নন্দ রানীর বিলাপ, তারা রানীর প্রশ্ন এবং আমাদের ধর্মান্ধতা

মিথুশিলাক মুরমু

১৭ অক্টোবর রংপুর পীরগঞ্জের বড়ো করিমপুর মাঝিপাড়া গ্রামের ২০ থেকে ২৫টি হিন্দু পরিবার ও দোকানপাটে আগুন লাগিয়ে দেয় চিহ্নিত দুর্বৃত্তরা। ঘটনাটি আকস্মিক ঘটেছে বলে মনে হয়নি। পরিতোষ সরকার ইসলাম ধর্মকে অবমাননাকর পোস্ট দিয়েছেন, এমন প্রচারণাও আমাদের কাছে বিশ^াস্য নয়। আমরা আজ পর্যন্ত বিশ্বাস করতে পারেনি কুমিল্লার নানুয়ার দীঘির পাড়ের পূজা ম-পে পবিত্র কোরআন ইকবাল হোসেন রেখেছেন বলে! নিশ্চিন্তে বলা যায়, ইকবলা হোসেনকে ব্যবহার করে ঘোলা জলে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের শিকার করা হয়েছে। কে বা কারা করেছে, হুকুমদাতা বা নীলনকশা প্রণয়নকারীদের মুখোশ ও রহস্য উন্মোচনে প্রশাসন ব্যর্থ হয়েছে। ইতিপূর্বেও যে কয়েকবার ধর্ম অবমাননার উন্মাদনা দেখেছি, ২০১২-তে রামু, ২০১৬ তে নাসিরনগর, ২০২১-তে শাল্লা, কুমিল্লা, রংপুরের পীরগঞ্জসহ অসংখ্য জায়গায় ধর্মান্ধ ও উগ্রবাদিরা ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর বর্বরতম হামলা চালিয়েছে। বরাবরেই বৃহত্তর সম্প্রদায়ের প্রতিবেশী ধর্মান্ধ ব্যক্তিরা আড়ালে-আবডালে কলকাঠি নাড়িয়ে দোষরোপ করা হয়েছে সংখ্যালঘুদের। দেশের সংখ্যালঘুদের বুকের পাটা হয়নি যে, রাষ্ট্রীয় ধর্মের ধর্মগ্রন্থকে অবমাননা করা; ইসলাম ধর্মের ধর্মপ্রাণ মানুষের ধর্মানুভূতিতে আঘাত করা। অতীতেও দেখেছি এবং এখনও আমরা দৃঢ়ভাবে বির্শ্বাস করি, কখনোই ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুরা এরূপ সাহস দেখাতে পারবে না।

আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও এমপি মাহবুব উল আলম হানিফ নিকট সম্প্রতিতে মন্তব্য করেছেন, ‘শিক্ষা ব্যবস্থার কারণে ধর্মপ্রাণের চেয়ে ধর্মান্ধ মানুষ বেশি।’ বিদ্যালয়ে পড়াশোনার সময় শিক্ষাগুরুরা বলতেন-পড়ে বিশ্বাস ও ধারণ করা এবং না পড়ে বিশ্বাস ও ধারণ করার মধ্যে আকাশসম পার্থক্য রয়েছে। এতে ভ্রান্তিটাই জীবনভর বিশ্বাস ও লালন করে চলি। আমাদের নতুন প্রজন্মরা শটকাট বা অল্প অধ্যয়নে ভালো রেজাল্টের প্রচেষ্টা করে, পূর্ণাঙ্গ জানা বা বোঝা নয়। এখানেই ঘাটতিটা থেকে যাচ্ছে-সেটি হোক পাঠ্যপুস্তক কিংবা ধর্মীয় বিষয়াদিতেও। আমার প্রতিবেশী দেশ ভারতের চূঁচুড়াতে এবার পুজোর অষ্টম দিন কুমারী পুজোয় মুসলিম শিশুকন্যাকে (সাহেবা খাতুন) কুমারীরূপে পুজো করা হলো চূঁচুড়া ঝিঙেপাড়ার সারদা রামকৃষ্ণ সেবাশ্রমে। মঠের মহারাজ বলেছেন, ‘আমরা রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের মতে পুজো করি, তাই ধর্মের বিভেদ করি না।’ আবার হুগলির আরামবাগ মহকুমা এলাকায় দুর্গাপূজার প্রাক্কালে সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী এই তিন দিন মুসলিম সম্প্রদায়ের নামাজের পর শুরু হয় সন্ধ্যা আরতি। এই রীতিটি কমপক্ষে ৩৫০ পূর্ব থেকে চলে এসেছে, সংখ্যাগুরু হিন্দু সম্প্রদায়ের উদারতায় সংখ্যালঘু মুসলিমরা আনন্দিত এবং পারস্পরিক ভ্রাতৃত্বের বন্ধন অটুট রয়েছে। মূলত বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে সব সময়ই অগ্রগণ্য ভূমিকা নিতে হবে; সংখ্যালঘুরা এতে নিরাপদ ও নিরাপত্তা অনুভব করবে।

