পিটিয়ে হত্যা করে অপমৃত্যুর মামলা পুলিশেরই

স্বজনদের থানায় ডেকে সাদা কাগজে সই করিয়ে নেয়

রংপুরের হারাগাছে যুবককে পিটিয়ে হত্যা ও থানা ঘেরাও করে বিক্ষোভের ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে দুটি মামলা দায়ের করেছে। এর একটি থানায় হামলা, ভাঙচুর ও সরকারি কাজে বাধা প্রদান। অপরটি ইউডি মামলা, যা অপমৃত্যুর ক্ষেত্রে দায়ের করা হয়। গত সোমবার রাতেই পুলিশ তাজুলের স্বজনদের থানায় ডেকে নিয়ে কয়েকটি সাদা কাগজে স্বাক্ষর নেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

এলাকাবাসীর অভিযোগ, তাজুলকে পুলিশের এএসআই রেয়াজুল ইসলাম কোন কারণ ছাড়াই নয়াবাজার এলাকা থেকে সোমবার সন্ধ্যায় আটক করে হ্যান্ডকাপ পরিয়ে নির্যাতন করলে ঘটনাস্থলেই তিনি মারা যান। এ ঘটনায় দায়ী পুলিশ সদস্যদের বিচার দাবি করেন তারা।

প্রত্যক্ষদর্শী নতুন বাজার এলাকার আফজাল জানান, ‘আমাদের সামনেই পুলিশ তাজুলকে আটক করে হাতে হ্যান্ডকাপ লাগালো, নির্যাতন করলো। আমাদের সামনেই সে মারা গেল। অথচ পুলিশ এখন বলছে, সে মাদক সেবী ও ব্যবসায়ী; এটা পুরোপুরি বানানো এবং মিথ্যা।

অন্য এক প্রত্যক্ষদর্শী সোহরাব হোসেন জানান, বাজারে প্রকাশ্যে তাজুলকে আটক করে হাতে হ্যান্ডকাপ পরিয়ে পিটিয়ে হত্যার ঘটনাকে পুলিশ এখন ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করছে। এলাকাবাসী অভিযোগ করেছে তাজুল ইসলাম মাদক সেবী নয় এবং মাদক ব্যবসায়ীও নয়। তাকে অন্যায়ভাবে আটক করে নির্যাতন করে হত্যা করেছে পুলিশ।

নিহত তাজুল ইসলামের এক স্বজন অভিযোগ করেন, সোমবার মধ্যরাতে পুলিশ বাসায় গিয়ে তার স্বজনদের থানায় ডেকে আনেন। এরপর কয়েকটি সাদা কাগজে স্বাক্ষর নেন।

গতকাল ঘটনাস্থল নতুন বাজার পাকার মাথা এলাকায় গিয়ে বিভিন্নস্তরের মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শত শত মানুষ নিহত তাজুল ইসলামকে নির্যাতনের ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছে।

এলাকাবাসী জানায়, তাজুল পরিচিত কাউকে দেখা পেলে ২০/৩০ টাকা সাহায্য চাইতো। মাদক সেবন করতো কিনা তার প্রমাণ পাওয়া যায়নি। যদিও পুলিশ দাবি করেছে সে মাদক সেবী। এলাকাবাসীর অভিযোগ সে মাদক ব্যবসায়ী নয় এটা এলাকার সকলেই জানেন। বয়স ৫০ বছরের উপরে হলেও সে বিয়ে করেনি। সংসারে অসচ্ছলতা ও অভাবের তাড়নায় মানুষের কাছে সাহায্য নিয়ে চলতো। এমন একজন নিরাপরাধ ব্যক্তিকে পুলিশ কেন গ্রেপ্তারের নাটক করলো, হাতে হাতকড়া পরালো?

