সর্ষের মধ্যেই ভূত?

এমএ কবীর

একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মানুষের উৎসবের আনন্দ আতঙ্কে পরিণত হলো। মারা গেলেন বেশ কয়েকজন মানুষ। কারা মারা যাচ্ছেন, মারা যাচ্ছেন এই দেশের মানুষ। এই রাষ্ট্রের নাগরিক। যারা এই রাষ্ট্রকে নির্মাণ করেছেন নিজ নিরাপত্তার স্বার্থে। রাষ্ট্র গড়ে ওঠার পেছনে যা যা কাজ করে তার প্রধান অনুষঙ্গই হচ্ছে সেই ভূখ-ের মানুষের নিরাপত্তা। একটি নির্দিষ্ট ভূখ-কে রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করে মানুষ জানান দেয় এটি আমার দেশ। যখন এমন রাষ্ট্রের নাগরিক মারা যায়,তাদের ঘরবাড়িতে আগুন জ্বলে, লুট হয় সম্ভ্রম, সম্পদ; তখন সেই রাষ্ট্র নিজেই প্রশ্নের সমুখে দাঁড়ায়।

বাবরি মসজিদ ভাঙ্গা হলো, তখন সব দল, শুভ বুদ্ধির মানুষ এক হয়ে একসঙ্গে মাঠে নামেন, যার ফলে বাইরে থেকে আসা উসকানি ক্রিয়াশীল হতে পারেনি। কারণ দুষ্কৃতির চেয়ে ভালো মানুষেরা মাঠে ও পাশে ছিলেন। এবার তা দেখা গেল না। কেন যায়নি, তার যে ব্যাখ্যা নেই তা বলা যাবে না। বাবরি মসজিদের ঘটনায় সব রাজনৈতিক দল এক হয় রাষ্ট্রের নাগরিকের নিরাপত্তার তাগিদে। সঙ্গে ছিল ইসলামী দলগুলোও। এবার তারা আগেই মাঠ ছাড়া। তাদের মাঠে পাওয়া গেল না। কেন গেল না, কেন রুদ্ধদ্বার, সে প্রশ্নটাও রাজনৈতিক।

ভারতে নানা সময়ে নানা অঘটন ঘটে। গরুর গোশত রাখার অপরাধে মানুষ পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এ দেশে এর প্রতিক্রিয়া হয় না। আসামে মুসলমানদের হত্যা করা হয়, এর প্রতক্রিয়া হয় না। কিন্তু এবার কেন ঘটল। এখনই বা কেন ঘটল। রামু, নাসিরনগর, শাল্লার ঘটনা আমাদের বিস্মিত করে। কেন এ দেশের মানুষ এত অনুভূতি প্রবণ হয়ে উঠলো। কথায় কথায় অনুভূতিতে আঘাত বিষয়টি এখন কেন সাধারণ হয়ে উঠল? শুধু ধর্ম নয় নানা কারণে এখন আমাদের অনুভূতি আহত হয়। অনুভূতি আহত হওয়ার মামলার পরিমাণ দেখলেই তা বোঝা যায়। যারা আগে রাজনীতি করতেন, তারা হাসিমুখে সমালোচনা এমনকি গালিগালাজ শুনে যেতেন। প্রশ্ন করা হলে বলতেন, ‘রাজনীতি করতে গেলে গায়ের চামড়া পুরু হতে হয়। নেতাদের অনেক কিছুই সইতে হয়।’ কিন্তু এখন রাজনৈতিক নেতা কেন, টুটকা দোকান জাতীয় সংগঠনের নেতাদের গায়ের চামড়া মসলিন কাপড়ের মতন ফিনফিনে। একটুতেই তাদের অনুভূতি আহত হয়। এই আহত অনুভূতির ফলই হচ্ছে ভাঙা প্রতিমা, আগুনে পোড়া বাড়ি আর মানুষের লাশ।