ধর্মান্ধ গোষ্ঠীরা রংপুরের ধর্মীয় সংখ্যালঘু হিন্দুপাড়া আক্রমণ করলে নন্দ রানীর বিলাপ বিশ^বাসীর বিবেককে নাড়া দিয়েছে। অগ্নিদগ্ধ ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন টিনের ঘরে সামনে নির্বাক নন্দ রানীর চোখের জল নেই ঠিকই কিন্তু হৃদয়গ্রাহী বিলাপ করে চলেছেন। ক্রন্দন, ডুকরে ডুকরে কান্না, এরপরই বিলাপ। ঘর ভেঙেছে, মন ভেঙেছে, হৃদয় ভেঙেছে; জীবনের চারিদিকে শুধুই হাহাকার; চেনা প্রতিবেশী অপরিচিত হয়েছে, হিন্দু হওয়ার অপরাধ, নারী হওয়ার অসহায়ত্ব, সবকিছুই মিলেই একজন নারী বিলাপ করেছেন। একজনের অপরাধে নিরাপরাধ নারী-পুরুষ, শিশু সন্তানরা অসহায় হয়ে জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ে, দিক-বিদিক প্রোতাশ্রয়ের খোঁজে দৌড়াদৌড়িতে ক্লান্ত এরূপ পরিস্থিতিকে উপলব্ধি করতে হয়। হৃদয় ভাঙলে কখনো জোড়া লাগে না, বিশ্বাস হারালে বিশ্বাস জন্মানো বড়ই শঙ্কাপূর্ণ। ঘর পোড়া গরু যেমন সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পায়, দেশের ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর আলাম্ফনে নিজেদের মানুষ ভাবতে পারি না। বোধকরি, একজন সংখ্যালঘুই অপর সংখ্যালঘুর মনোব্যথা, কষ্ট, হতাশা, উদ্বিগ্নতাকে রন্ধ্রে রন্ধ্রে অনুভব করতে সমর্থ হয়। আমার অগ্রজ সংখ্যালঘু প্রবীণ ব্যক্তি অনুনয়ের সুরে বলেছেন, পুনর্জন্ম যদি থেকেই থাকে-তাহলে ভগবানের কাছে প্রার্থনা জানাবো যেন পুনর্জন্মে সংখ্যালঘু হিসেবে প্রেরণ না করেন।

