স্মরণ : বিপ্লবী রণেশ দাশগুপ্ত

মাহবুবর রহমান চৌধুরী

৪ নভেম্বর ২০২১, বিপ্লবী রাজনীতিক, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব রণেশ দাশগুপ্তের ২৪তম প্রয়াণ দিবস। এই প্রয়াণ দিবসে সাত্বিক বিপ্লবী রণেশ দাশগুপ্তের স্মৃতির প্রতি প্রনতি নিবেদন করছি। শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি এ বিপ্লবীকে। বিগত শতকে যে কজন বাঙালি মনীষী তাদের ত্যাগ-তিতিক্ষা ও মনস্বিতা দিয়ে বাংলার এই ভূখণ্ডে রাজনীতি ও সাহিত্য-সাংস্কৃতিক অঙ্গনে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন তাদের অন্যতম বিপ্লবী রণেশ দাশগুপ্ত। শোষিত, বঞ্চিত, অধিকার হারা মানুষের মুক্তির সংগ্রামের লড়াকু সৈনিক আজীবন বিপ্লবী রণেশ দাশগুপ্তের জীবনাদর্শ ছিল মানব মুক্তির সংগ্রামে নিজকে সম্পূর্ণ নিবেদিত করা। তার রাজনীতি, সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার মূল কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল শোষিত, নিপীড়িত, বঞ্চিত অধিকার হারা মানুষ। মানব মুক্তির দর্শনকে তিনি অঙ্গীকার করেছিলেন তাঁর সর্ব কর্মে।

রণেশ দাশগুপ্তের জন্ম ১৫ জানুয়ারি ১৯১২, প্রয়াণ ৪ নভেম্বর ১৯৯৭। তার পিতৃভূমি ছিল মুন্সীগঞ্জ জেলার লৌহজং থানার গাউদিয়া গ্রাম। শিক্ষা জীবন কেটেছে রাঁচী, বাঁকুড়া ও বরিশালে। রণেশ দাশগুপ্ত রাঁচী জেলায় স্কুল থেকে ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে ম্যাট্রিক পাস করেন। রাঁচী ছিল পিতা অপূর্বরত্ন দাশগুপ্তের কর্মস্থল। ছাত্রজীবন থেকেই ব্রিটিশবিরোধী স্বদেশী আন্দোলনে তিনি নিজেকে যুক্ত করেন। বাঁকুড়া কলেজে অধ্যয়নকালে ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে রণেশ দাশগুপ্তের নেতৃত্বে তিনজন ছাত্র ভারতীয় পতাকা উত্তোলন করেন। এ কারণে তাকে কলেজ থেকে বহিষ্কার করা হয়। পরবর্তী অধ্যয়নস্থল বরিশাল ব্রজমোহন কলেজ। বরিশালে তার আবাসস্থল ছিল জেঠু সত্যানন্দ দাশের বাড়িতে। সত্যানন্দ দাশ বাংলার বিখ্যাত কবি জীবনানন্দ দাশের বাবা। কবি জীবনান্দ দাশ রণেশ দাশগুপ্তের জেঠতুতো দাদা। ১৯৩৮ সালে রণেশ দাশগুপ্ত ও অচ্যুৎ গোস্বামীর যৌথ সম্পাদনায় বের হয় ‘ক্রান্তি’ নামে সংকলন। প্রগতিশীল সাহিত্য চর্চার মুখপত্র হিসাবে এ পত্রিকা পরবর্তীতেও প্রকাশিত হতে থাকে এবং সাহিত্যাঙ্গনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। প্রগতি লেখক সংঘে যুক্ত হন সত্যেন সেন, মুনীর চৌধুরী, সরদার ফজলুল করিম প্রমুখ।

১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার পর ভাষা আন্দোলনে অংশ নেয়ার কারণেও বৈপ্লবিক রাজনীতিতে সংযুক্তির কারণে তাকে বারবার কারাবরণ করতে হয়। পাকিস্তানি শাসনামলে এক যুগেরও বেশি সময় তিনি কারাগারে কাটান।

১৯৫৫ সালে জেল থেকে মুক্তিলাভের পর তিনি ‘সংবাদ’-এ যোগ দেন। এটিই ছিল তার দীর্ঘদিনের কর্মস্থল। ১৯৫৮ সালে মুসলিম লীগ প্রার্থীকে পরাজিত করে কমিউনিস্ট পার্টির প্রার্থী হিসেবে ঢাকা মিউনিসিপ্যালিটির কমিশনার নির্বাচিত হন রণেশ দাশগুপ্ত।

