স্বাধীনতার প্রথম গণনাট্য ‘এক নদী রক্ত’ ও শেখ কামাল

মোস্তাফা জব্বার

দুই

শেখ কামাল ও ছাত্রলীগ কর্মীদের অভিনীত ‘এক নদী রক্ত’ ছিল সরাসরি গণজাগরণের নাটক। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে চারণ গায়ক মুকুন্দরাম দাস এবং বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের গান, পঞ্চাশের মন্বন্তরে জয়নুলের ছবি আর একাত্তরের এক নদী রক্ত নাটকের মধ্যে একটি গুণগত মিল খুঁজে পাওয়া যায়। মিলটি হচ্ছে গণসম্পৃক্তির। নিপীড়িত ও ভাগ্যবঞ্চিত মানুষের আবেগ ও আকাক্সক্ষাকে মানুষের ভেতর থেকেই আবিষ্কার করা, জাগিয়ে তোলা। এই জাগিয়ে তোলার কাজটি সেদিন এক নদী রক্ত খুব সার্থকভাবেই করতে পেরেছিল। নাটক শেষে ইচ্ছে করলে তখনই কয়েক হাজার ছাত্র-জনতার মিছিল নিয়ে বেরিয়ে পরা যেত, এ কথা জোরের সঙ্গেই বলা যায়।” আমরা সেই সময়ে রাজপথে যেমন সেøাগান দিই তেমনি সাহিত্য চর্চা করি, নাটক করি। নাটকের জন্য প্রখ্যাত নাট্যকার আশকার ইবনে শাইখের সাত রং নাট্যগোষ্ঠীতে শেখ কামালসহ আমরা ছাত্রলীগের কর্মীরা যুক্ত হই। তারপর আমরাই আশকার ইবনে শাইখকে সামনে রেখে গড়ে তুলি নাট্য একাডেমি। নাট্য একাডেমির সঙ্গে শেখ কামালের যুক্ত হবার বিষয়ে মুহম্মদ জালাল লিখেছেন, “নাট্য একাডেমীতে আমরা ক’জন ছিলাম সার্বক্ষণিক। আমাদের নিয়েই স্যার গড়ে তুলেছিলেন এ দেশের নাট্যাভিনয়, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের প্রথম প্রতিষ্ঠান নাট্য একাডেমী। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের জ্যেষ্ঠপুত্র (দ্বিতীয় সন্তান) শেখ কামাল একাত্তরের ১৭ জানুয়ারী ৭১ এ নাট্য একাডেমিতে ভর্তি হয় এবং আমাদের সঙ্গে সাধারণ রিহার্সেলে অংশগ্রহণ করতে থাকে। শেখ কামাল এর আগে তিন বছর সেতার বাদন শিখেছে। নাটকের রিহার্সেলেও বোঝা যাচ্ছিল ওর অভিনয় প্রতিভা আছে। চর্চা অব্যাহত রাখলে অভিনয়েও ভালো করবে। স্যার নিজেও শেখ কামালের রিহার্সেলে সন্তুষ্ট ছিলেন।”

