গরিবের শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন কর্মকর্তারা

গরিব ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষের আর্থসামাজিক উন্নয়নে ১৯৯৯ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয় পল্লী দারিদ্র্য বিমোচন ফাউন্ডেশন (পিডিবিএফ)। এই ফাউন্ডেশনের লক্ষ্য ছিল পল্লী এলাকার দারিদ্র্য দূরীকরণ। এর জন্য গরিব মানুষদের প্রশিক্ষণ ও উন্নয়নে বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়।

কিন্তু অনুসন্ধানে জানা যাচ্ছে উন্নয়ন না করে গরিবের টাকা ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তারা নিজেরাই আত্মসাৎ করেছেন। দরিদ্রদের জন্য বরাদ্দকৃত টাকা বিতরণ না করে নানা ভুয়া বিল-ভাউচার বানিয়ে ফাউন্ডেশনের সাবেক ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি)সহ একাধিক কর্মকর্তা ৪ কোটি টাকার বেশি নিজেদের পকেটে ঢুকিয়েছেন বলে পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের এক তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

এছাড়া বোর্ড সভায় সিদ্ধান্ত ছাড়া পিকে হালদারের মালিকানাধীন ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইনান্সিয়াল সার্ভিস লিমিটেডসহ বিভিন্ন বেসরকারি ভুইফোঁড় আর্থিক প্রতিষ্ঠানে প্রায় ২০০ কোটির বেশি বিনিয়োগ করেছে অভিযুক্তরা। এ সব প্রতিষ্ঠানের অনেকগুলোই দুর্নীতির কারণে দেউলিয়া হয়ে গেছে। অভিযুক্তরা ব্যক্তিগত লাভের জন্য দরিদ্রদের এই অর্থ ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

‘পিডিবিএফ’র নানা অনিয়ম-দুর্নীতির তদন্তে ২০১৯ সালের ৫ সেপ্টেম্বর পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় চার সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। কমিটির প্রধান ছিলেন সমবায় মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন অতিরিক্ত সচিব (প্রতিষ্ঠান) আফজাল হোসেন। সম্প্রতি কমিটি তদন্ত প্রতিবেদনটি মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছে।

তদন্তে অনিয়ম উঠে আসার পর পিডিবিএফের তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মদন মোহন সাহাকে চাকরিচ্যুত করা হলেও অভিযুক্ত অন্য কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কোন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয় নি বলে পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ সূত্রে জানা গেছে।

এ বিষয়ে পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য বলেন, ‘কামাল উদ্দিন তালুকদার সমবায় মন্ত্রণালয়ের সচিব থাকার সময় এসব ঘটনা ঘটেছিল। তখন পিডিবিএফে অরাজকতা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু কামাল তালুকদার তার নিজের লোকদের দিয়ে বোর্ড সাজিয়েছেন। সেই চেইন এখনো ভাঙেনি।’

প্রতিমন্ত্রীর দাবী তিনি তখন ছিলেন নতুন। পরবর্তীতে সেখানে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেছেন। এখন অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হলে পিডিবিএফের পরিচালনা বোর্ডের মাধ্যমেই নিতে হবে।

আর পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের সচিব মো. মশিউর রহমান সংবাদকে বলেন, ‘এই তদন্ত কমিটির বিষয়ে আমি তেমন কিছু বলতে পারবো না। কারন তখন আমি এই মন্ত্রণালয়ে ছিলাম না। তবে কোন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ থাকলে অবশ্যই তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

তবে ইতোমধ্যে দুই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে জানান তিনি।

তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ভারপ্রাপ্ত এমডির দায়িত্ব পাওয়ার পরপরই মদন মোহন সাহা নিয়মের ব্যাত্যয় ঘটিয়ে তার বেতন স্কেল বাড়িয়ে নেন। বেতন স্কেল গ্রেড-২ এর ৬৬ হাজার টাকা থেকে গ্রেড-১ এ ৭৮ হাজার টাকা করেন। গ্রেড-১ এ উন্নীত করতে হলে নিয়ম অনুযায়ী চাকরির ন্যূনতম মেয়াদ ২০ বছর হতে হবে। কিন্তু যখন তিনি গ্রেড-১ উন্নীত করেন, তখন তার চাকরির বয়স হয়েছিল ১৭ বছর।

