ভূমি অফিসের দুর্নীতি

মো. জিল্লুর রহমান

লাগামহীন দুর্নীতি চলছে ভূমি খাতের সাবরেজিস্ট্রার অফিস, এসিল্যান্ড অফিস ও তহসিল অফিসের সর্বক্ষেত্রে। এসব অফিস দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত। সবগুলো অফিসের সামনে সিটিজেন চার্টার টানানো আছে, দেখার অনেক লোক আছে কিন্তু এগুলো মানার কেউ নেই। শুধু লোক দেখানোর জন্য টানানো। এসব অফিসে কিছু সৎ ও নিষ্ঠাবান অফিসার থাকলেও প্রকান্তরে তারা অসৎ অফিসার বা শক্তিশালী দালাল চক্রের কারণে কোনঠাসা হয়ে থাকেন। তারা দৃশ্যমান কোন ভূমিকা রাখতে পারে না।

এসব অফিসে কোন সেবার জন্য গেলে অফিসের শক্তিশালী সিন্ডিকেট চক্রের ভাবখানা দেখলে মনে হয় তারা জমির মালিক বা রাজা। আর সেবা প্রত্যাশীরা জমির প্রজা বা হুকুমের গোলাম। এক্ষেত্রে নিয়মমাফিক কাজ করতে গেলে প্রতিপদে হেনস্তা হতে হয় এবং এক সময় বাধ্য হয়ে দালাদের দারস্থ হতে হয়। তারা ঘুষকে বকশিশ বা অতিরিক্ত পারিশ্রমিক বলতে স্বাচ্ছন্দবোধ করে এবং এটাকে তারা বৈধ আয় মনে করে।

একটি নামজারি নিয়মমাফিক দাখিল করা হলে বারবার প্রত্যাখ্যাত হয়, পরবর্তীতে বাধ্য হয়ে উপরোক্ত বকশিশের বিনিময়ে সমাধা করতে হয়। নামজারি ও খাজনা ডিজিটাল হয়েছে ঠিকই, কিন্তু ঘুষ বাণিজ্য বন্ধ করা যায়নি। তহসিল অফিসে ৫-১০ টাকার খাজনা পরিশোধ করতে গিয়ে বাধ্য হয়ে ১০০-৫০০ টাকা বকশিশ দিতে হয়। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছে কেউ অভিযোগ করলে তিনি প্রকারান্তরে কালো তালিকাভুক্ত হওয়ার আশঙ্কায় থাকে এবং উর্ধ্বতন কর্মকর্তাও যদি দুর্নীতিপ্রবণ হন, তাহলে সেবাপ্রত্যাশীর অবস্থা সেই রাজার দুধের গল্পের মতো পানসে মনে হয়।

এসব অফিসে খাজনা আদায়, জমি রেজিস্ট্রেশন, নামজারি, জমির শ্রেণী পরিবর্তন, ভূমি অধিগ্রহণে চেক জালিয়াতি, নীতিমালা ভঙ্গ করে জমি বরাদ্দ দেওয়া, জলমহাল ইজারাসহ নানা ক্ষেত্রে অবাধ দুর্নীতির প্রমাণ রয়েছে। কর্তৃপক্ষের অবহেলা, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, উদাসীনতা ও দুর্নীতিপরায়ণ মানসিকতার কারণে জনসম্পৃক্ত অতিগুরুত্বপূর্ণ এই খাতের ভাবমূর্তি দারুণভাবে ক্ষুণ্ন হচ্ছে। এসব অসৎ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অনিয়ম, দুর্নীতি, জালিয়াতি ও স্বেচ্ছাচারিতার কারণে ভূমি খাত দুর্নীতির বিষবৃক্ষে পরিণত হয়েছে। ভুক্তভোগীরা বলছেন, দিন দিন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও কতিপয় অসাধু কর্মকর্তার লোভ-লালসার কারণে মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক কার্যক্রম থেকে শুরু করে ইউনিয়ন ভূমি অফিস পর্যন্ত দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়েছে। এর বিনিময়ে মোটা অঙ্কের অর্থ, সম্পদ ও কোনো কোনো ক্ষেত্রে জমির মালিক হয়েছেন দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।

এসব অনিয়ম দূর করার জন্য ভূমির সব কাজে শতভাগ স্বচ্ছতা, জবাবদিহি নিশ্চিত করা জরুরি। নীতি ও আইনি প্রক্রিয়ার মধ্যে সব কাজ করা উচিত। ভূমি ব্যবস্থাপনা আধুনিকায়নের মাধ্যমে অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধ করা যাবে। প্রতিটি অফিসে সিসি ক্যামেরা স্থাপন ও ভূমি ব্যবস্থাপনা শুধু ডিজিটালাইজড করলেই হবে না, সংশ্লিষ্টদেরও সৎ ও নৈতিক মানসম্পন্ন হতে হবে। হয়রানি নয়, সেবার মনমানসিকতা থাকতে হবে। একইসাথে ভূমি খাতের দুর্নীতির বিষবৃক্ষ উপরে ফেলার জন্য জিরো টলারেন্স নীতি ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা দরকার।

[লেখক : ব্যাংকার]