আমাদের নিজেদের কাছে এটি বিস্ময়কর ছিল দেশের জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতা, পাকিস্তানের সম্ভাব্য প্রধানমন্ত্রীর পুত্র বা বাংলার মুকুটহীন রাজার ছেলে একজন অতি সাধারণ মানুষ হিসেবে নাটকের রিহার্সাল দিতে আসছে। অভিনয় শিখছে এবং নাটকে অংশ নেবার আগ্রহ দেখাচ্ছে। নাট্য একাডেমির পরিচালক আশকার ইবনে শাইখ যদিও আমাদের রাজনৈতিক ধারণার লোক ছিলেন না তবুও আমরা ছাত্রলীগের ছেলেরাই তাকে ঘিরে রেখেছিলাম। শেখ কামাল যোগ দেয়াতে আমরা আরও শক্তিশালী হলাম। এক সময়ে স্যার আমাদের ফেব্রুয়ারিতে একটি পরীক্ষামূলক নাটক করার পরামর্শ দিলেন। আমরা চাইলাম নাটকটি শহীদ দিবসে হবে এবং যেহেতু ডাকসু ছাত্রলীগের দখলে সেহেতু আমরা ডাকসুর ব্যানারে নাটকটা করব। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন সংস্কৃতি মানে ছাত্র ইউনিয়ন আর মিছিল-লড়াই মানে ছাত্রলীগ। আমরা সংস্কৃতিকে গণসংস্কৃতিতে পরিণত করার ভাবনা থেকে কাজ করছিলাম। মুহম্মদ জালাল লিখেছেন, “হঠাৎ একদিন, ফেব্রুয়ারির ১০/১২ তারিখে, রব ভাই নিজেই স্যারের বাসায় এলেন এবং বললেন, “স্যার, আপনি যে একটি নাটকের কথা বলেছিলেন, ডাকসুর জন্য ওই নাটকটি আমরা চাই। আপনাকে স্যার করে দিতেই হবে।” স্যার বললেন, “তা এত অল্প সময়ে ওই নাটকটি কি করে করা যাবে বাবা, নাটক তো এখনও পর্যন্ত লেখাই হয়নি।” রব ভাইও জিদ ধরে বসলেন, “আমি কিছুই জানি না। আপনি স্যার পারবেন। কিরে আফতাব।” আফতাব ভাই স্যারের দিকে তাকিয়ে রইলেন, স্যার কি বলেন। শেষ পর্যন্ত স্যার বললেন, “ঠিক আছে, চেষ্টা করে দেখা যাক।” আমাদের সবার ওপর স্যারের মোটামুটি আস্থা ছিল। ইতোমধ্যেই স্যারের পরিচালনায় কয়েকটি নাটক করেছি আমরা। রব ভাই চলে যাওয়ার পর স্যার আমাদের নিয়ে বসলেন এবং তার পরিকল্পিত নাটকের ঘটনা প্রবাহ, দৃশ্য পরিকল্পনা এবং দৃশ্য বিভাজনসহ নাটকের পুরো কাঠামোটি তুলে ধরলেন। সবাই আমরা চমৎকৃত হলাম। স্যার মোস্তাফাকে বললেন, “তুমি এখন এর নাট্যরূপ দেবে এবং সংলাপগুলো বসিয়ে দেবে।” আফতাব ভাইকে বললেন, “তুমিই এ নাটকটি পরিচালনা করবে। কাজেই, মোস্তাফা, তুমি আফতাবের সঙ্গে পরামর্শ করে সংলাপগুলো চূড়ান্ত করবে।” এ ব্যাপারে আমাদের সবাইকে স্যার সর্বাত্মক নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করার জন্য বললেন, “বুঝতেই পারছো, তোমরা এতদিন যে ধরনের নাটক করে এসেছো, সে সব নাটকের সঙ্গে এ নাটকের কোনো মিল নেই। মঞ্চের ওপর ছাত্র-পুলিশ সংঘর্ষ। স্যার হাসতে হাসতে বললেন, “তোমাদের সবারই অবশ্য এ বিষয়ে কমবেশি বাস্তব অভিজ্ঞতা রয়েছে। এটাই আমার সবচেয়ে বড় ভরসা।”

