মাথাপিছু ভাড়া ১০ টাকা
ছোট্ট রেলস্টেশন, অর্ধশতাধিক যাত্রীর জটলা! ট্রেন এসে থামল প্ল্যাটফর্মের বাইরের লাইনে! মুহূর্তে হুড়োহুড়ি পড়ে গেল। কোথা থেকে দু’জন এসে ট্রেনের দরজার সামনে জুড়ে দিল মই। সেই মই বেয়ে ঝুঁকি নিয়ে ট্রেনে উঠলেন যাত্রীরা। কেউবা হাতল ধরে ঝুলে ঝুলেও ঢুকলেন ভেতরে।
গত সোমবার এ দৃশ্য এটি। জানা যায় ১৩ বছর থেকে চলছে এমন ঘটনা। বলছি নাটোরের বাগাতিপাড়া উপজেলার মালঞ্চি রেল স্টেশনের কথা। ট্রেন আসার আগেই কথা হয় অপেক্ষমান যাত্রীদের সঙ্গে। তারা জানান, এ স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে ট্রেন থামে না। থামে বাইরের লাইনে। তাই মই বেয়ে ঝুঁকি নিয়েই উঠতে হয়। এ জন্য মাথাপিছু ১০ টাকা করে দিতে হয় সাহায্যকারীদের।
মালঞ্চি রেলস্টেশনে টিকিট কাটার কোন ব্যবস্থা নেই। তাই যাত্রীরা এখান থেকে বিনা টিকিটেই ট্রেনে ওঠে। এ কারণে নানা বিড়ম্বনায়ও পড়তে হয় তাদের। অনেকেই বিনা টিকিটে ভ্রমণের জন্য জেল-জরিমানার শিকার হয়েছে। স্টেশনটি সরকারিভাবে বন্ধ করা না হলেও একজন নৈশপ্রহরী ছাড়া কেউ নেই এখানে। সেই প্রহরী হিসেবে আছেন আব্দুস সালাম।
আব্দুস সালাম জানান, ২০০৩ সাল থেকে এ স্টেশনে জনবল কমতে শুরু করে। ২০০৮ সালে জনবলশূন্য হয়ে পড়ে স্টেশনটি। এখানে একটি সরাসরি এবং প্ল্যাটফর্ম-সংলগ্ন দু’টিসহ মোট তিনটি ক্রসিং লাইন রয়েছে। পয়েন্টসম্যান না থাকায় ক্রসিং লাইনে ট্রেনের গতিপথ পরিবর্তন করা সম্ভব হয় না। এ কারণে সব ট্রেন সরাসরি লাইনটি দিয়ে চলাচল করে। এই লাইন নিয়ন্ত্রণ করে মালঞ্চি স্টেশনের দুই পাশের স্টেশন নাটোর ও আব্দুলপুর।
আব্দুস সালাম বলেন, আগে এ স্টেশনে পাঁচটি ট্রেনে যাত্রী ওঠানামা করতেন। এখন পার্বতীপুর থেকে ছেড়ে আসা রাজশাহীগামী উত্তরা এক্সপ্রেস ও চিলাহাটি থেকে ছেড়ে আসা খুলনাগামী মেইল ট্রেন যাত্রাবিরতি করে। ট্রেন দুটি প্ল্যাটফর্মের বাইরের লাইনে থামার কারণে যাত্রীরা ওঠানামার জন্য মই ব্যবহার করেন। এতে যাত্রীদের, বিশেষ করে নারী, শিশু ও বয়স্কদের ভোগান্তিতে পড়তে হয়।
গত শনিবার সকালে দেখা গেল, স্টেশনটির প্রধান ফটকে তালা ঝুলছে। স্টেশন মাস্টারের কার্যালয়ের সামনে কুকুর-বিড়াল ও ছাগল ঘুমাচ্ছে। প্ল্যাটফর্ম জনমানবশূন্য। তবে প্ল্যাটফর্মের বাইরে অর্ধশতাধিক যাত্রী ট্রেনের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে।
ইদ্রিস আলী(৭০) নামের এক যাত্রী জানান, রাজশাহীতে ডাক্তার দেখাতে যাওয়ার জন্য তিনি ট্রেনের অপেক্ষায় আছেন। কিন্তু ট্রেনে উঠবেন কী করে, তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন।
কথা বলতে বলতেই রাজশাহীগামী উত্তরা এক্সপ্রেস ট্রেন এসে প্ল্যাটফর্মের বাইরের লাইনে দাঁড়ায়। মুহূর্তেই দুই ব্যক্তি মই হাতে ছুটে আসেন। তারা ট্রেনের দরজায় মই বসিয়ে যাত্রীদের ওঠানামা করান। বিনিময়ে মাথাপিছু ১০ টাকা নেন।
মশিউর রহমান নামের এক মইওয়ালা বললেন, ‘দুর্বল যাত্রীদের নিরাপদে ওঠানামা করায়ে আমরা পেটের ভাত জোগাড় করি। এতে যাত্রীরা অসন্তুষ্ট হন না।’