কুমিল্লার পূজাম-পে কোরআন অবমাননার গুজব ছড়িয়ে দেশের কয়েকটি এলাকায় অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে। প্রতিমা ভাঙচুর হয়েছে। হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে ভীতি ছড়িয়ে পড়ায় শান্তিপূর্ণভাবে পূজা পালনে বিঘœ ঘটেছে। চাঁদপুরের হাজীগঞ্জে সহিংসতায় প্রাণহানির ঘটনাও ঘটেছে।

সারা দেশের স্থানীয় প্রশাসন কঠোর অবস্থান নেয়ায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যায়নি, তবে শঙ্কা দূর হয়েছে সেটাও বলা যাবে না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ‘কুমিল্লায় সন্দেহভাজন কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সারা দেশে বেশকিছু বিশৃঙ্খলাকারীকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গ্রেপ্তার অব্যাহত থাকবে। যেখানেই বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে, সেখানেই গ্রেপ্তার করা হবে।’ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সতর্ক এবং সচেতন থাকলে উসকানিদাতারা সুবিধা করতে পারবে না। কিন্তু কখনো কখনো সর্ষের মধ্যেই ভূত থাকে বলে সমস্যা দেখা দেয়। প্রধানমন্ত্রী হিন্দু সম্প্রদায়কে আশ^স্ত করে বলেছেন, ‘আপনারা নিজেদের ক্ষুদ্র সম্প্রদায় মনে করবেন কেন? এই মাটিতে আপনাদের জন্ম। সবাই নিজের অধিকারে বসবাস করবেন। এখানে নিজেদের কখনোই সংখ্যা দিয়ে বিচার না করাই ভালো। আমরা আপনাদের সংখ্যালঘু না, আপনজন হিসেবে মানি।’ প্রধানমন্ত্রী সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় তার দৃঢ় অবস্থানের কথা পুনর্ব্যক্ত করে বলেছেন, ‘কুমিল্লায় যে ঘটনা ঘটেছে তার তদন্ত হচ্ছে। ব্যাপকভাবেই তদন্ত হচ্ছে। অনেক তথ্যও আমরা পাচ্ছি। অবশ্যই এ ধরনের ঘটনা যারা ঘটাবে, তাদের আমরা খুঁজে বের করবই। তা আমরা করতে পারব। এখন প্রযুক্তির যুগ। বের করা যাবে। সে যে-ই হোক না কেন, যে ধর্মের হোক না কেন, তার বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা অবশ্যই নেয়া হবে।’ কাউকে ছাড় দেয়া হবে না উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘অপরাধীদের এমন শাস্তি দেয়া হবে, যাতে ভবিষ্যতে আর কেউ এমন করতে সাহস না পায়।’

তিনি যা বলেন তা যে করেন, তার অনেক দৃষ্টান্ত আছে। তবে তার সব নির্দেশ নিচের দিকে সব সময় যে যথাযথভাবে পালনে উদাসীনতা দেখা যায়, সে বিষয়টিও অনেকে মনে রাখেন। গুজব ছড়িয়ে সংখ্যালঘুদের ওপর বেশ কয়েক দফা হামলা হয়েছে। উপাসনালয়, প্রতিমা, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, বসতবাড়ি সবকিছুই আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হয়েছে। যেসব জায়গায় সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ হয়েছে, সেসব জায়গায় অপরাধীদের শাস্তির আওতায় আনলে হয়তো এবার দুর্গাপূজা নির্বিঘœ হতে পারত। কথায় কঠোরতা নয়, কাজে কঠোর অবস্থানের প্রতিফলন দেখলে মানুষের অস্বস্তি দূর হয়।

