কাজুবাদাম : আন্তর্জাতিক বাজার ও সম্ভাবনা

এমএ আউয়াল ও এম মনির উদ্দিন

কৃষি মন্ত্রণালয় দেশে অপ্রচলিত ও উচ্চমূল্যের ফসল চাষে কার্যকরি পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে এবং এ রকমই সম্ভাবনাময়, রপ্তানিযোগ্য অপ্রচলিত এবং উচ্চমূল্যের একটি ফসল যার নাম কাজুবাদাম। কাজুবাদামে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন এবং বিভিন্ন ধরনের প্রয়োজনীয় ভিটামিন ও খনিজ সে সঙ্গে ঔষধি গুণাগুণ থাকায় বিশ্ববাজারে কাজুবাদামের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে এবং দিন দিন চাহিদা বেড়েই চলেছে। কাজুবাদাম একটি গ্রীষ্মম-লীয় ফসল, যার চাষাবাদ এশিয়া এবং আফ্রিকা মহাদেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকায় বিশ্বের উন্নত দেশগুলো পুষ্টিকর এই কৃষিপণ্যটির জন্য মূলত এই দুই মহাদেশের উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশগুলোর ওপর নির্ভরশীল।

বর্তমানে কাজুবাদামের আন্তর্জাতিক বাজারমূল্য রয়েছে প্রায় ১৪.৯ বিলিয়ন ডলার যেখানে, ভিয়েতনাম এককভাবে ৪ বিলিয়ন ডলারের কাজুবাদাম রপ্তানি করে থাকে। ভিয়েতনামে ২০১৯ সালে কাঁচা কাজুবাদাম উৎপাদিত হয় ২.৮৩ লাখ টন কিন্তু দেশটিতে কাজুবাদাম প্রক্রিয়াজাতের সুবিধা গড়ে উঠায় আফ্রিকার দেশগুলো থেকে কাঁচা কাজুবাদাম আমদানি করে এবং তা প্রক্রিয়াজাত করে আন্তর্জাতিক বাজারে সরবরাহ করে। ২০৩০ সাল নাগাদ ভিয়েতনাম সাড়ে ১০ বিলিয়ন ডলারের কাজুবাদাম রপ্তানি করার পরিকল্পনা করেছে অথচ ভিয়েতনামে কাজুবাদাম চাষের ইতিহাস খুব বেশিদিনের নয়। ১৯৮০ এর দশকে ভিয়েতনাম সরকার দেশের দরিদ্রতম জেলাগুলোর কিছু জমির মালিকদের কাজুবাদাম লাগাতে উৎসাহিত করে। ১৯৯০ দশকের মধ্যে ভিয়েতনামে কাজুবাদাম প্রক্রিয়াজাত কারখানা গড়ে উঠে এবং ২০১৩ সালের মধ্যে ভিয়েতনাম আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদার ২৫ শতাংশ কাজুবাদাম সরবরাহ করে। ভিয়েতনাম আজ বিশ্বের কাজুবাদাম বাণিজ্যের ১৪.৯ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে ৯ বিলিয়ন ডলারের বাজার একাই নিয়ন্ত্রণ করছে।

২০১৯ সালে বিশ্বে কাঁচা কাজুবাদাম উৎপাদন হয়েছে মোট ৩৯.৬১ লাখ টন যার ৩৯ শতাংশ উৎপাদন হয়েছে ভারত ও আইভরি কোস্ট মিলে। ২০২০ সালে বিশ্বের শীর্ষ প্রক্রিয়াজাত কাজুবাদাম রপ্তানিকারক দেশ হচ্ছে ভিয়েতনাম এবং শীর্ষ আমদানিকারক দেশ আমেরিকা। আফ্রিকার দেশগুলো বছরে প্রায় ২৫ লাখ টন কাঁচা কাজুবাদাম উৎপাদন করে কিন্তু প্রক্রিয়াজাতের তেমন আধুনিক ব্যবস্থা না থাকায় উৎপাদিত কাঁচা কাজুবাদামের ৯০ শতাংশই রপ্তানি করে।

বাংলাদেশেও কাজুবাদামের অভ্যন্তরীণ চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। ২০১৪-১৫ সালে দেশে মাত্র ১৮,০০০ কেজি প্রক্রিয়াজাত কাজুবাদাম আমদানি হয়, যা ২০১৮-২০১৯ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ৫ লাখ ৮০ হাজার টনে। ২০১৯-২০ সালে কাজুবাদাম আমদানি হয় সাড়ে ৬ লাখ মেট্রিক টন অথচ বাংলাদেশ কাজুবাদাম উৎপাদনের এক সম্ভাবনাময় উর্বর ভূমি।

