চণ্ডীদাসের দর্শন ও বাঙালির অসম্পূর্ণ নবজাগরণ

শেখর ভট্টাচার্য

আমাদের এই বাংলায় কী পরিপূর্ণ রেনেসাঁস বা নবজাগরণ ঘটেছিল? অনেক পুরোনো প্রশ্ন এবং এর বহুমুখী উত্তর আছে। তবে সব আলোচনা শেষে একটি কথা বলা যায় ১৯ শতকে ঘটা নবজাগরণের সঙ্গে পঞ্চদশ শতকে ঘটা ইউরোপীয় নবজাগরণ বা রেনেসাঁসের তুলনা করলে আমাদের নবজাগরণকে পরিপূর্ণ নবজাগরণ বলতে অনেকেরই দ্বিধা আছে। মধ্যযুগের অন্ধকার বিশ্বাস, কুসংস্কারাচ্ছন্ন জীবন আচরণ, জ্ঞান অন্বেষণের প্রথাকে ঝেড়ে ফেলে ইউরোপ যেভাবে জেগে উঠেছিল আমাদের নবজাগরণের ফলে সমাজ সেভাবে সেভাবে জেগে ওঠেনি। ইউরোপের নবজাগরণের ঢেউ এসে ভারতবর্ষ এবং বাংলাতে আছড়ে পড়েছিল কিন্তু তার স্রোত কিংবা ঢেউ ছিল তরঙ্গহীন। রেনেসাঁস মূলত দীর্ঘস্থায়ী একটি সমাজ পরিবর্তনের প্রক্রিয়া। অন্ধ বিশ্বাস, যুক্তিহীনতা থেকে যুক্তিপূর্ণ বিজ্ঞানভিত্তিক চিন্তা চেতনা জাগ্রত হয় ইউরোপীয় সমাজে। যার ঢেউ এসে লাগে সমগ্র বিশ্বের কোণে কোণে। রেনেসাঁস তাই শুধু ইউরোপের ইতিহাসের জন্য একটি বাঁক বদলের ঘটনা নয় এটি বিশ্ব ইতিহাসেরও একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা।

আমাদের রেনেসাঁসের ব্যাপ্তি কতটুকু? রেনেসাঁস নগরভিত্তিক ইংরেজি শিক্ষিত মানুষের মনে যে দোলা দিয়ে গিয়েছিল সমগ্র বাংলায় কি সে দোলার প্রভাব একই পরিমাণ ছিল? ইউরোপের রেনেসাঁস, প্রকৃত অর্থে যেভাবে “নবজাগরণ” ছিল বাংলায় সেটি কোন কোন ক্ষেত্রে কিছু কু-প্রথার বা ধর্মীয় কুসংস্কারের পরিবর্তনের জন্য প্রচেষ্টা ছিল। কিছু কিছু ক্ষেত্রে যেমন বিধবা বিবাহ, সতীদাহ প্রথা, নারী শিক্ষার বিষয়ে দৃশ্যমান কিছু ফল পাওয়া গিয়েছিল। ১৯ শতকের বঙ্গীয় রেনেসাঁকে বাঙালি বিদ্বানেরা পদ্ধতিগতভাবে চারটি পর্বে গড়ে তোলেন। প্রথমত, তারা বাংলা গদ্যভাষা ও নতুন বাংলা সাহিত্য সৃষ্টি করেন। দ্বিতীয়ত, ভারতের স্বর্ণযুগ নামে আখ্যাত ধ্রুপদী যুগের পুনরাবিষ্কার করেন যার সঙ্গে রয়েছে গ্রিস ও রোমের গৌরবময় ঐশ্বর্যের সমতুল্যতা শনাক্তকরণ। তৃতীয়ত, ভারতীয় বিদ্বানেরা নিজেদের ঐতিহাসিক অবস্থার সঙ্গে শ্রীরামপুরের মিশনারিদের দেয়া প্রোটেস্ট্যান্ট রিফর্মেশন সম্পর্কে নতুন ব্যাখ্যার সাদৃশ্য লক্ষ্য করেন। চতুর্থত, বৈশ্বিক প্রগতি সম্পর্কে একটি ধর্মনিরপেক্ষ ধারণায় উপনীত হন যার ওপর নির্ভরশীল ছিল তাদের প্রত্যাশা। সামাজিক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে বাংলার নবজাগরণ ছিল অত্যন্ত দুর্বল ও স্বপ্নহীন একটি প্রচেষ্টা।