ল্যাবে পরিক্ষার পর সব রিপোর্ট যখন ভালো আসে, তখন ভিনদেশীরা খুশি হয়ে স্রষ্টাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, যাক, সবকিছু ফাইন। আর বাঙালিরা মুখ গোমরা করে বিলাপের মতো করে বলেন, খামোখাই এতগুলা টাকা নষ্ট করলাম! সবকিছুতে বিবেচনাবোধ থাকে মানুষের। যুদ্ধের সময়ও অস্ত্র ফেলে দেয়া সৈন্য ভাবতে পারে নিজেকে নিরাপদ, নির্বাচন থেকে সরে যাওয়া প্রতিদ্বন্দ্বী, কিংবা অভয়ারণ্যের প্রাণীও। তবে সাম্প্রদায়িকতার কোনো বিচার-বিবেচনা নেই, এতে কারও নিষ্কৃতি নেই। ধর্ম নিয়ে হানাহানি হলে নিরাপদ নয় কোনো মানুষ। এটা সবচেয়ে ভয়ঙ্কর, সবচেয়ে অমানবিক। নির্বিচার হামলায় আক্রান্ত, ভীতসন্ত্রস্ত বা মনঃক্ষুণœœ হয়েছে হিন্দুধর্মাবলম্বী মানুষ, আত্মমর্যাদাবোধে আঘাত তো বটেই। পূজাম-পে পবিত্র কোরআন শরিফ রাখার ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়েছে মুসলিম জনগোষ্ঠী। পুলিশের গুলিতে মারা গেছে তাদের চারজন, তাদের হামলায় অন্য ধর্মের একজন। এখন গণমামলার ভয় একদলের মনে, সেই দলের অব্যাহত আক্রমণের আতঙ্ক অন্য একদলের মনে। সবাই পরাজিত, ভীত। এই সবকিছুর মধ্যেও অন্য একটা পক্ষ আছে। আছে তাদের কুৎসিত আনন্দ আর অর্জন। তাদেরই কেউ পূজাম-পে পবিত্র কোরআন রেখেছে, কেউ ফেসবুকে গুজব ছড়িয়ে ধাপে ধাপে উত্তেজিত করেছে মানুষকে, কেউ এসব ঘটনায় রাজনীতির জাল ফেলেছে, কেউ কেউ হয়তো বৈষয়িক লাভের হিসাব করছে। এরা কেউ ক্ষতিগ্রস্ত নয়, এরা অসভ্যতম ঘটনার সুবিধাভোগী।

উন্নত দেশেও ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার ঘটনা ঘটে। তবে এমন ঘটনা ঘটলে তারা শুধু সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বা সেক্যুলারিজমের বাণী দিয়ে থেমে থাকে না। সাম্প্রদায়িক ঘটনার মধ্যে বিভিন্ন ধরনের ফৌজদারি অপরাধ থাকে, তারা সেগুলোর বিচার করেন। বিচার নিয়ে রাজনীতি হয় না, দাবি তুলতে হয় না, বিচার প্রক্রিয়ায় প্রভাব থাকে না। সব দেশে সম্প্রদায় আছে। শুধু ধর্ম আর জাতি নয়, ক্ষমতা আর বিত্তও আছে। ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার মতো প্রকট, বোধশক্তি লোপকারী এবং নিষ্ঠুর আর কিছুই হয় না। সেক্যুলারিজমের বাণীর চেয়ে আইনের শাসন, মানবাধিকার আর গণতন্ত্র সেখানে সাম্প্রদায়িকতা রুখতে কম ভূমিকা রাখে না। এখানে সাম্প্রদায়িকতার ঘটনা ঘটলে আমরা তা দেখি সংকীর্ণ চোখে, সংকীর্ণ স্বার্থেও। কেউ ধর্মের দোষ খুঁজি, কেউ সংবিধানের কথা বলি, আইনের শাসনের কথা বলি না। আবার কেউ কেউ বৈষম্যের ভিকটিম হিসেবে শুধু ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের দেখি, কেউ শুধু মুসলিমদের দেখি। কেউ গুলি খাওয়া, মামলার ভয়ে পালিয়ে বেড়ানো মানুষের প্রতি অবিচারের কথা বুঝি। বুঝি না দুই পক্ষই একই ঘটনার ভিকটিম। সব পক্ষপাতিত্বের ঊর্ধ্বে উঠে প্রকৃত ঘটনা উদ্ঘাটনে সোচ্চার আর ঐক্যবদ্ধ হই না কেউই।

