করোনাকালে শিশুদের শিখন ঘাটতি

সন্ধ্যা রানী সাহা

আমরা সাধারণত দুটি উদ্দেশ্যে পড়ি। এক পরীক্ষার জন্য, দুই জানার জন্য। পরীক্ষার জন্য পড়াকে বিদ্যালয়সমূহে প্রাধান্য দেয়া হয়। যদিও এই পড়ার ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের স্বাধীনতা নেই বললেই চলে। কারণ নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সিলেবাস শেষ করতে হয়... শিক্ষার্থীরা বুঝুক আর না বুঝুক। পড়ার ক্ষেত্রে যে শিশু স্বাধীন নয় সে স্বাধীনভাবে/মুক্তভাবে চিন্তা করতে শিখে না। সাহসী হওয়া তো দূরের কথা। বলতে গেলে শিশুর অভ্যন্তরীণ গুণাবলির বিকাশ ইত্যাদি নির্ভর করে শিশুর স্বাধীনভাবে/মুক্তভাবে পড়তে পারার উপরে। আরেক কথায় জানার জন্য পড়ার ওপর। অথচ এই সাধারণ সত্যটাকে পাশ কাটিয়ে পরীক্ষার উদ্দেশ্যে পড়ার জন্য আমাদের প্রাথমিক বিদ্যালয়সমূহে শিক্ষক এবং শিক্ষার্থী উভয়ই প্রাণপণে চেষ্টা করে থাকে।

পরীক্ষায় ফেল করা বিষয়টি শিক্ষক এবং শিক্ষার্থী উভয়ের জন্যই বিপজ্জনক। কাজেই পরীক্ষাকে সামনে রেখে শিশুদের দিয়ে সবকিছু মুখস্থ করিয়ে নেয়ার একটা প্রবণতা অনেক শিক্ষকদের মধ্যে বিরাজমান। তাই কোনো বিদ্যালয়ে ঢুকলেই দেখা যায় সব শ্রেণীতে শিশুরা শব্দ করে পড়ছে। এবং একই পড়া বারবার পড়ছে। তবে হঠাৎ করেই উক্ত অনুচ্ছেদের প্রথম ও শেষ অংশ বাদ দিয়ে পড়তে দিলেই শিক্ষার্থী আর পড়তে পারে না। যাহোক বিষয়টি সবার জন্য সত্যি নয়। যেসব শিক্ষার্থী বাড়ি থেকে পড়া শিখে আসে তারা বেশ পড়তে পারে। কেন এমনটি হচ্ছে? উত্তরে শিক্ষক পরিদর্শকদের হঠাৎ উপস্থিতিকে দোষারোপ করতে ছাড়েন না। বলতে দ্বিধাবোধ করেন না-

‘আপনাকে দেখে ও (শিক্ষার্থী) ভয় পেয়েছে তাই পারছে না। এমনিতে তো পারে’।

এগুলো ‘প্রাথমিক পর্যায়ে শিখন-শেখানো দুর্বলতা’ সমূহের প্রকৃষ্ট উদাহরণ। দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করণ ও নিরাময়মূলক সহায়তা প্রদানের উদ্দেশ্যেই তো শ্রেণীকক্ষের শিখন-শেখানো কার্যাবলি পরিবীক্ষণ করা হয়। মূল উদ্দেশ্য হলো শ্রেণীকক্ষের শিখন-শিখানোর কাজে সফলতা আনয়ন, নির্ধারিত পাঠের নির্দিষ্ট শিখনফল অর্জনে সব শিক্ষার্থীকে সমানভাবে শিক্ষক সহায়তা করতে পারছেন কি না- তা যাচাই করা। পাশাপাশি শিক্ষককে প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করা। বুঝতে হবে পরিদর্শকবৃন্দ বাঘ-ভাল্লুক নয় যে তাদের দেখে শিক্ষার্থীরা ভয় পেয়েছে বলা যায়। ১২/০৯/২০২১ তারিখে রি-ওপেনিংয়ের পর একটি বিদ্যালয় পরিদর্শনকালে দেখা যায় পঞ্চম শ্রেণীর ১০ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে সাতজন উপস্থিত। তাদের মধ্যে একজন মাত্র ভালোমতো বাংলা পড়তে পারে। ইংরেজি বইয়ের নির্ধারিত পাঠ যাচাই করতে গিয়ে দেখা গেল ওই একজনই মাত্র পড়তে পারল। তাকে বোর্ডে নিয়ে তার বাবার নাম ইংরেজিতে লিখতে বলায় সে লিখলো My father name is Liton.

