জলবায়ু পরিবর্তন : চোখের সামনেই বদলে যাচ্ছে পৃথিবী

তীব্র তাপপ্রবাহ, প্রলয়ঙ্করী বন্যার মত দুর্যোগের ঘটনাগুলোই যে এখনকার আবহাওয়ার ‘নতুন স্বাভাবিকতা’ হয়ে উঠেছে, জলবায়ু সম্মেলনের সূচনায় সেটাই জানালো বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা-ডব্লিউএমও। গত রোববার জলবায়ু সম্মেলন স্কটল্যান্ডের গ�াসগোতে শুরু হয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নেতারা যোগ দিয়েছেন এ সম্মেলনে। জলবায়ু পরিবর্তন ও বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি নিয়ে নানা জনশ্রুতি রয়েছে। কেউ মনে করেন জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে আসলে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। কেউ মনে করেন স্বাভাবিক নিয়মেই বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়ে। কেউ আবার ভাবেন জনগণ ও বিভিন্ন দেশকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে এটি ক্ষমতাধরদের এক ধরনের চাল। এসব জনশ্রুতি ও প্রচলিত ধারণার কোনটা ঠিক, কোনটা ভুল তার বিশ্লেষণ তুলে ধরা হয়েছে এএফপিতে।

গতকাল ডব্লিউএমও এর প্রকাশিত ২০২১ সালের ‘দ্য স্টেট অব দ্য ক্লাইমেট রিপোটে’ দেখিয়েছে, কেমন করে চোখের সামনে বদলে যাচ্ছে এই পৃথিবী। ২০০২ সাল থেকে পরের ২০ বছরের গড় তাপমাত্রা হিসাব করে প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে, পৃথিবীর তাপমাত্রা এবারই প্রথম প্রাক শিল্পায়ন যুগের তুলনায় ১ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি বেড়ে যাওয়ার পথে রয়েছে। আর সমুদ্রপৃষ্ঠ ২০২১ সালে পৌঁছেছে নতুন উচ্চতায়।

বিবিসি বলেছে, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবেলায় বিশ্বনেতারা যখন স্কটল্যান্ডের গ�াসগোতে জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলনে মিলিত হচ্ছেন, তখনই এ প্রতিবেদন প্রকাশ করল ডব্লিউএমও। তাতে দেখা যাচ্ছে, বায়ুম-লে গ্রিনহাউজ গ্যাসের ঘনত্ব রেকর্ড পর্যায়ে পৌঁছানোয় ২০২১ সহ গত সাত বছরে পৃথিবীর তাপমাত্রা আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। এই বাড়তি তামপাত্রা পৃথিবীকে এক নতুন পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে জানিয়ে ডব্লিউএমওর অধ্যাপক পেত্তেরি তালাস বলেন, ‘আবহাওয়ার চরমভাবাপন্ন ঘটনাগুলোই এখন নতুন বাস্তবতা। মানুষের কর্মকা-ের কারণেই যে জলবায়ু বদলে যাচ্ছে, সে বিষয়ে বৈজ্ঞানিক তথ্য-প্রমাণ বাড়ছে।’

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে চলতি বছর পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষকে যে চরম আবহাওয়ার মুখোমুখি হতে হয়েছে, তার কিছু বিবরণ দিয়ে অধ্যাপক তালাস বলেন, মানুষ যখন থেকে রেকর্ড সংরক্ষণ শুরু করেছে তার মধ্যে এবারই প্রথম গ্রিনল্যান্ডের বরফ প্রান্তরে তুষারপাতের বদলে বৃষ্টি হয়েছে।কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের কিছু অংশ দিয়ে বয়ে যাওয়া তাপপ্রবাহের মধ্যে ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার এক গ্রামে তাপমাত্রা উঠে যায় প্রায় ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। যুক্তরাষ্ট্রে বয়ে যাওয়া এক তাপপ্রবাহের সময় ক্যালিফোর্নিয়ার ডেথ ভ্যালিতে তাপমাত্রা ৫৪.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছায়। চীনের একটি লঞ্চলে মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে এত বৃষ্টি হয়, যা আগের বছরগুলোতে কয়েক মাসেও হয়নি। ইউরোপের কিছু দেশ এবার বড় ধরনের বন্যার কবলে পড়ে, তাতে প্রাণ যায় শতাধিক মানুষের, আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ছাড়িয়ে যায় কয়েক বিলিয়ন ডলার। দক্ষিণ আমেরিকার ক্রান্তীয় অঞ্চলে টানা দ্বিতীয় বছরের মত খরা দেখা দেওয়ায় শুকিয়ে গেছে নদীর প্রবাহ। কৃষি, পরিবহন ও জ্বালানি উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে দারুণভাবে।

বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার গবেষণা বলছে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির যে তথ্য এবার তারা পেয়েছে, তা যথেষ্ট উদ্বেগজনক। ১৯৯৩ সালে মহাকাশ থেকে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে প্রথম যখন সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা মাপা হয়েছিল, তার তুলনায় ২০০২ সালে উচ্চতা বেড়ে যায় ২.১ মিলিমিটার। কিন্তু ২০১৩ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়েছে ৪.৪ মিলিমিটারের বেশি। উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে গলে যাচ্ছে মেরু অঞ্চল ও হিমবাহের বরফ, সেটাই সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা দ্রুত বাড়ার মূল কারণ। ব্রিস্টল গে�সিওলজি সেন্টারের পরিচালক অধ্যাপক জনাথন বম্বার বিবিসিকে বলেন, গত দুই শতকের মধ্যে এখনই সবচেয়ে দ্রুত বাড়ছে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা। এই ধারা যদি চলতে থাকে, তাহরে ২১০০ সালের মধ্যে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাবে ২ মিটার। তাতে বিশ্বের বিভিন্ন এলাকায় বাস্তুচ্যুত হবে ৬৩ কোটি মানুষ। সব মিলিয়ে তার যে ফল দাঁড়াবে, তা অকল্পনীয়।

বিবিসি বলেছে, তাপমাত্রার হিসাবে ২০২১ সাল হয়ত এ যাবৎকালের ষষ্ঠ বা সপ্তম উষ্ণতম বছর হিসেবে চিহ্নিত হবে। এর মূল কারণ ছিল বছরের শুরুর দিকে বয়ে যাওয়া ‘লা নিনা’। লা নিনার ফলে পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরের উপকূল বরাবর দক্ষিণ থেকে উত্তর দিকে স্বাভাবিকের চেয়ে শীতল সমুদ্র স্রোত বয়ে যায়। তাতে ওই অঞ্চলে উচ্চচাপের সৃষ্টি হয়, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও অস্ট্রেলিয়ার উত্তর অংশে বৃষ্টিপাত বাড়ে, দক্ষিণ আমেরিকার কিছু এলাকায় দেখা দেয় খরা।

লা নিনার প্রভাবে এ বছরের গড় তাপমাত্রা আগের কয়েক বছরের চেয়ে সামান্য কম থাকলেও গত ২০ বছরের গড় তাপমাত্রা এ বছরই প্রথমবারের মত প্রাক শিল্পায়ন যুগের চেয়ে ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে যাচ্ছে। উষ্ণতা বৃদ্ধির গতি কমিয়ে আনার কোনো উদ্যোগ যদি না নেওয়া হয়, তাহলে এই শতকের শেষে তা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি বেড়ে যেতে পারে। পরিস্থিতি সবচেয়ে খারাপ হলে বৈশ্বিক উষ্ণতা ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি বেড়ে যেতে পারে, যার ফল হবে ভয়ঙ্কর।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, বিপর্যয় এড়াতে হলে বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধির গতি কমিয়ে আনতে হবে। নিশ্চিত করতে হবে, যেন ২১০০ সাল পর্যন্ত সময়ে বৈশ্বিক উষ্ণতা প্রাক শিল্পায়ন যুগের চেয়ে ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি না বাড়ে।২০১৫ সালে ঐতিহাসিক প্যারিস চুক্তিতে রাষ্ট্রনেতারা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তাপমাত্রা বৃদ্ধি ওই পর্যায়ে আটকে রাখতে যা করা দরকার, তা তারা করবেন। ওই প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে হলে কার্বন গ্যাস নির্গমণের পরিমাণ কমিয়ে আনতে হবে। ২০৩০ সালের মধ্যে কোন দেশ কীভাবে কতটা কমাবে সেই পরিকল্পনা আসছে নভেম্বরে গ�াসগোতে বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন কপ-২৬ এ তাদের উপস্থাপন করার কথা।