আমরা দেখতে পাই সামগ্রিকভাবে বাংলার রেনেসাঁস সমাজের স্থবিরতা বিমোচনে বড় কোন প্রভাব ফেলতে পারেনি। মধ্যবিত্ত ইংরেজি শিক্ষিত মানুষের চিন্তা-চেতনার দরজায় হঠাৎ আলোর ঝলকানির মতো উপস্থিত হয়েছিল নবজাগরণ। আর একটি বিষয়, চিন্তা-চেতনায় ইংরেজি-শিক্ষিত মধ্য ও উচ্চবিত্তের মধ্যে যতটুকু পরিবর্তন নিয়ে এসেছিল নবজাগরণ, সমাজের গভীরে তার ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া এবং ফলাফল লক্ষ্য করা যায়নি। কেন যথেষ্ট দৃশ্যমান পরিবর্তন দেখা যায়নি? তা নিয়ে একটি বিশদ একাডেমিক আলোচনা হতে পারে তবে তা সংবাদপত্রের ক্ষুদ্র পরিসরে নয়। হয়তো দীর্ঘ কোন গবেষণামূলক রচনায়।

ইউরোপের রেনেসাঁস হলো মধ্য যুগ থেকে আধুনিক যুগে উত্তরণ। এই উত্তরণের মধ্য দিয়ে একদিকে মধ্যযুগের বৈশিষ্ট্যসমূহের পরিসমাপ্তি ঘটে অপরদিকে আধুনিক যুগের বৈশিষ্ট্যসমূহ সুস্পষ্ট রূপ লাভ করে। মধ্যযুগের সামাজিক প্রথা, কূপম-ুকতা, ধর্মান্ধতা, রক্ষণশীলতা, স্বৈর মানসিকতা ইত্যাদি মধ্য যুগের স্থবির অবস্থা থেকে বিবেক, যুক্তি, জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চা, উদারতা তথা এক কথায় গতিশীল ধারায় প্রবাহিত হয়। পুরোনো সংস্কার ছিন্ন হয়ে যায়, নতুন জ্ঞান-বিজ্ঞান চিন্তা-চেতনার আলোকে জীবন হয়ে উঠে গতিময়। কোন ধরনের আবদ্ধতা নয়, প্রাণ চাঞ্চল্য হয়ে উঠে জীবনের ধর্ম।

রেনেসাঁস বা নবজাগণের মূল মন্ত্রটিই হলো যুক্তিবাদ। মধ্যযুগের মানুষের মন ও চেতনা আবর্তিত হচ্ছিল বাইবেলকে ঘিরে। বাইবেলে নেই এমন কোন বিষয় সমাজে গৃহীত হতো না। অন্ধত্ব ও গোঁড়ামি ছিল মধ্যযুগীয় চিন্তা, চেতনার মূল বৈশিষ্ট্য। পঞ্চদশ শতকের ইউরোপীয় রেনেসাঁস মানুষের চিন্তা চেতনাকে প্রচলিত গোঁড়ামিপূর্ণ অবস্থান থেকে যুক্তি বাদে উত্তরণ ঘটায়। যুক্তিবাদের মূল কথা, যে কোন বিষয়কে প্রশ্নের মধ্য দিয়ে গ্রহণ করা এবং বিষয়টি সম্পর্কে অনুসন্ধান পরিচালনা করা। এই অনুসন্ধিৎসা ও যুক্তিবাদ মানুষের চিন্তা, চেতনা ও মননলোকে ব্যাপক পরিবর্তন সাধন করায় অগ্রসর চিন্তার দিকে এগিয়ে যেতে নবজাগরণ তাই যুগান্তকারী ভূমিকা রাখে।