রণেশ দাশগুপ্তের রচিত বইগুলোর মধ্যে-উপন্যাসের শিল্পরূপ, আয়ত দৃষ্টিতে আয়তরূপ, আলো দিয়ে আলো জ্বালা, রহমান মাস্টার ও অন্যান্য, সাম্যবাদী উত্থান প্রথ্যাশা, আত্মজিজ্ঞাসা, কখনো চম্পা কখনো অতসী প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। ল্যাটিন আমেরিকার মুক্তিসংগ্রাম তার রচিত একটি কালোত্তীর্ণ গ্রন্থ। তিনি কারাবাসকালে উর্দু শেখেন, চর্চা করেন। পাকিস্তানি প্রগতিশীল লেখক ফয়েজ আহমদ ফয়েজের উর্দু কাব্যগ্রন্থ তিনি বাঙলায় অনুবাদ করেন।

বিপ্লবী রণেশ দাশগুপ্ত জীবনের অন্তিমলগ্নে স্বদেশে ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মানুষের সামূহিক বিপর্যয় দেখেছেন, আদর্শিক ভাঙনের ধ্বনি শুনেছেন। স্বদেশে ধর্মান্ধতার বীভৎসতা, পুঁজিবাদের নির্মমতা প্রত্যক্ষ করেছেন। রাষ্ট্রীয় আদর্শ চতুষ্টয়-জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের ধ্বংস অবস্থা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন। কিন্তু এসব বিপর্যয়কে তিনি চিরকালীন সত্য বলে মানেননি। তার আশাবাদের উৎস শ্রমজীবী মানুষের মুক্তির স্বপ্ন এবং এ দেশের মানুষের লোকায়ত সংস্কৃতি খাতে আছে শাশ্বত প্রাণ প্রবাহ, জেগে ওঠার সঞ্জিবনী মন্ত্র। তাই তার প্রত্যয় দৃঢ় উচ্চারণ-‘আমি জনতায় বিশ্বাস করি। দেশ নির্বিশেষে জনতার মহৎ স্বপ্নের কোন মৃত্যু নেই, এদেশে এখনও সূর্য ওঠে, পাখি ডাকে, ফুল ফোটে তাই হতাশ হওয়ার কিছু নেই।’

বৃহস্পতিবার, ০৪ নভেম্বর ২০২১ , ১৯ কার্তিক ১৪২৮ ২৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৩

স্মরণ : বিপ্লবী রণেশ দাশগুপ্ত

মাহবুবর রহমান চৌধুরী

image

৪ নভেম্বর ২০২১, বিপ্লবী রাজনীতিক, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব রণেশ দাশগুপ্তের ২৪তম প্রয়াণ দিবস। এই প্রয়াণ দিবসে সাত্বিক বিপ্লবী রণেশ দাশগুপ্তের স্মৃতির প্রতি প্রনতি নিবেদন করছি। শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি এ বিপ্লবীকে। বিগত শতকে যে কজন বাঙালি মনীষী তাদের ত্যাগ-তিতিক্ষা ও মনস্বিতা দিয়ে বাংলার এই ভূখণ্ডে রাজনীতি ও সাহিত্য-সাংস্কৃতিক অঙ্গনে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন তাদের অন্যতম বিপ্লবী রণেশ দাশগুপ্ত। শোষিত, বঞ্চিত, অধিকার হারা মানুষের মুক্তির সংগ্রামের লড়াকু সৈনিক আজীবন বিপ্লবী রণেশ দাশগুপ্তের জীবনাদর্শ ছিল মানব মুক্তির সংগ্রামে নিজকে সম্পূর্ণ নিবেদিত করা। তার রাজনীতি, সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার মূল কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল শোষিত, নিপীড়িত, বঞ্চিত অধিকার হারা মানুষ। মানব মুক্তির দর্শনকে তিনি অঙ্গীকার করেছিলেন তাঁর সর্ব কর্মে।