শ্রেণী শিক্ষককে জিজ্ঞেস করলাম সে কি ঠিক লিখেছে? তিনি দৃঢ়ভাবে জবাব দিলেন “হ্যাঁ”। প্রধান শিক্ষককে বললাম শ্রেণী শিক্ষক কী শেখাচ্ছেন তা আপনি দেখেন কি না? তিনি জবাব দিলেন, “শ্রেণী শিক্ষকের জ্বর তাই ও রকম বলেছেন”। জবাবটি গ্রহণযোগ্য নয়। এহেন পরিস্থিতিতে Text বইটি মুখস্থ করানো থেকে বিরত থাকতে হয়। শিক্ষকগণকে শিশু পড়তে পারে কি না- তা যাচাই করতে হয়। করোনার ১৭ মাসে পড়ালেখার যথেষ্ট ক্ষতি হয়ে গেছে। আবার এ কথাও সত্যি যে শিক্ষকগণ অনলাইনে ক্লাস নিয়েছেন, মোবাইল ফোনে শিখিয়েছেন, বাড়ি বাড়ি গিয়ে শিক্ষার্থীদের দিক-নির্দেশনা দেয়ার চেষ্টা করেছেন। team visit, combined visit, surprise visit ইত্যাদি কার্যক্রমগুলোও বেশ জোরে-সোরেই চলমান। facebook তার প্রমাণ।

কিন্তু বাস্তবে সমস্যাগ্রস্ত (যাদের বাড়িতে পড়ানোর কোন ব্যবস্থা নেই) শিক্ষার্থীদের দুর্দশার তেমন সুরাহা হয়নি। এ পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে শুধু শিক্ষকবৃন্দ নয়, শিক্ষা পরিদর্শকদের আরও কিছু তৎপর হওয়ার দরকার আছে। অধিকাংশ শিক্ষকবৃন্দ সাধারণত তুলনামূলক ভালো শিক্ষার্থীদের দিকে বেশি মনযোগী। দুর্বল শিক্ষার্থীরা বরাবরই কিছুটা অবহেলার শিকার। পঞ্চম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের জন্য প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনীর আর মাত্র ২ মাস বাকি। এখনও অনেকেই সাবলীলভাবে পড়তে পারছে না। তৃতীয় শ্রেণীর এক শিক্ষার্থীকে কথোপকথনের একপর্যায়ে তার বাবার নাম বানান করতে বলায় সে কান্নায় ভেঙে পড়ল। পঞ্চম শ্রেণীর আরেক শিক্ষার্থীকে জিজ্ঞেস করলাম, “activity sheet এ ২/৩ রকমের লেখা কেন? কে লিখে দিয়েছে?” সেও কান্নাজুড়ে দিল। অর্থাৎ পড়ার মতোই হাতের লেখার অবস্থাও ভালো নয়। অথচ এই শিক্ষার্থীরাই উচ্চ বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবে। এখনকার শিখন-দুর্বলতা তখন তাদের ভেতরটাকে সব সময় block করে দিতে চাইবে। এ থেকে মুক্তির উপায় কী?

গণিত পড়াচ্ছেন এক শিক্ষক। অতি সাধারণ গাণিতিক বাক্য বোর্ডে বাংলায় লিখতে দিলে শিক্ষার্থী তা পারছে না। শিক্ষার্থীদের অধিকাংশই ১৪>৮ গাণিতিক বাক্যে লিখতে পারছে না। বাড়িতে যাদের শেখানোর ব্যবস্থা আছে তারা প্রায় সবাই পড়ালেখায় এগিয়ে আছে। তবে তাদের সংখ্যা বেশি নয়। আরেকটি বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণীর সাতজন শিক্ষার্থীর মধ্যে চারজন উপস্থিত পেয়েছি। পড়তে পেরেছে চারজনের মধ্যে একজন। ওই বিদ্যালয়ের কর্মরত শিক্ষক সংখ্যা পাঁচজন। অতএব শিক্ষক-স্বল্পতার দোষ এখানে খাটে না। তাছাড়া বর্তমানে করোনাকালে সীমিত আকারে শ্রেণীকাজ পরিচালিত হচ্ছে বিধায় শিক্ষক-স্বল্পতা তেমন নেই বললেই চলে। যে শিক্ষার্থী পড়তে পেরেছে তার বাড়িতে প্রাইভেট টিউটর আছে। শিক্ষকবৃন্দের এ বিষয়ে কি কোনো ব্যথা-বেদনা নেই?