রংপুরের আরেক নারী তারা রানী ভগবানকে প্রশ্ন করেছেন, ‘ভগবান, আমরা কী দোষ করছিলাম? কেন আমাদের সব শেষ করে দিল? এখন আমরা কোথায় থাকব, কী করব, কী খাব?’ স্রষ্টার সৃষ্টি মানুষ হিসেবে প্রত্যেকেই চিন্তা করবে থাকা, খাওয়া ইত্যাদি বিষয়ে কিন্তু অপরাধ, অন্যায় বা পাপটা কিসের! স্বভাবতই প্রশ্ন আসবে-তারা রানী তো কারো পাকা ধানে মই দেইনি; বাড়া ভাতে ছাই দেয়নি। সে তো অন্য ১০ জনের মতোই জীবনযাপন করতে চেয়েছেন। সংসার ধর্ম পালন করে স্বামী-সন্তান, আত্মীয়-স্বজন নিয়ে সুখের প্রত্যাশা করেছেন! তাহলে কী তার দোষ হিন্দু হওয়া, মন্দিরে পুজো দেয়া, সময়ে সময়ে উলুধ্বনি দেয়া! নাকি ধর্মান্ধ ব্যক্তিদের পছন্দনুযায়ী কোনো প্রার্থীকে ভোটদান থেকে বিরত থাকা! ভগবানই জানেন, কারণ তিনি তো ঊর্ধ্বে থাকেন, ঊর্ধ্ব থেকে সবকিছুই স্বচ্ছ দেখা যায়। শাস্ত্র বলে ‘ঈশ^র মানুষ্যকে সরল করিয়া নির্মাণ করিয়াছিলেন, কিন্তু তাহারা অনেক কল্পনার অন্বেষণ করিয়া লইয়াছে।’ আল্লাহ, ভগবান, ঈশ্বরের বিধি-ব্যবস্থা, নিয়ম-কানুনগুলোকে উপেক্ষা করে আমরা মানুষ জড়িয়ে পড়েছি হানাহানিতে, হত্যাযজ্ঞে এবং একে-অপরকে ক্ষতি সাধনে।

জাতিকে শিক্ষার আলোয় আলোকিত করতে না পারলে ধর্মান্ধতা সৃষ্টি হবে, সেটাই স্বাভাবিক এবং সেটাই হয়ে আসছে। আওয়ামী লীগের প্রাজ্ঞ ব্যক্তি হানিফ বলেছেন, ‘ভারত-বাংলাদেশসহ সর্বত্রই সাম্প্রদায়িক সংঘাতের মূল কারণ ছিল রাজনীতি। রাজনৈতিক কারণে এখনও ধর্মকে ব্যবহার করা হচ্ছে। সাম্প্রদায়িকতার আরেকটা বড় কারণ লোকসংস্কৃতির চর্চা কমে যাওয়া। এর জায়গা দখল করে নিয়েছে ওয়াজ মাহফিল। আরেকটি বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ফেসবুক বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। এসব মাধ্যমে বিভিন্ন পোস্টের কারণে দেশে উত্তেজনা ও সংঘর্ষ তৈরি হচ্ছে। মানুষের ন্যায়নীতি, সততা ও ন্যূনতম মূল্যবোধ থেকে দূরে সরে যাওয়াও সাম্প্রদায়িকতার অন্যতম কারণ।’ প্রয়োজন শিক্ষা ব্যবস্থায় আমুল পরিবর্তন, সম্প্রীতি, সৌহার্দ্য ও ভ্রাতৃত্ববোধ সম্পন্ন বইয়ের সমাহার বাড়ানো। বই এক আশ্চর্য জিনিস। বই আমাদের চিন্তা ভাবনাকে উন্নত করে। আমাদের হাসায়, কখনও কাঁদায়। বই পড়ুন। ভালো লাগলে যত্ন করে তুলে রাখুন ভবিষ্যতে পড়ার জন্য। চাইলে কোনো লাইব্রেরিতেও দান করে দিতে পারেন। আরও অনেক লোক পড়তে পারবে। শুধু একটা ব্যাপার মাথায় রাখতে হবে। এই পৃথিবীতে মানুষই কেবল পড়ে। মাটির মূর্তি বই পড়ে না। তাই মূর্তির কোলে বই না রেখে নিজেরা একটু বই পড়ুন। একটু-আধটু বই পড়া অভ্যেস হয়ে গেলে দেখবেন, প্রতিমা, মণ্ডপ, মন্দির, গির্জা, মসজিদ সহনাগরিকদের বিশ্বাস বা দেশের মেরুদণ্ড কিছুই আর ভাঙতে ইচ্ছে করছে না। বিশ্বাস করুন, বই এক আশ্চর্য জিনিস। কবি লিখেছেন- ‘... কিন্তু ধর্ম দিও না আমায়,/ না হিন্দু, না মুসলিম,/ না বৌদ্ধ, না খ্রিস্টান/ না পার্সি, না শিখ

কিছুই দিওনা আমায়।/ তাহলে আর মানুষ থাকবো না, /কথা দিলাম।’