শকুনের বাচ্চা বায়না ধরল, মানুষের মাংস খাওয়ার জন্য। শকুন বলল, ঠিক আছে, এনে দেব। শকুন উড়ে গিয়ে বাচ্চার জন্য শূকরের মাংস নিয়ে এলো। বাচ্চা বলল, এ তো শূকরের মাংস, আমি মানুষের মাংস খেতে চাই।’ শকুন বলল, ‘ঠিক আছে, এনে দেব।’ শকুন উড়ে গেল আর আসার সময় এক মরা গরুর মাংস নিয়ে এলো। বাচ্চা বলল, এ তো গরুর মাংস, আমি মানুষের মাংস চাই। এবার শকুন উড়ে গিয়ে শূকরের মাংস একটা মসজিদের পাশে আর গরুর মাংস একটা মন্দিরের পাশে ফেলে এলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই সেখানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় কয়েকশ’ মানুষের লাশ পড়ে গেল। শকুন তার বাচ্চাকে মানুষের মাংস খেতে নিয়ে গেল। বাচ্চা জিজ্ঞেস করল, এত মানুষের মাংস এখানে কি করে এলো?’ শকুন বলল, মানুষেরা এ রকমই। সৃষ্টিকর্তা মানুষকে সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে তৈরি করছেন। কিন্তু ধর্মের নামে এদের বাঘের থেকেও হিংস্র্র বানানো যেতে পারে। এদের একটা অংশ যখনই কোন অনিষ্ট করার চেষ্টায় ব্যর্থ হয় তখনই সহজ রাস্তা হিসেবে ধর্মকে ব্যবহার করে।’

[লেখক : সভাপতি, ঝিনাইদহ জেলা

রিপোর্টার্স ইউনিটি]

সোমবার, ০১ নভেম্বর ২০২১ , ১৬ কার্তিক ১৪২৮ ২৪ রবিউল আউয়াল ১৪৪৩

সর্ষের মধ্যেই ভূত?

এমএ কবীর

একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মানুষের উৎসবের আনন্দ আতঙ্কে পরিণত হলো। মারা গেলেন বেশ কয়েকজন মানুষ। কারা মারা যাচ্ছেন, মারা যাচ্ছেন এই দেশের মানুষ। এই রাষ্ট্রের নাগরিক। যারা এই রাষ্ট্রকে নির্মাণ করেছেন নিজ নিরাপত্তার স্বার্থে। রাষ্ট্র গড়ে ওঠার পেছনে যা যা কাজ করে তার প্রধান অনুষঙ্গই হচ্ছে সেই ভূখ-ের মানুষের নিরাপত্তা। একটি নির্দিষ্ট ভূখ-কে রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করে মানুষ জানান দেয় এটি আমার দেশ। যখন এমন রাষ্ট্রের নাগরিক মারা যায়,তাদের ঘরবাড়িতে আগুন জ্বলে, লুট হয় সম্ভ্রম, সম্পদ; তখন সেই রাষ্ট্র নিজেই প্রশ্নের সমুখে দাঁড়ায়।

বাবরি মসজিদ ভাঙ্গা হলো, তখন সব দল, শুভ বুদ্ধির মানুষ এক হয়ে একসঙ্গে মাঠে নামেন, যার ফলে বাইরে থেকে আসা উসকানি ক্রিয়াশীল হতে পারেনি। কারণ দুষ্কৃতির চেয়ে ভালো মানুষেরা মাঠে ও পাশে ছিলেন। এবার তা দেখা গেল না। কেন যায়নি, তার যে ব্যাখ্যা নেই তা বলা যাবে না। বাবরি মসজিদের ঘটনায় সব রাজনৈতিক দল এক হয় রাষ্ট্রের নাগরিকের নিরাপত্তার তাগিদে। সঙ্গে ছিল ইসলামী দলগুলোও। এবার তারা আগেই মাঠ ছাড়া। তাদের মাঠে পাওয়া গেল না। কেন গেল না, কেন রুদ্ধদ্বার, সে প্রশ্নটাও রাজনৈতিক।