রেনেসাঁস পৃথিবীকে বদলে দিয়েছে। রেনেসাঁসের পর শুধু ইউরোপ নয় সমগ্র পৃথিবীতে চিন্তা-চেতনায় বিজ্ঞান মনস্কতার প্রভাব এসে পড়ে। আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশে ধর্মীয় বাতাবরণ এতই শক্তিশালী ছিলো যে তার ফাঁক গলে পরিবর্তনের হাওয়া যতটুকু প্রবেশ করেছিল তা বিচ্ছিন্নভাবে কিছু কিছু বিষয়ে প্রলেপ দিতে সমর্থ হয়েছিল কিন্তু পরিবর্তনের জন্য শেকড় উপড়ে ফেলতে পারেনি। এই উপমহাদেশে যেহেতু নবজাগরণ পরিপূর্ণভাবে ঘটেনি, এই বাংলাতেও সমাজ পরিবর্তনের কোন সামগ্রিক প্রক্রিয়ারও তাই সূচনা ঘটেনি।

১৯ শতকে, বাংলায় রেনেসাঁসের সূচনা হয়েছিল ইংরেজদের হাত ধরে। আধুনিকতার ইতিবাচক বিষয়গুলোর ওপর যেসব ব্রিটিশ কর্মকর্তা প্রভাব বিস্তার করেন, মূলত তারা ছিলেন স্থানীয় সংস্কৃতি সম্পর্কে সচেতন কিছু সরকারি, বিচারবিভাগীয় কর্মকর্তা এবং কিছু মিশনারি। ইতিহাসের পরিভাষায় এদের বলা হয়েছে প্রাচ্যবিদ। প্রাচ্যবিদেরা বাঙালি বিদ্বানদের সঙ্গে দীর্ঘস্থায়ী সম্পর্ক গড়ে তোলেন এবং তাদের কাছে তুলে ধরেন ইউরোপীয় ইতিহাস ও ঐতিহ্য। তারাই মূলত দেশীয় বিদ্বানদের সঙ্গে মিলে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে পরিবর্তন নিয়ে আসার চেষ্টা করেন।

বহিরাগতদের প্রচেষ্টা আর নিজ ভূমি থেকে জেগে ওঠা কিঞ্চিৎ জাগরণের প্রভাব থেকে আমরা কতটুকু আশা করতে পারি? আমাদের নবজাগরণের প্রভাবে তাই সমাজ ও সংস্কৃতিতে ইউরোপের মতো ঝড় ওঠেনি যে ঝড়ে কুসংস্কার, পশ্চাদপদতাকে উপড়ে ফেলার মতো সামাজিক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হবে। তাই প্রশ্ন জাগে, আমাদের পশ্চাতপদতা, হীনমন্যতা, সাম্প্রদায়িকতার সবটুকুই কী তাহলে বাংলাতে এবং ভারতবর্ষে পূর্ণ-নবজাগরণ না ঘটার কারণে সৃষ্ট।