শুনেছি একজন শিক্ষক ২০১৯ সালে জাতীয় কৃষি-পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। তিনি নাকি ৫৫,০০০ গাছের চারা বিতরণ করে এ কৃতিত্ব অর্জন করেছেন। শিক্ষকবৃন্দ এমন অনেক বিষয়েই দক্ষ। শুধু শ্রেণীকক্ষে নিজের আসল কাজটি (শিখন-শেখানো) অনেকে মনোযোগ দিয়ে করতে চান না। প্রশিক্ষণ গ্রহণ কালেও শিক্ষকরা তাদের দক্ষতার পরিচয় দিয়ে থাকেন। ICT তেও তাদের অনেকে ইতোমধ্যে প্রচুর দক্ষতা অর্জন করে ফেলেছেন। শুধু অর্থনৈতিক অবস্থা বা বাড়ির পরিবেশ নয়, অঞ্চলভেদেও শিশুদের অর্জিত শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন আছে। সাধারণত Forward এলাকার অভিভাবকরা শিক্ষিত এবং সচেতন। তাই তাদের সন্তানাদি পড়াশোনার ব্যাপারেও বেশ পারদর্শী হয়। ও সব জায়গায় বিদ্যালয় পরিদর্শনও ঘন ঘন হয়। তবে অভিভাবক গরিব হলে বা সচেতন না হলে কিংবা যাদের প্রাইভেট টিউটর নেই তারা শিখন-ফল অর্জনের দিক থেকে সাধারণত পিছিয়েই থাকে।

করোনা নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে তা প্রশংসার দাবি রাখে। সরকার অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শিক্ষক-কর্মচারীগণকে করোনার টিকা প্রদান করেছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার জন্য উপবৃত্তি করোনা মহামারীর মহাসংকটেও অব্যাহত রেখেছে। অধিকন্তু করোনাকালের বিশেষ উপহার হিসেবে শিশুদের জন্য করফং’ Kids’ allowance এর ব্যবস্থা করেছে। পরিমাণটা নেহায়েৎ কম নয়। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী প্রতি ১০০০ টাকা। বিদ্যালয় মেরামত কাজ, উন্নয়নকাজ, শিক্ষক-কর্মচারীর বেতনভাতাদি প্রদান ইত্যাদি অব্যাহত রেখেছে। শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় কৃমি-নিধন, ভিটামিন এ+ ক্যাম্পেইন, উপজেলার হাসপাতালের ইনডোর-আউটডোর-কমিউটি ক্লিনিকের সেবা, বিদ্যালয়ে wash block নির্মাণ, chool level improvement plan বাস্তবায়নের বরাদ্দ (শিক্ষার্থী অনুযায়ী প্রত্যেক বিদ্যালয়ের জন্য কমপক্ষে ৫০,০০০ টাকা এবং শিক্ষার্থী সংখ্যা ৬০ জন ছাত্রের বেশি হলে তার চেয়ে বেশি পরিমাণ টাকা) ইত্যাদি চলমান আছে। সুতরাং করোনাকালের এই স্বল্পতম শিক্ষাবর্ষে (সেপ্টেম্বর-ডিসেম্বর) লেখাপড়া করাটা শিশুদের কাছে যেন হাসি-আনন্দের বিষয়ে পরিণত হয় সেটাই শিক্ষকদের এখনকার ভাবনা হওয়া উচিত।