বাংলাদেশের তিন পার্বত্য জেলা বান্দরবন, রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ির মোট আয়তন ১৩,৩৪,৪০০ হেক্টর যার মাত্র ৫ শতাংশ সমতল ফসলি জমি এবং বাকিটা পাহাড়ি এলাকা। কাজুবাদাম চাষের জন্য যে রকম মাটি, তাপমাত্রা ও বৃষ্টি দরকার তার সম্পূর্ণ বৈশিষ্ট্য রয়েছে এই পাহাড়ি এলাকায়। তিন পাবর্ত্য জেলার কমপক্ষে ২২ শতাংশ জমিতে এখনি কাজুবাদাম চাষের সুযোগ রয়েছে। পাশাপাশি দেশের অন্যান্য সীমান্তবর্তী পাহাড়ি এলাকার মাটিও কাজুবাদাম চাষের অনুকূলে। অর্থাৎ সঠিক পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যেতে পারলে ভিয়েতনামের সফলতার গল্প শুনতে হবে না বরং বাংলাদেশ আগামীদিনে ভিয়েতনামের জায়গায় প্রতিষ্ঠিত হতে পারবে।

১৯৬১-১৯৬২ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড এবং উদ্যান উন্নয়ন বিভাগ (কৃষি সম্প্রসারন বিভাগ) পার্বত্য এলাকায় অন্যান্য ফলের চারার সঙ্গে আফ্রিকা থেকে সংগ্রহ করা কিছু কাজুবাদামের চারাও রোপণ করে। কিন্তু বাজারজাত ও প্রক্রিয়াজাতের কোন সুযোগ না থাকায় অনেক কৃষক বেশকিছু কাজুবাদাম গাছ কেটে ফেলে। পরবর্তীতে স্থানীয় পাইকারগন কৃষকদের কাছ থেকে কাঁচা কাজুবাদাম সংগ্রহ করে ভারতে রপ্তানি শুরু করে এবং এতে স্থানীয় কৃষকেরা কাজুবাদামের প্রতি আবার আগ্রহী হয়ে উঠে। নিজস্ব উদ্যোগে কিছু কৃষক আবার নুতন করে কাজুবাদাম চাষে এগিয়ে আসে এবং কয়েক বছরের মধ্যেই গাছ থেকে ফলন পেতে শুরু করে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮-২০১৯ বছরে দেশে কাঁচা কাজুবাদামের উৎপাদন ছিল ৯৬২ মেট্রিক টন, যা ২০১৯-২০ বছরে বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ১৩২৩ মেট্রিক টনে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কাজুবাদামের উৎপাদন বাড়ানোর জন্য ১৪৮ কোটি টাকার একটি প্রকল্প শুরু করেছে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে ১০ হাজার হেক্টর জমি নতুন করে কাজুবাদাম চাষের আওতায় আসবে এবং ২০২৫ সালে প্রকল্পটি শেষ হলে দেশে বছরে ২৫০০০ টন কাঁচা কাজুবাদাম উৎপাদিত হবে। আগামী কয়েক বছরের মধ্যে কৃষি মন্ত্রণালয় ১ বিলিয়ন ডলারের প্রক্রিয়াজাত কাজুবাদাম রপ্তানি করার জন্য বদ্ধপরিকর। সম্প্রতি কৃষি মন্ত্রণালয় অপ্রচলিত ফসলের সম্প্রসারণের লক্ষ্যে “কাজুবাদাম ও কফি গবেষণা, উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ” শীর্ষক ২১১ কোটি টাকার আরেকটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। দেশে কাজুবাদামের প্রক্রিয়াজাত সহজতর করা এবং প্রক্রিয়াজাত শিল্প গড়ে তোলার জন্য কাঁচা কাজুবাদাম আমদানির ওপর শুল্কহার ৯০ শতাংশ থেকে কমিয়ে মাত্র ৫ শতাংশ করা হয়েছে।