কিছুটা উষ্ণতা বাড়া খারাপ নয়

বিশ্বের অনেকে দেশেই তীব্র শীত। এসব দেশে প্রচুর তুষারপাত হয়। এসব অঞ্চলের মানুষ মনে করে, বৈশ্বিক উষ্ণতা কিছুটা বাড়া খারাপ নয়। এ ধরনের ভ্রান্ত ধারণা তৈরির পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বড় ধরনের ভূমিকা রয়েছে। এ বছরের ২০ জানুয়ারি এক টুইটে ট্রাম্প বলেন, তীব্র শীত প্রমাণ করে, বৈশ্বিক উষ্ণতা বেড়ে যাওয়া আশঙ্কাজনক নয়। তীব্র শীতের কথা উল্লেখ করে ট্রাম্প সে সময় এমনও বলেন, বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়লেও তা উদ্বেগজনক নয়। বিজ্ঞানীরা বলছেন, বিভিন্ন সময়ে আবহাওয়ার গড় ওঠানামা অনুসারে জলবায়ু পরিবর্তন পরিমাপের মাপকাঠি। এক দিন অথবা এক সপ্তাহ তুষারপাত হলেই কয়েক দশক ধরে গড় উষ্ণতা বাড়েনি, এমনটা প্রমাণ হয় না।

বৈশ্বিক উষ্ণতা কিছুটা বাড়লে কী হতে পারে?

সাইবেরিয়ার কিছু অংশ চাষযোগ্য হতে পারে। খাদ্যের জোগান দিতে পারে। তবে উষ্ণতা বেড়ে যাওয়ার কারণে এসব অঞ্চলের বরফ গলে আরও বড় সংকট তৈরি হতে পারে। আইপিসিসির বিজ্ঞানীরা বলছেন, দুই ডিগ্রি তাপমাত্রা বাড়লেও সাগরের উচ্চতা আধা মিটার বা তারও বেশি বাড়তে পারে। এর প্রভাবে উপকূলবর্তী শহরগুলো ডুবেও যেতে পারে।

সর্বশেষ জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলছেন, এই পৃথিবীর জন্য, পৃথিবীর মানুষের জন্য এবারের জলবায়ু সম্মেলনকে অবশ্যই একটি ‘টার্নিং পয়েন্ট’ হতে হবে।

মঙ্গলবার, ০২ নভেম্বর ২০২১ , ১৭ কার্তিক ১৪২৮ ২৫ রবিউল আউয়াল ১৪৪৩

জলবায়ু পরিবর্তন : চোখের সামনেই বদলে যাচ্ছে পৃথিবী

image

তীব্র তাপপ্রবাহ, প্রলয়ঙ্করী বন্যার মত দুর্যোগের ঘটনাগুলোই যে এখনকার আবহাওয়ার ‘নতুন স্বাভাবিকতা’ হয়ে উঠেছে, জলবায়ু সম্মেলনের সূচনায় সেটাই জানালো বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা-ডব্লিউএমও। গত রোববার জলবায়ু সম্মেলন স্কটল্যান্ডের গ�াসগোতে শুরু হয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নেতারা যোগ দিয়েছেন এ সম্মেলনে। জলবায়ু পরিবর্তন ও বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি নিয়ে নানা জনশ্রুতি রয়েছে। কেউ মনে করেন জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে আসলে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। কেউ মনে করেন স্বাভাবিক নিয়মেই বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়ে। কেউ আবার ভাবেন জনগণ ও বিভিন্ন দেশকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে এটি ক্ষমতাধরদের এক ধরনের চাল। এসব জনশ্রুতি ও প্রচলিত ধারণার কোনটা ঠিক, কোনটা ভুল তার বিশ্লেষণ তুলে ধরা হয়েছে এএফপিতে।

গতকাল ডব্লিউএমও এর প্রকাশিত ২০২১ সালের ‘দ্য স্টেট অব দ্য ক্লাইমেট রিপোটে’ দেখিয়েছে, কেমন করে চোখের সামনে বদলে যাচ্ছে এই পৃথিবী। ২০০২ সাল থেকে পরের ২০ বছরের গড় তাপমাত্রা হিসাব করে প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে, পৃথিবীর তাপমাত্রা এবারই প্রথম প্রাক শিল্পায়ন যুগের তুলনায় ১ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি বেড়ে যাওয়ার পথে রয়েছে। আর সমুদ্রপৃষ্ঠ ২০২১ সালে পৌঁছেছে নতুন উচ্চতায়।