বর্তমানে মেয়ে শিশুদের লেখাপড়া নিয়ে সবাই বেশ আগ্রহী। ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে সব শিশুকে স্কুলে ভর্তির বিষয়ে শিক্ষকগণের চেয়ে অভিভাবকগণই বেশি তৎপর। সরকারের নানাবিধ প্রচেষ্টার ফলে এটা সম্ভব হয়েছে। নারীর ক্ষমতায়ন তার মধ্যে প্রধান। এখন এসব ভর্তিকৃত শিশুদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করা না গেলে ভবিষ্যতে দেশে এরা নানা সামাজিক সমস্যার কারণ হতে পারে। অথচ প্রাথমিক শিক্ষার জন্য নির্ধারিত প্রান্তিক যোগ্যতাসমূহ (২৯টি) শিশুদের অর্জন করানো গেলে শিশুরা যে সুনাগরিককে পরিণত হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এডুকেশন-ওয়াচের ২০১৫ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী মাত্র ১.৬% শিশু এই প্রান্তিক যোগ্যতাসমূহ অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। প্রদত্ত গাইড-লাইন অনুসরণে শিক্ষকদের অনীহাকেই প্রধান কারণ হিসাবে ওই রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে। এটি একটি ভয়ঙ্কর অন্যায়। কারণ পরবর্তী স্তরে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে শিক্ষার অর্জন কতটা হবে কিংবা হবে না তা এই প্রাথমিক শিক্ষার ওপরই নির্ভর করে।

QS (Quacquarelli symonds) World University Rankings 2021 থেকে দেখা যায় যে বিশে^র সেরা ১০টি বিশ^বিদ্যালয়ের (বিশ্বের নানা অঞ্চলের ১০০০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে) অবস্থান আমেরিকা এবং ইউরোপে। ঐ র‌্যাংকিংয়ের সেরা ৫০০ বিশ^বিদ্যালয়ের মধ্যে ভারত এবং পাকিস্তানের বিশ^বিদ্যালয় থাকলেও বাংলাদেশের কোন বিশ^বিদ্যালয় নেই। আমেরিকা এবং ইউরোপের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে শিক্ষা একটি সুদূর প্রসারি ভূমিকা পালন করে চলেছে। সরকারি উদ্যোগেই সেখানকার শিক্ষার উন্নয়ন ও প্রসারণ সম্ভব হয়েছে। তাহলে আমাদের কেন হবে না? আমাদের সরকারের দিক থেকে তো কোন ঘাটতি আছে বলে মনে হয় না।

পড়তে পারা, লিখতে পারা এবং হিসাব করতে পারা এই তিনটি সামর্থ্য একজন শিক্ষার্থীর জীবনের মান নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। আধুনিক বিশে্বর সঙ্গে ভাব বিনিময়ের জন্যও এই তিনটি সামর্থ্য ছাড়া সম্ভব নয়। আজকের দিনে নিরক্ষর থাকা আর বন্দি থাকা একই কথা। প্রাথমিক শিক্ষাই পারে মানুষের মুক্তির পথ খুলে দিতে।

শেষ কথা। বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষার লক্ষ্য, উদ্দেশ্য এবং প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনের ফলে অর্জনযোগ্য প্রান্তিক যোগ্যতাগুলোর চার্ট অফিস কক্ষে টানিয়ে রাখাই যথেষ্ট নয়। জনসাধারণকে তা অবহিত করতে হবে। সিটিজেনস চার্টার এর অন্তর্ভুক্ত করে তা দৃশ্যমান স্থানে রাখতে হবে। রাষ্ট্র যেভাবে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সুযোগ-সুবিধার প্রসার ঘটাচ্ছে তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে শিক্ষার গুণগত মানের উন্নয়ন ঘটাতে হবে। শিক্ষার অবনতির দায় কোনোভাবেই শুধু করোনা মহামারীর চাদর দিয়ে আড়াল করার চেষ্টা নয়। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সবার অধিকতর মনোযোগ আবশ্যক। সরকার দেশব্যাপী যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নসহ বহু চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। তবে এ মুহূর্তে মানসম্মত সার্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করার চেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ আর কী?

