বোধশূন্য মানুষ

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২১ আমার বড় ভাই মোহাম্মদ সাহাব উদ্দিন করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন; দাঁতের চিকিৎসা করাতে গিয়ে তিনি করোনায় আক্রান্ত হন। ফেনী জেলার জিএমহাট, নুরপুর গ্রামে তার জন্ম; আমাদের বাড়ির পাশে মাঠে জানাজা পড়ার জন্য কোন খালি জায়গা দেখলাম না, আশেপাশের সব উঁচু জমিতে বাড়ি আর বাড়ি। পাশের বাড়ির মসজিদের সম্মুখে সম্প্রতি একটি কওমি মাদ্রাসা গড়ে উঠেছে, বহুতলা বিশিষ্ট দুটি পাকা দালান, ওখানে একটি উন্মুক্ত জায়গা থাকায় ওখানে আমার বড় ভাইয়ের জানাজা হয়। জানাজা পড়ানোর পূর্বে মাদ্রাসার অধ্যক্ষ উল্লেখ করেন যে, ঢাকার যাত্রাবাড়ীর জামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলূম মাদানিয়া মাদ্রাসায় ৫/৬ জন হিন্দু ভর্তি হয়, পরবর্তীতে আচার-আচরণে সন্দেহ হওয়ায় ওদের জিজ্ঞাসা করে জানা যায়, ওদের ভারত থেকে পাঠানো হয়েছে সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রামে ভাঙচুর করে, আগুন লাগিয়ে মাদ্রাসার ছাত্রদের গায়ে কলঙ্ক লেপন করতে। এমন একটি ঘটনা কোন সাংবাদিক জানলো না, কোন পত্রিকায় খবর হলো না, কোন টিভি চ্যানেল খবর পরিবেশন করল নাÑঅথচ আমাদের কওমি মাদ্রাসার অধ্যক্ষ দৃঢ়তার সঙ্গে জানাজায় উপস্থিত শত শত জনকে তা জানিয়ে দিলেন।

আমাদের কওমি মাদ্রাসার অধ্যক্ষের কোন অপরাধ নেই; কারণ অনেক আজগুবি গল্প, নাটক, খবর তৈরি করে ফেসবুক এবং ইউটিউবে পোস্ট করা হচ্ছে। রাজনীতি ও ধর্মের বিষয়বস্তু-সংবলিত আজগুবি কল্পকাহিনীর ভিডিও ক্লিপ এখন দর্শক-শ্রোতাদের কাছে খুবই জনপ্রিয়। এসব ভিডিওর বেশিরভাগ ভিন্ন দেশ থেকে প্রচারিত হয়ে থাকে; ফলে সরকার এদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল আইনও প্রয়োগ করতে পারে না। নিজের লালিত মনোভাবের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হলে কিছু লোক এই সব বানানো গল্প কোন প্রশ্ন ছাড়াই গ্রহণও করছেন; অবশ্য কিছু লোক নিজস্ব মতাদর্শের প্রতি এত অন্ধ যে, এসব বানানো গল্প তাদের মনে কোন সংশয় সৃষ্টি করে না, বরং তাদের মনে আনন্দ আর উচ্ছ্বাসের ঢেউ তোলে। এমনসব অপকীর্তি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিশ্বস্থতা নষ্ট করছে। কিছু ভুয়া ফেসবুক একাউন্ট আছে যারা ফেসবুকে থাকেন না, শুধু ম্যাসেঞ্জারে বানানো ভিডিও ক্লিপ শেয়ার করে থাকেন।