আমার নিজের জন্য সেটি ছিল একটি বিরাট চ্যালেঞ্জ। এর আগে জীবনে কোনো নাটক লিখিনি। নাটক পরিচালনা করার অভিজ্ঞতা নেই। স্যার আমাকে অভিনয় করতেই দেননি। স্যার মনে করতেন আমার দ্বারা অভিনয় হবে না। তবে আস্থা রাখতেন যে, আমি লিখতে পারব। আমি স্যারের কথাগুলো মাথায় নিয়ে পুরো নাটকটিকে মঞ্চ থেকে রাজপথের স্তরে নামিয়ে আনলাম। বস্তুত বাংলার স্বাধীনতা আন্দোলনকে কেন্দ্র করেই নাটকটি গড়ে ওঠে। আমি আমাদের জাতীয় নেতৃবৃন্দকে চারণ হিসেবে রূপায়িত করলাম। তারা আমাদের গণসংগীত গাইতে গাইতে বাংলার স্বাধীনতার বাণী ছড়িয়ে দিতে লাগলেন। আমি সামরিক বাহিনীর সঙ্গে বাংলার তারুণ্যের যুদ্ধকে মঞ্চে তুলে আনলাম। মঞ্চে মিছিল হলো। রাস্তায় যেসব সেøাগান দিতাম সেগুলো মঞ্চে দিলাম। সামরিক বাহিনীর সঙ্গে নিরস্ত্র সংঘর্ষ মঞ্চে তুলে আনলাম।

মুহম্মদ জালাল নাটকের চরিত্রগুলো সম্পর্কে লিখেছেন, “নাটকের অন্যতম চরিত্রে এক চারণ গান গেয়ে জাগিয়ে তুলবে শোষিত, নিপীড়িত মানুষকে। এ চরিত্র রূপায়নের জন্য প্রয়োজন রথীনকে (রথীন আমাদের সহপাঠী ছিলো। বর্তমানে বাংলাদেশের অন্যতম ভাওয়াইয়া গায়ক রথীন্দ্র নাথ রায়কে পরিচয় করিয়ে দেয়ার অপেক্ষা রাখে না)। রথীন এমনিতে স্যারের নাট্যগোষ্ঠীর সঙ্গে জড়িত। কিন্তু অনিয়মিত। রথীন, মোস্তাফা, আমি সহপাঠী। রথীনকে নিয়মিত উপস্থিত রাখার দায়িত্ব পড়ল আমার ওপর। দ্বিতীয় চারণ মিহির (মিহির কুমার কর্মকার) ফরিদপুরের ছেলে। ভালো ছাত্র এবং ভালো গায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে ভর্তি হয়েছে। প্রথম সুযোগেই ওকে স্যারের কাছে নিয়ে এসেছি। ওর প্রতিভা ও আন্তরিকতায় স্যার খুশি। আফতাব ভাইও স্নেহ করে। মিহির এমনিতেই নিয়মিত। তবুও ওর দায়িত্বও আমাকে নিতে হলো। পরিকল্পনা ও কর্মবণ্টন এভাবেই চূড়ান্ত হলো।

শুরু হয়ে গেল ‘এক নদী রক্ত’ নাটক লেখা ও রিহার্সেলের কাজ। মোস্তাফা লিখে নিয়ে আসে। সন্ধ্যায় স্যারের বাসায় রিহার্সেল হয়। লেখা এগুচ্ছে একই সঙ্গে রিহার্সেল এগুচ্ছে। আফতাব ভাই রিহার্সেল করাচ্ছেন। স্যার দেখছেন। সময় খুবই কম। দু’একদিন মাথায় একটি চরিত্র নিয়ে সমস্যা দেখা দিল। চরিত্রটি মিলিটারি মেজরের। কেউ-ই এ চরিত্র করতে রাজী নয়। এ চরিত্রের কপালে গণধিক্কার অবধারিত। অবশেষে অনিচ্ছা সত্ত্বেও মহসীন ভাইকে (এসএম মহসীন) এ চরিত্রটিতে নিতে হলো। মহসীন ভাই বাংলা বিভাগেরই ছাত্র, আমাদের এক বছরের সিনিয়র, বর্তমানে শিল্পকলা একাডেমির নাট্য বিভাগের পরিচালক পদ থেকে অবসরে গেছেন।

প্রথম চারণ রথীনের একটি সংলাপ এবং কয়েটি গান। দ্বিতীয় ও তৃতীয় চারণ মিহির এবং আপেল মাহমুদের শুধু গান। আপেল মাহমুদ মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের “আমরা একটি ফুলকে বাঁচাব বলে যুদ্ধ করি” গানের জন্য জনপ্রিয় হন।