[লেখক : উপজেলা শিক্ষা অফিসার,

কামারখন্দ, সিরাজগঞ্জ]

রবিবার, ৩১ অক্টোবর ২০২১ , ১৫ কার্তিক ১৪২৮ ২৩ রবিউল আউয়াল ১৪৪৩

করোনাকালে শিশুদের শিখন ঘাটতি

সন্ধ্যা রানী সাহা

আমরা সাধারণত দুটি উদ্দেশ্যে পড়ি। এক পরীক্ষার জন্য, দুই জানার জন্য। পরীক্ষার জন্য পড়াকে বিদ্যালয়সমূহে প্রাধান্য দেয়া হয়। যদিও এই পড়ার ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের স্বাধীনতা নেই বললেই চলে। কারণ নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সিলেবাস শেষ করতে হয়... শিক্ষার্থীরা বুঝুক আর না বুঝুক। পড়ার ক্ষেত্রে যে শিশু স্বাধীন নয় সে স্বাধীনভাবে/মুক্তভাবে চিন্তা করতে শিখে না। সাহসী হওয়া তো দূরের কথা। বলতে গেলে শিশুর অভ্যন্তরীণ গুণাবলির বিকাশ ইত্যাদি নির্ভর করে শিশুর স্বাধীনভাবে/মুক্তভাবে পড়তে পারার উপরে। আরেক কথায় জানার জন্য পড়ার ওপর। অথচ এই সাধারণ সত্যটাকে পাশ কাটিয়ে পরীক্ষার উদ্দেশ্যে পড়ার জন্য আমাদের প্রাথমিক বিদ্যালয়সমূহে শিক্ষক এবং শিক্ষার্থী উভয়ই প্রাণপণে চেষ্টা করে থাকে।

পরীক্ষায় ফেল করা বিষয়টি শিক্ষক এবং শিক্ষার্থী উভয়ের জন্যই বিপজ্জনক। কাজেই পরীক্ষাকে সামনে রেখে শিশুদের দিয়ে সবকিছু মুখস্থ করিয়ে নেয়ার একটা প্রবণতা অনেক শিক্ষকদের মধ্যে বিরাজমান। তাই কোনো বিদ্যালয়ে ঢুকলেই দেখা যায় সব শ্রেণীতে শিশুরা শব্দ করে পড়ছে। এবং একই পড়া বারবার পড়ছে। তবে হঠাৎ করেই উক্ত অনুচ্ছেদের প্রথম ও শেষ অংশ বাদ দিয়ে পড়তে দিলেই শিক্ষার্থী আর পড়তে পারে না। যাহোক বিষয়টি সবার জন্য সত্যি নয়। যেসব শিক্ষার্থী বাড়ি থেকে পড়া শিখে আসে তারা বেশ পড়তে পারে। কেন এমনটি হচ্ছে? উত্তরে শিক্ষক পরিদর্শকদের হঠাৎ উপস্থিতিকে দোষারোপ করতে ছাড়েন না। বলতে দ্বিধাবোধ করেন না-

‘আপনাকে দেখে ও (শিক্ষার্থী) ভয় পেয়েছে তাই পারছে না। এমনিতে তো পারে’।

এগুলো ‘প্রাথমিক পর্যায়ে শিখন-শেখানো দুর্বলতা’ সমূহের প্রকৃষ্ট উদাহরণ। দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করণ ও নিরাময়মূলক সহায়তা প্রদানের উদ্দেশ্যেই তো শ্রেণীকক্ষের শিখন-শেখানো কার্যাবলি পরিবীক্ষণ করা হয়। মূল উদ্দেশ্য হলো শ্রেণীকক্ষের শিখন-শিখানোর কাজে সফলতা আনয়ন, নির্ধারিত পাঠের নির্দিষ্ট শিখনফল অর্জনে সব শিক্ষার্থীকে সমানভাবে শিক্ষক সহায়তা করতে পারছেন কি না- তা যাচাই করা। পাশাপাশি শিক্ষককে প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করা। বুঝতে হবে পরিদর্শকবৃন্দ বাঘ-ভাল্লুক নয় যে তাদের দেখে শিক্ষার্থীরা ভয় পেয়েছে বলা যায়। ১২/০৯/২০২১ তারিখে রি-ওপেনিংয়ের পর একটি বিদ্যালয় পরিদর্শনকালে দেখা যায় পঞ্চম শ্রেণীর ১০ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে সাতজন উপস্থিত। তাদের মধ্যে একজন মাত্র ভালোমতো বাংলা পড়তে পারে। ইংরেজি বইয়ের নির্ধারিত পাঠ যাচাই করতে গিয়ে দেখা গেল ওই একজনই মাত্র পড়তে পারল। তাকে বোর্ডে নিয়ে তার বাবার নাম ইংরেজিতে লিখতে বলায় সে লিখলো My father name is Liton.