শিশু বয়সে আমরা যখন মক্তবে পড়তাম তখন বলা হতো, একজন কোরআনে হাফেজ তার ১৪ গোষ্ঠীকে বেহেস্তে নিতে পারবেন। এ সম্পর্কে আলেম ড. মুহাম্মদ সাইফুল্লাহর মতে এ ধরনের কোনো সহি হাদিস নেই। তার মতে কোন হাফেজ তার পিতা-মাতাকেও বেহেস্তে নেয়ার অধিকার রাখেন না, পিতা-মাতার আমল না থাকলে হাফেজ পুত্রও তাদের বেহেস্তে নিতে পারবেন না। কারণ বেহেস্তে নেয়া কোন আবদারের বিষয় নয়। তবে কিয়ামতের দিন হাফেজকে বিশেষ মর্যাদা দেয়া হবে এবং হাফেজের পিতা-মাতাকেও সেদিন মর্যাদা দেয়া হবে যদি তারা আল্লাহর বাব্বুল আলামিনের কাছে মর্যাদার উপযুক্ত হন। কিন্তু আমাদের দেশের বেশিরভাগ নিরক্ষর ও কম শিক্ষিতরা এমন একটি ধারণা পোষণ করেন যে, সন্তানকে মাদ্রাসায় পড়ানো হলে, কোরআনে হাফেজ বানানো গেলে মা-বাবার বেহেস্ত নিশ্চিত। একটি নেহায়েত দুর্বল হাদিসে অবশ্য বলা হয়েছে যে, একজন কোরআনের হাফেজ তার গোষ্ঠীর ১০ জন জাহান্নামী ব্যক্তির জন্য সুপারিশ করতে পারবেন। কিন্ত খুবই দুর্বল হওয়ায় অধিকাংশ আলেম এই হাদিসটি অগ্রহণযোগ্য বলে মতামত দিয়েছেন। যারা হাদিসটি বর্ণনা করেছেন তাদের চারিত্রিক সততা ছিল না বলে অনেক আলেম উল্লেখ করেছেন।

আমাদের সমাজে হাফেজেরা বেশ সম্মানিত; সমাজে সম্মানিত হলেও তাদের স্থায়ী আয়ের ব্যবস্থা খুবই সীমিত। তারা কারো অনুরোধে কোরআন খতম করে, মিলাদ পড়িয়ে, খতম-তারাবি নামাজে ইমামতি করে যে আয় করেন তা খুবই সামান্য এবং এই সামান্য আয় নিয়েও তীব্র বিরোধিতা রয়েছে। কারণ ইসলামের দৃষ্টিতে কোরআন খতমের বিনিময়ে টাকা নেয়ার বিধান নেই। তাবলিগের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা ইলিয়াছ শাহ’র নাতি মাওলানা সাদ কান্ধলভীর মতে, কোরআন শিক্ষা দিয়ে যারা বেতন গ্রহণ করেন তাদের বেতন বেশ্যার উপার্জনের চেয়েও খারাপ। অবশ্য এ ব্যাপারে ভিন্ন মতও আছে; ভিন্নমত থাকার কারণেই দুই মতাবলম্বীর মারামারিতে টঙ্গিতে তাবলিগদের সমাবেশে একজন খুন হয়েছেন। তবে এটা ঠিক যে, কওমি মাদ্রাসায় যারা লেখাপড়া করেন তাদেরও সংসার আছে, পরিবার-পরিজন আছে, তাদেরও টাকার দরকার। বর্তমান সরকারের আমলে অবশ্য হাফেজদের গুরুত্ব বেড়েছে, কওমি মাদ্রাসার দাওরায়ে হাদিসকে মাস্টার্সের সমমর্যাদা দেয়া হয়েছে। দাওরায়ে হাদিসের মর্যাদা অনুযায়ী কর্মসংস্থানের দাবি আজ বা কাল উঠবেই, যার মহড়া ইতোমধ্যে শুরুও হয়েছে। যতদিন ক্ষমতায় যেতে পারছে না ততদিন এদের বেকারত্ব ঘুচানোর জন্য মডেল মসজিদ হচ্ছে, পাড়ায় পাড়ায় নতুন নতুন মাদ্রাসা, মসজিদ হচ্ছে।