স্টেশনটির পাশেই মালঞ্চি বাজার। সেখানে কথা হয়, উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুুল হাদীর সঙ্গে।
তিনি বলেন, আশপাশে সড়ক ও নৌ যোগাযোগ না থাকায় ১৯২৭ সালে মালঞ্চি রেলস্টেশন স্থাপিত হয়। এখনও সে অবস্থার তেমন উন্নতি হয়নি। স্টেশনের পাশে উপজেলা পরিষদ থাকায় সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অনেকেই ট্রেনে যাতায়াত করেন। পাশেই রয়েছে কাদিরাবাদ ক্যান্টনমেন্ট ও বাংলাদেশ আর্মি ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজির (বাউয়েট) মতো বড় বড় প্রতিষ্ঠান। অথচ বর্তমানে লোকবলের অভাবে স্টেশনটি ২৪ ঘণ্টা তালাবদ্ধ থাকে। উপজেলা পরিষদের পক্ষ থেকে বারবার বিষয়টি জানানোর পরও সমস্যার সমাধান হয়নি।
নাটোর রেলস্টেশনের মাস্টার অশোক কুমার চক্রবর্তী অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে মালঞ্চি স্টেশনের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি মুঠোফোনে বলেন, মূলত জনবলসংকটের কারণে স্টেশনটির এই দুরবস্থা। কয়েকবার স্টেশনটি পুরোদমে চালুর চেষ্টা করা হলেও পরে তা সম্ভব হয়নি। নতুন করে জনবল নিয়োগ শুরু হয়েছে। প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগ দেওয়া হলে স্টেশনটির সমস্যার সমাধান হবে।
বাগাতিপাড়া (নাটোর) : প্ল্যাটফর্মের বাইরের লাইনে থামা ট্রেনে মই বেয়ে উঠছেন যাত্রীরা -সংবাদ
আরও খবরবুধবার, ০৩ নভেম্বর ২০২১ , ১৮ কার্তিক ১৪২৮ ২৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৩
মাথাপিছু ভাড়া ১০ টাকা
প্রতিনিধি, বাগাতিপাড়া (নাটোর)
বাগাতিপাড়া (নাটোর) : প্ল্যাটফর্মের বাইরের লাইনে থামা ট্রেনে মই বেয়ে উঠছেন যাত্রীরা -সংবাদ
ছোট্ট রেলস্টেশন, অর্ধশতাধিক যাত্রীর জটলা! ট্রেন এসে থামল প্ল্যাটফর্মের বাইরের লাইনে! মুহূর্তে হুড়োহুড়ি পড়ে গেল। কোথা থেকে দু’জন এসে ট্রেনের দরজার সামনে জুড়ে দিল মই। সেই মই বেয়ে ঝুঁকি নিয়ে ট্রেনে উঠলেন যাত্রীরা। কেউবা হাতল ধরে ঝুলে ঝুলেও ঢুকলেন ভেতরে।
গত সোমবার এ দৃশ্য এটি। জানা যায় ১৩ বছর থেকে চলছে এমন ঘটনা। বলছি নাটোরের বাগাতিপাড়া উপজেলার মালঞ্চি রেল স্টেশনের কথা। ট্রেন আসার আগেই কথা হয় অপেক্ষমান যাত্রীদের সঙ্গে। তারা জানান, এ স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে ট্রেন থামে না। থামে বাইরের লাইনে। তাই মই বেয়ে ঝুঁকি নিয়েই উঠতে হয়। এ জন্য মাথাপিছু ১০ টাকা করে দিতে হয় সাহায্যকারীদের।
মালঞ্চি রেলস্টেশনে টিকিট কাটার কোন ব্যবস্থা নেই। তাই যাত্রীরা এখান থেকে বিনা টিকিটেই ট্রেনে ওঠে। এ কারণে নানা বিড়ম্বনায়ও পড়তে হয় তাদের। অনেকেই বিনা টিকিটে ভ্রমণের জন্য জেল-জরিমানার শিকার হয়েছে। স্টেশনটি সরকারিভাবে বন্ধ করা না হলেও একজন নৈশপ্রহরী ছাড়া কেউ নেই এখানে। সেই প্রহরী হিসেবে আছেন আব্দুস সালাম।