শ্রেণী শিক্ষককে জিজ্ঞেস করলাম সে কি ঠিক লিখেছে? তিনি দৃঢ়ভাবে জবাব দিলেন “হ্যাঁ”। প্রধান শিক্ষককে বললাম শ্রেণী শিক্ষক কী শেখাচ্ছেন তা আপনি দেখেন কি না? তিনি জবাব দিলেন, “শ্রেণী শিক্ষকের জ্বর তাই ও রকম বলেছেন”। জবাবটি গ্রহণযোগ্য নয়। এহেন পরিস্থিতিতে Text বইটি মুখস্থ করানো থেকে বিরত থাকতে হয়। শিক্ষকগণকে শিশু পড়তে পারে কি না- তা যাচাই করতে হয়। করোনার ১৭ মাসে পড়ালেখার যথেষ্ট ক্ষতি হয়ে গেছে। আবার এ কথাও সত্যি যে শিক্ষকগণ অনলাইনে ক্লাস নিয়েছেন, মোবাইল ফোনে শিখিয়েছেন, বাড়ি বাড়ি গিয়ে শিক্ষার্থীদের দিক-নির্দেশনা দেয়ার চেষ্টা করেছেন। team visit, combined visit, surprise visit ইত্যাদি কার্যক্রমগুলোও বেশ জোরে-সোরেই চলমান। facebook তার প্রমাণ।

কিন্তু বাস্তবে সমস্যাগ্রস্ত (যাদের বাড়িতে পড়ানোর কোন ব্যবস্থা নেই) শিক্ষার্থীদের দুর্দশার তেমন সুরাহা হয়নি। এ পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে শুধু শিক্ষকবৃন্দ নয়, শিক্ষা পরিদর্শকদের আরও কিছু তৎপর হওয়ার দরকার আছে। অধিকাংশ শিক্ষকবৃন্দ সাধারণত তুলনামূলক ভালো শিক্ষার্থীদের দিকে বেশি মনযোগী। দুর্বল শিক্ষার্থীরা বরাবরই কিছুটা অবহেলার শিকার। পঞ্চম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের জন্য প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনীর আর মাত্র ২ মাস বাকি। এখনও অনেকেই সাবলীলভাবে পড়তে পারছে না। তৃতীয় শ্রেণীর এক শিক্ষার্থীকে কথোপকথনের একপর্যায়ে তার বাবার নাম বানান করতে বলায় সে কান্নায় ভেঙে পড়ল। পঞ্চম শ্রেণীর আরেক শিক্ষার্থীকে জিজ্ঞেস করলাম, “activity sheet এ ২/৩ রকমের লেখা কেন? কে লিখে দিয়েছে?” সেও কান্নাজুড়ে দিল। অর্থাৎ পড়ার মতোই হাতের লেখার অবস্থাও ভালো নয়। অথচ এই শিক্ষার্থীরাই উচ্চ বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবে। এখনকার শিখন-দুর্বলতা তখন তাদের ভেতরটাকে সব সময় block করে দিতে চাইবে। এ থেকে মুক্তির উপায় কী?