চারণরা গান গেয়ে গেয়ে গণজাগরণ সৃষ্টি করে। চারণদের সঙ্গে রয়েছে প্রধান চারজন রাজনৈতিক কর্মী নূরুল আলম তালুকদার (ডালিম), শেখ কামাল, আমি এবং চিশতি হেলালুর রহমান। চিশতি হেলালুর রহমান ছিল অন্যতম তরুণ জঙ্গী ছাত্রলীগ কর্মী। সেøাগানে চিশতির তুলনা ছিল না। ২৫ মার্চের কালো রাত্রে বর্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে শহীদ হয় আমাদের সবার প্রিয় বন্ধু, ছাত্রলীগের অসাধারণ এক নিবেদিতপ্রাণ কর্মী চিশতি হেলালুর রহমান। ‘এক নদী রক্ত’ নাটকে আমাদের চারজনের মোটামুটি সংলাপ ছিল। সেই সঙ্গে শেখ কামাল এবং চিশতির বাড়তি কাজ ছিল মিছিল পরিচালনা করা। মিছিল পরিচালনার কোনো রিহার্সেল অবশ্য হয়নি। এ ব্যাপারে আফতাব ভাই নিজেই দায়িত্ব নিয়ে শেখ কামাল এবং চিশতিকে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। আর মিছিলে অংশগ্রহণকারী ছাত্রলীগের বেশকিছু কর্মীও ঠিক করা ছিল। একইভাবে মহসীন ভাইয়ের সঙ্গে কিছু পুলিশ-মিলিটারিও ঠিক করা ছিল। এদের অবশ্য একটি স্টেজ রিহার্সেল হয়েছিল শুধু পরিবেশটা বুঝে নেয়ার জন্য।

নাটকের প্রথম দৃশ্যে চাচা (আসলাম ভূঞা, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো ভিসি)-এর সঙ্গে অনবদ্য অভিনয় করেছিল স্যারের তিন ছেলে সোহেল (মেরিন ইঞ্জিনিয়ার ও বর্তমানে ব্যবসায়ী), রাজা (কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার) এবং কনিষ্ঠ কন্যা রূপা (পদার্থ বিদ্যায় মাস্টার্স)। এদের মধ্যে সবার বড় সোহেল তখন খুব সম্ভবত সপ্তম শ্রেণির ছাত্র ছিল। বাকিগুলো আরও ছোট। অন্যান্য কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকায় ছিল অন্নহারা ব্যক্তিÑসাঈদ তারেক, বস্ত্রহারা ব্যক্তিÑতাওরিত হোসেন বাদল (শেখ কামালের অন্যতম ঘনিষ্ঠ বন্ধু। বিসিএস করে কিছুদিন ম্যাজিস্ট্রেটের চাকরি করেছেন। এখন একটি বেসরকারি ব্যাংক কর্মকর্তা), গৃহহারা ব্যক্তি মুহম্মদ রাজ্জাকুল হায়দার (বাংলা বিভাগে আমাদের সহপাঠী, বর্তমানে সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক)। শৈল্পিক হস্তাক্ষরের জন্য পোস্টার লেখায় রাজ্জাক ছিল বিশেষ প্রয়োজনীয় ব্যক্তি। এক নদী রক্ত নাটকের জন্য তিনভাজে মোড়া সাইক্লোস্টাইল করা সেই পরিচিতিপত্রটি লিখেছিল রাজ্জাক।”

ঢাকা। ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১২। সর্বশেষ সম্পাদনা : ২৮ অক্টোবর, ২০২১।

[লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, কলামিস্ট, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাস-এর চেয়ারম্যান- সাংবাদিক, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যার-এর জনক]

