জুর করে আদালতের দেয়া আদেশ এখন বলবৎ আছে। পুলিশের প্রতিবেদন পাওয়ার পর মামলার কার্যক্রম আবার শুরু হবে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন ও অপরাধ) মোল্লা মোহাম্মদ শাহীন বলেন, মামলাগুলোর তদন্ত শেষ করে সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যেই আদালতে চার্জশিট জমা দিতে পারব বলে আশা করছি। প্রথম চার্জশিট হওয়া মামলাটিতে যাদের অভিযুক্ত করা হয়েছে, তাদের বাকি মামলাগুলোতেও অভিযুক্ত করে চার্জশিট দেয়া হবে।

তিনি আরও বলেন, রসরাজের মামলাটির তদন্ত কাজও শেষ পর্যায়ে। ফরেনসিক প্রতিবেদনের জন্য আদালতে প্রতিবেদন দিতে বিলম্ব হচ্ছিল। সম্প্রতি ফরেনসিক প্রতিবেদন পেয়েছি। এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বর্তমানে প্রশিক্ষণে আছেন। তিনি প্রশিক্ষণ শেষ করে এলেই এই মামলাটিও শেষ করতে পারব।