আমাদের মানবতার কবি চণ্ডীদাস ইউরোপীয় রেনেসাঁসের পূর্বে চতুর্দশ শতাব্দীতে সরলভাবে উদাত্ত আহ্বান জানান “শুন হে মানুষ ভাই, সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই”। কী বিস্ময়কর। আমাদের সমাজ ভাবনা দলবদ্ধভাবে না হলেও চতুর্দশ শতাব্দীতে কত উজ্জ্বল কত আধুনিক। ১৯ শতকের নবজাগরণ কেনো যে চতুর্দশ শতকের চণ্ডীদাসের দর্শনকে অনুসরণ করতে পারেনি সে এক অপার বিস্ময়। বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ডে নবজাগরণ ঘটেনি তবে সমাজ ও সংস্কৃতিতে এক ব্যাপক ঝড় তৈরি হয়েছিল। সে ঝড় থেকে নবজাগরণের এক বিপুল সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল। সমাজ, সংস্কৃতির গভীরে সাধারণ মানুষেরা যুক্তি নিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন। প্রশ্ন উদয় হয়েছিল আমরা কে? আমাদের জাতীয়তা কী? আমরা কোন সম্প্রদায়ের উত্তরাধিকার? আমাদের সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য কী? আমাদের জাতীয় মূলনীতি কী হওয়া উচিত? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে অনুসন্ধিৎসা ও যুক্তিবাদের উদ্ভব ঘটে। বাঙালির মননলোকে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটতে দেখা যায়। পূর্ববঙ্গের মানুষের মনোজগতে বিজ্ঞানমুখী আধুনিক চিন্তার উদ্ভব ঘটে। ধর্মনির্ভরতা থেকে ধর্ম নিরপেক্ষতার দিকে মানুষ এগোতে থাকে। বাঙালি আশ্রয় খোঁজে চর্চাযাপদে। সংস্কৃতি চর্চায় শেকড়ের সন্ধান করতে শুরু করে। মানুষের মনোজগতের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক চিন্তার ক্ষেত্রেও আধুনিক মনস্কতা লক্ষ্য করা যায়। ভাষা ও সংস্কৃতির অধিকার আদায়ের জন্য যে আন্দোলনের সূচনা ঘটে মাতৃভাষার অধিকার লাভের মাধ্যমে এ সংগ্রাম নতুন মাত্রা ও বোধের জন্ম দেয়। বাংলাদেশের স্বাধিকার আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলন এবং সর্বোপরি একাত্তরের সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন ভূখণ্ড লাভ, এসব অর্জনের অনুপ্রেরণা ছিল বাহান্নতে জন্ম নেয়া শেকড়সন্ধানী ভাষা ও সংস্কৃতির আন্দোলন।

বহিরাগতদের প্রচেষ্টা আর নিজ ভূমি থেকে জেগে ওঠা কিঞ্চিৎ জাগরণের প্রভাব থেকে আমরা কতটুকু আশা করতে পারি?

বায়ান্নর সূচিত আন্দোলনকে আমরা পরিপূর্ণতা লাভ করতে দেইনি। স্বাধীন বাংলাদেশ অর্জনের পর যে একটি ব্যাপক সাংস্কৃতিক আন্দোলন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আমাদের এগিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন ছিল আমার সে দিকে যেতে পারিনি। পঁচাত্তরের পটপরিবর্তন, এগিয়ে যাওয়ার ক্ষীণ আশাকে দুরাশায় পরিণত করে ফেলে। পঁচাত্তরের পরে দিক ভ্রান্ত হয়ে লক্ষ্যহীন জাতি হিসাবে পথ চলা শুরু করি আমরা। স্বাধীন বাংলাদেশে, বাঙালি জাতির অসম্পূর্ণ নবজাগরণকে সম্পূর্ণ করার যে প্রয়োজন ছিল, শুভশক্তি সম্পন্ন মানুষেরা এর প্রয়োজন অনুভব করেন। ইউরোপে যেমন পূর্ণাঙ্গ নবজাগরণ ঘটেছিল আমাদেরও প্রয়োজন একটি পূর্ণাঙ্গ নবজাগরণের। যে জাগরণ থেকে আমরা বিজ্ঞানবিমুখ, যুক্তিহীন, পশ্চাদপদ, অমানবিক সামাজিক সংস্কার থেকে মুক্তি লাভ করব। যে বদ্ধ জলাশয় থেকে আমরা সাম্প্রদায়িকতার চর্চা করছি, হিংসার সংস্কৃতিকে লালন করছি সে সংস্কৃতি ছিন্ন করে আমাদের ফিরে যেতে হবে শেকড়ে। ফিরে যেতে হবে চণ্ডীদাসের দর্শনে, আবারও সমস্বরে উদাত্ত আহ্বান জানাতে হবে, “শুন হে মানুষ ভাই, সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই”। পারব কী? রবার্ট ফ্রস্টের কবিতার ভাষায়, “বিশ্রামের আগে অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে।”

[লেখক : প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন গবেষক]