বৃহস্পতিবার, ০৪ নভেম্বর ২০২১ , ১৯ কার্তিক ১৪২৮ ২৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৩

নন্দ রানীর বিলাপ, তারা রানীর প্রশ্ন এবং আমাদের ধর্মান্ধতা

মিথুশিলাক মুরমু

১৭ অক্টোবর রংপুর পীরগঞ্জের বড়ো করিমপুর মাঝিপাড়া গ্রামের ২০ থেকে ২৫টি হিন্দু পরিবার ও দোকানপাটে আগুন লাগিয়ে দেয় চিহ্নিত দুর্বৃত্তরা। ঘটনাটি আকস্মিক ঘটেছে বলে মনে হয়নি। পরিতোষ সরকার ইসলাম ধর্মকে অবমাননাকর পোস্ট দিয়েছেন, এমন প্রচারণাও আমাদের কাছে বিশ^াস্য নয়। আমরা আজ পর্যন্ত বিশ্বাস করতে পারেনি কুমিল্লার নানুয়ার দীঘির পাড়ের পূজা ম-পে পবিত্র কোরআন ইকবাল হোসেন রেখেছেন বলে! নিশ্চিন্তে বলা যায়, ইকবলা হোসেনকে ব্যবহার করে ঘোলা জলে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের শিকার করা হয়েছে। কে বা কারা করেছে, হুকুমদাতা বা নীলনকশা প্রণয়নকারীদের মুখোশ ও রহস্য উন্মোচনে প্রশাসন ব্যর্থ হয়েছে। ইতিপূর্বেও যে কয়েকবার ধর্ম অবমাননার উন্মাদনা দেখেছি, ২০১২-তে রামু, ২০১৬ তে নাসিরনগর, ২০২১-তে শাল্লা, কুমিল্লা, রংপুরের পীরগঞ্জসহ অসংখ্য জায়গায় ধর্মান্ধ ও উগ্রবাদিরা ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর বর্বরতম হামলা চালিয়েছে। বরাবরেই বৃহত্তর সম্প্রদায়ের প্রতিবেশী ধর্মান্ধ ব্যক্তিরা আড়ালে-আবডালে কলকাঠি নাড়িয়ে দোষরোপ করা হয়েছে সংখ্যালঘুদের। দেশের সংখ্যালঘুদের বুকের পাটা হয়নি যে, রাষ্ট্রীয় ধর্মের ধর্মগ্রন্থকে অবমাননা করা; ইসলাম ধর্মের ধর্মপ্রাণ মানুষের ধর্মানুভূতিতে আঘাত করা। অতীতেও দেখেছি এবং এখনও আমরা দৃঢ়ভাবে বির্শ্বাস করি, কখনোই ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুরা এরূপ সাহস দেখাতে পারবে না।

আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও এমপি মাহবুব উল আলম হানিফ নিকট সম্প্রতিতে মন্তব্য করেছেন, ‘শিক্ষা ব্যবস্থার কারণে ধর্মপ্রাণের চেয়ে ধর্মান্ধ মানুষ বেশি।’ বিদ্যালয়ে পড়াশোনার সময় শিক্ষাগুরুরা বলতেন-পড়ে বিশ্বাস ও ধারণ করা এবং না পড়ে বিশ্বাস ও ধারণ করার মধ্যে আকাশসম পার্থক্য রয়েছে। এতে ভ্রান্তিটাই জীবনভর বিশ্বাস ও লালন করে চলি। আমাদের নতুন প্রজন্মরা শটকাট বা অল্প অধ্যয়নে ভালো রেজাল্টের প্রচেষ্টা করে, পূর্ণাঙ্গ জানা বা বোঝা নয়। এখানেই ঘাটতিটা থেকে যাচ্ছে-সেটি হোক পাঠ্যপুস্তক কিংবা ধর্মীয় বিষয়াদিতেও। আমার প্রতিবেশী দেশ ভারতের চূঁচুড়াতে এবার পুজোর অষ্টম দিন কুমারী পুজোয় মুসলিম শিশুকন্যাকে (সাহেবা খাতুন) কুমারীরূপে পুজো করা হলো চূঁচুড়া ঝিঙেপাড়ার সারদা রামকৃষ্ণ সেবাশ্রমে। মঠের মহারাজ বলেছেন, ‘আমরা রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের মতে পুজো করি, তাই ধর্মের বিভেদ করি না।’ আবার হুগলির আরামবাগ মহকুমা এলাকায় দুর্গাপূজার প্রাক্কালে সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী এই তিন দিন মুসলিম সম্প্রদায়ের নামাজের পর শুরু হয় সন্ধ্যা আরতি। এই রীতিটি কমপক্ষে ৩৫০ পূর্ব থেকে চলে এসেছে, সংখ্যাগুরু হিন্দু সম্প্রদায়ের উদারতায় সংখ্যালঘু মুসলিমরা আনন্দিত এবং পারস্পরিক ভ্রাতৃত্বের বন্ধন অটুট রয়েছে। মূলত বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে সব সময়ই অগ্রগণ্য ভূমিকা নিতে হবে; সংখ্যালঘুরা এতে নিরাপদ ও নিরাপত্তা অনুভব করবে।