তার চাক্রীর সময়কালে তিন বছরে (জুলাই-১৫ থেকে জুলাই ১৯ পর্যন্ত সময়ে) তিনি অতিরিক্ত বেতন নিয়েছেন ১ লাখ ৯ হাজার ৩২৪ টাকা। মদন মোহন একটি ‘বড় ধরনের আর্থিক অনিয়ম ও দুর্নীতি’ করেছেন বলে তদন্ত কমিটি মনে করে। কমিটি ওই টাকা সংস্থাকে ফেরত দেওয়ার সুপারিশ করে ও তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের পক্ষে মত দেয়।

তদন্তে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, মদন মোহন ও পিডিবিএফের তৎকালীন যুগ্ম পরিচালক বর্তমানে ভারপ্রাপ্ত পরিচালক (মাঠ পরিচালন) শহিদুল হক খান ১০ লাখ ৫০ হাজার টাকার ভুয়া বিল ভাউচার বানিয়ে আত্মসাৎ করেছেন। এর মধ্যে পিডিবিএফের সহকারী পরিচালক ফাতেমা খাতুনের নামে ২ লাখ ৫০ হাজার ও পরিণীতা রায়ের নামে ২ লাখ টাকা বিল দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তদন্ত কমিটির কাছে দুজনেই লিখিত দিয়েছেন তাদেরকে এ বাবদ কোনো টাকা দেওয়া হয়নি।

এছাড়া প্রতিষ্ঠানের মামলা পরিচালনার জন্য মাহবুব আলম নামের একজন আইনজীবীকে ৬ লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে। এছাড়া আব্দুর রহমান নামের আরেক আইনজীবীকে ৩ লাখ ৩০ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কোনো চেকের মুড়ি বইতে তাদের কোনো স্বাক্ষর পাওয়া যায়নি। আর যে চেকগুলো দেওয়া হয়েছে ব্যাংক স্টেটমেন্টে দেখা গেছে চেকগুলো বিয়ারার চেকের মাধ্যমে নগদায়ন করা হয়েছে।

তদন্ত কমিটি বলছে ‘এই টাকা দু’জনে যোগসাজশ করে আত্মসাৎ’ করেছেন। মদন মোহন সাহা ও শহীদুল হক খান এভাবে বড় ধরনের একটি আর্থিক অনিয়ম ও দুর্নীতি করেছেন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছেন কর্মকর্তারা।

ঝুঁকিতে ফেলা হয়েছে গরিবের ২০০ কোটির বেশী টাকা

পিডিবিএফের ৬৮তম বোর্ডসভার সিদ্ধান্ত ছিল, যেসব বেসরকারি ব্যাংক ও লিজিং কোম্পানিতে পিডিবিএফের টাকা বিনিয়োগ করা আছে, সেগুলো তুলে সরকারি ব্যাংকে রাখতে হবে। পাশাপাশি এসব অর্থ দেশের দরিদ্র মানুষের মধ্যে স্বল্প সুদে ঋণ প্রদান করতে হবে। আর কোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে পিডিবিএফের অর্থ বিনিয়োগ করা যাবে না।

কিন্তু ওই সিদ্ধান্তকে অমান্য করে পিডিবিএফের ৬৭ কোটি ৩৬ লাখ ৫৭ হাজার টাকা বিভিন্ন ভুঁইফোড় লিজিং কোম্পানিতে বিনিয়োগ করা হয়েছে। এর মধ্যে আলোচিত-সমালোচিত পিকে হালদারের মালিকানাধীন ইন্টারন্যাশনাল লিজিং এন্ড ফাইনান্সিয়াল সার্ভিস লিমিটেডে বিনিয়োগ করা হয়েছে ২৬ কোটি ১১ লাখ ১৯ হাজার টাকা। পিকে হালদারের কোম্পানি এখন দেউলিয়া হয়ে বন্ধ। আর পিকে হালদার এভাবে বহু টাকা হাতিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বিদেশে পলাতক।

এছাড়া প্রিমিয়ার লিজিং নামের আরেকটি প্রতিষ্ঠানে ৪ কোটি ৯ লাখ ৭৬ হাজার টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে। এই কোম্পানি লভ্যাংশ তো দূরের কথা, আসলই ফেরত দিতে পারছে না পিডিবিএফকে। এভাবে ১৫টি বেসরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে পিডিবিএফের ১০০ কোটি ৪২ লাখ ৫ হাজার টাকা ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগ করেছেন দায়িত্বশীলরা।