বিবিসি বলেছে, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবেলায় বিশ্বনেতারা যখন স্কটল্যান্ডের গ�াসগোতে জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলনে মিলিত হচ্ছেন, তখনই এ প্রতিবেদন প্রকাশ করল ডব্লিউএমও। তাতে দেখা যাচ্ছে, বায়ুম-লে গ্রিনহাউজ গ্যাসের ঘনত্ব রেকর্ড পর্যায়ে পৌঁছানোয় ২০২১ সহ গত সাত বছরে পৃথিবীর তাপমাত্রা আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। এই বাড়তি তামপাত্রা পৃথিবীকে এক নতুন পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে জানিয়ে ডব্লিউএমওর অধ্যাপক পেত্তেরি তালাস বলেন, ‘আবহাওয়ার চরমভাবাপন্ন ঘটনাগুলোই এখন নতুন বাস্তবতা। মানুষের কর্মকা-ের কারণেই যে জলবায়ু বদলে যাচ্ছে, সে বিষয়ে বৈজ্ঞানিক তথ্য-প্রমাণ বাড়ছে।’

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে চলতি বছর পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষকে যে চরম আবহাওয়ার মুখোমুখি হতে হয়েছে, তার কিছু বিবরণ দিয়ে অধ্যাপক তালাস বলেন, মানুষ যখন থেকে রেকর্ড সংরক্ষণ শুরু করেছে তার মধ্যে এবারই প্রথম গ্রিনল্যান্ডের বরফ প্রান্তরে তুষারপাতের বদলে বৃষ্টি হয়েছে।কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের কিছু অংশ দিয়ে বয়ে যাওয়া তাপপ্রবাহের মধ্যে ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার এক গ্রামে তাপমাত্রা উঠে যায় প্রায় ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। যুক্তরাষ্ট্রে বয়ে যাওয়া এক তাপপ্রবাহের সময় ক্যালিফোর্নিয়ার ডেথ ভ্যালিতে তাপমাত্রা ৫৪.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছায়। চীনের একটি লঞ্চলে মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে এত বৃষ্টি হয়, যা আগের বছরগুলোতে কয়েক মাসেও হয়নি। ইউরোপের কিছু দেশ এবার বড় ধরনের বন্যার কবলে পড়ে, তাতে প্রাণ যায় শতাধিক মানুষের, আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ছাড়িয়ে যায় কয়েক বিলিয়ন ডলার। দক্ষিণ আমেরিকার ক্রান্তীয় অঞ্চলে টানা দ্বিতীয় বছরের মত খরা দেখা দেওয়ায় শুকিয়ে গেছে নদীর প্রবাহ। কৃষি, পরিবহন ও জ্বালানি উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে দারুণভাবে।

বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার গবেষণা বলছে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির যে তথ্য এবার তারা পেয়েছে, তা যথেষ্ট উদ্বেগজনক। ১৯৯৩ সালে মহাকাশ থেকে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে প্রথম যখন সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা মাপা হয়েছিল, তার তুলনায় ২০০২ সালে উচ্চতা বেড়ে যায় ২.১ মিলিমিটার। কিন্তু ২০১৩ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়েছে ৪.৪ মিলিমিটারের বেশি। উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে গলে যাচ্ছে মেরু অঞ্চল ও হিমবাহের বরফ, সেটাই সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা দ্রুত বাড়ার মূল কারণ। ব্রিস্টল গে�সিওলজি সেন্টারের পরিচালক অধ্যাপক জনাথন বম্বার বিবিসিকে বলেন, গত দুই শতকের মধ্যে এখনই সবচেয়ে দ্রুত বাড়ছে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা। এই ধারা যদি চলতে থাকে, তাহরে ২১০০ সালের মধ্যে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাবে ২ মিটার। তাতে বিশ্বের বিভিন্ন এলাকায় বাস্তুচ্যুত হবে ৬৩ কোটি মানুষ। সব মিলিয়ে তার যে ফল দাঁড়াবে, তা অকল্পনীয়।

বিবিসি বলেছে, তাপমাত্রার হিসাবে ২০২১ সাল হয়ত এ যাবৎকালের ষষ্ঠ বা সপ্তম উষ্ণতম বছর হিসেবে চিহ্নিত হবে। এর মূল কারণ ছিল বছরের শুরুর দিকে বয়ে যাওয়া ‘লা নিনা’। লা নিনার ফলে পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরের উপকূল বরাবর দক্ষিণ থেকে উত্তর দিকে স্বাভাবিকের চেয়ে শীতল সমুদ্র স্রোত বয়ে যায়। তাতে ওই অঞ্চলে উচ্চচাপের সৃষ্টি হয়, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও অস্ট্রেলিয়ার উত্তর অংশে বৃষ্টিপাত বাড়ে, দক্ষিণ আমেরিকার কিছু এলাকায় দেখা দেয় খরা।