ধর্মান্ধ গোষ্ঠীরা রংপুরের ধর্মীয় সংখ্যালঘু হিন্দুপাড়া আক্রমণ করলে নন্দ রানীর বিলাপ বিশ^বাসীর বিবেককে নাড়া দিয়েছে। অগ্নিদগ্ধ ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন টিনের ঘরে সামনে নির্বাক নন্দ রানীর চোখের জল নেই ঠিকই কিন্তু হৃদয়গ্রাহী বিলাপ করে চলেছেন। ক্রন্দন, ডুকরে ডুকরে কান্না, এরপরই বিলাপ। ঘর ভেঙেছে, মন ভেঙেছে, হৃদয় ভেঙেছে; জীবনের চারিদিকে শুধুই হাহাকার; চেনা প্রতিবেশী অপরিচিত হয়েছে, হিন্দু হওয়ার অপরাধ, নারী হওয়ার অসহায়ত্ব, সবকিছুই মিলেই একজন নারী বিলাপ করেছেন। একজনের অপরাধে নিরাপরাধ নারী-পুরুষ, শিশু সন্তানরা অসহায় হয়ে জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ে, দিক-বিদিক প্রোতাশ্রয়ের খোঁজে দৌড়াদৌড়িতে ক্লান্ত এরূপ পরিস্থিতিকে উপলব্ধি করতে হয়। হৃদয় ভাঙলে কখনো জোড়া লাগে না, বিশ্বাস হারালে বিশ্বাস জন্মানো বড়ই শঙ্কাপূর্ণ। ঘর পোড়া গরু যেমন সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পায়, দেশের ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর আলাম্ফনে নিজেদের মানুষ ভাবতে পারি না। বোধকরি, একজন সংখ্যালঘুই অপর সংখ্যালঘুর মনোব্যথা, কষ্ট, হতাশা, উদ্বিগ্নতাকে রন্ধ্রে রন্ধ্রে অনুভব করতে সমর্থ হয়। আমার অগ্রজ সংখ্যালঘু প্রবীণ ব্যক্তি অনুনয়ের সুরে বলেছেন, পুনর্জন্ম যদি থেকেই থাকে-তাহলে ভগবানের কাছে প্রার্থনা জানাবো যেন পুনর্জন্মে সংখ্যালঘু হিসেবে প্রেরণ না করেন।

