মরে যাওয়া আখ রান্নার লাকড়ি হিসাবে ব্যবহার হচ্ছে
নাটোরে এ বছর প্রায় সাড়ে ৪ হাজার হেক্টর জমিতে আখের চাষ করা হয়েছে। তার মধ্যে এক হাজারেরও বেশি একর জমিতে চাষ করা আখে লাল পচা রোগ ছড়িয়ে পড়েছে। আক্রান্ত আখ মরে শুকিয়ে যাচ্ছে। শুকনো আখ কেটে চাষীরা রান্না করার লাকড়ি হিসেবে ব্যবহার করছে।
আখ চাষ করে কৃষকদের লাভ তো দূরের কথা মূলধন হারিয়ে কৃষকরা এখন বিপাকে পড়েছেন। অনেকের চোখে কান্না। আবার কেউ রাস্তায় নেমে মানববন্ধন করছেন। এখনও যে সব জমির আখ ভালো আছে তা সুগার মিল কর্তৃপক্ষ কিনতে রহস্যজনক কারণে গড়িমসি করছেন।
সরজমিনে ঘুরে এসে আমাদের নাটোর রিপোর্টার জানান, এবার আখ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল দুই লাখ টন। আখচাষীরা এসব আখ নাটোর সুগার মিলে বিক্রি করে। তারা যে টাকা পায় তা দিয়ে কোন মতে সংসার চালায়। কিন্তু আখের লাল পচা রোগের কারণে ইতোমধ্যে প্রায় এক হাজার একর জমির আখ পচে মরে গেছে। অন্য জমির মালিকরা দাবি জানিয়েছেন, এখনও আক্রান্ত হয়নি এমন আখ তাড়াতাড়ি নাটোর সুগার মিল কর্তৃপক্ষের কাছে বিক্রি করতে চাইলেও তা নিয়ে চলছে নানা গড়িমসি। যার কারণে আখ চাষীরা আছে এখন মহাবিপদে। যথাসময়ে আখ কেটে মিলে সরবরাহ না করলে আরও আখ আক্রান্ত হয়ে মরে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন।
নাটোর জেলার রামসা কাজিপুর গ্রামের আখচাষী নীরেন্দ্র নাথ সাহা জানান, তিনি ছয় বিঘা জমিতে আখ চাষ করেছেন। তার অর্ধেকের বেশি জমির আখ আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। এতে তিনি আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। যার কারণে আগামীতে আখচাষ ছেড়ে দেয়ার চিন্তা করছেন।
স্থানীয় মমিনপুর গ্রামের আখচাষী আফজাল হোসেন জানান, আখের পচা রোগ শুরু হলে তারা নাটোর সুগার মিল কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছেন। এরপরও তাদেরকে পাওয়া যায়নি। কোন উপায় না পেয়ে আখগুলো কেটে রান্না করার জ্বালানি হিসেবে তৈরি করা হয়েছে।
নাটোর শহরতলীর গাজী আবদুল জানান, গত বছরে তার ৩০ বিঘা জমিতে আখ চাষ করেছিলেন। কিন্তু সঠিক সময়ে সুগারমিল তার আখ না কেনায় তাকে ১৪ লাখ টাকা লোকসান গুনতে হয়। তাই এবারে শুধুমাত্র ১৫ বিঘা জমিতে আখের চাষ করেছেন। এবারেও সময়মতো আখ না কাটতে পারলে তাকে পথে বসতে হবে।
স্থানীয় হরিদা খুলশী গ্রামের মনসুর হোসেন জানান, সুগার মিলের কর্মকর্তাদের কারণেই কৃষকরা আজকে বিপর্যয়ের মুখোমুখি হচ্ছে। সঠিক সময়ে আখ চাষে সার, কীটনাশক না দেয়ার কারণে আজকে এই পরিস্থিতির সম্মুখীন হচ্ছে। তার পরেও আখ চাষের জন্য যে সার মিল থেকে সরবরাহ করে, জমাট বেঁধে থাকা সেই সারের গুণগতমান ঠিক থাকে না।
নাটোর সুগার মিলস-এর নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ মো. আবু বক্কর সংবাদকে জানান, কৃষকদের অভিযোগ সব ক্ষেত্রে সঠিক নয়। আমাদের জিএম কৃষি ও আখের দায়িত্বপ্রাপ্ত ম্যানেজার এবং ফিল্ড অফিসাররা নিয়মিত মাঠ তদারকি করেন।
তিনি আরও জানান, আমাদের কৃষকরা আখ চাষে সবচেয়ে অবহেলা করেন। তারা আখের কোনও যতœই নেন না। যে কারণে এমন বিপর্যয় হতে পারে।
নাটোরে দুটি সুগার মিল আছে। এর মধ্যে একটি মিলের নিজস্ব খামার আছে। আর নাটোর সুগার মিল কর্তৃপক্ষ কৃষক দিয়ে আখ চাষ করান।
