জাতীয় স্বেচ্ছায় রক্তদান ও মরণোত্তর চক্ষুদান দিবস

শারফুদ্দিন আহমেদ

আজ ২ নভেম্বর জাতীয় স্বেছায় রক্তদান ও মরণোত্তর চক্ষুদান দিবস। বাংলাদেশে স্বেছায় রক্তদান ও মরণোত্তর চক্ষুদান আন্দোলনের পথিকৃত ‘সন্ধানী’। রক্তদানের পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানটি মানুষের চক্ষু ব্যাংক হিসেবে কাজ করে। মৃত্যুর পূর্বে স্বেচ্ছাপ্রণোদিত চক্ষুদানের ব্যাপারে উৎসাহ প্রদান করে থাকে, যাতে ভবিষ্যতে কেউ ব্যবহার করতে পারেন। সমাজ সেবায় অবদানের জন্য ২০০৪ সালে বাংলাদেশ সরকার প্রতিষ্ঠানটিকে দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার স্বাধীনতা পুরস্কারে ঘোষিত করে।

১৯৭৮ সালের ২ নভেম্বর ডিএমসিএইচ ব্লাড ব্যাংকে সন্ধানী প্রথমবারের মতো স্বেচ্ছায় রক্তদান কর্মসূচির আয়োজন করে এবং পরবর্তীতে এই দিনটিকেই ‘জাতীয় স্বেচ্ছায় রক্তদান ও মরণোত্তর চক্ষুদান দিবস’ হিসেবে পালন করার ঘোষণা দেয়া হয়। ১৯৮২ সালে ‘সন্ধানী’ ডোনার ক্লাব এবং ১৯৮৪ সালে সন্ধানী চক্ষুদান সমিতি ও সন্ধানী জাতীয় চক্ষু ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়।

মরণোত্তর চক্ষুদান হলো মৃত্যুর পর কর্নিয়া দান করার জন্য জীবিত অবস্থায় অঙ্গীকার করা। মৃতের চোখের কর্নিয়া সংগ্রহ করে অন্যজনের চোখে লাগানোর ইচ্ছা ও সম্মতিই ‘মরণোত্তর চক্ষুদান’ নামে পরিচিত। উল্লেখ্য মৃত্যুর পরও মৃত ব্যক্তির বৈধ অবিভাবকেরাও কর্নিয়া দান করতে পারেন। মারা যাবার পর মৃত ব্যক্তির কর্নিয়া ৬ ঘণ্টার মধ্যে সংগ্রহ করতে হবে। কোথাও কোথাও ১২-২৪ ঘণ্টার মধ্যে সংগ্রহের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু সেটা সঠিক নয়। ছয় ঘণ্টার মধ্যে কর্নিয়া সংগ্রহ না করলে কর্নিয়া সেলের সংখ্যা কমে যায়।

জীবিত অবস্থায় প্রাপ্তবয়স্ক সুস্থ নারী পুরুষ মরণোত্তর চক্ষুদানে অঙ্গীকার করতে পারেন। পরিচিত মানুষের চক্ষুদানের বিষয়টি আগে থেকেই অবগত করে রাখতে হবে, যাতে দাতার মৃত্যুর পর তাদের মধ্যে দায়িত্বশীল কেউ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি সম্পর্কে দ্রুত অবগত করতে পারেন।

রক্তদানের বেশ কিছু উপকারিতা রয়েছে। ১৮ থেকে ৬৫ বছর বয়সী যেকোন সুস্থ মানুষ যাদের ওজন ৪৫ কেজির বেশি তারা প্রতি চার মাস পর পর রক্তদান করতে পারেন। চার মাস পর পর মানবদেহে নতুন রক্ত তৈরি হয় এবং রক্তকনিকাগুলো এমনিতেই মারা যায়। রক্তদান করলে শরীরের মধ্যে অবস্থিত ‘বোন ম্যারো’ নতুন কনিকা তৈরির জন্য শক্তি পায়। রক্তদানে শরীরে লোহিত কনিকাগুলোর কর্মচাঞ্চল্য বেড়ে যায়।