বাংলাদেশে ইতোমধ্যে যে কয়েকটি কাজুবাদাম প্রক্রিয়াজাত প্লান্ট স্থাপিত হয়েছে এবং বর্তমানে দেশীয় কাজুবাদামের যে উৎপাদন তা এই কারখানাগুলোর জন্য যথেষ্ট নয়। এশিয়া এবং আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ থেকে কাঁচা কাজুবাদাম সংগ্রহ করে প্রক্রিয়াজাত কাজু রপ্তানির মাধ্যমে এখনি বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব। বিশ্ব বাজারে কাঁচা কাজুবাদামের মূল্য মান অনুযায়ী ৯০-১৩০ টাকা। কাঁচা কাজুবাদাম আমদানির ক্ষেত্রে শুল্কহার কমানোর ফলে দেশে গড়ে উঠা কারখানাগুলো কাঁচা কাজুবাদাম আমদানির মাধ্যমে প্রক্রিয়াজাত কাজুবাদাম রপ্তানি করে বিলিয়ন ডলার আয় করা মোটেই অসম্ভব নয়।

নীলফামারী জেলায় জ্যাকপট কাজুবাদাম ইন্ডাস্ট্রি নামে একটি প্রক্রিয়াজাত ফ্যাক্টরি গড়ে উঠে। প্রাথমিকভাবে তারা বছরে ৩০ মেট্রিক টন কাঁচা কাজুবাদাম প্রক্রিয়াজাত করে দেশের বিভিন্ন বাজারে সরবরাহ করে। পরবর্তীতে, জ্যাকপট ইন্ডাস্ট্রি স্পেন এবং জার্মানির সঙ্গে মাসে ৩০ মেট্রিক টন কাজুবাদাম সরবরাহ করার জন্য চুক্তিবদ্ধ হয় এবং জ্যাকপট প্রতি মাসে ১০০ টন প্রক্রিয়াজাত কাজুবাদাম উৎপাদনের পরিকল্পনা করেছে। এখানে উল্লেখ্য যে, ৫ কেজি কাঁচা কাজুবাদাম থেকে ১ কেজি প্রক্রিয়াজাত কাজুবাদাম পাওয়া যায় এবং মান অনুযায়ী ১ কেজি প্রক্রিয়াজাত কাজুবাদামের বাজারমূল্য ৮০০-১৭০০ টাকা।

২০১৯ সালে গ্রিন গ্রেইন গ্রুপ চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় আধুনিক মানের একটি কাজুবাদাম প্রক্রিয়াজাত শিল্প গড়ে তোলে। ২০২০ সালে গ্রিন গ্রেইন গ্রুপ বান্দরবনের কৃষকদের কাছ থেকে ৪০০ টন কাঁচা কাজুবাদাম সংগ্রহ করে তা প্রক্রিয়াজাত শুরু করে। এর পরপরই গ্রিন গ্রেইন গ্রুপ সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে কাজুবাদামের সরবরাহ আদেশ পায়। বাংলাদেশ স্টিল রি-রোলিং মিলস (বিএসআরএম) কাজুবাদাম প্রসেসিং প্লান্ট স্থাপনের জন্য চট্টগ্রামের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরে ১৫ একর জমি লিজের জন্য বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের কাছে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। বান্দরবন ও রাজশাহীতেও একটি করে প্রক্রিয়াজাত কারখানা গড়ে উঠেছে।

দেশে কাজুবাদামের উৎপাদন বৃদ্ধি এবং এটিকে কৃষির বাণিজ্যিক পণ্য হিসাবে রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা আহরণের জন্য কয়েকটি বিষয় বিবেচনায় নেয়া গুরুত্বপূর্ণ যেমন :

১) বাংলাদেশের প্রচলিত কাজুবাদামের উৎপাদন ক্ষমতা অন্যান্য দেশের বিশেষ করে ভিয়েতনাম এবং ভারতের প্রচলিত জাতের তুলনায় অত্যন্ত কম। আমাদের দেশে যে জাত পার্বত্য এলাকায় চাষ হয় তার শেল কাজুবাদামের এর আকার ছোট (৩-৪ গ্রাম) এবং প্রতি গাছে শেল কাজু পাওয়া যায় ৪-৫ কেজি। ভারতের পশ্চিমবঙ্গে যে জাতটি বেশি ফলন দেয় তার নাম জারগ্রাম-২। এ জাতটি গাছ প্রতি ১২-১৪ কেজি শেল কাজু ফলন দেয় এবং প্রতি শেল কাজুর গড় ওজন ৮-১০ গ্রাম। ভিয়েতনামে ৫টি উচ্চফলনশীল কাজুবাদাম চাষ করা হয় যার মধ্যে ৪টির ফলন অন্যান্য যে কোন দেশের চেয়ে অনেক বেশি। ভিয়েতনামের এই ৪টি জাতের নাম ঝববফ ঊঝ০৪, ঝববফকচ১২, ঝববফকচ১১ এবং ঝববফইউ০১ যাদের গাছপ্রতি শেল কাজু পাওয়া যায় ৪৫-৬৫ কেজি।