গণিত পড়াচ্ছেন এক শিক্ষক। অতি সাধারণ গাণিতিক বাক্য বোর্ডে বাংলায় লিখতে দিলে শিক্ষার্থী তা পারছে না। শিক্ষার্থীদের অধিকাংশই ১৪>৮ গাণিতিক বাক্যে লিখতে পারছে না। বাড়িতে যাদের শেখানোর ব্যবস্থা আছে তারা প্রায় সবাই পড়ালেখায় এগিয়ে আছে। তবে তাদের সংখ্যা বেশি নয়। আরেকটি বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণীর সাতজন শিক্ষার্থীর মধ্যে চারজন উপস্থিত পেয়েছি। পড়তে পেরেছে চারজনের মধ্যে একজন। ওই বিদ্যালয়ের কর্মরত শিক্ষক সংখ্যা পাঁচজন। অতএব শিক্ষক-স্বল্পতার দোষ এখানে খাটে না। তাছাড়া বর্তমানে করোনাকালে সীমিত আকারে শ্রেণীকাজ পরিচালিত হচ্ছে বিধায় শিক্ষক-স্বল্পতা তেমন নেই বললেই চলে। যে শিক্ষার্থী পড়তে পেরেছে তার বাড়িতে প্রাইভেট টিউটর আছে। শিক্ষকবৃন্দের এ বিষয়ে কি কোনো ব্যথা-বেদনা নেই?

শুনেছি একজন শিক্ষক ২০১৯ সালে জাতীয় কৃষি-পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। তিনি নাকি ৫৫,০০০ গাছের চারা বিতরণ করে এ কৃতিত্ব অর্জন করেছেন। শিক্ষকবৃন্দ এমন অনেক বিষয়েই দক্ষ। শুধু শ্রেণীকক্ষে নিজের আসল কাজটি (শিখন-শেখানো) অনেকে মনোযোগ দিয়ে করতে চান না। প্রশিক্ষণ গ্রহণ কালেও শিক্ষকরা তাদের দক্ষতার পরিচয় দিয়ে থাকেন। ICT তেও তাদের অনেকে ইতোমধ্যে প্রচুর দক্ষতা অর্জন করে ফেলেছেন। শুধু অর্থনৈতিক অবস্থা বা বাড়ির পরিবেশ নয়, অঞ্চলভেদেও শিশুদের অর্জিত শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন আছে। সাধারণত Forward এলাকার অভিভাবকরা শিক্ষিত এবং সচেতন। তাই তাদের সন্তানাদি পড়াশোনার ব্যাপারেও বেশ পারদর্শী হয়। ও সব জায়গায় বিদ্যালয় পরিদর্শনও ঘন ঘন হয়। তবে অভিভাবক গরিব হলে বা সচেতন না হলে কিংবা যাদের প্রাইভেট টিউটর নেই তারা শিখন-ফল অর্জনের দিক থেকে সাধারণত পিছিয়েই থাকে।

করোনা নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে তা প্রশংসার দাবি রাখে। সরকার অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শিক্ষক-কর্মচারীগণকে করোনার টিকা প্রদান করেছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার জন্য উপবৃত্তি করোনা মহামারীর মহাসংকটেও অব্যাহত রেখেছে। অধিকন্তু করোনাকালের বিশেষ উপহার হিসেবে শিশুদের জন্য করফং’ Kids’ allowance এর ব্যবস্থা করেছে। পরিমাণটা নেহায়েৎ কম নয়। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী প্রতি ১০০০ টাকা। বিদ্যালয় মেরামত কাজ, উন্নয়নকাজ, শিক্ষক-কর্মচারীর বেতনভাতাদি প্রদান ইত্যাদি অব্যাহত রেখেছে। শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় কৃমি-নিধন, ভিটামিন এ+ ক্যাম্পেইন, উপজেলার হাসপাতালের ইনডোর-আউটডোর-কমিউটি ক্লিনিকের সেবা, বিদ্যালয়ে wash block নির্মাণ, chool level improvement plan বাস্তবায়নের বরাদ্দ (শিক্ষার্থী অনুযায়ী প্রত্যেক বিদ্যালয়ের জন্য কমপক্ষে ৫০,০০০ টাকা এবং শিক্ষার্থী সংখ্যা ৬০ জন ছাত্রের বেশি হলে তার চেয়ে বেশি পরিমাণ টাকা) ইত্যাদি চলমান আছে। সুতরাং করোনাকালের এই স্বল্পতম শিক্ষাবর্ষে (সেপ্টেম্বর-ডিসেম্বর) লেখাপড়া করাটা শিশুদের কাছে যেন হাসি-আনন্দের বিষয়ে পরিণত হয় সেটাই শিক্ষকদের এখনকার ভাবনা হওয়া উচিত।