সাম্প্রতিক সময়ে চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের চেয়ারম্যান জাকিয়া ইসলাম নাটোরে দুটি চিনিকল পরিদর্শন করেন এবং কৃষকদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। এ সময় তিনি আখ চাষীদের ন্যায্য দাবি পূরণ এবং মিল দুটি যাতে বন্ধ না হয়, তার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দেন।
আখের লাল পচা রোগ সম্পর্কে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহের কীটতত্ত্ব বিভাগের প্রফেসর ড. মুহাম্মদ মহির উদ্দীন সংবাদকে মুঠোফোনে জানান, আখের কা- ছিদ্রকারী পোকার আক্রমণের পর এক ধরনের ছত্রাক ধরা লাল পচা রোগ সৃষ্টি হয়। এ পোকা আখের নরম অংশ খায়, ওই ছিদ্রের ভিতরের নরম অংশে ছত্রাক ঢুকে। ফলে নরম অংশ পচে গিয়ে লাল হয়ে যায়। তাই এ রোগকে লাল পচা রোগ বলে।
আখের লাল পচা রোগ দমনে নানা কৌশল অবলম্বন করা যায়। যে আখ প্রথমে আক্রান্ত হয় তা কেটে পুড়িয়ে ফেলে রোগ দমন করা যায়। আবার অনেক সময় আখ চাষের জমিতে থাকা পুরনো আখের গোড়া থেকে নতুন এ পোকা ছড়িয়ে আখ আক্রান্ত করে। ফলে পুরনো আখের গোড়ার অংশ যাতে জমিতে না থাকে তার জন্য সতর্ক থাকতে হবে।
এছাড়া আক্রান্ত আখ ক্ষেতে আলোকপাতের মাধ্যমে পোকা দমন করা হয়। আখ ক্ষেতে আলো জ্বালিয়ে নিচে পানি ভর্তি কিছু রেখে আলোকপাত করলে পোকা আলোতে গিয়ে পানিতে পড়ে মারা যায়। এভাবে প্রতিদিন পোকা দমন করা যায় বলে এ বিশেষজ্ঞ মনে করেন।
বুধবার, ০৩ নভেম্বর ২০২১ , ১৮ কার্তিক ১৪২৮ ২৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৩
মরে যাওয়া আখ রান্নার লাকড়ি হিসাবে ব্যবহার হচ্ছে
বাকী বিল্লাহ, ঢাকা ও পরিতোষ কুমার অধিকারী, নাটোর
নাটোরে এ বছর প্রায় সাড়ে ৪ হাজার হেক্টর জমিতে আখের চাষ করা হয়েছে। তার মধ্যে এক হাজারেরও বেশি একর জমিতে চাষ করা আখে লাল পচা রোগ ছড়িয়ে পড়েছে। আক্রান্ত আখ মরে শুকিয়ে যাচ্ছে। শুকনো আখ কেটে চাষীরা রান্না করার লাকড়ি হিসেবে ব্যবহার করছে।
আখ চাষ করে কৃষকদের লাভ তো দূরের কথা মূলধন হারিয়ে কৃষকরা এখন বিপাকে পড়েছেন। অনেকের চোখে কান্না। আবার কেউ রাস্তায় নেমে মানববন্ধন করছেন। এখনও যে সব জমির আখ ভালো আছে তা সুগার মিল কর্তৃপক্ষ কিনতে রহস্যজনক কারণে গড়িমসি করছেন।
সরজমিনে ঘুরে এসে আমাদের নাটোর রিপোর্টার জানান, এবার আখ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল দুই লাখ টন। আখচাষীরা এসব আখ নাটোর সুগার মিলে বিক্রি করে। তারা যে টাকা পায় তা দিয়ে কোন মতে সংসার চালায়। কিন্তু আখের লাল পচা রোগের কারণে ইতোমধ্যে প্রায় এক হাজার একর জমির আখ পচে মরে গেছে। অন্য জমির মালিকরা দাবি জানিয়েছেন, এখনও আক্রান্ত হয়নি এমন আখ তাড়াতাড়ি নাটোর সুগার মিল কর্তৃপক্ষের কাছে বিক্রি করতে চাইলেও তা নিয়ে চলছে নানা গড়িমসি। যার কারণে আখ চাষীরা আছে এখন মহাবিপদে। যথাসময়ে আখ কেটে মিলে সরবরাহ না করলে আরও আখ আক্রান্ত হয়ে মরে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন।