নিয়মিত রক্তদানে রক্তের কোলেস্টেরলের উপস্থিতি কমাতেও সাহায্য করে। স্বেচ্ছায় রক্তদানের মাধ্যমে মানুষ বিনা মূল্যে জানতে পারে নিজের শরীরে হেপাটাইটিসি-বি, হেপাটাইটিস-সি, সিফিলিস, ম্যালেরিয়া এবং এইচআইভি (এইডস) এর মতো জটিল কোনো রোগ রয়েছে কিনা। সবচেয়ে বড় কথা হলো, রক্তদানের মাধ্যমে একজন মুমূর্ষু মানুষকে বাঁচানোর মতো কাজে শরিক হতে পেরে নিজের মানসিক তৃপ্তি মেলে।

অনেকে চক্ষুদান বিষয়ে নানা দ্বিধা-দ্বন্দে ভোগেন। এর মূল কারণ সচেতনতার অভাব অথবা ধর্মীয় ভুল ব্যাখ্যা। এজন্য অনেকে চক্ষুদান করার ব্যাপারে সম্মতি দিলেও নিকটাত্মীয়রা মৃত ব্যক্তির অঙ্গ নেয়ার বিষয়টি মেনে নিতে পারেন না।

মরণোত্তর চক্ষুদান ছাড়াও কিডনি, লিভার, হার্ট, অগ্ন্যাশয়, ফুসফুস, ক্ষুদ্রান্ত দান করা যায়। ধর্মীয় দিক দিয়েও অঙ্গদানে কোন বাধা নেই। সব ধর্মে মরণোত্তর অঙ্গদানের কথা বলা হয়েছে। অঙ্গদানে মানুষের প্রাণ বাঁচানো সহজ। অঙ্গদানে একটা প্রাণ বাঁচছে, অথচ দাতা ব্যক্তির কোনো ক্ষতি হচ্ছে না। কারণ তিনি মৃত। বাংলাদেশে অঙ্গদান-সংক্রান্ত আইন থাকা দরকার। আর দরকার কেন্দ্রীয় ইলেকট্রনিক ডেটা-বেসড রেজিস্ট্রি, যাতে দাতা ও গ্রহীতার নাম ও বিবরণ চিকিৎসকরা জানতে পারেন।

[লেখক : উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়]

মঙ্গলবার, ০২ নভেম্বর ২০২১ , ১৭ কার্তিক ১৪২৮ ২৫ রবিউল আউয়াল ১৪৪৩

জাতীয় স্বেচ্ছায় রক্তদান ও মরণোত্তর চক্ষুদান দিবস

শারফুদ্দিন আহমেদ

আজ ২ নভেম্বর জাতীয় স্বেছায় রক্তদান ও মরণোত্তর চক্ষুদান দিবস। বাংলাদেশে স্বেছায় রক্তদান ও মরণোত্তর চক্ষুদান আন্দোলনের পথিকৃত ‘সন্ধানী’। রক্তদানের পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানটি মানুষের চক্ষু ব্যাংক হিসেবে কাজ করে। মৃত্যুর পূর্বে স্বেচ্ছাপ্রণোদিত চক্ষুদানের ব্যাপারে উৎসাহ প্রদান করে থাকে, যাতে ভবিষ্যতে কেউ ব্যবহার করতে পারেন। সমাজ সেবায় অবদানের জন্য ২০০৪ সালে বাংলাদেশ সরকার প্রতিষ্ঠানটিকে দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার স্বাধীনতা পুরস্কারে ঘোষিত করে।

১৯৭৮ সালের ২ নভেম্বর ডিএমসিএইচ ব্লাড ব্যাংকে সন্ধানী প্রথমবারের মতো স্বেচ্ছায় রক্তদান কর্মসূচির আয়োজন করে এবং পরবর্তীতে এই দিনটিকেই ‘জাতীয় স্বেচ্ছায় রক্তদান ও মরণোত্তর চক্ষুদান দিবস’ হিসেবে পালন করার ঘোষণা দেয়া হয়। ১৯৮২ সালে ‘সন্ধানী’ ডোনার ক্লাব এবং ১৯৮৪ সালে সন্ধানী চক্ষুদান সমিতি ও সন্ধানী জাতীয় চক্ষু ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়।