ভিয়েতনামের এই জাতগুলো দেশে প্রবর্তন করার ব্যবস্থা করা হলে কাজুবাদামের উৎপাদন উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাবে।

২) পার্বত্য তিন জেলার পাশাপাশি চট্টগ্রাম, সিলেট, মৌলভীবাজার, ময়মনসিংহ, শেরপুর, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর এর সীমান্তবর্তী পাহাড়ি এলাকা সেসঙ্গে নরসিংদী, গাজীপুর, টাঙ্গাইল, নারায়ণগঞ্জের লালমাটি এলাকায় যে পতিত জমি রয়েছেÑ তা কাজু চাষের আওতায় নিয়ে আসার ব্যবস্থা করা।

৩) আফ্রিকার দেশগুলোতে প্রচুর কাজুবাদাম উৎপাদন হলেও সেখানে প্রক্রিয়াজাতের তেমন ভালো শিল্প গড়ে উঠেনি। এমতাবস্থায় আমাদের দেশে প্রক্রিয়াজাত শিল্প খুব সহজেই গড়ে তোলা সম্ভব যেহেতু প্রতিবেশী ভারতে আধুনিক মানের কাজুবাদাম প্রক্রিয়াজাতের মেশিনারি পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে প্রাইভেট সেক্টরকে প্রয়োজনীয় জমির বন্দোবস্তসহ কারিগরি সহায়তা দিয়ে কাজুবাদামের শিল্পপ্রতিষ্ঠায় উৎসাহিত করার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।

[লেখক : এম এ আউয়াল, সদস্য পরিচালক, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল; এম মনির উদ্দিন, এগ্রোনোমিস্ট]

মঙ্গলবার, ০২ নভেম্বর ২০২১ , ১৭ কার্তিক ১৪২৮ ২৫ রবিউল আউয়াল ১৪৪৩

কাজুবাদাম : আন্তর্জাতিক বাজার ও সম্ভাবনা

এমএ আউয়াল ও এম মনির উদ্দিন

কৃষি মন্ত্রণালয় দেশে অপ্রচলিত ও উচ্চমূল্যের ফসল চাষে কার্যকরি পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে এবং এ রকমই সম্ভাবনাময়, রপ্তানিযোগ্য অপ্রচলিত এবং উচ্চমূল্যের একটি ফসল যার নাম কাজুবাদাম। কাজুবাদামে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন এবং বিভিন্ন ধরনের প্রয়োজনীয় ভিটামিন ও খনিজ সে সঙ্গে ঔষধি গুণাগুণ থাকায় বিশ্ববাজারে কাজুবাদামের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে এবং দিন দিন চাহিদা বেড়েই চলেছে। কাজুবাদাম একটি গ্রীষ্মম-লীয় ফসল, যার চাষাবাদ এশিয়া এবং আফ্রিকা মহাদেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকায় বিশ্বের উন্নত দেশগুলো পুষ্টিকর এই কৃষিপণ্যটির জন্য মূলত এই দুই মহাদেশের উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশগুলোর ওপর নির্ভরশীল।