আব্দুস সালাম জানান, ২০০৩ সাল থেকে এ স্টেশনে জনবল কমতে শুরু করে। ২০০৮ সালে জনবলশূন্য হয়ে পড়ে স্টেশনটি। এখানে একটি সরাসরি এবং প্ল্যাটফর্ম-সংলগ্ন দু’টিসহ মোট তিনটি ক্রসিং লাইন রয়েছে। পয়েন্টসম্যান না থাকায় ক্রসিং লাইনে ট্রেনের গতিপথ পরিবর্তন করা সম্ভব হয় না। এ কারণে সব ট্রেন সরাসরি লাইনটি দিয়ে চলাচল করে। এই লাইন নিয়ন্ত্রণ করে মালঞ্চি স্টেশনের দুই পাশের স্টেশন নাটোর ও আব্দুলপুর।
আব্দুস সালাম বলেন, আগে এ স্টেশনে পাঁচটি ট্রেনে যাত্রী ওঠানামা করতেন। এখন পার্বতীপুর থেকে ছেড়ে আসা রাজশাহীগামী উত্তরা এক্সপ্রেস ও চিলাহাটি থেকে ছেড়ে আসা খুলনাগামী মেইল ট্রেন যাত্রাবিরতি করে। ট্রেন দুটি প্ল্যাটফর্মের বাইরের লাইনে থামার কারণে যাত্রীরা ওঠানামার জন্য মই ব্যবহার করেন। এতে যাত্রীদের, বিশেষ করে নারী, শিশু ও বয়স্কদের ভোগান্তিতে পড়তে হয়।
গত শনিবার সকালে দেখা গেল, স্টেশনটির প্রধান ফটকে তালা ঝুলছে। স্টেশন মাস্টারের কার্যালয়ের সামনে কুকুর-বিড়াল ও ছাগল ঘুমাচ্ছে। প্ল্যাটফর্ম জনমানবশূন্য। তবে প্ল্যাটফর্মের বাইরে অর্ধশতাধিক যাত্রী ট্রেনের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে।
ইদ্রিস আলী(৭০) নামের এক যাত্রী জানান, রাজশাহীতে ডাক্তার দেখাতে যাওয়ার জন্য তিনি ট্রেনের অপেক্ষায় আছেন। কিন্তু ট্রেনে উঠবেন কী করে, তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন।
কথা বলতে বলতেই রাজশাহীগামী উত্তরা এক্সপ্রেস ট্রেন এসে প্ল্যাটফর্মের বাইরের লাইনে দাঁড়ায়। মুহূর্তেই দুই ব্যক্তি মই হাতে ছুটে আসেন। তারা ট্রেনের দরজায় মই বসিয়ে যাত্রীদের ওঠানামা করান। বিনিময়ে মাথাপিছু ১০ টাকা নেন।
মশিউর রহমান নামের এক মইওয়ালা বললেন, ‘দুর্বল যাত্রীদের নিরাপদে ওঠানামা করায়ে আমরা পেটের ভাত জোগাড় করি। এতে যাত্রীরা অসন্তুষ্ট হন না।’
স্টেশনটির পাশেই মালঞ্চি বাজার। সেখানে কথা হয়, উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুুল হাদীর সঙ্গে।
তিনি বলেন, আশপাশে সড়ক ও নৌ যোগাযোগ না থাকায় ১৯২৭ সালে মালঞ্চি রেলস্টেশন স্থাপিত হয়। এখনও সে অবস্থার তেমন উন্নতি হয়নি। স্টেশনের পাশে উপজেলা পরিষদ থাকায় সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অনেকেই ট্রেনে যাতায়াত করেন। পাশেই রয়েছে কাদিরাবাদ ক্যান্টনমেন্ট ও বাংলাদেশ আর্মি ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজির (বাউয়েট) মতো বড় বড় প্রতিষ্ঠান। অথচ বর্তমানে লোকবলের অভাবে স্টেশনটি ২৪ ঘণ্টা তালাবদ্ধ থাকে। উপজেলা পরিষদের পক্ষ থেকে বারবার বিষয়টি জানানোর পরও সমস্যার সমাধান হয়নি।
নাটোর রেলস্টেশনের মাস্টার অশোক কুমার চক্রবর্তী অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে মালঞ্চি স্টেশনের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি মুঠোফোনে বলেন, মূলত জনবলসংকটের কারণে স্টেশনটির এই দুরবস্থা। কয়েকবার স্টেশনটি পুরোদমে চালুর চেষ্টা করা হলেও পরে তা সম্ভব হয়নি। নতুন করে জনবল নিয়োগ শুরু হয়েছে। প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগ দেওয়া হলে স্টেশনটির সমস্যার সমাধান হবে।