শিক্ষা-ব্যবস্থায় রয়েছে হ-য-ব-র-ল অবস্থা। হাজার হাজার মাদ্রাসা রয়েছে এবং লক্ষ লক্ষ ছাত্রছাত্রী ওখানে পড়ছে। কিছু মাদ্রাসার শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে বিজ্ঞান শিক্ষার কোন সম্পর্ক নেই। এখানে চিকিৎসা বিদ্যা নেই, এখানে কোন প্রকৌশলীর সৃষ্টি হয় না। এখান থেকে পাস করা কোন ছাত্রকে রাস্তা বা পুল বানানোর কাজে লাগানো যাবে না, এরা ওষুধ বানাতে পারবে না, রোগ নির্ণয় করতে পারবে না, সার্জারি করতে পারবে না, বিদ্যুৎ তৈরি করতে জানবে না, গ্যাস উত্তোলন করতে পারবে না, মোবাইল তৈরি করা শিখবে না, এরা মাইক বা বৈদ্যুতিক পাখা নির্মাণে অজ্ঞ। তবে নিজেরা তাগুত বিজ্ঞান শিক্ষার সঙ্গে সম্পর্ক না রাখলেও বিজ্ঞানের সৃষ্ট পণ্যগুলোর ব্যবহারে তাদের কোন আপত্তি নেই। আফগানিস্তানে তালেবানেরা ক্ষমতায় আসায় কওমি মাদ্রাসার লোকজন বেশ উজ্জীবিত। কারণ তালেবান শিক্ষামন্ত্রী মৌলভি নুরুল্লাহ বিশ্ববাসীকে জোর গলায় শুনিয়ে দিয়েছেন যে, পিএইচডি ডিগ্রি বা মাস্টার্স ডিগ্রির কোন মূল্য নেই; তার কথা অনুযায়ী ক্ষমতায় থাকা মোল্লা এবং তালেবানদের কারো পিএইচডি, এমএ এমনকি হাইস্কুলের ডিগ্রি না থাকলেও তারাই সবার চেয়ে বড়। অথচ আমেরিকানদের চলে যাওয়ার পর বিমানবন্দরটি মেরামত করতেও তারা পারেনি, বিদেশ থেকে লোক আনতে হয়েছে।

ময়মনসিংহে একটি কওমি মাদ্রাসায় শিক্ষক নেত্রকোণার পূর্বধলা উপজেলার বাসিন্দা ওয়াসেক বিল্লাহ নোমানী বলেছেন, খেলাফত কায়েম হলে সব সাংবাদিককে জবাই করা হবে। এই হুমকি বিশ্বাসযোগ্য; সাপ্তাহিক ‘যায়যায়দিন’-এ শফিক রেহমান ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটিকে উদ্দেশ্য করে একবার লিখেছিলেন, ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি ধারালো অস্ত্র দিয়ে একটি কচু গাছও কাটতে পারবে না, কিন্তু তাদের বিপক্ষের ধর্মান্ধরা ভোঁতা ছুরি দিয়েই তাদের বিরোধী লোকদের বিনা দ্বিধায় জবাই করে ফেলবে। শিক্ষা-ব্যবস্থায় বিজ্ঞান প্রাধান্য না পেলে ভ্যাকসিনের জন্য ইহুদি-নাসারাদের ওপর আমৃত্যু নির্ভর করে থাকতে হবে। ড. আহমদ শরীফের কথার প্রতিধ্বনি করে আমাদের এই মর্মে সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে, পরকাল চাইলে ধর্ম শিক্ষার ওপর সমধিক গুরুত্ব দিতে হবে, আর ইহকালে টিকে থাকতে হলে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার অপরিহার্যতা মেনে নিতে হবে, বিপরীতধর্মী দুটি শিক্ষা চালু থাকলে ইহকাল এবং পরকাল দুটোই হারাতে হবে।

[লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক]

ahmedzeauddin0@gmail.com

রবিবার, ৩১ অক্টোবর ২০২১ , ১৫ কার্তিক ১৪২৮ ২৩ রবিউল আউয়াল ১৪৪৩

বোধশূন্য মানুষ

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২১ আমার বড় ভাই মোহাম্মদ সাহাব উদ্দিন করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন; দাঁতের চিকিৎসা করাতে গিয়ে তিনি করোনায় আক্রান্ত হন। ফেনী জেলার জিএমহাট, নুরপুর গ্রামে তার জন্ম; আমাদের বাড়ির পাশে মাঠে জানাজা পড়ার জন্য কোন খালি জায়গা দেখলাম না, আশেপাশের সব উঁচু জমিতে বাড়ি আর বাড়ি। পাশের বাড়ির মসজিদের সম্মুখে সম্প্রতি একটি কওমি মাদ্রাসা গড়ে উঠেছে, বহুতলা বিশিষ্ট দুটি পাকা দালান, ওখানে একটি উন্মুক্ত জায়গা থাকায় ওখানে আমার বড় ভাইয়ের জানাজা হয়। জানাজা পড়ানোর পূর্বে মাদ্রাসার অধ্যক্ষ উল্লেখ করেন যে, ঢাকার যাত্রাবাড়ীর জামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলূম মাদানিয়া মাদ্রাসায় ৫/৬ জন হিন্দু ভর্তি হয়, পরবর্তীতে আচার-আচরণে সন্দেহ হওয়ায় ওদের জিজ্ঞাসা করে জানা যায়, ওদের ভারত থেকে পাঠানো হয়েছে সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রামে ভাঙচুর করে, আগুন লাগিয়ে মাদ্রাসার ছাত্রদের গায়ে কলঙ্ক লেপন করতে। এমন একটি ঘটনা কোন সাংবাদিক জানলো না, কোন পত্রিকায় খবর হলো না, কোন টিভি চ্যানেল খবর পরিবেশন করল নাÑঅথচ আমাদের কওমি মাদ্রাসার অধ্যক্ষ দৃঢ়তার সঙ্গে জানাজায় উপস্থিত শত শত জনকে তা জানিয়ে দিলেন।

আমাদের কওমি মাদ্রাসার অধ্যক্ষের কোন অপরাধ নেই; কারণ অনেক আজগুবি গল্প, নাটক, খবর তৈরি করে ফেসবুক এবং ইউটিউবে পোস্ট করা হচ্ছে। রাজনীতি ও ধর্মের বিষয়বস্তু-সংবলিত আজগুবি কল্পকাহিনীর ভিডিও ক্লিপ এখন দর্শক-শ্রোতাদের কাছে খুবই জনপ্রিয়। এসব ভিডিওর বেশিরভাগ ভিন্ন দেশ থেকে প্রচারিত হয়ে থাকে; ফলে সরকার এদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল আইনও প্রয়োগ করতে পারে না। নিজের লালিত মনোভাবের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হলে কিছু লোক এই সব বানানো গল্প কোন প্রশ্ন ছাড়াই গ্রহণও করছেন; অবশ্য কিছু লোক নিজস্ব মতাদর্শের প্রতি এত অন্ধ যে, এসব বানানো গল্প তাদের মনে কোন সংশয় সৃষ্টি করে না, বরং তাদের মনে আনন্দ আর উচ্ছ্বাসের ঢেউ তোলে। এমনসব অপকীর্তি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিশ্বস্থতা নষ্ট করছে। কিছু ভুয়া ফেসবুক একাউন্ট আছে যারা ফেসবুকে থাকেন না, শুধু ম্যাসেঞ্জারে বানানো ভিডিও ক্লিপ শেয়ার করে থাকেন।