বর্তমানে কাজুবাদামের আন্তর্জাতিক বাজারমূল্য রয়েছে প্রায় ১৪.৯ বিলিয়ন ডলার যেখানে, ভিয়েতনাম এককভাবে ৪ বিলিয়ন ডলারের কাজুবাদাম রপ্তানি করে থাকে। ভিয়েতনামে ২০১৯ সালে কাঁচা কাজুবাদাম উৎপাদিত হয় ২.৮৩ লাখ টন কিন্তু দেশটিতে কাজুবাদাম প্রক্রিয়াজাতের সুবিধা গড়ে উঠায় আফ্রিকার দেশগুলো থেকে কাঁচা কাজুবাদাম আমদানি করে এবং তা প্রক্রিয়াজাত করে আন্তর্জাতিক বাজারে সরবরাহ করে। ২০৩০ সাল নাগাদ ভিয়েতনাম সাড়ে ১০ বিলিয়ন ডলারের কাজুবাদাম রপ্তানি করার পরিকল্পনা করেছে অথচ ভিয়েতনামে কাজুবাদাম চাষের ইতিহাস খুব বেশিদিনের নয়। ১৯৮০ এর দশকে ভিয়েতনাম সরকার দেশের দরিদ্রতম জেলাগুলোর কিছু জমির মালিকদের কাজুবাদাম লাগাতে উৎসাহিত করে। ১৯৯০ দশকের মধ্যে ভিয়েতনামে কাজুবাদাম প্রক্রিয়াজাত কারখানা গড়ে উঠে এবং ২০১৩ সালের মধ্যে ভিয়েতনাম আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদার ২৫ শতাংশ কাজুবাদাম সরবরাহ করে। ভিয়েতনাম আজ বিশ্বের কাজুবাদাম বাণিজ্যের ১৪.৯ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে ৯ বিলিয়ন ডলারের বাজার একাই নিয়ন্ত্রণ করছে।

২০১৯ সালে বিশ্বে কাঁচা কাজুবাদাম উৎপাদন হয়েছে মোট ৩৯.৬১ লাখ টন যার ৩৯ শতাংশ উৎপাদন হয়েছে ভারত ও আইভরি কোস্ট মিলে। ২০২০ সালে বিশ্বের শীর্ষ প্রক্রিয়াজাত কাজুবাদাম রপ্তানিকারক দেশ হচ্ছে ভিয়েতনাম এবং শীর্ষ আমদানিকারক দেশ আমেরিকা। আফ্রিকার দেশগুলো বছরে প্রায় ২৫ লাখ টন কাঁচা কাজুবাদাম উৎপাদন করে কিন্তু প্রক্রিয়াজাতের তেমন আধুনিক ব্যবস্থা না থাকায় উৎপাদিত কাঁচা কাজুবাদামের ৯০ শতাংশই রপ্তানি করে।

বাংলাদেশেও কাজুবাদামের অভ্যন্তরীণ চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। ২০১৪-১৫ সালে দেশে মাত্র ১৮,০০০ কেজি প্রক্রিয়াজাত কাজুবাদাম আমদানি হয়, যা ২০১৮-২০১৯ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ৫ লাখ ৮০ হাজার টনে। ২০১৯-২০ সালে কাজুবাদাম আমদানি হয় সাড়ে ৬ লাখ মেট্রিক টন অথচ বাংলাদেশ কাজুবাদাম উৎপাদনের এক সম্ভাবনাময় উর্বর ভূমি।

বাংলাদেশের তিন পার্বত্য জেলা বান্দরবন, রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ির মোট আয়তন ১৩,৩৪,৪০০ হেক্টর যার মাত্র ৫ শতাংশ সমতল ফসলি জমি এবং বাকিটা পাহাড়ি এলাকা। কাজুবাদাম চাষের জন্য যে রকম মাটি, তাপমাত্রা ও বৃষ্টি দরকার তার সম্পূর্ণ বৈশিষ্ট্য রয়েছে এই পাহাড়ি এলাকায়। তিন পাবর্ত্য জেলার কমপক্ষে ২২ শতাংশ জমিতে এখনি কাজুবাদাম চাষের সুযোগ রয়েছে। পাশাপাশি দেশের অন্যান্য সীমান্তবর্তী পাহাড়ি এলাকার মাটিও কাজুবাদাম চাষের অনুকূলে। অর্থাৎ সঠিক পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যেতে পারলে ভিয়েতনামের সফলতার গল্প শুনতে হবে না বরং বাংলাদেশ আগামীদিনে ভিয়েতনামের জায়গায় প্রতিষ্ঠিত হতে পারবে।