মরণোত্তর চক্ষুদান হলো মৃত্যুর পর কর্নিয়া দান করার জন্য জীবিত অবস্থায় অঙ্গীকার করা। মৃতের চোখের কর্নিয়া সংগ্রহ করে অন্যজনের চোখে লাগানোর ইচ্ছা ও সম্মতিই ‘মরণোত্তর চক্ষুদান’ নামে পরিচিত। উল্লেখ্য মৃত্যুর পরও মৃত ব্যক্তির বৈধ অবিভাবকেরাও কর্নিয়া দান করতে পারেন। মারা যাবার পর মৃত ব্যক্তির কর্নিয়া ৬ ঘণ্টার মধ্যে সংগ্রহ করতে হবে। কোথাও কোথাও ১২-২৪ ঘণ্টার মধ্যে সংগ্রহের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু সেটা সঠিক নয়। ছয় ঘণ্টার মধ্যে কর্নিয়া সংগ্রহ না করলে কর্নিয়া সেলের সংখ্যা কমে যায়।

জীবিত অবস্থায় প্রাপ্তবয়স্ক সুস্থ নারী পুরুষ মরণোত্তর চক্ষুদানে অঙ্গীকার করতে পারেন। পরিচিত মানুষের চক্ষুদানের বিষয়টি আগে থেকেই অবগত করে রাখতে হবে, যাতে দাতার মৃত্যুর পর তাদের মধ্যে দায়িত্বশীল কেউ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি সম্পর্কে দ্রুত অবগত করতে পারেন।

রক্তদানের বেশ কিছু উপকারিতা রয়েছে। ১৮ থেকে ৬৫ বছর বয়সী যেকোন সুস্থ মানুষ যাদের ওজন ৪৫ কেজির বেশি তারা প্রতি চার মাস পর পর রক্তদান করতে পারেন। চার মাস পর পর মানবদেহে নতুন রক্ত তৈরি হয় এবং রক্তকনিকাগুলো এমনিতেই মারা যায়। রক্তদান করলে শরীরের মধ্যে অবস্থিত ‘বোন ম্যারো’ নতুন কনিকা তৈরির জন্য শক্তি পায়। রক্তদানে শরীরে লোহিত কনিকাগুলোর কর্মচাঞ্চল্য বেড়ে যায়।

নিয়মিত রক্তদানে রক্তের কোলেস্টেরলের উপস্থিতি কমাতেও সাহায্য করে। স্বেচ্ছায় রক্তদানের মাধ্যমে মানুষ বিনা মূল্যে জানতে পারে নিজের শরীরে হেপাটাইটিসি-বি, হেপাটাইটিস-সি, সিফিলিস, ম্যালেরিয়া এবং এইচআইভি (এইডস) এর মতো জটিল কোনো রোগ রয়েছে কিনা। সবচেয়ে বড় কথা হলো, রক্তদানের মাধ্যমে একজন মুমূর্ষু মানুষকে বাঁচানোর মতো কাজে শরিক হতে পেরে নিজের মানসিক তৃপ্তি মেলে।

অনেকে চক্ষুদান বিষয়ে নানা দ্বিধা-দ্বন্দে ভোগেন। এর মূল কারণ সচেতনতার অভাব অথবা ধর্মীয় ভুল ব্যাখ্যা। এজন্য অনেকে চক্ষুদান করার ব্যাপারে সম্মতি দিলেও নিকটাত্মীয়রা মৃত ব্যক্তির অঙ্গ নেয়ার বিষয়টি মেনে নিতে পারেন না।

মরণোত্তর চক্ষুদান ছাড়াও কিডনি, লিভার, হার্ট, অগ্ন্যাশয়, ফুসফুস, ক্ষুদ্রান্ত দান করা যায়। ধর্মীয় দিক দিয়েও অঙ্গদানে কোন বাধা নেই। সব ধর্মে মরণোত্তর অঙ্গদানের কথা বলা হয়েছে। অঙ্গদানে মানুষের প্রাণ বাঁচানো সহজ। অঙ্গদানে একটা প্রাণ বাঁচছে, অথচ দাতা ব্যক্তির কোনো ক্ষতি হচ্ছে না। কারণ তিনি মৃত। বাংলাদেশে অঙ্গদান-সংক্রান্ত আইন থাকা দরকার। আর দরকার কেন্দ্রীয় ইলেকট্রনিক ডেটা-বেসড রেজিস্ট্রি, যাতে দাতা ও গ্রহীতার নাম ও বিবরণ চিকিৎসকরা জানতে পারেন।

[লেখক : উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়]