মঙ্গলবার, ০২ নভেম্বর ২০২১ , ১৭ কার্তিক ১৪২৮ ২৫ রবিউল আউয়াল ১৪৪৩

স্বাধীনতার প্রথম গণনাট্য ‘এক নদী রক্ত’ ও শেখ কামাল

মোস্তাফা জব্বার

দুই

শেখ কামাল ও ছাত্রলীগ কর্মীদের অভিনীত ‘এক নদী রক্ত’ ছিল সরাসরি গণজাগরণের নাটক। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে চারণ গায়ক মুকুন্দরাম দাস এবং বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের গান, পঞ্চাশের মন্বন্তরে জয়নুলের ছবি আর একাত্তরের এক নদী রক্ত নাটকের মধ্যে একটি গুণগত মিল খুঁজে পাওয়া যায়। মিলটি হচ্ছে গণসম্পৃক্তির। নিপীড়িত ও ভাগ্যবঞ্চিত মানুষের আবেগ ও আকাক্সক্ষাকে মানুষের ভেতর থেকেই আবিষ্কার করা, জাগিয়ে তোলা। এই জাগিয়ে তোলার কাজটি সেদিন এক নদী রক্ত খুব সার্থকভাবেই করতে পেরেছিল। নাটক শেষে ইচ্ছে করলে তখনই কয়েক হাজার ছাত্র-জনতার মিছিল নিয়ে বেরিয়ে পরা যেত, এ কথা জোরের সঙ্গেই বলা যায়।” আমরা সেই সময়ে রাজপথে যেমন সেøাগান দিই তেমনি সাহিত্য চর্চা করি, নাটক করি। নাটকের জন্য প্রখ্যাত নাট্যকার আশকার ইবনে শাইখের সাত রং নাট্যগোষ্ঠীতে শেখ কামালসহ আমরা ছাত্রলীগের কর্মীরা যুক্ত হই। তারপর আমরাই আশকার ইবনে শাইখকে সামনে রেখে গড়ে তুলি নাট্য একাডেমি। নাট্য একাডেমির সঙ্গে শেখ কামালের যুক্ত হবার বিষয়ে মুহম্মদ জালাল লিখেছেন, “নাট্য একাডেমীতে আমরা ক’জন ছিলাম সার্বক্ষণিক। আমাদের নিয়েই স্যার গড়ে তুলেছিলেন এ দেশের নাট্যাভিনয়, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের প্রথম প্রতিষ্ঠান নাট্য একাডেমী। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের জ্যেষ্ঠপুত্র (দ্বিতীয় সন্তান) শেখ কামাল একাত্তরের ১৭ জানুয়ারী ৭১ এ নাট্য একাডেমিতে ভর্তি হয় এবং আমাদের সঙ্গে সাধারণ রিহার্সেলে অংশগ্রহণ করতে থাকে। শেখ কামাল এর আগে তিন বছর সেতার বাদন শিখেছে। নাটকের রিহার্সেলেও বোঝা যাচ্ছিল ওর অভিনয় প্রতিভা আছে। চর্চা অব্যাহত রাখলে অভিনয়েও ভালো করবে। স্যার নিজেও শেখ কামালের রিহার্সেলে সন্তুষ্ট ছিলেন।”