শিশু বয়সে আমরা যখন মক্তবে পড়তাম তখন বলা হতো, একজন কোরআনে হাফেজ তার ১৪ গোষ্ঠীকে বেহেস্তে নিতে পারবেন। এ সম্পর্কে আলেম ড. মুহাম্মদ সাইফুল্লাহর মতে এ ধরনের কোনো সহি হাদিস নেই। তার মতে কোন হাফেজ তার পিতা-মাতাকেও বেহেস্তে নেয়ার অধিকার রাখেন না, পিতা-মাতার আমল না থাকলে হাফেজ পুত্রও তাদের বেহেস্তে নিতে পারবেন না। কারণ বেহেস্তে নেয়া কোন আবদারের বিষয় নয়। তবে কিয়ামতের দিন হাফেজকে বিশেষ মর্যাদা দেয়া হবে এবং হাফেজের পিতা-মাতাকেও সেদিন মর্যাদা দেয়া হবে যদি তারা আল্লাহর বাব্বুল আলামিনের কাছে মর্যাদার উপযুক্ত হন। কিন্তু আমাদের দেশের বেশিরভাগ নিরক্ষর ও কম শিক্ষিতরা এমন একটি ধারণা পোষণ করেন যে, সন্তানকে মাদ্রাসায় পড়ানো হলে, কোরআনে হাফেজ বানানো গেলে মা-বাবার বেহেস্ত নিশ্চিত। একটি নেহায়েত দুর্বল হাদিসে অবশ্য বলা হয়েছে যে, একজন কোরআনের হাফেজ তার গোষ্ঠীর ১০ জন জাহান্নামী ব্যক্তির জন্য সুপারিশ করতে পারবেন। কিন্ত খুবই দুর্বল হওয়ায় অধিকাংশ আলেম এই হাদিসটি অগ্রহণযোগ্য বলে মতামত দিয়েছেন। যারা হাদিসটি বর্ণনা করেছেন তাদের চারিত্রিক সততা ছিল না বলে অনেক আলেম উল্লেখ করেছেন।

আমাদের সমাজে হাফেজেরা বেশ সম্মানিত; সমাজে সম্মানিত হলেও তাদের স্থায়ী আয়ের ব্যবস্থা খুবই সীমিত। তারা কারো অনুরোধে কোরআন খতম করে, মিলাদ পড়িয়ে, খতম-তারাবি নামাজে ইমামতি করে যে আয় করেন তা খুবই সামান্য এবং এই সামান্য আয় নিয়েও তীব্র বিরোধিতা রয়েছে। কারণ ইসলামের দৃষ্টিতে কোরআন খতমের বিনিময়ে টাকা নেয়ার বিধান নেই। তাবলিগের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা ইলিয়াছ শাহ’র নাতি মাওলানা সাদ কান্ধলভীর মতে, কোরআন শিক্ষা দিয়ে যারা বেতন গ্রহণ করেন তাদের বেতন বেশ্যার উপার্জনের চেয়েও খারাপ। অবশ্য এ ব্যাপারে ভিন্ন মতও আছে; ভিন্নমত থাকার কারণেই দুই মতাবলম্বীর মারামারিতে টঙ্গিতে তাবলিগদের সমাবেশে একজন খুন হয়েছেন। তবে এটা ঠিক যে, কওমি মাদ্রাসায় যারা লেখাপড়া করেন তাদেরও সংসার আছে, পরিবার-পরিজন আছে, তাদেরও টাকার দরকার। বর্তমান সরকারের আমলে অবশ্য হাফেজদের গুরুত্ব বেড়েছে, কওমি মাদ্রাসার দাওরায়ে হাদিসকে মাস্টার্সের সমমর্যাদা দেয়া হয়েছে। দাওরায়ে হাদিসের মর্যাদা অনুযায়ী কর্মসংস্থানের দাবি আজ বা কাল উঠবেই, যার মহড়া ইতোমধ্যে শুরুও হয়েছে। যতদিন ক্ষমতায় যেতে পারছে না ততদিন এদের বেকারত্ব ঘুচানোর জন্য মডেল মসজিদ হচ্ছে, পাড়ায় পাড়ায় নতুন নতুন মাদ্রাসা, মসজিদ হচ্ছে।