বর্তমানে মেয়ে শিশুদের লেখাপড়া নিয়ে সবাই বেশ আগ্রহী। ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে সব শিশুকে স্কুলে ভর্তির বিষয়ে শিক্ষকগণের চেয়ে অভিভাবকগণই বেশি তৎপর। সরকারের নানাবিধ প্রচেষ্টার ফলে এটা সম্ভব হয়েছে। নারীর ক্ষমতায়ন তার মধ্যে প্রধান। এখন এসব ভর্তিকৃত শিশুদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করা না গেলে ভবিষ্যতে দেশে এরা নানা সামাজিক সমস্যার কারণ হতে পারে। অথচ প্রাথমিক শিক্ষার জন্য নির্ধারিত প্রান্তিক যোগ্যতাসমূহ (২৯টি) শিশুদের অর্জন করানো গেলে শিশুরা যে সুনাগরিককে পরিণত হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এডুকেশন-ওয়াচের ২০১৫ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী মাত্র ১.৬% শিশু এই প্রান্তিক যোগ্যতাসমূহ অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। প্রদত্ত গাইড-লাইন অনুসরণে শিক্ষকদের অনীহাকেই প্রধান কারণ হিসাবে ওই রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে। এটি একটি ভয়ঙ্কর অন্যায়। কারণ পরবর্তী স্তরে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে শিক্ষার অর্জন কতটা হবে কিংবা হবে না তা এই প্রাথমিক শিক্ষার ওপরই নির্ভর করে।

QS (Quacquarelli symonds) World University Rankings 2021 থেকে দেখা যায় যে বিশে^র সেরা ১০টি বিশ^বিদ্যালয়ের (বিশ্বের নানা অঞ্চলের ১০০০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে) অবস্থান আমেরিকা এবং ইউরোপে। ঐ র‌্যাংকিংয়ের সেরা ৫০০ বিশ^বিদ্যালয়ের মধ্যে ভারত এবং পাকিস্তানের বিশ^বিদ্যালয় থাকলেও বাংলাদেশের কোন বিশ^বিদ্যালয় নেই। আমেরিকা এবং ইউরোপের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে শিক্ষা একটি সুদূর প্রসারি ভূমিকা পালন করে চলেছে। সরকারি উদ্যোগেই সেখানকার শিক্ষার উন্নয়ন ও প্রসারণ সম্ভব হয়েছে। তাহলে আমাদের কেন হবে না? আমাদের সরকারের দিক থেকে তো কোন ঘাটতি আছে বলে মনে হয় না।

পড়তে পারা, লিখতে পারা এবং হিসাব করতে পারা এই তিনটি সামর্থ্য একজন শিক্ষার্থীর জীবনের মান নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। আধুনিক বিশে্বর সঙ্গে ভাব বিনিময়ের জন্যও এই তিনটি সামর্থ্য ছাড়া সম্ভব নয়। আজকের দিনে নিরক্ষর থাকা আর বন্দি থাকা একই কথা। প্রাথমিক শিক্ষাই পারে মানুষের মুক্তির পথ খুলে দিতে।

শেষ কথা। বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষার লক্ষ্য, উদ্দেশ্য এবং প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনের ফলে অর্জনযোগ্য প্রান্তিক যোগ্যতাগুলোর চার্ট অফিস কক্ষে টানিয়ে রাখাই যথেষ্ট নয়। জনসাধারণকে তা অবহিত করতে হবে। সিটিজেনস চার্টার এর অন্তর্ভুক্ত করে তা দৃশ্যমান স্থানে রাখতে হবে। রাষ্ট্র যেভাবে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সুযোগ-সুবিধার প্রসার ঘটাচ্ছে তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে শিক্ষার গুণগত মানের উন্নয়ন ঘটাতে হবে। শিক্ষার অবনতির দায় কোনোভাবেই শুধু করোনা মহামারীর চাদর দিয়ে আড়াল করার চেষ্টা নয়। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সবার অধিকতর মনোযোগ আবশ্যক। সরকার দেশব্যাপী যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নসহ বহু চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। তবে এ মুহূর্তে মানসম্মত সার্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করার চেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ আর কী?

[লেখক : উপজেলা শিক্ষা অফিসার,

কামারখন্দ, সিরাজগঞ্জ]