আমাদের নিজেদের কাছে এটি বিস্ময়কর ছিল দেশের জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতা, পাকিস্তানের সম্ভাব্য প্রধানমন্ত্রীর পুত্র বা বাংলার মুকুটহীন রাজার ছেলে একজন অতি সাধারণ মানুষ হিসেবে নাটকের রিহার্সাল দিতে আসছে। অভিনয় শিখছে এবং নাটকে অংশ নেবার আগ্রহ দেখাচ্ছে। নাট্য একাডেমির পরিচালক আশকার ইবনে শাইখ যদিও আমাদের রাজনৈতিক ধারণার লোক ছিলেন না তবুও আমরা ছাত্রলীগের ছেলেরাই তাকে ঘিরে রেখেছিলাম। শেখ কামাল যোগ দেয়াতে আমরা আরও শক্তিশালী হলাম। এক সময়ে স্যার আমাদের ফেব্রুয়ারিতে একটি পরীক্ষামূলক নাটক করার পরামর্শ দিলেন। আমরা চাইলাম নাটকটি শহীদ দিবসে হবে এবং যেহেতু ডাকসু ছাত্রলীগের দখলে সেহেতু আমরা ডাকসুর ব্যানারে নাটকটা করব। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন সংস্কৃতি মানে ছাত্র ইউনিয়ন আর মিছিল-লড়াই মানে ছাত্রলীগ। আমরা সংস্কৃতিকে গণসংস্কৃতিতে পরিণত করার ভাবনা থেকে কাজ করছিলাম। মুহম্মদ জালাল লিখেছেন, “হঠাৎ একদিন, ফেব্রুয়ারির ১০/১২ তারিখে, রব ভাই নিজেই স্যারের বাসায় এলেন এবং বললেন, “স্যার, আপনি যে একটি নাটকের কথা বলেছিলেন, ডাকসুর জন্য ওই নাটকটি আমরা চাই। আপনাকে স্যার করে দিতেই হবে।” স্যার বললেন, “তা এত অল্প সময়ে ওই নাটকটি কি করে করা যাবে বাবা, নাটক তো এখনও পর্যন্ত লেখাই হয়নি।” রব ভাইও জিদ ধরে বসলেন, “আমি কিছুই জানি না। আপনি স্যার পারবেন। কিরে আফতাব।” আফতাব ভাই স্যারের দিকে তাকিয়ে রইলেন, স্যার কি বলেন। শেষ পর্যন্ত স্যার বললেন, “ঠিক আছে, চেষ্টা করে দেখা যাক।” আমাদের সবার ওপর স্যারের মোটামুটি আস্থা ছিল। ইতোমধ্যেই স্যারের পরিচালনায় কয়েকটি নাটক করেছি আমরা। রব ভাই চলে যাওয়ার পর স্যার আমাদের নিয়ে বসলেন এবং তার পরিকল্পিত নাটকের ঘটনা প্রবাহ, দৃশ্য পরিকল্পনা এবং দৃশ্য বিভাজনসহ নাটকের পুরো কাঠামোটি তুলে ধরলেন। সবাই আমরা চমৎকৃত হলাম। স্যার মোস্তাফাকে বললেন, “তুমি এখন এর নাট্যরূপ দেবে এবং সংলাপগুলো বসিয়ে দেবে।” আফতাব ভাইকে বললেন, “তুমিই এ নাটকটি পরিচালনা করবে। কাজেই, মোস্তাফা, তুমি আফতাবের সঙ্গে পরামর্শ করে সংলাপগুলো চূড়ান্ত করবে।” এ ব্যাপারে আমাদের সবাইকে স্যার সর্বাত্মক নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করার জন্য বললেন, “বুঝতেই পারছো, তোমরা এতদিন যে ধরনের নাটক করে এসেছো, সে সব নাটকের সঙ্গে এ নাটকের কোনো মিল নেই। মঞ্চের ওপর ছাত্র-পুলিশ সংঘর্ষ। স্যার হাসতে হাসতে বললেন, “তোমাদের সবারই অবশ্য এ বিষয়ে কমবেশি বাস্তব অভিজ্ঞতা রয়েছে। এটাই আমার সবচেয়ে বড় ভরসা।”