এলাকাবাসীর অভিযোগ, ঘটনার মূল হোতা এএসআই রেয়াজুল ইসলামের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা না নিয়ে বরং তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে পুলিশ। সে কারণে তাজুল ইসলামের নিহত হবার ঘটনার খবর জানাজানি হলে শত শত জনতা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। সন্ধ্যার পর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত পুলিশের সঙ্গে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া সংঘর্ষ হয়। পরে রংপুর থেকে অতিরিক্ত পুলিশ, রায়ট কার পানিবাহি গাড়ি, রাবার বুলেট, টিয়ার সেল ও ফাঁকা গুলি করেও বিক্ষুব্ধ জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে পারেনি।

গভীর রাতে রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের ডিসি (ক্রাইম) মারুফ হোসেন সাংবাদিকদের জানান, মৃত তাজুল ইসলাম মাদক ব্যবসায়ী ও মাদক সেবী। পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করলে সে হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছে।

তিনি দাবি করেন, এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে কিছু সুবিধাবাদী লোক থানায় হামলা করে ব্যাপক ক্ষতি সাধন করেছে। এসব ঘটনায় থানায় দুটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এর মধ্যে পুলিশের কাজে বাধা, হামলা এবং থানায় আক্রমণ করে ভাঙচুর। অন্য একটি অস্বাভাবিক মৃত্যুর মামলা হয়েছে। এ ঘটনায় কাউকেই গ্রেপ্তার করা হয়নি। তবে এলাকাবাসী জানিয়েছে ৫/৬ জনকে ধরে নিয়ে গেছে পুলিশ।

ঘটনার পর থেকে হারাগাছ পৌর এলাকার পরিস্থিতি ছিল থমথমে। কিছু দোকানপাট খুললেও সাধারণ মানুষের উপস্থিতি ছিল কম। পুরো হারাগাছ পৌর এলাকা জুড়ে বিপুল সংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। সেই সঙ্গে রায়ট কার ও পানিবাহি গাড়ি মোতায়েন করা হয়েছে।

সোমবার গভীর রাতে পুলিশ নিহত তাজুল ইসলামের মরদেহ ঘটনাস্থল নতুন বাজার এলাকা থেকে উদ্ধার ময়নাতদন্তের জন্য রংপুর মেডিকেল কলেজের মর্গে পাঠায়। গতকাল দুপুর আড়াইটার দিকে ময়নাতদন্ত শেষে মরদেহ অ্যাম্বুলেন্সে করে পুলিশি পাহারায় নিহত তাজুল ইসলামের বাড়ি সাবানটারী গ্রামে নিয়ে যাওয়া হয়। এ সময় তার দুই ভাই আবু ও লোটাস উপস্থিত ছিলেন। বাদ আসর নিহত তাজুল ইসলামের জানাজা স্থানীয় সাদা মসজিদ প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হয়। পরে তাকে পারিবারিক গোরস্থানে দাফন করা হয়।

এ সময় পুলিশের অঘোষিত নিষেধাজ্ঞার কারণে নিহত তাজুল ইসলামের স্বজনরা সাংবাদিকদের সামনে কোন কথা বলতে রাজি হননি। তারা বলেছে, পুলিশ নিষেধ করেছে।

এদিকে জনতার দাবির মুখে নিহত তাজুল ইসলামের মরদেহ গতকাল সকালে নির্বাহি ম্যাজিষ্ট্রেট মেহেদী হাসান সুরত হাল রিপোর্ট তৈরি করেন।

সার্বিক বিষয়ে জানতে রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের ডিসি (ক্রাইম) মারুফ হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি সংবাদকে বলেন, তাজুল মাদক সেবী ছিল এটা জানা গেছে। পুরো ঘটনা তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া হবে। এদিকে ডিসি মারুফ ছাড়া গতকাল দিনভর হারাগাছ থানার ওসিসহ কোন পুলিশ কর্মকর্তাই সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে রাজি হননি। দফায় দফায় ফোন করা হলেও তারা কেউই ফোন রিসিভ করেননি।

বুধবার, ০৩ নভেম্বর ২০২১ , ১৮ কার্তিক ১৪২৮ ২৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৩