এর বাইরে মিডল্যান্ড নামের একটি নতুন ব্যাংকে আরো ১০৪ কোটি ১৩ লাখ ২৪ হাজার টাকা বিনিয়োগ করেছে। তদন্ত কমিটি মনে করে, মদন মোহন সাহা ও শহীদুল হক খান পরস্পর যোগসাজশ করে ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হয়ে দরিদ্র মানুষের জন্য যে অর্থ তা ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগ করেছেন। এ ঘটনার জন্য তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন বলে তদন্ত কমিটি সুপারিশ করেছে।

‘সেবা নীড়’ নামে ৪ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে অভিযুক্তরা

পিডিবিএফের বোর্ডের অনুমতি না নিয়ে ‘সেবা নীড়’ নামে একটি প্রকল্প চালু করা হয়েছিল। তখন বলা হয়েছিল গ্রামের দরিদ্র নারী-পুরুষ ৬০০ টাকা দিয়ে সদস্য হতে পারবেন। পরবর্তী বছরের জন্য দিতে হবে ৪০০ টাকা। এভাবে ৪০৩টি কার্যালয়ের মাধ্যমে প্রচুর সংখ্যক সদস্য সংগ্রহ করা হয়। এভাবে দরিদ্রদের কাছ থেকে ৪ কোটিরও বেশি টাকা নেয়া হয়।

স্বাস্থ্য সেবাদানের জন্য অ্যাডভিন লিমিটেড নামের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে ৭ লাখ ৮০ হাজার ২৫০ টাকা দেওয়া হয়। কিন্তু তদন্ত কমিটি দেখতে পায়, এ প্রকল্পের মাধ্যমে কাউকে কোনো স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া হয়নি। অথচ ময়মনসিংহের ভালুকা কার্যালয় থেকে সদস্য ফি বাবদ ১ লাখ ২ হাজার টাকা, সিডস্টোর কার্যালয় থেকে ৭৭ হাজার ৮০০ টাকা আদায় করা হয়েছে। এভাবে টাঙ্গাইলের ভূয়াপুর, ঘাটাইল, বাসাইল, গোপালপুর, ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা, চেচুয়াবাজারসহ সারা দেশে থেকে ৪ কোটিরও বেশি টাকা দরিদ্রদের কাছ থেকে তুলে আত্মসাৎ করা হয়েছে।

বৃহস্পতিবার, ০৪ নভেম্বর ২০২১ , ১৯ কার্তিক ১৪২৮ ২৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৩

পল্লী দারিদ্র্য বিমোচন ফাউন্ডেশনে দুর্নীতি

গরিবের শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন কর্মকর্তারা

ইবরাহীম মাহমুদ আকাশ

গরিব ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষের আর্থসামাজিক উন্নয়নে ১৯৯৯ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয় পল্লী দারিদ্র্য বিমোচন ফাউন্ডেশন (পিডিবিএফ)। এই ফাউন্ডেশনের লক্ষ্য ছিল পল্লী এলাকার দারিদ্র্য দূরীকরণ। এর জন্য গরিব মানুষদের প্রশিক্ষণ ও উন্নয়নে বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়।

কিন্তু অনুসন্ধানে জানা যাচ্ছে উন্নয়ন না করে গরিবের টাকা ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তারা নিজেরাই আত্মসাৎ করেছেন। দরিদ্রদের জন্য বরাদ্দকৃত টাকা বিতরণ না করে নানা ভুয়া বিল-ভাউচার বানিয়ে ফাউন্ডেশনের সাবেক ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি)সহ একাধিক কর্মকর্তা ৪ কোটি টাকার বেশি নিজেদের পকেটে ঢুকিয়েছেন বলে পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের এক তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

এছাড়া বোর্ড সভায় সিদ্ধান্ত ছাড়া পিকে হালদারের মালিকানাধীন ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইনান্সিয়াল সার্ভিস লিমিটেডসহ বিভিন্ন বেসরকারি ভুইফোঁড় আর্থিক প্রতিষ্ঠানে প্রায় ২০০ কোটির বেশি বিনিয়োগ করেছে অভিযুক্তরা। এ সব প্রতিষ্ঠানের অনেকগুলোই দুর্নীতির কারণে দেউলিয়া হয়ে গেছে। অভিযুক্তরা ব্যক্তিগত লাভের জন্য দরিদ্রদের এই অর্থ ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

‘পিডিবিএফ’র নানা অনিয়ম-দুর্নীতির তদন্তে ২০১৯ সালের ৫ সেপ্টেম্বর পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় চার সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। কমিটির প্রধান ছিলেন সমবায় মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন অতিরিক্ত সচিব (প্রতিষ্ঠান) আফজাল হোসেন। সম্প্রতি কমিটি তদন্ত প্রতিবেদনটি মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছে।