আমার নিজের জন্য সেটি ছিল একটি বিরাট চ্যালেঞ্জ। এর আগে জীবনে কোনো নাটক লিখিনি। নাটক পরিচালনা করার অভিজ্ঞতা নেই। স্যার আমাকে অভিনয় করতেই দেননি। স্যার মনে করতেন আমার দ্বারা অভিনয় হবে না। তবে আস্থা রাখতেন যে, আমি লিখতে পারব। আমি স্যারের কথাগুলো মাথায় নিয়ে পুরো নাটকটিকে মঞ্চ থেকে রাজপথের স্তরে নামিয়ে আনলাম। বস্তুত বাংলার স্বাধীনতা আন্দোলনকে কেন্দ্র করেই নাটকটি গড়ে ওঠে। আমি আমাদের জাতীয় নেতৃবৃন্দকে চারণ হিসেবে রূপায়িত করলাম। তারা আমাদের গণসংগীত গাইতে গাইতে বাংলার স্বাধীনতার বাণী ছড়িয়ে দিতে লাগলেন। আমি সামরিক বাহিনীর সঙ্গে বাংলার তারুণ্যের যুদ্ধকে মঞ্চে তুলে আনলাম। মঞ্চে মিছিল হলো। রাস্তায় যেসব সেøাগান দিতাম সেগুলো মঞ্চে দিলাম। সামরিক বাহিনীর সঙ্গে নিরস্ত্র সংঘর্ষ মঞ্চে তুলে আনলাম।

মুহম্মদ জালাল নাটকের চরিত্রগুলো সম্পর্কে লিখেছেন, “নাটকের অন্যতম চরিত্রে এক চারণ গান গেয়ে জাগিয়ে তুলবে শোষিত, নিপীড়িত মানুষকে। এ চরিত্র রূপায়নের জন্য প্রয়োজন রথীনকে (রথীন আমাদের সহপাঠী ছিলো। বর্তমানে বাংলাদেশের অন্যতম ভাওয়াইয়া গায়ক রথীন্দ্র নাথ রায়কে পরিচয় করিয়ে দেয়ার অপেক্ষা রাখে না)। রথীন এমনিতে স্যারের নাট্যগোষ্ঠীর সঙ্গে জড়িত। কিন্তু অনিয়মিত। রথীন, মোস্তাফা, আমি সহপাঠী। রথীনকে নিয়মিত উপস্থিত রাখার দায়িত্ব পড়ল আমার ওপর। দ্বিতীয় চারণ মিহির (মিহির কুমার কর্মকার) ফরিদপুরের ছেলে। ভালো ছাত্র এবং ভালো গায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে ভর্তি হয়েছে। প্রথম সুযোগেই ওকে স্যারের কাছে নিয়ে এসেছি। ওর প্রতিভা ও আন্তরিকতায় স্যার খুশি। আফতাব ভাইও স্নেহ করে। মিহির এমনিতেই নিয়মিত। তবুও ওর দায়িত্বও আমাকে নিতে হলো। পরিকল্পনা ও কর্মবণ্টন এভাবেই চূড়ান্ত হলো।

শুরু হয়ে গেল ‘এক নদী রক্ত’ নাটক লেখা ও রিহার্সেলের কাজ। মোস্তাফা লিখে নিয়ে আসে। সন্ধ্যায় স্যারের বাসায় রিহার্সেল হয়। লেখা এগুচ্ছে একই সঙ্গে রিহার্সেল এগুচ্ছে। আফতাব ভাই রিহার্সেল করাচ্ছেন। স্যার দেখছেন। সময় খুবই কম। দু’একদিন মাথায় একটি চরিত্র নিয়ে সমস্যা দেখা দিল। চরিত্রটি মিলিটারি মেজরের। কেউ-ই এ চরিত্র করতে রাজী নয়। এ চরিত্রের কপালে গণধিক্কার অবধারিত। অবশেষে অনিচ্ছা সত্ত্বেও মহসীন ভাইকে (এসএম মহসীন) এ চরিত্রটিতে নিতে হলো। মহসীন ভাই বাংলা বিভাগেরই ছাত্র, আমাদের এক বছরের সিনিয়র, বর্তমানে শিল্পকলা একাডেমির নাট্য বিভাগের পরিচালক পদ থেকে অবসরে গেছেন।