ভারতে নানা সময়ে নানা অঘটন ঘটে। গরুর গোশত রাখার অপরাধে মানুষ পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এ দেশে এর প্রতিক্রিয়া হয় না। আসামে মুসলমানদের হত্যা করা হয়, এর প্রতক্রিয়া হয় না। কিন্তু এবার কেন ঘটল। এখনই বা কেন ঘটল। রামু, নাসিরনগর, শাল্লার ঘটনা আমাদের বিস্মিত করে। কেন এ দেশের মানুষ এত অনুভূতি প্রবণ হয়ে উঠলো। কথায় কথায় অনুভূতিতে আঘাত বিষয়টি এখন কেন সাধারণ হয়ে উঠল? শুধু ধর্ম নয় নানা কারণে এখন আমাদের অনুভূতি আহত হয়। অনুভূতি আহত হওয়ার মামলার পরিমাণ দেখলেই তা বোঝা যায়। যারা আগে রাজনীতি করতেন, তারা হাসিমুখে সমালোচনা এমনকি গালিগালাজ শুনে যেতেন। প্রশ্ন করা হলে বলতেন, ‘রাজনীতি করতে গেলে গায়ের চামড়া পুরু হতে হয়। নেতাদের অনেক কিছুই সইতে হয়।’ কিন্তু এখন রাজনৈতিক নেতা কেন, টুটকা দোকান জাতীয় সংগঠনের নেতাদের গায়ের চামড়া মসলিন কাপড়ের মতন ফিনফিনে। একটুতেই তাদের অনুভূতি আহত হয়। এই আহত অনুভূতির ফলই হচ্ছে ভাঙা প্রতিমা, আগুনে পোড়া বাড়ি আর মানুষের লাশ।

কুমিল্লার পূজাম-পে কোরআন অবমাননার গুজব ছড়িয়ে দেশের কয়েকটি এলাকায় অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে। প্রতিমা ভাঙচুর হয়েছে। হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে ভীতি ছড়িয়ে পড়ায় শান্তিপূর্ণভাবে পূজা পালনে বিঘœ ঘটেছে। চাঁদপুরের হাজীগঞ্জে সহিংসতায় প্রাণহানির ঘটনাও ঘটেছে।

সারা দেশের স্থানীয় প্রশাসন কঠোর অবস্থান নেয়ায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যায়নি, তবে শঙ্কা দূর হয়েছে সেটাও বলা যাবে না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ‘কুমিল্লায় সন্দেহভাজন কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সারা দেশে বেশকিছু বিশৃঙ্খলাকারীকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গ্রেপ্তার অব্যাহত থাকবে। যেখানেই বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে, সেখানেই গ্রেপ্তার করা হবে।’ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সতর্ক এবং সচেতন থাকলে উসকানিদাতারা সুবিধা করতে পারবে না। কিন্তু কখনো কখনো সর্ষের মধ্যেই ভূত থাকে বলে সমস্যা দেখা দেয়। প্রধানমন্ত্রী হিন্দু সম্প্রদায়কে আশ^স্ত করে বলেছেন, ‘আপনারা নিজেদের ক্ষুদ্র সম্প্রদায় মনে করবেন কেন? এই মাটিতে আপনাদের জন্ম। সবাই নিজের অধিকারে বসবাস করবেন। এখানে নিজেদের কখনোই সংখ্যা দিয়ে বিচার না করাই ভালো। আমরা আপনাদের সংখ্যালঘু না, আপনজন হিসেবে মানি।’ প্রধানমন্ত্রী সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় তার দৃঢ় অবস্থানের কথা পুনর্ব্যক্ত করে বলেছেন, ‘কুমিল্লায় যে ঘটনা ঘটেছে তার তদন্ত হচ্ছে। ব্যাপকভাবেই তদন্ত হচ্ছে। অনেক তথ্যও আমরা পাচ্ছি। অবশ্যই এ ধরনের ঘটনা যারা ঘটাবে, তাদের আমরা খুঁজে বের করবই। তা আমরা করতে পারব। এখন প্রযুক্তির যুগ। বের করা যাবে। সে যে-ই হোক না কেন, যে ধর্মের হোক না কেন, তার বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা অবশ্যই নেয়া হবে।’ কাউকে ছাড় দেয়া হবে না উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘অপরাধীদের এমন শাস্তি দেয়া হবে, যাতে ভবিষ্যতে আর কেউ এমন করতে সাহস না পায়।’