লা নিনার প্রভাবে এ বছরের গড় তাপমাত্রা আগের কয়েক বছরের চেয়ে সামান্য কম থাকলেও গত ২০ বছরের গড় তাপমাত্রা এ বছরই প্রথমবারের মত প্রাক শিল্পায়ন যুগের চেয়ে ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে যাচ্ছে। উষ্ণতা বৃদ্ধির গতি কমিয়ে আনার কোনো উদ্যোগ যদি না নেওয়া হয়, তাহলে এই শতকের শেষে তা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি বেড়ে যেতে পারে। পরিস্থিতি সবচেয়ে খারাপ হলে বৈশ্বিক উষ্ণতা ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি বেড়ে যেতে পারে, যার ফল হবে ভয়ঙ্কর।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, বিপর্যয় এড়াতে হলে বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধির গতি কমিয়ে আনতে হবে। নিশ্চিত করতে হবে, যেন ২১০০ সাল পর্যন্ত সময়ে বৈশ্বিক উষ্ণতা প্রাক শিল্পায়ন যুগের চেয়ে ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি না বাড়ে।২০১৫ সালে ঐতিহাসিক প্যারিস চুক্তিতে রাষ্ট্রনেতারা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তাপমাত্রা বৃদ্ধি ওই পর্যায়ে আটকে রাখতে যা করা দরকার, তা তারা করবেন। ওই প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে হলে কার্বন গ্যাস নির্গমণের পরিমাণ কমিয়ে আনতে হবে। ২০৩০ সালের মধ্যে কোন দেশ কীভাবে কতটা কমাবে সেই পরিকল্পনা আসছে নভেম্বরে গ�াসগোতে বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন কপ-২৬ এ তাদের উপস্থাপন করার কথা।

কিছুটা উষ্ণতা বাড়া খারাপ নয়

বিশ্বের অনেকে দেশেই তীব্র শীত। এসব দেশে প্রচুর তুষারপাত হয়। এসব অঞ্চলের মানুষ মনে করে, বৈশ্বিক উষ্ণতা কিছুটা বাড়া খারাপ নয়। এ ধরনের ভ্রান্ত ধারণা তৈরির পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বড় ধরনের ভূমিকা রয়েছে। এ বছরের ২০ জানুয়ারি এক টুইটে ট্রাম্প বলেন, তীব্র শীত প্রমাণ করে, বৈশ্বিক উষ্ণতা বেড়ে যাওয়া আশঙ্কাজনক নয়। তীব্র শীতের কথা উল্লেখ করে ট্রাম্প সে সময় এমনও বলেন, বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়লেও তা উদ্বেগজনক নয়। বিজ্ঞানীরা বলছেন, বিভিন্ন সময়ে আবহাওয়ার গড় ওঠানামা অনুসারে জলবায়ু পরিবর্তন পরিমাপের মাপকাঠি। এক দিন অথবা এক সপ্তাহ তুষারপাত হলেই কয়েক দশক ধরে গড় উষ্ণতা বাড়েনি, এমনটা প্রমাণ হয় না।

বৈশ্বিক উষ্ণতা কিছুটা বাড়লে কী হতে পারে?

সাইবেরিয়ার কিছু অংশ চাষযোগ্য হতে পারে। খাদ্যের জোগান দিতে পারে। তবে উষ্ণতা বেড়ে যাওয়ার কারণে এসব অঞ্চলের বরফ গলে আরও বড় সংকট তৈরি হতে পারে। আইপিসিসির বিজ্ঞানীরা বলছেন, দুই ডিগ্রি তাপমাত্রা বাড়লেও সাগরের উচ্চতা আধা মিটার বা তারও বেশি বাড়তে পারে। এর প্রভাবে উপকূলবর্তী শহরগুলো ডুবেও যেতে পারে।

সর্বশেষ জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলছেন, এই পৃথিবীর জন্য, পৃথিবীর মানুষের জন্য এবারের জলবায়ু সম্মেলনকে অবশ্যই একটি ‘টার্নিং পয়েন্ট’ হতে হবে।