বৃহস্পতিবার, ০৪ নভেম্বর ২০২১ , ১৯ কার্তিক ১৪২৮ ২৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৩

চণ্ডীদাসের দর্শন ও বাঙালির অসম্পূর্ণ নবজাগরণ

শেখর ভট্টাচার্য

আমাদের এই বাংলায় কী পরিপূর্ণ রেনেসাঁস বা নবজাগরণ ঘটেছিল? অনেক পুরোনো প্রশ্ন এবং এর বহুমুখী উত্তর আছে। তবে সব আলোচনা শেষে একটি কথা বলা যায় ১৯ শতকে ঘটা নবজাগরণের সঙ্গে পঞ্চদশ শতকে ঘটা ইউরোপীয় নবজাগরণ বা রেনেসাঁসের তুলনা করলে আমাদের নবজাগরণকে পরিপূর্ণ নবজাগরণ বলতে অনেকেরই দ্বিধা আছে। মধ্যযুগের অন্ধকার বিশ্বাস, কুসংস্কারাচ্ছন্ন জীবন আচরণ, জ্ঞান অন্বেষণের প্রথাকে ঝেড়ে ফেলে ইউরোপ যেভাবে জেগে উঠেছিল আমাদের নবজাগরণের ফলে সমাজ সেভাবে সেভাবে জেগে ওঠেনি। ইউরোপের নবজাগরণের ঢেউ এসে ভারতবর্ষ এবং বাংলাতে আছড়ে পড়েছিল কিন্তু তার স্রোত কিংবা ঢেউ ছিল তরঙ্গহীন। রেনেসাঁস মূলত দীর্ঘস্থায়ী একটি সমাজ পরিবর্তনের প্রক্রিয়া। অন্ধ বিশ্বাস, যুক্তিহীনতা থেকে যুক্তিপূর্ণ বিজ্ঞানভিত্তিক চিন্তা চেতনা জাগ্রত হয় ইউরোপীয় সমাজে। যার ঢেউ এসে লাগে সমগ্র বিশ্বের কোণে কোণে। রেনেসাঁস তাই শুধু ইউরোপের ইতিহাসের জন্য একটি বাঁক বদলের ঘটনা নয় এটি বিশ্ব ইতিহাসেরও একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা।

আমাদের রেনেসাঁসের ব্যাপ্তি কতটুকু? রেনেসাঁস নগরভিত্তিক ইংরেজি শিক্ষিত মানুষের মনে যে দোলা দিয়ে গিয়েছিল সমগ্র বাংলায় কি সে দোলার প্রভাব একই পরিমাণ ছিল? ইউরোপের রেনেসাঁস, প্রকৃত অর্থে যেভাবে “নবজাগরণ” ছিল বাংলায় সেটি কোন কোন ক্ষেত্রে কিছু কু-প্রথার বা ধর্মীয় কুসংস্কারের পরিবর্তনের জন্য প্রচেষ্টা ছিল। কিছু কিছু ক্ষেত্রে যেমন বিধবা বিবাহ, সতীদাহ প্রথা, নারী শিক্ষার বিষয়ে দৃশ্যমান কিছু ফল পাওয়া গিয়েছিল। ১৯ শতকের বঙ্গীয় রেনেসাঁকে বাঙালি বিদ্বানেরা পদ্ধতিগতভাবে চারটি পর্বে গড়ে তোলেন। প্রথমত, তারা বাংলা গদ্যভাষা ও নতুন বাংলা সাহিত্য সৃষ্টি করেন। দ্বিতীয়ত, ভারতের স্বর্ণযুগ নামে আখ্যাত ধ্রুপদী যুগের পুনরাবিষ্কার করেন যার সঙ্গে রয়েছে গ্রিস ও রোমের গৌরবময় ঐশ্বর্যের সমতুল্যতা শনাক্তকরণ। তৃতীয়ত, ভারতীয় বিদ্বানেরা নিজেদের ঐতিহাসিক অবস্থার সঙ্গে শ্রীরামপুরের মিশনারিদের দেয়া প্রোটেস্ট্যান্ট রিফর্মেশন সম্পর্কে নতুন ব্যাখ্যার সাদৃশ্য লক্ষ্য করেন। চতুর্থত, বৈশ্বিক প্রগতি সম্পর্কে একটি ধর্মনিরপেক্ষ ধারণায় উপনীত হন যার ওপর নির্ভরশীল ছিল তাদের প্রত্যাশা। সামাজিক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে বাংলার নবজাগরণ ছিল অত্যন্ত দুর্বল ও স্বপ্নহীন একটি প্রচেষ্টা।