পিটিয়ে হত্যা করে অপমৃত্যুর মামলা পুলিশেরই

স্বজনদের থানায় ডেকে সাদা কাগজে সই করিয়ে নেয়

লিয়াকত আলী বাদল, রংপুর

রংপুরের হারাগাছে যুবককে পিটিয়ে হত্যা ও থানা ঘেরাও করে বিক্ষোভের ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে দুটি মামলা দায়ের করেছে। এর একটি থানায় হামলা, ভাঙচুর ও সরকারি কাজে বাধা প্রদান। অপরটি ইউডি মামলা, যা অপমৃত্যুর ক্ষেত্রে দায়ের করা হয়। গত সোমবার রাতেই পুলিশ তাজুলের স্বজনদের থানায় ডেকে নিয়ে কয়েকটি সাদা কাগজে স্বাক্ষর নেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

এলাকাবাসীর অভিযোগ, তাজুলকে পুলিশের এএসআই রেয়াজুল ইসলাম কোন কারণ ছাড়াই নয়াবাজার এলাকা থেকে সোমবার সন্ধ্যায় আটক করে হ্যান্ডকাপ পরিয়ে নির্যাতন করলে ঘটনাস্থলেই তিনি মারা যান। এ ঘটনায় দায়ী পুলিশ সদস্যদের বিচার দাবি করেন তারা।

প্রত্যক্ষদর্শী নতুন বাজার এলাকার আফজাল জানান, ‘আমাদের সামনেই পুলিশ তাজুলকে আটক করে হাতে হ্যান্ডকাপ লাগালো, নির্যাতন করলো। আমাদের সামনেই সে মারা গেল। অথচ পুলিশ এখন বলছে, সে মাদক সেবী ও ব্যবসায়ী; এটা পুরোপুরি বানানো এবং মিথ্যা।

অন্য এক প্রত্যক্ষদর্শী সোহরাব হোসেন জানান, বাজারে প্রকাশ্যে তাজুলকে আটক করে হাতে হ্যান্ডকাপ পরিয়ে পিটিয়ে হত্যার ঘটনাকে পুলিশ এখন ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করছে। এলাকাবাসী অভিযোগ করেছে তাজুল ইসলাম মাদক সেবী নয় এবং মাদক ব্যবসায়ীও নয়। তাকে অন্যায়ভাবে আটক করে নির্যাতন করে হত্যা করেছে পুলিশ।

নিহত তাজুল ইসলামের এক স্বজন অভিযোগ করেন, সোমবার মধ্যরাতে পুলিশ বাসায় গিয়ে তার স্বজনদের থানায় ডেকে আনেন। এরপর কয়েকটি সাদা কাগজে স্বাক্ষর নেন।

গতকাল ঘটনাস্থল নতুন বাজার পাকার মাথা এলাকায় গিয়ে বিভিন্নস্তরের মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শত শত মানুষ নিহত তাজুল ইসলামকে নির্যাতনের ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছে।

এলাকাবাসী জানায়, তাজুল পরিচিত কাউকে দেখা পেলে ২০/৩০ টাকা সাহায্য চাইতো। মাদক সেবন করতো কিনা তার প্রমাণ পাওয়া যায়নি। যদিও পুলিশ দাবি করেছে সে মাদক সেবী। এলাকাবাসীর অভিযোগ সে মাদক ব্যবসায়ী নয় এটা এলাকার সকলেই জানেন। বয়স ৫০ বছরের উপরে হলেও সে বিয়ে করেনি। সংসারে অসচ্ছলতা ও অভাবের তাড়নায় মানুষের কাছে সাহায্য নিয়ে চলতো। এমন একজন নিরাপরাধ ব্যক্তিকে পুলিশ কেন গ্রেপ্তারের নাটক করলো, হাতে হাতকড়া পরালো?