শিক্ষা-ব্যবস্থায় রয়েছে হ-য-ব-র-ল অবস্থা। হাজার হাজার মাদ্রাসা রয়েছে এবং লক্ষ লক্ষ ছাত্রছাত্রী ওখানে পড়ছে। কিছু মাদ্রাসার শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে বিজ্ঞান শিক্ষার কোন সম্পর্ক নেই। এখানে চিকিৎসা বিদ্যা নেই, এখানে কোন প্রকৌশলীর সৃষ্টি হয় না। এখান থেকে পাস করা কোন ছাত্রকে রাস্তা বা পুল বানানোর কাজে লাগানো যাবে না, এরা ওষুধ বানাতে পারবে না, রোগ নির্ণয় করতে পারবে না, সার্জারি করতে পারবে না, বিদ্যুৎ তৈরি করতে জানবে না, গ্যাস উত্তোলন করতে পারবে না, মোবাইল তৈরি করা শিখবে না, এরা মাইক বা বৈদ্যুতিক পাখা নির্মাণে অজ্ঞ। তবে নিজেরা তাগুত বিজ্ঞান শিক্ষার সঙ্গে সম্পর্ক না রাখলেও বিজ্ঞানের সৃষ্ট পণ্যগুলোর ব্যবহারে তাদের কোন আপত্তি নেই। আফগানিস্তানে তালেবানেরা ক্ষমতায় আসায় কওমি মাদ্রাসার লোকজন বেশ উজ্জীবিত। কারণ তালেবান শিক্ষামন্ত্রী মৌলভি নুরুল্লাহ বিশ্ববাসীকে জোর গলায় শুনিয়ে দিয়েছেন যে, পিএইচডি ডিগ্রি বা মাস্টার্স ডিগ্রির কোন মূল্য নেই; তার কথা অনুযায়ী ক্ষমতায় থাকা মোল্লা এবং তালেবানদের কারো পিএইচডি, এমএ এমনকি হাইস্কুলের ডিগ্রি না থাকলেও তারাই সবার চেয়ে বড়। অথচ আমেরিকানদের চলে যাওয়ার পর বিমানবন্দরটি মেরামত করতেও তারা পারেনি, বিদেশ থেকে লোক আনতে হয়েছে।

ময়মনসিংহে একটি কওমি মাদ্রাসায় শিক্ষক নেত্রকোণার পূর্বধলা উপজেলার বাসিন্দা ওয়াসেক বিল্লাহ নোমানী বলেছেন, খেলাফত কায়েম হলে সব সাংবাদিককে জবাই করা হবে। এই হুমকি বিশ্বাসযোগ্য; সাপ্তাহিক ‘যায়যায়দিন’-এ শফিক রেহমান ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটিকে উদ্দেশ্য করে একবার লিখেছিলেন, ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি ধারালো অস্ত্র দিয়ে একটি কচু গাছও কাটতে পারবে না, কিন্তু তাদের বিপক্ষের ধর্মান্ধরা ভোঁতা ছুরি দিয়েই তাদের বিরোধী লোকদের বিনা দ্বিধায় জবাই করে ফেলবে। শিক্ষা-ব্যবস্থায় বিজ্ঞান প্রাধান্য না পেলে ভ্যাকসিনের জন্য ইহুদি-নাসারাদের ওপর আমৃত্যু নির্ভর করে থাকতে হবে। ড. আহমদ শরীফের কথার প্রতিধ্বনি করে আমাদের এই মর্মে সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে, পরকাল চাইলে ধর্ম শিক্ষার ওপর সমধিক গুরুত্ব দিতে হবে, আর ইহকালে টিকে থাকতে হলে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার অপরিহার্যতা মেনে নিতে হবে, বিপরীতধর্মী দুটি শিক্ষা চালু থাকলে ইহকাল এবং পরকাল দুটোই হারাতে হবে।

[লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক]

ahmedzeauddin0@gmail.com