নাটোর জেলার রামসা কাজিপুর গ্রামের আখচাষী নীরেন্দ্র নাথ সাহা জানান, তিনি ছয় বিঘা জমিতে আখ চাষ করেছেন। তার অর্ধেকের বেশি জমির আখ আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। এতে তিনি আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। যার কারণে আগামীতে আখচাষ ছেড়ে দেয়ার চিন্তা করছেন।
স্থানীয় মমিনপুর গ্রামের আখচাষী আফজাল হোসেন জানান, আখের পচা রোগ শুরু হলে তারা নাটোর সুগার মিল কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছেন। এরপরও তাদেরকে পাওয়া যায়নি। কোন উপায় না পেয়ে আখগুলো কেটে রান্না করার জ্বালানি হিসেবে তৈরি করা হয়েছে।
নাটোর শহরতলীর গাজী আবদুল জানান, গত বছরে তার ৩০ বিঘা জমিতে আখ চাষ করেছিলেন। কিন্তু সঠিক সময়ে সুগারমিল তার আখ না কেনায় তাকে ১৪ লাখ টাকা লোকসান গুনতে হয়। তাই এবারে শুধুমাত্র ১৫ বিঘা জমিতে আখের চাষ করেছেন। এবারেও সময়মতো আখ না কাটতে পারলে তাকে পথে বসতে হবে।
স্থানীয় হরিদা খুলশী গ্রামের মনসুর হোসেন জানান, সুগার মিলের কর্মকর্তাদের কারণেই কৃষকরা আজকে বিপর্যয়ের মুখোমুখি হচ্ছে। সঠিক সময়ে আখ চাষে সার, কীটনাশক না দেয়ার কারণে আজকে এই পরিস্থিতির সম্মুখীন হচ্ছে। তার পরেও আখ চাষের জন্য যে সার মিল থেকে সরবরাহ করে, জমাট বেঁধে থাকা সেই সারের গুণগতমান ঠিক থাকে না।
নাটোর সুগার মিলস-এর নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ মো. আবু বক্কর সংবাদকে জানান, কৃষকদের অভিযোগ সব ক্ষেত্রে সঠিক নয়। আমাদের জিএম কৃষি ও আখের দায়িত্বপ্রাপ্ত ম্যানেজার এবং ফিল্ড অফিসাররা নিয়মিত মাঠ তদারকি করেন।
তিনি আরও জানান, আমাদের কৃষকরা আখ চাষে সবচেয়ে অবহেলা করেন। তারা আখের কোনও যতœই নেন না। যে কারণে এমন বিপর্যয় হতে পারে।
নাটোরে দুটি সুগার মিল আছে। এর মধ্যে একটি মিলের নিজস্ব খামার আছে। আর নাটোর সুগার মিল কর্তৃপক্ষ কৃষক দিয়ে আখ চাষ করান।
সাম্প্রতিক সময়ে চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের চেয়ারম্যান জাকিয়া ইসলাম নাটোরে দুটি চিনিকল পরিদর্শন করেন এবং কৃষকদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। এ সময় তিনি আখ চাষীদের ন্যায্য দাবি পূরণ এবং মিল দুটি যাতে বন্ধ না হয়, তার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দেন।
আখের লাল পচা রোগ সম্পর্কে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহের কীটতত্ত্ব বিভাগের প্রফেসর ড. মুহাম্মদ মহির উদ্দীন সংবাদকে মুঠোফোনে জানান, আখের কা- ছিদ্রকারী পোকার আক্রমণের পর এক ধরনের ছত্রাক ধরা লাল পচা রোগ সৃষ্টি হয়। এ পোকা আখের নরম অংশ খায়, ওই ছিদ্রের ভিতরের নরম অংশে ছত্রাক ঢুকে। ফলে নরম অংশ পচে গিয়ে লাল হয়ে যায়। তাই এ রোগকে লাল পচা রোগ বলে।
আখের লাল পচা রোগ দমনে নানা কৌশল অবলম্বন করা যায়। যে আখ প্রথমে আক্রান্ত হয় তা কেটে পুড়িয়ে ফেলে রোগ দমন করা যায়। আবার অনেক সময় আখ চাষের জমিতে থাকা পুরনো আখের গোড়া থেকে নতুন এ পোকা ছড়িয়ে আখ আক্রান্ত করে। ফলে পুরনো আখের গোড়ার অংশ যাতে জমিতে না থাকে তার জন্য সতর্ক থাকতে হবে।
এছাড়া আক্রান্ত আখ ক্ষেতে আলোকপাতের মাধ্যমে পোকা দমন করা হয়। আখ ক্ষেতে আলো জ্বালিয়ে নিচে পানি ভর্তি কিছু রেখে আলোকপাত করলে পোকা আলোতে গিয়ে পানিতে পড়ে মারা যায়। এভাবে প্রতিদিন পোকা দমন করা যায় বলে এ বিশেষজ্ঞ মনে করেন।