এলাকাবাসীর অভিযোগ, ঘটনার মূল হোতা এএসআই রেয়াজুল ইসলামের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা না নিয়ে বরং তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে পুলিশ। সে কারণে তাজুল ইসলামের নিহত হবার ঘটনার খবর জানাজানি হলে শত শত জনতা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। সন্ধ্যার পর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত পুলিশের সঙ্গে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া সংঘর্ষ হয়। পরে রংপুর থেকে অতিরিক্ত পুলিশ, রায়ট কার পানিবাহি গাড়ি, রাবার বুলেট, টিয়ার সেল ও ফাঁকা গুলি করেও বিক্ষুব্ধ জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে পারেনি।

গভীর রাতে রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের ডিসি (ক্রাইম) মারুফ হোসেন সাংবাদিকদের জানান, মৃত তাজুল ইসলাম মাদক ব্যবসায়ী ও মাদক সেবী। পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করলে সে হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছে।

তিনি দাবি করেন, এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে কিছু সুবিধাবাদী লোক থানায় হামলা করে ব্যাপক ক্ষতি সাধন করেছে। এসব ঘটনায় থানায় দুটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এর মধ্যে পুলিশের কাজে বাধা, হামলা এবং থানায় আক্রমণ করে ভাঙচুর। অন্য একটি অস্বাভাবিক মৃত্যুর মামলা হয়েছে। এ ঘটনায় কাউকেই গ্রেপ্তার করা হয়নি। তবে এলাকাবাসী জানিয়েছে ৫/৬ জনকে ধরে নিয়ে গেছে পুলিশ।

ঘটনার পর থেকে হারাগাছ পৌর এলাকার পরিস্থিতি ছিল থমথমে। কিছু দোকানপাট খুললেও সাধারণ মানুষের উপস্থিতি ছিল কম। পুরো হারাগাছ পৌর এলাকা জুড়ে বিপুল সংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। সেই সঙ্গে রায়ট কার ও পানিবাহি গাড়ি মোতায়েন করা হয়েছে।

সোমবার গভীর রাতে পুলিশ নিহত তাজুল ইসলামের মরদেহ ঘটনাস্থল নতুন বাজার এলাকা থেকে উদ্ধার ময়নাতদন্তের জন্য রংপুর মেডিকেল কলেজের মর্গে পাঠায়। গতকাল দুপুর আড়াইটার দিকে ময়নাতদন্ত শেষে মরদেহ অ্যাম্বুলেন্সে করে পুলিশি পাহারায় নিহত তাজুল ইসলামের বাড়ি সাবানটারী গ্রামে নিয়ে যাওয়া হয়। এ সময় তার দুই ভাই আবু ও লোটাস উপস্থিত ছিলেন। বাদ আসর নিহত তাজুল ইসলামের জানাজা স্থানীয় সাদা মসজিদ প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হয়। পরে তাকে পারিবারিক গোরস্থানে দাফন করা হয়।

এ সময় পুলিশের অঘোষিত নিষেধাজ্ঞার কারণে নিহত তাজুল ইসলামের স্বজনরা সাংবাদিকদের সামনে কোন কথা বলতে রাজি হননি। তারা বলেছে, পুলিশ নিষেধ করেছে।

এদিকে জনতার দাবির মুখে নিহত তাজুল ইসলামের মরদেহ গতকাল সকালে নির্বাহি ম্যাজিষ্ট্রেট মেহেদী হাসান সুরত হাল রিপোর্ট তৈরি করেন।

সার্বিক বিষয়ে জানতে রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের ডিসি (ক্রাইম) মারুফ হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি সংবাদকে বলেন, তাজুল মাদক সেবী ছিল এটা জানা গেছে। পুরো ঘটনা তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া হবে। এদিকে ডিসি মারুফ ছাড়া গতকাল দিনভর হারাগাছ থানার ওসিসহ কোন পুলিশ কর্মকর্তাই সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে রাজি হননি। দফায় দফায় ফোন করা হলেও তারা কেউই ফোন রিসিভ করেননি।