তিনি যা বলেন তা যে করেন, তার অনেক দৃষ্টান্ত আছে। তবে তার সব নির্দেশ নিচের দিকে সব সময় যে যথাযথভাবে পালনে উদাসীনতা দেখা যায়, সে বিষয়টিও অনেকে মনে রাখেন। গুজব ছড়িয়ে সংখ্যালঘুদের ওপর বেশ কয়েক দফা হামলা হয়েছে। উপাসনালয়, প্রতিমা, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, বসতবাড়ি সবকিছুই আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হয়েছে। যেসব জায়গায় সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ হয়েছে, সেসব জায়গায় অপরাধীদের শাস্তির আওতায় আনলে হয়তো এবার দুর্গাপূজা নির্বিঘœ হতে পারত। কথায় কঠোরতা নয়, কাজে কঠোর অবস্থানের প্রতিফলন দেখলে মানুষের অস্বস্তি দূর হয়।

ল্যাবে পরিক্ষার পর সব রিপোর্ট যখন ভালো আসে, তখন ভিনদেশীরা খুশি হয়ে স্রষ্টাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, যাক, সবকিছু ফাইন। আর বাঙালিরা মুখ গোমরা করে বিলাপের মতো করে বলেন, খামোখাই এতগুলা টাকা নষ্ট করলাম! সবকিছুতে বিবেচনাবোধ থাকে মানুষের। যুদ্ধের সময়ও অস্ত্র ফেলে দেয়া সৈন্য ভাবতে পারে নিজেকে নিরাপদ, নির্বাচন থেকে সরে যাওয়া প্রতিদ্বন্দ্বী, কিংবা অভয়ারণ্যের প্রাণীও। তবে সাম্প্রদায়িকতার কোনো বিচার-বিবেচনা নেই, এতে কারও নিষ্কৃতি নেই। ধর্ম নিয়ে হানাহানি হলে নিরাপদ নয় কোনো মানুষ। এটা সবচেয়ে ভয়ঙ্কর, সবচেয়ে অমানবিক। নির্বিচার হামলায় আক্রান্ত, ভীতসন্ত্রস্ত বা মনঃক্ষুণœœ হয়েছে হিন্দুধর্মাবলম্বী মানুষ, আত্মমর্যাদাবোধে আঘাত তো বটেই। পূজাম-পে পবিত্র কোরআন শরিফ রাখার ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়েছে মুসলিম জনগোষ্ঠী। পুলিশের গুলিতে মারা গেছে তাদের চারজন, তাদের হামলায় অন্য ধর্মের একজন। এখন গণমামলার ভয় একদলের মনে, সেই দলের অব্যাহত আক্রমণের আতঙ্ক অন্য একদলের মনে। সবাই পরাজিত, ভীত। এই সবকিছুর মধ্যেও অন্য একটা পক্ষ আছে। আছে তাদের কুৎসিত আনন্দ আর অর্জন। তাদেরই কেউ পূজাম-পে পবিত্র কোরআন রেখেছে, কেউ ফেসবুকে গুজব ছড়িয়ে ধাপে ধাপে উত্তেজিত করেছে মানুষকে, কেউ এসব ঘটনায় রাজনীতির জাল ফেলেছে, কেউ কেউ হয়তো বৈষয়িক লাভের হিসাব করছে। এরা কেউ ক্ষতিগ্রস্ত নয়, এরা অসভ্যতম ঘটনার সুবিধাভোগী।