প্রথম চারণ রথীনের একটি সংলাপ এবং কয়েটি গান। দ্বিতীয় ও তৃতীয় চারণ মিহির এবং আপেল মাহমুদের শুধু গান। আপেল মাহমুদ মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের “আমরা একটি ফুলকে বাঁচাব বলে যুদ্ধ করি” গানের জন্য জনপ্রিয় হন।

চারণরা গান গেয়ে গেয়ে গণজাগরণ সৃষ্টি করে। চারণদের সঙ্গে রয়েছে প্রধান চারজন রাজনৈতিক কর্মী নূরুল আলম তালুকদার (ডালিম), শেখ কামাল, আমি এবং চিশতি হেলালুর রহমান। চিশতি হেলালুর রহমান ছিল অন্যতম তরুণ জঙ্গী ছাত্রলীগ কর্মী। সেøাগানে চিশতির তুলনা ছিল না। ২৫ মার্চের কালো রাত্রে বর্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে শহীদ হয় আমাদের সবার প্রিয় বন্ধু, ছাত্রলীগের অসাধারণ এক নিবেদিতপ্রাণ কর্মী চিশতি হেলালুর রহমান। ‘এক নদী রক্ত’ নাটকে আমাদের চারজনের মোটামুটি সংলাপ ছিল। সেই সঙ্গে শেখ কামাল এবং চিশতির বাড়তি কাজ ছিল মিছিল পরিচালনা করা। মিছিল পরিচালনার কোনো রিহার্সেল অবশ্য হয়নি। এ ব্যাপারে আফতাব ভাই নিজেই দায়িত্ব নিয়ে শেখ কামাল এবং চিশতিকে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। আর মিছিলে অংশগ্রহণকারী ছাত্রলীগের বেশকিছু কর্মীও ঠিক করা ছিল। একইভাবে মহসীন ভাইয়ের সঙ্গে কিছু পুলিশ-মিলিটারিও ঠিক করা ছিল। এদের অবশ্য একটি স্টেজ রিহার্সেল হয়েছিল শুধু পরিবেশটা বুঝে নেয়ার জন্য।

নাটকের প্রথম দৃশ্যে চাচা (আসলাম ভূঞা, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো ভিসি)-এর সঙ্গে অনবদ্য অভিনয় করেছিল স্যারের তিন ছেলে সোহেল (মেরিন ইঞ্জিনিয়ার ও বর্তমানে ব্যবসায়ী), রাজা (কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার) এবং কনিষ্ঠ কন্যা রূপা (পদার্থ বিদ্যায় মাস্টার্স)। এদের মধ্যে সবার বড় সোহেল তখন খুব সম্ভবত সপ্তম শ্রেণির ছাত্র ছিল। বাকিগুলো আরও ছোট। অন্যান্য কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকায় ছিল অন্নহারা ব্যক্তিÑসাঈদ তারেক, বস্ত্রহারা ব্যক্তিÑতাওরিত হোসেন বাদল (শেখ কামালের অন্যতম ঘনিষ্ঠ বন্ধু। বিসিএস করে কিছুদিন ম্যাজিস্ট্রেটের চাকরি করেছেন। এখন একটি বেসরকারি ব্যাংক কর্মকর্তা), গৃহহারা ব্যক্তি মুহম্মদ রাজ্জাকুল হায়দার (বাংলা বিভাগে আমাদের সহপাঠী, বর্তমানে সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক)। শৈল্পিক হস্তাক্ষরের জন্য পোস্টার লেখায় রাজ্জাক ছিল বিশেষ প্রয়োজনীয় ব্যক্তি। এক নদী রক্ত নাটকের জন্য তিনভাজে মোড়া সাইক্লোস্টাইল করা সেই পরিচিতিপত্রটি লিখেছিল রাজ্জাক।”

ঢাকা। ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১২। সর্বশেষ সম্পাদনা : ২৮ অক্টোবর, ২০২১।

[লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, কলামিস্ট, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাস-এর চেয়ারম্যান- সাংবাদিক, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যার-এর জনক]