আমরা দেখতে পাই সামগ্রিকভাবে বাংলার রেনেসাঁস সমাজের স্থবিরতা বিমোচনে বড় কোন প্রভাব ফেলতে পারেনি। মধ্যবিত্ত ইংরেজি শিক্ষিত মানুষের চিন্তা-চেতনার দরজায় হঠাৎ আলোর ঝলকানির মতো উপস্থিত হয়েছিল নবজাগরণ। আর একটি বিষয়, চিন্তা-চেতনায় ইংরেজি-শিক্ষিত মধ্য ও উচ্চবিত্তের মধ্যে যতটুকু পরিবর্তন নিয়ে এসেছিল নবজাগরণ, সমাজের গভীরে তার ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া এবং ফলাফল লক্ষ্য করা যায়নি। কেন যথেষ্ট দৃশ্যমান পরিবর্তন দেখা যায়নি? তা নিয়ে একটি বিশদ একাডেমিক আলোচনা হতে পারে তবে তা সংবাদপত্রের ক্ষুদ্র পরিসরে নয়। হয়তো দীর্ঘ কোন গবেষণামূলক রচনায়।

ইউরোপের রেনেসাঁস হলো মধ্য যুগ থেকে আধুনিক যুগে উত্তরণ। এই উত্তরণের মধ্য দিয়ে একদিকে মধ্যযুগের বৈশিষ্ট্যসমূহের পরিসমাপ্তি ঘটে অপরদিকে আধুনিক যুগের বৈশিষ্ট্যসমূহ সুস্পষ্ট রূপ লাভ করে। মধ্যযুগের সামাজিক প্রথা, কূপম-ুকতা, ধর্মান্ধতা, রক্ষণশীলতা, স্বৈর মানসিকতা ইত্যাদি মধ্য যুগের স্থবির অবস্থা থেকে বিবেক, যুক্তি, জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চা, উদারতা তথা এক কথায় গতিশীল ধারায় প্রবাহিত হয়। পুরোনো সংস্কার ছিন্ন হয়ে যায়, নতুন জ্ঞান-বিজ্ঞান চিন্তা-চেতনার আলোকে জীবন হয়ে উঠে গতিময়। কোন ধরনের আবদ্ধতা নয়, প্রাণ চাঞ্চল্য হয়ে উঠে জীবনের ধর্ম।

রেনেসাঁস বা নবজাগণের মূল মন্ত্রটিই হলো যুক্তিবাদ। মধ্যযুগের মানুষের মন ও চেতনা আবর্তিত হচ্ছিল বাইবেলকে ঘিরে। বাইবেলে নেই এমন কোন বিষয় সমাজে গৃহীত হতো না। অন্ধত্ব ও গোঁড়ামি ছিল মধ্যযুগীয় চিন্তা, চেতনার মূল বৈশিষ্ট্য। পঞ্চদশ শতকের ইউরোপীয় রেনেসাঁস মানুষের চিন্তা চেতনাকে প্রচলিত গোঁড়ামিপূর্ণ অবস্থান থেকে যুক্তি বাদে উত্তরণ ঘটায়। যুক্তিবাদের মূল কথা, যে কোন বিষয়কে প্রশ্নের মধ্য দিয়ে গ্রহণ করা এবং বিষয়টি সম্পর্কে অনুসন্ধান পরিচালনা করা। এই অনুসন্ধিৎসা ও যুক্তিবাদ মানুষের চিন্তা, চেতনা ও মননলোকে ব্যাপক পরিবর্তন সাধন করায় অগ্রসর চিন্তার দিকে এগিয়ে যেতে নবজাগরণ তাই যুগান্তকারী ভূমিকা রাখে।