রংপুরের আরেক নারী তারা রানী ভগবানকে প্রশ্ন করেছেন, ‘ভগবান, আমরা কী দোষ করছিলাম? কেন আমাদের সব শেষ করে দিল? এখন আমরা কোথায় থাকব, কী করব, কী খাব?’ স্রষ্টার সৃষ্টি মানুষ হিসেবে প্রত্যেকেই চিন্তা করবে থাকা, খাওয়া ইত্যাদি বিষয়ে কিন্তু অপরাধ, অন্যায় বা পাপটা কিসের! স্বভাবতই প্রশ্ন আসবে-তারা রানী তো কারো পাকা ধানে মই দেইনি; বাড়া ভাতে ছাই দেয়নি। সে তো অন্য ১০ জনের মতোই জীবনযাপন করতে চেয়েছেন। সংসার ধর্ম পালন করে স্বামী-সন্তান, আত্মীয়-স্বজন নিয়ে সুখের প্রত্যাশা করেছেন! তাহলে কী তার দোষ হিন্দু হওয়া, মন্দিরে পুজো দেয়া, সময়ে সময়ে উলুধ্বনি দেয়া! নাকি ধর্মান্ধ ব্যক্তিদের পছন্দনুযায়ী কোনো প্রার্থীকে ভোটদান থেকে বিরত থাকা! ভগবানই জানেন, কারণ তিনি তো ঊর্ধ্বে থাকেন, ঊর্ধ্ব থেকে সবকিছুই স্বচ্ছ দেখা যায়। শাস্ত্র বলে ‘ঈশ^র মানুষ্যকে সরল করিয়া নির্মাণ করিয়াছিলেন, কিন্তু তাহারা অনেক কল্পনার অন্বেষণ করিয়া লইয়াছে।’ আল্লাহ, ভগবান, ঈশ্বরের বিধি-ব্যবস্থা, নিয়ম-কানুনগুলোকে উপেক্ষা করে আমরা মানুষ জড়িয়ে পড়েছি হানাহানিতে, হত্যাযজ্ঞে এবং একে-অপরকে ক্ষতি সাধনে।

জাতিকে শিক্ষার আলোয় আলোকিত করতে না পারলে ধর্মান্ধতা সৃষ্টি হবে, সেটাই স্বাভাবিক এবং সেটাই হয়ে আসছে। আওয়ামী লীগের প্রাজ্ঞ ব্যক্তি হানিফ বলেছেন, ‘ভারত-বাংলাদেশসহ সর্বত্রই সাম্প্রদায়িক সংঘাতের মূল কারণ ছিল রাজনীতি। রাজনৈতিক কারণে এখনও ধর্মকে ব্যবহার করা হচ্ছে। সাম্প্রদায়িকতার আরেকটা বড় কারণ লোকসংস্কৃতির চর্চা কমে যাওয়া। এর জায়গা দখল করে নিয়েছে ওয়াজ মাহফিল। আরেকটি বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ফেসবুক বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। এসব মাধ্যমে বিভিন্ন পোস্টের কারণে দেশে উত্তেজনা ও সংঘর্ষ তৈরি হচ্ছে। মানুষের ন্যায়নীতি, সততা ও ন্যূনতম মূল্যবোধ থেকে দূরে সরে যাওয়াও সাম্প্রদায়িকতার অন্যতম কারণ।’ প্রয়োজন শিক্ষা ব্যবস্থায় আমুল পরিবর্তন, সম্প্রীতি, সৌহার্দ্য ও ভ্রাতৃত্ববোধ সম্পন্ন বইয়ের সমাহার বাড়ানো। বই এক আশ্চর্য জিনিস। বই আমাদের চিন্তা ভাবনাকে উন্নত করে। আমাদের হাসায়, কখনও কাঁদায়। বই পড়ুন। ভালো লাগলে যত্ন করে তুলে রাখুন ভবিষ্যতে পড়ার জন্য। চাইলে কোনো লাইব্রেরিতেও দান করে দিতে পারেন। আরও অনেক লোক পড়তে পারবে। শুধু একটা ব্যাপার মাথায় রাখতে হবে। এই পৃথিবীতে মানুষই কেবল পড়ে। মাটির মূর্তি বই পড়ে না। তাই মূর্তির কোলে বই না রেখে নিজেরা একটু বই পড়ুন। একটু-আধটু বই পড়া অভ্যেস হয়ে গেলে দেখবেন, প্রতিমা, মণ্ডপ, মন্দির, গির্জা, মসজিদ সহনাগরিকদের বিশ্বাস বা দেশের মেরুদণ্ড কিছুই আর ভাঙতে ইচ্ছে করছে না। বিশ্বাস করুন, বই এক আশ্চর্য জিনিস। কবি লিখেছেন- ‘... কিন্তু ধর্ম দিও না আমায়,/ না হিন্দু, না মুসলিম,/ না বৌদ্ধ, না খ্রিস্টান/ না পার্সি, না শিখ

কিছুই দিওনা আমায়।/ তাহলে আর মানুষ থাকবো না, /কথা দিলাম।’