তদন্তে অনিয়ম উঠে আসার পর পিডিবিএফের তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মদন মোহন সাহাকে চাকরিচ্যুত করা হলেও অভিযুক্ত অন্য কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কোন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয় নি বলে পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ সূত্রে জানা গেছে।

এ বিষয়ে পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য বলেন, ‘কামাল উদ্দিন তালুকদার সমবায় মন্ত্রণালয়ের সচিব থাকার সময় এসব ঘটনা ঘটেছিল। তখন পিডিবিএফে অরাজকতা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু কামাল তালুকদার তার নিজের লোকদের দিয়ে বোর্ড সাজিয়েছেন। সেই চেইন এখনো ভাঙেনি।’

প্রতিমন্ত্রীর দাবী তিনি তখন ছিলেন নতুন। পরবর্তীতে সেখানে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেছেন। এখন অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হলে পিডিবিএফের পরিচালনা বোর্ডের মাধ্যমেই নিতে হবে।

আর পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের সচিব মো. মশিউর রহমান সংবাদকে বলেন, ‘এই তদন্ত কমিটির বিষয়ে আমি তেমন কিছু বলতে পারবো না। কারন তখন আমি এই মন্ত্রণালয়ে ছিলাম না। তবে কোন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ থাকলে অবশ্যই তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

তবে ইতোমধ্যে দুই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে জানান তিনি।

তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ভারপ্রাপ্ত এমডির দায়িত্ব পাওয়ার পরপরই মদন মোহন সাহা নিয়মের ব্যাত্যয় ঘটিয়ে তার বেতন স্কেল বাড়িয়ে নেন। বেতন স্কেল গ্রেড-২ এর ৬৬ হাজার টাকা থেকে গ্রেড-১ এ ৭৮ হাজার টাকা করেন। গ্রেড-১ এ উন্নীত করতে হলে নিয়ম অনুযায়ী চাকরির ন্যূনতম মেয়াদ ২০ বছর হতে হবে। কিন্তু যখন তিনি গ্রেড-১ উন্নীত করেন, তখন তার চাকরির বয়স হয়েছিল ১৭ বছর।

তার চাক্রীর সময়কালে তিন বছরে (জুলাই-১৫ থেকে জুলাই ১৯ পর্যন্ত সময়ে) তিনি অতিরিক্ত বেতন নিয়েছেন ১ লাখ ৯ হাজার ৩২৪ টাকা। মদন মোহন একটি ‘বড় ধরনের আর্থিক অনিয়ম ও দুর্নীতি’ করেছেন বলে তদন্ত কমিটি মনে করে। কমিটি ওই টাকা সংস্থাকে ফেরত দেওয়ার সুপারিশ করে ও তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের পক্ষে মত দেয়।

তদন্তে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, মদন মোহন ও পিডিবিএফের তৎকালীন যুগ্ম পরিচালক বর্তমানে ভারপ্রাপ্ত পরিচালক (মাঠ পরিচালন) শহিদুল হক খান ১০ লাখ ৫০ হাজার টাকার ভুয়া বিল ভাউচার বানিয়ে আত্মসাৎ করেছেন। এর মধ্যে পিডিবিএফের সহকারী পরিচালক ফাতেমা খাতুনের নামে ২ লাখ ৫০ হাজার ও পরিণীতা রায়ের নামে ২ লাখ টাকা বিল দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তদন্ত কমিটির কাছে দুজনেই লিখিত দিয়েছেন তাদেরকে এ বাবদ কোনো টাকা দেওয়া হয়নি।

এছাড়া প্রতিষ্ঠানের মামলা পরিচালনার জন্য মাহবুব আলম নামের একজন আইনজীবীকে ৬ লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে। এছাড়া আব্দুর রহমান নামের আরেক আইনজীবীকে ৩ লাখ ৩০ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কোনো চেকের মুড়ি বইতে তাদের কোনো স্বাক্ষর পাওয়া যায়নি। আর যে চেকগুলো দেওয়া হয়েছে ব্যাংক স্টেটমেন্টে দেখা গেছে চেকগুলো বিয়ারার চেকের মাধ্যমে নগদায়ন করা হয়েছে।

তদন্ত কমিটি বলছে ‘এই টাকা দু’জনে যোগসাজশ করে আত্মসাৎ’ করেছেন। মদন মোহন সাহা ও শহীদুল হক খান এভাবে বড় ধরনের একটি আর্থিক অনিয়ম ও দুর্নীতি করেছেন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছেন কর্মকর্তারা।