রেনেসাঁস পৃথিবীকে বদলে দিয়েছে। রেনেসাঁসের পর শুধু ইউরোপ নয় সমগ্র পৃথিবীতে চিন্তা-চেতনায় বিজ্ঞান মনস্কতার প্রভাব এসে পড়ে। আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশে ধর্মীয় বাতাবরণ এতই শক্তিশালী ছিলো যে তার ফাঁক গলে পরিবর্তনের হাওয়া যতটুকু প্রবেশ করেছিল তা বিচ্ছিন্নভাবে কিছু কিছু বিষয়ে প্রলেপ দিতে সমর্থ হয়েছিল কিন্তু পরিবর্তনের জন্য শেকড় উপড়ে ফেলতে পারেনি। এই উপমহাদেশে যেহেতু নবজাগরণ পরিপূর্ণভাবে ঘটেনি, এই বাংলাতেও সমাজ পরিবর্তনের কোন সামগ্রিক প্রক্রিয়ারও তাই সূচনা ঘটেনি।

১৯ শতকে, বাংলায় রেনেসাঁসের সূচনা হয়েছিল ইংরেজদের হাত ধরে। আধুনিকতার ইতিবাচক বিষয়গুলোর ওপর যেসব ব্রিটিশ কর্মকর্তা প্রভাব বিস্তার করেন, মূলত তারা ছিলেন স্থানীয় সংস্কৃতি সম্পর্কে সচেতন কিছু সরকারি, বিচারবিভাগীয় কর্মকর্তা এবং কিছু মিশনারি। ইতিহাসের পরিভাষায় এদের বলা হয়েছে প্রাচ্যবিদ। প্রাচ্যবিদেরা বাঙালি বিদ্বানদের সঙ্গে দীর্ঘস্থায়ী সম্পর্ক গড়ে তোলেন এবং তাদের কাছে তুলে ধরেন ইউরোপীয় ইতিহাস ও ঐতিহ্য। তারাই মূলত দেশীয় বিদ্বানদের সঙ্গে মিলে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে পরিবর্তন নিয়ে আসার চেষ্টা করেন।

বহিরাগতদের প্রচেষ্টা আর নিজ ভূমি থেকে জেগে ওঠা কিঞ্চিৎ জাগরণের প্রভাব থেকে আমরা কতটুকু আশা করতে পারি? আমাদের নবজাগরণের প্রভাবে তাই সমাজ ও সংস্কৃতিতে ইউরোপের মতো ঝড় ওঠেনি যে ঝড়ে কুসংস্কার, পশ্চাদপদতাকে উপড়ে ফেলার মতো সামাজিক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হবে। তাই প্রশ্ন জাগে, আমাদের পশ্চাতপদতা, হীনমন্যতা, সাম্প্রদায়িকতার সবটুকুই কী তাহলে বাংলাতে এবং ভারতবর্ষে পূর্ণ-নবজাগরণ না ঘটার কারণে সৃষ্ট।