রণেশ দাশগুপ্তের জন্ম ১৫ জানুয়ারি ১৯১২, প্রয়াণ ৪ নভেম্বর ১৯৯৭। তার পিতৃভূমি ছিল মুন্সীগঞ্জ জেলার লৌহজং থানার গাউদিয়া গ্রাম। শিক্ষা জীবন কেটেছে রাঁচী, বাঁকুড়া ও বরিশালে। রণেশ দাশগুপ্ত রাঁচী জেলায় স্কুল থেকে ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে ম্যাট্রিক পাস করেন। রাঁচী ছিল পিতা অপূর্বরত্ন দাশগুপ্তের কর্মস্থল। ছাত্রজীবন থেকেই ব্রিটিশবিরোধী স্বদেশী আন্দোলনে তিনি নিজেকে যুক্ত করেন। বাঁকুড়া কলেজে অধ্যয়নকালে ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে রণেশ দাশগুপ্তের নেতৃত্বে তিনজন ছাত্র ভারতীয় পতাকা উত্তোলন করেন। এ কারণে তাকে কলেজ থেকে বহিষ্কার করা হয়। পরবর্তী অধ্যয়নস্থল বরিশাল ব্রজমোহন কলেজ। বরিশালে তার আবাসস্থল ছিল জেঠু সত্যানন্দ দাশের বাড়িতে। সত্যানন্দ দাশ বাংলার বিখ্যাত কবি জীবনানন্দ দাশের বাবা। কবি জীবনান্দ দাশ রণেশ দাশগুপ্তের জেঠতুতো দাদা। ১৯৩৮ সালে রণেশ দাশগুপ্ত ও অচ্যুৎ গোস্বামীর যৌথ সম্পাদনায় বের হয় ‘ক্রান্তি’ নামে সংকলন। প্রগতিশীল সাহিত্য চর্চার মুখপত্র হিসাবে এ পত্রিকা পরবর্তীতেও প্রকাশিত হতে থাকে এবং সাহিত্যাঙ্গনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। প্রগতি লেখক সংঘে যুক্ত হন সত্যেন সেন, মুনীর চৌধুরী, সরদার ফজলুল করিম প্রমুখ।

১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার পর ভাষা আন্দোলনে অংশ নেয়ার কারণেও বৈপ্লবিক রাজনীতিতে সংযুক্তির কারণে তাকে বারবার কারাবরণ করতে হয়। পাকিস্তানি শাসনামলে এক যুগেরও বেশি সময় তিনি কারাগারে কাটান।

১৯৫৫ সালে জেল থেকে মুক্তিলাভের পর তিনি ‘সংবাদ’-এ যোগ দেন। এটিই ছিল তার দীর্ঘদিনের কর্মস্থল। ১৯৫৮ সালে মুসলিম লীগ প্রার্থীকে পরাজিত করে কমিউনিস্ট পার্টির প্রার্থী হিসেবে ঢাকা মিউনিসিপ্যালিটির কমিশনার নির্বাচিত হন রণেশ দাশগুপ্ত।

রণেশ দাশগুপ্তের রচিত বইগুলোর মধ্যে-উপন্যাসের শিল্পরূপ, আয়ত দৃষ্টিতে আয়তরূপ, আলো দিয়ে আলো জ্বালা, রহমান মাস্টার ও অন্যান্য, সাম্যবাদী উত্থান প্রথ্যাশা, আত্মজিজ্ঞাসা, কখনো চম্পা কখনো অতসী প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। ল্যাটিন আমেরিকার মুক্তিসংগ্রাম তার রচিত একটি কালোত্তীর্ণ গ্রন্থ। তিনি কারাবাসকালে উর্দু শেখেন, চর্চা করেন। পাকিস্তানি প্রগতিশীল লেখক ফয়েজ আহমদ ফয়েজের উর্দু কাব্যগ্রন্থ তিনি বাঙলায় অনুবাদ করেন।

বিপ্লবী রণেশ দাশগুপ্ত জীবনের অন্তিমলগ্নে স্বদেশে ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মানুষের সামূহিক বিপর্যয় দেখেছেন, আদর্শিক ভাঙনের ধ্বনি শুনেছেন। স্বদেশে ধর্মান্ধতার বীভৎসতা, পুঁজিবাদের নির্মমতা প্রত্যক্ষ করেছেন। রাষ্ট্রীয় আদর্শ চতুষ্টয়-জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের ধ্বংস অবস্থা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন। কিন্তু এসব বিপর্যয়কে তিনি চিরকালীন সত্য বলে মানেননি। তার আশাবাদের উৎস শ্রমজীবী মানুষের মুক্তির স্বপ্ন এবং এ দেশের মানুষের লোকায়ত সংস্কৃতি খাতে আছে শাশ্বত প্রাণ প্রবাহ, জেগে ওঠার সঞ্জিবনী মন্ত্র। তাই তার প্রত্যয় দৃঢ় উচ্চারণ-‘আমি জনতায় বিশ্বাস করি। দেশ নির্বিশেষে জনতার মহৎ স্বপ্নের কোন মৃত্যু নেই, এদেশে এখনও সূর্য ওঠে, পাখি ডাকে, ফুল ফোটে তাই হতাশ হওয়ার কিছু নেই।’