১৯৬১-১৯৬২ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড এবং উদ্যান উন্নয়ন বিভাগ (কৃষি সম্প্রসারন বিভাগ) পার্বত্য এলাকায় অন্যান্য ফলের চারার সঙ্গে আফ্রিকা থেকে সংগ্রহ করা কিছু কাজুবাদামের চারাও রোপণ করে। কিন্তু বাজারজাত ও প্রক্রিয়াজাতের কোন সুযোগ না থাকায় অনেক কৃষক বেশকিছু কাজুবাদাম গাছ কেটে ফেলে। পরবর্তীতে স্থানীয় পাইকারগন কৃষকদের কাছ থেকে কাঁচা কাজুবাদাম সংগ্রহ করে ভারতে রপ্তানি শুরু করে এবং এতে স্থানীয় কৃষকেরা কাজুবাদামের প্রতি আবার আগ্রহী হয়ে উঠে। নিজস্ব উদ্যোগে কিছু কৃষক আবার নুতন করে কাজুবাদাম চাষে এগিয়ে আসে এবং কয়েক বছরের মধ্যেই গাছ থেকে ফলন পেতে শুরু করে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮-২০১৯ বছরে দেশে কাঁচা কাজুবাদামের উৎপাদন ছিল ৯৬২ মেট্রিক টন, যা ২০১৯-২০ বছরে বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ১৩২৩ মেট্রিক টনে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কাজুবাদামের উৎপাদন বাড়ানোর জন্য ১৪৮ কোটি টাকার একটি প্রকল্প শুরু করেছে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে ১০ হাজার হেক্টর জমি নতুন করে কাজুবাদাম চাষের আওতায় আসবে এবং ২০২৫ সালে প্রকল্পটি শেষ হলে দেশে বছরে ২৫০০০ টন কাঁচা কাজুবাদাম উৎপাদিত হবে। আগামী কয়েক বছরের মধ্যে কৃষি মন্ত্রণালয় ১ বিলিয়ন ডলারের প্রক্রিয়াজাত কাজুবাদাম রপ্তানি করার জন্য বদ্ধপরিকর। সম্প্রতি কৃষি মন্ত্রণালয় অপ্রচলিত ফসলের সম্প্রসারণের লক্ষ্যে “কাজুবাদাম ও কফি গবেষণা, উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ” শীর্ষক ২১১ কোটি টাকার আরেকটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। দেশে কাজুবাদামের প্রক্রিয়াজাত সহজতর করা এবং প্রক্রিয়াজাত শিল্প গড়ে তোলার জন্য কাঁচা কাজুবাদাম আমদানির ওপর শুল্কহার ৯০ শতাংশ থেকে কমিয়ে মাত্র ৫ শতাংশ করা হয়েছে।

বাংলাদেশে ইতোমধ্যে যে কয়েকটি কাজুবাদাম প্রক্রিয়াজাত প্লান্ট স্থাপিত হয়েছে এবং বর্তমানে দেশীয় কাজুবাদামের যে উৎপাদন তা এই কারখানাগুলোর জন্য যথেষ্ট নয়। এশিয়া এবং আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ থেকে কাঁচা কাজুবাদাম সংগ্রহ করে প্রক্রিয়াজাত কাজু রপ্তানির মাধ্যমে এখনি বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব। বিশ্ব বাজারে কাঁচা কাজুবাদামের মূল্য মান অনুযায়ী ৯০-১৩০ টাকা। কাঁচা কাজুবাদাম আমদানির ক্ষেত্রে শুল্কহার কমানোর ফলে দেশে গড়ে উঠা কারখানাগুলো কাঁচা কাজুবাদাম আমদানির মাধ্যমে প্রক্রিয়াজাত কাজুবাদাম রপ্তানি করে বিলিয়ন ডলার আয় করা মোটেই অসম্ভব নয়।

নীলফামারী জেলায় জ্যাকপট কাজুবাদাম ইন্ডাস্ট্রি নামে একটি প্রক্রিয়াজাত ফ্যাক্টরি গড়ে উঠে। প্রাথমিকভাবে তারা বছরে ৩০ মেট্রিক টন কাঁচা কাজুবাদাম প্রক্রিয়াজাত করে দেশের বিভিন্ন বাজারে সরবরাহ করে। পরবর্তীতে, জ্যাকপট ইন্ডাস্ট্রি স্পেন এবং জার্মানির সঙ্গে মাসে ৩০ মেট্রিক টন কাজুবাদাম সরবরাহ করার জন্য চুক্তিবদ্ধ হয় এবং জ্যাকপট প্রতি মাসে ১০০ টন প্রক্রিয়াজাত কাজুবাদাম উৎপাদনের পরিকল্পনা করেছে। এখানে উল্লেখ্য যে, ৫ কেজি কাঁচা কাজুবাদাম থেকে ১ কেজি প্রক্রিয়াজাত কাজুবাদাম পাওয়া যায় এবং মান অনুযায়ী ১ কেজি প্রক্রিয়াজাত কাজুবাদামের বাজারমূল্য ৮০০-১৭০০ টাকা।