বুধবার, ০৩ নভেম্বর ২০২১ , ১৮ কার্তিক ১৪২৮ ২৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৩

ভূমি অফিসের দুর্নীতি

মো. জিল্লুর রহমান

লাগামহীন দুর্নীতি চলছে ভূমি খাতের সাবরেজিস্ট্রার অফিস, এসিল্যান্ড অফিস ও তহসিল অফিসের সর্বক্ষেত্রে। এসব অফিস দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত। সবগুলো অফিসের সামনে সিটিজেন চার্টার টানানো আছে, দেখার অনেক লোক আছে কিন্তু এগুলো মানার কেউ নেই। শুধু লোক দেখানোর জন্য টানানো। এসব অফিসে কিছু সৎ ও নিষ্ঠাবান অফিসার থাকলেও প্রকান্তরে তারা অসৎ অফিসার বা শক্তিশালী দালাল চক্রের কারণে কোনঠাসা হয়ে থাকেন। তারা দৃশ্যমান কোন ভূমিকা রাখতে পারে না।

এসব অফিসে কোন সেবার জন্য গেলে অফিসের শক্তিশালী সিন্ডিকেট চক্রের ভাবখানা দেখলে মনে হয় তারা জমির মালিক বা রাজা। আর সেবা প্রত্যাশীরা জমির প্রজা বা হুকুমের গোলাম। এক্ষেত্রে নিয়মমাফিক কাজ করতে গেলে প্রতিপদে হেনস্তা হতে হয় এবং এক সময় বাধ্য হয়ে দালাদের দারস্থ হতে হয়। তারা ঘুষকে বকশিশ বা অতিরিক্ত পারিশ্রমিক বলতে স্বাচ্ছন্দবোধ করে এবং এটাকে তারা বৈধ আয় মনে করে।

একটি নামজারি নিয়মমাফিক দাখিল করা হলে বারবার প্রত্যাখ্যাত হয়, পরবর্তীতে বাধ্য হয়ে উপরোক্ত বকশিশের বিনিময়ে সমাধা করতে হয়। নামজারি ও খাজনা ডিজিটাল হয়েছে ঠিকই, কিন্তু ঘুষ বাণিজ্য বন্ধ করা যায়নি। তহসিল অফিসে ৫-১০ টাকার খাজনা পরিশোধ করতে গিয়ে বাধ্য হয়ে ১০০-৫০০ টাকা বকশিশ দিতে হয়। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছে কেউ অভিযোগ করলে তিনি প্রকারান্তরে কালো তালিকাভুক্ত হওয়ার আশঙ্কায় থাকে এবং উর্ধ্বতন কর্মকর্তাও যদি দুর্নীতিপ্রবণ হন, তাহলে সেবাপ্রত্যাশীর অবস্থা সেই রাজার দুধের গল্পের মতো পানসে মনে হয়।

এসব অফিসে খাজনা আদায়, জমি রেজিস্ট্রেশন, নামজারি, জমির শ্রেণী পরিবর্তন, ভূমি অধিগ্রহণে চেক জালিয়াতি, নীতিমালা ভঙ্গ করে জমি বরাদ্দ দেওয়া, জলমহাল ইজারাসহ নানা ক্ষেত্রে অবাধ দুর্নীতির প্রমাণ রয়েছে। কর্তৃপক্ষের অবহেলা, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, উদাসীনতা ও দুর্নীতিপরায়ণ মানসিকতার কারণে জনসম্পৃক্ত অতিগুরুত্বপূর্ণ এই খাতের ভাবমূর্তি দারুণভাবে ক্ষুণ্ন হচ্ছে। এসব অসৎ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অনিয়ম, দুর্নীতি, জালিয়াতি ও স্বেচ্ছাচারিতার কারণে ভূমি খাত দুর্নীতির বিষবৃক্ষে পরিণত হয়েছে। ভুক্তভোগীরা বলছেন, দিন দিন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও কতিপয় অসাধু কর্মকর্তার লোভ-লালসার কারণে মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক কার্যক্রম থেকে শুরু করে ইউনিয়ন ভূমি অফিস পর্যন্ত দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়েছে। এর বিনিময়ে মোটা অঙ্কের অর্থ, সম্পদ ও কোনো কোনো ক্ষেত্রে জমির মালিক হয়েছেন দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।

এসব অনিয়ম দূর করার জন্য ভূমির সব কাজে শতভাগ স্বচ্ছতা, জবাবদিহি নিশ্চিত করা জরুরি। নীতি ও আইনি প্রক্রিয়ার মধ্যে সব কাজ করা উচিত। ভূমি ব্যবস্থাপনা আধুনিকায়নের মাধ্যমে অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধ করা যাবে। প্রতিটি অফিসে সিসি ক্যামেরা স্থাপন ও ভূমি ব্যবস্থাপনা শুধু ডিজিটালাইজড করলেই হবে না, সংশ্লিষ্টদেরও সৎ ও নৈতিক মানসম্পন্ন হতে হবে। হয়রানি নয়, সেবার মনমানসিকতা থাকতে হবে। একইসাথে ভূমি খাতের দুর্নীতির বিষবৃক্ষ উপরে ফেলার জন্য জিরো টলারেন্স নীতি ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা দরকার।

[লেখক : ব্যাংকার]