ঝুঁকিতে ফেলা হয়েছে গরিবের ২০০ কোটির বেশী টাকা

পিডিবিএফের ৬৮তম বোর্ডসভার সিদ্ধান্ত ছিল, যেসব বেসরকারি ব্যাংক ও লিজিং কোম্পানিতে পিডিবিএফের টাকা বিনিয়োগ করা আছে, সেগুলো তুলে সরকারি ব্যাংকে রাখতে হবে। পাশাপাশি এসব অর্থ দেশের দরিদ্র মানুষের মধ্যে স্বল্প সুদে ঋণ প্রদান করতে হবে। আর কোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে পিডিবিএফের অর্থ বিনিয়োগ করা যাবে না।

কিন্তু ওই সিদ্ধান্তকে অমান্য করে পিডিবিএফের ৬৭ কোটি ৩৬ লাখ ৫৭ হাজার টাকা বিভিন্ন ভুঁইফোড় লিজিং কোম্পানিতে বিনিয়োগ করা হয়েছে। এর মধ্যে আলোচিত-সমালোচিত পিকে হালদারের মালিকানাধীন ইন্টারন্যাশনাল লিজিং এন্ড ফাইনান্সিয়াল সার্ভিস লিমিটেডে বিনিয়োগ করা হয়েছে ২৬ কোটি ১১ লাখ ১৯ হাজার টাকা। পিকে হালদারের কোম্পানি এখন দেউলিয়া হয়ে বন্ধ। আর পিকে হালদার এভাবে বহু টাকা হাতিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বিদেশে পলাতক।

এছাড়া প্রিমিয়ার লিজিং নামের আরেকটি প্রতিষ্ঠানে ৪ কোটি ৯ লাখ ৭৬ হাজার টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে। এই কোম্পানি লভ্যাংশ তো দূরের কথা, আসলই ফেরত দিতে পারছে না পিডিবিএফকে। এভাবে ১৫টি বেসরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে পিডিবিএফের ১০০ কোটি ৪২ লাখ ৫ হাজার টাকা ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগ করেছেন দায়িত্বশীলরা।

এর বাইরে মিডল্যান্ড নামের একটি নতুন ব্যাংকে আরো ১০৪ কোটি ১৩ লাখ ২৪ হাজার টাকা বিনিয়োগ করেছে। তদন্ত কমিটি মনে করে, মদন মোহন সাহা ও শহীদুল হক খান পরস্পর যোগসাজশ করে ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হয়ে দরিদ্র মানুষের জন্য যে অর্থ তা ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগ করেছেন। এ ঘটনার জন্য তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন বলে তদন্ত কমিটি সুপারিশ করেছে।

‘সেবা নীড়’ নামে ৪ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে অভিযুক্তরা

পিডিবিএফের বোর্ডের অনুমতি না নিয়ে ‘সেবা নীড়’ নামে একটি প্রকল্প চালু করা হয়েছিল। তখন বলা হয়েছিল গ্রামের দরিদ্র নারী-পুরুষ ৬০০ টাকা দিয়ে সদস্য হতে পারবেন। পরবর্তী বছরের জন্য দিতে হবে ৪০০ টাকা। এভাবে ৪০৩টি কার্যালয়ের মাধ্যমে প্রচুর সংখ্যক সদস্য সংগ্রহ করা হয়। এভাবে দরিদ্রদের কাছ থেকে ৪ কোটিরও বেশি টাকা নেয়া হয়।

স্বাস্থ্য সেবাদানের জন্য অ্যাডভিন লিমিটেড নামের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে ৭ লাখ ৮০ হাজার ২৫০ টাকা দেওয়া হয়। কিন্তু তদন্ত কমিটি দেখতে পায়, এ প্রকল্পের মাধ্যমে কাউকে কোনো স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া হয়নি। অথচ ময়মনসিংহের ভালুকা কার্যালয় থেকে সদস্য ফি বাবদ ১ লাখ ২ হাজার টাকা, সিডস্টোর কার্যালয় থেকে ৭৭ হাজার ৮০০ টাকা আদায় করা হয়েছে। এভাবে টাঙ্গাইলের ভূয়াপুর, ঘাটাইল, বাসাইল, গোপালপুর, ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা, চেচুয়াবাজারসহ সারা দেশে থেকে ৪ কোটিরও বেশি টাকা দরিদ্রদের কাছ থেকে তুলে আত্মসাৎ করা হয়েছে।