উন্নত দেশেও ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার ঘটনা ঘটে। তবে এমন ঘটনা ঘটলে তারা শুধু সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বা সেক্যুলারিজমের বাণী দিয়ে থেমে থাকে না। সাম্প্রদায়িক ঘটনার মধ্যে বিভিন্ন ধরনের ফৌজদারি অপরাধ থাকে, তারা সেগুলোর বিচার করেন। বিচার নিয়ে রাজনীতি হয় না, দাবি তুলতে হয় না, বিচার প্রক্রিয়ায় প্রভাব থাকে না। সব দেশে সম্প্রদায় আছে। শুধু ধর্ম আর জাতি নয়, ক্ষমতা আর বিত্তও আছে। ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার মতো প্রকট, বোধশক্তি লোপকারী এবং নিষ্ঠুর আর কিছুই হয় না। সেক্যুলারিজমের বাণীর চেয়ে আইনের শাসন, মানবাধিকার আর গণতন্ত্র সেখানে সাম্প্রদায়িকতা রুখতে কম ভূমিকা রাখে না। এখানে সাম্প্রদায়িকতার ঘটনা ঘটলে আমরা তা দেখি সংকীর্ণ চোখে, সংকীর্ণ স্বার্থেও। কেউ ধর্মের দোষ খুঁজি, কেউ সংবিধানের কথা বলি, আইনের শাসনের কথা বলি না। আবার কেউ কেউ বৈষম্যের ভিকটিম হিসেবে শুধু ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের দেখি, কেউ শুধু মুসলিমদের দেখি। কেউ গুলি খাওয়া, মামলার ভয়ে পালিয়ে বেড়ানো মানুষের প্রতি অবিচারের কথা বুঝি। বুঝি না দুই পক্ষই একই ঘটনার ভিকটিম। সব পক্ষপাতিত্বের ঊর্ধ্বে উঠে প্রকৃত ঘটনা উদ্ঘাটনে সোচ্চার আর ঐক্যবদ্ধ হই না কেউই।

শকুনের বাচ্চা বায়না ধরল, মানুষের মাংস খাওয়ার জন্য। শকুন বলল, ঠিক আছে, এনে দেব। শকুন উড়ে গিয়ে বাচ্চার জন্য শূকরের মাংস নিয়ে এলো। বাচ্চা বলল, এ তো শূকরের মাংস, আমি মানুষের মাংস খেতে চাই।’ শকুন বলল, ‘ঠিক আছে, এনে দেব।’ শকুন উড়ে গেল আর আসার সময় এক মরা গরুর মাংস নিয়ে এলো। বাচ্চা বলল, এ তো গরুর মাংস, আমি মানুষের মাংস চাই। এবার শকুন উড়ে গিয়ে শূকরের মাংস একটা মসজিদের পাশে আর গরুর মাংস একটা মন্দিরের পাশে ফেলে এলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই সেখানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় কয়েকশ’ মানুষের লাশ পড়ে গেল। শকুন তার বাচ্চাকে মানুষের মাংস খেতে নিয়ে গেল। বাচ্চা জিজ্ঞেস করল, এত মানুষের মাংস এখানে কি করে এলো?’ শকুন বলল, মানুষেরা এ রকমই। সৃষ্টিকর্তা মানুষকে সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে তৈরি করছেন। কিন্তু ধর্মের নামে এদের বাঘের থেকেও হিংস্র্র বানানো যেতে পারে। এদের একটা অংশ যখনই কোন অনিষ্ট করার চেষ্টায় ব্যর্থ হয় তখনই সহজ রাস্তা হিসেবে ধর্মকে ব্যবহার করে।’

[লেখক : সভাপতি, ঝিনাইদহ জেলা

রিপোর্টার্স ইউনিটি]