আমাদের মানবতার কবি চণ্ডীদাস ইউরোপীয় রেনেসাঁসের পূর্বে চতুর্দশ শতাব্দীতে সরলভাবে উদাত্ত আহ্বান জানান “শুন হে মানুষ ভাই, সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই”। কী বিস্ময়কর। আমাদের সমাজ ভাবনা দলবদ্ধভাবে না হলেও চতুর্দশ শতাব্দীতে কত উজ্জ্বল কত আধুনিক। ১৯ শতকের নবজাগরণ কেনো যে চতুর্দশ শতকের চণ্ডীদাসের দর্শনকে অনুসরণ করতে পারেনি সে এক অপার বিস্ময়। বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ডে নবজাগরণ ঘটেনি তবে সমাজ ও সংস্কৃতিতে এক ব্যাপক ঝড় তৈরি হয়েছিল। সে ঝড় থেকে নবজাগরণের এক বিপুল সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল। সমাজ, সংস্কৃতির গভীরে সাধারণ মানুষেরা যুক্তি নিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন। প্রশ্ন উদয় হয়েছিল আমরা কে? আমাদের জাতীয়তা কী? আমরা কোন সম্প্রদায়ের উত্তরাধিকার? আমাদের সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য কী? আমাদের জাতীয় মূলনীতি কী হওয়া উচিত? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে অনুসন্ধিৎসা ও যুক্তিবাদের উদ্ভব ঘটে। বাঙালির মননলোকে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটতে দেখা যায়। পূর্ববঙ্গের মানুষের মনোজগতে বিজ্ঞানমুখী আধুনিক চিন্তার উদ্ভব ঘটে। ধর্মনির্ভরতা থেকে ধর্ম নিরপেক্ষতার দিকে মানুষ এগোতে থাকে। বাঙালি আশ্রয় খোঁজে চর্চাযাপদে। সংস্কৃতি চর্চায় শেকড়ের সন্ধান করতে শুরু করে। মানুষের মনোজগতের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক চিন্তার ক্ষেত্রেও আধুনিক মনস্কতা লক্ষ্য করা যায়। ভাষা ও সংস্কৃতির অধিকার আদায়ের জন্য যে আন্দোলনের সূচনা ঘটে মাতৃভাষার অধিকার লাভের মাধ্যমে এ সংগ্রাম নতুন মাত্রা ও বোধের জন্ম দেয়। বাংলাদেশের স্বাধিকার আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলন এবং সর্বোপরি একাত্তরের সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন ভূখণ্ড লাভ, এসব অর্জনের অনুপ্রেরণা ছিল বাহান্নতে জন্ম নেয়া শেকড়সন্ধানী ভাষা ও সংস্কৃতির আন্দোলন।

বহিরাগতদের প্রচেষ্টা আর নিজ ভূমি থেকে জেগে ওঠা কিঞ্চিৎ জাগরণের প্রভাব থেকে আমরা কতটুকু আশা করতে পারি?

বায়ান্নর সূচিত আন্দোলনকে আমরা পরিপূর্ণতা লাভ করতে দেইনি। স্বাধীন বাংলাদেশ অর্জনের পর যে একটি ব্যাপক সাংস্কৃতিক আন্দোলন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আমাদের এগিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন ছিল আমার সে দিকে যেতে পারিনি। পঁচাত্তরের পটপরিবর্তন, এগিয়ে যাওয়ার ক্ষীণ আশাকে দুরাশায় পরিণত করে ফেলে। পঁচাত্তরের পরে দিক ভ্রান্ত হয়ে লক্ষ্যহীন জাতি হিসাবে পথ চলা শুরু করি আমরা। স্বাধীন বাংলাদেশে, বাঙালি জাতির অসম্পূর্ণ নবজাগরণকে সম্পূর্ণ করার যে প্রয়োজন ছিল, শুভশক্তি সম্পন্ন মানুষেরা এর প্রয়োজন অনুভব করেন। ইউরোপে যেমন পূর্ণাঙ্গ নবজাগরণ ঘটেছিল আমাদেরও প্রয়োজন একটি পূর্ণাঙ্গ নবজাগরণের। যে জাগরণ থেকে আমরা বিজ্ঞানবিমুখ, যুক্তিহীন, পশ্চাদপদ, অমানবিক সামাজিক সংস্কার থেকে মুক্তি লাভ করব। যে বদ্ধ জলাশয় থেকে আমরা সাম্প্রদায়িকতার চর্চা করছি, হিংসার সংস্কৃতিকে লালন করছি সে সংস্কৃতি ছিন্ন করে আমাদের ফিরে যেতে হবে শেকড়ে। ফিরে যেতে হবে চণ্ডীদাসের দর্শনে, আবারও সমস্বরে উদাত্ত আহ্বান জানাতে হবে, “শুন হে মানুষ ভাই, সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই”। পারব কী? রবার্ট ফ্রস্টের কবিতার ভাষায়, “বিশ্রামের আগে অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে।”

[লেখক : প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন গবেষক]