২০১৯ সালে গ্রিন গ্রেইন গ্রুপ চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় আধুনিক মানের একটি কাজুবাদাম প্রক্রিয়াজাত শিল্প গড়ে তোলে। ২০২০ সালে গ্রিন গ্রেইন গ্রুপ বান্দরবনের কৃষকদের কাছ থেকে ৪০০ টন কাঁচা কাজুবাদাম সংগ্রহ করে তা প্রক্রিয়াজাত শুরু করে। এর পরপরই গ্রিন গ্রেইন গ্রুপ সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে কাজুবাদামের সরবরাহ আদেশ পায়। বাংলাদেশ স্টিল রি-রোলিং মিলস (বিএসআরএম) কাজুবাদাম প্রসেসিং প্লান্ট স্থাপনের জন্য চট্টগ্রামের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরে ১৫ একর জমি লিজের জন্য বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের কাছে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। বান্দরবন ও রাজশাহীতেও একটি করে প্রক্রিয়াজাত কারখানা গড়ে উঠেছে।

দেশে কাজুবাদামের উৎপাদন বৃদ্ধি এবং এটিকে কৃষির বাণিজ্যিক পণ্য হিসাবে রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা আহরণের জন্য কয়েকটি বিষয় বিবেচনায় নেয়া গুরুত্বপূর্ণ যেমন :

১) বাংলাদেশের প্রচলিত কাজুবাদামের উৎপাদন ক্ষমতা অন্যান্য দেশের বিশেষ করে ভিয়েতনাম এবং ভারতের প্রচলিত জাতের তুলনায় অত্যন্ত কম। আমাদের দেশে যে জাত পার্বত্য এলাকায় চাষ হয় তার শেল কাজুবাদামের এর আকার ছোট (৩-৪ গ্রাম) এবং প্রতি গাছে শেল কাজু পাওয়া যায় ৪-৫ কেজি। ভারতের পশ্চিমবঙ্গে যে জাতটি বেশি ফলন দেয় তার নাম জারগ্রাম-২। এ জাতটি গাছ প্রতি ১২-১৪ কেজি শেল কাজু ফলন দেয় এবং প্রতি শেল কাজুর গড় ওজন ৮-১০ গ্রাম। ভিয়েতনামে ৫টি উচ্চফলনশীল কাজুবাদাম চাষ করা হয় যার মধ্যে ৪টির ফলন অন্যান্য যে কোন দেশের চেয়ে অনেক বেশি। ভিয়েতনামের এই ৪টি জাতের নাম ঝববফ ঊঝ০৪, ঝববফকচ১২, ঝববফকচ১১ এবং ঝববফইউ০১ যাদের গাছপ্রতি শেল কাজু পাওয়া যায় ৪৫-৬৫ কেজি।

ভিয়েতনামের এই জাতগুলো দেশে প্রবর্তন করার ব্যবস্থা করা হলে কাজুবাদামের উৎপাদন উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাবে।

২) পার্বত্য তিন জেলার পাশাপাশি চট্টগ্রাম, সিলেট, মৌলভীবাজার, ময়মনসিংহ, শেরপুর, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর এর সীমান্তবর্তী পাহাড়ি এলাকা সেসঙ্গে নরসিংদী, গাজীপুর, টাঙ্গাইল, নারায়ণগঞ্জের লালমাটি এলাকায় যে পতিত জমি রয়েছেÑ তা কাজু চাষের আওতায় নিয়ে আসার ব্যবস্থা করা।

৩) আফ্রিকার দেশগুলোতে প্রচুর কাজুবাদাম উৎপাদন হলেও সেখানে প্রক্রিয়াজাতের তেমন ভালো শিল্প গড়ে উঠেনি। এমতাবস্থায় আমাদের দেশে প্রক্রিয়াজাত শিল্প খুব সহজেই গড়ে তোলা সম্ভব যেহেতু প্রতিবেশী ভারতে আধুনিক মানের কাজুবাদাম প্রক্রিয়াজাতের মেশিনারি পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে প্রাইভেট সেক্টরকে প্রয়োজনীয় জমির বন্দোবস্তসহ কারিগরি সহায়তা দিয়ে কাজুবাদামের শিল্পপ্রতিষ্ঠায় উৎসাহিত করার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।

[লেখক : এম এ আউয়াল, সদস্য পরিচালক, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল; এম মনির উদ্দিন, এগ্রোনোমিস্ট]